বারো
আমাদের নায়েবমশাইয়ের দাদা, আমরা যাঁকে বড় নাগমশায়ই বলে ডাকতাম, তিনি এসে আমার বাবাকে খবর দিয়েছিলেন, ভাইডি, হারামজাদায় মরছে। হ্যারে মাইরইয়া ফ্যালাইছে, বোজজো? বাবা খুবই কাতর হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কার কথা কইলেন? কারে মারছে?
: ক্যান গান্দিডা? হালার পো হালার লইগ্যা আইজ মোগো একি দশা এ্যাঁ? হ্যারে নাথুরাম দেছে শ্যাষ করইয়া।
এ ঘটনার কথা বাবা পরবর্তীকালে যতবার গল্প করেছেন, বলেছেন, বড় নাগের আফসোস আমি বুজি, তয় মহাত্মা, আহা! এরহম করইয়া কইতে অয়? তেনার নিধন! মহাত্মার এমন পরিণতি!
কিন্তু সেসব স্মৃতির ঘটনা, অপঘটনা, এখন থাক। মূলকথায় যাই। মূলকথা বলতে, যা বলছিলাম, এক ভস্ম আর ছাড়। দোষগুণ কব কার? সেই কথা। দোষে গুণে আমরা উভয় সম্প্রদায়ই তুল্যমূল্য। কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে, বরাবর আমরা একে অন্যকে দুষে আসছি। কেউই কখনো নিজেদের দোষের পসরা নিয়ে বলিনি, দেখো ভাই, এই আমাদের দোষ, এগুলোকে তুচ্ছ করে এসো আমরা ভালোয়-মন্দে বাঁচি এবং এই দোষগুলোর সংশোধন করি। না, আমরা কদাপি এরকম সুবুদ্ধিতে পরিচালিত হইনি। না হিন্দুরা, না মুসলমানেরা।
আমার উজানিখালের দুপাশের যত বসতি ছিল, বক্সীবাবু দেশত্যাগ করলে সবার মধ্যেই একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল গ্রাম ছাড়ার। এদের মধ্যে বেশির ভাগই পাড়ি দিচ্ছিলেন হিন্দুস্থানে। হ্যাঁ, আমরা তখন পাকিস্তানের বিপরীতের দেশটিকে ‘হিন্দুস্থানই” বলতাম। আমাদের শিক্ষা সেরকমই ছিল। তখন সেকুলার-ননসেকুলার তত্ত্ব জানতাম না। পাকিস্তান মুসলমানেদের দেশ এবং হিন্দুস্থান হিন্দুদের। এরকম একটা শিক্ষা আমরা ওই সময়ে পারিবারিক, গ্রাম্য সামাজিক এবং রাষ্ট্রগতভাবেই পেয়েছি। সে যা হোক, যাঁরা সেই সময় হিন্দুস্থানে পাড়ি দিতে পারেননি, তাঁরা কেউ কেউ, গাঁয়ের বাড়িঘর বিক্রি করে, ঝালকাঠি, বরিশাল, ঢাকা বা অন্য কোনো শহরগঞ্জে বাসাবাড়ি ভাড়া করে উঠে যেতে লাগলেন। তাঁরা কেউ বাড়িঘর বাগান পুকুর বিক্রি করলেন একেবারেই জলের দামে, কারণ তাঁরা জেনে গিয়েছিলেন অন্যথায় কিছুই পাবেন না। এমনিতেই সব বেহাত হয়ে যাবে। কেউ-বা আশায় বুক বেঁধে বাড়ির দেখভাল করার দায়দায়িত্ব প্রতিবেশী গ্রামের কোনো মুসলমান ভদ্রলোকের কাছে গস্ত করে চলে গিয়েছিলেন। মনে আশা যদি কোনোদিন আবার ফিরে আসতে পারেন। যদি কোনোদিন এমন কোনো অলৌকিক ঘটনা ঘটে, যা তাঁদের মানসিক আকাঙ্ক্ষার অভীপ্সিত অবস্থা ফিরিয়ে আনে। অর্থাৎ এঁদের মনেও বুড়িপিসিমার আকাঙ্ক্ষা।
এই মানসিকতাটি আজও আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। বুড়িপিসিমা এবং নগেনজেঠিমার কথনে প্রায়ই এই মনোভাব দেখতে পেতাম। দুজনে প্রায় সমবয়সি এবং জ্ঞাতি সম্পর্কে বুড়িজেঠিমার পিশাশুড়ি। আমাদের দরদালানের পুবদিকে এককোণে বসে দুই মহিলার নানান জল্পনা-কল্পনা। বুড়িপিসিমা প্রায় বলতেন, বোজজোনি বউ, কাইল রাত্তিরে সপ্পন দ্যাখলাম। দেখলাম কি, হিন্দুস্থান পাকিস্তান বেয়াক ভাগাভাগি মিডইয়া গেছে। বেয়াক কিছুই আবার আগের ল্যাহান। গোলায় ধান, পুহইরে মাছ, গাছে ফলফলাদি, কদম আলি আবার আগের ল্যাহান খাড়ি দুদ দেয়া আরম্ব করছে। কোনোদিগেই কোনো উদ্বাগ নাই। এ স্বপ্ন তিনি এর আগেও দেখেছেন এবং বাবা-জ্যাঠামশাইকে বলেছেন। কিন্তু জেঠিমা খুব আহ্লাদের সঙ্গে জিজ্ঞেস করতেন —
: কও কী? তুমি হেরম দ্যাখলা?
: হ, কই কী শোনো না। দেহি—, এভাবেই দুজনে আকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন নিয়ে বিভোর হতেন। এঁদের কথা ইতিপূর্বে বলেছি। আরও একটু বাকি। তাঁদের দুজনের সম্পর্ক যা-ই থাক, ভাবটি বড় গাঢ় সখীত্বের। যতদিন কাছাকাছি ছিলেন, এ ভাব তাঁদের বজায় ছিল। শীতলখোলা, বটকালীতলা, জাতকরনীখোলা এইসব স্থানে পুজো বা ব্রতকথা শেষ হলে, জেঠিমা বলতেন, ও ঊষা বর চাও।
: ওয়া তোমার কাম, তুমিই চাও, জানো তো বেয়াকই।—পূজা বা ব্রতের শেষে বর চাওয়ার এক রীতি ছিল আমাদের ওখানে। ব্রতকথা বলার অধিকারিণী যদি বুড়িপিসিমা, জেঠিমার পদাধিকার ছিল বর চাওয়ার। সেই বর চাওয়ার রীতকরণটিও আজও বেশ মনে আছে। জেঠিমা বর চাইতেন–
আ আরে বড় বাড়ইয়ারা কী কী বরো চায়
এই ধোনো বরো দিলাম লো
মানো বরো দিলাম লো
পরমাই বর লইয়া যাও ঘরে।
এভাবে গাঁয়ের প্রত্যেকটি বাড়ির জন্য বর চাওয়া শেষ হলে খোলা বা তলায় উপস্থিত মহিলামহলের গান শুরু হতো। যাঁরা গাইতে জানতেন, তাঁরা সাধারণত রামপ্রসাদী গাইতেন। আমার মা এ ব্যাপারে বেশ দড় ছিলেন বলে তাঁকে সবাই অনুরোধ জানাত। জেঠিমা তাঁকে ডেকে বলতেন, ও লাবণ্য তুই একখান ধর। মা ওই শীতলা বা বটকালীতলার চত্বরে সম্মিলিত গ্রামীণ মহিলাদের মধ্যে গান গাইতেন উচ্চৈঃস্বরে এবং অসংকোচে। মা গাইতেন—
শ্মশান ভালোবাসিস বলে
শ্মশান করেছি হৃদি।
শ্মশানবাসিনী শ্যামা।
নাচবি বলে নিরবধি ॥
জানি না, মা যখন এই গান করতেন তাঁর মনের মধ্যে গ্রামগুলোর শ্মশান হয়ে যাওয়ার বেদনাও কাজ করত কি না।
হিন্দু গ্রামগুলো ব্যাপকভাবে জনশূন্য হতে থাকলেও এই দুই মহিলা যতদিন এখানে ছিলেন, ততদিন এই পরম্পরা বজায় ছিল। শীতলা এবং বটকালীতলার সামনেই বিশাল ঘাটবাঁধানো এক প্রাচীন দিঘি। সেই ঘাটলার সিঁড়ির ওপর মায়েদের গান শোনার জন্য তখন আমাদের পাবলিক ফিল্ডের খেলোয়াড়েরা, যারা মুসলমান সম্প্রদায়েরই বেশির ভাগ, খেলা শেষে বাড়ি ফেরার পথে বসে থাকত। আর তাদের বাড়ির মেয়েরা একটু তফাতে হলেও খোলার সামনে আমাদের মায়েদের সঙ্গে বসেই এইসব গ্রামীণ দেবীদের পূজার্চনা দেখত, গান শুনত, কেউ কেউ-বা গেয়েও ফেলত দু-চার কলি। গোপনে পূজার উপকরণও দিত জেঠিমার কাছে এবং আশীর্বাদ নিত, নির্মাল্য আর প্রসাদ নিত, বলত, ক্যাওরে বুজি কয়েন, পোলাডা ভোগতে আছে আইজ দ্যাড় মাস। পিরছায়েবের পানিপরা খাওয়াইয়া তো কিছু অইলে না। হে কারণে ভাবলাম—এইসব ধারা শত গোলযোগ সত্ত্বেও এই সময় দেখেছি। তারপর ক্রমশ তা স্তিমিত হয়ে আসতে থাকে। এইসব কথা এখন স্মৃতির পর্দায় কখনো মেঘ কখনো রোদ্দুরের মতো জেগে ওঠে। কিন্তু যতই প্রাচীনতা একে গ্রাস করে, ততই যেন সব ধূসর ছবি হয়ে মিলিয়ে যায়। সম্পর্কের বহতা এক ঊষর প্রান্তরে গিয়ে লীন হয় আর তারপর থাকে এক হাহাকারের ইতিহাস।
পিছারার খালের জগতে আমাদের বাড়িটি ছিল বড়বাড়ি। সবাই বলত, বড়বাড়ি। এ-কারণেই আমরা ‘বড় বাড়ইয়া’। কিন্তু নিয়মমতো বড়বাড়ি হওয়া উচিত ছিল আমাদের গাঁয়ের রায়চৌধুরী বাড়ির। তাদের বিশাল প্রাসাদ। নবাবি উপাধি এবং তাম্রপত্রে লিখে দেয়া জমিদারির চৌহদ্দির ব্যাপারটা আমাদের ওখানে একটা কিংবদন্তির সৃষ্টি করেছিল। ওই বাড়িতে নবাবি-ভূস্বামীদের আদলে একটি ভূগর্ভস্থ কয়েদখানাও ছিল। আমরা বলতাম অন্ধকূপ। সে যা হোক, তারা নানা কারণে গত শতাব্দীর চতুর্থ দশকের মধ্যেই অন্তিমতা প্রাপ্ত হলে তাদের জ্ঞাতি আমরাই হলাম বড়বাড়ি। ইংরেজি ‘এল’ অক্ষরের আকৃতিতে গড়া আমাদের এই অট্টালিকাটির বহির্বিন্যাস আভিজাত্যমণ্ডিত হলেও অন্দরের জীবনযাপনপ্রণালি ছিল খুবই সরল। এককালে দীয়তাং ভুজ্যতাং-এর বাহুল্য থাকলেও, যখনকার কথা বলছি, তখন তেমন কিছুই ছিল না। শুধু দোল-দুগ্গোচ্ছব-মোচ্ছবে কিছু রইসি ব্যাপার-স্যাপার দেখা যেত। বাড়িটিতে ঘরের সংখ্যা ছিল ষোলোটি। মোটা গথিক ঘরানায় তৈরি থামগুলোসহ একদিকে দোতলা আর অন্যদিকে একতলার বিন্যাসে বাড়িটি তার সংযুক্তি রক্ষা করেছে যে কৌণিক যুগ্মস্তম্ভে, তার আড়ালেই দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। অট্টালিকাটির বয়ঃক্রম আনুমানিক দেড়শ বছর।
এর আগে ছিল নাকি গোলপাতার ঘর। সাধারণ গেরস্তের ঘরই নাকি ছিল। আমাদের তালুকদারির বীজপুরুষ জগৎচন্দ্র এবং চন্দ্রমোহন বুদ্ধি এবং লাঠির জোরে একদা এই তালুকদারির তথা এই বাড়ির নির্মাণ করেন। একদিন যে বংশ চিকিৎসাবিদ্যাকে কুলকর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, তাঁরা একসময়ে তালুকদার হলেন। বংশকথায় এ তথ্য পাই।
চন্দ্রমোহন এবং জগৎচন্দ্র ছিলেন দুই ভাই। জ্যেষ্ঠ চন্দ্রমোহন, বাল্যেই পিতৃবিয়োগবশত পার্শ্ববর্তী বাসণ্ডা গ্রামের জমিদার সেন রায়চৌধুরীদের সেরেস্তায় গোমস্তার কাজ নেন। সেখানে কিছুকাল কর্ম করার প্রাক্কালে কনিষ্ঠ জগত্ত ওই জমিদারিতে একটি কর্ম পান। সেকালে তাঁদের মাস-মাইনে ছিল, জ্যেষ্ঠর বারো, কনিষ্ঠের পাঁচ। তখন তাঁদের গোলপাতার বাড়ি, হোগলের বেড়া। মা-বাপ অতি শৈশবে গত হলে, বিধবা পিসিমা, তাঁর একমাত্র পুত্র গুরুদাসকে নিয়ে ভাইপোদের সংসারের হাল ধরলেন। তারা এই মামাতো, পিসতুতো তিন ভাই ওই বিধবা রমণীর তত্ত্বাবধানে ক্রমশ প্রায় সহোদর ভ্রাতার ন্যায় একটি পরিবার গড়ে তোলেন। জগৎচন্দ্র, যিনি আমার পিতামহের পিতা অর্থাৎ প্রপিতামহ, তিনি আমাদের পিছারার খালের জগতের প্রত্যন্ত দক্ষিণ অঞ্চলের মহালে, বাসণ্ডার জমিদারদের খাজনা আদায়কারী গোমস্তা ছিলেন তখন। সন-তারিখের হিসেব জানি না, তবে লোকায়ত প্রবাদে তিনপুরুষে একশ বছর ধরলে জগত্মশাইয়ের সময়কাল প্রায় পৌনে দুশ বছর ধরা হয়তো যায়। তখন অবশ্যই ব্রিটিশ-সূর্য মধ্যগগনের পথে দ্রুত ধাবমান। জগত্মশাই তখন বাইশ-পঁচিশ বছরের যুবক।
মহানুভব ব্রিটিশরাজ তখন এ দেশীয় ভূমির জরিপাদি কার্যে ব্যস্ত। আমাদের ওই রকম নবীন ভূখণ্ডের সমুদ্রকূলবর্তী প্রায় কিশোরী ভূমির বিষয়ে তাঁরা যে অবশ্যই যত্নবান হবেন, সে কথা বলাই বাহুল্য। জঙ্গল আবাদ করো, ভূমি হাসিল করো এই জাতীয় এক ফতোয়ায় বোধহয় এই সময় আমাদের এই দক্ষিণের অটবী–অঞ্চলকে নিমূর্লকরণের প্রক্রিয়াটি চালু হয়। সুন্দরীবনের অন্ত্যেষ্টি এভাবেই হয়েছিল।
এই স্থানের হাজার হাজার বিঘা জমির কোনো এক আবাদের জনৈক মুসলমান জমিদার ছিলেন। এই পরগণে সেলিমাবাদ আবাদের শুরুতেই তাঁরা এখানে ভূস্বামী হয়ে বসেছিলেন নবাবি বরকতে। সে ইতিহাস লেখা নেই। কিন্তু আমার পিতামহ যখন তাঁর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে খাজনা আদায়কারী ব্যক্তি, তখন এই মুসলমান জমিদারের অধীনস্থ সম্পন্ন প্রজারা জগৎচন্দ্রের কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করে, তাঁর কাছে এক সমবেত আবেদনে হাজির হন। এই মুসলমান জমিদারটি অসম্ভব ইন্দ্রিয়পরায়ণ এবং অত্যাচারী হয়ে উঠেছিলেন। এ কারণে তাঁদের দাবি যে, জগত্মশাই যদি তাদের অছি হন, তবে তাঁরা ওই জমিদারের আওতায় আর থাকবেন না। এ কারণে হয়তো কিছু কাজইয়া ফ্যাসাদ হবে, তবে জগত্মশাই যদি আফইত্য না করেন এবং মদত দেন তবে সে ফ্যাসাদ মোকাবেলা করা যাবে।
জগত্মশাইয়ের একটি সুসংগঠিত লাঠিয়ালবাহিনী ওই অঞ্চলে ছিল। সংক্ষেপে বলি ওই লাঠিয়ালবাহিনী এবং তাঁর বুদ্ধি সব মিলিয়ে মিঞাসাহেবের জমিদারটি অচিরে তাঁর হলো। মিঞা ভিখিরি হয়ে শেষজীবন যাপন করেছেন। এ কথা আমিও ওখান থেকে আসা প্রজাদের জোরগলায় বলতে শুনেছি। হয়তো জগত্মশাইয়ের কর্মকাণ্ডও ততদিনে সেখানে এক কিংবদন্তি হয়ে থাকবে। এভাবেই আমাদের তালুকদারির সূত্রপাত। তখন বোধকরি ঊনবিংশ শতকের মধ্যকাল। পরবর্তী দুই পুরুষে এর সৌষ্ঠব বাড়তে থাকে এবং বাগান, বৈঠকখানা, দিঘি, পুকুর, গোলাঘর, নাটমন্দির, অভিনয়-মঞ্চ ইত্যাদি, ইত্যাদি ক্রমশ বিস্তৃতি পায়। যার গঠনকল্প নবাবি এবং সাহেবি উভয় ঘরানার।
যে চৌধুরী পরিবারের কথা বলেছিলাম, তাঁরা এবং তাদের জ্ঞাতিসূত্রে আমাদের পরিবারই এই পিছারার ঘাটের চৌহদ্দির তাবৎ উচ্চ এবং অপবর্গীয় মনুষ্যদের বীজপুরুষদের এ স্থানে বসতি করান। তবে এদের অনেক আগেই ধীবর-কৈবর্তরা এ স্থানে বসতি গড়েছিল। তারা শুধু মৎস্যজীবীই ছিল। চাষি-গৃহস্থ ছিল না। আবাদকারীদের অর্থাৎ চাষি-মনুষ্যদের নিয়ে এখানে যে বসতি স্থাপন আমাদের বীজপুরুষেরাই করান, এ তথ্য স্থানীয় ইতিহাসে পাওয়া যায়।
আমার অনুমানে এই পিছারার খালের বিশ্বটি গড়ে উঠেছিল প্রায় তিনশ বছরের আবাদি প্রচেষ্টায়। এই বসতের সৃজন-কথা আশৈশব শুনেছি, এই স্থানের পরম রহস্যময় এবং আশ্চর্য পরণকথা শুনেছি এবং এই স্থানকে এক পরম দিব্য বিভায়ও একসময় দেখেছি; তারপর এর ধ্বংস যখন প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে তখনকার অপার দুঃখ তো জীবৎকাল ধরে বহনও করে যাচ্ছি। এই সমুদয় সমৃদ্ধি দেখে, এই আশ্চর্য জগতের এক অনাকাঙ্ক্ষিত বিলীয়মানতা প্রত্যক্ষ করতে করতে আমার জীবন চিরকালের জন্য এক বিষণ্ণ জীবনই হয়ে রইল। আমার মতো হয়তো আরও হাজারো জীবনই এরকম দুঃখময়তার বিষণ্নতায় তাদের জীবন অতিবাহিত করে তাঁদের পিছারার ঘাটের শূন্যতাকে হৃদয়ে নিয়ে নিঃশেষ হলেন, তার খবর, ইতিহাসে কোথায় থাকে? লোকেরা শুধু গোদা কথায় দেশভাগ আর তার কার্যকারণ ব্যাখ্যা করে। সেই ব্যাখ্যাই ইতিহাস হয়, কিন্তু আমাদের অনুভবের দুঃখের স্থান সে ইতিহাসে কোথায়?
গাজির ব্যাপারটি এবং আরও অনেক ঘটনা পিসিমার কর্তৃত্বে নাড়া দিয়েছিল। তাঁর ক্ষমতার জগতে সেই সময় এক ব্যাপক ভাঙন দেখা দিলে উনিশশ বাহান্ন কি তিপ্পান্ন সালের ফাল্গুনের এক সকালে বড়খালের ঘাটে একখানা বেশ বড়সড় নৌকো লাগল। পিসিমাবুড়ি তার বয়স্থ, বয়স্থা নাতি-নাতনিদের নিয়ে জীবনের দ্বিতীয়বারের মতো তাঁর বাপের বাড়ি ছাড়লেন। প্রথম ছেড়েছিলেন সাত বছর বয়সে, ‘রোহিনী বউ’ হিসেবে, কেননা, তখন ‘পঞ্চমবর্ষে ভবেৎ গৌরী, সপ্তমে চ রোহিনী’ একাদশ বর্ষে বৈধব্য নিয়ে ফিরে এসেছিলেন বাপের বাড়িতে ‘স্বামীখাগি’ অভিধা শিরোধার্য করে। তারপর এই তাঁর দ্বিতীয় বহির্গমন এবং শেষ। তাঁর চোখে আমরা কোনো কারণে কোনোদিন জল দেখিনি। কিন্তু নৌকোয় ওঠার আগে, বাড়ির সব ঠাকুর-দেবতা, তাঁর জাগেশ, উঠোনের গাছপালা, তাঁর তাবৎ প্রিয় বৃক্ষাবলি এবং মন্দিরগুলোকে প্রণাম করার সময়, তাঁর আকুল কান্না আমি দেখেছি। সে চিত্র ভোলার নয়। তাঁর আজীবনের অবলম্বন ওই সিংহ-পালঙ্ক ভর্তি অজিনাসনে উপবিষ্ট অসংখ্য ঠাকুর-দেবতার ছবি, পালঙ্কের আনাচে-কানাচে সব দেবতা, দেবকল্পিত নুড়ি, পাথর এবং ইত্যাকার তাবৎ আড়ম্বর আর তাঁর জীবনের সব অবলম্বন পরিত্যাগ করে বুড়িপিসিমা পিছারার খালের জগৎ ছাড়লেন। এইসঙ্গে আমাদের ব্রতকথা, পাঁচালি, বিভিন্ন খোলার মোচ্ছব এবং সমুদয় কিংবদন্তির যুগের অবসান হলো। আমরা বাকি যারা রইলাম, তারা নেহাতই একটা শ্মশানের পোড়া কয়লা আর ভাঙা কলসি হিসেবেই রইলাম। এরপর আর কেউই এমন থাকল না, যে প্রতিটি ক্রান্তিকালে বা সামাজিক তথা রাষ্ট্রীয় প্লবতার সময় সুন্দর সুন্দর সব স্বপ্নের কথা-কাহিনি শুনিয়ে আতঙ্কিতজনেদের খানিক আশ্বস্ত করতে পারেন। নৌকোয় ওঠার সময়, আমাদের সেই বৃক্ষদম্পতির শিকড় তাঁর মাথা কোটার আর্তি আজও এক অনুপম ছবি হয়ে আছে।