স্যার, আমি খুন করেছি

স্যার, আমি খুন করেছি

‘স্যার, আমি খুন করেছি।’

অবাক হলেন? হবারই কথা। আপনারা স্যার সবসময় উলটো কথা শুনে অভ্যস্থ। সবাই বলে, ‘খুন আমি করিনি, আমাকে ছেড়ে দিন।’ তখন স্বীকারোক্তি আদায় করতে আপনাদের কী ঝামেলাতেই না পড়তে হয়। মারধোর, পুলিশ কুকুর, হাতের ছাপ, রক্তের নমুনা একবারে বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড। আমার বেলায় সেসব কিছুই করতে হবে না। আমি নিজেই বলতে এসেছি। আমাকে অ্যারেস্ট করুন। লকাপে নিয়ে যান স্যার। কাল কোর্টে চালান করবেন। কোনো চিন্তা নেই, আমি সব স্বীকার করব। কেন খুন করলাম, কীভাবে খুন করলাম সব। যদি মনে করেন, কাল আমার মন ঘুরে যেতে পারে, অপরাধ অস্বীকার করতে পারি, বলতে পারি, গতকাল যা সত্যি বলেছিলাম, আজ আমার কাছে তা মিথ্যে, তবে এখনই আমার বয়ান নিয়ে রাখুন। কাগজে সই করে দিচ্ছি। যা বলেছি সত্যি বলেছি, সত্যি ছাড়া মিথ্যে বলব না…।

আপনার মুখ দেখে বুঝতে পারছি আমার কথা আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না। আপনার চোখদুটো সরু হয়ে গেছে, ভুরু গেছে কুঁচকে, নাকের পাটা অল্প অল্প কাঁপছে। সবই অবিশ্বাসের লক্ষণ। বিশ্বাসের লক্ষণ আলাদা। তখন চোখ ঝলমল করে।

আপনি স্যার একজন পুলিশ অফিসার। কোথায় যেন শুনেছিলাম, পুলিশ আর নেতারা চট করে কিছু বিশ্বাস করে না। নিয়মে নেই। তারা সবসময় মনে করে, আমরা বাস করি মিথ্যের জগতে। সেখানে মিথ্যের ছদ্মবেশে কিছু সত্যি ঘুরে বেড়ায়। তাদের খুঁজে বের করতে হয়। স্যার, আমি পুলিশ নই, নেতাও নই। আনন্দ আর দুঃখের মধ্যে দিয়ে আমি জেনেছি সত্যি আর মিথ্যে আসলে একটাই বিষয়। তাদের আলাদা করা ঠিক নয়। একে অপরের পাশে তারা চলে চুপিসাড়ে, হামাগুড়ি দিয়ে। কোনটা আলো, কোনটা ছায়া বোঝা যায় না।

আমার এই খুনের ঘটনাটাই দেখুন না স্যার। একটা মিথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে মালবিকাকে আমি খুন করেছি। কিন্তু সেই মিথ্যে যখন সরে গেছে, দিনের আলোর মতো আমার সামনে সত্যিটা স্পষ্ট হয়েছে। সেদিক থেকে বলতে গেলে, মালবিকাকে ভালোবাসি এই মিথ্যে কারণে তাকে যেমন খুন করেছি, আবার মালবিকাকে ভালোবাসি এই সত্যি কারণে আপনার কাছে ধরা দিতেও এসেছি। আপনাদের ভাষায় একে কী বলে? আত্মসমর্পণ? সে যাই বলুক, মজার ঘটনা হল, একই ভালোবাসা একসময়ে সত্যি, একসময়ে মিথ্যে। একসময়ে আলো, একসময়ে ছায়া। আমার কথা কি স্যার বুঝতে সমস্যা হচ্ছে? প্রথমটায় আমারও সমস্যা হয়েছিল স্যার। নিজে কী বলছি, নিজেই ধরতে পারতাম না। ধীরে ধীরে পেরেছি। বুঝতে পেরেছি, শেষ পর্যন্ত ওরা দুজনেই এক। যা সত্যি তাই মিথ্যে। অথবা মিথ্যেটাই আসলে সত্যি। আর তাই আমার হামবেল রিকোয়েস্ট স্যার, আপনিও ফারাক রাখবেন না। অন্তত আমার জন্য একটু নরম হোন। আমার কথা বিশ্বাস করুন। দোহাই স্যার।

স্যার, মুখ দেখে মনে হচ্ছে, এবার আমার কাছে জানতে চাইবেন, কোনো প্রমাণ আছে কিনা।

না স্যার, কোনো প্রমাণ নেই। মালবিকাকে খুনের জন্য আমি কোনো অস্ত্র ব্যবহার করিনি। তার গলা টিপিনি, ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলেও দিইনি। সত্যি কথা বলতে খুনের সময় আমি তার ধারেকাছেও ছিলাম না। সে ছিল তার কলকাতার বাড়িতে, আমি ছিলাম আমডাঙায়। পুরো আমডাঙাতেও নয়, আরও খানিকটা দূরে। দেশের বাড়িতে। গ্রামের নাম মরাবিল, পোস্টাপিস মিরাহাটা, থানা নন্দীপুর। আমাদের গ্রামে মস্ত একটা বিল রয়েছে। তার নামেই গ্রামের নাম। নাম শুনে মনে হয়, বিল মরা, শুকনো। ঘটনা তা নয়। বিলে সারা বছর জল টলমল করে। কী জীবন্ত যে লাগে! যখন বাতাস বয়, এপার ওপার জুড়ে ঢেউ ওঠে, মনে হয় প্রাণশক্তিতে উচ্ছল, উন্মাদ। মনে হয়, চিৎকার করে বলছে, ‘মোরে আরও আরও আরও দাও প্রাণ’। তারপরেও নাম মরাবিল! আশ্চর্য না? দেখুন স্যার, এখানে আবার সেই সত্যি মিথ্যে মিশে গেছে। একে অপরের ঘাড়ে চেপেছে। নাম মরা অথচ কত জীবন্ত! কত আনন্দ!

আপনার চোখমুখ বলছে, আপনি বিরক্ত হচ্ছেন। হবারই কথা। আপনাদের মতো কাজের মানুষের সামনে যদি গাঁয়ের বিল নিয়ে গপ্পো ফাঁদি, বিরক্ত হবারই কথা। যাক, প্রমাণের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। যেহেতু খুনের সময় আমি ছিলাম না, ‘উইপেন ইউসড ফর মার্ডার’ ধরনের কিছু আমার কাছে নেই। থাকলে আপনার টেবিলে রাখতাম। আপনিও ‘এভিডেন্স নম্বর ওয়ান’ লিখে প্লাস্টিকে পুরে মুখ বন্ধ করে ফেলতেন। দুঃখিত স্যার। সে সুযোগ হল না। তবে একটা কথা কি আপনি বিশ্বাস করেন যে অনেক সময় খুনের জন্য অস্ত্র লাগে না?

স্যার, নিজেকে দোষী প্রমাণ করবার সমস্যা আরও আছে। কোনো ভাড়াটে খুনিকে কাজে লাগাই নি। যাকে বলা হয়, সুপারি কিলার’। ফলে আমি যে তার নাম বলে দেব আর আপনি বাংলা, বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড থেকে তাকে পাকড়াও করে নিয়ে আসবেন সে উপায় নেই। খুনি ভাড়া কি চাট্টিখানি কথা? আমার অত পয়সা কই স্যার? বাকি রইল একটাই। আত্মহত্যার জন্য প্ররোচনা। আমি কি আত্মহত্যার জন্য মালবিকাকে প্ররোচনা দিয়েছি? আইপিসি কত যেন?

আমি স্যার মালবিকাকে চিঠি লিখেছিলাম,’তোমাকে ভালোবাসি।’ সেই চিঠি নিশ্চয় স্যার আপনাদের হেফাজতে জমা পড়েছে। ‘ভালোবাসি’ কি প্ররোচনা?

স্যার, আপনার মুখ দেখে বুঝতে পারছি, এখনও আপনি আমাকে বিশ্বাস করছেন না। শুধু বিশ্বাস করছেন না এমন নয়, বিরক্তও হচ্ছেন। নাকের কাছটা একটু লাল, চোখের মণি স্থির। এরপরেও যদি একই কথা বলে যাই, আপনি রেগে যাবেন। একজন হাবিলদারকে ডেকে বলবেন, এই লোকটাকে ঘাড় ধরে বের করে দাও তো।’ দয়া করে এমন কাজ করবেন না স্যার। আমাকে আর একটু সুযোগ দিন। আমি বরং হড়বড়িয়ে গল্পটা আপনাকে বলে ফেলি। তারপর আপনি বিচার করবেন। বিচার করে দেখবেন, আমাকে ধরা করা উচিত কিনা। যদি মনে করেন, উচিত তাহলে তো ল্যাঠা চুকে গেল, আর যদি মনে হয়, ভুল, গালে দুটো চড় মেরে বের করে দেবেন।

তাহলে শুরু করি? আপনি চা দিতে বলুন। চায়ের শেষে আমাকে একটা সিগারেট দেবেন। এক চা-সিগারেটেই গল্প শেষ হবে। খুব বেশি হলে, আরেক কাপ চা। শুধু একটা অনুরোধ, গল্পের সত্যি মিথ্যে নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। সত্যি মিথ্যে নিজের মতো থাকবে, আপনি গল্প শুনবেন আপনার মতো।

একেবারে নিজের নাম থেকে শুরু করা যাক। আমার নাম পরিতোষ। ডাক নাম পরি। বয়স ছাব্বিশ বছর দু’মাস। সামান্য এক চাষি পরিবারের সন্তান। বাড়ি কলকাতা থেকে দূরে। সাইকেলে বড়রাস্তায়। সেখানে ক্ষিরোদকাকার দোকানে সাইকেল রেখে, বাসে রেলস্টেশন যেতে হবে। দিনে কলকাতা যাওয়ার দুটো মাত্র ট্রেন। ট্রেন যত জোরেই ছুটুক হাওড়া পৌঁছোতে তিন ঘণ্টা। গাঁয়ের নাম তো আগেই বলেছি, মরাবিল। সেখানে আমাদের একফালি জমি আছে, একটা হাফ কুঁড়ে হাফ পাকা দোতলা বাড়ি রয়েছে। বাড়ির পিছনে কটা বড় গাছ আছে, একটা পাতকুয়ো আছে, একটা পাকা পায়খানা আছে। পাকা পায়খানা আগে ছিল না। দু’বছর হল হয়েছে। আমাদের ফালি জমিতে ধান ছাড়াও কিছু সবজি হয়। বেশি কিছু নয়, তবে কিছুটা বেচে, কিছুটা খেয়ে আমাদের ছোটো সংসার টেনেটুনে চলে। সংসারে বলতে, বাবা-মা, আমি আর আমার ভাই। আমার ভাইয়ের নাম মহীতোষ। ডাকনাম মহি। মহির সঙ্গে আমার বয়েসের পার্থক্য লম্বা। বারো বছর। সমস্যা সেটা নয়, সমস্যা হল, আমার ভাই জন্ম থেকেই শোওয়া। মেরুদণ্ডের কঠিন রোগ। ডাক্তার বলেছে, রোগ নয়, শিরদাঁড়ায় খামতি রয়েছে। মানুষের সোজা হওয়ার জন্য যে জরুরি কশেরুকাগুলির অতি প্রয়োজন, মহির তার মধ্যে দুটি নেই। এই মানুষকে কৃত্রিম উপায় কিছুটা সোজা করবার জন্য বিপুল খরচ। সেই খরচের দশভাগের এক ভাগও আমাদের নেই। ফলে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড হুইল চেয়ার জোগাড় করা ছাড়া আমাদের করবার কিছু ছিল না। সেই চেয়ারে তেমন কাজ হত না। ধরে না থাকলে ভাইয়ের মাথা হেলে পড়ত। তারপরেও বাবা বাবার মতো, মা মায়ের মতো চেষ্টা করেছে। যেটুকু পারে ডাক্তার দেখিয়েছে, মা পুজোআচ্চা, তাবিজ, জলপড়ায় গেছে। একসময়ে দুজনেই হাল ছাড়ল। ভাই থাকল শুয়ে। স্নান, খাওয়া, পেচ্ছাপ, পায়খানা সব শুয়ে। মা আর আমি ভাগাভাগি করে সামলাতাম। বাবা জমিতে থাকত। না থাকলে খাব কী? একটু বয়স হলে, মাও আর পেরে উঠত না। মহির শরীর ভারি হয়ে উঠল। আমিই মহিকে দেখতে শুরু করলাম।

বাড়ির এই কঠিন অবস্থা সত্ত্বেও, কী ভাবে যেন আমি লেখাপড়ায় ভালো করেছি। তারপরেও স্কুল শেষ করে হওয়ার পর ঠিক করলাম, লেখাপড়া আর করব না। বাবারও বয়স বাড়ছে। একা ক্ষেতের কাজ সামলাতে পারে না। তারওপর বাড়িতে মহি রয়েছে।

মজার কথা কি জানেন স্যার? মহি আমাকে বলল, ‘দাদা, তুমি যদি কলেজে পড়তে না যাও, আমি খাওয়া বন্ধ করে দেব।’

আমি অবাক বললাম, ‘তা কী করে হবে? বাবা-মায়ের বয়স হয়েছে। তারওপর তোমার এই অবস্থা…।’

মহি বলল, ‘কোনও কথা শুনব না দাদা, যা হবার হবে। তোমাকে যেতেই হবে।’

স্যার, একবার বুঝুন মহির কথা! বলছে যা হবে। কী হবে ও জানে না। পোশাক নোংরা করে বিছানায় পড়ে থাকতে হবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। জানে না ও? তারপরেও একথা বলছে! শুধু বলছে না, এরপর একটা মজার কাণ্ড করল। সে সত্যি সত্যি খাওয়া বন্ধ করে দিল। দাদার লেখাপড়া চালু রাখতে ভাইয়ের হাঙ্গার স্ট্রাইক। একটা মজার ঘটনা না স্যার? আমি বাধ্য হয়ে কলকাতায় গিয়ে কলেজে ভর্তি হলাম। সেখানে মেসে ঘর নিলাম। কটা টিউশন এবং কলেজস্ট্রিটে বইয়ের দোকানে পার্ট টাইম বসে খরচের খানিকটা তুলতে হত। ছুটি হলেও কলকাতা দৌড়োতে পারতাম না। টিউশন, পার্টটাইম চাকরি সবই তো থাকত।

ইউনিভার্সিটি শেষ করবার পর আমার জীবন বাঁক নিল। বাঁক! না, বাঁক বলা ঠিক হবে না, বলা উচিত, কঠিন সত্যি থেকে খুব বড় একটা মিথ্যেতে ঢুকে পড়লাম। ট্রেন অন্ধকার টানেলে ঢোকবার মতো।

এক অপরূপ সুন্দরী আমার প্রেমে পড়ল। একটু-আধটু প্রেমে পড়া নয়, মরাবিলের উন্মাদনার মতো প্রেম। এই মেয়ে আমার ইউনিভার্সিটির এক অধ্যাপকের কন্যা। ভালো রেজাল্ট করবার জন্য প্রফেসর আমাকে একদিন বাড়িতে চা খেতে ডেকেছিলেন। সেখানেই মালবিকাকে দেখি। নাকি মালবিকা আমাকে দেখে? সেটা বলাই যথার্থ হবে। মেয়েটি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া সবে শেষ করেছে। চাকরি বাছাই করছে। ভালো কোম্পানি? নাকি আরও ভালো কোম্পানি? এদেশে? নাকি বিদেশে? আমাদের চায়ের আসরে সে যোগ দিয়েছিল। স্যার পরিচয় করিয়ে দিলেন।

‘মালবিকা, মিট পরিতোষ। ভেরি ব্রাইট বয়। খুব হার্ড জীবনের মধ্যে দিয়ে চলেও লেখাপড়া ভীষণ ভালো করেছে! শহরে থাকলে বইয়ের দোকানে পার্ট টাইম কাজ করে, গ্রামে গেলে বাবার সঙ্গে লাঙল ধরে। আমি ঠিক করেছি ও যাতে গবেষণা করতে পারে তার জন্য সবরকম অ্যাসিসটেন্স দেব।’

মালবিকা সহজভাবে বলল, ‘ভালো।’

স্যার, তখন বুঝতে পারেনি, ওই মেয়ে আমার প্রেমে পড়ে গেল। বোঝার কোনো কারণও ছিল না। আমি তো মুখ তুলেও তাকায়নি। শিক্ষিত, বুদ্ধিমতী কোনো মেয়ে এভাবে ‘দেখলাম আর ভালোবেসে ফেললাম’ সিস্টেমে প্রেমে পড়ে না। ও ঘটনা উত্তম-সুচিত্রা সেনের আমলেই শেষ হয়ে গেছে। আমার জীবনে সেই জিনিসই ফিরে এল আমি বুঝব কী করে। প্রথম দেখার দিন পনেরো পরে আবার প্রফেসরের বাড়িতে গিয়েছি। উনি ছিলেন না। খবর পাঠিয়েছেন, কোথায় আটকে গেছেন, ফিরতে দেরি হবে। মালবিকা আমার কাছে বসল। একথা সেকথার পর গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমি যদি একটা কথা বলি, আপনি রাজি হবেন?’

আমি চমকে উঠে বলি, ‘কী কথা?’

মালবিকা চোখ তুলে তাকাল। তাকে দেখতে এতোই সুন্দর যে গম্ভীর হলেও সুন্দর লাগত।

‘আগে বলুন রাজি আছেন?’

তার চোখের চাহনিতে আমি নার্ভাস হলাম। এমনিতেই এই মেয়ের প্রখর ব্যক্তিত্ব। তারওপর প্রফেসরের মেয়ে। প্রফেসর আমাকে সবরকম সাহায্য করছেন। গবেষণার গাইড হয়েছেন তো বটেই, বইপত্র দিয়েছেন, ইউনিভার্সিটি হস্টেলে ঘর ঠিক করে দিয়েছেন। আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘রাজি। বলুন কী কথা?’

মালবিকা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কথা জানার দরকার নেই। তুমি রাজি এটাই জানার ছিল।’

সুন্দরীর মুখে ‘তুমি’ সম্বোধনে আমি চমকে উঠেছিলাম।

সময় কম, প্রেমের বিস্তারিত ঘটনায় যাব না স্যার। শুধু বলে রাখি, প্রেমের প্রকাশ ছিল সত্যি এবং মিথ্যের মাঝখানে। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যখন মনে হয়েছে, মেয়েটাকে ভালোবাসি, তখন ভয় করেছে। নিজেকে বুঝিয়েছি, এ ভালোবাসা সত্যি নয়, এ ভালোবাসা মিথ্যে। এই মিথ্যে কথা মালবিকা এখনই বলা যাবে না। সময় সুযোগ মতো বলতে হবে। কিছুদিনের মধ্যে মালবিকা বাইরে চলে যাওয়ার সুযোগ পেল। দুবাই। মাইনে, বাড়ি, গাড়ি, আর্দালির বিরাট প্যাকেজ।

আমি মালবিকাকে বললাম, ‘এমন হতে পারে না মালবিকা। তুমি ভালো চাকরি পেয়েছ, বিদেশে চলে যাচ্ছ।’

‘কেন হতে পারে না? কেন?’

‘মালবিকা, তুমি আমার বাড়ির অবস্থা জান না।’

জানি। তোমার বাড়ির সঙ্গে তোমার আমাদের বিয়ের কী সম্পর্ক?’

‘আমাদের বাড়ি চাষির বাড়ি। বাবা ধান কাটে, মা পাতকুয়োর পাশে বসে কাপড় কাচে, বেড়ার দেওয়ালে ঘুঁটে দেয়। আমি বাড়ি গেলে মহি’র মলমূত্র পরিষ্কার করি।’

মালবিক ঠান্ডা গলায় বলে, করবে না। চাকরি করে লোক রাখবে। গাঁয়ের জমি বাড়ি বেচে দিয়ে সবাইকে কলকাতায় এনে রাখবে। এখন তোমার টাকা নেই, তখন তোমার টাকা হবে। আমি তোমার পাশে থাকব।’

‘এখন বলছ, পরে এসব হবে না মালবিকা। আমরাও পারব না, ওরাও রাজি হবে না।’

মালবিকা আমাকে শক্ত করে চেপে ধরেছিল। মুখ নামিয়ে আমাকে চুমু খাওয়ার আগে হিসহিসিয়ে বলেছিল, না হলে না হবে। আমি তো তোমার বাড়িকে চাই না, তোমাকে চাই। তোমাকে বিয়ে করব। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।’

আমি মালবিকাকে সরিয়ে দিতে গেলাম। সে আমাকে ছাড়ল না। ওই প্রথম জানতে পারলাম, মেয়েদের প্রেম কত ক্রূর, নিষ্ঠুর!

স্যার, আর এক কাপ চা বলবেন নাকি? না হলে ক্ষতি নেই। গল্প প্রায় শেষ করে এনেছি। আর একটু।

আমি মরাবিলে গিয়ে মাকে মালবিকার কথা বললাম। মা চুপ করে শুনল।

‘খুব ভালো মেয়ে মা। ইঞ্জিনিয়ার। চাকরি নিয়ে বিদেশ চলে যাচ্ছে। আমাকে নিয়ে যাবে বলছে।’

মা মুখ তুলে বলল, দেখ না, মহিকে যদি বিদেশে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখাতে পারিস।’

আমি ফিরে মালবিকাকে বললাম, ‘মা রাজি হয়েছে। মহিকেও বাইরে নিয়ে যাব।’

মালবিকা ভুরু কুঁচকে বিরক্ত মুখে বলল, ‘এটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না পরি? আগে আমি যাই, তোমাকে নিয়ে যাই। তারপর তো তোমার ভাইয়ের কথা।’

আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, ‘সরি, ঠিক বলেছ।’

মালবিকা আমার গালে হাত রেখে নরম গলায় বলল, ‘চল তোমার গাঁয়ের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করি।’

‘আচ্ছা যাব।’

মালবিকা বলল, ‘যাব না। কাল সকালেই চলো। এরপরে আর পারব না। খুব ভোরে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাব।’

আমি দেশে আগাম খবর দিতে পারলাম না। পরদিন বেলায় আমি আর মালবিকা মরাবিলে পৌঁছোলাম। গোটা পথটা মালবিকা খুব উৎসাহে কাটাল। বাড়িতে এসে মুখ শুকিয়ে গেল। যাবারই কথা। মা বিরাট জ্বর বাধিয়ে বিছানায় শুয়ে কোঁকাচ্ছে। বাবা ক্ষেতে গিয়েছে। মহি বিছানা নোংরা করে শুয়ে আছে কুঁকড়ে লজ্জা পেয়ে। যেমনটা ও চিরকাল পেয়েছে। যেন ওর অসমর্থ শিড়দাঁড়ার জন্য ও দায়ী। দুর্গন্ধে বাড়িতে ঢোকা যাচ্ছে না। আমি মালবিকাকে বাইরে একটা মোড়া এনে দিলাম।

‘বস।’

মালবিকা বসল না। সে কাঁধ থেকে ব্যাগ রেখে মাকে নিয়ে পড়ল। মাথা ধুইয়ে গা স্পঞ্জ করে দিল। রান্নাঘরে গিয়ে খুঁজে পেতে দুধ বের করল। স্টোভ জ্বেলে গরম করল। মাকে দিল। নিজের ব্যাগ থেকে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট বের করে দিল। আমি ভাইকে পরিষ্কার করলাম। পাঁজাকোলা করে নিয়ে গিয়ে স্নান করালাম। মালবিকা ওর বিছানায় পাউডার ছড়াল। একপাশে ধূপ জ্বেলে দিল। বাবা জল কাদা মেখে ফিরলে মালবিকা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। তারপর রান্নঘরের দখল নিল। ভাত বসাল, ডাল তরকারি বানাল। ঘরে যা ছিল শশা টশা তাই দিয়ে স্যালাড বানাল। দুপুরে সবাই গরম ভাত খেলাম। বাবা মা, ভাই মালবিকার ওপর খুব খুশি। মা তার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করল। যাবার সময় মহি মালবিকার হাত চেপে ধরল। দিদিকে সে ছাড়বে না। সবথেকে মজার কাণ্ড করল বাবা। বলল, ‘মাগো, তোমার বাবাকে তোমার কুষ্ঠিটা বের করে রাখতে বল দেখি। আমাদের বাড়িতে আবার বিয়ের আগে কুষ্ঠি বিচার না করলে হয় না।’

স্যার, আমি বুঝতে পারছিলাম, এসবই মিথ্যে। এই যত্ন, এই খুশি, এই ভালোবাসা সব। সব ফুরিয়ে যাবে। এই বাড়ির জন্য, বাড়ির লোকজনের জন্য যে অবহেলাটুকু পড়ে থাকবে সেটাই শেষপর্যন্ত সত্যি হবে। আর আমিও সেই সত্যির একটা অংশ হয়ে যাব। আবার একদিন মা জ্বর বাধিয়ে বিছানায় শুয়ে কোঁকাবে। বাবা ক্ষেতে যাবে জল কাদা মাখতে। মহি বিছানা নোংরা করে শুয়ে থাকবে কুঁকড়েমুকুড়ে অনেকটা লজ্জা নিয়ে। মালবিকা চাইলেও আমি এখানে সেদিন আসব না। ঝগড়া করব। বিরক্ত হব। কারণ আমিও ততক্ষণে যে মিথ্যেকে ভালোবেসে ফেলেছি।

বিকেলে মালবিকার সঙ্গে কলকাতা ফিরতে ফিরতে ঠিক করলাম, এই মেয়ের থেকে অনেক দূরে পালাব। নয়তো অন্য কোনো উপায় ভাবতে হবে। স্যার, তখনও আমি খুনের কথা ভাবিনি।

যে বিপদের কথা ভেবেছিলাম তাই হল। হল কিছুদিন পর। মালবিকা আমাকে বিয়ের কথা বলল। যাওয়ার আগে সে রেজিস্ট্রি করতে চায়। তারপর আমার গবেষণা শেষ হলেই আমাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে। আমি চুপ রইলাম। নিজের ঘরে ফিরে সারারাত ছটফট করলাম। এ বিয়ে আমি করব না। কারণ আমি মালবিকাকে যতটা ভালবাসি, ঠিক ততটাই ভালোবাসি না। শুধু আমার বাবা, মা, শয্যাশায়ী ভাইকে ছেড়ে চলে যাওয়ায় নয় স্যার, মালবিকা এমন একজন যে আমাকেও আমার থেকে সরিয়ে নিতে পারবেও। সেই সম্মোহন, সেই মায়া, সেই ক্ষমতা ওর আছে। ময়াল সাপের মতো জাপটে, পিষে, ভালোবেসে মারবে আমাকে। আমার দমবন্ধ হয়ে যাবে। আমি কী নিয়ে থাকব স্যার?

পরদিন ভোর হতে আমি কলকাতা ছেড়ে পালালাম। পালানোর আগে মালবিকাকে এক লাইন চিঠি লিখি। যে চিঠি এখন আপনাদের হেফাজতে। চিঠিতে লিখি ‘মালবিকা, আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

আমি হারিয়ে গেলাম। মালবিকা উন্মাদের মতো আমাকে খুঁজতে লাগল। সে হস্টেলে গেল, আমাকে পেল না। মরাবিল গেল, আমাকে পেল না এভাবে এক মাস কেটে গেল স্যার। মালবিকা তার বিদেশ যাওয়া পিছিয়ে দিল। আবার মরাবিল গেল। আমি ক্ষেতে লুকিয়ে থাকলাম। স্যার, আমি জানতাম মেয়েটা এরপর পারবে না। একটা কিছু করবে। ভয়ংকর কিছু। এই প্রথম তাকে মুখ ফুটে এতো স্পষ্ট করে ভালোবাসার কথা জানিয়েছি না। এরপর আমাকে ছাড়া সে থাকবে কী করে?

আমার অনুমান ঠিক হল স্যার। মালবিকা শেষপর্যন্ত গাদাখানেক ঘুমের ওষুধ খেয়ে বসল। চিঠি লিখে গেল আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।

এবার বলুন স্যার, এই মৃত্যুর জন্য আমি কি দায়ী নই? এটা কি খুন নয় আর সেই খুন কি আমিই করিনি?

স্যার, কথা শেষ। এবার দয়া করে একটা সিগারেট দিন। আরাম করে টেনে লকাপে ঢুকি। এই গল্পের কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে আমি নিজেও তেমন জানি না। আপনিও জানতে চাইবেন না। একটা মিথ্যের কথা বলে শুধু জানিয়ে রাখি, আপনার মামলা সাজাতে হয়তো সুবিধে হবে। যেদিন মালবিকা আমার সঙ্গে প্রথম মরাবিলে যায়, আমার গাঁয়ের বাড়িতে সেদিন ফেরার পথে সে ক্রমাগত বমি করতে থাকে।

‘কী হয়েছে মালবিকা? শরীর খারাপ?’

‘না, দুৰ্গন্ধ।’

‘দুর্গন্ধ! কীসের?’

মালবিকা বলেছিল, ‘তোমাদের বাড়ির দুর্গন্ধ।

আমি অবাক হয়েছিলাম স্যার। দুর্গন্ধ তার সেভাবে পাওয়ার কথা নয়। সে তো বাড়িতে ঢোকেই নি। আমি একটা মোড়া এনে দিয়েছিলাম। বাইরে বসেছিল। জলটুকু পর্যন্ত ছোঁয়নি। তাহলে?

স্যার আমাকে এবার লক-আপে পোরবার ব্যবস্থা করুন।

***

2 Comments
নীলকান্ত February 22, 2025 at 5:13 am

এককথায় অসাধারণ ❤️

It was so good for a lifetime asset no doubt.get pleasure to read.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *