রেমি মাথা ঠান্ডা রেখে শান্ত গলায় প্রশ্ন করল, বাচ্চাটা যে তোমার নয় এরকম একটা কথা তুমি কি মনে করো?
ধ্রুব মাথা নাড়ল, কী জানি। হতে পারে।
আমি জানতে চাই এরকম ধারণা তোমার কেন হল!
ধারণা আমার নয়। আমি আজকাল তলিয়ে কিছু ভাবতেই পারি না।
তাহলে ধারণাটা কার?
ধ্রুব খাওয়া থামিয়ে পিছনে হেলান দিয়ে খুব অপ্রতিভ মুখে একটু হেসে বলল, এসব নিয়ে আকচা-আকচি কি এখনই করতে হবে? আমি ড্যাম টায়ার্ড।
টায়ার্ড আমিও। তোমাকে নিয়ে।
আমাকে ছেড়ে দাও না কেন? তোমার কি কোনও প্রেমিক নেই, আমাকে ছেড়ে দিয়ে যার কাছে ফিরে যেতে পারো?
না। আমরা সেরকম মানুষ নই।
তোমরা কীরকম মানুষ তাহলে? সর্বংসহা সতী সাধ্বী? মাইবি, এই সব টাইপ নিয়েই পুরুষদের যত ঝামেলা।
আমি এখনও তেমন ঝামেলা করিনি, কিন্তু করব! কথাটার জবাব দেবে?
ধ্রুব উঠে বেসিনে আঁচিয়ে এসে বলল, ঘরে চলো।
ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিল ধ্রুব। তারপর সিগারেট ধরিয়ে বলল, কথাটা বেস বেবিয়ে গিয়েছিল সেদিন। যেতে দাও। আর হবে না।
ওটা কোনও এক্সপ্লানেশন নয়। কথাটা বোস বেরোয়ওনি। যদি কথাটাই বড় হত তাহলে তুমি আমাকে মিথ্যে বুঝিয়ে পেটের বাচ্চাটা নষ্ট করতে না। আরও কিছু আছে।
ধরো, ঠিক এই সময়ে আমি বাচ্চা চাইছিলাম না।
সেটা আমাকে বলতে পারতে। ডিসিশনটা আমরা দুজনে মিলেই নিতাম।
তুমি নিতে পারতে না রেমি। তুমি একটু সেকেলে টাইপের।
দেখো, আমার সঙ্গে এখন চালাকি কোরো না। আমার মন ভাল নেই। আমাকে নিয়ে খেলা পুতুলের মতো যা খুশি অনেক করেছ। ব্যাপারটা শেষ হওয়া দরকার।
ধ্রুব কি একটু ভয় পেল? হবেও-বা। তার মুখ-চোখে কিন্তু জলে-পড়া ভাব ফুটে উঠছিল।
ধ্রুব খানিকক্ষণ নীরবে সিগারেট টেনে গেল। তারপর হঠাৎ বলল, ওরকম ধারণার কথা কেউ মুখ ফুটে বলেনি। কিন্তু তবু এ বাড়ির বাতাস শুকলে কখনও কখনও তুমি মানুষের মনোভাব টের পাবে। অবশ্য খুব সেনসিটিভ নার্ভ থাকা দরকার।
তাই নাকি? কিন্তু আমি ওসব বুজরুকি শুনতে চাই না। আসল কথাটা বলো।
সেটাই বলার চেষ্টা করছি। ধারণাটা আমার নয়। অন্য কারও। কিন্তু ধারণাটা আমাদের ভিতরে ঠিকই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তুমি শিলিগুড়ি গেছ। সমীরও সেখানেই আছে। সমীর এবং তুমি তোমাদের দুজনের মধ্যে কী রিলেশন তা আমি জানি না। ইন্টারেস্টেডও নই। কিন্তু দেয়ার ইজ এ হামিং অ্যাবাউট ইট।
ছিঃ ছিঃ!
ব্যাপারটা হয়তো নিতান্তই ছিঃ ছিঃ। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। শুনেছি তোমার শ্বশুর সমীরকে কলকাতায় ডেকে পাঠিয়েছিল। জরুরি কাজে। সে আসেনি।
তোমরা এত হীন?
তুমি আর কতটাই বা জানো? আমরা তার চেয়েও হীন। সেইজন্যই তোমাকে বলি, এ বাড়ির বনিয়াদ ভাঙতে থাকো। সব মুখোশ খুলে দাও।
আমার বাচ্চাটা যে তোমার নয় একথাটা কে প্রথম তোমাকে বলে?
ধ্রুব অবাক হয়। বলে, কেউ তো বলেনি!
তাহলে?
বললাম তো, কেউ মুখ ফুটে বলে না। কিন্তু সন্দেহের বীজ বাতাসে ছড়িয়ে দেয়। আর বাতাসেই সব বার্তা সবাই জানতে পেরে যায়।
আমি ওসব বিশ্বাস করি না। কিন্তু শুধু সন্দেহের বশে একটা বাচ্চাকে খুন করা কি মানুষের কাজ, পিশাচের?
পিশাচের। এ ব্যাপারে আমি তোমার সঙ্গে একমত।
যাতে কিছুতেই, কোনও রক্তৃপথেই এ পরিবারের রক্তে কোনও কলুষিত রক্ত ঢুকতে না পারে, সেই জন্য?
অবিকল তাই।
রেমির চোখ-মুখ অস্বাভাবিক তীক্ষ আর গনগনে হয়ে উঠছিল। তবে সে ধ্রুবকে আক্রমণ করল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কিন্তু এ ঘানা আমি ঘটাব।
কী ঘটাবে?
তোমাদের রক্তের বিশুদ্ধতার শুচিবাই আমাকে ভাঙতেই হবে।
ধ্রুব উদাস গলায় বলে, ভাঙাই উচিত। ভাঙো।
আমি তোমার পারমিশান চাইনি।
চাওনি, তবু আমি দিলাম। এমনকী এ ব্যাপারে আমি তোমার সঙ্গে কো-অপারেটও করতে পারি।
তার মানে?
আমি বলছি, তোমার এই ভেনচারে আমার সায় আছে। আমি হেলপও করতে পারি।
রেমি এই অদ্ভুত ও কিম্ভুত লোকটার দিকে হতবুদ্ধির মতো চেয়ে রইল। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, তুমি কি বিশ্বাস করো যে, সমীরের সঙ্গে আমার সত্যিই কিছু হতে পারে? এটা কি সম্ভব?
ধ্রুব মৃদুস্বরে বলে, আমার মতামত চাইছ কেন?
তুমি আমার স্বামী, তোমার মতই আমার কাছে সবচেয়ে ইমপরট্যান্ট।
আমি নামকোবাস্তে স্বামী।
সে তো ঠিকই। তবু আমার জানা দরকার, কথাটা তুমি বিশ্বাস করো কি না।
ধ্রুব একটু সময় নিল। নিজের নখগুলোর দিকে চেয়ে রইল অনেকক্ষণ। তারপর একটা শ্বাস ফেলে বলল, অনেকক্ষণ ভ্যাজরং-ভ্যাজরং করছি। আর ভাল লাগছে না।
বলবে না? কথাটা আমার যে জানা ভীষণ দরকার।
কেন, আত্মহত্যাফত্যা করবে নাকি?
সেটা জানার পর ঠিক করব।
আজকাল এসব আকছার হয়। আত্মহত্যা-ফত্যা করে বোসো না। তাহলে তোমার শ্বশুরের পলিটিক্যাল কেরিয়ার ফিনিশ হয়ে যাবে।
রেমি ঠান্ডা মাথাতেই বলে, বলো।
ধ্রুব মাথা নাড়ল, না করি না।
সত্যি বলছ?
বলছি।
তাহলে? তাহলে বাচ্চাটা নষ্ট করলে কেন?
বহুত জেরা করছ ভাই।
একথাটার জবাব দাও।
শুধু একথার জবাব দিলেই হবে?
হবে।
আমার ধারণা তোমার প্রেগন্যান্সি সম্পর্কে কারও সন্দেহ হয়েছিল। সে চায় এই বংশের ধাবায় কোনও বরক্ত এসে যেন না মেশে। এবং তার সেই সন্দেহের সম্মান রাখতেই ঝামেলাটা করতে হয়েছিল।
তিনি কি শ্বশুরমশাই?
হতে পারে। তবে আমাকে কৃষ্ণকান্তবাবু এম এল এ এবং মাননীয় মন্ত্রী নিজের মুখে কিছু বলেননি। তবে সন্দেহটা এ বাড়ির বাতাসে জীবাণুর মতো সংক্রামিত হয়েছিল।
তোমাকে তো কেউ নিশ্চয়ই বলেছিল!
না। আমি টের পেয়েছিলাম।
এটা কি আমাকে বিশ্বাস করতে বলো?
বলি। আমি প্রয়োজনে মিথ্যে কথা বলি। অপ্রয়োজনে নয়।
আমি আজই তোমাদের বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি।
উইশ ইউ গুড লাক। তৈরি হয়ে নাও।
রেমি উঠল এবং বাস্তবিকই একটা ছোট ব্যাগ গোছাতে লাগল।
ধ্রুব অলস চোখে ব্যাপারটা দেখতে দেখতে কয়েকবার হাই তুলল।
তারপর উঠে পোশাক পরে বেরিয়ে গেল।
কাউকেই কিছু বলল না রেমি। কারও অনুমতি নিল না। তার মাথা আর বুক জুড়ে একটা ঘৃণা রাগ আর ধিক্কারের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সে কিছু সঠিক ভাবে চিন্তা করতে পারছে না। উচিত-অনুচিতে বোধ লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
বাপের বাড়িতে এসে দুদিন প্রায় নির্বাক রইল রেমি। কারও প্রশ্নের জবাব দেয় না। কারও দিকে তাকায় না। শুধু গভীর রাতে বালিশে মুখ ঠেসে ধরে কেঁপে কেঁপে কাঁদে।
আশ্চর্য এই, তিন দিনেব মধ্যেও তার শ্বশুরবাড়ি থেকে কেউ খোঁজ করতে এল না। ব্যাপাবটা অস্বাভাবিক। রেমির বাপের বাড়ির সকলেই খানিকটা চিন্তিত উদ্বিগ্ন। কিন্তু রেমির মুখে কিছু না শুনে তারাও কৃষ্ণকান্ত বা ধ্রুবকে কিছু জিজ্ঞেস করতে ভরসা পায় না। রেমির বাপের বাড়িতে ফোন নেই, থাকলেও ও বাড়ির থেকে কেউ খোঁজ করত কি না কে জানে।
চতুর্থ দিন অফিস থেকে ফিরে রেমির বাবা নিশ্চিন্ত গলায় বললেন, আজ কৃষ্ণকান্তবাবুর সেক্রেটারি আমার অফিসে ফোন করেছিলেন।
উদ্বিগ্ন রেমির মা বললেন, কী কথা হল?
এমনি। রেমি কেমন আছে জানতে চাইল।
আর কিছু বলল না?
না।
আমি তো মেয়ের ভাবগতিক ভাল বুঝছি না। ওরা বাঙাল মানুষ, মেয়ে বোধহয় মানিয়ে নিতে পারছে না।
শুধু বাঙাল নয়, জামাই বাবাজিও সুবিধের লোক নয়। এখন বুঝতে পারছি না বিয়েটা দিয়ে ঠিক কাজ করেছি কি না।
ছোট বাড়ি। পরিসর কম। সব কথাই রেমির কানে যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে বিস্ফোরণ ঘটে। সে আর সব সহ্য করতে পারে, শুধু ধ্রুবর প্রসঙ্গটা বাদে। ওই একটা বিষয় নিয়ে কেউ কিছু বলুক তা সে সইতে পারে না।
রেমি কাউকে কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করল না। এমনকী জিনিসপত্র পর্যন্ত গোছাল না। হাতব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে ট্যাকসি ধরল। সোজা শ্বশুরবাড়ি কালীঘাট।
ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল সে।
ধ্রুব খুব রাত করল না। এমনকী মদ খেয়েও আসেনি। বেশ ক্লান্ত চেহারা। বোধহয় অফিসে খাটতে হয়েছে।
ঘরে ঢুকে থমকে গিয়ে বলল, আরে! আমি ভাবছি ওদিকে তুমি এ বাড়ির তলায় ডিনামাইট ফিট কবার জন্য গর্ত খুঁড়তে লেগেছ! আর তুমি নিজেই রিটার্ন পোস্টে ব্যাক করলে?
করলাম। তোমার কি একটু অসুবিধে হল?
আরে না। তুমি থাকলে একটু ঘেঁষাঘেঁষি হয় বটে, স্পেস কমে যায়, কিন্তু তাতে কী?
আমি থাকলে তোমার স্পেস কমে যায়?
তা একটু কমবারই তো কথা। এক ঘরে দুজন থাকলে।
শ্বশুরমশাই দোতলায় আমার ঘর ঠিক করে রেখেছেন, তা তো জানোই।
জানব না কেন! আমি বেশি মাতলামি করলে তুমি গিয়ে সেই ঘরে কত দিন থেকেও ছিলে।
এখন যদি পাকাপাকিভাবে ওপরেই থাকি?
থাকো। এ গুড ডিসিশন। ওয়াইজ।
তোমার সুবিধে হবে? সত্যিই হবে?
আঃ মাইরি! তুমি বহুত বকাবাজ আছে।
আজ তো মদ খাওনি, তবু ওরকম রকবাজের মতো কথা বলছ কেন?
একটু দিল্লাগি করছি।
তোমার ইয়ার্কি আমার ভাল লাগছে না। তুমি আমাকে সহ্য করতে পারো না কেন?
পারি না কে বলল? খুব পারি।
না পারো না।
বাপের বাড়িতে কী হল? ওখানেও খিচ লেগেছিল নাকি?
না। আমি নিজেই থাকতে পারিনি।
বিরহ নাকি!
হতে পারে।
তুমি খুব অদ্ভুত আছ। সেলফ-রেসপেক্ট নেই।
নেই। তুমি আমার খোঁজ নাওনি কেন?
নেওয়ার কথা ছিল বুঝি?
কথা ছিল না। তবু নিতে পারতে!
আমি ভাবলাম তুমি ওখানে গিয়ে বেশ আছে। খামোকা ঝামেলা মাচিয়ে লাভ কী?
না, তা ভাবোনি।
তবে কী ভেবেছি বলো তো অন্তর্যামী?
তুমি আমার কথা মোটেই ভাবোনি।
ধ্রুব খুব চিন্তিতভাবে নিজের মাথায় দুটো টোকা মেরে বলল, ভাবিনি। সত্যিই ভাবিনি নাকি? ঠিক জানো! না, এক-আধবার নিশ্চয়ই ভেবেছি।
ইয়ার্কি কোরো না। তুমি জানো, বাপের বাড়িতে মেয়েদের স্বামীর জন্য কতটা অপমান সইতে হয়?
কে অপমান করেছে তোমাকে?
তা শুনে আর কী হবে?
তবু বলো। ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে।
কেউ আমাকে অপমান করেনি। করেছো তুমি।
আমি? আমি কী করলাম?
খোঁজ নাওনি। একবার যাওনি। শুধু তুমিই নও। এ বাড়ির কেউ খোঁজ করেনি।
তুমি কদিন হল গেছ?
তাও মনে নেই? চার দিন।
ওঃ চার দিন! আমি ভাবছিলাম, কাল-পরশুই একবার যাব।
উঃ মুখে আসেও সব মিথ্যে কথা!
না, সত্যিই একবার ভেবেছিলাম কিন্তু।
রেমি একটু হাসল। ম্লান হলেও হাসিটা তার বুক থেকেই উঠে এল। সাজানো নয়। মাথা নেড়ে সে বলল, জানি, সব জানি।
ধ্রুব তার মুখোমুখি বসে বলল, তবু আমার ওপর সত্যিকারের রাগ করতে পারছ না?
রেমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, পারছি। আমার সব রাগ এখন তো তোমারই ওপর। কিন্তু সে রাগেব তো কোনও দাম নেই।
কে বলল তো?
যে রাগের দাম দেয় তার ওপরেই রাগ করা যায়।
ধ্রুব মাথা নেড়ে বলল, মেয়েমানুষকে আমি ভাল চিনি না, বুঝলে! মাকে যদি পেতাম, বুঝতাম।
ওটা কোনও কথা হল না।
ওটাই কথা। তুমি বুঝবে না। ওটাই কথা।
ওটা তো অতীত। বহু দিন পার হয়ে গেছে।
ধ্রুব মাথা নাড়ে, অতীত হলে বেঁচে যেতাম। মা এখনও রোজ আমার মনে এসে হানা দেয়। না, কথাটা ঠিক হল না। মার সবটুকু নয়। শুধু একটা দৃশ্য। সারা গায়ে আগুন, তার মধ্যে মা–আমার ভীষণ ফরসা মা কালো থেকে আরও কালো হয়ে যাচ্ছে। বীভৎস!
রেমি সম্মোহিতের মতো চেয়ে থাকে। কতদিন নিজেকে নিয়েও একরকম দৃশ্য কল্পনা করেছে সে। কেরোসিন ঢেলে গায়ে আগুন দেবে, নয়তো গলায় ফাঁস আটকে ঝুলবে, বিষ খাবে।
ধ্রুবর মায়ের কথা খানিকটা শুনেছে রেমি। বেশি শুনতে চায়নি সে। তার মনে হয়েছে মায়ের ঘটনাটাকে ধ্রুব সুকৌশলে বাপের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে কাজে লাগাচ্ছে। শোক এত দীর্ঘস্থায়ি হয় না কখনও।
রেমি বলল, ওরকম একটা দৃশ্য এখন দেখতে তোমার কেমন লাগবে?
তার মানে?–ধ্রুব একটা কল্পনার স্তর থেকে নেমে এল।
যারা গেছে তারা তো গেছেই, যারা আছে তাদের ধরে রাখতে হবে তো!
ধ্রুব গম্ভীর হল। বলল, হুঁ।
আমি তোমাকে ভয় দেখাচ্ছিলাম না।
ধ্রুব জামাকাপড় পালটাতে লাগল। তারপর বলল, শ্বশুরের সঙ্গে দেখা করেছ?
না।
উনি কদিন খুব দুশ্চিন্তা করছেন তোমার জন্য।
তাই বুঝি খোঁজ নেননি।
খোঁজ নিতে ওঁর সম্মানে লাগে হয়তো। বিশেষ করে পুত্রবধূর বাপের বাড়িতে। কিন্তু কথাটা বিশ্বাস করতে পারো। এ কয়দিন উনি ভাল করে খাননি, ভাল ঘুমোননি। শুনেছি আমার উদ্দেশে অজস্র কটুকাটব্যও করেছেন।
রেমি খুশি হয়ে বলল, তোমার দোষ কী?
ওঁর ধারণা আমার জন্যই তুমি রাগ করে বাপের বাড়ি গেছ। অথচ প্রকৃত ব্যাপারটা জানার কোনও উপায় নেই। অক্ষম আক্রোশে এই চারদিন উনি কনটিনিউয়াস ফ্রঁসেছেন।
রেমি উঠে পড়ল। বলল, যাই গিয়ে বলে আসি যে, আমি এসেছি।
ধ্রুব গম্ভীর হয়ে বলল, যাও। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো। উনিই সেই ভিলেন যিনি রক্তের বিশুদ্ধতায় বিশ্বাসী। উনিই সেই খলচরিত্র যিনি তোমাব চরিত্রের ইন্টিগ্রিটিতে বিশ্বাস স্থাপন করতে পেরে সমীরকে কলকাতায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন। উনিই সেই—
রেমি হাতজোড় করে বলল, দয়া করে চুপ করবে?
কেন বলো তো!
আমি সব জানি।
তবু মনে করিয়ে দিলাম। লোকটাকে যতটা শ্রদ্ধা করা উচিত নয় ততটা কোরো না।
আমি অত হিসেব জানি না। শুধু এটুকু জানি, সব সত্ত্বেও উনি আমাকে স্নেহ করেন।
স্নেহ নয় ভাই, গাড্ডা। গভীর গাড্ডা।
হোক গে। আমি তো গাড্ডাই চাই। তুমি তো তাও দিতে পারোনি।
আমি আর উনি! মন্ত্রীর ভালবাসার দাম কত বেশি!
রেমি রাগ করে চলে গেল।
কিন্তু কৃষ্ণকান্ত তখনও ফেরেননি। কোথায় একটা সেতু উদ্বোধন করতে গেছেন। ফিরতে রাত হবে। নাও ফিবতে পারেন।
তবে কিছুক্ষণ রাইটার্সে ফোনে চেষ্টা করে জেলা শহরের সার্কিট হাউসের নম্বর জোগাড় করল রেমি।
কৃষ্ণকান্ত তার গলা শুনেই সোল্লাসে টেলিফোনে চেঁচিয়ে উঠলেন, ফিরেছ মা, ফিরেছ! বাঁচালে!
আপনি ফিরবেন না বাবা?
ঠিক ছিল, আজ আর ফিরব না। কিন্তু তুমি যখন ফিরেছ তখন আর কথা কী! এক্ষুনি রওনা হচ্ছি।
দুঘণ্টার মধ্যেই কৃষ্ণকান্ত ফিরলেন। দু-তিন ঘণ্টার মোটরদৌড়ের পরও তার মুখে হাসি উপচে পড়েছে। চোখ চিকমিক করছে আনন্দে।
রেমি বুঝল, এই আত্মম্ভরী কুসংস্কারাচ্ছন্ন নিষ্ঠুর ও আত্মকেন্দ্রিক লোটার কাছ থেকেও তার মুক্তি নেই। স্নেহের মতো শক্ত বাঁধন আর কী আছে? খুনি ডাকাত বাপকেও তার মেয়েটা সর্বস্ব দিয়ে ভালবাসে। রাত্রে রেমি যখন ফিরল তখন ধ্রুব বই পড়ছে। অদ্ভুত সব বই পড়ে সে। শক্ত বিষয়। খটোমটো।
বইটা এক টানে নিয়ে রেখে দেয় রেমি। বলে, এবার তোমার সঙ্গে বোঝাপড়া।
ধ্রুব একটু হাসল। কী অদ্ভুত মাদক হাসি। রেমির পায়ের তলায় ভূমিকম্প হতে লাগল। বুক উথাল-পাথাল।