রেমি কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, ব্যাপারটা কী। তাদের বাচ্চা হবে, তাতে দুশ্চিন্তা বা ভয়ের কী? সে অবাক হয়ে ধ্রুবকে বললে, ওরকম করছ কেন?
ধ্রুব একটু হাসবার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, খবরটা এখন চেপে যাও।
তার মানে?
কাউকে কিছু বোলো না।
কেন বলব না?
কারণ আছে, তাই।
রেমি রেগে গিয়ে বলল, কী কারণ তা আমার জানা দরকার।
ধ্রুব বিব্রত মুখে বলে, কারণটা এখনই বলতে পারছি না।
জীবনে প্রথম মা হতে চলেছে রেমি, এই সংবাদ তার ভিতরে যে রোমহর্ষ, যে রহস্যময় আনন্দের এক অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি করেছিল তা এক ফুৎকারে উড়ে গেল। তীব্র অপমানে ঝা ঝা করতে লাগল মুখচোখ। সে ধ্রুবর জামা খিমচে ধরে বলল, তোমাকে বলতেই হবে! তোমাকে বলতেই হবে! কী দোষ করেছি আমি?
ধ্রুব নিজেকে ছাড়িয়ে নিল না। শুকনো ঠোঁট জিব দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে বলল, আসলে কী জানো? আমাদের পরিবারের প্রথম সন্তান বাঁচত না। লোকে বলে, কে বা কারা যেন বিষ নজর দিয়ে এই অপকর্মটি করে। আমি অবশ্য এই সব কুসংস্কার বিশ্বাস করি না। কিন্তু এই পরিবারের বউ পোয়াতি হলে খবরটা গোপন রাখাই নিয়ম। না হলে নাকি নজর লাগে।
একথায় রেমির রাগটা একটু ধাক্কা খেল। খানিকক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে সামলে সে বলল, কিন্তু এ খবর কি গোপন রাখা যায়?
যায়।–ধ্রুব মৃদু গলায় বলল, লোকের সামনে না বেরোলেই হয়।
সেটাও কি এই পরিবারের নিয়ম?
তাই তো জানি।
তোমরা শহরে বাস না করে আফ্রিকার জঙ্গলে গিয়ে থাকলে ভাল হত। সেখানে মানাত তোমাদের।
ধ্রুব কাতর গলায় বলল, মানছি। কিন্তু তবু যে পরিবারে এসেছ সেই পরিবারের প্রচলিত নিয়মগুলো খামোকা ভাঙতে যেয়ো না।
তা বলে দশ মাস ঘরবন্দি থাকতে হবে?
তা নয়। বেরোবে মাঝে মাঝে। কিন্তু নিজের মুখে এখনই খবরটা কাউকে দিতে যেয়ো না।
রেমি ফুঁসতে লাগল, কিন্তু আর ঝগড়া করল না ধ্রুবর সঙ্গে। তবে তার মনে একটা সন্দেহ ওত পেতে রইল। ধ্রুব বোধহয় কথাটা বানিয়ে বলেছে। নজর লাগার ব্যাপারটা একদম বাজে। সম্ভবত এই অযৌক্তিক অনুরোধের পিছনে অন্য কোনও গৃঢ় কারণ আছে।
পরদিনই ধ্রুব তাকে নিয়ে গেল একজন গায়নোকোলজিস্টের কাছে। ডাক্তারটি গোমড়ামুখো এবং কম কথার লোক। তবে ডাক্তারের অ্যাসিস্ট্যান্ট মেয়েটি ভারী হাসিখুশি এবং ছলবলে। রেমিকে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা সে-ই করল। তারপর বলল, আপনি প্রেগন্যান্ট, একথা কী করে জানলেন?
রেমি অবাক হয়ে বলল, কেন বলুন তো! নই নাকি?
মনে তো হচ্ছে না।
কিন্তু আমি সব লক্ষণই টের পাচ্ছি।
মেয়েটি হেসে বলল, ওরকম কত ফিলিং হয় মেয়েদের!
তবে আমার কী হয়েছে?
মনে হচ্ছে ভিতরে একটা ব্লাড ক্লট প্যাসেজে আটকে আছে। ওটাকে রিমুভ করা দরকার।
কেন?
ওটা থাকলে নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। বেশিদিন থাকলে ক্যানসার অবধি হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়।
আপনি সেন্ট পারসেন্ট শিয়োর?
তা অবশ্য নই। তবে কাল আপনাকে একটা ক্লিনিকে ভর্তি হতে হবে। আরও পরীক্ষা আছে। তারপর হয়তো একটা মাইনর অপারেশন করতে হবে।
রেমির মনটা আবার ঝাৎ করে ওঠে। কেমন একটা সন্দেহ ঘুলিয়ে ওঠে মনে। কিন্তু ডাক্তারের যা চকচকে চেম্বার, নানারকম গ্যাজেট, অ্যাসিস্ট্যান্টের হাবভাবের মধ্যে উঁচুদরের পেশাদারি দক্ষতা এসব দেখে সে উচ্চবাচ্য করল না। সে ডাক্তার নয়, বিশেষজ্ঞ নয়, সে কী করে সব কিছু জানবে?
কিন্তু সন্দেহ ছিল। বারবার উসখুস করে উঠছে একটা অস্বস্তি, অজানা ভয়। ফেরার পথে গাড়িতে সে ধ্রুবকে জিজ্ঞেস করল, এরা কারা?
কারা মানে?
উনি কি খুব ভাল ডাক্তার?
খুব ভাল। যে-কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারো।
জিজ্ঞেস করতে হবে না, রেমি জানে। খুব উঁচুদরের ডাক্তার ছাড়া কৃষ্ণকান্তর পুত্রবধূর চিকিৎসা আর কেউ করবে না।
রেমি মৃদুস্বরে বলল, ব্লাড ক্লট না কী যেন বলছিল মেয়েটা। ওরকম কি হয়?
না হলে বলছে কেন?
মা-মাসিদের কারও এরকম হয়েছে বলে শুনিনি।
শোনোনি বলেই কি হতে নেই?
আমার কেমন ভয় করছে। অন্য কোনও ডাক্তারকে দেখালে হয় না?
কাকে দেখাতে চাও?
আমার বাপের বাড়ির ডাক্তার হলেন অমিত গুপ্ত। ভাল গাইনি।
ধ্রুব একটু অবাক হয়ে রেমির দিকে চেয়ে বলল, বাপের বাড়ি?
রেমি সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। তার খেয়াল ছিল না, ধ্রুবদের পরিবারে যারা বউ হয়ে আসে তাদের অতীত মুছে ফেলেই আসতে হয়। কোনও সূত্রেই বাপের বাড়ির সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বিশেষ থাকে না। কথায়-কথায় বাপের বাড়ির রেফারেন্স দেওয়া বারণ, বাপের বাড়ির কোনওরকম সাহায্য নেওয়া বারণ, এমনকী ছোটখাটো নিমন্ত্রণেও সেখানে যাওয়া নিষেধ। রেমির অবশ্য এই নিয়ম মেনে নিতে খুব একটা অসুবিধে হয়নি। কৃষ্ণকান্ত তাকে অগাধ স্নেহ দিয়ে ঘিরে রেখেছেন, দেওরননদদের কাছ থেকেও সে যথেষ্ট আদর আর সহানুভূতি পায়। একমাত্র স্বামীটিই যা অন্যরকম। তবু এই সুদর্শন ও অদ্ভুত মানুষটির প্রতি এক রহস্যময় আকর্ষণ এবং একে আবিষ্কার করার এক নাছোড় নেশা রেমিয় শূন্যস্থানটি ভরিয়ে রেখেছে। বাপের বাড়িকে সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল, কিন্তু ধ্রুবর ওই বাপের বাড়ি? প্রশ্নটি উচ্চারণে যে প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপ টের পেল সে, তাতে মন ফুসে উঠল হঠাৎ।
রেমি শান্ত গলায় বলল, হ্যাঁ। আমার বাপের বাড়ির রুগি দেখেন বলে তো আর অমিত গুপ্ত পচে যাননি।
রেমির কথার ঝঝে ওর মনের অবস্থাটা টের পেয়েই বোধহয় ধ্রুব কথাটা ঘুরিয়ে নিল। বলল, ভয় পেয়ো না রেমি, তোমাকে যিনি দেখছেন তিনি দেশের সবচেয়ে ভাল ডাক্তারদের একজন।
জানি। তবু বড় ডাক্তারদেরও ভুল হয়। আমি আর-একজন ডাক্তারকে দেখাতে চাই।
বেশ। দেখাবে।
কথা রেখেছিল ধ্রুব। পরদিন আরও একজন বড় ডাক্তার রেমিকে দেখল এবং অনেক রকম প্রশ্ন করল। কিন্তু রেমির প্রশ্নের জবাব দিল না। একটু স্নেহসিক্ত হাসিমুখে এড়িয়ে গেল বারবার।
রেমি কিছুতেই বুঝতে পারল না, তার গোলমালটা কী।
ফেরার সময় গাড়িতে ধ্রুব একটু হেসে জিজ্ঞেস করল, আরও ডাক্তার দেখাবে? আরও আছে। কিন্তু!
রেমি স্থির চোখে সামনের দিকে চেয়ে উউনডস্ক্রিনের আয়ত চতুষ্কোণে দ্রুত গুটিয়ে আসা রাস্তা দেখছিল শূন্য চোখে। একটা চক্রান্ত! একটা গণ্ডগোল! একটা অদ্ভুত ও অর্থহীন ষড়যন্ত্র! নইলে তার বাচ্চা হবে শুনে প্রথম দিনই ধ্রুব অমন সাদা হয়ে গেল কেন?
রেমি ধ্রুবর কথার জবাব দিল না। বাড়ি ফিরে এসে শুধু বালিশে মুখ ঠেসে ধরে গোপনে কাঁদল কিছুক্ষণ।
পরদিন একটা চমৎকার ক্লিনিকে ভর্তি হল সে। প্রথমূবারের গোমড়ামুখো ডাক্তারটি এত নিপুণভাবে সেই রহস্যময় জমাট রক্তটি বের করে নিল যে রেমি কোনও শারীরিক যন্ত্রণা প্রায় টেরই পেল না। কিংবা পেলেও তা প্রকাশ করল না একটুও। দুটো দৃঢ়বদ্ধ ঠোঁট বজ্রের মতো এঁটে থেকে ভিতরকার সব যন্ত্রণার শব্দকে আটকে রাখল। পরদিন একটু সাদা, একটু ক্লান্ত এবং একটু বিষণ্ণ চেহারা নিয়ে সে ফিরে এল বাড়িতে। ধ্রুবর সঙ্গেই।
ধ্রুব সেদিন কোনও কথা বলল না। ঠাট্টা নয়, সান্ত্বনা নয়, কিছু না। সেই রাতেই সে অফিসের কাজে চলে গেল বোম্বাই। সাত দিন আর তার কোনও খবর নেই।
সেই সাত দিনের মধ্যেই অবশ্য কৃষ্ণকান্ত বিদেশ থেকে ফিরলেন। প্রচুর জিনিসপত্র এনেছেন। সেগুলো আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে হই হই করে বিলোলেন। রেমির জন্য এনেছিলেন ফরাসি ও জারমান কয়েক রকম সুগন্ধ, বিখ্যাত সব শিল্পের দামি প্রিন্ট, সোনার বালার সেট করা ঘড়ি, কাট গ্লাসের কিছু জিনিস।
এত দামি সব উপহার পেয়েও যে রেমির মুখে সত্যিকারের খুশি উপচে পড়ল না এটা লক্ষ করেছিলেন কৃষ্ণকান্ত। বুদ্ধিমান মানুষ তাই প্রথমেই জেরা করেননি। পরদিন রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে উচ্চকিত হয়ে উঠলেন, সেই দামড়াটা কই? সেটা আবার কোথায় গেল?
দামড়াটা যে কোনওকালেই কৃষ্ণকান্তর সঙ্গে বসে খায় না এটা সবাই জানে। তবু অভিনয়টা দেখালেন ভালই। রেমির দিকে চেয়ে বললেন, এই তল্লাটে আছে, না হিল্লিদিল্লি কোথাও গেছে?
নতমুখে রেমি বলল, বোম্বাই। অফিসের কাজে।
অফিস!–কৃষ্ণকান্ত চোখ বড় বড় করে বলল, আবার চাকরিতে ঢুকেছে নাকি? কোন কোম্পানির সর্বনাশ করছে এবার?
খাওয়ার পর রেমিকে স্টাডিতে ডেকে নিয়ে সুদর্শনের মেয়ের বিয়ে সম্পর্কে সব খুঁটিয়ে শুনলেন। সুদর্শনের সঙ্গে তার কতকালের ও কেমন বন্ধুত্ব তারও অনেক মজার ঘটনা বললেন। তারপর খুব নিরীহভাবে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাকে কেন এত রোগা দেখছি মা? দামড়াটার সঙ্গে কিছু আবার হয়নি তো!
না।–মৃদুস্বরে রেমি বলে।
কৃষ্ণকান্ত খুব উদার গলায় বলেন, আমি তো তোমাকে বলেই দিয়েছি, লোকে কন্যা সম্প্রদান করে, আমি করেছি পুত্র সম্প্রদান। কী করলে ওর ভাল হয় তুমি বুঝে দেখো। লাঠৌষধিতেও আমার আপত্তি নেই।
রেমি জবাব দিল না।
কৃষ্ণকান্ত একটা কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আসলে রক্তটা তো খারাপ নয়। কুসঙ্গে পড়েছে। বলে ওরকম। আদর্শ নেই, লক্ষ নেই, আত্মনিয়ন্ত্রণ নেই। এই যুগের ছেলেরা যেমন হয় আর কী। সবচেয়ে বড় কথা, দেশাচার লোকাঁচার বা ট্র্যাডিশনের প্রতিও শ্রদ্ধা নেই। আমি একটু প্রাচীনপন্থী ঠিকই। কিন্তু এটাও ঠিক যে, একটা দেশের প্রথা, লোকাঁচার, অভ্যাসের মধ্যেই একটা জাতির ব্যক্তিত্ব। মাঝেমধ্যে সেইসব প্রথা প্রকরণের সংশোধন পরিমার্জন করতে হয়, কিন্তু বিনাশ করা ভাল নয়। কিন্তু এই দামড়াটা যে যুগে জন্মেছে এটা হল ব্যক্তিত্বহীনতার যুগ। কী মানে, কী মানে না, সেটাও বোঝে না ভাল করে। ওকে কেউ যদি স্বক্ষেত্রে ফেরাতে পারে তো সে তুমি। বলেছি তো, রক্তটা খারাপ নয়, একটু শুধু গোড করা দরকার।
রেমি অনেকক্ষণ শুনল। তারপর খুব মৃদু স্বরে বলল, আপনি চিন্তা করছেন কেন? আমার সঙ্গে কোনও গণ্ডগোল হয়নি। অফিসের কাজেই বোম্বাই গেছে।
কৃষ্ণকান্ত একটু অবাক হয়ে বললেন, তা হলে তোমার এ চেহারা কেন? শরীর ভাল তো?
রেমি একটু দ্বিধা করল। তারপর বলল, একটু খারাপ হয়েছিল। এখন সেরে গেছে।
কৃষ্ণকান্ত একটা নিশ্চিন্তের শ্বাস ফেলে বললেন, তা হলেই ভাল। তোমার জন্য আমি খুব ভাবি। একটু বেশিই ভাবি।
রেমি সেটা জানে। তার কথা কৃষ্ণকান্ত ভাবেন। দুনিয়ার আর-কেউ যদি না-ও ভাবে, তবু কৃষ্ণকান্ত ভাবেন। রেমির সামান্য গাম্ভীর্য বা ক্ষণিক বিষণ্ণতাও তার নজর এড়ায় না। একজন ব্যস্ত মন্ত্রী এবং রাজনীতিবিদের পক্ষে সেটা এক মস্ত স্নেহের প্রকাশ। আর এই জন্যই এই লোকটির প্রতি রেমিরও আছে এক অন্ধ ভক্তি ও শ্রদ্ধা। অন্ধই। কারণ রেমি জানে, লোকটি স্বেচ্ছাচারী, আত্মম্ভরী, পরিবার-সচেতন এবং ক্ষমতাপ্রিয়।
কৃষ্ণকান্ত সেদিন ভারী নরম হয়ে পড়লেন। আস্তে আস্তে নিজের জীবনের কিছু কথা বললেন রেমিকে। বললেন, মাতৃস্নেহ কাকে বলে আমি জানি না। তোমার শাশুড়ির সঙ্গেও আমার সম্পর্ক ছিল সামান্য। আমি হয় জেল খাটতাম, না হয় আন্দোলন করে দেখোদ্ধারে মেতে থাকতাম। ছেলেবেলায় একমাত্র ছিল আমার ছোড়দিদি আর বাবার সঙ্গ। সেও বড় একটা পাওয়া যেত না। বাবা ছিলেন গম্ভীর ও অন্যমনস্ক মানুষ। ছেলের দিকে নজর দেওয়ার রীতিও ছিল না তখন। তবু ছিটেফোঁটা যা ভালবাসা পেয়েছিলাম তা তার কাছ থেকেই। সেটুকুই সম্পদ।
কৃষ্ণকান্ত খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে নিচু ও অদ্ভুত করুণ গলায় বললেন, মা গো, নিজের জনেরা কেউ আমাকে মানুষ বলেই ভাবল না। তারা ভাবে, আমি বুঝি নরদেহে এক পাথরের মূর্তি। আমার বুঝি-বা হৃৎপিণ্ড নেই, মগজ নেই, বোধশক্তি নেই, সুখদুঃখ নেই। বাইরের লোকেরা আমাকে যে চোখে দেখে, ঘরের লোকেরাও সেই চোখে দেখে। একজন নেতা। আর কিছু নয়।
তা কেন বাবা?
কৃষ্ণকান্ত খুব মলিন একটু হেসে বললেন, তোমার কথা বলিনি। একমাত্র তুমিই বোধহয় একটু আলাদা। একটু অন্যরকম। কিন্তু বেশির ভাগ সংসারই মানুষের সদগুণগুলি নষ্ট করে দেয়। ছাড়ানকাটান নেই। ভাবি ওই দামড়াটার সঙ্গ করে করে তুমিও বুঝি একদিন আমাকে ঘেন্না করতে শিখে যাবে।
রেমি প্রায় কেঁদে ফেলেছিল। ধরা গলায় বলল, না বাবা, কক্ষনও নয়।
কিন্তু প্রতিজ্ঞাটা টেকেনি রেমির। টিকল না ধ্রুবর জন্যই।
বোম্বাই থেকে ধ্রুব ফিরলই মাতাল অবস্থায়। কিংবা এও হতে পারে, এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি আসার পথে কোথাও নেমে গলা অবধি খেয়ে এসেছিল। এসেই সদর দরজায় দাঁড়িয়ে চেঁচাতে লাগল, ভাঙো, ভাঙো, ভেঙে ফেললা বাড়ি ঘর। রোলার চালিয়ে দাও। বদমাশ, খুনিয়া, শয়তান, ভণ্ড এইসব মানুষের মুখোশ খোলো। শালারা পলিটিকস করে! আঁ! পলিটিকস! খোয়াড়ে ছাগলগুলো পর্যন্ত এদের চেয়ে অনেক বেশি ওয়েল-বিহেভ৬।
লোকজন গিয়ে ধরে আনল ধ্রুবকে। ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল।
কিন্তু তারপর দিন থেকেই ধ্রুব ফিরে গেল তার পুরনো চরিত্রে। সারাদিন মদ খায় হল্লা করে। কখনও বাড়ি ফেরে, কখনও ফেরে না। বোম্বাই থেকে ফেরার পর প্রায় মাসখানেক ধ্রুবকে স্বাভাবিক অবস্থায় দেখল না রেমি।
কৃষ্ণকান্ত দোতলায় আলাদা একটা ঘর ঠিক করে দিয়ে বললেন, ওঘরে তোমার অসুবিধে হলে এখানে এসে থেকো। দামড়াটা কখন কী কাণ্ড করে বসে তার তত ঠিক নেই।
রেমি সেইটেই সঙ্গত প্রস্তাব বলে মেনে নিয়েছিল। ধ্রুবর ঘরে রাত্রিবাস সে প্রায় ছেড়েই দিল। তা বলে যে ধ্রুব তাকে কোনওদিন প্রশ্ন করেছে তাও নয়। প্রশ্ন করলে বা জোর করে রেমিকে ধরে নিয়ে গেলেই বোধহয় রেমি খুশি হত। কিন্তু ধ্রুব সেই ধাতুতে গড়া নয়।
রেমি একদিন টের পেল, ধ্রুব সন্ধেবেলায় তার ঘরে আছে এবং খুব একটা হল্লা করছে না। চেঁচিয়ে কার কাছে যেন জল চাইল এবং ঘরের টেবিল-ল্যাম্পের বালবটা ফিউজ হয়ে গেছে বলে কিছুক্ষণ রাগারাগি করল। তারপর চুপচাপ।
রেমিকে ভূতে পেল সেদিন। ধ্রুবকে ধরতেই হবে আজ। ওর মুখ থেকে শুনতে হবে, কেন ও এরকম।
পা টিপে টিপে রেমি নেমে গেল নীচে। ভেজানো দরজা ফাঁক করে দেখল, ধ্রুব বিছানায় আধশোয়া হয়ে বই পড়ছে। এই একটা কাজ ধ্রুব করে। খুব বই পড়ে। প্রায়ই সেগুলো অর্থনীতি বা সমাজদর্শন বা অনুরূপ কঠিন বিষয়ের বই।
রেমি ঘরে ঢুকে বইটা বিনা ভূমিকায় কেড়ে নিয়ে বলল, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
ধ্রুব বিরক্ত হয়ে বলল, তোমার অত কথা কীসের?
থাকলে কী করব?
আমার বেশি কথা ভাল লাগে না।
আমি কি বেশি কথা বলি?
তা একটু বলো। মেয়েরা বড্ড বাজে বকে।
আমি জানতে চাই, তুমি এরকম করছ কেন?
কী রকম করছি।
আবার মদ খাচ্ছ!
আমি তো বরাবর খাই। যোলো-সতেরো বছর বয়স থেকে।
মাঝখানে খেতে না তো!
ধ্রুব বিরক্ত হয়ে বলল, খাই তো নিজের পয়সায় খাই। তোমার বাপের পয়সায় খাই না, তোমার শ্বশুরের পয়সাতেও খাই না।
পয়সার কথা উঠছে না। খাও কেন? কী হয়েছে?
কিছু একটা হয়েছে।
আজ খেয়েছ?
খেয়েছি।
কতটা?
বেশি নয়। তিন পেগ। নেশা হয়নি। এখন আবার খাব। তুমি সেফলি কেটে পড়ে ওপরের ঘরে গিয়ে দরজা দাও। পারলে শ্বশুরকে দরজায় পাহাবা বসিয়ে রেখো। লাঠি হাতে গোঁফে তা দিতে দিতে বউমাকে পাহারা দেবে, যেন ছেলে গিয়ে তার সতীত্ব নষ্ট না করে।
তুমি গেলে কি আমার সতীত্ব নষ্ট হয়? যাও না কেন? গেলেই তো পারো। গিয়ে দেখো, কেউ তোমাকে আটকায় কি না।
ইজ ইট অ্যান ইনভিটেশন?
ধরো তাই।
আমি দোতলায় উঠি না। ওটা একজন নখদন্তহীন অথর্ব ও কুম্মাণ্ড মন্ত্রীর এলাকা।
উনি তোমার বাবা।
যা, দুর্ভাগ্যক্রমে।
ঠিক আছে, ওপরে যেতে না চাও, না যাবে। আমি কি আসব?
না। তোমাকে আমার দরকার তো নেই।
তোমাকে আমার আছে।
না, আমাকেও তোমার দরকার নেই।
আমার ওপর রাগ করেছ?
না। আলমারি থেকে হুইস্কির বোতলটা বের করে আনো। খেতে খেতে একটু কথা কই।
রেমি দাঁতে দাঁত পিষে তাই করল। ধ্রুবর মুখ থেকে তার কথা বের করাটা দরকার। অনেকটা হুইস্কি খাওয়ার পর ধ্রুব বলল, কী বলতে এসেছ?
তুমি আবার মদ খাচ্ছো কেন?
আমার খুব দুঃখ হয়েছিল, তাই।
কীসের দুঃখ?
বাচ্চাটার জন্য।
কোন বাচ্চা?
আমার বাচ্চা।
রেমি কেঁপে উঠল। বলল, কী বলছ?
ধ্রুব মাথা নাড়ল, ওটা ব্লাড ক্লট নয়। বাচ্চা।