ঘর-বার করতে করতে কেমন পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছিল রেমি। ধ্রুবর রাত করে বাড়ি ফেরা এমন কিছু ব্যাপার নয়। কিন্তু আজকাল, এবং বিশেষ করে পুরীর এই অদ্ভুত অ্যাডভেঞ্চারে আসার পর থেকে রেমির ধৈর্য কমে গেছে। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে ধ্রুব তার সঙ্গে ঘর করতে চায় না। বর কাছে তার কোনও মূল্য নেই। অথচ পালিয়ে আসার সময় ধ্রুব যখন তাকেও সঙ্গে এনেছিল তখন রেমি এক রোমহর্ষক আনন্দ বোধ করেছিল। মনে হল, ধ্রুবর বুঝি বরফ গলল।
না। তা তো নয়।
সমুদ্রে অচেনা ঢেউয়ের সঙ্গে যখন তার প্রথম চেনাজানা করিয়ে দিয়েছিল ধ্রুব তখনও রেমি এক অদ্ভুত নৈকট্যের স্বাদ পেয়েছিল। মাঝে মাঝে এত আপন, এত নিজের জন মনে হয় ধ্রুবকে, পরমুহূর্তেই ভাঙা পুতুলের মতো রেমিকে ছুড়ে ফেলে সে খেলা ভেঙে উঠে যায়। কিন্তু কোথায় যায়?
এত কাছে থেকে, এত ঘনিষ্ঠ মেলামেশার পরও কী করে একজন এত দূরের মানুষ থেকে যায়, তা রেমির অল্পবুদ্ধির মাথায় ঢোকে না।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে রেমি দেখল, হোটেলের সদর ফটক বন্ধ হয়ে গেল রাতের মতো। বন্ধ হয়ে গেল দরজা। ক্রমশ নিজ্ঝুম হয়ে এল চারধার। রেমি জানে, হোটেলের ম্যানেজারকে খবরটা জানানোর কোনও মানেই হয় না। কেউ কিছু করতে পারবে না।
অনেকক্ষণ অন্ধকার বালিয়াড়ির দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইল রেমি। দুর্যোগের দিন বলে কেউ কোথাও নেই। ধ্রুবরও থাকার কথা নয় ওখানে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পাগল-পাগল মাথা নিয়ে ঘরে এসে দোর দিল রেমি। তারপর কাঁদতে বসল।
একা হোটেলের ঘরে যুবতী বউকে ফেলে রেখে যে চলে যেতে পারে তাকে স্বামী হিসেবে স্বীকার করা উচিত নয় রেমির। তার উচিত জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলা। ধ্রুব তাকে চায় না, তারও উচিত ধ্রুবকে না-চাওয়া।
কাঁদতে কাঁদতেই রেমি উঠল। তার ব্যাগে কিছু টাকা আছে। ধ্রুবর সুটকেস খুলে একটু হাঁটকাতেই সে পেয়ে গেল বাহান্নখানা একশো টাকার নোটেব একটা নতুন তাড়া।
চোখের জল মুছে রেমি নিঃশব্দে তার শাড়ি-টাড়ি গুছিয়ে নিল ব্যাগে। কাজ শেষ করে ঘড়িতে দেখল, রাত দুটো।
ঘুম আসবে না। বাইরে ঝোড়ো বাতাসের আক্রোশ এখন অনেকটা কম। তবে অবিরল ঢেউ ভাঙার শব্দ আসছে। বাতি নেভাল না রেমি। ভয় করে। বাতি জ্বেলেই শুয়ে রইল বিছানায়।
ঘুমহীন দুচোখ ভরে ফের জল এল। এখন আর রাগ নেই। বুক জুড়ে এক অভিমানের সমুদ্র।
তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারি না। তবু তোমার জন্যই তোমাকে ছেড়ে থাকতে হবে। চললাম।
অনুপস্থিত ধ্রুবর একটা অট্টহাসি শুনতে পায় রেমি। ধ্রুব যেন বলে, যাও। পৃথিবীতে কাউকেই আমার খুব একটা প্রয়োজন নেই।
রাগে দুঃখে দুহাত মুঠো করে রেমি বলে, কেন প্রয়োজন নেই?
কেন? মানুষে-মানুষে কোনও স্থায়ি সম্পর্ক নেই, আত্মীয়তা একটা সংস্কার মাত্র। আমি এই জীবনে তা বহুবার প্রত্যক্ষ করেছি। ওই যে আমার জন্মদাতা, উনি ঠিক কে বলো তো! বাবা বলে ভাবলে বাবা, কিন্তু যদি না ভাবি!
শুধু বাবার ওপর রাগ বলেই কি তোমার মনটা ওরকম হয়ে গেছে?
রাগ হলে তো বাঁচতাম। শুধু রাগ তো নয়।
তাহলে কী?
কী করে বলি! তবে ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করছি। আমার মা যখন মারা যায় রেমি, সেটা আমার চোখের সামনেই ঘটেছিল। আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ, সবচেয়ে আপন, যার গায়ের গন্ধ, নাকের বাঁ পাশের আঁচিলটা সবই ছিল যেন আমার নিজস্ব ঐশ্বর্য, তাকে চোখের সামনে অঙ্গার হয়ে যেতে দেখে আমার সেই যে মোহভঙ্গ ঘটেছিল তা আর মন থেকে গেল না। হঠাৎ ঘরের ছাদ উড়ে গেলে মানুষের যেমন অসহায় লাগে, কিংবা কোনও অঙ্গ হঠাৎ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে মানুষ যেরকম হতভম্ব হয়ে যায়, ঠিক তেমনই একটা বিস্ময়বোধ আমাকে আজও আচ্ছন্ন করে আছে। বাবা দেশোদ্ধার করে বেড়াচ্ছেন, ভাল কথা, কিন্তু আমার মায়ের অপরাধ কী তা আজও আমি জানি না। কেন তাকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া হল? কেন তার নীরব ও নিরবচ্ছিন্ন ভারাক্রান্ত মনের দিকে কেউ তাকাল না?
শোক কি এত দীর্ঘস্থায়ি হয়?
না। প্রথমে শোক ছিল। কিন্তু বড় হতে হতে আমি বারবার ঘটনাটির বিচার ও বিশ্লেষণ করে দেখেছি। শোক থেকে উৎপন্ন হয়েছে এক ক্রোধা কৃষ্ণকান্ত চৌধুরীর সঙ্গে আমার বোঝাপড়াটা যতদিন না শেষ হয় ততদিন পৃথিবীর অন্যান্য ঘটনাবলী এবং মানুষ আমার কাছে অর্থহীন।
কীসের বোঝাপড়া? মানুষ তো ত্রুটিহীন নয়। সকলেরই কিছু না কিছু দোষ থাকেই। শ্বশুরমশাইকে তুমি কী করতে চাও?
ভয় পেয়োনা রেমি। আমি ওঁকে খুন করতে চাই না।
তাহলে?
আমি ওঁর দৃষ্টিভঙ্গিটা পালটে দিতে চাই।
সেটা আবার কীরকম?
লোকটা জীবনে সবই পেয়েছে। সামন্ততান্ত্রিক ব্যাকগ্রাউন্ড, স্বদেশিয়ানার ছাপ, সততা ও নিষ্ঠার খ্যাতি। হি ইজ এ বিগ ম্যান। আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমি লোকটাকে বিগ্রহের আসন থেকে টেনে ধুলোমাটির মধ্যে নামাতে চাই। যে উচ্চাকাঙ্ক্ষার নেশায় লোকটা চিরকাল কাছের লোকজনকে অবহেলা করেছে, তাদের সুখ দুঃখ মনোবেদনার দিকে তাকায়নি, সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমি একেবারে শেষ করে দিতে চাই। কিন্তু মুশকিল কী জানো? লোকটার অস্তিত্বটাই জড়িয়ে আছে ওই ভুল পলিটিকস আর ভুল দেশপ্রেমের সঙ্গে। ওগুলো কেড়ে নিলে লোকটা হয়তো বাঁচবেই না। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে লোকটাকে শোধরানোর মানে আসলে দাঁড়াবে লোকটাকে খুন করা। কিন্তু আমি নাচার।
তুমি শ্বশুরমশাইকে ভুলে যেতে পারো না?
কী করে সেটা সম্ভব?
ওঁর কথা ভেবো না। অন্য সব কিছু নিয়ে ব্যস্ত রাখো নিজেকে।
ভোলা সহজ নয়, রেমি।
চলো আমরা অন্য কোথাও গিয়ে ঘর বাঁধি।
লোকটার কাছ থেকে দূরে সরে গেলেই কি সব সমস্যার সমাধান হবে?
তা হলে কী করবে? একটা কিছু তো করতে হবে।
আমার ক্ষমতা কতটুকু, রেমি? কৃষ্ণকান্ত চৌধুরী আমাদের তিন ভাইয়ের দিকে কখনও মনোযোগ দেয়নি। স্বার্থপর লোকটা চিরকাল নিজের কেরিয়ার তৈরিতে ব্যস্ত ছিল। আমাদের মানুষ করে ভোলার জন্য যতটুকু করার ছিল তার কিছুই করেনি। দাদার মিলিটারিতে যাওয়ার কোনও ইচ্ছে ছিল না। কেবলমাত্র একটি ডানপিটে দুষ্ট ছেলেকে দূরে রাখার জন্যই তাকে দেরাদুন মিলিটারি আকাদেমিতে পাঠিয়ে দিয়েছিল তোমার শ্বশুর ছেলে যে সেই পর হয়ে গেল আর তাকে কোনওদিন কাছে ডাকল না। আমার তো মনে হয় কৃষ্ণকান্তকে জব্দ করতেই দাদা একজন মারাঠি ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করে বসেছে। প্রচণ্ড মদ খায়, র্যাশ লাইফ লিড করে। আমার ছোট ভাইকে তো দেখেছ? কোনওদিন মনে হয়েছে যে, এ বাড়ির ওপর তার টান আছে? নেই। কারণ তাকে ছোটবেলা থেকেই ঠিক ওরকম ভাবতে বাধ্য করা হয়েছে। দাদার মতো সেও একদিন এ বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কের শেষ সুতোর বাঁধনটাও ছিঁড়ে ফেলবে। শুধু আমি। আমার জন্যই কৃষ্ণকান্ত এখনও নিষ্কণ্টক নয়। সুতরাং ওই একটা কাঁটা তার জীবনে থাক, রেমি।
এসব কাল্পনিক সংলাপ অবশ্য পুরোটাই রেমির কল্পনা নয়। বিভিন্ন সময়ে ধ্রুবর সঙ্গে তার এসব কথাবার্তা হয়েছে।
ভোর পর্যন্ত রেমি আধো-ঘুম ও আধো-জাগরণে বহুবার ধ্রুবর কথা, শুধু ধ্রুবর কথাই ভাবল। কোনও দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তবু সেটাকে সম্ভব বলে মনে হল না তার। মদ খেয়ে কোথাও পড়ে আছে? অসম্ভব নয়। তবে মদ খেয়ে ঘরে ফিরতেও যখন বাধা ছিল না, তখন না ফেরারই বা কী অর্থ? রেমির যেটা সম্ভব বলে মনে হয়, ধ্রুব ইচ্ছে করেই ফেরেনি। দুপুরে ধ্রুব বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখেছে, রেমি দুরন্ত সমুদ্রের জলে নামছে একা। বোধহয় সে ভেবেছে, রেমি আত্মহত্যার চেষ্টা করছে। এতে বোধহয় একটু আশান্বিতই হয়েছে ধ্রুব। আত্মহত্যার দিকে রেমিকে আর-একটু ঠেলেই দেওয়া যাক তাহলে! সেই কারণেই কি সারারাত নিজের ইচ্ছাশক্তির সঙ্গে, নিজের ভূতের সঙ্গে লড়াই করতে তাকে ফেলে গেল ব? একটানা সারা রাত সে এই ঘরে একা। নানারকম দুশ্চিন্তা, অদ্ভুত সব বিকার, বিকট সব ভয় তাকে ঘেঁকে ধরছে। কিছু করার নেই। সে মেয়েমানুষ, যুবতী, চেঁচালে কেলেংকারি হবে।
ভোরের আলো ভাল করে ফুটবার আগেই রেমি উঠে পড়ে। ধ্রুব আজ ফিরবে কি না তা সে জানে না। ভাববার মানেও হয় না কোনও। রেমি সকালের জলখাবার খেয়ে নিল অনিচ্ছা সত্ত্বেও। সকাল নটা নাগাদ একটা রিকশা ডেকে ব্যাগ নিয়ে রওনা হয়ে পড়ল স্টেশনের দিকে। সিদ্ধান্তটা খুবই দুঃসাহসী। কিন্তু আপাতত এই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।
কিন্তু বিকেলের আগে কলকাতার ভাল ট্রেন নেই। রেমি অনেকক্ষণ চেষ্টাচরিত্র এবং খানিকটা ছোটাছুটি করে ও অবশেষে এক দালালকে বেশি টাকা কবুল করে একটা স্লিপার বার্থের ব্যবস্থা করে ফেলল। একা মেয়েমানুষের পক্ষে ফার্স্ট ক্লাস খুব ভাল নয়। সে সেকেন্ড ক্লাসেই যাবে।
সারাটা দিন রেমি ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিং রুমে বসে বসে স্টেশন থেকে কেনা পত্রপত্রিকা আর বই পড়ল। খিদে পেলে খেয়ে এল রেস্টুরেন্ট থেকে। খুবই স্বাভাবিক আচরণ করে যাচ্ছিল সে। কিন্তু মনের মধ্যে সর্বদা এক উচাটন ভাব। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ধ্রুব সকালে হোটেলে ফিরবে এবং তাকে না পেয়ে ছুটে আসবে স্টেশনে। আসেনি।
বিকেল চারটে পর্যন্ত শক্ত ছিল রেমি। তারপর আর পারল না। কে জানে, ধ্রুব আদৌ ফিরেছে কি না! যদি কোনও বিপদ ঘটে থাকে তার?
স্টেশন থেকেই ডিরেকটারি দেখে হোটেলে ফোন করে রেমি।
দোতলার চোদ্দো নম্বর ঘরের মিস্টার চৌধুরী কি ফিরেছেন?
হ্যাঁ। অনেকক্ষণ। আপনি কি মিসেস চৌধুরী?
হ্যাঁ।
উনি কয়েকবার আপনার খোঁজ করেছিলেন। কোথায় গেছেন বলে যাননি তো!
না। হঠাৎ একটু বেরিয়ে পড়লাম।
কোথায় গিয়েছিলেন?
রেমি একটু ভেবে বলল, বেড়াতে। ওঁকে বলবেন, আমি আমার ফিরতে একটু দেরি হবে। চিন্তার কিছু নেই।
আচ্ছা।
রেমি নিশ্চিন্ত মনে এসে বসতে পারল ওয়েটিং রুমে। একটু ঘুমিয়েও নিল। সবচেয়ে গাঢ় ঘুম হল তার গাড়িতে। এক ঘুমে কলকাতা। ট্যাকসিতে উঠে সোজা চলে এল বাপের বাড়িতে।
সে এবং ধ্রুব যে কোথাও গিয়েছিল এবং কলকাতায় যে বেশ কয়েকদিন তারা ছিল না, এ খবরটা পর্যন্ত তার বাপের বাড়িতে পৌঁছোয়নি। ব্যাপারটা বিস্ময়কর। তবে তার শ্বশুর কৃষ্ণকান্ত বোধহয় পুত্র আর পুত্রবধূর এই আকস্মিক গৃহত্যাগের ঘটনাটা চাউড় করতে চাননি। দ্বিতীয় যে ঘটনাটা আরও চমকপ্রদ এবং দূরপ্রসারী সেটা বাপের বাড়িতে পা দিয়েই শুনল সে, কৃষ্ণকান্তর দফতর বদল হয়েছে। মোটামুটি গুরুত্বপূর্ণ এক দফতর থেকে তাকে সরিয়ে নিতান্তই একটা এলেবেলে দফতরে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তা নিয়ে খুব একটা হই-চই হয়নি অবশ্য। কিন্তু গুজব হল, কৃষ্ণকান্তর দলের মধ্যে ফাটল দেখা দিয়েছে। ওঁকে হয়তো মন্ত্রিত্বই ছাড়তে হতে পারে।
খবরটা ভাল না মন্দ তা বুঝতে পারল না রেমি। আসলে খবরটা তাকে তেমন স্পর্শই করল না। তার নিজের জীবনে অনেক গুরুতর আর-একটা ঘটনা ঘটতে চলেছে। ধ্রুবর সঙ্গে তার সম্পর্কের ইতি ঘটছে। সে তুলনায় কৃষ্ণকান্তর মন্ত্রিত্ব নিয়ে গণ্ডগোেল তেমন কোনও ঘটনাই নয়।
বিকেলের দিকে সে কয়েকবার ফোন করার পর শ্বশুরমশাইকে ধরতে পারল তাঁর দফতরে।
আমি রেমি বলছি।
কৃষ্ণকান্তর গলাটা একটু দুর্বল শোনাল, কে? বউমা! তোমাদের জন্য ভেবে ভেবে আমি–কোথায় গিয়েছিলে, মা?
পুরী। আপনার ছেলে এখনও ওখানেই আছে।
তুমি কি একা কলকাতায় চলে এসেছ?
হ্যাঁ।
একদম একা?
একদম একা কেন হবে! আমি সেকেন্ড ক্লাসে এসেছি, গাড়িতে অনেক লোক ছিল।
কৃষ্ণকান্ত একটু হাসলেন, তা তো থাকারই কথা। তবু মেয়েদের একা চলাফেরা করতে নেই। এ দেশটা এখনও ততদুর সভ্য নয়, বুঝলে! এখনও জঙ্গলের শাসন কায়েম আছে। তা একা আসতে হল কেন? সেই দামড়াটার সঙ্গে বুঝি ফের ঝগড়া!
না, ঠিক ঝগড়া নয়।
ঠিক আছে। পরে শুনব। আজ ফিরতে একটু রাত হবে হয়তো। জেগে থেকো। আমি আজই সব শুনব।
কিন্তু আমি তো কালীঘাটের বাড়িতে উঠিনি।
তবে কোথায় আছো? বাপের বাড়িতে নাকি?
হ্যাঁ।
গণ্ডগোলটা তাহলে বেশ গুরুচরণ, কী বলে?
আমি অন্য একটা অ্যারেঞ্জমেন্টের কথা ভাবছি।
কী অ্যারেঞ্জমেন্ট, মা?
ভাবছি কিছুদিন দূরে সরে থাকাটা দরকার।
তাতে কিছু লাভ হবে মনে করো?
কাছে থেকেও তো হচ্ছে না।
হচ্ছে না কে বলল? আমি তো দেখছি হচ্ছে। এই যে আমাকে অপদস্থ করতে বাড়ি থেকে দুম করে পালিয়ে গেল, কিন্তু তোমাকেও নিয়ে গেল সঙ্গে। এটা কি ওর উন্নতির লক্ষণ নয়?
আমরা ওভাবে চলে যাওয়াতে আপনি অসন্তুষ্ট হয়েছেন নিশ্চয়ই!
তা হয়েছিলাম। তবে পরে হাসিই পেয়েছিল। পুলিশ ওকে নিয়ে গিয়ে কিছু ইনটেরোগেশনের পর ছেড়ে দিত। সেটাই নিয়ম। কেন যে খামোকা নাটক করতে গেল! তবে তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ায় দামড়াটা সম্পর্কে আমার একটু শ্রদ্ধাও হয়েছিল। এটা বুদ্ধির কাজ। কিন্তু তারপর কী হল, মা?
সব তো ফোনে বলা যায় না।
সে তো ঠিকই। দামড়াটা কি এখনও পুরীতেই আছে?
হ্যাঁ।
হোটেলের নামটা বলবে?
সি ভিউ।
ঠিক আছে। আমি দেখছি। তুমি তাহলে এখন বাপের বাড়িতেই থাকবে বলছ!
আপনি যদি অনুমতি দেন এবং রাগ না করেন।
ধ্রুবর জন্য তুমি যা করছ তা হয়তো ঠিকই করছ। কিন্তু মা, শুধু ধ্রুবই তো নয়, তোমার তো আমরাও আছি। দামড়াটাকে জব্দ করতে গিয়ে আমাদেরও জব্দ করা কি ঠিক?
রেমি বার দুই ঢোক গিলল। একটা আবেগ তাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। কান্না আসছে। শ্বশুর কেমন মানুষ তা সে জানে না, কিন্তু এই লোকটার মধ্যে সে এক গভীর স্নেহ ও অগাধ প্রশ্রয় পেয়েছে। কিছুতেই এই মানুষটাকে সে নিজের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে না।
রেমি ধরা-ধরা গলায় বলল, আমি কী করব তা বুঝতে পারছি না।
কৃষ্ণকান্ত একটু গম্ভীর গলায় বললেন, শোনো মা, ধ্রুবর বন্ধুরা তোমার বাপের বাড়িতে একটা অন্যায় হামলা চালিয়েছিল। তাতে বেয়াই বাড়িতে আমার মানসম্মান নষ্ট হয়েছে, বেয়াইমশাইয়েরও চূড়ান্ত অপমান হয়েছে। এটা তুমি নিশ্চয়ই বোঝো যে, ধ্রুব এ কাজ করেছে আমাকে আর বেয়াইমশাইকে অপ্রস্তুত করার জন্যই। অন্য কেউ হলে আমি আরও কঠিন ব্যবস্থা করতাম। কিন্তু সে আমার ছেলে বলেই বিচারের ভার নিজের হাতে না নিয়ে পুলিশের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। সেটা কি অন্যায় করেছি, বলো!
না, অন্যায় কেন হবে! ঠিকই করেছেন।
আমি জানি তুমি ওই দামড়াটাকে অসম্ভব ভালবাসো। অত ভালবাসা পাওয়ার যোগ্যতা ওর নেই। তাই ভাবছিলাম, বাপ হয়ে ছেলেকে পুলিশের হাতে দিচ্ছি বলে তুমি আমার ওপর আবার অসন্তুষ্ট না হও!
অসন্তুষ্ট হইনি তো!
হয়েছ মা, নইলে এতক্ষণ কথা বলছ অথচ একবারও আমাকে বাবা বলে ডাকোনি।
রেমি স্তব্ধ হয়ে রইল কিছুক্ষণ। কৃষ্ণকান্তকে ইচ্ছে করেই আজ সে বাবা বলে ডাকছিল না। সম্পর্ক তো সে শেষ করতেই চলেছে। এখন কী বলবে! তার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় বেদনা বোধহয় প্রিয়জনকে অকারণ আঘাত করার বেদনা।
রেমি স্তব্ধতা ভেঙে বলল, ঠিক তা নয়, বাবা।
কৃষ্ণকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, অত কঠিন হোয়য়া না, মা। আমি নানা কারণে বড় জর্জরিত। কিছুটা বোধহয় শুনেও থাকবে। এর মধ্যে তুমিও যদি ওরকম হও তাহলে আমি কোথায় দাঁড়াই বলো তোর
রেমি জানে, কৃষ্ণকান্ত এত দুর্বল প্রকৃতির মানুষ নন। তবে তিনি মানুষকে পটাতে ওস্তাদ। তবু এই চিনি মাখানো কথায় রেমি জেনেশুনেও ভিজল। একটু হেসে বলল, আমি তো এখনও পাকাঁপাকিভাবে কিছু ঠিক করিনি, আপনি ওরকম ভাবছেন কেন?
না বলে ধ্রুবর সঙ্গে পুরী গেলে মা, তাতে কিছু মনে করিনি। কিন্তু এখন যেসব কথা বলছ তাতে ভয় পাচ্ছি।
আমি কি কালীঘাটের বাড়িতে চলে যাব, বাবা?
কৃষ্ণকান্ত একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, না, আজ থাক। কাল আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেব। যদি তোমার মা বাবা অনুমতি করেন তাহলে চলে এসো। আজ বরং বিশ্রাম নাও।
আপনি যা বলবেন তাই করব, বাবা।
কোরো মা। আমি কাউকে খুব খারাপ পরামর্শ দিই না। তোমার স্বামী যদি আমার কথা ছিটেফোঁটাও শুনত তাহলে মানুষ হয়ে যেত।
রেমি আচমকাই বলে বসে, আপনি কেন ওর মুখোমুখি হয়ে জবাবদিহি করতে বলেন না!
আমি!–কৃষ্ণকান্ত যেন চমকে ওঠেন। তারপর স্তিমিত কণ্ঠে বলেন, আমি মাত্র একজনকেই দুনিয়ায় ভয় পাই, মা। তোমার স্বামীকে।