০৩. নীলুদের বাড়ি

বহু খোঁজাখুঁজি করেও মিসির আলি নীলুদের বাড়ি বের করতে পারলেন না। তাঁর কাছে কোনো ঠিকানা নেই। তিনি ইচ্ছা করেই ঠিকানা রাখেন নি। না-রাখাটা বোকামি হয়েছে। কাঁঠালবাগানের যে-অঞ্চলে লাল রঙের দোতলা বাড়ি থাকার কথা, সেখানে লাল রঙের কোনো বাড়িই নেই।

কয়েকটি পান-বিড়ির দোকানদারকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন–লাল রঙের দোতলা বাড়ি, ভেতরে ফুলের বাগান আছে। ওরা যখন শুনল, তিনি ঠিকানা জানেন না এবং বাড়ির মালিকের নামও জানেন না, তখন খুবই অবাক হয়ে গেল।

‘ঢাকা শহরে ঠিকানা দিয়াও বাড়ি পাওন যায় না, আফনে আইছেন ঠিকানা ছাড়া! কেমুন লোক আফনে।’

মিসির আলির নিজেরও মনে হল, কাজটা বুদ্ধিমানের মতো হয় নি। স্মৃতির উপর বিশ্বাস করতে নেই। স্মৃতি হচ্ছে প্রতারক। নানানভাবে সে মানুষকে প্রতারণা করে।

অন্য কোনো মানুষ হলে এতক্ষণ খোঁজাখুঁজি বন্ধ করে বাড়ি চলে যেত। কিন্তু তিনি ভিন্ন ধরনের মানুষ। কোনো-একটি বিষয় শেষ না দেখে তিনি ছাড়েন না। কাজেই সকাল দশটার সময় তাঁকে দেখা গেল একটা রিকশা ঠিক করতে। ঘন্টা হিসাবে চুক্তি। এক ঘন্টা সে মিসির আলিকে নিয়ে কাঁঠালবাগানের বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরবে। তিনি বাড়ি বের করতে চেষ্টা করবেন।

মিসির আলির কোলে রসমালাইয়ের একটা হাঁড়ি। কি মনে করে যেন তিনি এক সের রসমালাই কিনে ফেলেছেন। ছাত্রীর বাড়িতে খালি হাতে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু এখন মিষ্টির হাঁড়িটা একটা উপদ্রবের মতো লাগছে। মিসির আলির কেন যেন মনে হচ্ছে, যে-কোনো মুহূর্তে হাঁড়ি ভেঙে তার সমস্ত শরীর মাখামাখি হয়ে যাবে।

রিকশাওয়ালাটা বুড়ো এবং চালাক। খুব কম পরিশ্রমে সে এক ঘন্টা পার করতে চায়। রিকশা চলছে হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে। মিসির আলি বললেন, ‘বুড়ো মিয়া, আপনি এই যে আস্তে আস্তে রিকশা চালাচ্ছেন, এতে কিন্তু আপনার কষ্ট বেশি হচ্ছে। প্রতিবারই নতুন করে মোমেনটাম দিতে হচ্ছে। কিন্তু আপনি যদি জোরে চালাতেন, তাহলে মোমেনটামের জন্যে বল দিতে হত এক বার। বাকি সময়টা শুধু ফ্রিকশন কাটানোর জন্যে অল্প কিছু বল লাগত।

বুড়ো রিকশওয়ালাকে এই জটিল বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কিছুমাত্র অনুপ্রাণিত করতে পারল না। তার রিকশার গতি আরো শ্লথ হয়ে গেল।

মিসির আলি ভাবতে চেষ্টা করলেন, যে-বাড়িতে আগে এক বার এসেছেন, সে-বাড়িটি এখন খুঁজে না-পাওয়ার পেছনে কী কী কারণ থাকতে পারে। অনেকগুলো কারণ হতে পারে। পরবর্তী সময়ে হয়তো লাল রঙের দালানটিকে সাদা রঙ করা হয়েছে। দোতলা ছিল, তিনতলা করা হয়েছে। ফুলের বাগান নষ্ট করে ঘর তোলা হয়েছে। কিংবা এ-ও হতে পারে যে, মস্তিষ্কের যে অংশ বস্তুজগতের আবস্থানিক বিষয়গুলোর বিশ্লেষণ করে নিউরোন স্মৃতিকক্ষে জমা রাখে–তাঁর সেই অংশ কাজ করছে না।

মিসির আলি হঠাৎ লক্ষ করলেন, তাঁর রসমালাইয়ের হাঁড়ি দু’খণ্ড হয়েছে। সমস্ত গায়ে, রিকশার সীটে এবং নিচে রসে মাখামাখি। এই অবস্থায় নীলুর বাসা খোঁজার কোনো মানে হয় না। অথচ এক ঘন্টা পার হতে এখনো পনের মিনিট বাকি। পনের মিনিট আগে রিকশা ছেড়ে দেবারও প্রশ্ন ওঠে না। তিনি রিকশওয়ালাকে ছায়ায় নিয়ে রিকশা দাঁড় করাতে বললেন।

রসে মাখামাখি হয়ে তিনি পনের মিনিট রিকশার সীটে বসে রইলেন। মিষ্টির লোভে তাঁর মাথার ওপর কাক ডাকতে লাগল। দু’-একটা সাহসী কাক ছোঁ মেরে মেরে রসগোল্লার টুকরা ঠোঁটে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে। বুড়ো রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে তাঁকে দেখছে। সে তার জীবনে এমন বিচিত্র যাত্রী খুব বেশি পায় নি। মিসির আলি বললেন, ‘পনের মিনিট পার হলেই আমি চলে যাব, বুঝলেন?’

রিকশাওয়ালা মাথা নাড়ল–সে বুঝেছে।

আজ গরম সে-রকম নেই। কাল রাতে প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় আজ একটা শীতল ভাব আছে। তা ছাড়া রাস্তাঘাট ঝকঝক করছে। গাছপালায় সতেজ ভাব। কচুরিপানার মতো হালকা বেগুনি ফুল ফুটে আছে জারুল গাছে। কী চমৎকার যে লাগছে দেখতে! এই ফুলগুলোর জন্যেই চারদিকে একটা কোমল ভাব চলে এসেছে।

.

মিসির আলি বাসায় ফিরলেন এগারটার সময়। বাসায় এক ফোঁটা পানি নেই। একটার দিকে বাড়িওয়ালা কল ছাড়বে। তার আগে গোসলের কোনো সম্ভাবনা নেই। রসমালাইয়ের রস সারা গায়ে মেখে বসে থাকতে হবে।

তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। হানিফাকে চা বানাতে বলে ফিরোজের ফাইল খুলে বসলেন। এই ফাইলটিতে লেখা: ফিরোজ/মোহনগঞ্জ। মোহনগঞ্জে ফিরোজের অভিজ্ঞতা এবং মোহনগঞ্জ প্রসঙ্গে যাবতীয় খবরাখবর এখানে আছে। তিনি মোহনগঞ্জের বিভিন্ন লোকজনের কাছে যে-সব চিঠিপত্র লিখেছেন, তার কপি এবং সেইসব চিঠিপত্রের জবাবও এখানে আছে।

মিসির আলি পাতা ওল্টাতে লাগলেন। প্রথম চিঠিটি নাজনীনকে লেখা। তারিখ দেয়া আছে ১৭–৬–৮৫, প্রায় এক বছর আগে লেখা চিঠি। আজ হচ্ছে ১০-৬-৮৬। মিসির আলি নিজের লেখা চিঠির উপর চোখ বোলাতে লাগলেন।

নাজনীন,

কল্যাণীয়াসু, আমার ভালবাসা নাও। পরিচয় দিয়ে নিচ্ছিঃ আমি মিসির আলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিষয়ের এক জন অধ্যাপক। ফিরোজ খান নামের এক জন মানসিক রোগীর চিকিৎসার দায়িত্বে নিয়োজিত। তাকে চিকিৎসা করা হচ্ছে মেডিস্টিক সাইকোথেরাপি পদ্ধতিতে। এই রোগীকে তুমি চেন। ও তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিল এবং সে অসুস্থ হয়ে পড়ে তোমাদের বাড়িতেই। শোন নাজনীন –– মানসিক রোগের উৎপত্তি মনে। মানুষের মন বিচিত্র জিনিস। সমগ্র নক্ষত্রপুঞ্জে যে-রহস্য ও জটিলতা আছে, তার চেয়েও অনেক বেশি রহস্যময় মানুষের মন। আমরা আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞান দিয়ে সেই রহস্যের জট খুলতে চেষ্টা করি। প্রায় সময়ই তা সম্ভব হয় না। ফিরোজের বর্তমান যে-অবস্থা, তার কারণ অনুসন্ধান করতে তোমার সাহায্য প্রয়োজন। একটি অসুস্থ ছেলের সাহায্যে তুমি কি এগিয়ে আসবে না? আমি যা জানতে চাই, তা হচ্ছে–ফিরোজের সঙ্গে তোমার ক’ বার দেখা হয়েছে এবং কী কী কথা হয়েছে। কোনো কিছু বাদ না দিয়ে আমাকে জানাবে। আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন তথ্যও অর্থবহ হতে পারে। আমার শরীরটা বিশেষ ভালো না। শরীর একটু ভালো হলে তোমাদের বাড়িটা দেখতে যাব। এই ব্যাপারে তোমারই বড় ভাই আজমলের সাথে কথা হয়েছে। আদর ও ভালবাসা নাও।

মিসির আলি

চিঠির উত্তর তিনি এক সপ্তাহের ভেতর পেয়ে গেলেন। তিনি মুগ্ধ হলেন চিঠি পড়ে। সহজ এবং আন্তরিক ভঙ্গিতে লেখা চিঠি। হাতের লেখা বড় সুন্দর। তার চিঠির অংশবিশেষ এ রকম–

‘ভাইয়া যে তার বন্ধুকে নিয়ে বেড়াতে আসবে, তা আমি জানতাম। গরমের ছুটির সময় এসে বলে গিয়েছিল। ভাইয়া সেই কলেজে পড়ার সময় থেকে তার বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে বেড়াতে আসে। আমাদের বাড়িটা বিশাল। ভাইয়া তার বন্ধুদের এই বাড়ি দেখিয়ে মুগ্ধ করতে চায় বলেই আমার ধারণা।

যাই হোক, ভাইয়ার বন্ধুরা এলে আমার খুব ভালো লাগে। বাড়িতে একটা উৎসব-উৎসব ভাব থাকে। ভাইয়ার মেজাজ থাকে খুব খারাপ (আপনি বোধহয় জানেন না, ভাইয়া খুব রাগী)।

এবার যখন ফিরোজ ভাই বেড়াতে এল–আমার মোটেও ভালো লাগে নি। কারণ, ভাইয়ার এই বন্ধুকে এখানে নিয়ে আসার পেছনে একটি উদ্দেশ্য ছিল, যা আমার পছন্দ হয় নি। ভাইয়া চাচ্ছিল, আমি তার বন্ধুর সঙ্গে গল্পটল্প করি, চা-টা বানিয়ে দিই। এবং তা করলেই তার বন্ধু আমাকে পছন্দ করে ফেলবে। আমার শারীরিক ত্রুটি তার চোখে পড়বে না। আমার একটি ভালো বিয়ে হবে। ভাইয়ার ধারণা, তার এই বন্ধু পৃথিবীর সেরা মানুষদের এক জন।

মার কাছ থেকে এসব শুনে আমার খুব মন খারাপ হল। একটি ছেলেক ভুলিয়ে-ভালিয়ে বিয়ে করতে হবে কেন? বিয়েটা কি এতই জরুরি? আমি ভাইয়াকে ডেকে নিয়ে বললাম, ‘আমি কখনো, কোনো অবস্থাতেই তোমার এই বন্ধুর সামনে যাব না।’ ভাইয়া চোখ লাল করে বলল, ‘যেতেই হবে।’ আমি শান্ত গলায় বললাম, ‘এটা নিয়ে তুমি যদি জোর খাটাও, আমি তাহলে মরে যাব।’ ভাইয়া চুপ করে গেল। আমি শান্ত ধরনের মেয়ে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই ভয়ঙ্কর জেদি। ভাইয়া তা খুব ভালোই জানে। সে আমাকে ঘাঁটাল না। আমি ভেতরের বাড়িতে থাকতে লাগলাম। ভুলেও বাইরে পা বাড়াই না। তবু এক দিন সন্ধ্যায় দেখা হয়ে গেল। ফিরোজ ভাইকে দেখে মনে হল, তিনি খুব অবাক হয়েছেন। আমি হকচকিয়ে গিয়েছি। নিজেকে সামলে নিয়ে কোনোমতে বললাম, ‘বড় ঘরে গিয়ে বসুন, সেখানে চা দেয়া হবে।’

এই বলে আমি চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়েছি। পোলিওর জন্যে আমার এক পায়ে কোনো জোর নেই, কাজেই উল্টে পড়ে গেলাম। ফিরোজ ভাই আমাকে টেনে তুললেন। এটাই স্বাভাবিক। এতে লজ্জা বা অপমানের কিছুই নেই। কিন্তু রেগে গেলাম এবং কঠিন গলায় বললাম, ‘হাত ছাড়ুন।’

তিনি পাংশুবর্ণ হয়ে গেলেন। আমার হাত ছেড়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন।’

মিসির আলি এই চিঠিটা বেশ অনেক বার পড়েছেন এবং প্রতিবারই তাঁর মনে হয়েছে, চমৎকার একটি চিঠি। আন্তরিক এবং কোনো ভান নেই। এক জন মানুষ সবচেয়ে বেশি ভান করে তার চিঠিতে। যে এই ভানের ওপরে উঠে আসতে পারে, তাকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে হয়।

সুন্দরী একটি মেয়ের মনটাও বোধহয় সুন্দর হয়।

মিসির আলি অন্যমনস্কভাবে খাতার পাতা ওল্টাতে লাগলেন। এখনো পানি আসে নি। আজ কি বাড়িওয়ালা তার পানির পাম্পটি খুলবে না? ওদের নিজেদের কি পানির দরকার হয় না? দুপুরের খাওয়াদাওয়ারও একটা ব্যবস্থা করতে হয়। রান্নাবান্না কিছু হয় নি। হানিফা জ্বরে কাতর। কালকের ঘটনায় বেচারি বেশ ভয় পেয়েছে। সকালে এক শ’ এক জ্বর ছিল, এখন এক শ’ দুই। দুটি প্যারাসিটামল কিছুক্ষণ আগেই খাওয়ানো হয়েছে। জ্বর কমে যাওয়া উচিত, কিন্তু কমছে না। বিকেল নাগাদ না—কমলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।

তিনি খাতাপত্র গুছিয়ে উঠলেন। উঁকি দিলেন হানিফার ঘরে। হানিফার জন্যে তিনি একটি ঘর দিয়েছেন। এই ঘরে ছোট্ট একটি খাট আছে, পড়ার চেয়ার-টেবিল আছে, একটি আলনা আছে। এই মেয়েটি কোনোদিন কল্পনাও করে নি, কোনোদিন এতগুলো জিনিস তার হবে।

‘হানিফা, তোর জ্বর কেমন রে?’

‘ভালো।’

মিসির আলি কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠলেন।

‘ভালো কোথায়? অনেকখানি জ্বর তো! মাথায় পানি ঢালতে হবে।’

হানিফা জ্বরতপ্ত চোখে তাকিয়ে রইল। এই লোকটিকে সে বুঝতে পারছে না। এক জন কাজের মেয়ের জন্যে কেউ এতটা দরদ দেখায়, না দেখান উচিত?

‘হানিফা।’

‘জ্বর খুব বেশি। জ্বর নামাতে হবে। পানি তো বোধহয় এক ফোঁটাও নেই।’

‘জ্বি না।’

‘যাই, বাড়িওয়ালাকে পাম্প ছাড়তে বলি।’

‘বলেন।’

‘ফিরোজদের বাড়ি থেকে কেউ এসেছিল?’

‘জ্বি-না।’

‘টেলিফোন করে একটা খোঁজ নিতে হয়। কী বলিস হানিফা?’

‘জ্বি, নেন।’

হানিফা চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার জ্বর বোধহয় বাড়ছে। চোখ ছোট-ছোট হয়ে এসেছে। চোখের সাদা অংশ কেমন ঘোলাটে দেখাচ্ছে। মিসির আলি চিন্তিত মুখে বাড়িওয়ালার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। বাড়িওয়ালা করিম সাহেব বাসাতেই ছিলেন। পানি এখনো ছাড়া হয় নি শুনে তিনি

খুব হৈচৈ করতে লাগলেন। বারবার বললেন, ‘এই সামান্য কাজের জন্যে আপনি নিজে আসলেন প্রফেসর সাহেব–বড় লজ্জায় ফেললেন আমাকে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ।’

মিসির আলি সাহেব বললেন, ‘একটা টেলিফোন করা যাবে করিম সাহেব?’

‘একটা কেন, এক শ’টা করা যাবে। যখন ইচ্ছা তখন করা যাবে। দরকার হলে ট্রাংকল করবেন–খুলনা ময়মনসিংহ বরিশাল। টেলিফোনের বিল আবদুল করিমকে কিছু করতে পারবে না, বুঝলেন প্রফেসর সাহেব? ওরে, টেলিফোনটা প্রফেসর সাহেবকে এনে দে। আর দেখ, ঠাণ্ডা পেপসি বা সেভেন আপ কিছু আছে কি না।

‘কিছু লাগবে না।‘

‘আপনি না বললেই হবে নাকি? আপনার একটা ইজ্জত আছে না? ছয় মাসে এক বছরে একবার আসেন। আমি বলতে গেলে রোজই বসে থাকি আপনার ওখানে। আপনি ফ্যানটার নিচে ঠাণ্ডা হয়ে বসেন তো দেখি!’

মিসির আলি বসলেন। বাড়িওয়ালা করিম সাহেব মিসির আলিকে একটু বিশেষ রকম স্নেহ করেন। গত দু’বছরে তিনি প্রতিটি ফ্লাটের ভাড়া তিন দফায় বাড়িয়েছেন, শুধু প্রফেসর সাহেবের ভাড়া এক পয়সাও বাড়ে নি। কেন বাড়ে নি কে জানে?

.

ফিরোজের মাকে টেলিফোনে পাওয়া গেল। তাঁর কাছ থেকে যে-সমস্ত তথ্য জানা গেল, সেগুলো হচ্ছে–ফিরোজ ভালো আছে, সুস্থ এবং স্বাভাবিক। তার ঘরে একটি মাইক্রোফোন বসিয়ে ঘরের যাবতীয় শব্দ টেপ করা হয়েছে। টেপগুলো তিনি সন্ধ্যাবেলা পাঠাবেন।

ফিরোজের মা চিন্তিত স্বরে বললেন, ‘আপনি অসুস্থ বলেছিলেন কেন? আমরা খুব ভয়ে ভয়ে রাতটা কাটালাম। আপনার ওখানে সে কিছু করেছিল নাকি?’

‘না, তেমন কিছু করে নি। একটু উদ্‌ভ্রান্ত মনে হচ্ছিল। ফিরোজ কি আছে ঘরে?’

‘হ্যাঁ, আছে। কথা বলবেন?’

‘বলব। দিন ওকে।’

ফিরোজের গলা শান্ত ও স্বাভাবিক।

‘কেমন আছ ফিরোজ?’

‘ভালো।

‘কী করছিলে?’

‘কিছু করছিলাম না। একটা উপন্যাস নিয়ে বসেছিলাম।’

‘কার উপন্যাস?’

‘জন স্টেইনবেক। নাম হচ্ছে গিয়ে আপনার, সুইট থার্সডে। স্যার, আপনি পড়েছেন এটা?’

‘গল্প-উপন্যাস আমি পড়িটড়ি না। এক জন লেখকের বানানো দুঃখ-কষ্টের বিবরণ পড়ে কী হয় বল? এমনিতেই আমাদের চারদিকে প্রচুর দুঃখ-কষ্ট আছে।’

‘স্যার, আপনাকে বইটা পড়তেই হবে। আমার পড়া শেষ হলেই আপনাকে দিয়ে আসব।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। শোন ফিরোজ।’

‘বলুন।’

‘কাল রাতে তোমার কেমন ঘুম হয়েছিল?’

‘ভালো।’

‘কী রকম ভালো?’

‘খুব ভালো। এক ঘুমে রাত পার করেছি। কি জন্যে জিজ্ঞেস করছেন স্যার?’

‘এমনি জানতে চাচ্ছি। কোনো স্পেসিফিক কারণ নেই। তুমি কি কাল রাতে কোনো স্বপ্ন দেখেছ?’

‘জ্বি-না স্যার।’

‘চট করে না বলে দিও না। চিন্তা করে তারপর বল।‘

‘এবার ও সময় নিল জবাব দেয়ার আগে।’

‘একটা স্বপ্ন দেখেছি। আর ওটা তো আমি প্রায়ই দেখি।’

‘কোনটা?’

‘ঐ যে, ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছি, তারপর দেখি কোনো প্রশ্নের উত্তর জানি না।’

‘এটা ছাড়া আর কোনো স্বপ্ন দেখ নি?’

‘জ্বি না।’

‘শোন ফিরোজ, এ ছাড়াও যদি অন্য কোনো স্বপ্নের কথা মনে পড়ে, আমাকে জানিও।’

‘জ্বি আচ্ছা।‘

‘তুমি কি আজ সন্ধ্যার দিকে এক বার আসবে?’

‘না স্যার, আজ আসব না। বইটা শেষ করব।’

‘প্রেমের উপন্যাস নাকি?’

ফিরোজ লাজুক স্বরে বলল, ‘হুঁ।’

.

টেপগুলো পরীক্ষা করতে-করতে রাত তিনটা বেজে গেল। প্রথম চারটি টেপে তেমন কিছু নেই। এক বার শুধু কিছুক্ষণের জন্যে আহ্ উহ্ শব্দ। সেটা স্বপ্ন দেখার জন্যে, কিংবা বেকায়দা অবস্থায় শোয়ার জন্যে। তবে শেষ টেপটিতে মিসির আলির জন্যে বড় ধরনের বিস্ময় অপেক্ষা করছিল।

তিনি বিচিত্র একটি কণ্ঠস্বর শুনলেন সেখানে। তীক্ষ্ণ তীব্র। হাই ফ্রিকোয়েন্সি–কথাগুলো এ-রকম :

অপরিচিত কণ্ঠস্বর : ‘হুঁ হুঁ ফিরোজ! ফিরোজ …. (অস্পষ্ট)

ফিরোজের কণ্ঠস্বর : ‘না। না। উঁচু না।

অপরিচিত : লোহার রডটা কোথায়?

ফিরোজ : জানি না, আমি জানি না।

অপরিচিত : (অস্পষ্টভাবে কিছু বলল)। নিঃশ্বাসের শব্দ।

ফিরোজ : না। না। না।

অপরিচিত : লোহার রড। রড।

ফিরোজ : না। না।

অপরিচিত : (অস্পষ্টভাবে কিছু কথা)। হাসির শব্দ।

মিসির আলি অসংখ্যবার এই অংশটি বাজিয়ে-বাজিয়ে শুনলেন। অস্পষ্ট অংশগুলো উদ্ধার করতে পারলেন না। অপরিচিত যে-কণ্ঠস্বর শুনছেন, তা ফিরোজেরই কণ্ঠস্বর। এটি তার একটি দ্বিতীয় সত্তা। সেকেণ্ড পারসোনালিটি। ফিরোজকে পুরোপুরি সুস্থ করতে হলে তার দ্বিতীয় সত্তাটিকে ভালোভাবে বুঝতে হবে।

.

হানিফা ছটফট করছে। তার জ্বর কমে নি। এখন এক শ’ দুইয়েরও কিছু বেশি। মিসির আলি চিন্তিত বোধ করলেন। রাত দশটার দিকে জ্বর অনেক কম ছিল। নিরানব্বুই পয়েন্ট পাঁচ। এখন এত বাড়ল কেন?

হানিফা জেগে আছে। কিন্তু কোনোরকম সাড়াশব্দ করছে না। মিসির আলি কোমল গলায় বললেন, ‘খারাপ লাগছে নাকি রে বেটি?’

‘না।’

‘মাথার যন্ত্রণা আছে?’

‘আছে।’

‘বেশি?’

‘মাথা টিপে দেব?’

হানিফা লজ্জিত স্বরে বলল, ‘জ্বি-না।’

‘না কেন? আরাম লাগবে। তার আগে মাথায় পানি ঢেলে জ্বরটা কমাতে হবে।’

তিনি বাথরুমে ঢুকলেন পানির বালতির খোঁজে। তাঁর নিজের শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। মাথা ভার ভার লাগছে। বমি-বমি লাগছে। শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু একটি বাচ্চা মেয়ে জ্বরে ছটফট করবে, আর তিনি শুয়ে থাকবেন–এটা হয় না।

হানিফার এ-বাড়িতে আসার ইতিহাস বেশ বিচিত্র। গত বছর জুলাই মাসের দিকে এক বার বেশ বড় একটা ঝড় হল। রাত একটায় জেগে উঠে দেখেন, দড়ামদুড়ুম শব্দে জানালার পাট আছড়ে পড়ছে। বৃষ্টির ছাটে ঘর ভেসে যাচ্ছে। ইলেকট্রিসিটি নেই। চারদিক অন্ধকার। মোটামুটি একটি ভয়াবহ অবস্থা। তিনি জানালা বন্ধ করতে গিয়ে দেখলেন, আট ন’ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে একা-একা দেয়াল ঘেঁষে বসে আছে।

‘কে রে তুই?’

মেয়েটি ভয়-পাওয়া স্বরে বলল, ‘আমি।’

‘এখানে কী করছিস?’

‘ঘুমাইতাছি।’

‘জেগে জেগে ঘুমাচ্ছিস নাকি?’

মেয়েটি জবাব দিল না।

‘বাপ-মা কোথায়?’

মেয়েটি নিরুত্তর।

‘তোর বাবা-মা নেই।’

‘না।’

‘আত্মীয়স্বজন কেউ নেই?’

‘না।’

‘তুই কি এ-রকম একা-একা মানুষের বারান্দায় ঘুমোস নাকি?’

‘মেয়েটি জবাব দিল না। মিসির আলি বললেন, ‘ভয় লাগছে না তোর?’

‘না।’

‘বলিস কী! নাম কি তোর?’

‘হানিফা।’

‘আয়, ভেতরে আয়। ইস্, ভিজে জবজবে হয়ে গেছিস তো!’

‘মিসির আলি হারিকেন জ্বালিয়ে তাকালেন মেয়েটির দিকে। ছেলেদের মতো ছোট-ছোট করে কাটা চুল। আদুরে একটা মুখ।

‘তোর বাপের নাম কি?’

‘জানি না।’

‘বলিস কী! মা’র নাম?’

‘জানি না।’

‘তোর হাতে কী? মুঠোর ভেতর কী আছে?’

হানিফা মুঠি খুলল। ভাংতি পয়সা।

‘ভিক্ষা করে পেয়েছিস?’

‘হুঁ।’

মিসির আলি গুনলেন। দু’ টাকা ত্রিশ পয়সা। এই বিশাল পৃথিবীতে আগামীকাল এই মেয়েটি যাত্রা শুরু করবে–দু’ টাকা ত্রিশ পয়সা, একটা নোংরা ফ্রক এবং একটা তালি দেয়া প্যান্ট নিয়ে। কোনো মানে হয়?

তিনি একটি শুকনো লুঙ্গি বের করলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘কাপড় বদলে এটা পরে ফেল্। নিউমোনিয়া বাধাবি তো! ঐ ঘরে একটা বিছানা আছে, ওখানে গিয়ে শুয়ে থাক্।

মিসির আলি ভেবেছিলেন, সকাল হলেই সে চলে যেতে ব্যস্ত হয়ে যাবে। এক বার যাযাবর জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেলে বন্ধন আর ভালো লাগে না। কিন্তু হানিফা সকালবেলা চলে যাবার কোনো রকম লক্ষণ দেখাল না। এমনভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগল, যেন এইটি তার ঘরবাড়ি।

.

হানিফার প্রতি সমাজের যে দায়িত্ব ছিল, মিসির আলি তা পালন করেছেন। নিজেই তাকে পড়তে শিখেয়েছেন। যোগ ভাগ গুণ শিখিয়ে নিয়ে গেছেন স্কুলে ভর্তি করাবার জন্যে। কেউ ভর্তি করাতে রাজি হয় নি। এত বড় মেয়েকে ক্লাস ওয়ানে অ্যাডমিশন দেয়ানো সম্ভব নয়। তিনি হানিফাকে বলেছেন, ‘ঠিক আছে, তুই ঘরে বসেই পড়াশোনা চালিয়ে যা। যথাসময়ে প্রাইভেটে তোকে দিয়ে ম্যাট্রিক দেওয়াব। আমি নিজে তো সব সময় দেখতে পারি না। এক জন মাস্টার রেখে দেব।’

.

শেষরাতের দিকে হানিফার জ্বর কমে এল। শরীর ঘামতে লাগল। সে বিড়বিড় করে নানান কথা বলতে লাগল। মেয়েটির বিড়বিড় করে বলা কথাগুলো থেকেই মিসির আলি বড় ধরনের একটি আবিষ্কার করলেন। তাঁর বিস্ময়ের সীমা রইল না।

এই প্রসঙ্গে যথাসময়ে বলা হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *