বিড়ির গন্ধটা নিমাইয়ের সহ্য হচ্ছিল না। বিড়ির মধ্যে যে কী মধু আছে কে জানে বাবা! লোকে সারাক্ষণ ফুসফুস করে টেনেই চলেছে, টেনেই চলেছে। বিটকেল ঝালো গন্ধটা কে এলেই নিমাইয়ের পেটে গোতলান মারতে চায় একটা অস্বস্তি। তবু সইতে হয়। না সয়ে উপায় কী? যার সঙ্গেই কথা কইতে যায় সেই দুচার কথার পর ফস করে একটা বিড়ি বা সিগারেট ধরিয়ে ফেলে। বিড়িই বেশী। সিগারেট বিড়িতে চারদিকটা ময়লাপ।
গণেশ সাহা মস্ত মানুষ। মণিমালা অপেরার মালিক। চিৎপুরে গদি। এরকম সব মানুষের সামনে এসে বসতে পারাটাই ভাগ্যের কথা। কত উমেদার আসে, দরজার বাইরে থেকেই খেদিয়ে দেওয়ার কথা। সেটা যে করেনি সেটাই সৌভাগ্য বলে বিবেচনা করছে নিমাই।
গনেশের বিড়ির ধোয়া সুতরাং সইতে হচ্ছে নিমাইকে। নাক চেপে থাকবে, তারও উপায় নেই। নাক চেপে থাকলে গনেশ সাহার অপমান হতে পারে।
কথা অবশ্য বীণাই কইছে। বলে-কয় ভাল। আগে একটু আলাপও ছিল। কাঁচড়াপাড়া যাত্রা উৎসবে দল নিয়ে গিয়ে বছরটাক আগে বিশ্ববিজয় অপেরার পালা দেখেছিল গণেশ। তখনই আলাপ। বীণা পায়ের ধুলো নিয়েছিল, গনেশ আশীর্বাদ করেছিল। সেসব আজ আর মনে থাকার কথা নয়। ছিল না গণেশের। আজও পায়ের ধুলে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল বীণা। পেরে ওঠেনি। ঘরখানা বড় ছোট, তার মধ্যে রাজ্যের টেবিল চেয়ার পাতা। আর গণেশ একখানা হাফ সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশে বসা। টেবিলের নিচে অতি দুর্গম জায়গায় তার পা। বীণা নিচু হয়ে যখন অন্ধকারে গণেশের পা খোঁজাখুঁজি করছিল তখন ঠকাস করে কপাল ফুকে গেল টেবিলের কানায়। গণেশ শশব্যস্ত হয়ে বলল, থাক থাক।
শিয়ালদায় নেমে চিৎপুর অবধি আসতেই তারা ঘেমে, হাপসে অস্থির! একখানা শহর বটে এই কলকাতা। কোনওদিকেই এগোনো যায় না। বাসে ট্রামে গন্ধমাদন ভিড়, রাস্তায় থিক থিক করছে মানুষ-পোকা, হকার, বাজার, রাগী আর তেড়িয়া সব বাঘ-ভালুকের মতো লোক। বাসে ট্রামে সুবিধে হল না বলে হেঁটেই আসতে হয়েছে। ঠিকানা খুঁজে বের করতে দম আরও বেরিয়ে গেছে। গলির গলি তস্য গলির মধ্যে এই ঘরখানা। বুকচাপা অন্ধকার। হওয়া নেই। লোড শেডিং বলে দিনের বেলাতেও মোম জ্বলছে। হাতপাখা হাতে মোটা মানুষ গণেশ বসা। বদ্ধ ঘরে গণেশের বিড়ির ধোয়া একেবারে আঁট হয়ে বসে আছে। নড়ছে না।
বীণা বলল, আপনি তো আমার পার্ট দেখেছেন গণেশদা। একবার চাঙ্গ নিয়ে দেখুন, প্রাণ দিয়ে করব।
গনেশ ভারি বিমর্ষ গলায় বলল, আরে ভাই, বায়নাই হচ্ছে না তো পার্ট, গত বছর এসময়ে অন্তত গোটা কুড়ি আগাম বায়না হয়েছিল। এবার তো মাছিও বসছে না।
কেন, মণিমালা অপেরার তো খুব নাম।
সে ছিল। পৌরাণিক পালাগুলো একসময়ে রে রে করে আসর মাতিয়ে দিত। তা এখন একটু অন্যরকম করতে গিয়ে মার খাচ্ছি। দুদুটো পালা বসে মার খেল। শাখা-সিঁদুর চলল না, সতীর জ্বালা তিন-চার জায়গায় হল,কিন্তু ক্ল্যাপই পেল না।
তা বলে তো আর দল বসে থাকবে না।
বসার মতোই অবস্থা। সিনেমার পাঁচু চাটুজ্জেকে সাতের দরে রাখলুম, তাতেও কিছু হল না। লোহার কারবারটা ছিল বলে রক্ষে, নইলে পেটের ভাতে টান পড়ত।
ওকথা বলবেন না। আপনার তো খুব নামডাক। এখন একটু পড়তি অবস্থা যাচ্ছে বলে কী, আবার বায়না হবে।
তা বিশ্ববিজয়ও তো ভালই করছিল। ছেড়ে আসতে চাও কেন?
বিশ্ববিজয় ভাল দল। কাকার মতোও মানুষ হয় না। কিন্তু বনগাঁয়ে চিরটা কালই কি পড়ে থাকব।
লাইম লাইটে আসতে চাও নাকি? সে বড় শক্ত কথা। রোজ কত ছেলে মেয়ে এসে ধরনা দিচ্ছে। অনেকে পয়সাকড়িও চায় না, শুধু একটা চান্স চায়। আমি বলি কি, বিশ্ববিজয় ছেড়ে না। এখানে তো খুব কম্পিটিশন, ওখানে তা নেই। বিশ্ববিজয় কম পয়সায় পালা করে, তাই বায়নাও হয়। আর আমাদের অবস্থা দেখ, হাতি পোর খরচ। বছরে কতগুলো মাস আর্টিস্টদের বসিয়ে বসিয়ে মাইনে দিতে হয়। আমরা কম পয়সায় করতে পারি না।
দেখবেন, বায়না ঠিকই হবে।
কোথায় আর হচ্ছে! শাখা-সিঁদুর আর সতীর জ্বালা এ দুটো পালায় কম পয়সা ঢেলেছিলাম? সবই কপাল। পালা দুটো চললে না হয় কথা ছিল।
আচ্ছা, আমার চেহারা তো খুব খারাপ নয়। পার্ট দেখেও তো লোকে ক্ল্যাপ দেয়। একেবারে কি ফেলনা ভাবছেন আমাকে?
গণেশ একথায় রাগ করল না। মাথা নেড়ে বলে, ওরে বাপু, চেহারা তো আমরা মেক-আপ আর আলো দিয়েই পেত্নীকে পরী বানিয়ে দিই। ওটা কোনও কথা নয়। চন্দ্রা মল্লিককে মেক-আপ ছাড়া দেখেছে কখনও রাস্তায় হেঁটে গেলে কেউ ফিরেও তাকাবে না। সেই চন্দ্রা যখন স্টেজে নামে তখন লোকে পাগল হয়ে যায়।
সে জানি। চন্দ্রাদির সঙ্গে আমার আলাপও আছে একটু।
নাম করে ফেললে সব দোষই ঢেকে যায়।
আমাকেও একটু নাম করতে দিন না। দেখবেন, ঠকবেন না।
গণেশ বিড়িটা একটা অ্যাশট্রের মধ্যে খুঁজে দিয়ে বলল, নতুন একটা পালা এবারে নামাচ্ছি। বাবু-বিবি। যদি এটা লাগে তাহলে তোমার কথা ভাববখন। এ সিজনটা যেতে দাও।
বীণা খুব আবদার মাখানো গলায় বলে, আমার কথা আপনার মনেই থাকবে না। এই তো বললেন, কত ছেলেমেয়ে আসছে পার্টের জন্য।
তা আসছে। মণিমালা অপেরার বুকের পাটা আছে বলেই নতুন আর্টিস্ট নামায়। সুনীতি বিশ্বাস, জয়ন্ত হালদার, যোগেন বোস এরা সবাই এই আমার হাতের তৈরি। সুনীতি নেমকহারামি করেনি, এখনও আছে। যদিও মেলা টাকা চাইছে আজকাল। আর যারা নাম করেছে সবাই বড় বড় দলে গিয়ে ভিড়েছে। তবু কি ভেঙে পড়েছি? আবার নতুনদের দিয়েই বছর চারেক আগে সাধক বামাক্ষ্যাপা আর ঝড়ের রাত নামিয়ে কেমন হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছিলুম!
সে আর বলতে! ঝড়ের রাত তো এই সেদিন অবধিও চলেছে।
সব নতুন মুখ ছিল। বুঝলে?
বাবু-বিবির কাস্টিং কি শেষ?
ও বাবা! শেষ কবে হয়েছে। রিহার্সালই তো চলছে পনেরো দিনের বেশি।
একটা ছোটখাটো রোলও কি পড়ে নেই?
তাই কি থাকে! আমাদের সব গোড়া বেঁধে কাজ করতে হয়। পুজোর সময় থেকেই পালা নামবে, আর কটা দিন হাতে আছে?
আর কটা দিন আগে এলে বোধ হয় ভাল করতুম, তাই না?
তা করতে। বড্ড দেরী করে ফেলেছে। তবে চিন্তা কিসের? বয়স কম, সুযোগ হয়তো পেয়ে যাবে। সঙ্গে এটি কে বলো তো!
বীণা একটু লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে বলল, আমার বর।
গণেশ পুরনো আমলের মানুষ। যাত্রাওয়ালির ঘর-সংসার আছে জেনে যেন খুশিই হল। বলল, বাঃ বেশ। তা তুমি কী করো হে বাপ।
নিমাই তটস্থ হয়ে বলল, এই টুকটাক।
বীণা তাড়াতাড়ি নিমাইয়ের আহাম্মক ঢাবার জন্য বলল, ফলের ব্যবসা আছে।
গণেশ প্রশান্ত মুখে বলল, খুব ভাল ব্যবসা। ফল শুদ্ধ জিনিস। তা গানটান জানোনা নাকি? একটু আগে যেন শুনছিলাম গুনগুন করে একটু গাইছিলে! কীর্তনের মতো!
ভারি লজ্জা পেয়ে গেল নিমাই। গান জানার ওই হল একটা মুশকিল। যখন তখন যেখানে সেখানে বে-খেয়ালে গলায় সুরটা খেলে ওঠে। মাথা নামিয়ে বলল, আজ্ঞে গানটান জানি না। হেঁড়ে গলায় কি আর গান হয়? একটু কীৰ্তন-টির্তন করি আর কি!
খুব ভাল। গলায় সুরও আছে মনে হচ্ছে। তা ফলও ভাল, কীর্তনও ভাল, কিন্তু কচি বউটিকে এই লাইনে ঠেলছে কেন? সংসার যে রসাতলে যাবে।
নিমাই আতান্তরে পড়ে গেল। কথাটা ন্যায্য বটে, কিন্তু প্রকাশ্যে কথাটার পো ধরা যায় না। বীণাপাণি ধর চোখে চেয়ে আছে। আমতা আমতা করে নিমাই যা বলল তারও কোনও মানে হয় না। সে বলল, আজ্ঞে, দিনকাল যা পড়েছে।
গণেশ সাহা আর একখানা বিড়ি ধরিয়ে বলল, আমার ছেলেরা সব লায়েক হয়েছে। বড়জনই এখন দলের কাজকর্ম। দেখছে। আমাদের সেকেলে রুচি সে বেশী পছন্দ করছে না। তার ইচ্ছে সিনেমার লোকজনকে টেনে আনে। কাস্টিং ভাল হলে, পালা যাই হোক, চলবে। আমার সঙ্গে মতে মেলে না, তবে মেনে নিতে হচ্ছে। এদের আমলে তো নতুনদের দলে ঢোকাই কঠিন হবে।
বীণার মুখখানা একেবারে ফ্যাকাসে মেরে গেল। ঘামছেও খুব! রুমালে মুখ মুছতে গিয়ে ঘামের সঙ্গে রূপটানের সবটুকুই প্রায় পুঁছে ফেলল। কেমন ন্যানো গলায় বলল, আমিও তো গান গাই।
গণেশ সাহা বিড়ির ধোঁয়ায় ঘরটাকে একেবারে জতুগৃহ বানিয়ে বলল, বলছি তো, সিজনটা শেষ হোক। দেখব।
আমার নাম ঠিকানা লিখে রাখুন তাহলে। নইলে ভুলে যাবেন।
গনেশ বোধ হয় বীণার হাত থেকে বাঁচার জন্যই অনিচ্ছে সত্ত্বেও এদিক ওদিক খুঁজে একটা কাগজের টুকরো আর ডটপেন বের করে নাম ঠিকানা টুকে নিল। তারপর বলল, এবার এসো গিয়ে।
নিমাই তড়াক করে উঠে পড়ল। যত তাড়াতাড়ি ঘরটা থেকে বেরনো যায় ততই মঙ্গল। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
বাইরে বেরিয়ে এসে বীণার কাঁদো-কাঁদো মুখটার দিকে চেয়ে খুব সন্তৰ্পণে জিজ্ঞেস করল, এবার কোথায় যাবে?
বীণাপাণি ঝাঝের সঙ্গে বলল, কেওড়াতলায়!
এ হল রাগের কথা। রাগের সময় লোককে ঘাঁটাতে নেই। বীণা একটা মস্ত বড় হাতব্যাগ বয়ে বেড়াচ্ছে। অত বড় ব্যাগ আনার দরকার ছিল না। ভারী জিনিস, ওর কষ্ট হচ্ছে। নিমাই হাত বাড়িয়ে বলল, ব্যাগটা বরং আমার হাতে দাও। তোমার কষ্ট হচ্ছে।
সঙ্গে সঙ্গে বীণাপাণি ব্যাগটা দ্বিগুণ জোরে পাঁজরে চেপে ধরে বলে, না। মেয়েদের ব্যাগ তুমি বাইবে কেন? খারাপ দেখাবে।
নিমাই একটু হাসল। মেয়েরা যেন কিছুতেই পুরুষদের বিশ্বাস করতে চায় না। নিমাই হাতটা গুটিয়ে নিয়ে বলল তেষ্টা পায়নি।
কেন বলো তো!
একটা ডাব খাবে নাকি? এখানে বেশ সস্তা।
আমার আর কিছু হবে না জানো?
কী হবে না।
কেউ নেবে না আমাকে। বিশ্ববিজয় অপেরা উঠে যাবে। তখন না খেয়ে বনগাঁয় পড়ে মরতে হবে।
এর জবাবে নিমাইয়ের কিছু বলার ছিল। কিন্তু গরম ঘেমমা দুপুরে চিৎপুরের পাগলকরা ভিড়ের গলিতে দাঁড়িয়ে কথাটা বলা যায় না। বললেও নেবে না বীণা। রেগে যাবে। মেজাজ বুঝে কথা না বললেই বিপদ। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
বীণা কোন দিকে যাবে তা যেন ঠিক করতে পারছে না। তার চোখে জল আসছে। ধরা গলায় বলল, এর পর বয়স হবে, রূপ যৌবন যাবে। কে পুঁছবে আমায় আর। মণিমালা অপেরার মতো ছোট দলই এত প্যাঁচ কষছে! বড় দলতো কথাই বলতে চাইবে না।
নিমাই জানে, এটা কোনও প্রশ্ন নয়। তাই জবাব দেওয়ার দরকার নেই। মুখে শুধু একটু কষ্টের ভাব ফুটিয়ে রাখা। যেন ওর দুঃখে বুক ফেটে যাচ্ছে তার। অভিনয় সেও একটু জানে। সবাই জানে। না জানলে কি জগৎসংসার চলত?
বীণাপাণি আরও কিছুক্ষণ ভিড়ের রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইল। ওর মাথায় কেন যেন ভূত চেপেছে আজকাল, বিশ্ববিজয় ছেড়ে বড় দলে ঢুকবে, কলকাতায় বাসা করবে। আরও অনেক কিছু। বীণাপাণিকে কিছু বোঝনোর নেই নিমাইয়ের। যা ভাল বুঝবে তাই করুক। তার দুর্দিনে বীণাপাণি যে তার জন্য অনেক করেছে সেটা ভোলে কি করে নিমাই? খারাপ অসুখ থেকে সারিয়ে তুলেছে। দোকান করে দেবে বলে ভরসা দিয়েছে। বীণাপাণি তো আর খারাপ মেয়ে নয়।
বশংবদ নিমাই বীণার কাছ ঘেঁষেই চিন্তিতভাবে দাঁড়িয়ে থাকে।
অনেকক্ষণ বাদে বীণা বলে, চলো।
চলো। কোনদিকে যাবে?
এমনি হাঁটি চলল। মনটা ভাল নেই।
সে তো জানি।
লোকটার কথা শুনে তোমার কী মনে হল বলো তো! সত্যিই ডাকবে আমাকে?
নিমাই সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যে করতে পারে না। বলল, এরা সব ঘুঘু লোক। মনের কথা বুঝতেই দেয় না।
তার মানে ডাকবে না, এই তো!
মনে তো হয়, না। ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে।
এদের কেউ পৌঁছে না, জানো? বায়না হয় না। তবু কেমন ডাঁট দেখাচ্ছে। ফিল্ম স্টার নিচ্ছে না হাতি! পাঁচু চাটুজ্জের কোনও বাজার আছে নাকি? ফিলে চান্স পায় না বলে যাত্রায় এসে ঢুকেছে।
তাই হবে। সাতের দর না কী একটা বলছিল যেন।
সাতের দর মানেও জানো না? মাসে সাত হাজার টাকা মাইনে। মণিমালা অপেরা দেবে সাতের দর, হুঁ!
হাঁটতে হাঁটতে তারা চিৎপুরের ট্রাম রাস্তায় এসে ওঠে।
হ্যাঁ গো, তুমি ফোন করতে পারো?
ফোন! কাকে করবে?
বড়দার বাড়িতে।
জরুরী কথা আছে নাকি? দুপুরে কি বড়দাদা বাড়িতে থাকবেন? অফিস নেই।
তাই তো! মনে ছিল না। তাহলে চলো আর দু-একটা গদিতে যাই।
নিমাই একটু নিবে গিয়ে বলে, যাবে!
যাই না। বড় জোর ঘাড় ধাক্কা দেবে, তার বেশী তো আর নয়। তা আজকের দিনটা ঘাড় ধাক্কা খেয়েই যাক।
একটু চেনাজানা না থাকলে কি গিয়ে সুবিধে হবে?
একেবারে যে নেই তা নয়। পুষ্প অপেরার ম্যানেজার পানুবাবুর সঙ্গে তো কাকা একবার আলাপ করিয়ে দিয়েছিল।
নিমাই মিয়নো গলায় বলে, সে কি আর মনে রেখেছে।
চলোই না দেখা যাক। গদিটা কাছেই কোথাও হবে।
আবার খুঁজতে খুঁজতে দুজনে হয়রান হয়। পুষ্প অপেরাও ছোট দল, বাজারে তেমন নাম নেই। তবে ধৈর্য ধরার একটা মূল্য তো আছেই। অবশেষে একটা গলির শেষে পুরনো একটা দোতলা বাড়ির ওপরের তলায় পুষ্প অপেরার একটা রংচটা সাইন বোর্ড দেখতে পাওয়া গেল।
পুরনো ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে উঠে একখানা টানা বারান্দার একেবারে শেষ ঘরখানায় পুষ্পর অফিস। দুজন লোক বসা। একজন বোধ হয় কোনও জ্যোতিষী। সেই বিষয়েই কথা হচ্ছিল।
অন্য জন পানুবাবুই। কাঁচা পাকা চুলের মাঝবয়সী মানুষ। বেশ শৌখিন পোশক। আদ্দির পাঞ্জাবি, হাতে তিন রকম পাথরের আংটি, গলায় সোনার চেন। কালোর মধ্যে চেহারা মন্দ নয়।
বীণা এবার আর পা খুঁজল না। খুব শিক্ষা হয়েছে। তবে জোড় হাতে নমস্কার করে বলল, পানুবাবু, চিনতে পারছেন?
পানুবাবু চিনতে পারলেন না। বা চিনতে চাইলেন না। একটু চেয়ে থেকে বললেন, না তো! তুমি কোথা থেকে আসছো?
বনগাঁ। বিশ্ববিজয় অপেরায় পার্ট করি। কাকা আলাপ করিয়ে দিয়েছিল আপনার সঙ্গে। মনে নেই?
অ। বোসো, বোসো। কাকার খবর কী? ভাল আছে তো!
আছে। আমি একটা আবদার নিয়ে এসেছি।
এখানেও লোডশেডিং। তবে সুখের কথা হল, পানুবাবু বা জ্যোতিষী বিড়ি খাচ্ছে না, আর ঘরখানা দোতলায় বলে একটু আলো-হাওয়া আছে। নিমাই বসে মৃদু মৃদু ঠ্যাং নাচাতে লাগল। কথাবার্তা যা হবে সে যেন আগে থেকেই তা জানে।
বীণা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, আমি যদি দলে আসতে চাই তাহলে নেবেন।
পানুবাবু মৃদু একটু হাসলেন। তারপর বললেন, সে তো খুব ভাল কথা। কিন্তু দল কোথায়?
কেন, দল উঠে গেছে নাকি?
এইবার তুলে দেবো। লোকে যা চায় তা দিতে পারছি কোথায়? পেরেও উঠব না।
তাহলে আমার কী হবে? অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম যে!
আমরাই মাইনে পাচ্ছি না ঠিকমতো। গত বিশটি বচ্ছর ম্যানেজারি করে এখন গুনাগার দিতে হচ্ছে। কর্তা আর টাকাপয়সা ঢালবেন না। বড় বড় দলের চাপে আমাদের এখন নাভিশ্বাস উঠছে। কয়েক লাখ টাকা ঢাললে তবে একটু তোলা। যায় হয়তো। টাকারই জোগাড় নেই।
বীণা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, এবার আপনাদের পালা নামছে না?
পানুবাবু একটা মাছিকে তাড়ানোর জন্য হাতের ঝাঁপটা মেরে বললেন, দুটো পুরনো প্লে নামবে। কয়েকটা বায়না হয়েছে। দেখা যাক।
তাতে হয় না?
পুরনো লোকরা সব রয়েছে যে! তাদের তো আর তাড়াতে পারি না।
নতুন মুখও তো দরকার হয়। হয় না?
দরকার হলেই বা উদ্যোগ কে নেবে বলো! স্বয়ং মালিকেরই গা নেই। তার এখন নানা ব্যবসা। খুব ফলাও অবস্থা।
যাত্রার বাজার তো এখন খুব ভাল।
আরে ভাল তো বড় বড় নামকরা দলগুলোর কাছে। আমাদের নয়।
জ্যোতিষী লোকটার চেহারা বেশ পরিপাটি। গলায় রুদ্ৰাক্ষ আর কপালে একটা সিঁদুরের ফোঁটা আছে। মিটিমিটি দেখছিল দুজনকে।
নিমাইয়ের মাথাটা এই গরমে আর রোদে একটু গোলমালই হয়ে গিয়ে থাকবে। হঠাৎ জ্যোতিষীর দিকে চেয়ে বলে ফেলল, আজ্ঞে, হাত দেখাতে কত দক্ষিণা লাগে?
জ্যোতিষী লোকটা একটু অবাক হল যেন। একটু হাসল, তারপর বলল, কেন, হাত দেখাতে চান নাকি?
কখনও দেখাইনি কাউকে। ভাগ্যটা বিশেষ ভাল যাচ্ছে না।
জ্যোতিষী মিটিমিটি হেসে বলল, কেমন যাচ্ছে! কাজকর্ম নেই নাকি?
নেইই বলতে পারেন।
দেখি হাতটা।
নিমাই হাতটা লুকিয়ে ফেলে বলে, আজ্ঞে, দক্ষিণাটা না জেনে দেখাই কি করে? পরে পয়সা দিতে না পারলে?
পয়সা লাগবে না।
বলেন কি? বিনা পয়সায় কি কিছু হয়?
আমি ওরকম জ্যোতিষী নই।
নিমাই চেয়ার বদল করে জ্যোতিষীর পাশে এসে বসল। হাতখানা মেলে দিয়ে বলল, দেখাতে একটু-ভয় ভয়ও করে। কি জানি কী লেখা আছে হাতে! হয়তো অপঘাতে মৃত্যু।
পানুবাবু একটা দেশলাই কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছেন। আড় চোখে দেখছেন এদিকে। বীণা একটু অবাক চোখে চেয়ে আছে। নিমাই এমন অদ্ভুত কাণ্ড কখনও করে না।
জ্যোতিষী হাতটা মন দিয়ে মিনিট খানেক দেখল। তারপর ছেড়ে দিয়ে বলল, অপঘাতে মরবেন না।
নিজের এই হঠাৎ করে হাত দেখানোর কাটা ঘটিয়ে নিমাইয়েরও এখন লজ্জা লজ্জা করছে একটু। বিনয়ে বিগলিত হয়ে বলল, বাঁচা আর মরা সমানই হয়ে এসেছে। কেমন দেখলেন হাতখানা?
জ্যোতিষী একটু হাসল। বলল, সবটাই কি কারও ভাল বা মন্দ হয়। তবে আপনি লোক খারাপ নন।
একটা ব্যবসা করার খুব ইচ্ছে। হবে?
এ হাত ব্যবসাদারের হাতই নয়। তবু করুন।
এই রে, একেবারে জল ঢেলে দিলেন যে!
কত বয়স হল।
সে সব কি আর হিসেব আছে? ত্রিশের কাছাকাছি তো হবেই। বেশীও হতে পারে।
ত্রিশের পর একটু ভাল হতে পারে।
জীবনে হাত দেখায়নি নিমাই। জ্যোতিষীরা কিরকম বলে-কয় তার ধারণাও ছিল না। অবাক হয়ে বলল, কিরকম ভাল হবে।
জ্যোতিষী একটু হেসে বলে, দেখুন না কি হয়!
নিমাই ভাল, বিনা পয়সায় যথেষ্ট হয়েছে। হাতটা সরিয়ে নিল সে।
বীণা উঠল। পানুবাবুকে বলল, আসি তাহলে।
এসো গিয়ে। কাকার দলে আছো এখনও?
আছি।
চলছে কেমন?
খারাপ নয়। তবে মফস্বলের দল তো।
তাতে কি? মফস্বল কি আর ভাল হয় না?
দুজনে ফের বেড়িয়ে পড়ল। রাস্তায় এসে বীণা বলল, হ্যাঁ গো, তুমি হঠাৎ হাত দেখালে কেন?
নিমাই লজ্জা পেয়ে এক গল হেসে বলে, সবাই দেখায়। শখ হল।
খুব বিদঘুটে লোক আছো তুমি! বলে হাসল।
তুমি কিছু মনে কররানি তো!
করেছি। পয়সার কথা বলছিলে কেন? পয়সা লাগলে কি দিতে পারি না আমরা?
ও বাবা! খামোখা হাত দেখিয়ে নষ্ট করার মতো পয়সা কি আমাদের আছে?
আচ্ছা, একটা সত্যি কথা বলবে আজ?
বলব না কেন? কী জানতে চাও?
আমি দেখতে কেমন?
নিমাই অবাক হয়ে হেসে ফেলল, কেন, হঠাৎ আবার সন্দেহ হচ্ছে নাকি? বনগাঁয়ে তো তোমার রূপের সুখ্যাতি সবাই করে।
ছাই করে। তুমি হচ্ছে এক নম্বরের মিথ্যুক। যদি আমি সুন্দরীই হবো তাহলে লোকে পাত্তা দিচ্ছে না কেন?
পাত্তা দিচ্ছে না কে বলল? এদের অবস্থা টাইট। সব গরিব দল। তোমার উচিত বড় বড় দলের কাছে যাওয়া।
তারা আরও পাত্তা দেবে না। আমি দেখতে একটুও সুন্দর নই।
নিমাই যেন নতুন করে বউকে একটু দেখল ভাল করে। তারপর বলল, তাহলে তাদের চোখ নেই।
আচ্ছা, তুমি তো ভগবানের লোক। তুমি যখন বলছ তখন চলে একটা বড় দলের গদিতে যাই।
আজই?
আজই! আমাদের কি আর রোজ রোজ কলকাতায় আসা হয়? চলো।
নিমাই একটা শ্বাস ফেলে বলে, চলো।