শিস

শিস

অনিমেষের সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক দিনের। আত্মা ও পরলোক সম্বন্ধীয় ব্যাপারে তার জ্ঞান সুবিদিত, এ বিষয়ে সে যথেষ্ট পড়াশুনা ও তথ্যানুসন্ধান করেছে। এককথায় তাকে পারলৌকিকবিদ বলা চলে। মাঝে মাঝে জটিল ভৌতিক রহস্যের অনুসন্ধানের জন্যে তার ডাক আসে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেইসব সমস্যার হয় সমাধান, নয় এমন ব্যবস্থার নির্দেশ দিয়েছে যার ফলে তার মক্কেলরা উপকৃত হয়েছে।

একদিন বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় তার বসবার ঘরে হাজির হয়েছিলাম। ভূতুড়ে গল্পের রসদ সংগ্রহের জন্যে মাঝে মাঝেই আমি তার বাড়ি হানা দিতাম। অনিমেষ বিয়ে করেনি। দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত পল্লিতে পৈতৃক বাড়ির চারটি ফ্ল্যাটের মধ্যে তিনটি ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে অবশিষ্ট ফ্ল্যাটটিতে সে তার কমবাইন্ড হ্যান্ড অনাদিকে নিয়ে থাকে।

বাইরে ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে অনিমেষ একটা সিগারেট ধরাল। তার মুখে একটা গভীর চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে; দৃষ্টিটাও অন্যমনস্ক। বুঝলাম সে একটা সমস্যায় চিন্তাক্লিষ্ট। আমি কোনো প্রশ্ন না করে অপেক্ষা করতে লাগলাম, কারণ আমি জানি ও নিজে থেকেই সব আমাকে খুলে বলবে। আমার অনুমানই ঠিক; কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর অনিমেষ বলল, ‘একটা গুরুতর সমস্যায় পড়েছি, ঘটনাটা ভৌতিক না আর কিছু, বুঝে উঠতে পারছি না।’ সে ঘন ঘন কয়েকবার সিগারেটে টান দিল; আমি উৎসুকভাবে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। অনিমেষ সিগারেটে একটা শেষ টান দিয়ে সেটাকে ছাইদানিতে ঘষে নিভিয়ে ফেলতে ফেলতে বলতে শুরু করে, ‘আজ থেকে ঠিক পনেরো দিন আগে আমি একটা জরুরি ডাকে বিষ্ণুপুর গিয়েছিলাম। দীপক রায় সেখানকার একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসায়ী। তাঁর আদি ব্যাবসা বাঁকুড়ায়, বিষ্ণুপুরে গত একবছর ধরে তিনি নতুন ব্যাবসার পত্তন করেছেন এবং এই অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ জাঁকিয়ে বসেছেন। মাসকয়েক আগে তিনি শহরের প্রান্তে একটা খুব বড়ো বাড়ি কিনেছেন। বাড়িটা বহুদিনের পুরোনো এবং প্রায় ভগ্নদশা বলে জলের দামে তিনি কিনে সংস্কার করতে শুরু করেন। বাড়িটার ঘরগুলো মস্ত বড়ো বড়ো, সাবেকি আমলের। তিনি যতদূর সম্ভব বাড়িটার মূল গঠনপ্রণালী বজায় রেখে বাড়িটাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজিয়েছেন। মাত্র গত মাসেই তিনি ওই বাড়িতে প্রবেশ করেন।

‘বাড়িটা কেনার আগে অনেকেই তাঁকে নিষেধ করেছিলেন— বাড়িটা নাকি ভূতুড়ে এবং গত কুড়ি বছরে অনেকেই বাড়িটা কিনেছিলেন, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বেচে দিতে বাধ্য হন। দীপকবাবু অবশ্য ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করেন না। তাই তাঁদের কথা শোনেননি।

‘তিনি বাড়িতে ঢোকার ঠিক পঞ্চম রাত্রে পুব দিকের শেষ প্রান্তের ঘর থেকে একটা অস্বস্তিকর শিসের শব্দ শুনতে পান। শিসের শব্দটা এমন বিচিত্র যেন মনে হয় কেউ বুঝি শয়তানি হাসি হাসছে। দীপকবাবু, তাঁর ছোটোভাই আর তাদের অনেকদিনের পুরোনো চাকর রামু ব্যাপারটা অনুসন্ধান করবার উদ্দেশ্যে লন্ঠন নিয়ে সেই ঘরের বন্ধ দরজা খুলে ভেতরে ঢোকেন। আশ্চর্য! ঘরের মধ্যে তাঁরা কাউকে দেখতে পেলেন না, অথচ সমস্ত ঘর জুড়ে শিসের শব্দটা ভেসে বেড়াচ্ছে, আর যেদিকেই তাঁরা মুখ করে দাঁড়ান না কেন, মনে হচ্ছে কেউ যেন তাঁদের পেছন থেকে শিস দিচ্ছে। তারা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দরজায় চাবি লাগিয়ে দিলেন তারপর লাঠিসোঁটা নিয়ে বাড়ির চারপাশে খুঁজে দেখতে লাগলেন কেউ বা কারা তাদের ভয় দেখাবার উদ্দেশ্যে একটা ভৌতিক আবহাওয়া সৃষ্টি করবার কৌশল অবলম্বন করছে কি না। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও তাঁরা কারো টিকি দেখতে পেলেন না। ঘর থেকে শিসের শব্দ কিন্তু তখনও ভেসে আসছে।

পরদিন দিনের আলোয় তাঁরা ঘরটার মেঝে, দেওয়াল এবং আনাচকানাচ পরীক্ষা করে দেখলেন, কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুই তাঁদের চোখে পড়ল না। প্রতিদিন রাত্রে তারা বাড়ির চারপাশে পাহারা বসালেন কিন্তু শিসের রহস্য আর ভেদ হল না— এদিকে রামু ছাড়া বাড়ির আর সব চাকরবাকর ভূতের ভয়ে পালিয়েছে; অত বড়ো বাড়িটাতে এখন মাত্র তিনটি প্রাণী। এর পরই তিনি আমার সাহায্যপ্রার্থী হন।

‘এখন ব্যাপার হল, দীপকবাবু বিষ্ণুপুরে আসার অল্প কিছুদিন পরেই স্থানীয় এক উকিলের একমাত্র মেয়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের সৌভাগ্য হয়। মহিলা নাকি অপূর্ব রূপসি। এই পরিচয় ক্রমশ অন্তরঙ্গতায় পরিণত হয় এবং তাদের বিয়ের কথাও পাকাপাকি হয়ে যায়। স্থানীয় অনেক যুবকই ওই মহিলার পাণিপ্রার্থী ছিল, তাদের এই ঘটনায় ঈর্ষা হওয়া স্বাভাবিক। বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে যাবার পর দীপকবাবু আগে যে বাড়িতে থাকতেন সেখানে একটা ভোজের আয়োজন করেন। শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ছাড়াও এইসব স্থানীয় যুবকের দলও এই ভোজে আমন্ত্রিত হয়েছিল।

‘কথায় কথায় ওই বাড়ির প্রসঙ্গ ওঠে এবং ওটা যে হানাবাড়ি সে-সম্বন্ধে কারো দ্বিমত ছিল না। দীপকবাবু কথাটা হেসে উড়িয়ে দিলে তাদের মধ্যে একজন বাজি ধরে যে দু-মাসের বেশি তিনি কিছুতেই ওই বাড়িতে বাস করতে পারবেন না। দীপকবাবুও বাজিতে রাজি হয়ে যান— তাই প্রথম প্রথম তার সন্দেহ হয়েছিল যে, তাঁকে বাজিতে হারাবার উদ্দেশ্যেই স্থানীয় যুবকেরা কোনো কৌশলে শিসের শব্দ করছে।

‘বাড়িটার এমনিতেই অপবাদ আছে, তার ওপর রাত্রে ওই ধরনের শব্দ শুনলে অতি বড়ো সাহসীরও কাবু হয়ে পড়া বিচিত্র নয়। কিন্তু বহু চেষ্টাতেও সেই স্থানীয় যুবকদের সন্ধান কিংবা সেই শিসের সূত্র না পাওয়ায় তাঁর বিশ্বাসে ফাটল ধরেছে এবং সমস্ত ঘটনাটা যে ভৌতিক সে বিষয়ে এখন আর তাঁর সন্দেহ নেই।

‘আমি সন্ধের মুখে বিষ্ণুপুর পৌঁছোলাম; ঘটনাটা শুনতে শুনতে রাত ন-টা বেজে গেল। তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা বসবার ঘরে এসে বসেছি এমন সময় তীক্ষ্ন একটা শিসের শব্দ অন্ধকারের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে খান খান করে দিল। একটা অমানুষিক, গা ছমছম করা তীব্র শিস— ভূত-প্রেত নিয়েই আমার কারবার কিন্তু আমারও গায়ের লোম যেন খাড়া হয়ে উঠল। শিসের তীব্রতা ক্রমে বেড়েই চলল। আমরা লাঠিসোঁটা আর আলো নিয়ে ওই ঘরের দিকে ছুটলাম।

‘আগেই বলেছি ঘরটা পুবদিকের শেষপ্রান্তের ঘর। সাবেকি আমলের বাড়ি, বিরাট বিরাট ঘর আর সেই লম্বা টানা প্রশস্ত বারান্দা। বসবার ঘর থেকে সেই রহস্যময় ঘরের দূরত্ব কম নয়। যাহোক, আমরা একটু এগুতেই মনে হল যেন সমস্ত ঢাকা বারান্দায় শিসের ধ্বনির প্রতিধ্বনি হচ্ছে। আমরা দরজা খুলে ঘরের ভেতরে ঢুকলাম। মুহূর্তে সেই শিসের শব্দটা আমাদের এই অনাহূত উপস্থিতিতে থমকে গেল, কিন্তু পরক্ষণেই আমাদের সচকিত করে শিস শুরু হল— যেন আমাদের ব্যঙ্গ করছে। শব্দটা যেন একটা ভয়ংকর রূপ নিতে লাগল। একটা প্রতিহিংসার সুর আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম। ঠিক তারপরই কেউ যেন আমার কানে ফিসফিস করে বলল, ‘শিগগির পালাও।’

‘আমি এর আগে কয়েকটা ঘটনায় এইরকম সতর্কবাণী অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সুফল পেয়েছি। সুতরাং আর দ্বিরুক্তি না করে চেঁচিয়ে বললাম, ”সবাই এইমুহূর্তে বেরিয়ে চলুন।” তারপর একলাফে সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে এসে বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। ঠিক সঙ্গেসঙ্গেই ঘর থেকে একটা অস্বাভাবিক তীব্র আর্তনাদ আর ভয়ংকর শিসের শব্দ ভেসে এল। তারপর সব চুপচাপ।

‘আমার শোবার ব্যবস্থা হয়েছিল বসবার ঘরের পাশেই অতিথিদের জন্যে নির্দিষ্ট একটা ঘরে। সেই ঘরটার পরেই ঢালা বারান্দা, তারপর শেষপ্রান্তেই ভূতুড়ে ঘরটা। রাতে সবাই শুয়ে পড়ার পর আমি আমার সাজসরঞ্জামের বাক্সটা নিয়ে বসলাম। বিদেশে, বিশেষ করে ইউরোপের লোকেদের বিশ্বাস যে প্রেতাত্মারা কিছুতেই রসুনের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। আমিও কয়েকবার রসুনের সাহায্য নিয়ে সুফল পেয়েছি। একটা রসুনের মালা আমি গলায় পরলাম, দুই কানের ফুটোর মধ্যে আলগা করে রসুন গুঁজে দিলাম। তারপর হাতে একটা শক্তিশালী বৈদ্যুতিক টর্চ নিয়ে ঘরের দরজা খুলে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়লাম। ততক্ষণে সমস্ত বাড়িটা সুপ্তির কোলে ঢলে পড়েছে।

রহস্যময় ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে আমার বুকটা একবার কেঁপে উঠল, কিন্তু না, পেছোনো চলবে না। দরজাটার বাইরে থেকে চাবি লাগানো ছিল। আমি চাবি খুলে এক লাথি মেরে দরজাটা খুলে ফেললাম। টর্চের আলোয় ঘরটা আলোকিত হয়ে উঠল। দরজার চৌকাঠ থেকে সমস্ত ঘরটায় আলো ফেললাম, না কোথাও কিছু নেই। আমি আর দ্বিধা না করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। সঙ্গেসঙ্গে আমার মনে হল ঘরের এই নৈঃশব্দ্য যেন অস্বাভাবিক। একটা অমঙ্গলজনক আর পাশবিক ভয়াবহতা যেন সমস্ত ঘর জুড়ে রয়েছে, ভয়ংকর একটা উদ্দেশ্য নিয়ে যেন আমাকে লক্ষ করছে। আমি আর কালক্ষেপ না করে আমার কাজ শুরু করে দিলাম।

‘ঘরের বন্ধ জানালা দুটোর প্রত্যেকটা কাচের শার্সির ওপর মানুষের লম্বা চুল আড়াআড়িভাবে আঠা দিয়ে আটকে দিলাম। এটা হল প্রেতাত্মাদের শূন্য পথে সহজ যাতায়াতের একটা প্রতিবন্ধক। এসব যখন করছি তখন ঘরের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে আমি অনুভব করলাম। নিঃস্তব্ধতা যেন ক্রমশঃ গাঢ় আর জমাট হয়ে উঠছে। কেউ যে আমার প্রতিটি কাজ লক্ষ করছে তা আমি আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি দিয়ে স্পষ্ট উপলব্ধি করলাম।

‘আমার কাজ যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে ঠিক তক্ষুনি ঘরের মধ্যে একটা চাপা বিদ্রূপাত্মক শিস ধ্বনিত হয়ে উঠল। কেউ যেন আমাকে ভীষণভাবে ব্যঙ্গ করছে। আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা হিম শিহরন বয়ে গেল। শিসের শব্দটা ক্রমশ একটা ভয়ংকর আকার নিয়ে উচ্চ হতে উচ্চতর গ্রামে সমস্ত ঘর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। আশ্চর্য, শিসটা ঠিক মানুষের সুর করে শিস দেওয়ার মতো হলেও তার চরিত্র অমানুষিক, পৈশাচিক। আমি এক ছুটে দরজার কাছে চলে এলাম, আর ঠিক সেইমুহূর্তে একটা অবর্ণনীয় যন্ত্রণা-কাতর ক্রুদ্ধ চিৎকার— অনেকটা অমঙ্গলকামী আর্তনাদের মতো— শিসের শব্দকে ছাপিয়ে বেজে উঠল। আমি এক হ্যাঁচকায় দরজার একটা পাল্লা খুলে বেরিয়ে এলাম, বাইরে থেকে সশব্দে সেটা টেনে বন্ধ করে চাবি লাগিয়ে দিলাম।

‘বাইরে, দরজাটার ঠিক উলটোদিকের দেয়ালে ঠেস দিয়ে আমি হাঁপাতে লাগলাম। বুঝতে পারলাম ঘটনাটা ভৌতিক নয়, পৈশাচিক এবং আমি যেসব সাবধানতা অবলম্বন করেছি তা হয়তো যথেষ্ট নয়। সবচেয়ে বড়ো কথা হল, একটা জড় মৃতের জীবিতের মতো আচার ব্যবহারের প্রয়াস। এযাত্রা আমি খুব অল্পের জন্যে বেঁচে গেছি। যে পিশাচ ইট, কাঠ ও পাথরের মধ্যে দিয়ে মানুষের মতো কণ্ঠস্বর অনুকরণ করার ক্ষমতা রাখে তার কাছে রসুন বা কোনো পবিত্র রক্ষাকবচই পর্যাপ্ত নয়। এই ধরনের পিশাচের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার কোনো ব্যবস্থা আছে কিনা আমার জানা নেই। অবশ্য কয়েক মুহূর্তের জন্য যা এই পিশাচকেও দমন করে রাখতে পারে তা হল পিশাচ-সিদ্ধের মন্ত্রগুপ্তির শেষ স্তবকের শেষ চরণ। শুনেছি যখনই পিশাচ ভয়ংকর হয়ে ওঠে, জীবিত প্রাণীর অনিষ্ট করতে উদ্যত হয়, তখনই আপনা থেকে সেই অজ্ঞাত চরণটি উচ্চারিত হয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য সে পিশাচকে দুষ্কর্ম থেকে নিরস্ত করে।

‘ঘরের মধ্যে তখন অবিরাম শিস বেজে চলেছে, কিন্তু ক্রমে ক্রমে তা মিলিয়ে গেল। বাইরে থেকেই ভেতরের নিস্তব্ধতার মধ্যে আমি একটা গোপন নিষ্ঠুর ইচ্ছার আভাস পেতে লাগলাম। যাহোক, আমি আমার ঘরে ফিরে এসে শুয়ে পড়লাম।

‘ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু রাত প্রায় দুটোর সময় তীব্র শিসের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। সমস্ত বাড়িটা মনে হল শিসের শব্দে ভরে গেছে। যেন একটা দানব মত্ত হয়ে উঠেছে। আমি উঠে বসতেই ঘরের দরজাটা খুলে গেল আর দীপকবাবু লণ্ঠন হাতে প্রবেশ করলেন। তিনি বললেন যে শিসের প্রচণ্ডতায় তাঁরও ঘুম ভেঙে গেছে। পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করে তিনি আমাকে বললেন, ‘চলুন, আজ ঘরে ঢুকে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়ব, এ আর সহ্য হয় না। একটা ফয়সালা হয়ে যাক।’ আমি তাঁকে অনেক বুঝিয়ে নিরস্ত করলাম। ঘণ্টাখানেক পর শিস থামল। দীপকবাবুও নিজের ঘরে চলে গেলেন।

‘সকাল বেলা আমি আবার ঘরটা পরীক্ষা করলাম। দরজার বাইরে থেকে আমি যে চুল দিয়ে ‘সিল’ করে দিয়েছিলাম তা ঠিকই আছে। ভেতরের জানালার শার্সিগুলোর একটার চুল কিন্তু আলগা হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। আমি ভাবলাম হয়তো কাল স্নায়বিক উত্তেজনার বশে চুলটা ঠিকমতো লাগাতে পারিনি তাই খুলে গেছে। আমি নতুন করে সেই শার্সিটা ‘সিল’ করে দিলাম। তারপর দেওয়ালগুলো আবার ভালো করে পরীক্ষা করতে শুরু করলাম। এমনও তো হতে পারে কেউ একটা ভৌতিক আবহাওয়া সৃষ্টির উদ্দেশ্যে দেওয়ালের মধ্যে গর্ত করে একটা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বসিয়েছে, যা থেকে শিসের মতো শব্দ বেরুচ্ছে। কিন্তু আমার সবরকম পরীক্ষাই এমনকী কোনো লুকোনো যন্ত্রের সঠিক অবস্থান নির্ণয়ের জন্য যে সর্বাধুনিক যন্ত্র ব্যবহৃত হয় তা দিয়ে পরীক্ষাও ব্যর্থ হল। এরপর প্রায় প্রত্যেক রাতেই সেই শিসের আওয়াজ অসহ্য হয়ে উঠল। যেন ঘরে কেউ আমার নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ করে তার বিদ্বেষ প্রকাশ করছে। প্রতি রাতে নিঃশব্দ পায়ে আমি সেই ঘরের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়াতাম; সঙ্গেসঙ্গে ভেতরের শিসের আওয়াজ যেন বদলে যেত। একটা ভয়াবহ বিদ্রূপের সুর ধ্বনিত হয়ে উঠত, যেন অর্ধজীবন্ত একটা দানব বন্ধ ঘরের দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে আমাকে স্পষ্ট লক্ষ করছে। ক্রমে তার শিসের গর্জন সমস্ত বারান্দায় ছড়িয়ে পড়ত আর আমি দেওয়ালে ঠেস দিয়ে একা অসহায়ের মতো বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম।

‘প্রত্যেকদিন সকাল বেলা আমি ঘরে প্রবেশ করে চুলের ”সিল”গুলো ঠিক আছে কি না পরীক্ষা করতাম। প্রথম সপ্তাহের পর ঘরের চার দেওয়াল জুড়ে সমান্তরালভাবে চুল আটকে দেওয়া ছাড়াও আমি সমস্ত মেঝে বরাবর মিহি বিস্কুটের গুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। যদি কোনো জীবন্ত প্রাণী কোনো গুপ্তপথে ঘরে প্রবেশ করে তবে আমি সহজেই তার পায়ের ছাপ লক্ষ করে তাকে অনুসরণ করতে পারব। কিন্তু এখানেও আমাকে হার মানতে হল। ভেতরের কোনো জিনিসেরই কোনোরকম নড়চড় হয়নি।

‘একদিন মাঝরাতে আমি কীসের একটা তীব্র আকর্ষণে দরজাটা খুলে ভেতরে পা দিলাম, সঙ্গেসঙ্গে সমস্ত ঘরটা জুড়ে একটা উন্মত্ত তীক্ষ্ন চিৎকার বেজে উঠল; আমার মনে হল আওয়াজটা যেন আমাকে লক্ষ করে তেড়ে আসছে। সঙ্গেসঙ্গে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে দরজাটা টেনে দিলাম।

‘কালই আমি ফিরে এসেছি। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে এই বিষয়ে একটা দুর্মূল্য জার্মান বই আছে। সেটা থেকে যদি কিছু প্রতিবিধান পাই এই আশাতেই এসেছি। আবার আগামীকালই ওখানে যাব। অবশ্য দীপকবাবুকে আমি বার বার করে বলে এসেছি আমার অবর্তমানে কোনো কারণেই যেন ঘরের দরজা রাত্রিবেলা খোলা না হয়। ভালো কথা, শিসের আওয়াজটা ‘টেপ’ করে নিয়েছিলাম, কিন্তু রেকর্ড যখন চালানো হল তখন দেখা গেল কোনো আওয়াজ হচ্ছে না। অর একটা অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, রাত্রে শিসের সময় আমি ‘মাইক’ ব্যবহার করে দেখেছি শব্দটা বাড়ে না, এমনকী মাইকের মধ্য দিয়ে আওয়াজ যায়ই না— যেন শিসের কোনো অস্তিত্বই নেই।’ অনিমেষ চুপ করল।

সরকারি কাজে বাইরে যাওয়ায় অনিমেষের সঙ্গে আমার প্রায় দিন কুড়ি দেখা হয়নি। প্রথম সুযোগেই আমি তার বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। স্মিত মুখে সে আমাকে অভ্যর্থনা জানাল। অনাদি সেদিন মুরগির মাংস রান্না করেছে, একটা সুগন্ধ বসবার ঘরটাকেও ভরিয়ে তুলেছে। অনিমেষ মৃদু হেসে বলল, ‘আজ রাত্রে খেয়ে যা, নচেৎ শুধু আঘ্রানে পেট ভরিয়ে চলে গেলে আমার নিশ্চয় শরীর খারাপ হবে।’ আমিও ভেবে দেখলাম অনিমেষের কথাটা নেহাত মিথ্যে নয়, তাই এককথাতেই হেসে রাজি হয়ে গেলাম।

পরিতৃপ্তির সঙ্গে নৈশভোজন শেষ করে আমরা বসবার ঘরে গিয়ে বসলাম। অনিমেষ একটা সিগারেট ধরিয়ে তার কাহিনির দ্বিতীয় পর্ব শুরু করল।

‘তোর সঙ্গে শেষ দেখার পরদিনই আমি বিষ্ণুপুর রওনা হলাম। আমি যখন সেখানে পৌঁছুলাম তখন বেশ রাত। যাওয়ার আগে দীপকবাবুকে আমি খবর পাঠাইনি তাই তিনি গাড়ি নিয়ে আমাকে নিতে আসেননি। সেটা ছিল চাঁদনি রাত; ফুটফুটে জোছনায় সব সাদা আর ভারি সুন্দর দেখাচ্ছিল। আমি ঠিক করলাম অমন সুন্দর রাতে হেঁটে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়। দীপকবাবুর বাড়িটা ছিল স্টেশন থেকে প্রায় মাইলতিনেক দূরে, শহরের একপ্রান্তে। আমি যখন তার বাড়ির কাছে এসে পৌঁছুলাম তখন প্রায় রাত এগারোটা; চারদিক নিস্তব্ধ।

‘আগেই বলেছি বাড়িটা সাবেকি আমলের খুব বড়ো বাড়ি, আর বাড়ির লাগোয়া জমি ও বাগান অনেকখানি জায়গা নিয়ে। আমি গেট খুলে কিছুটা হাঁটার পরেই পুব প্রান্তের সেই ঘর থেকে শিসের শব্দটা ভেসে এল, যেন আমাকে বিদ্রূপ করেই ওটা ধ্বনিত হল। একটানা মৃদু অথচ তীক্ষ্ন শিস; রাতের শান্ত নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে সেই আওয়াজ আমার মুখের ওপর সোজা ছোবল মারল। আমি ততক্ষণে সেই ঘরের একটা জানালার নীচে এসে দাঁড়িয়েছি। ঘরটা যদিও একতলায় কিন্তু বড়ো বড়ো ঘর হওয়ার দরুন জানালাগুলি একটু উঁচুতে, মাটিতে দাঁড়িয়ে ভেতরটা দেখা যায় না। বাগানে বসবার জন্য কয়েকটা চেয়ার ছিল; আমি একটা চেয়ার টেনে ঘরের ঠিক মাঝখানে যে জানালাটা, তার তলায় রাখলাম। তারপর চেয়ারে দাঁড়িয়ে জানালার কাচের ভেতর দিয়ে ভেতরটা দেখতে লাগলাম।

‘চাঁদের আলোয় ভেতরটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। শিসের শব্দটা ক্রমেই বেড়ে চলল। জীবিত মানুষের অনুকরণে শিস দেবার একটা অমানুষিক, বীভৎস প্রয়াস। যেন একটা পিশাচের মধ্যে জীবিত মানুষের আত্মা প্রবেশ করে শিস দিচ্ছে।

তারপর হঠাৎ একটা অদ্ভুত জিনিস আমি লক্ষ করলাম। সেই প্রকাণ্ড ঘরের ঠিক মাঝখানের মেঝেটা যেন কুঁচকে নরম উঁচু ঢিবির আকার ধারণ করেছে, ঢিবির চূড়ায় একটা গর্ত; আর সেই গর্তটা শিসের শব্দের সঙ্গে কেঁপে কেঁপে উঠছে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো ব্যাপারটা লক্ষ করতে লাগলাম। সেই গর্ত বা ফাঁকটা নিশ্বাস টানা আর ছাড়ার মতো নড়ে উঠছে। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস টেনে যেন সেটা কেঁপে উঠছে আর সঙ্গেসঙ্গে অবিশ্বাস্য সুরে শিস বেজে উঠছে। তারপরই আমি আবিষ্কার করলাম বস্তুটা জীবন্ত; চাঁদের আলোয় দুটো পাশবিক বিশাল, কালো স্ফীত ঠোঁট স্পষ্ট দেখতে পেলাম। সেই ঠোঁট দুটো যেন অসীম প্রচেষ্টায় শিস দিচ্ছে আর স্ফীত ঠোঁটের চারপাশটা কুঁচকে যাচ্ছে। দারুণ পরিশ্রমে ওপরের পুরু বিশাল ঠোঁটের ওপর ঘন ঘাম জমে গেছে।

‘সেই মুহূর্তে তীব্র আর্তনাদ করে শিসটা বেজে উঠল, আমি শিউরে উঠলাম। পরক্ষণেই আমি স্তম্ভিত হয়ে ঘরের মসৃণ মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলাম; ঢিবির কোনো চিহ্নই নেই; সম্পূর্ণ নিরীহ, আসবাবশূন্য একটা বিরাট ঘর। কিন্তু আমার তো দৃষ্টিভ্রম হয়নি; চাঁদের আলোয় আমি সব স্পষ্ট দেখেছি। একটা ভীষণ ভয় আমাকে ঘিরে ধরল। আমি চেয়ার থেকে নেমে ছুটে পালাব ভাবছি ঠিক সেই সময় ঘরের ভেতর থেকে দীপকবাবুর আর্তনাদ শুনতে পেলাম, ‘বাঁচাও, বাঁচাও।’

আমি যেন সাহস ফিরে পেলাম। কাচের জানলায় জোরে আঘাত করতেই কাচ ভেঙে গেল। ফোকর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ভেতরের ছিকিনিটা খুলে এক ধাক্কা দিতেই জানালাটা হাঁ হয়ে গেল। আমি জানলা দিয়ে লাফ মেরে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লাম, তারপর ফায়ার প্লেসের দিকে ছুটে গেলাম। আমার কেন জানি মনে হয়েছিল দীপকবাবুর চিৎকারটা ওদিক থেকেই এসেছে। কিন্তু কোথায় দীপকবাবু। সমস্ত ঘরটা ফাঁকা, কেউ নেই। বিদ্যুৎ চমকের মতো আমি উপলব্ধি করলাম, দীপকবাবু ঘরে কখনোই ছিলেন না; আমাকে বিভ্রান্ত করে ঘরে টেনে আনার জন্যই অশরীরী পিশাচটা ওই ধূর্ত কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে।

‘আমি পেছন ফিরে জানালা লক্ষ করে ছুটলাম, আর সেই মুহূর্তে একটা ভয়াবহ শিসের আর্তনাদে সমস্ত ঘরটা ভরে উঠল। আমার মনে হল চারপাশের দেওয়াল আমার দিকে এগিয়ে আসছে আর আমার বাঁ-দিকে ঠিক এক গজ দূরে এক জোড়া বিশাল কালো ঠোঁট হিংস্রভাবে আমাকে লক্ষ করছে, এই বুঝি আমাকে গ্রাস করবে। বুঝলাম, আমার আর পরিত্রাণ নেই। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার কানের কাছে পিশাচসিদ্ধের মন্ত্রগুপ্তির শেষ স্তবকের শেষ চরণটা ফিসফিসিয়ে উঠে সমস্ত ঘরে ছড়িয়ে পড়ল।

‘সঙ্গেসঙ্গে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। ওপর থেকে ক্রমাগত যেন ধুলো পড়তে লাগল আর ঘরের মধ্যে সব কিছু থমকে গেল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস হল যে কয়েক মুহূর্ত-মাত্র। কয়েক মুহূর্তের জন্য আমি নিরাপদ। আমি আর সময় নষ্ট না করে ছুটে জানালার কাছে চলে গেলাম, অবিশ্বাস্য এক লাফ মেরে জানালার চৌকাঠে উঠে পড়লাম, তারপর আর এক লাফে নীচের নরম মাটিতে। চাঁদের আলোয় নরম মাটি আর ভেজা ঘাসের ওপর বসে আমি হাঁপাতে লাগলাম; আমার মাথার ওপরে জানালা দিয়ে শিকার হাতছাড়া হয়ে গেলে পশু যেমন হিংস্র হয়ে ওঠে সেইরকম হিংস্র শিস যেন আছড়ে বেরিয়ে আসতে লাগল।

‘সকাল বেলা দীপকবাবুর কাছে সমস্ত ঘটনাটা বিবৃত করে আমি পরামর্শ দিলাম ওই ভূতুড়ে ঘরটা সম্পূর্ণ ভেঙে টুকরো টুকরো করে যথাসম্ভব পুড়িয়ে ফেলতে হবে। দীপকবাবু আমার কথায় সম্মত হলেন। একসঙ্গে অনেক লোক মিলিয়ে দশ দিনের মধ্যেই ঘরটা ভেঙে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করা হল। ঘরটা যখন ভাঙা শেষ হয়ে এসেছে ঠিক তখন আমি ভয়ংকর ঘটনাটার ওপর আলোকপাত করতে সক্ষম হলাম। আগুন চুল্লির কাঠের কাঠামোটা ভেঙে ফেলতেই একটা চতুষ্কোণ পাথর বেরিয়ে এল। তার ওপর সংস্কৃত ভাষায় খোদাই করে লেখা ছিল, ‘এই ঘরে জমিদার বল্লভ চৌধুরীর বিদূষক, জয়রাম, যে প্রবল পরাক্রান্ত জমিদার মহিম রায়ের নামে উপহাসমূলক গান রচনা করেছিল, তাকে পুড়িয়ে মারা হল।’

আমি বিষ্ণুপুরের প্রাচীন ইতিহাস ও পুথিপত্র ঘাঁটতে শুরু করলাম। দীপকবাবুর বাড়ির বিরাট লাইব্রেরিতে অতি পুরাতন সব বই ছিল। ওইসব বইগুলো প্রাচীন আমলের, সম্ভবত বাড়িটা তৈরি হবার পর থেকেই ওগুলো লাইব্রেরিতে স্থান পেয়েছে এবং শতাব্দী ধরে কালের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে এসেছে। দীপকবাবু বাড়ি কেনার সময় একইসঙ্গে ওগুলোরও উত্তরাধিকারী হয়েছেন। ওরই মধ্যে তালপাতার একটা পুথি আমার হস্তগত হল। পুথির লেখা প্রায় অস্পষ্ট ও বিকৃত হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে তা থেকে আমি পাঠোদ্ধার করতে সক্ষম হলাম এক বিচিত্র কাহিনির।

‘প্রায় তিন-শো বছর আগে বিষ্ণুপুরে বল্লভ চৌধুরী ও মহিম রায় নামে দু-জন জমিদার ছিলেন। দুই জমিদারের মধ্যে প্রবল রেষারেষি থাকলেও সাংঘাতিক কিছু কোনোদিন ঘটেনি। এইসময় বল্লভ চৌধুরীর বিদূষক জয়রাম, মহিম রায়ের নামে ব্যঙ্গপূর্ণ একটা গান বাঁধে আর তাই নিয়ে বিরোধ চরমে ওঠে। গানটা লোকের মুখে মুখে মহিম রায়ের কানে উঠতেই তিনি এত খেপে যান যে এক নিশুতি রাত্রে তাঁর লোকজন ও লাঠিয়াল নিয়ে তিনি স্বয়ং বল্লভ চৌধুরীর ওপর চড়াও হন এবং অপ্রস্তুত শত্রুকে পর্যুদস্ত ও স্ববংশে নিহত করে জয়রামকে বেঁধে নিয়ে আসেন। দীপকবাবুর বর্তমান বাড়িটা ছিল মহিম রায়ের বাগানবাড়ি। এখানে তিনি জয়রামকে এনে তার জিভ কেটে ফেলেন এবং পুবপ্রান্তের ঘরে তাকে বন্দি করে রাখেন। জয়রামের সুন্দরী স্ত্রীকেও তিনি ধরে এনেছিলেন। তাকে তিনি নিজের কাছে আটকে রাখেন।

‘কিন্তু এক রাতে জয়রামের স্ত্রীকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। পরদিন সকালে দেখা গেল সে তার স্বামীর কোলের ওপর মরে পড়ে আছে আর জয়রাম সোজা হয়ে বসে মহিম রায়ের নামে রচিত গানটা শিস দিচ্ছে; জিভ কাটা বলে গাইতে সে আর পারত না।

‘তখন মহিম রায়ের আদেশে জয়রামকে ওই আগুন চুল্লির মধ্যে জীবন্ত পোড়ানো হয়। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত জয়রাম উপহাসমূলক গানটা শিস দিয়ে চলেছিল, একবারও থামেনি। তারপর থেকেই রাতে ওই ঘর থেকে শিসের শব্দ যেত। লোকজন ভয় পেতে শুরু করায় মহিম রায় ওই বাড়িটা ছেড়ে চলে যান।

‘ঘটনার এমনই যোগাযোগ দীপকবাবু যে মহিলাটিকে বিয়ে করছেন, তিনি নাকি মহিম রায়েরই বংশধর। এমন অদ্ভুত ব্যাপার, বিয়ের কথাটা পাকাপাকি হবার পর থেকেই ওই ঘরটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। আশেপাশের লোককে আমি জিজ্ঞেস করে দেখেছি, সাধারণত ওই বাড়িতে কেউ বাস না করলে শিসের শব্দ শোনা যায় না; আর সেটা কখনো এত ভয়ংকর হয়ে ওঠেনি। মনে হয়, জয়রামের প্রেতাত্মা যেন প্রতিহিংসার মানসে পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠেছিল। যদি ভদ্রমহিলা বিয়ের পর ওই ঘরে প্রবেশ করতেন…! জয়রামের আত্মা শতাব্দী ধরে এইরকম একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। তার স্ত্রীকে যেমনভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছিল হয়তো মহিম রায়ের সুন্দরী বংশধরের ওপর সে তেমনই কোনো নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নিত। পূর্বপুরুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত ভদ্রমহিলাকে জীবন দিয়ে শোধ করতে হত। একবার যদি তিনি ও ঘরে ঢুকতেন…!’

অনিমেষ চুপ করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *