রবিন হুড – ২

দুই  

দেখতে-দেখতে রবিন হুডের দল প্রসিদ্ধ হয়ে উঠল। শেরিফ শত চেষ্টা করেও দস্যুদলের কারুকেও ধরতে পারলেন না। সাধারণ লোকেরা এই দস্যুদলের এই নামে ভয়ে জড়সড়ো হত। কিন্তু ক্রমে যখন সকলে দেখল যে, অত্যাচারী বড়লোকদের ধনসম্পত্তি কেড়ে নিয়ে দস্যুরা গরিব দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়, তখন এই দলের প্রতি ক্রমেই লোকের শ্রদ্ধা বাড়তে লাগল। সঙ্গে-সঙ্গে দিন-দিন নতুন লোক এসে এদের দলে মিশতে লাগল, এবং দলটি বেশ জাঁকাল হয়ে উঠল।

এইভাবে কিছুদিন গেল। বনের ভেতর চুপ করে বসে থাকাটা রবিনের আর ভালো লাগল না। একদিন তিরধনুক নিয়ে তিনি তৈরি হলেন এবং দলের লোকদের বললেন,–’আমি চললাম, একবার শহরের খবরটা নিয়ে আসি। তোমরা বনের পাশেই থেকো এবং আমার শিঙা শুনলে হাজির হোয়ো।’

সদর রাস্তায় খানিক দূর গিয়ে রবিন হুডের হঠাৎ মনে পড়ল, বনের মধ্য দিয়ে একটা সোজা রাস্তা আছে, সেটি বেশ নির্জন এবং সেখান দিয়ে গেলে, একটি ঝরনা পার হলেই শহর খুব কাছে। তখন তিনি সদর রাস্তা ছেড়ে বনের পথে চললেন। ঝরনার কাছে এসে দেখলেন, পার হওয়া মুশকিল, জল বেশি হয়েছে, তার ওপর আবার স্রোত খুব। একটি কাঠের সরু পোল ছিল তার ওপর উঠে দেখতে পেলেন, অন্য একজন লোকও পার হওয়ার জন্য অপর দিক থেকে উঠল। তাড়াতাড়ি পার হওয়ার জন্য দুজনেই এগিয়ে গিয়ে ঠিক মাঝখানে এসে হাজির। বেজায় সরু পোল, একজন পিছিয়ে না গেলে পার হওয়া অসম্ভব।

রবিন হুডের রাগ হল। তিনি বললেন,–’কে হে বাপু, তুমি? সরে যাও, আমাকে পার হতে দাও।’

অপর লোকটি হেসে ফেলল। রবিন হুডের চেয়ে সে একমাথা উঁচু। রবিনকে বলল, ——সেটি হচ্ছে না বাবা! আমার চেয়ে জোয়ান এবং ওস্তাদ না হলে আমি কাকেও রাস্তা ছেড়ে দিই না।’

‘বটে! আচ্ছা রোসো, কে ওস্তাদ এখনই দেখতে পাবে।’

ঢ্যাঙা লোকটি বলল,—’বেশ, বেশ! আমিও তাই খুঁজে বেড়াচ্ছি।’

রবিন তখন লাফিয়ে ডাঙ্গায় আসলেন এবং ছয় ফুট লম্বা একটা ওকের ডাল কেটে নিয়ে বুক ফুলিয়ে আবার পোলের মাঝখানে এসে হাজির। ঢ্যাঙা লোকটিকে বললেন,–’দ্যাখো বাপু! তিরধনুক নিয়ে লড়াই করলেই আমার পক্ষে সুবিধা হত বটে, তা কুছ পরোয়া নেই, এসো লাঠি খেলাটাই একটু দেখিয়ে দিই। এখন তৈরি হও; ‘এক-দুই’–

‘রবিন দুই পর্যন্ত বলতেই, ঢ্যাঙাজন ধাঁ করে ‘তিন’ বলেই রবিনকে ভয়ানক এক ঘা বসিয়ে দিল। তিনি নিমেষের মধ্যে সরে গিয়ে অতি কষ্টে রক্ষা পেলেন। তারপর অনেকক্ষণ পর্যন্ত দুই জনে লড়াই— ঠকাঠক-ঠকাঠক খালি লাঠির শব্দ। লম্বা লোকটি অসুরের মতো বলবান, রবিন হুড চটপটে চালাক। তিনি লম্বা লোকটির আঘাতগুলি বিফল করতে লাগলেন, আবার মাঝে-মাঝে তার পেটে, পাঁজরে, পালটা আঘাত করতেও কসুর করলেন না। কেউ-ই এক পা নড়ল না, হারও মানল না।

হঠাৎ রবিন হুডের এক আঘাতে লম্বু লোকটি আর একটু হলে জলে পড়ে যেত, কিন্তু চট করে সামলে নিয়ে টলতে টলতে রবিনের মাথায় এমন ভীষণ এক ঘা মারল যে, তার মাথা ঘুরে গেল, তিনি

চোখে তারা দেখলেন এবং পোল থেকে ঝুপ করে একেবারে ঝরনার মাঝখানে পড়ে গেলেন।

ঢ্যাঙা লোকটি তা দেখে হেসেই খুন। কিন্তু তখনই আবার নিজের লাঠিটি বাড়িয়ে দিয়ে রবিন হুডকে বলল,–’ধরো, আমার এই লাঠি ধরে ওঠো। দেখো, শক্ত করে ধরো, মাথার মতো হাত যেন ঘুরে না যায়।’

রবিন শক্ত করে লাঠি ধরলেন, তখন লম্বা লোকটি টেনে তাকে ওপরে তুলল। একটু ঠান্ডা হয়ে রবিন হুড বললেন,–’বাপ রে বাপ! তোমার লাঠির বাড়ি খেয়ে এখনও আমার মাথার ভেতর বনবন করছে।’ তারপর তিনি শিঙা বের করে তিনটি ফুঁ দিলেন আর তখনই উইল স্টাটলি প্রভৃতি কয়েকজন দস্যু এসে হাজির হল।

রবিন হুডের অবস্থা দেখে স্টাটলি বলল,–’এ কী! আপনার কাপড়-চোপড় ভিজল কী করে?’

রবিন বললেন,–’আরে সে কথা আর বলো কেন! এই লম্বু লোকটা কিছুতেই আমাকে পোল পার হতে দিচ্ছিল না; কী আর করি, লাঠি দিয়ে মারলাম এক খোঁচা! তখনই তার লাঠিও আমার মাথায় পড়ল, আর আমিও জলে ডুব মেরে উঠলাম।’

স্টাটলি তখন লোকটিকে ধরতে গেল। রবিন হুড বাধা দিয়ে বললেন,—’না-না স্টাটলি! ওকে কিছু বোলো না, ওর কোনও দোষ নেই। আমিই আগে মেরেছি, তারপর ও মেরেছে, আমাদের দেনা–পাওনা শোধ হয়ে গেছে।’ তারপর লোকটির দিকে ফিরে বললেন, ‘কেমন হে! তা-ই তো না কি?’

ঢ্যাঙা পালোয়ানটি বলল,–ঠিক-ঠিক। তোমাকে ভাই আমার বড় ভালো লেগেছে। আচ্ছা, তোমার নামটি কী বলো দেখি?’

রবিন বললেন, ‘আমার নাম রবিন হুড।’

ঢ্যাঙা লোকটি বলল,–’আপনি রবিন হুড? আরে ছি-ছি, তাহলে তো আমার বড় অন্যায় হয়েছে। আপনার দলে ঢুকব বলেই তো এসেছিলাম, এখন কি আর আমাকে দলে নেবেন?’

রবিন বললেন,—’কেন নেব না? নিশ্চয়ই নেব। তোমার মতো লোক কি সহজে মেলে? আচ্ছা! তোমার নামটা তো বললে না?’

ঢ্যাঙা লোকটি বলল,–’আমার নাম, জন লিটল।’

লিটল মানে, ছোট। এতবড় ঢ্যাঙা পালোয়ানের নাম ‘লিটল’ শুনে সকলে হো-হো করে হেসে উঠল।

রবিন বললেন,–’তোমার চেহারার সঙ্গে নামটি মানায় না। নামটি উলটে নিয়ে আজ থেকে তোমাকে আমরা ‘লিটল জন’ বলে ডাকব। এসো তবে লিটল জন! তোমাকে আমাদের দলে নিলাম।’

লিটল জনের শরীরে অসাধারণ শক্তি, চেহারাটি তার অসুরের মতো, আবার লাঠি খেলাতেও সে অদ্বিতীয়। তাকে দলে এনে রবিন হুড পরম সৌভাগ্য মনে করলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *