নার্সিংহোমে রক্তের অভাব নেই। টাকা ফেললেই বোতল-বোতল রক্ত পাওয়া যায়। কিন্তু কৃষ্ণকান্তের সেইসব অজ্ঞাতকুলশীল রক্তে আস্থা নেই। সেইজন্য পরিবার এবং আত্মীয়স্বজন সবাইকে খবর দিয়ে রেখেছেন, বউমার অপারেশন, রক্ত দরকার, তোমরা এসো।
প্রথমেই ট্যাকসি হাঁকড়ে এসে গেল লালটু। ভিতরে ভিতরে যত বিরোেধই থাক, পরিবারের কেউ বিপদে পড়লেই সে আগে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
লাউঞ্জে বসে কৃষ্ণকান্ত একটা কোল্ড ড্রিংক খাচ্ছিলেন। ভিতরে প্রচণ্ড উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা, গলা শুকিয়ে কাঠ। নার্সিংহোমের কর্তৃপক্ষ অবশ্য তিনি উঠতে বললে উঠছে, বসতে বললে বসছে, কিন্তু তাতে তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। জীবন-মৃত্যুর ওপর কোনও খলিফারই তো হাত নেই।
লালটু ঢুকল বুনো মোষের মতো। তেমনই প্রকাণ্ড চেহারা, বেশ বড়সড় একটা ভুঁড়ি, বড় বড় শ্বাস ফেলে, প্রচণ্ড জোরে কথা বলে। ঢুকেই বলল, সেই হারামজাদাটা কোথায়?
কৃষ্ণকান্ত একটু হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। হারামজাদা এক ও অদ্বিতীয় ধ্রুব। ছেলেটা তাকে কতদুর ডোবাবে তা তিনি এখনও জানেন না। মতিগতি ফেরানোর জন্য একটু অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়েছিলেন। লাভ হয়নি।
লালটু বলল, আপনি বাড়ি চলে যান কাকা। আমরা তো আছি। আপনি বুড়ো মানুষ, রাত জেগে বসে থাকার কী দরকার?
কৃষ্ণকান্ত একটু গা ঢিলে দিয়ে একটা সোফায় বসে আছেন। পাশে নার্সিংহোমের সুপারিনটেনডেন্ট ও আর-একজন উচ্চপদস্থ গোছের লোক খুব সতর্ক মুখচোখ নিয়ে উপবিষ্ট। কৃষ্ণকান্ত কোল্ড ড্রিংকের ঔ-তে আর-একটা মৃদু টান দিয়ে বললেন, যাব। রক্ত দেওয়ার লোকজন সব আসুক।
আর কে আসবে?
কৃষ্ণকান্ত লালটুর কথার জবাব দেওয়ার আগেই সুপারিনটেনডেন্ট বিনীতভাবে বলল, ব্লাড উইল বি নো প্রবলেম স্যার।
কৃষ্ণকান্ত একথাটায় বিরক্ত হলেন। মাথা নেড়ে বললেন, প্রবলেমটা তোমার বোঝার কথা নয়, মিত্র। তোমরা সব আপ টু ডেট লোক। ব্লাডের ব্যাপার বোঝো না। আমার একটু সংস্কার আছে। আই ওয়ান্ট ব্লাড অফ মাই ওন ক্ল্যান। এটা সায়েন্টিফিক ব্যাপার কিছু নয়, কিন্তু সংস্কার।
মিত্র কথা বাড়াল। শ্রদ্ধার সঙ্গে চুপ করে রইল।
লালটু বলল, কত রক্ত লাগবে? ধ্রুবর বউ তো একটা চিংড়ি মাছের মতো। যা লাগবে আমিই দিতে পারব।–বলে একখানা অতিশয় বলিষ্ঠ হাত বাড়িয়ে দেখাল।
কৃষ্ণকান্ত বললেন, যা লাগার লাগবে। প্রস্তুত থাকা ভাল। ওই তো বোধহয় কানু আর চানু এল। দেখ তো লালটু।
লালটু লাউঞ্জের সিঁড়ি দিয়ে নামে। একটা ট্যাকসি থেকে কানু আর চানু নামছে। তার খুড়তুতো ভাই। বড় কাকার ছেলে। দুজনই ব্রিলিয়ান্ট। একজন শিবপুরে বি ই, অন্যজন এম বি বি এস পাশ করে এম এস করছে। তাদের সঙ্গেই এসেছে বড় পিসির ছেলে সুশান্ত। সে ব্রিলিয়ান্ট নয় বটে, কিন্তু দুর্দান্ত মস্তান। হাঁক-ডাকে ওস্তাদ লোক। লালটু তিনজনকে তাড়া দিয়ে বলল, যা যা ভিতরে যা। আমি একটু এগিয়ে দেখি আর কে আসে।
তিনজনই দৌড় পায়ে ভিতরে চলে গেল। লালটু বাইরে এসে দাঁড়াল। সামনেই একটা তেমাথা। পেট্রল পাম্প। রাত গভীর হওয়ায় রাস্তায় লোকজন নেই। মাঝে মাঝে এক-আধটা মোেটর বা ট্যাকসি দারুণ জোরে বেরিয়ে যাচ্ছে। মধ্যরাত্রির কলকাতার একটা অদ্ভুত চরিত্র আছে। এই কলকাতাকেই লালটুর বেশি পছন্দ। লালটুর বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ। মাত্র ছ-সাত বছর আগেও সে কলকাতার হার্স্ট টিভিশনে ফুটবল খেলেছে। দুবছর ইস্টবেঙ্গলেও ছিল। জীবন এখনও তার কাছে ফুটবলের মতোই উপভোগ্য, টানাপোড়েন ও উত্তেজনায় ভরা। লালটু ফুর্তি করতে ভালবাসে, মারপিট করতে ভালবাসে, মড়া পোড়াতে ভালবাসে। তার ভালবাসা বিচিত্র ও বহুমুখী। তার রাগ সাংঘাতিক, ভালবাসাও সাংঘাতিক। যাকে ভালবাসে তার জন্য জান দিতে পারে, যার ওপর রাগ। হয় তার গলা কেটে ফেলার কথা ভাবে। এই চরমপন্থী মনোভাব তাকে বহুবার বহু সমস্যায় ফেলেছে। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে সে টিকে থাকতে পারেনি এই স্বভাবের দরুন। এই স্বভাবের জনাই যে মেয়েটিকে সে সত্যিকারের ভালবাসত তাকে বিয়ে কবতে পারেনি। সবচেয়ে যেটা গুরুতর সেটা হল, উগ্র মেজাজের জন্য বহুবার তাকে চাকরি ছাড়তে হয়েছে। এখন সে ব্যাংকের অফিসার বটে, কিন্তু আরও একটু উঁচু জায়গায় তার এতদিনে থাকার কথা ছিল। আত্মীয়স্বজনরা বলে, লালটুর পাতিল কালা হয় না। বাঙাল ভাষার কথাটার সাদা অর্থ হল, তার হাঁড়ি কালো হয় না। তবে সে যে দিলদরিয়া লোক এটা সবাই স্বীকার করে। নিজেদের বৃহৎ পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের প্রতি তার আনুগত্য নিরেট ও অটল। ছোটকাকার সঙ্গে তার একটা কাজিয়া চলছে বটে, কিন্তু কাকা কাকাই। রক্তের গভীর সম্পর্ক।
লালটু বাইরে দাঁড়িয়ে ফাঁকা বাস্তাঘাট লক্ষ করছিল। আরও লোক আসবে। তাদেরই জ্ঞাতিগুষ্ঠি সব। রেমির অত রক্ত কিছুতেই লাগবে না। কিন্তু ছোটকাকার স্বভাবই হল ওই। যে কোনও উপলক্ষে নিজের বৃহৎ পরিবারটির সকলকে জড়ো করে ফেলবেন। গোষ্ঠীপতি হিসেবে তিনি নিজের ক্ষমতাটা এইভাবেই যাচাই করতে ভালবাসেন মাঝে মাঝে।
লালটুর হঠাৎ নজরে পড়ল, বাইরের আবছায়ায় দেয়ালে ঠেস দিয়ে একটা অল্পবয়সি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। খুব উদাস ভঙ্গি। লালটুর ছেলেটাকে চেনা-চেনা লাগছিল। সে দু পা এগোল।
আরে! তুমি রেমির ভাই না?
ছেলেটা একটা জ্বলন্ত সিগারেট টুক করে ফেলে চটিতে মাড়িয়ে বলল, হ্যাঁ, আপনি তো লালটুদা!
কতক্ষণ এসেছ তুমি?
অনেকক্ষণ। সেই সন্ধে থেকেই। আমি একা নই। বাবা, মা, দাদা সবাই আছে।
কোথায়! দেখলাম না তো!
ওরা ওপরে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আমার হাসপাতালের গন্ধ ভাল লাগে না বলে নীচে এসে দাঁড়িয়ে আছি।
ছেলেটার গায়ে এই শীতেও মাত্র শার্ট দেখে লালটু বলল, গরম জামাও তো পরে আসোনি দেখছি।
সময় পাইনি। দিদির খবর পেয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছি।
আরে, এত চিন্তার কী? আমরা তো আছি। আফটার অল রেমি আমাদের বাড়ির বউ। তুমি মা বাবাকে নিয়ে বাড়ি চলে যাও। টেক রেস্ট।
ছেলেটা একটু অভিমান ভরে বলল, যদি কোনও দরকার হয় সেইজন্যই আছি। শুনেছিলাম দিদির রক্ত লাগবে। কিন্তু তালুইমশাই কিছুতেই আমাদের রক্ত অ্যাকসেপ্ট করতে রাজি নন। কেন বলুন তো!
লালটু হোট হোর করে হাসল। বলল, আরে! তার জন্য রাগছ কেন? কাকার একটু বাতিক আছে।
এটা কী ধরনের বাতিক? আমরা তো দিদিব পর নই। আমাদের রক্ত কি অশুচি? তালুইমশাই অত্যন্ত ক্লাস কনশাস।
লালটু ছেলেটাকে একটু ভাল করে দেখল। রোগা ফরসা চেহারা। গালে কৈশোরের নরম কিছু দাড়ি এবং গোঁফ। আজকাল দাড়ি গোঁফটা বেশ চালু ফ্যাশন। ছোকরার মাথার চুলও মেলা। ঘাড় পর্যন্ত বাবরি। লালটু বুঝতে পারছিল না ছোকরা কমিউনিস্ট কি না। আগে পায়জামা এবং পাঞ্জাবি ছিল দেশি কমিউনিস্টদের মার্কামারা পোশাক। দেখেই চেনা যেত। আজকাল অবশ্য বাইরেটা দেখে চেনা মুশকিল। ছেলেটার নাম কিছুতেই মনে পড়ছিল না লালটুর। তবে সে বিগ ব্রাদারের মতো ছোকরার কাঁধে হাত রেখে বলল, আরে না, ক্লাস কনশাস কথাটা বড্ড ভারী। ওসব নয়। কাকার ধারণাটা কী জানো? শুনলে তুমি হাসবে, বাট ইট ইজ এ ফ্যাক্ট। কাকার বিশ্বাস, যারা ইস্টবেঙ্গলের লোক তারা এককালে ভাল খেয়েছে-দেয়েছে, ফ্রেশ এয়ার পেয়েছে, কাজেই তাদের রক্তটা একটু বেশি পিউরিফায়েড অ্যান্ড হেলদি।
বলে লালটু আর-এক চোট হোঃ হোঃ করে হাসল।
কিন্তু রেমির ভাই হাসল না। বলল, এই বিজ্ঞানের যুগে ওসব বিশ্বাস অচল। রক্ত কার কত পিউরিফায়েড সেটা স্পেশালিস্টরা বলবে। আমরা পশ্চিমবঙ্গের লোক বলে আমাদের রক্ত পিউরিফায়েড নয় এটা তো অশিক্ষিত লোকের ধারণা। তাই যদি হবে তবে পশ্চিমবঙ্গের মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিতে যাওয়াই বা কেন?
প্রশ্নটা হকের। জবাবটা লালটু খানিক জানে। তবে সে কথা এই দুধের বাচ্চাকে বলবার মতো নয়। সে একটু উদার গলায় বলল, আফটার অল কাকা বুড়ো হয়েছেন, কিছুটা সেনিলিটিও এসে যায় এই বয়সে। এক সময়ে জমিদারি করেছেন, মেজাজটাও তেমন। ওঁর ওপর আমরা কোনও কথা বলি না। তবে জানি, ওঁর অনেক ধারণাই লজিক্যাল নয়।
রেমির ভাই গম্ভীর মুখে বলল, এই বিয়েতে আমরাও খুব খুশি •ই! জামাইবাবুর বিহেবিয়ার খুব খারাপ। দিদি সাইকোলজিক্যালি ভীষণ আপসেট। অনেকদিন ধরেই আমরা সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে আসছি লালটুদা। কিন্তু এখন রক্তের পিউরিটির ব্যাপারটা আমাদের কাছে খুব হাস্যকর লাগছে। জামাইবাবুর রক্ত কি আপনার কাছে খুব পিয়োর বলে মনে হয়?
কোথাও কিছু না, এই সামান্য কথাটায় হঠাৎ লালটুর মাথাটা দপ করে জ্বলে উঠল। সেই আগুন ঝলসে উঠল তার চোখেও। ঠিক কথা, ধ্রুব অল্প বয়স থেকে মদ খায়, অন্যান্য দোষও আছে। কিন্তু তা বলে তার সম্পর্কে এরকম কথা অন্তত কুটুমের মুখে মানায় না। লালটু একটু দম ধরে থেকে রাগটা সামলাল। চণ্ড রাগটাকে সে নিজেই আজকাল ভয় পায়। তারপর চাপা রাগের গনগনে গলায় বলল, ধ্রুবকে আমি বাচ্চাবেলা থেকে জানি, হি ইজ মাই ব্রাদার। মদ আমিও খাই। কিন্তু কোন শুয়োরের বাচ্চা আমার রক্তকে ইমপিয়োর বলবে হে?
রেমির ভাই যে এই ধমকে ভয় খেল এমন নয়। বরং খুবই উদাস একরকম বেপরোয়া মুখে স্তিমিত গলায় বলল, একটু আগে আমার বাবাকে তালুইমশাই ইনডিরেক্টলি অপমান করেছেন। দিদির এই প্রথম বাচ্চা। একটা প্রিমিটিভ নিয়ম আছে প্রথম বাচ্চা হওয়ার দায়দায়িত্ব মেয়ের বাপের বাড়ির। আমার বাবা নার্সিংহোমের খরচটা নিজে দিতে চেয়েছিলেন। তাতে তালুইমশাই এমন সব কথা বললেন যাতে মনে হয় এখনও এদেশে সামন্ততন্ত্র চালু আছে এবং গোটা দেশটাই ওঁর জমিদারি। নার্সিংহোমের খরচ দিতে চেয়ে আমার বাবা যেন ওঁকে অপমান করেছেন।
লালটু খুবই অবাক হয়ে গেল। তার ছোটকাকা নেতা মানুষ। পাবলিক তার সম্পর্কে ভাল কথাও বলে, খারাপ কথাও বলে। কিন্তু তা বলে কুটুমরা বলবে কেন? লালটুর গা-হাত-পা নিশপিশ করছিল।
ঠিক এই সময়ে একটা প্রাইভেট গাড়ি এসে থামল নার্সিংহোমের ফটকে। দরজা খুলে প্রথমে নামল জগা। তারপর ধ্রুব। সঙ্গে আর-একটা বাচ্চা চাকর।
লালটুর রাগটা গিয়ে পড়ল ধ্রুবর ওপর। সে গিয়ে শরীরটা চিতিয়ে দাঁড়াল তার সামনে। গলায় ফেটে পড়ল রাগ, এতক্ষণ কোথায় ছিলি রে হারামজাদা? তোর জন্য কি আমাদের মুখে চুনকালি পড়বে? শালার তিন পয়সার সব কুটুমও আজকাল লম্বা চওড়া লেকচার ঝেড়ে যায়। ফর ইউ। ওনলি ফর ইউ।
বলে আচমকা ধ্রুবর পুলওভারের বুকের কাছটা খামচে ধরে দুটো মগজ-নাড়ানো ঝাঁকুনি দিল লালটু।
এই একটা লোককে ধ্রুব বরাবর ভয় পায়। নেশা এখন আর নেই। মাথাটা এমনিতেই কেমন ভোম্বল হয়ে আছে। ঝাঁকুনিতে সে আরও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। বলে, কেন, কী হয়েছে? ইজ শি ডেড?
মরলে তোরই মরা উচিত। গো হোম অ্যান্ড শুট ইয়োরসেলফ।
ধ্রুব কিছু বুঝতে পারছে না। অসহায়ভাবে বলল, কী হয়েছে লালটুদা? এনিথিং রং?
এভরিথিং রং। যেসব লোক আমাদের জুতোবরদার হওয়ার যোগ্যতা রাখে না তাদের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়াই বোকামি হয়েছে। যা ভিতরে যা। কাকা বসে আছেন।
ধ্রুব অবশ্য ভিতরে গেল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। জগা দৃশ্যটা দাঁড়িয়ে দেখে আস্তে আস্তে ভিতরে চলে গেল। লালটু এগিয়ে গেল পেট্রল পাম্পটার কাছাকাছি। পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগল।
রক্তের শুদ্ধতা সম্পর্কে তার শুচিবায়ু নেই। ওটা কাকার বাতিক ঠিকই। কিন্তু লালটু জানে তাদের পরিবারে আজ অবধি বেচাল কিছু হয়নি। নিজেদের বংশ সম্পর্কে তাদের গৌরব এখন হয়তো বৃথা, কিন্তু এটাও ঠিক গৌরব করার মতো বংশ খুব বেশি লোক পায় না। তারা ভাগ্যক্রমে পেয়েছে। ব্যতিক্রম অবশ্য ধ্রুব। একমাত্র ধ্রুব।
আড়চোখে চেয়ে লালটু দেখে, রেমির ভাই আর-একটু দূরে সরে গিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে আবার সিগারেট ধরিয়েছে। একটা ট্যাকসি বাঁক নিল। তার হেডলাইটের আলোয় রেমির ভাইয়ের সাদা এবং দাড়িওলা মুখটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্পষ্ট দেখা গেল।
চোখ বাঁচাতে মুখ নামিয়ে নিল ছেলেটা।
ট্যাকসি থেমেছে। তাদেরই লোক। লালটু এগোল। তার অনুমান ঠিক। ট্যাকসি থেকে একে একে নেমে আসছে শচীন, অলক, মৃদুল, জয়িতা, শান্তনু আর পৃথা। ছোটকাকার গোষ্ঠী বা ক্ল্যান। আরও আসবে। আত্মীয়রাই তো শুধু নয়, ছোটকাকার বিশাল পরিচিতির জগৎ। রাজনৈতিক দলের লোকেরা আছে। প্রভাবশালী বন্ধুবান্ধব আছে। চামচা আছে। একটু বাদেই নার্সিংহোম হয়তোবা জনসমুদ্রে পরিণত হবে।
পায়ে পায়ে আবার লাউঞ্জে ফিরে আসছিল লালটু। হঠাৎ অবাক হয়ে দেখল, ধ্রুব তার দুর্বিনীত শালাটির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ইতিমধ্যে। দুজনে নিচু স্বরে কথা বলছে।
দৃশ্যটা ভাল লাগল না লালটুর। ধ্রুবর উচিত শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে কোনও সম্পর্কই না রাখা। ব্যাপারটা একদিন ধ্রুবকে বুঝিয়ে দেবে সে।
পায়ে পায়ে লাউঞ্জে ফিরে আসে লালটু। ছোটকাকা ভ্রু কুঁচকে বসে আছেন সেই একই জায়গায়। অন্যরা নীরবে দাঁড়িয়ে।
কী হয়েছে?—লালটু জিজ্ঞেস করে।
কৃষ্ণকান্ত তার দিকে একবার চেয়ে মাথা নাড়লেন। গলাটা সাফ করে নিয়ে বললেন, হেমারেজটা বন্ধ হচ্ছে না। কন্ডিশন গ্রেভ। লালটু, নিতাইটাকে দেখ তো। বোধহয় গাড়িতে ঘুমোচ্ছে। ওর কাছে আমার প্রেশারের বড়ি আছে। নিয়ে আয়।
আপনি বাড়ি চলে যান না! একটা কামপোজ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। আমরা আছি।
না, ঠিক আছে। ওই গর্ভস্রাবটা কোথায়?
ধ্রুব বাইরে আছে। ডাকব?
ডাকতে হবে না। শুধু বল গিয়ে, বউমার অবস্থা ভাল না।
বলে কী হবে? আপনি উত্তেজিত হবেন না। অপারেশন তো হবে। দেখা যাক।
যে রুগি বাঁচতে চায় না তাকে বাঁচাবে কে?
বাঁচতে চায় না?
তাই তো শুনছি। সার্জেন দাশগুপ্ত বলল, পেশেন্ট বলছে, আমার বাঁচার ইচ্ছে নেই। আমি বাঁচতে চাই না। এমনকী বাচ্চাটার জন্যও না।
লালটু বুঝে নিল, বউমার জন্য দুশ্চিন্তা, ছেলের ওপর রাগ সব মিলিয়ে ছোটকাকা আজ একটু বেহেড। সে গিয়ে ছোটকাকার পাশের খালি জায়গাটায় বসে বলল, ভেঙে পড়বেন না। এভরিথিং উইল বি অলরাইট। আমি বলি, আপনার বাড়ি চলে যাওয়াই ভাল।
কেন, বাড়ি যেতে বলছিস কেন? বাড়ি গিয়ে কী করব? সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা হবে। তার চেয়ে এই-ই ভাল। যা হওয়ার চোখের সামনে হোক। বাচ্চা মেয়েটা… এই সেদিন বিয়ে দিয়ে আনলাম। স্টিল এ চাইল্ড। ওই গর্ভস্রাবটার দোষে…
কাকা!—লালটু সাবধান করে দেয়। দেয়ালেরও কান আছে। কুটুমরা ঘুরছে আশেপাশেই। কোন কথার কোন অর্থ ধরবে তা তো বলা যায় না। গলা খাকারি দিয়ে সে বলল, ধ্রুবরও তো বয়স বেশি না। পঁচিশ কি ছাব্বিশ। এই বয়সে কত আর কাণ্ডজ্ঞান হয় মানুষের।
এই বয়সে যার না হয় তার কোনওকালেই হয় না। ও জন্মেছে আমাকে শেষ করার জন্য।
অপারেশন থিয়েটারে রেমি তখন আলোর নীচে শুয়ে। এত আলো তবু যেন সব আলোও অন্ধকারকে তাড়াতে পারছে না। অন্ধকার চোখে নয়। ভিতরে।
রক্তে সে আজ স্নান করছে কখন থেকে। ভেসে যাচ্ছে নিজের রক্তের স্রোতে।
বাচ্চাটা জন্মাল দুপুরের একটু পর। অনেক যন্ত্রণা দিয়ে নাড়ি ছিঁড়ে, শরীর অবশ করে নেমে গেল। দুর্বহ যন্ত্রণার অবসান। কচি গলার কান্নার শব্দ পৃথিবী জুড়ে মাদল বাজাতে লাগল।
ছেলে? না মেয়ে?
ছেলে! ছেলে! ছেলে হয়েছে গো! সোনার গয়না দিতে হবে কিন্তু।–ধুইয়ে মুছিয়ে ছেলেটাকে দেখিয়ে এই কথা বলে নিয়ে গেল একটা আয়া।
কিন্তু তারপর থেকে রেমির শরীরের ভিতরে রক্তের কলধ্বনি আর থামতে চায় না।
হেমারেজটা ধরতে অনেক সময় নিয়েছে ডাক্তার। কিন্তু শুধু ডাক্তারেরই কি দোষ? লেবার রুম থেকে বেডে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সব টের পেয়েও কি চুপ করে থাকেনি রেমি?
শুধু সে টের পেয়েছিল। কিন্তু কিছু বলেনি কাউকে। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল অয়েলক্লথের ওপর পাতা চাদর। ঢাকা কম্বলের নীচে তার শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছিল। রিমঝিম করছিল মাথা। কানে সব শব্দ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছিল।
কে?
আমি। আমি ধ্রুব।
খুব লাজুক মুখেই ধ্রুব এসে দেখা করেছিল।
চোখের দুর্বল পাতা অতি কষ্টে তুলে রেমি জিজ্ঞেস করল, ওকে দেখেছ?
কাকে?
বাচ্চাটাকে।
ন্ না। দেখব। তাড়া কী?
দেখো। ভাল করে দেখো।
তোমার কি খুব কষ্ট হয়েছে?
না। কষ্ট কীসের? মেয়ে হয়ে জন্মেছি, এ কষ্ট তো কপালের লেখন।
তা বটে। বাপদের গর্ভযন্ত্রণা নেই। কিন্তু অন্য যন্ত্রণা আছে।
আছে নাকি? আছে আছে।
রেমির চোখে সেই সময় একটা মস্ত পাথর চাপা দিল কে। আবার একটু বাদে চোখ মেলতে পারল সে। গলাটা বড় শুকনো। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আমাকে একটু জল দিতে বলে। বড় তেষ্টা।
ধ্রুব নিজেই জল খাইয়ে দিল তাকে। খুব সাবধানে, আস্তে আস্তে। তবু ধ্রুবর হাত কাঁপছিল। অল্প অল্প চলকাচ্ছিল জল ছোট্ট পোসিলিনের মগটা থেকে।
আঃ, গায়ে জল পড়ছে। ঠান্ডা না!
আমার হাতটা আজকাল কঁপে কেন বলো তো! মাল খাই বলে নাকি?
তুমি যাও, আয়াকে বলো। না হয় নার্সকে ডাকো।
আমিই না হয় দিলাম। দাঁড়াও, গলায় তোয়ালে দিয়ে নিই।
আর লাগবে না। হয়েছে।
ধ্রুব মগটা রেখে দিল। বলল, এবার কেটে পড়তে হবে। বাবা আসবে।
তাই পড়ো না। কে থাকতে বলেছে?
তোমার চেহারাটা ভাল দেখাচ্ছে না রেমি! ইউ আর সিক!
না, মোটেই না। আমি ভাল আছি।খুব জোর দিয়ে রেমি বলেছিল। কিন্তু সে ঠিকই টের পেয়েছিল, সে ভাল নেই। তলপেটে একটা ব্যথা মেরে মেরে নিচ্ছিল। রক্তের কলধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল সে। কিন্তু সে বলেনি সেই কথা। কাউকে বলেনি।
কত বয়স হবে তার এখন? কুড়ি? না, একুশ। হ্যাঁ একুশ। এখনও সে কলেজের ছাত্রী। এই এত অল্প বয়সে সে বউ হয়েছে, মা-ও হয়ে গেল। এত তাড়াতাড়ি দরকার ছিল না এসব হওয়া। অপেক্ষা করা উচিত ছিল।
সে আচমকা বলল, শোনো, একটা কথা বলি।
কী?
বাচ্চাটাকে দেখো।
তার মানে?
বাচ্চাটাকে একবার দুটো চোখে দেখে এসো।
বলছি তো দেখব। তাড়া কীসের?
শোনো, এই বাচ্চাটা—এটা তোমার।
তার মানে?
আমাকে সন্দেহ কোরো না।
ধ্রুব একটু লজ্জা পেল কি? হ্যাঁ, পেল। ফরসা রং একটু লাল হল। বেশ দেখতে লোকটা। লম্বা ছিপছিপে চাবুকের মতো চেহারা। স্পষ্টই বোঝা যায় গায়ে অভিজাত বংশের রক্ত আছে। তবু গোলমালটা কোথায়? কেন গোলমাল? কেন লোকটা স্বাভাবিক নয়?
বিয়ের পরই তাদের জোড়ে দার্জিলিং পাঠিয়েছিলেন শ্বশুরমশাই। সেটা এক ধরনের হানিমুনই হবে। আর সেখানে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল।