রবিন হুড – ৫

পাঁচ

শেরিফের বাড়িতে রবিন হুডকে দেখে বাবুর্চি অবাক হয়ে বলল,—’আপনি রবিন হুড? কী সর্বনাশ, আপনার সাহস তো কম নয়! আর এই ঢ্যাঙা পালোয়ানটি কে?’

গ্রিনলিফ উত্তর করল,—’আমি হচ্ছি ভাই, লিটল জন।’

বাবুর্চি বলল,–’তা তুমি লিটল জনই হও আর রেনোল্ড গ্রিনলিফই হও, তুমি লোকটি খাসা। আমার নাম হচ্ছে মাচ্চ। রবিন হুড যদি অনুগ্রহ করে আমাকে তার দলে নেন, তা হলে আমি পরম সৌভাগ্য মনে করব।’

রবিন হুড বললেন,—’ ‘নিশ্চয় নেব মাচ্চ। আজ থেকে তুমি আমার দলের হলে। আমি এখন চললাম, এখানে আর দেরি করা উচিত নয়, কে জানে আবার কোন বিপদে পড়ব! তবু ভালো, বাড়ির লোকজন নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে, তা নইলে এতক্ষণে ঢের লোক এখানে এসে হাজির হত। তোমরা এক কাজ করো, আজ রাত্রেই এখান থেকে চলে যাও, আমি কাল সকালে সারউডে তোমাদের সঙ্গে মিলব।’

মাচ্চ বলল,–’তাহলে কি আজ রাত্রিটা আপনি শেরিফের বাড়িতে থাকবেন মনে করেছেন? খবরদার, এমন কাজও করবেন না। মেলার পর থেকেই শহরের দরজায় পাহারা বসেছে। পশ্চিমে দরজার পাহারাওয়ালা আমার চেনা লোক; আমাদের নিশ্চয়ই ছেড়ে দেবে। কিন্তু কাল সকালে কিছুতেই বেরুতে পারবেন না।’

রবিন বললেন,–’আরে মাচ্চ, আমার জন্যে তুমি ভেবো না! আমি কি আর একা যাব? শেরিফ মহাশয়ও যে আমার সঙ্গে যাবেন। কে দরজা আটকাবে? তোমরা দুজন আজ রাতেই চলে যাও, বনের ধারেই আমার লোকদের পাবে। তাদের বোলো দুটি হরিণ যেন মেরে রাখে কাল, একজন নামজাদা অতিথি যাবেন। তাকে খাওয়াব।’ এই বলে রবিন হুড চলে গেলেন।

রবিন হুড চলে গেলে পর, লিটল জন বলল,–’চলো মাচ্চ, আমরাও আর দেরি করব না। আর যাওয়ার সময় এক কাজ করা যাক, এসো আমরা শেরিফের এই রূপোর ডিশগুলি সব নিয়ে যাই— বড় মজা হবে এখন, না?’

মাচ্চ বলল,–’ঠিক বলেছ ভাই! একটু সবুর করো, একটা থলে নিয়ে আসি।’ মাচ্চ তখনই থলে এনে সব ডিশ তাতে পুরল এবং ফটক পার হয়ে সেগুলি দুজনে কাঁধাকাঁধি করে নিয়ে, একেবারে বনে গিয়ে হাজির হল।

পরদিন শেরিফের চাকরদের ঘুম ভাঙতে অনেক বেলা হয়ে গেল। গ্রিনলিফের ধাক্কায় স্টুয়ার্ড প্রায় আধমরা হয়েছিল। তখন পর্যন্ত তার মাথা পরিষ্কার হয়নি। রাত্রে ডিশ চুরি হয়েছে, কি কোনওদিন তা ছিলই না, কে তার হিসাব রাখে? কাজেই ডিশ চুরির ব্যাপারটা তখনকার মতো চাপা রইল।

এদিকে শেরিফ রবিন হুডের সঙ্গে রওনা হলেন। রবিন সেই মাংসের গাড়িতে এবং শেরিফ তাঁর ঘোড়ায় চড়ে শহর পার হয়ে ক্রমে সারউডের রাস্তায় চললেন। রবিন চলতে-চলতে শিস দিয়ে গান ধরলে, শেরিফ জিজ্ঞাসা করলেন,—’কী হে বাপু! তোমার যে দেখছি ভারী ফূর্তি, ব্যাপারটা কী?’

রবিন বললেন,–’আজ্ঞে আমার বড় ভয় করছে, তাই শিস দিচ্ছি!’

‘নটিংহামের শেরিফ তোমার সঙ্গে, ভয়টা কীসের হে বাপু?’

রবিন বললেন,—’ আজ্ঞে তা তো বটেই! তবে কিনা লোকে বলে, রবিন হুড নাকি শেরিফকে কেয়ারও করেন না।’

শেরিফ বললেন, ‘আরে রেখে দাও তোমার রবিন হুড! বেটাকে ধরতে পারলে মজাটা দেখিয়ে দিতাম।’

‘শেরিফ মশাই! আমি শহরে যাওয়ার সময় এই রাস্তায় রবিন হুডকে দেখে গিয়েছি।’

রবিন হুডের নামে শেরিফের মনে ভয় ঢুকল। কিন্তু ভয়ের ভাব চাপা দিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন—তুমি নিজেই দেখতে পেয়েছিলে কি?’

রবিন বলবেন,–’পেয়েছিলাম বইকি! তিনি আমার এই গাড়ি ঘোড়া পর্যন্ত কিনতে চেয়েছিলেন। তাঁর না কি বড় শখ হয়েছে, কসাইয়ের ব্যাবসা করবেন।’

এসব কথাবার্তা হচ্ছে এমন সময় দূরে বনের মধ্যে কতকগুলি হরিণ দেখতে পেয়ে রবিন বললেন,–’ওই দেখুন শেরিফ মহাশয়! আমার জন্তুগুলো কেমন চরে বেড়াচ্ছে, আপনার পছন্দ হয় কি? দেখুন দেখি, সবগুলি কেমন তেজি আর সুশ্রী।’

রবিন হুডের কথা শুনে তখুনি ঘোড়া থামিয়ে শেরিফ বললেন,—’দেখ ব্যাটা! তোর রকমসকম আমার একটুও ভালো বোধ হচ্ছে না। এইসব জন্তু দেখবার জন্য আমায় এনেছিস? তোর মুখও আমি আর দেখতে চাই না। তুই যেখানে খুশি যা, আমি ফিরে চললাম।’

তখন চট করে শেরিফের ঘোড়ার লাগাম ধরে রবিন বললেন, ‘আজ্ঞে সেটি কিছুতেই হবে না। কত কষ্ট করে আপনাকে পেয়েছি, এত সহজে কি আর ছাড়তে পারি? আপনার বাড়িতে নেমন্তন্ন খেলাম, এখন আপনাকে না খাইয়ে কি যেতে দিতে পারি?’ এই বলে রবিন তিনবার শিঙা বাজালেন, আর দেখতে-দেখতে বনের চারদিক থেকে অস্ত্রধারী প্রায় চল্লিশ জন ডাকাত এসে রবিন হুডকে নমস্কার করে দাঁড়াল। শেরিফ তো একেবারে স্তম্ভিত! তখন দলের একজন সর্দার–’আসতে আজ্ঞা হোক হুজুর।’—এই বলে শেরিফকে নমস্কার করল। সর্দারটি লিটল জন। তাকে দেখে শেরিফ বললেন,–’তবে রে ব্যাটা বেইমান গ্রিনলিফ! তুই-ই সে না আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিস’

জন বলল,–’দোহাই হুজুর। আমার কোনও দোষ নেই, আপনারই বরং সব দোষ। যা হোক, আপনার বাড়িতে যদিও আমি আধপেটা খেয়ে থাকতাম কিন্তু আজ আমাদের বাড়িতে আপনাকে খুব ভালো করে খাওয়াব।’

তখন রবিন বললেন,—’বেশ বলেছ জন। আজ শেরিফ মশাইকে আমরা খুব আদর-যত্ন করে খাওয়াব। এখন তুমি তাঁর ঘোড়ার রাশ ধরে নিয়ে চলো।

শেরিফকে নিয়ে সকলে আড্ডায় হাজির হল। রবিন হুডের হুকুমমতো আগে খাবারের আয়োজন তৈরি ছিল। খানিক বিশ্রামের পর সকলে খাবার খেতে বসলেন। শেরিফ দেখলেন, যে, তাঁর বাবুর্চি মাচ্চ পরিবেশন করছে। শুধু তাই নয়, খাবারের ডিশগুলি পর্যন্ত তাঁর নিজের তখন তিনি আর সহ্য করতে না পেরে বললেন,–’আরে হতভাগা বেটারা! আমার ডিশগুলি পর্যন্ত চুরি করে এনেছিস, এত বড় আস্পদ্ধা! আমি কিছুতেই খাব না।’

রবিন হুড বললেন,–’শেরিফ মশাই! এত রাগ কেন? মনে করেছিলেন, ফাঁকি দিয়ে আমার সবগুলি জন্তু নেবেন। তাই, তারই একটু ফলভোগ করলেন মাত্র! এখন রাগ করলে চলবে কেন? বসুন ঠান্ডা হয়ে খান।’

কী আর করেন, অগত্যা শেরিফ খাবারে প্রবৃত্ত হলেন। পেটে আগুন জ্বলছে, খাওয়ারের আয়োজনের ত্রুটি নেই, তিনি বেশ আনন্দের সঙ্গে খাবার খেলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–’রবিন হুড! লিটল জন! মাচ্চ! তোমাদের ব্যবহারে আমি খুবই খুশি হয়েছি, এজন্য অনেক ধন্যবাদ। এখন বেলা প্রায় শেষ হয়েছে, কেউ যদি পথ দেখিয়ে দাও, তা হলে এখন আমি বিদায় হই।’

রবিন। তা যাবেন বইকি! কিন্তু দুটো কথা আপনি একেবারে ভুলে গেছেন। প্রথম হচ্ছে, আমার জন্তুগুলি কিনবেন বলেছিলেন। তারপর যে নেমন্তন্ন খেলেন, এর খরচটাও দিয়ে যেতে হবে।’

শেরিফ বললেন,–’আমার কাছে তো বেশি কিছু নেই, কোথা থেকে দেব?’ লিটল জন বলল,–’কত টাকা আছে হুজুর? আমার মাইনেটা যে পাওনা আছে?’

মাচ্চ বলল,–’আমারও যে মাইনে বাকি, হুজুর!’ রবিন ও হাসতে-হাসতে বললেন,–’আর আমার মাইনে?’ শেরিফ তো মহা মুশকিলে পড়লেন। তখন অতি কষ্টে রাগ সামলে নিয়ে বললেন, ‘আরে আমার রূপোর ডিশগুলি নিয়েও কি তোমাদের সাধ মিটল না?’

এই কথা শুনে রবিন হুড বললেন,–’আচ্ছা শেরিফমশায়! ডিশগুলি না হয় মাইনের দরুন কাটা গেল, এখন খাওয়ার খরচটা দিন।’

শেরিফ। ‘আচ্ছা বিপদেই পড়া গেল দেখছি! এই নাও বাপু, আমার কাছে এই কুড়িটি মোহর আছে—নাও!’ এই বলে ব্যাগটি দিলেন। তখন সেটি লিটল জনের হাতে দিয়ে রবিন হুড বললেন, ‘গুনে দ্যাখো তো হে জন, মোহরগুলি ঠিক আছে কি না?’ জন ব্যাগটি ওলটপালট করে গুনে বলল,–’আজ্ঞে ঠিকই আছে।’

এই কথা শুনে রবিন হুড বললেন,–’ব্যস! খাওয়ার খরচের দরুন কুড়িটি মোহরই যথেষ্ট!’

তখন উইল স্টাটলি বলল,–’আজ্ঞে, আর একটা কথা বাকি রইল যে! শেরিফ মশাইকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে, তিনি আর আমাদের সঙ্গে ঘাঁটাঘাঁটি করবেন না।

শেরিফ তখন প্রতিজ্ঞা করলেন,–’ধর্মের নামে শপথ করে বলছি সারউড বনের দস্যুদলের ওপর আর অত্যাচার করব না।’ কিন্তু মনে–মনে ভাবলেন : ‘বেটাদের বনের বাইরে একবার পেলে হয়!

রবিন হুড তখন ঘোড়ার লাগাম ধরে শেরিফকে পথ দেখিয়ে চললেন। সদর রাস্তায় এসে সপাং করে ঘোড়াকে এক চাবুক! অমনি শেরিফকে নিয়ে ঘোড়া ঊর্ধ্বশ্বাসে নটিংহামের দিকে ছুটে চলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *