ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়ার পর আমি আর হিমাংশু ঠিক করেছিলাম যে আমরা দু’জন সাইকেলে পূর্ববঙ্গ সফরে বেরুবো। আমার বয়স তখন সবে পনেরো ছাড়িয়েছে। হিমাংশুর ষোলো। প্রথমে পরিকল্পনা করেছিলাম গোটা ভারত পরিক্রমার। পরে নিজেরাই নিজেদের বয়স, অভিজ্ঞতা, সামর্থ্য ইত্যাদির বিশদ বিবেচনার পর আদি পরিকল্পনা বাতিল করে দিই। শেষ পর্যন্ত অবশ্য পূর্ববঙ্গের সামান্য একটু অংশ ভ্রমণ করেই আমাদের অ্যাডভেঞ্চার পর্বের ইতি টানতে হয়। কিন্তু ভ্রমণে বেরিয়ে পড়বার আগের ছোট একটা ইতিহাস আছে। তার কথা বলে নিই।
সাইকেলে করে আমরা দু’জন আনাড়ি কিশোর এইভাবে ঘুরতে বেরুব এটা আমাদের দুই পরিবারের বড়দের কারোরই ভালো লাগেনি। বিশেষ করে আমার পরিবারের। আমি ছিলাম বাড়ির প্রথম সন্তান, উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের আদরে লালিত কষ্ট সহ্য করার অভিজ্ঞতাহীন ছেলে। এইভাবে সাইকেলে ঘুরতে বেরুবার কথা শুনে আমার মায়ের চোখে তো পানি টলমল করতে থাকল। বাবা তখন চাকরিসূত্রে অন্যত্র থাকেন। আমাদের দেশ-ভ্রমণের পরিকল্পনার খবর পেয়ে একটা অসামান্য চিঠি লিখেছিলেন। অনেকদিন পর্যন্ত আমি চিঠিটা যত্ন করে তুলে রেখেছিলাম, এখন আর খুঁজে পাচ্ছি না। কিশোরজীবনে অ্যাডভেঞ্চারের স্থান, আশা আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন আর সাধ্য-সামর্থ্য, বাস্তবতার সঙ্গে সমন্বয় বিধানের অত্যাবশ্যকতা, মা-বাবা কেন সন্তানের জন্য উদ্বিগ্ন হন এইসব কথা খুব সহজ ও সুন্দর করে লিখেছিলেন বাবা। শেষ পর্যন্ত তিনি ওই ভ্রমণের অনুমোদন দিয়েছিলেন, তবে সাবধান করে দিয়েছিলেন যে মিথ্যা আত্মাভিমান অথবা জেদের বশে যেন কিছু না করি। অর্থাৎ সহজে যতদূর ঘুরতে পারি ততদূরই যেন যাই, তার বেশি নয়।
একদিন কাকডাকা ভোরে আমরা দুই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ঝোলার মধ্যে এক প্রস্থ করে শার্ট- প্যান্ট, গামছা-গেঞ্জি, টুথব্রাশ-টুথপেস্ট-চিরুনি, পানির ফ্লাস্ক, টর্চলাইট, ছোট একটা ছুরি, একট শিশিতে একটু আয়োডিন, একটা ছোট নোটবই ও পেনসিল, আরো দু’চারটে টুকিটাকি জিনিস। শেষ মুহূর্তে আমি, আগে পড়া হলেও, ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মাদার’ বইটাও সঙ্গে নিয়ে নিলাম।
কত কাল আগের কথা। ১৯৩৮-এর একেবারে গোড়ার দিকের ঘটনা। সব আজ ভালো করে মনেও নেই। আমরা কিছু মাত্র স্ট্রেন না করে সহজভাবে সাইকেল চালিয়েছিলাম। দুপুরে একটা গঞ্জে থেমে সস্তা হোটেলে ডাল ভাত মাছ তরকারি খেয়ে নিয়ে তারপর আবার চলতে শুরু করি। সন্ধ্যার আগে হঠাৎ ঝড় উঠে বৃষ্টি নামল। সে এক বিশ্রী ব্যাপার। বাতাস ঠেলে সাইকেল চালানো কষ্টকর হয়ে উঠল। পরের জনপদ থেকে আমরা তখনো তিন-চার মাইল দূরে। ভিজে সপসপে হয়ে আমরা যখন সেখানে এসে পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা অতিক্রান্ত। সেটা ছিল ফরিদপুর শহরের কাছাকাছি একটা পুরোপুরি হিন্দুপ্রধান গ্রাম। গৃহস্থবাড়িতে শাঁখ বাজানো ও তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালানো হয়ে গেছে। গ্রামে ঢুকে একজন মাঝ বয়সী চাষীর কাছে খবর নিয়ে আমরা এক সমৃদ্ধ গোছের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করলাম। বেশ সচ্ছল গৃহস্থ। হিন্দু। হিমাংশু আমাকে আগেই বলে দিয়েছিল যে এই রকম গ্রামাঞ্চলে দুটি অল্প বয়সের ছেলে, একজন হিন্দু ও আরেকজন মুসলমান, ওই রকম গোলমেলে পরিচয়ে আমাদের কোনো বাড়িতে আশ্রয় পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। কাজেই আমি হয়ে গেলাম হিমাংশুর ছোট সুধাংশু। চেহারা, পোশাক-আশাক ও কথাবার্তায় কে কোনো ধর্মের তা বোঝার কোনো উপায় ছিল না। শুধু আমাকে সতর্ক থাকতে হবে যেন পানি বলে না ফেলি, হিমাংশুকে দাদা বলে সম্বোধন করি এবং এঁটো ডান হাতে কাঁসার গ্লাস তুলে নিয়ে পানি খাই। গৃহকর্তা সেই বাদলের রাতে আমাদের সমাদর করে আশ্রয় দিয়েছিলেন, শোবার ব্যবস্থা করেছিলেন বাইরের ঘরে টিনের আটচালায়, খেতে দিয়েছিলেন চিড়া-মুড়ি-কলা ও দুধ।
আমরা পরদিন খুব ভোরে ওই গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। তবে আমাদের কিশোর বয়সের সেই অ্যাডভেঞ্চার আর বেশি দূর অগ্রসর হয়নি। শারীরিক ক্লান্তি ও প্রতিকূল আবহাওয়ার অত্যাচারে মধ্যাহ্নের দিকেই আবার আমরা ঘরের পথ ধরি। সব মিলিয়ে আমরা বোধহয় সোয়াশো মাইলের মতে ঘুরেছিলাম যাই হোক, আজ কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে গেলেও ওই সাইকেল ভ্রমণের স্মৃতি আমার মনে বহুদিন উজ্জ্বল হয়ে ছিল। হিমাংশু ও আমার বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে ওই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা একটা নতুন মাত্রিকতা যোগ করেছিল।