1 of 3

০১৪. ভোটে জিতে কৃষ্ণকান্ত মন্ত্রী হয়েছেন

ভোটে জিতে কৃষ্ণকান্ত মন্ত্রী হয়েছেন। বাড়ির আবহাওয়াটা খুবই ভাল। ফুরফুরে একটা আনন্দের হাওয়া বয়ে যাচ্ছে সবসময়ে। সেই আনন্দটা রেমিকেও ছোঁয়। এমন এক বাড়ির সে বউ, যে বাড়িটা সর্বসাধারণের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ এ বাড়ির লোককে সম্ভ্রম এবং খাতির করে। কৃষ্ণকান্ত এলেবেলে মন্ত্রী নন। বহুদিন ধরেই এক নাগাড়ে তিনি বেশ কয়েকটা ভারী দফতর চালিয়েছেন। তার সুনাম এবং প্রতিষ্ঠা নিখাদ। অতীতটাও স্বর্ণগর্ভ। স্বদেশি আমলে মার খেয়েছেন, জেল খেটেছেন, কৃচ্ছসাধনও কিছু কম করেননি। এখনও অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপন করেন। মোেটা খদ্দরের ধুতি, সাধারণ পাঞ্জাবি পরেন, সামান্য অনাড়ম্বর খাবার খান, কম ঘুমোন। মোটামুটি একটা গাঁধীবাদী গন্ধ আছে তাকে ঘিরে। শুধু মেজাজটা কিছু চড়া, প্রতাপ সাংঘাতিক।

একদিন রেমিকে ডেকে বললেন, রামছাগলটা আবার চাকরি ছেড়েছে জানো?

রেমি জানত না। মাথা নিচু করে রইল।

কৃষ্ণকান্ত বললেন, আটশো টাকা মাইনের চাকরি। এ বাজারে কিছু কম নয়। কেন ছাড়ল তা তোমাকে বলেছে?

উনি আমাকে কিছু বলেন না।

বলার পাত্র নয়। তোমাকে মানুষ বলে জ্ঞান করে না। আমাকেই করে না তো তুমি! ছাগলটাকে জিজ্ঞেস কোরো তো কেন ছাড়ল।

করব।

কৃষ্ণকান্ত একটু ভেবে বললেন, তোমাকে হয়তো বলবে না। তবে আমি খানিকটা আন্দাজ করতে পারি। চাকরিটা ছিল একটা প্রাইভেট ফার্মে। আমার চেনা ফার্ম। বোধহয় আমার সঙ্গে খাতির রাখতেই ওরা ছাগলটাকে ডেকে নিয়ে চাকরি দিয়েছিল। সেটাতে বোধহয় বাবুর অপমান হয়ে থাকবে। বাপের খাতিরে ওর মতো লাটসাহেব চাকরি করবে কেন! কিন্তু বউমা, আমি বুঝি না ছাগলটার কোয়ালিফিকেশনটাই বা কী যে খাতির ছাড়া আটশো টাকা মাইনের চাকরি জোগাড় করবে। ওকে একথাটাও জিজ্ঞেস কোরো।

রেমি মাথা নত করেই ছিল। জবাব দিল না। সে জানে, ধ্রুবর চাকরি ছাড়াটা এমন কিছু দারুণ ঘটনা নয়। এর আগেও কয়েকবার ছেড়েছে। আবার চাকরি পেয়েও গেছে। না পেলেও তো ক্ষতি নেই। ধ্রুবর রোজগারের পয়সা এ বাড়ির কেউ হেঁয়ওনি, এমনকী রেমি পর্যন্ত না। মাইনের টাকায় সে কী করে তা কেউ জানেও না, খবরও নেয় না।

কৃষ্ণকান্ত কিন্তু উত্তেজিত গলায় বললেন, চিরটা কাল এরকম যাবে না, বুঝলে বউমা? আমরা যৌবনে কেবিয়ার তৈরির কথা ভাবতাম না ঠিকই। কিন্তু তখন আমাদের সামনে একটা পজিটিভ লক্ষ্যবস্তু ছিল। দেশকে স্বাধীন করতে হবে। কিন্তু এখনকার ইয়ংগার জেনারেশনের সামনে ওরকম কিছু তো নেই। ওই গর্ভস্রাবটার তো আরও নেই। সামনে একটা পলিটিক্যাল ক্রাইসিস আসছে। চিরকাল তো আমি ক্ষমতায় থাকব না। মরতেও একদিন হবে। তখন ওর গতিটা হবে কী?

রেমি একথার জবাব দিল না। ইদানীং ধ্রুবর সঙ্গে তার সম্পর্কটা ভালই যাচ্ছিল। ধ্রুব অবশ্য বউ নিয়ে সিনেমায় যাওয়া বা রেস্টুরেন্টে খাওয়া ইত্যাদি হালকা পলকা ব্যাপারে নেই। প্রেমে গদ গদ ভাবেরও তার অভাব। উপরন্তু সে কমপ্লিমেন্ট দিতে জানে না। কোনওদিন রেমিকে সে বলেনি, বাঃ, তুমি তো খুব সুন্দর! কিন্তু রেমি অতটা আশাও করে না ধ্রুবর কাছ থেকে। ধ্রুব যে রোজ বাড়ি ফেরে, তার সঙ্গে স্বাভাবিক দু-চারটে কথাবার্তা কয় এবং এক বিছানায় শোয় সেইটেই যথেষ্ট বলে ধরে নিয়েছে রেমি। এর চেয়ে বেশি ভালবাসা প্রকাশের ক্ষমতাই ধ্রুবর নেই। রেমি মনে মনে ভগবানকে বলে, এটুকু বজায় থাকলেই যথেষ্ট। আমি আর বেশি চাই না। সুতরাং ধ্রুবর চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ঘটনায় সে স্বামীর ওপর একটুও চটল না। সে জানে, কারও অধীনে কাজ করা বর পক্ষে শক্ত। অন্যে হুকুম করবে আর ধ্রুব তা তামিল করে যাবে এমনটা তার সম্পর্কে যেন কল্পনাই করা যায় না।

কৃষ্ণকান্ত বললেন, শোনো মা, ওর সঙ্গে তোমারও ভবিষ্যৎ জড়ানো। ওর কেরিয়ারটা তৈরির ভার তুমিও একটু নাও। ওকে বোঝাও, শাসন করো।

রেমি বলল, আপনি ভাবছেন কেন? একটা কিছু ঠিক করবে।

সেটা আর কবে হবে? চাকরি করতে যদি না চায়, ব্যাবসা করুক। কিন্তু সেটাও কি করবে? টাকা হাতে পেলেই ফুঁকে দিয়ে বসে থাকবে। বাপের হোটেলে থাকে বলে টের পায় না কত ধানে কত চাল। কিন্তু দেশ কালের অবস্থা তত সুবিধের নয়। ওকে একটু বুঝিয়ে বোলো।

একথাটা একটু বিঁধল রেমিকে। ধ্রুব বাপের হোটেলে খায় বটে, কিন্তু সে আরও অনেকেই খায়। কথাটা শ্বশুরমশাই রেমির সামনে না বললেও পারতেন।

ধ্রুব কয়েকদিন যাবৎ মদ খাচ্ছে না। সেদিনও ধ্রুবকে রাত্রি স্বাভাবিক অবস্থায় পেয়ে গেল রেমি। বিছানায় শুয়ে একটা অর্থনীতির বই পড়ছিল। কয়েকদিন যাবৎ-ই অখণ্ড মনোযোগে বইটা পড়ছে। থার্ড ওয়ার্ল্ড ইকনমি।

রেমি বইটা কেড়ে নিয়ে পাশে বসে বলল, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।

ধ্রুব বিরক্ত হলেও সেটা প্রকাশ করল না। বলল, মেয়েদের অত কী বলার থাকে বলে তো!

আজকের কথাটা ইমপর্ট্যান্ট।

কোন কথাটা ইমপর্ট্যান্ট নয় তোমার?

বাবা আজ আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

ডেকে পাঠানোর কী? তুমি তো সবসময়েই শ্বশুরের আশেপাশে পোষা বেড়ালের মতো ঘুরঘুর করছ বাবা।

তা করছি। তবু আজ ডেকে কয়েকটা কথা বললেন তোমার সম্পর্কে।

ওঃ হ্যাঁ, কথা একটা বলার আছে বটে। আমি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি।

কিন্তু সেটা আমাকে জানাওনি। অথচ আমি তোমার স্ত্রী।

চাকরি ছাড়লে স্ত্রীকে বলার একটা সাংবিধানিক নিয়ম আছে বোধহয়!

আছে। আমি জানতাম না।

তুমি অনেক কিছুই জানো না। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, আমাকে যখন বিয়ে করেছ, তখন আমারও ইচ্ছে করে স্বামীর রোজগারে খেতে পরতে। ইচ্ছেটা কি অন্যায়?

অন্যায় তো বটেই। তোমাকে আমি আজও বিয়ে করিনি। তোমার শ্বশুর আমার সঙ্গে তোমাকে জুটিয়ে দিয়েছেন। খাওয়া পরার ব্যাপারটা ওঁর সঙ্গেই ফয়সালা করে নাও গো

তোমার মুড পালটে যাচ্ছে।

ধ্রুব হেসে বলল, না। আমি ভাল মুডে আছি। চাকরি না থাকলে আমি সব সময়েই ভাল মুডে থাকি।

চাকরি ছাড়লে কেন?

আমার ভাল লাগে না। আমাদের বংশে কেউ কখনও চাকরি করেনি। ওটা আমার ধাতে নেই।

তুমি যে বাপের হোটেলে খাও তা নিয়ে শ্বশুরমশাই আজ একটু খোটা দিলেন। সেটা আমার ভাল লাগেনি।

সত্যকে সহ্য করাই তো ভাল।

কেন করব উপায় থাকতে?

উপায়টা কী?

তোমাকে রোজগার করতে হবে।

খামোকা রোজগার করে কী লাভ? বাবার মেলা টাকা। আমরা কভাই ছাড়া খাবে কে?

তবু সেটা বাবার টাকা, তোমার তো নয়।

বাবারও পুরোটা নয়। বলা ভাল, পূর্বপুরুষদের টাকা। তাতে বাবারও যা অধিকার আমাদেরও তাই।

সেটা উনি যখন থাকবেন না তখন দেখা যাবে। আমার স্বামী যে অক্ষম নয় আমি সেটা প্রমাণ করতে চাই।

শ্বশুরের অপমানের শোধ নেবে নাকি?

যদি বলি তাই?

লোকটা ঝানু পলিটিসিয়ান। অপমান গায়ে মাখে না। তুমি যে শোধ নিয়েছ তা হয়তো বুঝতেই পারবে না।

বোঝাতে চাইও না। আমি ওঁকে আর অপমান করার সুযোগ দিতে চাই না।

আমি চাকরি বা রোজগার করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?

খানিকটা যাবে।

কী ভাবে?

আমরা আলাদা বাসা করে সংসার পাতব।

ধ্রুব কথাটা শুনে হঠাৎ উঠে বসল। রেমিকে দুহাতে ধরে স্থির দৃষ্টিতে মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে মৃদু একটু হেসে বলল, আমি একথাটাই তোমার মুখে শুনব বলে আশা করছিলাম। কিন্তু একথা আর কখনও উচ্চারণ কোরো না।

ধ্রুবর এই কথায় একটু ঘাবড়ে গেল রেমি। বলল, কেন?

আমাদের পরিবারে বাপ এবং ছেলের ভিন্ন হওয়ার প্রথা এখনও চালু হয়নি। হয়তো ভবিষ্যতে একদিন হবে। কিন্তু তুমি সেটা শুরু কোরো না।

তা হলে কী করে প্রমাণ হবে যে, তুমি ওঁর ওপর নির্ভরশীল নও?

কৃষ্ণকান্ত চৌধুরী প্রমাণ চাইছে না। তুমি ভুল করছ। বাপের হোটেলে খাওয়া নিয়ে খোঁটা দেওয়াটা একটা মৃদু প্রোভোকেশন মাত্র। আমি আত্মনির্ভরশীল হলেই কৃষ্ণকান্তবাবু খুশি হবেন তা নয়। বরং উনি চান যে, আমি ওঁরই হাত থেকে রোজ ল্যাজ নেড়ে নেড়ে ভুক্তাবশেষ গ্রহণ করি।

ছিঃ, ও কী বলছ?

ঠিকই বলছি। তুমি লোকটাকে চেনো না।

রেমি একটু চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে, তা হলে তুমি রোজগার করে ওঁর হাতে প্রতি মাসে টাকা দাও।

কত টাকা দেব?

যতই হোক। পাঁচশো-সাতশো।

তোমার শ্বশুর সেটা হাত পেতে নেবে?

নেবেন না কেন?

সেটা জিজ্ঞাসা করে এসো।

জিজ্ঞেস করতে হবে কেন? বাপ কি ছেলের টাকা নেয় না?

কৃষ্ণকান্ত কি তেমন বাপ?

নেবেন না বলছ?

হয়তো নেবে, তবে নিজে হাত পেতে নেবে না। হয়তো কোনও চাকরকে ডেকে বলবে, ওরে টাকাটা তোর কাছে রেখে দে তো।

যাঃ, শ্বশুরমশাই মোটেই ওরকম নন।

হবে হয়তো। আমি ভদ্রলোক সম্পর্কে খুব ভাল জানি না।

ইয়ারকি হচ্ছে?

বাস্তবিকই জানি না, আমার লোকটা সম্পর্কে একটু ধাঁধা আছে।

কীরকম ধাঁধা?

ধরো, লোকটা একসময়ে স্বদেশি করত। তাই না?

তা তো বটেই।

বেশ আদর্শবাদী লোক ছিল। তাই না?

এখনও আছেন।

আহা, এখনকার কথা ছাড়ো।

ঠিক আছে, বলো।

লোকটার জ্যাঠা সন্ন্যাসী হয়ে যায়। কাকা স্বদেশি করতে করতে খুন হয় বা দুর্ঘটনায় মারা যায়। ঠিক তো?

তাই তো শুনেছি।

সুতরাং লোকটার ভিতরে সন্ন্যাস এবং স্বদেশিয়ানার একটা অ্যাডমিকশ্চারও ঘটেছে। স্বীকার করো?

না হয় করলাম।

কিন্তু লোকটা এখন এক নম্বরের ধাপ্পাবাজ, মিথ্যেবাদী এবং কেরিয়ারিস্ট।

আবার?

ধ্রুব রেমির হাত নিয়ে খেলা করতে করতে বলল, তোমার বয়স কত?

কেন, তুমি জানো না?

মেয়েদের বয়স তারা নিজেরাই মনে রাখতে চায় না। সে যাক গে। তুমি খুব কম বয়সি বোকা একটি মেয়ে।

না হয় হলাম।

এ বয়সে একজন দেশবিখ্যাত নেতার মুখোমুখি হলে মাথা ঠিক রাখা মুশকিল। চোখ ধাধিয়ে যায়।

আমার কি তাই হয়েছে?

হয়েছে। একটু বেশি মাত্রায় হয়েছে। যতক্ষণ ওই ধাঁধানো ভাবটা থাকবে ততক্ষণ লোকটার আসল চেহারা তোমার নজরে পড়বে না।

রেমি অভিমানভরে বলল, তুমি ঠিক বলছ না গো। শ্বশুরমশাই কত সহজ সরলভাবে থাকেন, একটুও বাবুগিরি নেই, আরাম আয়েস নেই—

ঠিক কথা। লোকটার সপক্ষে পজিটিভ পয়েন্টও অনেক আছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে লোকটা সম্ভবত চরিত্রবানই ছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই লোকটা চরিত্র হারাচ্ছে। খুব ধীরে ধীরে অবশ্য।

পলিটিকস করতে গেলে ওরকম একটু-আধটু হয়।

ধ্রুব নীরবে মাথা নাড়ল। তারপর অন্যমনস্ক চোখে ঘরের আলোটার দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, তুমি কথাটা ভেবে বলোনি, কিন্তু খুব ঠিক কথা বলেছ।

কোন কথাটা?

এই যে বললে পলিটিকস্ করতে গেলে অমন একটু-আধটু করতে হয়।

হয়ই তো।

আমি তো সেটা মেনেই নিয়েছি। কথাটা খুবই সত্যি। এদেশে পলিটিকস মানেই ওইসব। মিথ্যে কথা, ফেরেববাজি, ধাপ্পা এবং কেরিয়ার। চলো, কাল তোমাকে বিধানসভায় নিয়ে যাব। একটু দেখে আসবে, শ্রদ্ধেয় এম এল এ আর মন্ত্রীরা সেখানে বসে কেমন খেয়োখেয়ি করেন।

আমার দেখে দরকার নেই।

দরকার আছে। তোমার শ্বশুর কীরকম দেখোদ্ধার করছেন তার একটা আঁচ পাওয়া তোমার দরকার।

আমার চোখে শ্বশুরমশাইকে ছোট করে দিয়ে তোমার কী লাভ?

ধ্রুব গভীর এক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে স্নেহভরে বলল, তুমি কি বিশ্বাস করো কৃষ্ণকান্তকে কালিমালেপন করায় আমার খুব সুখ?

রেমি ধ্রুবর খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বলল, তবে সব সময় ওঁর সম্পর্কে ওরকম বলো কেন?

লাভ-হেট রিলেশন কাকে বলে জানো?

কথাটা শুনেছি। মানে জানি না।

মানে আমিও ভাল জানতাম না। কিন্তু কৃষ্ণকান্তর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা এখন বোধহয় ওই লাভ-হেট।

তার মানে?

আমি যখন কৃষ্ণকান্ত চৌধুরীকে বাবা বলে ভাববার চেষ্টা করি তখন কিছুতেই মন্ত্রী কৃষ্ণকান্তর ছবি চোখের সামনে আসে না।

তবে কী ছবি আসে?

চল্লিশ দশকের গোড়ায় জেলখানায় বসে এক কৃষ্ণকান্ত খুব মলিন বিকেলের আলোয় লাল কাগজে পেনসিল দিয়ে তার বিরহিনী বউকে চিঠি লিখছে, এরকম একটা লোককে মনে পড়ে। কিংবা মনে পড়ে একটা লোক–যাক গে, ওসব বলে লাভ নেই।

রেমির চোখ ছলছল করছিল। বলল, উনি খুব কষ্ট পেয়েছেন এককালে। না গো?

ধ্রুব হেসে মাথা নেড়ে বলল, কষ্ট কীসের? স্কোপ পেলে আমিও ওরকম রোমান্টিক কষ্ট করতে রাজি। কিন্তু আমরা তো স্কোপই পেলাম না রেমি।

পেলে কী করতে?

ওঃ, সে অনেক কিছু করতাম। বোমা মের ফাঁসির দড়িতে হাসতে হাসতে মরতাম। তার আগে গীতা পাঠ করতাম। গান গাইতাম, হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী। কিংবা দ্বীপান্তরে চলে যেতাম গোল কয়েক ইংরেজকে নিকেশ করে।

খুব বকুনি! সাহস জানা আছে।

কেন, আমি কি খুব ভেড়ুয়া?

তা বলছি না।

তবে কী বলতে চাইছ?

তুমি কোনও ব্যাপারেই সিরিয়াস নও।

আমি ভীষণ সিরিয়াস রেমি। আমি যদি স্বদেশি আমলে জন্ম নিতাম তা হলে কৃষ্ণকান্তর মতো স্বদেশি করতাম না।

কী করতে?

অন্যরকম কিছু। ভারতবর্ষে স্বদেশি আমলটাই ছিল আবেগসর্বস্ব। আবেগ জিনিসটা ক্ষণস্থায়ি। চট করে কেটে যায়। কৃষ্ণকান্তর অবস্থা দেখছ না? স্বদেশি জ্বর যেই ছেড়ে গেল, দেশ যেই স্বাধীন হল, অমনি কোমরে কাপড়ে বেঁধে স্বদেশি সার্টিফিকেটখানা বুকে লটকে কেরিয়ার তৈরি করতে নেমে পড়েছে। সেই কৃষ্ণকান্তর সঙ্গে যদি এই কৃষ্ণকান্তর আজ দেখা হয়ে যায় তা হলে দুজনের মধ্যে তুমুল মারপিট লেগে যাবে।

রেমি হেসে গড়িয়ে পড়ল, কী যে বলো না!

সেইজন্যই বলছিলাম, মা যা ছিলেন এবং মা যা হইয়াছেন তা দেখতে চলো অ্যাসেমব্লিতে যাই। গ্যালারি থেকে দেখবে নীচের এরেনায় দুদল লোক দুদিকে বসে কেমন গলা ছেড়ে ঝগড়া করছে। কলেজের ডিবেটিংও এর চেয়ে অনেক ভাল। ওই কুয়োর মধ্যে যে তোতি, রেষারেষি, ঠেলাঠেলি চলছে তাই থেকে দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে এমন কথা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে।

তার জন্য তো শ্বশুরমশাই দায়ি নন।

না। তবে তিনি যদি সৎ হতেন তবে ওই কুম্ভীপাকে গিয়ে ঢুকতেন না। স্বাধীন ভারতের পলিটিকস সভয়ে পরিহার করে ভদ্রলোকের মতো জীবনযাপন করতে পারতেন।

যারা পলিটিকস করে তারা ভদ্রলোক নয়?

কে বলল নয়? তা বলিনি। ব্যক্তিমানুষ হিসেবে অনেকেই ভদ্রলোক। ভাল এবং সৎ লোকেরও অভাব নেই। কিন্তু সেটুকু তাদের নন-পলিটিক্যাল একজিসটেন্স।

আমি আর এসব শুনতে চাই না। এখন আমাকে আদর করো।

আমার মেজাজটা চটকে দিয়ে এখন আদর চাইছ?

মেজাজ কখন চটকালাম?–রেমি চোখ কপালে তুলল।

এই যে এতক্ষণ বকালে!

তুমিই বকলে।

না, তুমিই বকালে। কৃষ্ণকান্তর প্রসঙ্গ পারতপক্ষে আমার কাছে তুলো না।

আচ্ছা, ঘাট মানছি।

শোনো।

বলো।

তোমার শ্বশুরকে বলে দিয়ে, আমি কেরিয়ারিস্ট নই। নিজের জীবন কীভাবে যাপন করব সেটাও ঠিক করব আমিই। উনি যেন সেটা নিয়ে চিন্তা না করেন।

ও বাবা, ওসব আমি বলতে পারব না।

তা হলে আমিই বলব।

দোহাই, পায়ে পড়ি। বোলো না। উনি রাগী মানুষ।

আমিও রাগী।

বেশ, রাগটা আমার ওপর দেখাও। ওঁর ওপর নয়।

তোমার ভয়টা কীসের?

তোমাদের যদি ঝগড়া হয়?

হোক না।

না গো। পায়ে পড়ি।

তুমি খুব পায়ে পড়তে শিখেছ তো! কার কাছ থেকে শিখলে?

ঠেকে শিখেছি।

ধ্রুব মাথা নেড়ে বলল, এটাও পলিটিকস নয় তো? এই পায়ে পড়াটা?

তুমি এক নম্বরের—

কী?

বলব না। আমাকে এবার একটু আদর করে। একটুখানি।

ধ্রুব সে কথায় কর্ণপাত করল না। উঠে পায়চারি করতে করতে বলল, আজ আমার ঘুম আসবে। একদম ঘুম আসবে না।

পরদিন থেকেই ধ্রুব আবার বেহেড। সকাল থেকে গভীর রাত অবধি পাত্তা নেই। কোনওদিন নিজেই ফেরে, কোনওদিন পুলিশ পৌঁছে দিয়ে যায়। প্রায় দিনই বেহুশ অবস্থায় ফেরে।

কেঁদে ভাসাতে লাগল রেমি।

সেই দুঃসহ দুর্দিনে হঠাৎ একদিন এসে হাজির হল সমীর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *