প্রতিধ্বনি

প্রতিধ্বনি

থমকে ফিরে তাকায় বনহুর।

মুখে তার কালো গালপাট্টা জড়ানো ছিলো। মাথায় পাগড়ি। ডিম্ লাইটের আধো অন্ধকারে চোখ দুটো জ্বলে উঠলো বনহুরের। দেখলো, পর্দার ফাঁকে বেরিয়ে আছে একটা পিস্তলের মুখ।

জীবনে বনহুর বহু দস্যুতা করেছে কিন্তু এমন অদ্ভুত ব্যাপারে কোনোদিন সে পড়েনি। বনহুর বেশ হকচকিয়ে গেলো, বললো সে কে তুমি?।

নারীকণ্ঠের হাস্যধ্বনি হলো–আমি কে জানতে চাও? আবার হেসে উঠলো নারীকণ্ঠ।

বনহুর কান পেতে মনোযোগ সহকারে স্মরণ করতে চেষ্টা করলো, এ স্বর কোথাও সে শুনেছে কিনা। এটা নূরীর কণ্ঠ নয় তা বেশ বুঝতে পেরেছে বনহুর। বললো এবার–হাঁ, আমি জানতে চাই– কে তুমি।

এবার মেয়েলী কণ্ঠ পুনরায় উচ্চারণ করলো–আমার পরিচয় আজ পাবে না দস্যু বনহুর!

 ওঃ, আমার পরিচয় তুমি জানো দেখছি?

আরও জানি–তোমার জীবনের সব ঘটনা আমি অবগত আছি।

তুমি কে বলো?

আমার পরিচয় তুমি পাবে না। আর শোন, তুমি যে উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছে তা সফল হবে না। পারবে না তুমি এখানে কোনো ক্ষতি করতে।

তাহলে তুমি…

হাঁ, তোমাকে মুক্তি দেবো। শীঘ্ৰ তোমার হস্তের রিভলভার ত্যাগ করো। খুলে ফেলো তোমার দস্যু-ড্রেস। লুকিয়ে রাখো পিয়ানোর মধ্যে।

নইলে কি করবে?

এক পা এগুলে বা পিছুলে তোমাকে গুলী করে হত্যা করবো। পুনরায় বলছি, ত্যাগ করো তোমার রিভলভার।

বনহুর এবার বাধ্য হলো তার হস্তস্থিত রিভলভারখানা নামিয়ে রাখতে।

খোলো তোমার দস্যু-ড্রেস।

বনহুর এবার তার শরীর থেকে জমকালো দস্যু-ড্রেস খুলে ফেললো। লুকিয়ে রাখলো পিয়ানোর মধ্যে।

এবার বললো নারীকণ্ঠ–যাও, তোমার শয্যায় গিয়ে চুপ করে শুয়ে পড়ো। কথা দিলাম, কেউ জানবে না তোমার এ অদ্ভুত কাজের কথা। জানবে না তোমার আসল পরিচয়… …

বনহুর সুবোধ বালকের মত শয্যা গ্রহণ করলো।

কোনো যাদুমন্ত্রে সে যেন আজ পুতুল বনে গেছে। বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করলো বনহুর। একটা নারীর কাছে আজ তার চরম পরাজয়।

কখন যে বনহুর ঘুমিয়ে পড়েছে।

*

রাত ভোর হতেই মিঃ হাশেম চৌধুরী এসে জড়িয়ে ধরলেন বনহুরকে–সুপ্রভাত বন্ধু! আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমি। আপনার পিয়ানোর সুর আজ আমাকে রাত্রির ভয়ঙ্করের কবল থেকে রক্ষা করেছে।

স্বপনও ততক্ষণে জেগে উঠেছে।

বনহুর থতমত খেয়ে গেলো, কেমন যেন বিব্রত বোধ করতে লাগলো সে। এ বাড়িতে এমন কেউ আছে, যে তার আসল পরিচয় জানে। বনহুর আর বেশিক্ষণ বিলম্ব করতে পারলো না বা করবার মত তার মনোভাব ছিলো না। আজ সে এমনভাবে পরাজয় বরণ করবে কল্পনা করতে পারেনি।

বনহুর যতই সরে পড়ার চেষ্টা করুক মাসুমা কিন্তু তাকে ছাড়লো না, জোর করে চা-নাস্তা ভোজন কাজ সমাপ্ত করে তবেই ছুটি দিলো। আর বলে দিলো, পুনরায় আমাদের পিয়ানো শোনাতে হবে। যাবো একদিন আপনাদের ওখানে পিয়ানো শুনতে।

বনহুর আর স্বপন চলে এলো পুলিশ সুপারের বাংলো থেকে। কিন্তু মন তার সচ্ছ নয়। গভীর চিন্তায় মগ্ন সে–কে ঐ নারী যে জানে তার আসল পরিচয়। সুদূর দিল্লী নগরীতে কে সে?

ওদিকে মনিরার মনে আজ আনন্দের উৎস।

তার মহামূল্য রত্নের সন্ধান আজ পেয়েছে। পেয়েছে তার স্বামীর দর্শন। মনিরা কিছুতেই যেন এ আনন্দ বুকে চেপে রাখতে পারছিলো না। আবার প্রকাশ করবার মত দুঃসাহসও হচ্ছিলো না। যদিও মনিরা হৃদয়ের গোপন আনন্দ-উৎস হৃদয়েই চেপে রাখার চেষ্টা করছিলো, কিন্তু তার কিছুটা ফুটে উঠেছিলো ওর চোখে-মুখে।

মনিরা খুসিতে আত্মহারা!

মাসুমা চিরগম্ভীরা বান্ধবীকে উজ্জ্বল-দীপ্ত হতে দেখে সেও সুখী হলো অনেক। ভাবলো, তাদের প্রচেষ্টা তাহলে সার্থক হয়েছে। মনিরার মুখে হাসি ফোঁটানোই ছিলো তাদের উদ্দেশ্য।

মনিরাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে মাসুমা-মনিরা, রঞ্জন বাবুর পিয়ানো শোনার পর থেকে তোমাকে সত্যি বড় সচ্ছ মনে হচ্ছে। তার সঙ্গে যদি পরিচিত হতে তাহলে আরও মুগ্ধ হতে। অদ্ভুত মানুষ রঞ্জন বাবু। দেখতে যেমন সুন্দর-সুপুরুষ তিনি, তেমনি হাস্যোদীপ্ত স্বভাব। বড় ভাল লোক কিন্তু…

হোক, আমি কারো সঙ্গে পরিচয় করতে রাজি নই ভাই। উনার পিয়ানোর সুর সত্যি অপূর্ব তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

শুধু অপূর্বই নয়, সমস্ত অন্তরকে বিমুগ্ধ করে ফেলে–এ কথা অস্বীকার করা যায় না।

কদিন বেশ কেটে গেলো।

শহরে রাত্রির ভয়ঙ্করের ভয়াবহ উপদ্রব ক’দিন আর হয়নি। বেশ শান্তই মনে হচ্ছে দিল্লী নগরীটা আজকাল। দিল্লী পত্রিকা এ নিয়ে অনেক রকম মন্তব্য প্রকাশ করে চলেছে। বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্ন মতামত প্রকাশ পাচ্ছে।

আজকাল পুলিশ সুপার মিঃ হাশেম চৌধুরী রঞ্জন বাবুর অত্যন্ত ভক্ত হয়ে পড়েছেন। প্রায়ই তিনি আসেন তার পিয়ানো শুনতে। সেদিন মাসুমা মনিরাকে ধরে বসলো–চল না ভাই, আজ কল্পনাদের বাড়ি।

শেষ পর্যন্ত দেখছি কল্পনার দাদার পিয়ানোর সুরে আকৃষ্ট হলি। বলি মিঃ চৌধুরীর উপায় কি হবে বলতো?

কেন, তুই না হয় আমার হয়ে এদিকটা চালিয়ে নিস্। বললো মাসুমা।

মনিরা রাগ করার ভান করে বলে–বড্ড দুষ্ট হয়েছিস মাসুমা।

আমার চেয়ে তুই বেশি দুষ্ট। কেবল, সত্যি ভাই ওর পিয়ানোর সুর আমাকে মুগ্ধ করেছে। শেষ পর্যন্ত দেখছি ভদ্রলোকের…প্রেমে পড়ে না যাস?

এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করেন হাশেম চৌধুরী–তাহলে এ বান্দার কি হবে?

 মাসুমা আর মনিরা চমকে উঠে। বিব্রত বোধ করে মনিরা, বিশেষ করে হাশেম চৌধুরীর সম্মুখে সে লজ্জিত হয়। বেরিয়ে যায় মনিরা কক্ষ থেকে।

মাসুমা আর হাশেম চৌধুরী মিলে চলে নানা রসপূর্ণ আলাপ-আলোচনা।

*

সেদিন সন্ধ্যায় মাসুমা মনিরাকে সঙ্গে করে যায় কল্পনাদের বাড়ি বেড়াতে। মাসুমার উদ্দেশ্য রঞ্জন বাবুর পিয়ানো শুনবে।

মনিরা কিন্তু নতুন এক জেদ ধরে বসলো,–সে বোরখা পরে তবেই গেলো। আজকালকার মেয়ে হয়ে একি সেকেলে ফ্যাশান!

মনিরা নির্বাক, কোনো কথা সে বললো না।

হাশেম চৌধুরী আজ অফিসের কাজে আটকা পড়ে গিয়েছিলেন। কাজেই মাসুমা আর মনিরা এলো এ-বাড়ি।

কল্পনা, স্বপন আর রঞ্জন তাদের অভ্যর্থনা জানালো।

মাসুমা আর মনিরা গাড়ি থেকে নেমে হলঘরে প্রবেশ করলো। মাসুমার সঙ্গে বোরখা পরা একটি যুবতীকে দেখে অবাক হলো ওরা। কল্পনা বললো–মাসু বৌদি, এ কালের মেয়ে হয়ে দিদি বোরখা পড়েন কেন?

হেসে বললো মাসুমা–ওর সখ।

বোরখার মধ্য থেকে সুমিষ্ট একটি কণ্ঠস্বর বেরিয়ে এলো–মুসলমান হয়ে বেপর্দা করা মোটেই উচিৎ নয়। তাই আমি এভাবে চলাফেরা করি।

বললো রঞ্জনবেশী বনহুর–এ জন্য আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

মাসুমা হেসে উঠলোবেশতো, বোরখার মধ্য থেকে আমার বান্ধবী আপনার ধন্যবাদ আদায় করে নিলো। আগে জানলে আমিও বোরখা পরে আসতাম। ওঃ ভুলেই গেছি, আমার বান্ধবীর সঙ্গে আপনার পরিচয় হয় নি এখনও। ওর নাম….

মাসুমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো মনিরা–আমার নাম আলেয়া।

 মাসুমা অবাক হলো, তবু মনিরার কথায় যোগ দিয়ে বললো–হাঁ, ওর নাম আলেয়া।

বললো বনহুর–বেশ নাম; হাঁ, উনি আলেয়াই বটে।

 স্বপন আর কল্পনা এতোক্ষণ দাঁড়িয়েছিলো হাবার মত।

বললো বনহুর–বসুন আপনারা।

মাসুমা একটা সোফায় বসে পড়ে বললো–আলেয়া, বোস্ ভাই।

বললো মনিরা।

 এবার বনহুর, স্বপন ও কল্পনা আসন গ্রহণ করলো।

স্বপন বললো–বৌদি, আপনারা এসেছেন, সত্যি আমরা অনেক খুসি হয়েছি।

কল্পনাও যোগ দিলো দাদার কথার সঙ্গে।

মাসুমা বললো–রঞ্জন বাবু, আপনার পিয়ানোর সুর আমাদের টেনে এনেছে। এবার বুঝতেই পারছেন ব্যাপারখানা, আমার পর্দানশীন বান্ধবী আলেয়া পর্যন্ত থাকতে পারলো না, সেও ছুটে চলে এলো।

ভ্রূ কুঞ্চিত করে তাকালো বনহুর বোরখা–ঢাকা মুখখানার দিকে। কে ঐ বোরখার অন্তরালে, যে জানে তার আসল পরিচয়।

মনিরা বুঝতে পারে–বনহুর তাকে সন্দেহ করেছে। কারণ মাসুমার সঙ্গে তাকে বোরখা-পরা অবস্থায় বড় বেমানান লাগছিলো। তাছাড়া পরশু রাতে পুলিশ সুপারের বাংলোতে ওকে যেভাবে বেকু বানিয়ে দিয়েছে মনিরা, তাতে সন্দেহ না করে উপায় ছিলো না বনহুরের।

মনিরার মুখ বনহুর দেখতে না পেলেও মনিরা বনহুরের মুখোভাব স্পষ্ট লক্ষ্য করছিলো। হাসি পাচ্ছিলো মনিরার; জানে সে বনহুর বুঝতে পেরেছে–বাংলোর সেই অদৃশ্য নারীই এই বোরখাধারিনী।

মনিরা আরও সাবধান হয়ে যায়। কিছুতেই সে এতো সহজে ধরা দেবে না ওকে। তাকে ও কাঁদিয়েছে রাতের পর রাত, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। এবার খুঁজে পেয়েছে। হয়তো ভাগ্য তাই সে নিয়তির টানে চলে এসেছে সুদূর ভারতবর্ষে। মনিরা স্বামীর দর্শনে আনন্দে অধীর হয়েছে, কতবার ধৈর্যহারা হয়েছে তবু নিজেকে কঠিন করে রেখেছে। সে দেখতে চায় স্বামীর আসল রূপ।

নিজেকে কঠিন করে রাখে মনিরা, নিজের মধ্যে এতোটুকু দুর্বলতা যেন প্রকাশ না পায় সেদিকে তার সতর্ক দৃষ্টি। বনহুর বললো এবার–মিসেস চৌধুরী, আপনার পর্দানশীন বান্ধবী কষ্ট করে। এসেছেন আমার পিয়ানো শুনতে। এ জন্য আমি আনন্দিত।

তাহলে এবার শুরু করুন। বললো মাসুমা।

 রঞ্জনবেশী বনহুর পিয়ানোর পাশে এসে বসলো।

স্বপন কলিং বেল টিপে বয়কে ডেকে জলযোগের আয়োজন করতে বললো।

কল্পনা তো একটা আসন দখল করে নিয়ে বসেছে। সে তার রঞ্জন দাদার হাতে পিয়ানো শুনতে পাগল হয়ে পড়ে।

বনহুর পিয়ানো বাজাতে শুরু করলো। সু

রের মূর্হনায় মুখর হয়ে উঠলো হলঘর।

 তন্ময় হয়ে গেছে মাসুমা।

মনিরার দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুবিন্দু। বোরখার আবরণে তার মুখমণ্ডল যদি ঢাকা না থাকতো তাহলে সবাই দেখতো, মনিরার মুখ আনন্দে দীপ্তময় হয়ে উঠেছে। অদ্ভুত এক দিপ্ততায় উজ্জ্বল হয়েছে তার নয়ন দুটি। মনিরা কিছুতেই নিজকে যেন ধরে রাখতে পারছিলো না। স্বামী-হস্তের পিয়ানোর সুর তাকে আবছন্ন করে ফেলেছিলো। সমস্ত শিরায় শিরায় ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছিলো একটা উষ্ণ রক্তের প্রবাহ। সোফায় ঠেশ দিয়ে চুপ করে বসে রইলো সে।

বনহুরের পিয়ানো থেমে যায়।

 কিন্তু কক্ষমধ্যে পিয়ানোর সুরের প্রতিধ্বনি তখনও সৃষ্টি করে চলেছে এক অপূর্ব পরিবেশ।

 চা-নাস্তা আসে।

বনহুর উঠে আসে পিয়ানোর পাশ থেকে।

 চায়ের টেবিলে বসে ওরা সবাই মিলে।

মাসুমাও উঠে যায় টেবিলের পাশে।

মনিরা তখনও বসে আছে নিজের আসনে।

মাসুমা ওকে লক্ষ্য করে হেসে বলে–কিরে আলেয়া, অমনি চুপ হয়ে গেলি দেখছি। রঞ্জন বাবুর পিয়ানোর সুর শুধু আমাকেই বিমুগ্ধ করে ফেলেনি, তোকেও দেখছি একেবারে তন্দ্রাচ্ছন্ন করে ফেলেছে।

মাসুমার পরিহাস-বাক্যে মনিরা যেন সন্বিৎ ফিরে পায়। উঠে দাঁড়ায় মনিরা, তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বলে–বড় বাড়াবাড়ি শুরু করছো মাসুমা। রঞ্জন বাবুর পিয়ানোর সুর আমাকে মুগ্ধ করেছে সত্যি কিন্তু তার সুরের মোহ আমাকে তন্দ্রাচ্ছন্ন করতে পারবে না কোনোদিন।

মাসুমা একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়, সত্যি কথাটা বলে সে হয়তো ভুলই করেছে। আরও ভাবে, মনিরা অবিবাহিত মেয়ে নয়। তার স্বামী আছে, সন্তান আছে, একটা অপর পুরুষ সম্বন্ধে এভাবে বলাটা অত্যন্ত বাড়াবাড়িই হয়ে গেছে।

চা-নাস্তা-পর্ব শেষ করে যখন বিদায় নিলো মাসুমা, তখন বেশ রাত হয়ে গেছে।

রঞ্জনবাবুবেশী বনহুর, স্বপন আর কল্পনা গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলো। যদিও বেশিদূর নয় বাংলোটা, তবু পুলিশ-সুপারের সহধর্মিনী হেঁটে যাবেন প্রকাশ্য রাজপথ দিয়ে–এ হতে পারে না, কাজেই গাড়ি নিয়ে এসেছিলো ওরা।

গাড়িতে বসে হাত নাড়ে মাসুমা–আবার আসবো কিন্তু রঞ্জন বাবু, পিয়ানো শোনাতে হবে।

 আসবেন। বললো বনহুর।

কল্পনা আর স্বপন একসঙ্গে বললো–যত খুসি পিয়ানো শুনবেন মাসুমা বৌদি। আসবেন আবার।

 গাড়ি চলে গেলো।

 ফিরে এলো ওরা তিনজনা হলঘরে।

হলঘরে প্রবেশ করতেই বনহুরের নজর চলে গেলো যে আসনটায় বসেছিলো বোরখা পরা মহিলাটি। একটা ছোট্ট কাগজ ভাঁজ করা পড়ে আছে বলে মনে হলো তার।

বনহুর স্বপন আর কল্পনা কথা বলতে বলতে কক্ষমধ্যে এগুচ্ছিলো।

স্বপন বলছিলো–রঞ্জন দা, মাসুমা বৌদি খুব সুন্দর, তাই না? বেশ মিশুক মেয়ে কিন্তু। আমার বড্ড ভাল লাগে মাসুমা বৌদিকে।

কল্পনা বলে উঠে–আলেয়াদিকে তুমি তো দেখোনি রঞ্জন দা। সত্যি অদ্ভুত মেয়ে আলেয়াদি। যেমন রূপ তেমনি গুণ। মাসুমা বৌদির চেয়ে অনেক সুন্দরী…

রেখে দে, সুন্দরী হলে সে আবার ভূতের মত বোরখা পরে থাকে নাকি? তাহলে সব সময়

সব সময় রূপ দেখিয়ে বেড়াবে এই বলছো তো? কিন্তু জানো না স্বপনদা, আলেয়াদি তেমন মেয়ে নয়। একটুও রূপের গর্ব তার নেই।

ভাই-বোন মিলে যখন তব বিতর্ক চলছিলো তখন বনহুর ওদের অলক্ষ্যে চট করে সোফা থেকে ভাঁজ করা কাগজের টুকরাটা তুলে নেয় হাতে। তখনকার মত রেখে দেয় পকেটে, তারপর এসে বসে ওদের পাশে, হেসে বলে বনহুর–কি ব্যাপার বলো তো?

কল্পনা বলে–দেখো তো রঞ্জন দা, ও বিশ্বাসই করতে চায় না।

 কি বিশ্বাস করতে চায় না স্বপন?

আমি বলছি, মাসুমা বৌদির চেয়ে আলেয়াদি অনেক বেশি সুন্দরী। জানো রঞ্জনদা, ও বলছে। তাহলে অমন ভূতের মত বোরখা পরে বেড়াতো না।

ও ঠিকই বলেছে কল্পনা। সত্যিই তো বোরখা ব্যবহার করে কারা–যারা কুৎসিৎ কদাকার তারাই। সুন্দরী আর রূপসী হলে তারা নিজেদের অমন করে ঢেকে রাখবে কেন? মানুষ তো আর রাক্ষস না যে দেখলেই খেয়ে ফেলবে?

অভিমান-ভরা কণ্ঠে বলে কল্পনা–আলেয়াদি নিজেকে বোরখার আবরণে ঢেকে রাখে লোকদের চোখ ঝলসে যাবে বলে। তারপর রাগ করে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

স্বপন ঠোঁট উল্টে বলে গেলো তো বয়েই গেলো। যাকে আজ পর্যন্ত একবার দেখতে পেলাম না, তার আবার রূপের প্রসংসা। লোকেই যদি ওর রূপ না দেখলো তবে কি হবে ও রূপ দিয়ে। আরে ছোঃ …

স্বপনের কথায় হাসলো বনহুর, বললো–দ্রাক্ষাফল খেতে না পেলে টই হয়। তেমনি সুন্দর জিনিস দেখতে না পেলে কুৎসিতই মনে হয় স্বপন।

তুমিও দেখছি কল্পনার দিকে ঝুঁকে পড়লে রঞ্জনদা, যাই বলো মেয়েদের বোরখা পরা আমার একেবারে সহ্য হয় না।

তুমি জানো না স্বপন, মুসলমান হাদিসে আছে–মেয়েরা অপর পুরুষের দৃষ্টি থেকে নিজেদের আড়াল করে রাখবে।

আর যদি আড়াল না করে?

পাপ হবে।

বাঃ বাঃ চমঙ্কার কথা! ওরা বোরখা পরে নিজেদের শরীর ঢাকা দিয়ে রাখবে আর বোরখার ছিদ্র দিয়ে পুরুষদের ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে দেখবে, তাতে বুঝি পাপ হয় না? তার চেয়ে বোরখা পরে অন্দর মহলে বসে থাকবে, তবেই না মুসলিম নারী। হাঁ, অমন কত বোরখা-পরা যেয়ে দেখেছি–সব কিছু শয়তানি ঐ বোরখার নিচে…

বনহুর সিগারেট ধরালো, মুখে তার মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। মিথ্যা বলেনি স্বপন। বোরখা পরা মেয়েদের মধ্যে যত নষ্টামি রয়েছে, তত নেই সাধারণ মেয়েদের। কারণ সাধারণ মেয়েরা চলাফেরা করবে স্বাভাবিকভাবে। তাদের চাল-চলন হবে স্বাভাবিক। বোরখা পরতে গেলেই তাদের ভিতরে থাকবে অপ্রকাশিক এক গোপনতা। পুরুষদের দৃষ্টি বার বার অন্বেষণ করে ফিরে ঐ বোরখার নীচে। একমুখ ধোয়া ছুঁড়ে দিয়ে বলে বনহুর–স্বপন, তোমার সঙ্গে আমার একমত।

স্বপন খুশিতে লাফিয়ে উঠে, করমর্দন করে সে বনহুরের, তারপর কথাটা ছোট বোন কল্পনাকে জানানোর জন্য দ্রুত কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়।

বনহুর হস্তস্থিত অৰ্দ্ধদগ্ধ সিগারেটটা এ্যাসট্রেতে নিক্ষেপ করে পকেট থেকে বের করে ভাঁজ করা কাগজের টুকরাখানা। মেলে ধরে আলোর সামনে। আঁকাবাঁকা কয়েক লাইন লেখা। লেখাটা কোনো নারীর বাম হস্তের তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বনহুর পড়লো–

–হে বনের সৌন্দর্য, বন ছেড়ে কেন তুমি। এই ইট-পাথরে গড়া নগরের বুকে আশ্রয় গ্রহণ করেছো? তোমার বিরহে বনের পশু-পাখি যে। হাহাকার করে ফিরছে। ফিরে যাও তোমার আবাসে, যেখানে তোমার প্রতী ক্ষায় প্রহর গুণছে সবাই। – বান্ধবী।

একবার নয়, বার বার পড়লো বনহুর চিঠির টুকরাখানা। আশ্চর্য এ নারী, কে এই বান্ধবী যে তার সব কিছুই জানে? দেখতে হবে বনহুরের চোখে ধূলো দেয় এমন জন আছে নাকি কেউ!

*

কক্ষমধ্যে পায়চারী করে ফিরছে বনহুর।

গভীর রাত।

যে যার কামরায় ঘুমিয়ে পড়েছে।

 সিগারেটের পর সিগারেট নিঃশেষ করে চলেছে বনহুর। রাত বেড়ে আসছে। বনহুর এবার তার ড্রেসিংরুমে প্রবেশ করলো। পরে নিলো তার জমকালো ড্রেস। মাথায় কালো পাগড়ি। পাগড়ীর খানিকটা অংশ ঝুলছে বাম পাশে। ঐ অংশটা বনহুর মুখের নিচে গালপাট্টার মত জড়িয়ে নেয়। রিভলভারটা তুলে নিলো পকেটে।

আয়নার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো বনহুর। অপূর্ব লাগছে নিজেকে। জমকালো ড্রেসটা তাকে অদ্ভুত সুন্দর করে তোলো। বনহুর বাম পাশে ঝুলানো কালো কাপড়ের অংশটা মুখে জড়িয়ে নিলো। বেরিয়ে এলো সন্তর্পণে।

*

মনিরা জানে, বনহুর নিশ্চয়ই আসবে। তার চিঠিখানা অবশ্যই সে পেয়েছে। আরও থোকা লেগেছে তার মনে। মনিরা নিজের মনেই হাসে, সে তার স্বামীকে নিয়ে এবার একটা মজার খেলা খেলবে। অনেক কাঁদিয়েছে বনহুর ওকে, এবার বনহুরকে মনিরা কিছুটা নাকানি-চুবানি খাওয়াবে।

মনিরা গোপনে হাশেম চৌধুরীর রিভলভারখানা এনে রেখেছে নিজের কাছে। রিভলভার আনলেও। তাতে সত্যি কোনো গুলী ছিলো না।

এবার মনিরা কান পেতে শুনলো…পাশের কক্ষে হাশেম চৌধরী নাক ডাকছে। ঘুমিয়ে পড়েছে হাশেম চৌধুরী আর মাসুমা। দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালো সে, রাত দুটো বেজে ত্রিশ মিনিট হয়েছে।

মনিরা পরে নিলো তার বোরখাটা, তারপর রিভলভার হাতের মুঠোয় চেপে ধরে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে রইলো নিশ্চুপ হয়ে।

এক মিনিট, দু’মিনিট করে কেটে গেলো কয়েক মিনিট। মনিরা তবু নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। এ কক্ষে কয়েকটা জানালা রয়েছে। কিন্তু প্রত্যেক জানালায় লোহার মজবুত শিক্ দেওয়া আছে। শুধু এ জানালাটায় কাঁচের শার্সী। মনিরা জানে, বনহুর এলে এ জানালা দিয়েই তার কক্ষে প্রবেশ করবে।

রিভলভার উঁচু করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মনিরা।

দেয়ালঘড়িটা টিক্ টিক্ শব্দে বেজে চলেছে।

ঘড়ির কাঁটার শব্দের সঙ্গে মনিরার বুকের মধ্যেও ঢি ঢিপ করছিলো। স্বামীর দর্শনে সে যেন আত্মহারা না হয়, বিচলিত যেন না হয়ে পড়ে, সেজন্য নিজকে শক্ত করে নিচ্ছিলো।

হঠাৎ একটি শব্দ হলো খুট করে।

 শব্দটা অত্যন্ত মৃদু।

সজাগ হয়ে দাঁড়ালো মনিরা, নিশ্চয়ই সে এসেছে। মনিরা নিজের বুকের মধ্যে একটা আলোড়ন অনুভব করলো। স্তব্ধ নিশ্বাসে দাঁড়িয়ে রইলো মনিরা, দক্ষিণ হস্তে রিভলভারখানা।

মনিরা রিভলভারখানা উদ্যত করে ধরে আছে, তার উপর নজর পড়তেই যেন প্রথম রিভলভারখানা চোখে পড়ে। মনিরা জানালার আড়ালে আত্মগোপন করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।

এমন সময় জানালার শার্শী খুলে যায়।

সঙ্গে সঙ্গে কক্ষে প্রবেশ করে বনহুর, মেঝেতে লাফিয়ে পড়ে সে, তারপর এগিয়ে যায় খাটের দিকে।

মনিরা লক্ষ্য করে বনহুরের কার্যকলাপ।

খাটের উপর তার কোলবালিশটা চাদর দিয়ে বেশ করে ঢেকে রেখেছিলো মনিরা।

বনহুর মনে করে, নিশ্চয়ই সেই বান্ধবী নামধারিনী মহিলা শুয়ে আছে বিছানায়। এবার জানতে পারবে সে–কে এই মহিলা।

সন্তর্পণে এগিয়ে যায় সে।

মনিরা রুদ্ধ নিশ্বাসে তাকিয়ে থাকে। মনিরার হস্তেও রিভলভার, কিন্তু রিভলভার গুলীশূন্য।

 বনহুর শয্যার পাশে এসে দাঁড়ায়।

 রিভলভার উদ্যত রেখে সরিয়ে ফেলে চাদরখানা। মুহূর্তে ক্রুদ্ধ হয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় চাদরখানা মেঝেতে।

অমনি মনিরা বনহুরের পিঠে তার ফাঁকা রিভলভারের মুখটা চেপে ধরে পিছন থেকে খবরদার, একচুল নড়বে না।

বনহুর বিস্ময়ে আড়ষ্ট হয়ে যায়।

মনিরা তীব্র কণ্ঠে বলে দাও, রিভলভার আমার হাতে দাও।

বনহুর পিঠে রিভলভারের মুখের শক্ত চাপ অনুভব করে। বাধ্য হয়ে হাতের রিভলভারখানা তার সম্মুখে এগিয়ে ধরা হাতখানার উপরে রাখে।

মনিরা এবার বলে উঠে বেরিয়ে যাও, যে পথে এসেছো ঐ পথে। খবরদার, আমার দিকে ফিরে তাকাবার চেষ্টা করো না, সঙ্গে সঙ্গে গুলী করবো।

বনহুর যেন হকচকিয়ে যায়। এমন নিপুণ কৌশলে তাকে কে জব্দ করলো? তবে হাঁ, বান্ধবীই বটে, তাকে হাতের মুঠায় পেয়েও গ্রেফতার না করে চলে যাবার জন্য নির্দেশ দিচ্ছে। বনহুর বললো– কে তুমি না দেখে আমি যাবো না।

বেশ, তাহলে মরতে রাজি আছো?

বনহুর মরতে ভয় করে না, তবে নারীর হস্তে সে মরতে রাজি নয়।

তবে সসম্মানে বেরিয়ে যাও। যাও বলছি, নইলে এক্ষুণি পুলিশ সুপার এসে পড়বেন।

বনহুর বিলম্ব না করে যে পথে এসেছিলো ঐ পথে অদৃশ্য হলো।

 মনিরা হেসে উঠলো হাঃ হাঃ হাঃ….

বনহুরের কানে সে হাসির শব্দ যেন গরম সীসার মত জ্বালাময় মনে হলো।

মনিরা এবার তার বোরখা উন্মোচন করে ফেললো। নিজের হস্তের রিভলভারখানা শয্যায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে স্বামীর রিভলভারখানা চেপে ধরলো বুকে। গণ্ড বেড়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু।

*

পরদিন মনিরা যখন ঘুম থেকে জাগলো তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে। অবশ্য এতো বেলা ঘুমানোর কারণ আছে যথেষ্ট। প্রায় সমস্ত রাত্রি জেগেই কেটেছে মনিরার। বনহুর চলে যাবার পরও বহুক্ষণ ঘুমাতে পারে না সে।

ভোরের দিকে ঘুমিয়েছিলো মাত্র, তাই জাগতে বেশ বেলা হয়ে গেছে।

 চায়ের টেবিলে বসে নানারকম গল্প শুরু হলো।

গত রাতে কল্পনাদের বাড়িতে বেড়ানো ব্যাপার থেকে রঞ্জন বাবুর পিয়ানো বাজানো সম্বন্ধে সব আলোচনাই চললো।

মনিরা কিন্তু সব কথায় ঠিকভাবে যোগ দিতে পারছিলো না। মনের মধ্যে নানারকম চিন্তা জট পাকাচ্ছিলো ওর, তবু যোগ না দিয়ে উপায় ছিলো না। বিশেষ করে মাসুমা তাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে ব্যস্ত করে তুলছিলো।

মাসুমা বললো হঠাৎ–ওগো, চলো না আজ আমরা আগ্রা তাজমহল দেখতে যাই? সত্যি, যত বার দেখি আরো যেন দেখবার সখ জাগে মনে। কি বলিস মনি, তাই না?

হাঁ। ছোট্ট জবাব দিলো মনিরা।

মাসুমা রাগতভাবে বললো–তুই বড্ড বুড়িয়ে গেছিস, মনিরা। বেশি কথা বলবি না। বেশি খাবি না, বেড়াবি না। সব সময় কেমন যেন ভাবগম্ভীর স্বভাব নিয়ে থাকবি।

হাশেম চৌধুরী হেসে বলেন–তোমার মত অমন রসিক মেয়ে তো সবাই নয়।

আমি বুঝি রসিক মেয়ে!

তা নয় তো কি? তোমার বান্ধবীর চেয়ে তুমি বড় ছেলেমানুষী করো।

 যাও আর কথা বলবো না বা কোথাও বেড়াতে যাবো না। তোমার সঙ্গে আড়ি…

আঃ বাচলাম তাহলে।

 কিন্তু বাঁচতে তোমাকে দেবো না আমি।

তার মানে?

মানে রঞ্জন বাবুকে বলেছি, তিনি নিয়ে যাবেন আমাদের। আর তুমি যাবে আমাদের পাহারাদার হিসেবে।

সবাই এবার হেসে উঠলো হো হো করে।

মনিরাও জোরে হেসে উঠলো এবার।

মাসুমা বললো–দেখলে আমার বান্ধবী নাকি হাসতে জানে না, এবার দেখলে তো?

*

বিকেলে হাশেম চৌধুরী সপরিবারে আগ্রার দিকে রওয়ানা দিলেন। স্বপন, কল্পনা আর রঞ্জন বাবুও সঙ্গে রইলো তাদের। আর রইলো কয়েকজন সশস্ত্র পুলিস ফোর্স।

হাশেম চৌধুরীর নিজস্ব কারেই রওয়ানা দিলো সবাই মিলে।

 পিছনে চললো পুলিশ ভ্যান।

এক সময় বনহুর হেসে বললো–মিঃ চৌধুরী, পুলিশ ফোর্স নিয়েছেন ব্যাপার কি? ডাকু গ্রেফতারে চলেছেন নাকি?

হাশেম চৌধুরী বললেন–সাবধানতা রক্ষার জন্য ওদের সঙ্গে নিলাম রঞ্জন বাবু। হঠাৎ যদি… রাত্রির ভয়ঙ্কর হামলা দিয়ে বসে, তাই?

হাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন রঞ্জন বাবু। সত্যি, আমি অবাক হয়ে গেছি এই রাত্রির ভয়ঙ্করের অদ্ভুত কার্যকলাপে। শত শত পাহারার মধ্যেও এই দস্যু তার কাজ ঠিকভাবে করে চলেছে।

মনিরা, মাসুমা আর কল্পনা বসেছিলো পিছনের আসনে। সম্মুখে বসেছিলেন হাশেম চৌধুরী আর স্বপন। ড্রাইভারের কাজ করছিলো রঞ্জনবেশী দস্যু বনহুর।

অবশ্য ইচ্ছা করেই বনহুর নিজে নিয়েছিলো এই ভারটা।

আজও মনিরার শরীরে বোরখা আবৃত ছিলো। বনহুরের মিষ্ট গম্ভীর কণ্ঠস্বর তার অন্তরে এক আনন্দ উৎসব বইয়ে দিচ্ছিলো। নিশ্চুপ বসে শুনছিলো সব। রাত্রির ভয়ঙ্কর যে অন্য কেহ নয় তা বেশ উপলব্ধি করছিলো মনিরা। তার স্বামী যে রাত্রির ভয়ঙ্কর নাম ধারণ করে দিল্লী নগরী তোলপাড় করে তুলেছে– একথা কেউ না জানলেও জানে সে। হাশেম চৌধুরীর কথায় বনহুরের টিপ্পনি-ভরা বাক্যগুলো শুনে মনে মনে হাসছিলো মনিরা। সুচতুর স্বামীর কার্যকলাপ সে নিপুণভাবে লক্ষ্য করে চলেছে। সুদূর। ভারতে এসেও সে তার স্বভাব ত্যাগ করতে পারেনি।

অনেক কথাই ভাবছিলো মনিরা, স্বামীকে এতো কাছে পেয়েও না পাওয়ার ব্যথা যে কত গভীর তা একমাত্র মনিরা ছাড়া কেউ বুঝতে পারবে না।

মাসুমা বললো হঠাৎ–আচ্ছা রঞ্জন বাবু, একটা কথা বলবো?

বলুন? একটা কেন যত খুশি বলুন আপনি। গাড়ির হ্যাণ্ডেলে হাত রেখে সম্মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো বনহুর।

মাসুমা বললো–রঞ্জন বাবু, আপনার জন্মভূমি কি এই দিল্লী নগরী?

বললো বনহুর–হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন মিসেস চৌধুরী?

আমি জানতে চাই আপনি আসল দিল্লীবাসী কিনা?

মনিরাই অবশ্য মাসুমাকে এ প্রশ্ন করবার জন্য তার কানে মুখ নিয়ে মৃদুস্বরে বলে দিয়েছিলো।

বনহুর বুঝতে পারে–বোরখাধারিনীই এ প্রশ্নের জন্য দায়ী মাসুমা নয়। বলে বনহুর–আমার জন্মভূমির সঠিক সন্ধান আমি জানি না। তবে সমস্ত পৃথিবীটাই আমার জন্মভূমি–এই জানি।

হেসে উঠেন হাশেম চৌধুরী, স্বপন আর কল্পনা।

 হাশেম চৌধুরী বলে উঠেন–ঠিক বলেছেন রঞ্জন বাবু। মনে পড়ে কোনো এক কবি বলেছিলেন—

বিশ্ব আমার জন্মভূমি।
বিশ্ব আমার মা বিশ্ব মায়ের চরণ সেবায়
বিলিয়ে দেবো গা,

মাসুমা বললো আবার–অমন সোজা উত্তর সবাই দিতে জানে রঞ্জন বাবু। আপনি যে বাংলাদেশের সন্তান নন, এ কথা আমি জানি।

চমকে উঠে বনহুর, তবে কি বোরখাধারিনী তার পরিচয় প্রকাশ করেছে মিসেস চৌধুরীর কাছে?

অসম্ভব কিছু নয়, এতো যখন ঘনিষ্ঠতা, তখন না বলার কোনো কারণ নেই। তবে এটুকু সান্ত্বনা হাশেম চৌধুরী এখনও জানেন না এ সব কিছু। জানলে নিশ্চয়ই তিনি তার সঙ্গে এমনভাবে মিশতে পারতেন না। কে এই মহিলা–একবার নয়, দু’বার সে তাকে জব্দ করে দিয়েছে? পুরুষ নয়–একটা নারীর কাছে তার চরম অপমান!

কি ভাবছেন রঞ্জন বাবু? বললো মাসুমা।

ভ্রূকুঞ্চিত করে বললো বনহুর–বাংলাদেশে বাস করি। বাংলা কথা বলি। তবু আমি বাঙালির সন্তান নই–আশ্চর্য! আফসোেস, আজও আমি নিজের পরিচয় নিজেই জানি না।

হাশেম চৌধুরী অবাক হয়ে বললেন–স্বপন আর কল্পনা তবে….

যদিও আমার মার গর্ভে তাদের জন্ম হয়নি তবু ওরা আমার ঠিক সহোদরের মত।

 এ-কথা সে-কথার মধ্যে গাড়ি এক সময় তাজমহলের অদূরে এসে থামলো।

 গাড়ি থেকে বনহুর নেমে পিছন আসনের দরজা খুলে ধরলো। বললো সে–নামুন।

 মাসুমা নামলো।

কল্পনাও নেমে দাঁড়ালো এবার।

মনিরা নামবার সময় ইচ্ছা করেই তার হাতখানা না জানার ভান করে বনহুরের হাতের উপর। রাখলো।

বনহুর চট করে তার নিজের হাতখানা সরিয়ে নিতে চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। মনিরার হাতখানা তখনও তার হাতের উপর বেশ চেপে রয়েছে।

বনহুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে হাতখানা লক্ষ্য করলো মুহূর্তের জন্য–হ সুন্দরী বটে–হাতেই তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। দুগ্ধ ধবল সুকোমল একটি হাত।

হাশেম চৌধুরী নেমে পড়ে বললেন–চলে এসো তোমরা।

সবাই অগ্রসর হলো তাজমহলের দিকে।

হঠাৎ বনহুরের মনটা বেদনায় চড়াৎ করে উঠলো। মনে পড়লো একদিনের কথা…সে আর লুসী পাশাপাশি এই পথ ধরে এগুচ্ছিলো সেদিন। ক’দিনের পরিচয়ে লুসী তাকে কত আপন করে নিয়েছিলো…

বনহুরের চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে যায়। মনিরা ঠিক তার পাশে পাশে এগিয়ে চলছিলো। মাসুমা ছিলো একটু আগে।

হাশেম চৌধুরী, স্বপন আর কল্পনা অনেকটা এগিয়ে গেছে।

মনিরা হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় ভূতলে, আর্তকণ্ঠে উচ্চারণ করে–উঃ মাগো।

 সঙ্গে সঙ্গে বনহুর ধরে ফেলে।

স্বামীর বলিষ্ঠ হাতের ছোঁয়ায় মনিরার সমস্ত দেহটা যেন অবশ শিথিল হয়ে আসে। শিরায় শিরায় বয়ে যায় এক অপূর্ব আনন্দদ্যুতি।

মাসুমা ততক্ষণে ধরে ফেলেছে মনিরাকে, রাগত কণ্ঠে বলে সে–এতো করে বললাম বোরখা পরার ঢং ত্যাগ কর, তবু বোরখা ছাড়বে না–এবার হলো? দেখি কোথাও চোট লেগেছে কিনা?

বনহুর আর মাসুমার হাতের মধ্য হতে মনিরা নিজেকে সংযত করে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বলে। সেনা না, আমার কিছু হয়নি।

আবার চলতে শুরু করে ওরা।

মনিরার মনেও একটা আলোড়ন শুরু হয়েছে। কিন্তু না, কিছুতেই এতো সহজে ধরা দেবে না সে ওকে।

তাজমহলের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো সবাই মিলে।

স্বপন ক্যামেরা এনেছিলো সঙ্গে ছবি তুললো কয়েকটা। তারপর আবার সকলে মিলে অগ্রসর হলো তাজমহলে।

তাজমহলের প্রথম সোপানে এসে দাঁড়াতেই একজন সকলের জুতো খুলে নিলো। হাশেম চৌধুরী সাহেবী ক্যাপ পরে গিয়েছিলেন, তার ক্যাপটাও নিয়ে রাখলো সে।

বনহুরের শরীরে ছিলো সাধারণ ড্রেস। শুধু স্যুট পরেছিলো, কোনো টুপী বা হ্যাট ছিলো না তার মাথায়। কাজেই কোনো অসুবিধা হলো না।

সমস্ত তাজমহলটা ঘুরেফিরে দেখতে লাগলো সবাই মিলে।

যদিও তারা আরও কয়েকবার এসেছে এখানে, তবু তাজমহল দেখার বাসনা তাদের প্রত্যেকের প্রবল রয়েছে। শ্বেত পাথরের তৈরি মমতাজের স্মৃতিসৌধ যেন নতুন হয়ে ফুটে উঠে তাদের চোখে।

সমস্ত তাজমহলটা দেখা শেষ করে পিছন দিকে যমুনার উপরে এসে দাঁড়ায় সবাই। বেলাশেষের অস্তগামী সূর্য তখন যমুনার নীল জলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ছোট ছোট পালতোলা নৌকাগুলো হাওয়ায় তর তর করে ভেসে চলেছে।

তন্ময় হয়ে এ দৃশ্য উপভোগ করছিলো মাসুমা আর মনিরা।

হাশেম চৌধুরী, স্বপন আর কল্পনা এগিয়ে গেছে ওদিকে আরও কিছুটা।

মনিরা রেলিং-এর উপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিলো।

মাসুমাও কখন যে সরে গেছে তার পাশ থেকে, কিছু খেয়াল করেনি মনিরা।

হঠাৎ একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করলো মনিরা নিজের হাতের উপর, সঙ্গে সঙ্গে চাপা মৃদু কণ্ঠস্বর–বান্ধবী, নিজেকে এমনভাবে আড়াল করে রাখলেও বেশিদিন আপনি আমার কাছ থেকে গোপন থাকতে পারবেন না।

মনিরা বোরখার আড়ালে মৃদু হাসলো, কোনো জবাব দিলো না। বনহুর দ্রুত সরে গেলো কিছুটা, তারপর সিগারেট কেসটা বের করে একটা সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করলো।

বনহুর যখন মনিরার পাশে গিয়ে ফিস ফিস করে কথাগুলো বলছিলো, তখন কেউ লক্ষ্য না। করলেও মাসুমা একটু আঁচ করে নিয়েছিলো। এবং চমকে উঠেছিলো সে। কারণ রঞ্জন বাবুর সঙ্গে মনিরার কোনো রকম পরিচয় বা ঘনিষ্ঠতা নেই। রঞ্জন বাবু মনিরাকে কি বললেন তবে?

মনিরার পাশে এলো মাসুমা, বললো–চ ফেরা যাক।

 মনিরা বললো হাঁ চল্ মাসুমা।

হাশেম চৌধুরী, কল্পনা আর স্বপনসহ বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেছেন। মিনারের পাশে দাঁড়িয়ে কিছু আলোচনা করছিলেন।

বনহুর মাসুমা আর মনিরা এসে দাঁড়ালো তাদের পাশে।

বললো বনহুর–মিঃ চৌধুরী, চলুন এবার।

বেড়ানো হলো তোমাদের? মাসুমাকে লক্ষ্য করে বললেন হাশেম চৌধুরী।

এবার কথা বললো মনিরা-রাত্রির ভয়ঙ্কর হঠাৎ হামলা দিয়ে বসতে পারে!

মাসুমা চমকে উঠলো, এতোক্ষণ তার মনেই ছিলো না এ কথাটা। বললো সে–সত্যি বলেছে মনি,

মনিরা সঙ্গে সঙ্গে খুব জোরে একটা চিমটি কাটলো মাসুমার গায়ে।

মাসুমা অমনি মুখটা বিকৃত করে বলে উঠলো–মানে আলেয়া যা বললো একেবারে সত্যি! তাই তো, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, হঠাৎ রাত্রির ভয়ঙ্কর হামলা করে বসতে পারে।

হাঁ, নির্ঘাৎ সত্যি, এভাবে বাইরে রাত্রি করা মোটেই উচিৎ হবে না। চলুন, এবার যাওয়া যাক। কথাটা বললো রঞ্জনবেশী দস্যু বনহুর।

মনিরা বোরখার অন্তরালে হাসলো!

গাড়ির পাশে যখন ওরা ফিরে এলো তখন বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে।

হাশেম চৌধুরী পুলিশগণকে আদেশ দিলেন তারা যেন সতর্কভাবে লক্ষ্য রেখে তাদের সঙ্গে চলে।

গাড়িতে বসে বললো মাসুমা–এতোগুলো পুলিশ রয়েছে, সাধ্য কি রাত্রির ভয়ঙ্কর আমাদের গাড়ির আশেপাশে আসে।

মনিরা মৃদুস্বরে বললো-রাত্রির ভয়ঙ্করের অসাধ্য কিছু নেই; হয়তো সে আমাদের গাড়িতেও থাকতে পারে।

বলো কি? বললো মাসুমা।

 হাঁ। মনিরা বললো আবার।

বনহুর ড্রাইভিং আসনে বসে সব শুনলো, তার মুখেও ফুটে উঠলো একটা হাসির রেখা।

হাশেম চৌধুরী বললেন–রাত্রির ভয়ঙ্করের সাধ্য কি আমার গাড়ির পাশে আসে।

 এবার অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলো বনহুর হাঃ হাঃ হাঃ….

আশ্চর্য হলো সবাই।

চমকে উঠলো মনিরা।

 হাশেম চৌধুরী অবাক কণ্ঠে বললো–ব্যাপার কি রঞ্জন বাবু?

 বনহুর হাসি বন্ধ করে বললো–অহেতুক আপনাদের আশঙ্কা দেখে আমার হাসি পেলো, তাই।

মাসুমা বললো–আপনি বীর পুরুষ কিনা, তাই আপনার কোনো দুশ্চিন্তা নেই।

 বনহুরের হাতে গাড়িখানা তখন উক্কাবেগে ছুটে চলেছে।

*

বনহুর সে রাতে বাসায় ফিরে বেশ উত্তেজনা বোধ করলো নিজের মনে। বোরখাধারিনী যে তার সব কিছুই জানে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এতো জেনেও সে তার কথা আজও কাউকে বলেনি। কেন। এমনকি পুলিশ সুপার তার আত্নীয়–তাকেও জানায়নি সে। নিশ্চয়ই কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে ঐ বোরখার নিচে।

অনেক রাত।

বনহুর পায়চারী করছে মেঝেতে।

 ললাটে তার চিন্তারেখা ফুটে উঠেছে।

বনহুর যখন কক্ষমধ্যে পায়চারী করছে তখন একটা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়ালো তার কক্ষের বাহিরে জানালার পাশে। বোরখায় আবৃত তার সমস্ত দেহ।

বোরখা আবৃত ছায়ামূর্তি অন্য কেহ নয়–মনিরা। সে গোপনে বেরিয়ে এসেছে বাংলো থেকে, সন্ধান নিতে স্বামীর। মনিরা বুকে সাহস সঞ্চয় করে নিয়েছে, দুর্গম পথে পা বাড়াতে এখন তার কোনো ভয় নেই।

মনিরা কোনোদিন দুঃসাহসিনী ছিলো না। ইদানিং তার হৃদয়ে এক অদ্ভুত সাহস দানা বেঁধে উঠেছে। সে স্বাভাবিক নারী বটে, কিন্তু তার স্বামী অস্বাভাবিক পুরুষ; কাজেই তাকেও হতে হবে অস্বাভাবিক নারী, না হলে স্বামীকে সে কোনোদিন জয় করতে পারবে না।

মনিরা সেদিন প্রথম স্বামীকে দেখার পর নিজেকে কিছুতেই সংযত রাখতে পারছিলো না। একটা অদ্ভুত আলোড়ন তাকে চঞ্চল করে তুলেছিলো। ইচ্ছা হচ্ছিলো তখনই ছুটে গিয়ে স্বামীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কিন্তু অনেক কষ্টে আত্মসংযত করে নিয়েছিলো মনিরা সেদিন। না, এতো সহজেই তাকে ধরা দেবে না সে। গোপনে সন্ধান নেবে এই সুদূর দিল্লী নগরীতে কি উদ্দেশ্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। মনিরা অশিক্ষিত নারী নয়, সে উচ্চশিক্ষিতা এতোটুকু ধৈর্য যদি সে না ধারণ করতে পারে তাহলে চলবে কি করে।

মনিরা তার দস্যুস্বামীকে এবার পরীক্ষা করে দেখবে। তাই সে দুঃসাহসে বুক বেঁধে এ পথে অগ্রসর হয়েছে।

বনহুর যখন কক্ষমধ্যে পায়চারী করছিলো তখন মনিরা তার কালো বোরখার মধ্য থেকে সব লক্ষ্য করছিলো। বনহুর প্রবেশ করলো ড্রেসিংরুমে। মনিরা তখন অতি সন্তর্পণে প্রবেশ করলো কক্ষে, বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। বালিশটা উঁচু করতেই নজরে পড়লো রিভলভারখানা। মনিরা দ্রুতহস্তে রিভলভারখানা তুলে নিলো হাতে।

তারপর আলমারীর আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো।

প্রতীক্ষা করছিলো ড্রেসিংরুম থেকে কখন বের হবে বনহুর।

কিছুক্ষণ পর বনহুর বেরিয়ে এলো ড্রেসিংরুম থেকে। সমস্ত দেহে জমকালো ড্রেস, মাথায় পাগড়ি। বনহুর এবার বিছানার পাশে এসে বালিশটা সরিয়ে ফেললো। বিস্ময়ে তার চোখ দুটো জ্বলে উঠলো যেন! বালিশটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো মেঝেতে।

অমনি নারীকণ্ঠে হাস্যধ্বনি হলো-হাঃ হাঃ হাঃ….

চমকে ফিরে তাকালো বনহুর।

বোরখাধারিনীর হস্তে উদ্যত রিভলভার লক্ষ্য করলো। চোখ দুটো বনহুরের আগুনের ভাটার মত জ্বলে উঠলো মুহর্তে। নারীকণ্ঠে প্রতিধ্বনি হলো–হ্যাণ্ডস আপ।

স্বামীকে নিয়ে মনিরা তামাসা করছে।

বনহুর জানে না এ বোরখাধারিনী কে। সে ধারণাও করতে পারে না, সুদূর কান্দাই থেকে মনিরা আসতে পারে এখানে। মনিরার কণ্ঠ যদিও তার পরিচিত কিন্তু এখন তার মনিরার কণ্ঠ সম্বন্ধে কোনোরকম কল্পনা করা সম্ভব নয়। কাজেই বনহুরের কাছে মনিরা সম্পূর্ণ অজ্ঞাত।

মনিরার অনুরোধেই হাশেম চৌধুরী তাদের দেশ কোথায় কাউকে জানাননি। যদিও তিনি এ ব্যাপারে আশ্চর্য হয়েছেন তবু স্ত্রীর বান্ধবীর অনুরোধ অমান্য করতে পারেননি। হাশেম চৌধুরীর দেশের সন্ধান তাই সর্বসাধারণের অজ্ঞাত রয়ে গেছে। এমনকি তার বাংলোর বয়-বাবুর্চি–এরাও জানে না হাশেম চৌধুরীর জন্মভূমির সন্ধান।

বনহুর ধীরে ধীরে হাত তুলে দাঁড়ালো।

রাগে গস গস করছে বনহুর, বোরখাধারিনীর দুঃসাহস দেখে অবাকও হয়েছে সে।

বললো বনহুর–বান্ধবী, কি চাও তুমি আমার কাছে?

মনিরা ক্রুদ্ধ কণ্ঠের ভান করে বললো তোমার দস্যুতার সমাপ্তি করতে চাই।

হাঃ হাঃ হা-অট্টহাসি হেসে উঠলো বনহুর, তারপর হাসি থামিয়ে বললো–বান্ধবী, তোমার ভয়ে আমি দস্যুতা ত্যাগ করতে রাজি নই। তোমার অনুরোধে আমি দস্যুতা পরিহার করতে রাজি আছি, যদি তুমি আমার কথায় রাজি হও।

বলো, কি বলতে চাও তুমি?

কে তুমি, তোমার আসল পরিচয় কি–জানতে চাই।

অসম্ভব! আমার পরিচয় আমি কাউকে জানাতে রাজি নই।

তাহলে আমিও তোমার কথা রাখতে পারবো না।

বনহুর কথার ফাঁকে অগ্রসর হচ্ছিলো ধীরে ধীরে, নিকটে পৌঁছে চট করে ওর হাতখানা ধরে ফেলবে–এই তার উদ্দেশ্য।

মনিরা স্বামীর উদ্দেশ্য বুঝতে পারে, তাই সে সতর্ক করে বলে উঠে–খবরদার, এক পা এগুলে আমি তোমাকে গুলী করবো। পিছু হঠতে লাগলো মনিরা।

বনহুর হঠাৎ বলে উঠলো–স্বপন ওকে ধরে ফেলো। ধরে ফেলো–

মনিরা জানে, এটা বনহুরের মিথ্যা উক্তি। হেসে উঠে মনিরা–স্বপন এখন গভীর নিদ্রায় অচেতন। বনহুর, তুমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাও….কথা শেষ করে মনিরা ঘরের বাইরে গিয়ে চট করে দরজা বন্ধ করে দেয়।

আটকা পড়ে যায় বনহুর।

মনিরা তখন অন্ধকারে অদৃশ্য হয়েছে।

 ফিরে আসে মনিরা বাংলোয়।

শয্যা গ্রহণ করে সে, মনে তার অফুরন্ত আনন্দ–দস্যু স্বামীকে সে ভীষণভাবে জব্দ করে দিয়েছে। মনিরা শোবার সময় সমস্ত দরজা-জানালা মজবুতভাবে বন্ধ করে শোয়। কারণ, বনহুর যে কোনোভাবে তার কক্ষে প্রবেশ করতে পারে, তাই সে সর্তকতা অবলম্বন করে।

আজকাল শহরে রাত্রির ভয়ঙ্করের উৎপাত অনেক কমে এসেছে বটে কিন্তু আশঙ্কা কমেনি এখনও। সদা ভয় আর দুর্ভাবনা নিয়ে কাটায় নগরবাসী।

সেদিন মাসুমা, মনিরা আর হাশেম চৌধুরী বাগানে বসে চা পান করছিলেন, এমন সময় ব্যস্তভাবে একজন পুলিশ এসে সেলুটু করে দাঁড়ালো, তারপর বললো–স্যার, এক ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। জরুরি দরকার আছে।

হাশেম চৌধুরী বললেন–মাসুমা, তোমরা ভিতরে যাও, ওকে এখানেই ডাকি।

মাসুমা আর মনিরা উঠে দাঁড়ালো, কারণ তাদের চা পান শেষ হয়ে গিয়েছিলো।

ওরা চলে যেতেই হাশেম চৌধুরী পুলিশকে বললো–যাও তাকে এখানে নিয়ে এসো।

পুলিশটা চলে গেলো।

অল্পক্ষণ পর ফিরে এলো সঙ্গে এক মাড়োয়ারী ভদ্রলোক। মুখমণ্ডল তার ভয়ে বিবর্ণ, দুরু দুরু বক্ষে এসে আদাব জানালো।

হাশেম চৌধুরী বললেন–বসুন।

মাড়োয়ারী ভদ্রলোক আসন গ্রহণ করে প্রায় কেঁদেই ফেললেন।

হাশেম চৌধুরী বললেন–বলুন কি বলতে চান?

ভদ্রলোক পকেট থেকে একটা ভাঁজ-করা কাগজ বের করে হাশেম চৌধুরীর হাতে দিলেন।

হাশেম চৌধুরী কাগজখানা হাতে নিয়ে খুলে ফেললেন, তারপর পড়লেন–ভানুসিং, আজ রাত্রে চার ঘটিকায় আমি আসবো। এক শত ভরি সোনা আমার জন্য মজুত রাখবে। ঠিক্ তোমার শয়নকক্ষে দেখা করবো।

চিঠিখানা বার দুই পড়ে নিয়ে পকেটে রাখলেন পুলিশ সুপার হাশেম চৌধুরী। বললেন তিনি রাত্রির ভয়ঙ্কর হঠাৎ আপনার কাছে সোনা চেয়ে বসবে–এর কারণ কি?

হাভী কুছু সমঝতা নেহি বাবুজি। তব হামারা সোনা কি দোকান ন্যায়, উছিসে ডাকু হামারা পাশ সোনা কি জলুম কিয়া।

হাঁ ঠিক বলেছেন, তা আপনি কি রাজি আছেন এতে?

নেহি বাবুজী। হাম মর যায়েগা একশো ভরি সোনে হাম কাহাছে দেগা বাবুজী!

আচ্ছা, আপনি এক কাজ করুন। এক শো ভরি সোনা দেবার জন্য স্বীকার হয়ে যান এবং আপনার কক্ষে সেভাবে তৈরি থাকবেন।

ইয়া আল্ কেইছে বাৎ কহিতেছেন বাবুজী? হাম একশো ভরি সোনে দিবে তব কেইছে বাঁচেগা–

আপনাকে বাঁচানোর জন্যই তো এতো করছি। আপনি ঠিভাবে তৈরি থাকবেন কিন্তু সোনা আপনার খোয়া যাবে না।

বাবুজি!

হাঁ, আপনার কক্ষের আশেপাশে গোপনে লুকিয়ে থাকবে আমার পুলিশ ফোর্স।

হাঃ হাঃ হাঃ সশস্ত্র পুলিশ ফোর্স…ব্যাপার কি মিঃ চৌধুরী? কথাটা বলতে বলতে এগিয়ে এলো রঞ্জন।

আরে রঞ্জনবাবু যে, আসুন আসুন…

রঞ্জনবেশী দস্য বনহুর আসন গ্রহণ করলো।

 বললেন হাশেম চৌধুরী–শুনুন, আজ আবার নতুন খবর।

নতুন খবর?

হাঁ, এই দেখুন…হাশেম চৌধুরী প্যান্টের পকেট থেকে চিঠিখানা বের করে রঞ্জনবাবুর হাতে দিলেন–পড়ে দেখুন আপনি।

বনহুর চিঠিখানা মনোযোগ সহকারে পড়ে নিয়ে বললো–আশ্চর্য, রাত্রির ভয়ঙ্করের চিঠি এটা!

 এবার বুঝতে পারছেন কেন সশস্ত্র পুলিশের প্রয়োজন।

 হাঁ, এবার সব বুঝতে পারলাম। চিঠিখানা ফেরৎ দিলো রঞ্জন।

হাশেম চৌধুরী চিঠিখানা পকেটে ভাঁজ করে রেখে বললেন–এবার বলুন রঞ্জনবাবু, কিভাবে রাত্রির ভয়ঙ্করের কবল থেকে বেচারীকে বাঁচানো যায়!

আবার হাসলো বনহুর–অসংখ্য পুলিশ ফোর্স থাকতে দুশ্চিন্তার কারণ নেই মিঃ চৌধুরী।

তা অবশ্য ঠিক্ বলেছেন। শুধু পুলিশ ফোর্সই থাকবে না রঞ্জন বাবু, আমি নিজেও থাকবো। আর আপনি যদি আমাকে সাহায্য করেন!

এটুকুরই প্রতীক্ষা করছিলো বনহুর, তবু বললো সে–আমি আপনাকে কি সাহায্য করতে পারি?

আপনি যা পারেন অনেকেই তা পারে না রঞ্জন বাবু। আপনার পিয়ানোর সুর রাত্রির ভয়ঙ্করের কবল থেকে রক্ষা করতে পারে।

বেশ, তাহলে তাই হবে।

 সত্যি রাজি আছেন আপনি, ঐ দিন থাকবেন আমার সঙ্গে?

আপনার অনুরোধ না রেখে পারি!

এরা যখন বাগানে বসে রাত্রির ভয়ঙ্কর সম্বন্ধে নানারকম আলোচনা করছিলো তখন মনিরা ও মাসুমা ওপাশে আড়ালে বসে সব কথাবার্তাই শুনছিলো।

মুহূর্তে মুহূর্তে মনিরার মুখোভাবে পরিবর্তন আসছিলো।

যখন হাশেম চৌধুরী আর মাড়োয়ারী ভদ্রলোক রাত্রির ভয়ঙ্করের চিঠির ব্যাপার নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছিলো তখন মনিরা আঁচ করে নিয়েছিলো সমস্ত ঘটনাটা। রাত্রির ভয়ঙ্কর যে তারই প্রিয়তম তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তারপর যখন স্বয়ং রঞ্জন বাবু এসে উপস্থিত হলো তখন তার চোখেমুখে হঠাৎ একটা পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছিলো।

মাসুমা লক্ষ্য করেছিলো মনিরার মুখোভাব। রঞ্জন বাবুর আগমনে মনিরার চোখ দুটো যেন উজ্জ্বল দীপ্ত হয়ে উঠলো। ভাবে মাসুমা, তবে কি তার বান্ধবীর মনে রঞ্জন বাবু রেখাপাত করেছে। পরপর কয়েকটা ঘটনা মনে পড়ে তার। প্রথম পিয়ানোর সুর মনিরার অন্তরকে বিমুগ্ধ করে ফেলেছিলো। সেদিন মনিরার মধ্যে লক্ষ্য করেছিলো মাসুমা অদ্ভুত এক অস্বাভাবিকতা। তারপর আরও কয়েকদিন মাসুমা মনিরার মধ্যে দেখতে পেয়েছে ঐ রকম তন্দ্রাচ্ছন্নভাব। রঞ্জন বাবু সুন্দর সুপুরুষ, তাই বলে মনিরা…না না, এ কি করে সম্ভব হবে, মনিরা যে বিবাহিতা। শুধু তাই নয়–তার স্বামী আছে, সন্তান আছে।

মনে পড়ে মাসুমার সেদিনের কথা–আগ্রায় যেদিন তারা তাজমহল দেখতে গিয়েছিলো। সকলের অলক্ষ্যে রঞ্জন বাবু মনিরার পাশে দাঁড়িয়ে কিছু যেন চাপা স্বরে বলেছিলো স্পষ্ট স্মরণ আছে তার। আজও মাসুমা মনিরার মুখোভাব তীক্ষ্ণভাবে খেয়াল করছিলো। রঞ্জনবাবুর কণ্ঠস্বর তার অন্তরে যেন সুধা বর্ষণ করে চলেছে।

মাসুমা বললো হঠাৎ মনিরা, একটা কথা বলবো, সঠিক জবাব দিবি?

মনিরা তখন তন্ময় হয়ে হাশেম চৌধুরী আর রঞ্জন বাবুর কথাবার্তা শুনছিলো। মাসুমার প্রশ্নে সজাগ হয়ে সোজা হয়ে বসলো, বললো সে–নিশ্চয়ই দেবো।

আচ্ছা মনিরা, রঞ্জনবাবুকে তোর কেমন লাগে?

 অনেক ভাল।

 তাকে না তার পিয়ানোর সুর?

মাসুমা, তুই আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিস রঞ্জনবাবুকে আমার কেমন লাগে, তার পিয়ানোর সুর নয়।

হাঁ।

কোন্ টা?

 রঞ্জনবাবু না তার পিয়ানোর সুর?

হাঁ, দুটোই আমার খুব ভাল লাগে!

 মনিরা!

 জানি এ আমার অন্যায়, তবুও…

মাসুমা গম্ভীর হয়, কোনো কথা বলে না।

 মনিরা বলে–চল ভিতরে যাই।

চল্। উঠে দাঁড়ায় মাসুমা।

*

এতো সতর্ক পাহারা থাকা সত্ত্বেও সেদিন মাড়োয়ারীর বাড়িতে রাত্রির ভয়ঙ্কর হানা দিয়ে একশত ভরি সোনা হরণ করে নিয়ে গেছে। পুলিশ সুপার স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন, ছিলো রঞ্জনবাবু আর ছিলো অগণিত পুলিশ ফোর্স।

গভীর রাতে এতো কড়া পাহারার মধ্যেও জমকালো পোশাক পরা রাত্রির ভয়ঙ্কর গুলীভরা রিভলভার নিয়ে হানা দেয়।

এতোগুলো পুলিশ বাহিনীর চোখে ধূলো দিয়ে গভীর রাতে একেবারে মাড়োয়ারী ভদ্রলোকের শোবার কক্ষে হাজির হয় রাত্রির ভয়ঙ্কর।

একশত ভরি সোনা অবশ্য ছিলো না, তবু প্রায় সত্তর ভরি সোনা ছিলো আর ছিলো পঞ্চাশ হাজার টাকা। সব লুটে নিয়েছে রাত্রির ভয়ঙ্কর।

পাশের কামরাতেই ছিলেন পুলিশ সুপার আর রঞ্জনবাবু।

জেগেই ছিলো তারা, মাঝে মাঝে চা পান করছিলো। এক সময় চা পান করে হাশেম চৌধুরী ঝিমিয়ে পড়লেন, কেমন যেন তার দু’চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসতে লাগলো। কিছুতেই জেগে থাকতে পারলেন না। এক সময় সোফার উপর ঢলে পড়লেন তিনি।

ভোর বেলা জেগে উঠলে হাশেম চৌধুরী মাড়োয়ারী ভদ্রলোকের আকুল আর্তনাদে–বাবুজী হাম্ খতম্ হুগিয়ে। ডাকু হামারা সব লুট লেগিয়ে। বাবুজী …বাবুজী…

ধড়মড় করে জেগে সোজা হয়ে বসলেন হাশেম চৌধুরী, বিস্ময়ে হতবাক হলেন, কখন সে এভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলো বুঝতেই পারেনি।

ভালো করে তাকিয়ে দেখলো পাশের সোফায় রঞ্জনবাবু দিব্য আরামে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে।

হাশেম চৌধুরী–তাকে ধাক্কা দিয়ে জাগালেন –রঞ্জনবাবু, রঞ্জনবাবু, সর্বনাশ হয়ে গেছে।

জেগে উঠে রঞ্জনবাবু, কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছিলো।

 বললো হাশেম চৌধুরী–আমাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে রঞ্জনবাবু।

হ্যাঁ বলেন কি! ডাকু এসেছিলো তাহলে?

হাঁ বাবুজী, ডাকু মেরা সব কুছ লেগিয়ে ..মাড়োয়ারী ভদ্রলোক হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন।

রঞ্জনবাবু ব্যস্ত হয়ে পড়লো, দুঃখিতভাবে বললো-হায়, কখন এমনভাবে আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম?

বললো হাশেম চৌধুরী–আমিও ঠিক তাই ভাবছি। ঠিক আমাদের চায়ে কিছু মেশানো হয়েছিলো, না হলে এমনভাবে আমরা দুজনা ঘুমিয়ে পড়তাম না।

হাশেম চৌধুরী তক্ষুণি পুলিশদের আদেশ করলেন–রাতে যারা চা তৈরি করেছিলো সেই সব বয় আর রান্নার বামুন ঠাকুরদের গ্রেফতার করো।

আদেশের সঙ্গে সঙ্গে মাড়োয়ারী বয় আর বামুন ঠাকুর যে রাতে চা তৈরি করেছিলো তাকে গ্রেফতার করা হলো।

অনেক কান্নাকাটি করা সত্ত্বেও হাশেম চৌধুরীর কড়া আদেশ শিথিল হলো না।

শহরে এ-ব্যাপার নিয়ে বেশ তোলপাড় শুরু হলো। স্বয়ং পুলিশ সুপার এবং অগণিত পুলিশ ফোর্স সতর্ক পাহারারত থাকা সত্তেও মাড়োয়ারী বাড়ি রাত্রির ভয়ঙ্কর হানা দিয়ে বহু সোনা ও অর্থ হরণ করে নিয়ে গেছে।

পুলিশ রাত্রির ভয়ঙ্করের কিছু করতে পারেনি।

কথাটা হাশেম চৌধুরীর মনে খুব করে লাগলো। এবার সে রাত্রির ভয়ঙ্করকে গ্রেফতারে কঠিন শপথ গ্রহণ করলেন। যেমন করে হোক তাকে গ্রেফতার করতেই হবে।

*

পরদিন বাংলোর ড্রইংরুমে বসে এসব ব্যাপার নিয়েই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছিলো। এতো সাবধানতা অবলম্বন করেও রাত্রির ভয়ঙ্করের কবল থেকে মাড়োয়ারী ভদ্রলোককে রক্ষা করতে পারেননি বলে আফসোস করছিলেন হাশেম চৌধুরী।

বললেন তিনি রঞ্জনবাবু, রাত্রির ভয়ঙ্করকে গ্রেফতার না করে আমি স্বস্তি পাবো না। শয়তান অত্যন্ত চতুর। সে জানতো–আমি এবং আপনি মাড়োয়ারী বাড়ি রয়েছি, তাই কৌশলে বামুন ঠাকুর আর বয়কে হাত করে নিয়ে আমাদের চায়ের সঙ্গে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছিলো।

ঐ রকম আমারও মনে হয় মিঃ চৌধুরী। না হলে ওভাবে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি একটুও খেয়াল নেই।

এবার আমিও দেখে নেবো রাত্রির ভয়ঙ্কর কত চালাক।

নতুন কোনো কৌশল মাথায় এসেছে নাকি?

আসেনি, তবে নতুনভাবেই তাকে ফাঁদে ফেলবো।

হাঁ, সেই ভাল হবে। রাত্রির ভয়ঙ্করকে গ্রেফতার করে দক্ষ পুলিশ সুপার নামটা কিনে নেবেন– তাহলে এবার?

দেখি কতদূর পারি। বললেন হাশেম চৌধুরী।

*

রাতে স্বামীকে খেতে দিয়ে বললো মাসুমা–খুবতো বড় বড় কথা বলেছিলে, কই পারলে রাত্রির ভয়ঙ্করকে গ্রেফতার করতে?

খেতে খেতে জবাব দিলেন হাশেম চৌধুরী–একবার পারিনি বলে হতাশ হবার লোক হাশেম চৌধুরী নয়, রাত্রির ভয়ঙ্করের চেয়েও ভয়ঙ্কর আমি।

হেসে উঠলো মাসুমা সেতো দেখতেই পাচ্ছি। দুইবন্ধু মিলে গিয়েছিলে, খুব বড় বড় কথা বলেছিলে। রাত্রির ভয়ঙ্করের হাত থেকে বেঁচে ফিরে এসেছে –এইতো বড় কথা।

মাসুমা, হাশেম চৌধুরীকে আজও চেনো না। বাছাধন যাবে কোথা? এবার সঙ্গী-সাথী কেউ নয়, আমি একাই দেখবো রাত্রির ভয়ঙ্কর কেমন!

এ ঘরে যখন স্বামী-স্ত্রী রাত্রির ভয়ঙ্কর নিয়ে আলাপ, আলোচনা চলছিলো তখন পাশের ঘরে মনিরা ছিলো। অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছিলো সে। হাশেম চৌধুরী যে গত রাতে মাড়োয়ারী বাড়ি পুলিশ ফোর্সসহ রাত্রির ভয়ঙ্কর গ্রেফতারে গিয়েছিলো–জানে মনিরা। সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে, তাও জানে সে।

হাশেম চৌধুরী এবার বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। যেমন করে হোক রাত্রির ভয়ঙ্করকে শায়েস্তা না করে ছাড়বেন না। মনিরা একটু আশঙ্কিত হয়। যদিও সে জানে, তার স্বামীই রাত্রির ভয়ঙ্কর আরও জানে, তাকে গ্রেফতার করা বা শায়েস্তা করা কারো সাধ্য নয় তবু বিচলিত হয় মনিরা অন্তরে অন্তরে।

কখন কোথায় কে রাত্রির ভয়ঙ্কর সম্বন্ধে আলাপ করছে সেদিকে থাকে তার সতর্ক দৃষ্টি।

মনিরা প্রাণ দেবে তবু স্বামীর অমঙ্গল হতে দেবে না– এটাই তার কামনা।

হাশেম চৌধুরী পুলিশ বাহিনী নিয়ে রাত্রির ভয়ঙ্কর গ্রেফতারে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

আশঙ্কিত হলো মনিরা।

বনহুর তখন তার লুণ্ঠিত অর্থ আর সোনা-দানা আনন্দোদ্দীপ্ত মনে বিলিয়ে দিয়ে চলেছে। কোথায় কার ঘরে খাবার নেই।

কোথায় কে অসুখে ধুকে মরছে, কোথায় কার ঘরে বয়স্ক মেয়ে অর্থের অভাবে বিয়ে দিতে পারছে না। বনহুর প্রত্যেকের ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের অভাব পূরণ করে চলেছে।

সেদিন বনহুর তার অদ্ভুত ড্রেসে সজ্জিত হয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।

রাত তখন গভীর।

একটা ছায়ামূর্তি তার অলক্ষ্যে গাড়ির পিছন আসনের নিচে লুকিয়ে পড়েছিলো।

বনহুরের গাড়ি যখন ছুটে চলেছে তখন ছায়ামূর্তি অন্ধকারে নিশ্চুপ বসে ছিলো।

গাড়ি দিল্লীর অদূরে নিকৃষ্ট পল্লী অভিমুখে চলেছে। পথ নির্জন এবং অপরিসর মেঠোপথ। দু ধারে শাল আর পাইন গাছ।

আরও কত নাম-না-জানা গাছও রয়েছে। এ পথে কোনো লাইট-পোষ্ট নেই, গাড়ির আলোতে পথ দেখে গাড়ি চালাচ্ছিলো বনহুর।

পিছন আসনের ছায়ামূর্তি বোরখাধারিনী মনিরা। সে আজ-কাল প্রতি রাতেই স্বামীকে ফলো করে থাকে। অত্যন্ত সাবধানে গোপনে লুকিয়ে থাকে সে। বনহুর অতো সতর্ক থাকা সত্তেও মনিরার চাতুরির কাছে পরাজিত হয়েছে।

বনহুরের গাড়ি গিয়ে থামলো একটা পল্লী অঞ্চলে। ঘন বনানী ঢাকা ছোট ছোট ঘরের চালা ঘরগুলো যেন সুপ্তির কোলে ঢলে পড়েছে। দিল্লী নগরীর বাইরে এমন নির্জন পল্লী আছে–ভাবাও কঠিন।

বনহুরের গাড়ি থামতেই কতগুলো হাড়-জিরজিরে নারী-পুরুষ এসে তার গাড়ির চারপাশে ঘিরে দাঁড়ালো।

এতো রাতেও এরা জেগে ছিলো।

বনহুরের গাড়ির হর্ণ শোনামাত্র সবাই বিপুল উৎসাহ নিয়ে ছুটে এসেছে। তারা যেন জানতো আসবে বনহুর।

মনিরা অন্ধকারে আত্মগোপন করে দেখছে স্বামীর কাণ্ডকলাপ।

তার স্বামী যে দস্যু এ কথা সে জানে কিন্তু তার কার্যকলাপ তো কোনোদিন দেখেনি। অবাক হয়ে দেখে মনিরা।

গাড়ির দু’পাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে অগণিত নারী-পুরুষ। কারো দেহে বস্ত্র আছে কিনা ঠিক বোঝা যায় না–সামান্য একখণ্ড ন্যাকড়ায় ওরা কোনোরকমে লজ্জা নিবারণ করছে। কারো কারো হস্তে লণ্ঠন ছিলো, লণ্ঠনের আলোতে অস্পষ্ট প্রেত আত্মার মতই লাগছিলো ওদের।

দু হাত প্রসারিত করে দিয়েছে সবাই গাড়ির দিকে।

বনহুর একটা থলির মধ্য থেকে টাকা-পয়সা আর সোনার টুকরা ওদের হাতে মুঠি মুঠি তুলে দিচ্ছে। সে কি অদ্ভুত অপূর্ব দৃশ্য!

বনহুরের মুখমণ্ডল দীপ্ত উজ্জল। স্বল্প আলোতে তাকে দেব পুরুষের মত লাগছে। সেকি জ্যোতির্ময় চেহারা! স্বামীর কার্যকলাপ লক্ষ্য করে মনিরার দু চোখে আনন্দ অশ্রু ঝরে পড়ে।

ফিরে আসে বনহুর তার দীন-হীন অসহায় বন্ধুদের কাছ থেকে।

.

বনহুর গাড়ি রেখে চলে যায় ভিতরে।

মনিরা তখন ফিরে যায় বাংলোয়।

আকাশে অসংখ্য তারার মেলা। বাংলোর গেটে রাইফেলধারী পুলিশ টুলেন উপর বসে বসে ঝিমুচ্ছে।

সমস্ত দিল্লী নগরী গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।

 মনিরা নিজ কক্ষের পিছন দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো।

 পাশের কামরায় তখন হাশেম চৌধুরী আর মাসুমা গাঢ় নিদ্রায় অচেতন।

*

সারাটা দিন শহরময় সাপের খেলা দেখিয়ে বেড়ায় কেশব আর নূরী। কোনোদিন বা নূরী নাচ দেখায়, কেশব মাদল বাজায় তার সঙ্গে।

নূরী জংলী মেয়ে।

জঙ্গলে তার জন্ম। নূরীর তাই এ-সবে কোনো লজ্জা বা সংকোচ নেই। ঘাগড়া পরা, গায়ে আঁট সাট ব্লাউজ, একটা ওড়না জড়িয়ে থাকে সে গলায় আর বুকে। মাথার চুলগুলো ওর চিরকালই খাটো আর কোকড়ানো। ডাগর ডাগর হরিণ আঁখির মত দু’টিচোখ।

নূরী যখন নাচ দেখায় তখন অগণিত জনতা চারপাশে ভীড় জমিয়ে ফেলে। তারিফ করে নূরীর নাচের; পয়সাও হয়–ওদের দুজনার খাওয়া-পরা চলে যায় কোনো রকমে।

সারাদিন পর ফিরে যায় তাদের ছোট্ট কুঠিরে।

নূরী রান্না করে, আর কেশব বসে থাকে তার পাশে। বন থেকে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করে এনে দেয় সে নূরীকে।

রান্না শেষ হলে দুজনে বসে খায়।

 নূরী শয়ন করে কুঠিরের মধ্যে আর কেশব থাকে কুঠিরের দাওয়ায়।

ওরা যে পল্লীতে বাস করে ওটা সাপুড়েদের আবাসভূমি।

 নূরীদের কুঠিরের আশে-পাশে বেশ কয়েকটা কুঠির আছে। আর আছে বেশ কিছু তাঁবু।

সাপুড়েদের দলপতি হীরালা বয়স্ক হলেও অত্যন্ত দুঃসাহসী। তার মনে যেমন সাহস, দেহে তেমনি অসীম বল। সমস্ত সাপুড়ে দল তাকে ভয় করে–সমীহ করে।

হীরালাল ভালোবাসতো কেশব আর নূরীকে। সে-ই আশ্রয় দিয়েছিলো ওদের দু’জনকে। নূরী হীরালালকে বাবা বলে ডাকতো, কেশবও তাই। হীরালালও ওদের পুত্র-কন্যার মতই স্নেহ করতো।

হীরালাল কেশব আর নূরীকে ভালবাসে–এটা সহ্য হতো না হীরালালের ভ্রাতুস্পুত্র রংলালের। সে কিছুতেই কেশবকে বরদাস্ত করতে পারতো না। রংলালের লোভ ছিলো নূরীর উপর। নূরীকে সে হাতের মুঠোয় পাবার জন্য নানা রকম উপায় খুঁজে ফিরতো।

অনেকদিন কেশবের অজ্ঞাতে সে ওর কাছে প্রেম নিবেদন করেছে, কিন্তু সর্বতোভাবে বিমুখ হয়েছে সে। নূরীকে সে কিছুতেই বশে আনতে সক্ষম হয়নি।

একদিন রাতে নূরী শুয়ে আছে নিজের কুঠিরের মধ্যে। ঘুমিয়ে পড়েছে সে।

বারান্দায় শুয়েছে কেশব।

সারাটা দিন ওরা সাপ খেলা দেখিয়ে আর নাচ দেখিয়ে পয়সা রোজগার করেছে; তারপর ক্লান্ত অবশ দেহ নিয়ে অল্পক্ষণেই ঘুমিয়ে পড়েছে ওরা।

হঠাৎ নূরীর ঘুম ভেঙে যায়–অন্ধকারে কে যেন তার মুখ টিপে ধরেছে।

নূরী চিৎকার করতে যায়, কিন্তু একখানা বলিষ্ঠ হাত তার কণ্ঠ রোধ করে দেয়।

 ধস্তাধস্তি শুরু হয়।

বাইরে ঘুম ভেঙে যায় কেশবের। ধড়ফড় উঠে কুঠিরে প্রবেশ করে, ম্যাচ জ্বালে কেশব। সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটো তার বিস্ময়ে চক চক্ করে উঠে।

কেশবকে দেখেই নূরীকে ছেড়ে দেয় রংলাল।

কিন্তু কেশবের মাথায় রক্ত তখন গরম হয়ে উঠেছে। ঝাঁপিয়ে পড়ে সে রংলালের উপর। শুরু হয় আবার ধস্তাধস্তি।

নূরী আর্ত চিৎকার করে উঠে–বাবা,বাবা, বাঁচাও, বাঁচাও…

সাপুড়ে সর্দার হীরালালের নিদ্রা ছুটে যায়, সে সূতীক্ষ্ণ ছোরা হস্তে ছুটে আসে নূরীর কুঠিরে। রংলাল আর কেশবকে কুঠিরের মেঝেতে ধস্তাধস্তি করতে দেখে থমকে দাঁড়ায়।

নূরী তখন এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

হীরালালকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে তার বুকে মাথা রাখে –বাবা, রংলাল আমাকে পাকড়াও করেছিলো। কেশব আমাকে বাঁচিয়ে নিয়েছে।

হীরালালের চোখ দুটো আগুনের গোলার মত জ্বলে উঠে।

কঠিন কণ্ঠে বলে–রংলাল খবরদার!

বাধ্য হয় রংলাল কেশবকে ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াতে। হিংস্র জন্তুর মত ফোঁস ফোঁস করতে থাকে সে।

হীরালাল হাতের সূতীক্ষ্ণ-ধার ছোরাখানা উদ্যত করে বলে–ফের যদি ফুল মাইয়ার গায়ে হাত দিবি তাহলে তোকে খতম করিয়া দিবো। বেরিয়ে যা, আমাদের আস্তানায় আর তোর জায়গা হবি না।

রংলাল রক্তচক্ষু বিস্ফারিত করে তাকালো হীরালাল, কেশব আর নূরীর দিকে, তারপর দ্রুত কক্ষ ত্যাগ করে চলে গেলো।

হীরালাল ওর চলে-যাওয়া পথের দিকে খানিকটা থুথু নিক্ষেপ করে বললো–যা চলে যা….

এবার কেশব আর নূরীকে লক্ষ্য করে বললো হীরালাল-তোরা নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে যা। বদমাস আর আসবি না।

হীরালাল তার ছোরাখানা কোমরের ফাঁকে খুঁজে রেখে বেরিয়ে যায়।

নূরীর চোখে ঘুম আর আসে না, তার মনের আকাশে তখন চিন্তার জাল ছড়িয়ে পড়ে। কোথায় তার হুর, এতোবড় শহরের বুকে আর কত তাকে খুঁজে ফিরবে! দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে, কত জায়গাতেই না নূরী আর কেশব ঘুরে ফিরেছে–সাপ খেলা দেখিয়েছে। নাচ দেখিয়ে পয়সা উপার্জন করেছে: কিন্ত নজর তার সব সময় অম্বেষণ করে ফিরেছে প্রতিটি লোকের মুখে মুখে, খুঁজেছে তার বনহুরকে।

কত আশা নিয়েই না রোজ বের হয় ওরা, ভাবে আজ নিশ্চয়ই তার সন্ধান পাবে। যে বেশেই। থাক নূরীর চোখে ধুলো দিতে পারবে না সে। শহরের প্রতিটি রাস্তায় বাড়ি বাড়ি সাপ খেলা দেখিয়েছে। প্রতিটি দোকানে দোকান, হোটেলে হোটেলে, ক্লাবে–সব জায়গায় ফিরেছে; কিন্তু তার দেখা পায়নি। তবে কি বনহুর আবার ফিরে গেছে তার আস্তানায়! নূরী শুয়ে শুয়ে ভাবে এসব। তারপর এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।

*

কেশবও ঘুমিয়ে পড়েছে।

রংলাল চলে যায় তাদের আস্তানা ছেড়ে। আর ফিরে আসার সাহস তার হয় না। কিন্ত চলে গেলেও রাগ তার কমে না একটুও।

বরং নূরীকে হস্তগত করার জন্য সে উন্মত্ত হয়ে উঠে। গোপনে সে কৌশল অবলম্বন করে–কেমন করে প্রতিশোধ নেবে হীরালালের উপর, কেমন করে কেশবকে পথ থেকে সরাবে, কেমন করে নূরীকে করবে আত্মসাৎ।

রংলাল ক্ষিপ্তের ন্যায় অস্থির হয়ে পড়েছে। সে বিষাক্ত সর্প জোগাড় করেছে, সে সর্প দিয়ে হত্যা করবে কেশবকে, হত্যা করবে রংলালকে। সূতীক্ষ্ণ ছোরা সংগ্রহ করেছে; বাধা দিতে আসবে যে, তাকে খতম করবে।

সাপুড়ে রংলাল ভীষণ রুদ্রমূর্তি ধারণ করলো। আস্তানা থেকে বাইরে যেয়ে সে নানাভাবে বুদ্ধি। আটতে লাগলো কিভাবে সে ওদের সর্বনাশ করবে।

কেশব আর নূরী প্রতিদিনের মত সেদিনও সাপ খেলা দেখাতে বের হয়। আজ আবার নূরী ও কেশব যায় পুলিশ সুপারের বাংলোয়।

নূরী আর কেশবকে দেখে খুশিতে আত্মহারা হলো মাসুমা আর মনিরা।

 হাশেম চৌধুরীও আনন্দিত হলো ওদের দেখে, হেসে বললো কিরে, তোরা এতোদিন পর এলি?

কেশব বললো–বাবুজী, আমরা বহু দূরে থাকি। এক একদিন এক একদিকে চলে যাই। এদিকে এলে তবে তো আসবো!

বেশ, এসেছিস যখন সাপ খেলা দেখা।

 হাঁ বাবুজী, দেখাচ্ছি। বললো কেশব।

ওরা দুজনে মিলে সাপ বের করলো।

বাঁশি বাজাতে লাগলো কেশব। নুরী সাপ খেলা করতে লাগলো।

 দাঁতভাঙ্গা বিষধর সাপ, তাই নূরী আর কেশব সহজেই ওদের বশে আনতে পারতো।

নূরী বাঁশির সুরে সুরে মিলিয়ে গান গায়।

 মনিরা আর মাসুমা মুগ্ধ হয়ে যায়।

 হাশেম চৌধুরীও বিমুগ্ধ হয়। এমন সুমধুর সুর জীবনে বুঝি শোনেনি তারা।

খেলা শেষ হলে হাশেম চৌধুরী দশ টাকার একখানা নোট দেন কেশবের হাতে।

মনিরা আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলো; সে নিজের কণ্ঠ থেকে খুলে দেয় চেন মালাটা, যে মালার লকেটে আছে তার আর বনহুরের ছোট্ট বেলার ফটো দুটো।

এ মালা মনিরা সব সময় গলায় পরে থাকতো। বিশেষ করে বনহুরের সঙ্গে তার মিলন হবার পর থেকে কোনোদিন এ মালা সে গলা থেকে খোলেনি।

আনন্দের আতিশয্যেই মালাটা মনিরা তুলে দেয় নূরীর হাতে! নূরী খুশি হয়ে গলায় পরে সেটা।

 কিন্তু পরক্ষণেই মনিরা নিজের ভুল বুঝতে পারে। নূরী তখন মালাটা গলায় পরে নিয়েছে, খুশিতে চোখ দুটো তার দীপ্ত উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

মনিরা মালাটা আর ফিরিয়ে নিতে পারে না।

নূরী আর কেশব খুশি হয়ে চলে যায়।

ঠিক সে সময় বাংলোর গেটে বনহুরের গাড়ি এসে থামলো। কল্পনা ও স্বপনকে নিয়েই এসেছে সে।

মাসুমা বললো–রঞ্জন বাবু এসেছেন।

 মনিরা আর মুহূর্ত বিলম্ব না করে বাগানবাড়ি থেকে উঠে গেলো ভিতরে।

মাসুমা আর হাশেম চৌধুরী এগিয়ে গেলো।

 বনহুর, স্বপন আর কল্পনা গাড়ি থেকে নেমে বাগানের দিকে অগ্রসর হলো।

হাশেম চৌধুরী বললো–হ্যালো রঞ্জন বাবু।

বনহুর এগিয়ে এসে করমর্দন করলো পুলিশ সুপারের, তারপর হেসে বললো–কেমন আছেন ভাবী?

বনহুর মাসুমাকে ভাবী বলে ডাকতো।

 কল্পনা আর স্বপন ডাকতো বৌদি বলে।

বনহুরের কথায় বললো মাসুমা–খুব ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন রঞ্জন বাবু?

আসন গ্রহণ করতে করতে বললো বনহুর–রাত্রির ভয়ঙ্করের ভয়ে সব সময় আতঙ্কিত।

মাসুমা বললো–তাতো হবেই, যাদের প্রচুর অর্থ-ঐশ্বর্য তাদের আতঙ্কিত হবার কথাই যে। তা যাই বলুন–আজ পিয়ানো শোনাতে হবে। রঞ্জন বাবু, শুধু আপনার হাতে পিয়ানো শুনব বলেই আমি পিয়ানো কিনেছি।

বনহুরের মুখে একটা হাসির আভাস ফুটে উঠলো, বললো–আমার মত ভাগ্যবান কে আছে বলুন। পুলিশ সুপার-স্ত্রী আমার পিয়ানোভক্ত।

শুধু আমিই আপনার পিয়ানোভক্ত নই রঞ্জন বাবু। আমার বান্ধবী আলেয়া আপনার পিয়ানোর সুরে আত্মহারা।

মৃদু হেসে বলে বনহুর–তাই নাকি!

হাঁ, শুধু আত্নহারাই নয় রঞ্জন বাবু। একেবারে সম্বিৎহারা…কথাটা বলে হাসেন হাশেম চৌধুরী।

 মাসুমা বলে রঞ্জন বাবু, আপনি আলেয়াকে জানেন না, বড় হাসি-খুশি আর আনন্দ প্রিয়…

কিন্তু তাকে বড্ড বেরসিক মনে হয়। বললো বনহুর।

কেন?

 আজকাল কেউ অমন বোরখা পরে নাকি?

ওঃ, তাই বলছেন বড় বেরসিক? আপনি ওর সম্বন্ধে কিছুই জানেন না রঞ্জন বাবু। আমার বান্ধবীর মত মেয়েই হয় না, বেচারী বড় অসুখী। একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে মাসুমা।

বলে উঠে কল্পনা–সত্যি আলেয়াকে দেখলে কেমন মায়া হয়। সব সময় তার মুখমণ্ডল কেমন যেন চিন্তাযুক্ত লাগে।

বললো বনহুর–তাই বুঝি বান্ধবীর প্রতি এতো দরদ আপনার?

মিথ্যা নয় রঞ্জন বাবু, মাসুমা বান্ধবীর নামে পাগল। দেখছেন না কেমন নিজের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। কথাটা বললেন হাশেম চৌধুরী।

মাসুমা ক্রুদ্ধ হবার ভান করে বলেছিঃ ও যদি শোনে তাহলে কি মনে করবে বলো তো? আপনি ওর কথা শুনবেন না রঞ্জন বাবু। জানেন, আমার বান্ধবী অনেক বড়ঘরের মেয়ে। কোটি কোটি টাকার ঐশ্বর্য তার আছে। শুধু তার মনে শান্তি নেই এবং সে কারণেই আমি ওকে সঙ্গে এনেছি…

বলেই ফেলো না, এতোই যদি বললে। বললেন হাশেম চৌধুরী।

 বনহুর বিপুল আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে, তার মনেও যে এ কথা জানার প্রবল বাসনা।

 বলতে শুরু করে মাসুমা আমার বান্ধবী বিবাহিতা।

 কি বললেন, আপনার বান্ধবী বিবাহিতা?

হাঁ, রঞ্জন বাবু।

 তার স্বামী…সংসার…

সে কথাই আপনাকে বলবো। আমার বান্ধবীর স্বামী সেনা বিভাগের সেনাপতি। স্ত্রীর প্রেমের চেয়ে তার কাছে দেশপ্রেম অনেক শ্রেয়। কাজেই সেনাপতি তার দেশ নিয়ে মেতে থাকেন দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। আর আমার বান্ধবী স্বামীর প্রেমে আত্নহারা, সে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত প্রতীক্ষা করে তার স্বামীর; কিন্তু হতভাগ্য স্বামী কোনোদিন তার স্ত্রীকে স্মরণ করে না।

অবাক হয়ে শুনছিলো বনহুর মাসুমার কথাগুলো। নিশ্চুপ নিস্পন্দ হয়ে শুনে চলেছে সে, কেমন যেন অসাড়ের মত।

মাসুমা বলে যাচ্ছে–অপদার্থ স্বামী বুঝলো না তার সতী লক্ষ্মী স্ত্রীর মর্যাদা। স্ত্রীর প্রেম-প্রীতি আর ভালবাসা কোনোটাই তাকে ঘরে বন্দী করে রাখতে পারলো না।

বনহুর নিজের মনে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছে। মাসুমার কথাগুলো তারই অন্তরে এসে বিদ্ধ হচ্ছিলো যেন।

মাসুমা যখন বনহুরের কাছে সব বলছিলো তখন বাগানের একটা হাহানার ঝাড়ের আঁড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো মনিরা, সে লক্ষ্য করছিলো স্বামীর মুখোভাব। মাসুমাকে মনিরা শত শত ধন্যবাদ দিচ্ছিলো অন্তরে অন্তরে।

বলে চলেছে মাসুমা–আমার বান্ধবীর মত মেয়েকে যে স্বামী তুচ্ছ জ্ঞানে ভুলে থাকতে পারে, তার মত হতভাগ্য স্বামী আর কে আছে বলুন?

হাঁ সত্যি বলেছেন মিসেস চৌধুরী। হতভাগ্য স্বামীই বটে।

মনিরা উপলব্ধি করে বনহুরের অন্তরের ব্যথা। সে দেখে, ওর চোখ দুটো কেমন সকরুণ হয়ে। উঠেছে। সুন্দর ললাটে ফুটে উঠেছে গভীর চিন্তার ছাপ। আর কেউ না বুঝলেও মনিরা বুঝতে পারলো ওর মনের কথা।

মাসুমা বলে চলে–তাই বেচারী বড় মনমরা হয়ে থাকে। কোনো সময় তার মনে আনন্দ নেই। স্বামীর বিরহে বিরহিনী…ব্যথা-ভরা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক চিরে।

হঠাৎ বনহুর লক্ষ্য করলো, হাহানার আঁড়াল থেকে সরে গেলো একটা ছায়ামূর্তি। আনমনা হয়ে পড়লো সে, তাহলে বোরখাধারিনী এতোক্ষণ আঁড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনেছিলো। সব যেন কেমন রহস্যপূর্ণ মনে হয়।

*

মাসুমার অনুরোধে পিয়ানো বাজাতে হয় বনহুরকে।

ড্রইংরুমে বসে পিয়ানো বাজাচ্ছিলো বনহুর। হঠাৎ তার দৃষ্টি চলে যায় ওদিকের জানালায়। দেখতে পায়–এক জোড়া ব্যাকুল আঁখি স্থিরভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বনহুরের দৃষ্টি ওদিকে পড়তেই সরে গেলো জোড়া আঁখি দুটি।

বনহুরের দৃষ্টি ফিরে এলো পিয়ানোর বুকে, কিন্তু হাতখানা মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠলো তার।

পিয়ানো বাজানো শেষে বনহুর বিদায় নিয়ে যখন গাড়ির দিকে পা বাড়ালো তখন আবার সে লক্ষ্য। করলো-দরজার আঁড়াল থেকে কেউ যেন তাকিয়ে আছে তার দিকে।

গাড়িতে বসে বনহুরের মনে নানারকম চিন্তার উদ্ভব হতে লাগলো! বোরখাধারিনী কে? কি চায়। সে তার কাছে? শুধু আজ নয়, আরও অনেক দিন সে লক্ষ্য করেছে দুটি ব্যাকুল আঁখি তাকে যেন অন্বেষণ করে ফিরছে। বনহুর বুঝতে পেরেছে–ও আঁখি দুটি অন্য কারো নয়–ঐ বোরখাধারিনীর। কিন্তু কেন, কেন সে অমন করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে? মিসেস চৌধুরী বললেন তার বান্ধবী বিবাহিতা…বিবাহিতা নারীর পক্ষে কোনোসময় উচিৎ নয় এসব, তবে কি মিসেস চৌধুরীর বান্ধবী চরিত্রহীনা।

কল্পনা আর স্বপন ধরে বসলো এতো শীঘ্র বাসায় ফিরবে না, বেড়াতে যাবে কোথাও।

অগত্যা বনহুর রাজি হলো কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়। স্বপন বললো যমুনা তীরে আর কল্পনা ধরলো সিনেমায় যাবে। শেষ পর্যন্ত কল্পনার কথাই মেনে নিতে হলো স্বপনকে। বনহুরও রাজি হয়ে গেলো। অনেক দিন ছবি দেখা হয়নি তার, কাজেই বেশি আপত্তি করলো না বনহুর।

দিল্লীর শ্রেষ্ঠ ছবিঘর রূপসী মহল। বনহুরের গাড়ি রূপসী মহলের দিকে অগ্রসর হলো।

আনন্দ ধরে না কল্পনার।

 স্বপনও খুশি হয়েছে।

 বনহুর স্বয়ং ড্রাইভ করছিলো।

 হঠাৎ বনহুর দেখলো–পথের এক জায়গায় লোকজন ভীড় করে কিছু দেখছে।

বনহুর গাড়িখানার স্পীড কমিয়ে দিলো। শোনা গেলো একটা সুমিষ্ট সুর আর তার সঙ্গে নুপুর ধ্বনি।

কল্পনা আর স্বপন আগ্রহভরা নয়নে দেখার চেষ্টা করলো, কিন্তু এতো ভীড়ের চাপে ওরা কিছু দেখতে পেলো না।

কল্পনার বড় সখ সে দেখবে।

বনহুর বললো–যাও, তাহলে দেখে এসো গিয়ে। স্বপন, তুমিও যাও।

আর আপনি? বললো কল্পনা।

আমি এখানে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছি, তোমরা দু’জনা যাও, দেখে এসো গে।

কল্পনা আর স্বপন নেমে গেলো গাড়ি থেকে।

 বনহুর ড্রাইভিং আসনে বসে সিগারেট কেসটা বের করে একটা সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করলো।

ভীড় ঠেলে এগিয়ে গেলো স্বপন আর কল্পনা।

কেশব মাদল বাজাচ্ছিলো।

নাচছিলো নূরী।

নূরীর চরণের নুপুর ধ্বনি আর গানের সুর পথের লোকজনদের বিমুগ্ধ করে ফেলেছিলো। সবাই ভীড় জমিয়ে দেখছিলো ওর নাচ।

স্বপন আর কল্পনা ভীড় ঠেলে এসে দাঁড়ালো। ওরাও মুগ্ধ হয়ে গেলো নূরীর নাচ আর গান শুনে।

বনহুর তখন গাড়িতে বসে ধুম্র উদগীরণ করে চলেছে, সে জানে না–তারই নূরীর কণ্ঠ এটা, তার নূরীরই চরণধ্বনি তাকে আনমনা করে তুলেছে। নীরবে বসে বসে শোনে সে।

ওদিকে নূরী নাচে-গায় আর দৃষ্টি তার খুঁজে ফেরে লোকের মুখে মুখে–কোথায় তার হুর।

কেশব মাদল বাজায়।

 এক সময় ফিরে আসে স্বপন আর কল্পনা, গাড়িতে চেপে বসে।

বনহুর গাড়িতে স্টার্ট দেয়।

কল্পনা বলে–রঞ্জনদা, তুমি যদি দেখতে সত্যি মুগ্ধ হয়ে যেতে।

তাই নাকি? ড্রাইভিং আসন থেকে বলে বনহুর।

হাঁ, সত্যি আশ্চর্য। বললো স্বপন।

কি আশ্চর্য? জিজ্ঞাসা করলো বনহুর।

স্বপন বললো–সবই।

 তার মানে?

 মানে যেমন নাচ, তেমনি গান, তেমনি রূপসী..

 হেসে উঠে বনহুর রূপসীকে মনে ধরলো নাকি?

দ্যুৎ, কি যে বলেন! বললো স্বপন।

কল্পনা বললো–সত্যি রঞ্জনদা, অমন সুন্দরী মেয়ে আমি আর দেখিনি।

ওঃ তুমিও দেখছি নাচনেওয়ালীর রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছো।

শুধু আমি নই, সত্যি রঞ্জন দা আপনি যদি দেখতেন!

 সর্বনাশ, আমি তাহলে না গিয়ে ভালই করেছি, কি বলো?

 ঠকেছেন আপনি। বললো কল্পনা।

এ্যা, ঠকেছি তাহলে? যাক, ভাগ্য যদি থাকে তবে আর একদিন বরাৎ হয়ে যেতে পারে। এইতো রূপসী মহল এসে গেছে, চলো।

গাড়ি রেখে নেমে পড়লো বনহুর, স্বপন আর কল্পনা। টিকেট করে প্রবেশ করলো হলের মধ্যে।

তখন টাইটেল দেখানো হচ্ছে, হল অন্ধকার।

আসন গ্রহণ করলো বনহুর, স্বপন আর কল্পনা। বনহুর অন্ধকারেই লক্ষ্য করলো তার পাশেই বসে আছে একজন নারী এবং সে বোরখা পরা!

বনহুর লক্ষ্য করলেও স্বপন আর কল্পনা করেনি।

একটা গভীর সন্দেহ বনহুরের মনে দানা বেঁধে উঠলো। তবে কি পুলিশ সুপারের বাড়ির সেই মহিলা গোয়েন্দা এটা? আজ বনহুর একে হাতে-নাতে শায়েস্তা করে তবে ছাড়বে।

ছবি শুরু হলো।

একটা ইংলিশ পিকচার দেখানো হচ্ছে। ফাইটিং চিত্র। বনহুরের ছবি দেখা অভ্যাস নেই, ফাইটিং চিত্র দেখে সে তন্ময় হয়ে গেলো।

যখন ছবি শেষ হলো ফিরে তাকিয়ে দেখলো বনহুর, ওদিকের আসন শূন্য-বোরখাধারিনী নেই! কিন্তু নজর পড়লো একটা কাগজের টুকরা পড়ে আছে সে আসনের উপরে।

বনহুর এগিয়ে গেলো, সকলের অলখ্যে কাগজের টুকরাটা তুলে নিলো হাতে। মাত্র এক লাইন লেখা কাগজের টুকরায় ও

রাত একটায় আমি আসবো তোমার ঘরে, দরজা খুলে রেখো। –বান্ধবী।

কাগজের টুকরাটা পকেটে রেখে হাসলো বনহুর। বান্ধবীই বটে না-হলে তাকেও নাকানি-চুবানি খাইয়ে ছাড়ছে। আজ আবার কি মতলব নিয়ে আগমন করবে তাই বা কে জানে!

*

মনিরা সোজা এসে হাজির হলো স্বপনদের বাড়িতে। অন্দর বাড়িতে প্রবেশ করে ডাকলো– কল্পনা…কল্পনা….

ব্যস্তভাবে এগিয়ে চলো চাকর-বাকরের দল, বললো তারা–ওরা তো বাসায় নেই।

মনিরা বললো–কখন আসবে তোমরা জানো?

একজন উত্তর দিলো–ঠিক করে আমরা বলতে পারছি না, আপনি বসুন, ওরা হয়তো এক্ষুণি এসে পড়বে।

না, আমার বসবার সময় নেই, তবে রঞ্জন বাবুর সঙ্গে জরুরি একটা দরকার ছিলো। তা একটা কাগজ আর কলম দাও তো, লিখে রেখে যাই?

আমরা চাকর-বাকর মানুষ–কাগজ আর কলম কোথায় পাবো। আপনি বরং উনার ঘরে টেবিলে কাগজ-কলম সব আছে, লিখে রেখে যান।

সেই ভাল…মনিরা এটাই চাইছিলো। সে বিলম্ব করলো না, বনহুরের কক্ষে প্রবেশ করে চারদিকে তাকালো। সর্বত্র স্বামীর হস্তের ছোঁয়া যেন ছড়িয়ে আছে। বিছানায় হাত রেখে অনুভব করলো। বালিশটা তুলে গালে-মুখে-কপালে ছোঁয়ালো। তারপর আলনায় ঝুলিয়ে রাখা জামাটা তুলে চেপে ধরলো বুকে সমস্ত অন্তর দিয়ে অনুভব করলো স্বামীর স্পর্শ। টেবিলে এসে কাগজ আর কলম তুলে নিলো, কিন্তু কিছু লিখলো না সে। কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাবার সময় শুধু বালিশে ছড়িয়ে দিলো খানিকটা গুড়োর মত পাউডার।

চাকর-বাকরদের কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেলো মনিরা।

মনিরা চলে যাবার কিছু পরে ফিরে এলো বনহুর, স্বপন আর কল্পনা।

রাত হয়ে গিয়েছিলো অনেক, কাজেই সেদিন আর কোনো গল্প-সল্পের আসর না জামিয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ করে যে যার শোবার ঘরে চলে গেলো।

স্বপন আর কল্পনা চলে গেলে, বনহুর প্রবেশ করলো নিজের কক্ষে। বনহুর আবার পকেট থেকে বের করে পড়লো চিঠির টুকরাটা। হাসলো বনহুর আপন মনে, আজ সে দেখে নেবে–কে ঐ বোরখাধারিনী। বিছানায় শুয়ে ঘুমের ভান করে থাকবে, তারপর সে যখন এসে দাঁড়াবে তার বিছানার পাশে, তখন আচমকা ওর হাতের রিভলভার কেড়ে নিতে হবে অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এ নারী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নইলে তার মত দস্যুকেও নাকানি-চুবানি খাওয়াতে পারে কোনো নারী!

হাতঘড়ির দিকে তাকায় বনহুর, একটা বাজতে আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকী। বনহুর রিভলভারটা বালিশের তলায় রেখে চুপচাপ শুয়ে পড়লো বিছানায়। বালিশে মাথা রেখে পাশ ফিরে শুলো। একটা সুমিষ্ট গন্ধ অনুভব করলো বনহুর।

তারপর ধীরে ধীরে তার চোখের পাতা বন্ধ হয়ে এলো।

মনিরা বার বার তাকাচ্ছে দেয়ালঘড়ির দিকে।

 মাসুমা বললো–যাই, বড়ড় ঘুম পাচ্ছে।

আমারও কিন্তু খুব ঘুম পাচ্ছে আজ। মনিরাও উঠে নিজের কামরায় চলে গেলো।

মনিরা কক্ষে প্রবেশ করলো বটে, কিন্তু সে শয্যা গ্রহণ করলো না। সে ড্রেসিং টেবিলের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো।

মনিরা যখন ড্রেসিং টেবিলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে নিচ্ছিলো তখন মাসুমা জানালার বাইরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলো আত্নগোপন করে।

আজ মাসুমার মনে সন্দেহ জেগেছিলো। মনিরার মধ্যে সে লক্ষ্য করেছিলো একটা আনমনা ভাব। বার বার যখন সে ঘড়ি দেখছিলো তখন মাসুমা আঁচ করে নিয়েছিলো–নিশ্চয়ই আজ মনিরা কিছু করবে। তাই ঘুমের ভান করে চলে গেলেও সে আসলে গেলো না, লুকিয়ে রইলো অন্ধকারে মনিরার কক্ষের পাশে।

শুধু আজ নয়, বেশ কিছুদিন হলো মাসুমা লক্ষ্য করছে মনিরার মধ্যে একটা পরিবর্তন বিশেষ করে রঞ্জন বাবু যেদিন প্রথম এসেছিলো সেই দিন হতে মনিরা যেন কেমন হয়ে পড়েছে। সবসময় অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবে, রঞ্জন বাবু এলে সে সম্মুখে আসে না অবশ্য কিন্তু তার চোখেমুখে ফুটে উঠে এক আনন্দ উচ্ছ্বাস। তা ছাড়াও মাসুমা আরও লক্ষ্য করেছে–মনিরা আজকাল বড় উদাস হয়ে পড়েছে।

হাশেম চৌধুরী আজ জরুরি কোনো কাজে অফিসে আটকা পড়ে গেছেন। মাসুমার কোনো অসুবিধা হলো না, সে সর্তকভাবে লুকিয়ে মনিরার কার্যকলাপ দেখতে লাগলো।

মনিরা সজ্জিত হয়ে নিয়ে বোরখা পরে নিলো। তারপর বেরিয়ে এলো কক্ষ থেকে। আলগোছে। দরজা বন্ধ করে বাগানের দিকে অগ্রসর হলো।

মাসুমাও অনুসরণ করলো তাকে।

আজ সে দেখবে–মনিরা কি করে বা কোথায় যায়।

মনিরা যে-পথে অগ্রসর হলো সে-পথ নির্জন; এদিকে তেমন কোনো পাহারার ব্যবস্থা নেই। মনিরার জমকালো বোরখা মিশে গেলো অন্ধকারে।

মাসুমা গোপনে এগিয়ে চলেছে।

একি, মনিরা সোজা স্বপনদের বাড়ির দিকে অগ্রসর হলো।

মাসুমাও সাহস করে তাকে অনুসরণ করলো।

গাছের আড়ালে, কখনও বা দেয়ালের পাশ কেটে, কখনও বা লাইটপোস্টের ছায়ায় ছায়ায় এগিয়ে চললো মাসুমা।

মাসুমার বুক ঢিপ ঢিপ করছে, একটা দারুণ সন্দেহ তার মনকে অস্থির করে তুলছে। তার প্রিয় বান্ধবী মনিরা চরিত্রহীনা না না, এ কথা মনেও সে স্থান দিতে পারছে না।

কোথায় চলেছে মনিরা? তবে কি সে রঞ্জন বাবুর বাসায় যাচ্ছে? তাই তো মনে হচ্ছে। মাসুমা যা ভাবছিলো তাই হলো। মনিরা প্রবেশ করলো কল্পনাদের বাড়ির ভিতরে। পিছন দিকের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো উপরে।

মাসুমাও চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে অগ্রসর হলো। মনিরা অদৃশ্য হতেই মাসুমা সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলো। একি, কোথাও তো ওকে দেখা যাচ্ছে না! মাসুমা জানে, এদিকের কক্ষটায় থাকে রঞ্জন বাবু।

মাসুমা অতি সন্তর্পণে এগিয়ে গেলো।

ঠিক রঞ্জন বাবুর ঘরের পাশে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। বুক ঢিপ ঢিপ করছে মাসুমার, সমস্ত শরীর ঘেমে চুপসে উঠেছে–এও কি সত্য! তার বান্ধবী মনিরা…ছিঃ ছিঃ ছিঃ ঘৃণায় মন তার বিষিয়ে উঠলো। এতোদূর এসেছে যখন–শেষ অবধি না দেখে যাবে না সে। জানালার পাশে সে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি ফেললো কক্ষমধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে মাসুমার দৃষ্টি আরষ্ট হয়ে গেলো, পা থেকে মাথা অবধি বিদ্যুৎ চমকে গেলো যেন। স্পষ্ট দেখলো–শয্যায় শায়িত রঞ্জন বাবুর মুখের উপর ঝুঁকে পড়েছে মনিরা, চুম্বন দিচ্ছে তার ঘুমন্ত মুখে! আশ্চর্য হলো মাসুমা, রঞ্জন বাবু যেমন আছে তেমনি রইলো–একটুও নড়ছে না সে!

আর দাঁড়াতে পারে না মাসুমা, সন্তর্পণে নেমে যায় সিঁড়ি বেয়ে। বাসায় ফিরে আসে, কিন্তু ঘুমাতে পারে না আর সে।

সমস্ত রাত কাটে অনিদ্রায়। ঘরময় পায়চারী করে মাসুমা। নিজের চোখকে যেন সে বিশ্বাস করতে পারে না। মনিরার সঙ্গে রঞ্জন বাবুর এতো গভীরতা–এ যেন তার কল্পনার বাইরে!

মাসুমা কক্ষমধ্যে পায়চারী করলেও দৃষ্টি তার ছিলো মনিরার কক্ষের দরজার দিকে। বেশ কিছু সময় কেটে গেলো, এতোক্ষণও ফিরে এলো না মনিরা।

মাসুমা ক্রমেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে। বার বার হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে সে। লজ্জায়-ক্ষোভে মাটিতে যেন মিশে যাচ্ছিলো মাসুমা। মনিরাকে সে কোনোদিন মন্দ মেয়ে বলে ভাবতে পারেনি, তাছাড়া তার চাল-চলন অতি সচ্ছ, সুন্দর ও স্বাভাবিক কিন্তু একি দেখলো সে আজ! রঞ্জনবাবু সুপুরুষ– যে কোনো নারী তাকে ভালবাসতে পারে, তাই বলে মনিরা বিবাহিতা মেয়ে হয়ে…না না,. এ হতে পারে না, এ হতে পারে না…

ঠিক সে মুহূর্তে কালো বোরখা-পরা মনিরা লঘু পদক্ষেপে তার ঘরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে দেখতে পেলো মাসুমা।

ক্রুদ্ধা নাগিনীর মত মাসুমা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। এগিয়ে এলো তার পিছনে, কঠিন কণ্ঠে বললো– মনিরা!

থমকে দাঁড়ালো মনিরা, পিছনে তাকাবার সাহস হলো না তার। মাসুমা নিকটে সরে এলো, পূর্বের ন্যায় তীব্র কণ্ঠে বললো–মনিরা, ছিঃ ছিঃ ছিঃ আমি ভাবতে পারিনি তুই এত জঘন্য…

মনিরা এবার তাকালো মাসুমার দিকে, কিন্তু কোনো কথা সে উচ্চারণ করলো না বা করতে পারলো না। নির্বাক পুতুলের মত দাঁড়িয়ে রইলো স্থির হয়ে।

মাসুমা বলে চলেছে–আমি জানতাম মনিরা, তুই সচ্চরিত্রা মেয়ে কিন্তু…

 এবার বললো মনিরা–মাসুমা!

এ কারণেই তুই ঢং করে রঞ্জন বাবুর সামনে না বেরিয়ে আড়ালে আড়ালে এতোদূর অগ্রসর হয়েছি, তার সঙ্গে গোপনে প্রেম করছি…

মাসুমা, সংযতভাবে কথা বল?

 আমি নিজের চোখকে অবিশ্বাস করতে পারি না।

মাসুমা!

হাঁ, আমি সব দেখেছি।

এবার মনিরা সরে এলো, মাসুমার পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো, কাঁধে হাত রাখলো সে মাসুমার।

মাসুমা ক্ষিপ্রহস্তে মনিরার হাতখানা সরিয়ে দিয়ে বললো–অপবিত্র কলুষিত দেহে আমাকে স্পর্শ করিস না মনিরা। আমি যা দেখেছি, যা জেনেছি, এরপর আমাকে…

মাসুমা বোন, শোন, শোন বলছি…

না না, আমি কোনো কথাই শুনতে চাই না মনিরা। যা হবার হয়েছে। এমন জানলে তোকে আমি সঙ্গে করে কিছুতেই আনতাম না।

মাসুমা!

কালকেই আমি ওকে বলবো তোকে দেশে রেখে আসতে।

 মাসুমা!

 ভয় নেই, আমি আমার স্বামীর কাছে তোর সম্বন্ধে কোনো কথাই বলবো না।

মাসুমা স্থির হয়ে শোন। আমারও অনেক কথা তোকে বলবার আছে।

 আমি সব জানি–আর শোনার মত প্রবৃত্তি আমার নেই।

মাসুমা, আমাকে ভুল বুঝিস না বোন।

ভুল! ছিঃ মনিরা, আমি তোকে অনেক সমীহ করতাম। তোকে আমি শ্রদ্ধা করতাম অন্তর দিয়ে। কিন্তু আজ যা দেখলাম…..

মাসুমা মাসুমা, ধৈর্য ধর বোন। আমি কোনো অসৎ কাজ করিনি। আমি কোনো অন্যায় করিনি মাসুমা। বিশ্বাস কর আমাকে।

মাসুমা কঠিন পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে। মুখমণ্ডল গম্ভীর, স্থির দুটি আঁখি। নিশ্বাস দ্রুত বইছে।

মনিরা মাসুমার কাঁধে আবার হাত রাখলো।

চোখ দুটো তার অশ্রু ছলছল করছে। বললো মনিরা এবার–মাসুমা প্রথমেই তোকে কথাটা বললে আজ হয়তো এমন একটা বিভ্রাট ঘটতো না। মাসুমা, আমাকে তুই অবিশ্বাস করিস না বোন। আমি চরিত্রহীনা ব্যাভিচারিণী নই। রঞ্জন বাবুই আমার স্বামী,

মাসুমা বিস্ময়ে অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো–রঞ্জন বাবু তোর স্বামী!

হাঁ, মাসুমা। আমি জানতাম ভারতবর্ষে এসে ওর সাক্ষাৎ পাবো।

 তবে যে বলেছিলি তোর স্বামী সেনাপতি?

সে কথা মিথ্যা নয় মাসুমা, কিন্তু ও বড় খামখেয়ালী, বড় এক-গুয়ে। যখন যা খুশি তাই করে বেড়ায়। যা তার মন চায় করে। যেখানে তার মন চায় চলে যায়। ওকে ধরে রাখার সাধ্য কারো নেই।

এ সব কি বলছিস মনিরা?

সব সত্য। এতোটুকু মিথ্যা আমি বলবো না তোর কাছে। যদি খামখেয়ালী না হবে, তাহলে সুদূর কান্দাই থেকে এই দিল্লী নগরীতে সে এলো কি করে। আর মুসলমান নাম পাল্‌টে দিব্য হিন্দু নাম ধারণ করে স্বপন ও কল্পনার দাদা সেজে বসেছেই বা কি করে?

আশ্চর্য!

শুধু আশ্চর্য নয় মাসুমা অদ্ভুত। বড় রহস্যময় মানুষ সে! আমি ওকে প্রথম দিন থেকেই চিনতে পেরেছি। কেউ না চিনলেও আমার চোখে ও গোপন থাকতে পারবে না। আমি ওর স্ত্রী।

মনিরা, আমি যে বিশ্বাস করতে পারছি না তোর কথা।

সব শুনলে অবিশ্বাস করতে পারবি না মাসুমা। জানিস, ওর জন্য আমি আজ সর্বহারা পৃথিবীর হাসি, আনন্দ সব নীরস শুধু ওর জন্য। মাসুমা, তোর জন্যই আজ আমি খুঁজে পেয়েছি ওকে। আবার আমার জীবন পূর্ণতায় ভরে উঠেছে। আবার আমার মনে ফিরে এসেছে আনন্দের উৎস। মাসুমা, আমি ওকে দেখার পর থেকে কি করে সে নিজেকে শক্ত করে রেখেছি, আমি নিজেই জানি না।

মনিরা, তাই তোর এই বোরখা পরার ছলনা।

হাঁ, আমি এতো সহজে ওকে ধরা দেবে না বলেই ওর কাছ থেকে নিজেকে এভাবে গোপন রেখেছি।

এবার মাসুমার মুখে হাসি ফুটে উঠে। বলে মাসুমা, আমাকে তুই ক্ষমা কর বোন।

দোষ তোর নয় মাসুমা, দোষ আমার। অন্ততঃ তোকে বলাটা আমার উচিৎ ছিলো। কিন্তু তোকেও বলতে পারিনি। কেন পারিনি বলব?

বল্।

ভেবেছিলাম সবার কাছেই গোপন রাখবো এবং কত দূরে গিয়ে এর শেষ হয় দেখবো। আর দেখবো ওর ভিতরের রহস্য কি কারণে সে কান্দাই ছেড়ে চলে এসেছে এই সুদূর ভারতবর্ষে।

এবার সব বুঝেছি মনিরা। কিন্তু কই ওর কাছে নিজেকে তো গোপন রাখতে পারলি না?

রেখেছি। এখনও আমি ওকে আমার পরিচয় জানতে তো দেইনি।

 তবে যে তুই…

ওঃ আমি গিয়েছিলাম তাই?

হাঁ।

মাসুমা…হাসলো মনিরা একটু, তারপর বললো আবার–মাসুমা, ও যে ঘুমিয়ে ছিলো।

কিন্তু মনিরা, আমাকে ক্ষমা কর–আমি সব দেখেছি।

ওঃ তাই? তবে শোন, আমি আজ সন্ধ্যায় মার্কেটে যাবো বলে বাইরে গিয়েছিলাম, মনে পড়ে?

হাঁ, কি সব আনতে গিয়েছিলি জানি।

সত্যি আমি মার্কেটে যাইনি, গিয়েছিলাম ওর ওখানে। আর যাবার সময় একটা ডাক্তারের দোকান থেকে কয়েকটা টাকা কম্পাউণ্ডারকে দিয়ে খানিকটা ক্লোরফরম ঔষধ সংগ্রহ করে নিয়েছিলাম। তারপর রঞ্জন বাবুর ঘরে প্রবেশ করে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম তার বালিশে। তখন রঞ্জন বাবু বা স্বপন, কল্পনা কেউ ছিলো না বাসায়।

হুঁ, এবার বুঝেছি সব। মাসুমা মনিরার গালে মৃদু টোকা দেয়।

মনিরার মুখ এবার লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো, বললো–মাসুমা, আমার একটা অনুরোধ রাখতে। হবে তোকে।

একটা কেন, হাজারটা অনুরোধ রাখতে রাজি আছি। বল এবার?

তুই জানলি শুধু এ কথা, আর যেন কেউ না জানে। এমনকি হাশেম সাহেবকেও বলবি না কিছু।

না না, বলবো না, বলবো না। সত্যি, মনির সাহেব যে রঞ্জন বাবু সেজে বসে আছেন একেবারে কল্পনার বাইরে।

সেদিন গোটা রাত দুই বান্ধবী মিলে আর ঘুমাতে পারলো না। হাশেম চৌধুরী জরুরি কাজে সন্ধ্যার পর অফিসে গিয়ে আটকা পড়ে গিয়েছিলেন, তিনি ফিরে আর এলেন না সে রাতে। ফোনে জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি; আজ আমার বাসায় যাওয়া হবে উঠবে না, তোমরা খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়ো।

মাসুমা আর মনিরার রাতভর চললো গল্প আর গল্প। কত কথা মনিরা স্বামীর সম্বন্ধে বলতে লাগলো, শুনতে লাগলো মাসুমা। গল্পের যেন শেষ নেই। সব কথা বললেও মিনরা একটি কথা গোপন করে গেলো, যে কথা কাউকে বলার নয়। তার স্বামী দস্যু বনহুর–এ কথাটা বললো না সে ওকে।

*

মাসুমার কাছে খুলে বলে মনিরা নিজকে অনেকখানি হালকা বোধ করে। এতোদিন তার বুকের মধ্যে যে একটা জমাট আনন্দ চাপা পড়ে ছিলো, আজ যেন সে আনন্দ-উৎস পথ পেয়ে হু হু করে বেরিয়ে আসে। খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠে মনিরা।

সকাল বেলা ঘর গোছাচ্ছিলো আর গুন গুন করে গান গাইছিলো মনিরা।

পা টিপে টিপে কক্ষে প্রবেশ করে মাসুমা। পিছন থেকে ওর চোখ দুটো ধরে ফেলে।

মনিরা হেসে বলে-মাসু।

চোখ ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় মাসুমা, বলে সে–আজ যে বড় আনন্দময় দেখছি।

অধরে অধর মিলায়ে করিয়াছ সুধা পান।
 তাই বুঝি এতো আনন্দ, এতো মধুময় গান?

মাসুমা সুর করে বললো কথাটা–কেমন তাই না?

 যাও তুমি বড় দুষ্ট মাসুমা।

 দাঁড়াও এবার কেমন দুষ্টামি করি, তখন আমাকে দুষ্ট না বলে বলবে লক্ষী বান্ধবী আমার।

 আচ্ছা তখন দেখা যাবে।

 শোন মনিরা…ওর কানে মুখ নিয়ে ফিস্ ফিস্ করে কিছু বললো মাসুমা।

 হাসলো মনিরা।

এখানে দুই বান্ধবী মিলে যখন কথাবার্তা হচ্ছিলো, তখন বনহুর কেবলমাত্র ঘুম থেকে জেগে উঠে হাই তুলে ভাবছিলো, কই সে তো এলো না। তবে কি তার কথা মিথ্যা? হয়তো তাকে ধোকা দিয়েছে। হঠাৎ নজর পড়লো তার নিজের বুকে আলপিন আঁটা একটা কাগজের টুকরায়। তাড়াতাড়ি খুলে নিলো কাগজের টুকরাটা সে, মেলে ধরলো চোখের সামনে। নজরে পড়লো লেখাটা?

বন্ধু– এসে ফিরে গেলাম। কই আমার জন্য তুমি তো জেগে থাকনি? নিয়ে গেলাম আমার যা পাওনা।
বান্ধবী

বনহুর শয্যা ত্যাগ করে মেঝেতে নেমে দাঁড়ালো, বার বার পড়লো কাগজের টুকরায় লেখাটা। লজ্জায় বনহুরের মুখমণ্ডল আরক্ত হয়ে উঠলো। একটা মেয়ের কাছে তার এমন পরাজয়–একবার নয়, দুবার নয়–পর পর সে তাকে এভাবে জব্দ করে চলেছে। কে এই বোরখা পরিহিতা? যেমন করে হোক জানতেই হবে কে সে?

বনহুর বাথরুমে প্রবেশ করে ভাবে, কি তার পাওনা যা সে নিয়ে গেছে। আবার ঘরে ফিরে এসে তার জিনিসপত্র সব খুঁজে দেখে, না কিছুতো হারায়নি–সব ঠিক আছে। এমন কি তার সুটকেসের মধ্যে ছিলো প্রচুর টাকা-পয়সা আর সোনা। যেমন ছিলো তেমনি আছে।

আশ্চর্য হলো বনহুর।

চা-নাস্তা পর্ব শেষ করে বেরিয়ে পড়লো তখনই, চললো সে বাংলোর দিকে। আজ সে মিসেস চৌধুরীর কাছে জিজ্ঞাসা করবে–বোরখা পরা মহিলা কে, কি তার পরিচয়?

*

বাংলায় এসে হাজির হলো বনহুর।

মাসুমা আর মনিরা জানালায় দাঁড়িয়ে দেখলো।

মাসুমা মনিরার চিবুকে মৃদু টোকা দিয়ে বললো–দেখলি তো, যাদুকাঠির স্পর্শে আত্নহারা হয়ে ছুটে এসেছেন দেবকুমার।

হাসলো মনিরা।

 মাসুমা বেরিয়ে গেলো তাড়াতাড়ি করে।

ড্রইংরুমে প্রবেশ করে বললো মাসুমা রঞ্জন বাবু যে, হঠাৎ অসময়ে।

রঞ্জন বাবুর মুখমণ্ডল গম্ভীর, বললো–বসুন, একটা কথা বলবো বলে অসময়ে বিরক্ত করতে এসেছি।

বিরক্ত নয়, খুশি হয়েছি অনেক। বলুন, তারপর খবর কি?

 বসুন বলছি। বলবো বনহুর।

 মাসুমা বয়কে ডেকে চা-নাস্তা আনতে বললো, তারপর আসন গ্রহণ করলো।

 বললো বনহুর–মিসেস চৌধুরী, আজ আমাকে একটা কথা আপনি খুলে বলবেন আশা করি?

 বলুন বলবো।

আপনার বান্ধবীর পরিচয় আমি জানতে চাই।

আমার বান্ধবীর পরিচয়?

হাঁ। বলুন কে সে? আর কেনই বা সে নিজেকে অমন করে আত্নগোপন করে রাখে?

এ কথা জানার জন্যই কি আপনি…

হাঁ হাঁ–বলুন কে সে? আমি সে কথাই জানতে এসেছি।

সে আমার বান্ধবী একথা আপনি জানেন। তার নাম যে আলেয়া একথাও আপনি জানেন। আরও জানেন আমার বান্ধবী পর্দানশীন মেয়ে।

না। তার আরও কোনো গোপন পরিচয় আছে।

আমার বান্ধবীর এমন কোনো গোপন পরিচয় নেই যা আমি জানি না। আমার বান্ধবী বিবাহিতা, তার স্বামী-পুত্র-সংসার এও আছে–তাও জানি। কিন্তু আপনি আজ হঠাৎ তার সম্বন্ধে এমন ভাবে প্রশ্ন করে বসবেন ভাবতে পারিনি।

বেয়াদবী মাফ করবেন, আমি আপনার বান্ধবীর কতগুলো আচরণে বেশ আশ্চর্য হয়েছি।

হাঁ, তা সত্য, ওর কতগুলো চাল-চলন আশ্চর্য বটে। যেমন, আজকালকার মেয়ে হয়ে সে বোরখা পরে। নিজে ভাল সঙ্গীত-চর্চা করতে পারে অথচ অপরের সঙ্গীত শুনে আত্নহারা হয়ে যায়। তারপর নিজের স্বামী থাকতে অপরজনকে যে ভালবাসতে পারে…রঞ্জন বাবু, আপনি শুনে অবাক হবেন না যেন। আমার বান্ধবী আপনার পিয়ানোর সুরে মুগ্ধ হয়ে আপনাকে ভালবেসে ফেলেছে।

বনহুরের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠে, বিশেষ করে মিসেস চৌধুরীর মুখে এ কথা তার মনে অসহ্য লাগে। গম্ভীর হয়ে বসে থাকে সে।

বলে মাসুমা–আপনি হয়তো ক্রুদ্ধ হচ্ছেন, কিন্তু আমার বান্ধবীর প্রেম পাওয়া পরম ভাগ্যের কথা।

ছিঃ আপনি এ সব কি বলছেন মিসেস চৌধুরী?

দেখুন যা সত্য তাই বলছি, আপনার অপরূপ সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করেছে রঞ্জন বাবু।

অধর দংশন করে বনহুর।

 মাসুমা যখন এসব কথা বলছিলো, তখন মনিরা আড়ালে লুকিয়ে স্বামীর মুখোভাব লক্ষ্য করছিলো আর মুখ টিপে হাসছিলো সে।

মাসুমা বললো আবার–যদি ওর সঙ্গে চাক্ষুস পরিচয় করতে চান তবে আমি ওকে ডাকছি।

 উঠে দাঁড়ালো বনহুর–যাক কাজ নেই আর চাক্ষুস পরিচয়ে। চলি তাহলে?

 মাসুমাও উঠে দাঁড়িয়েছিলো, বললো এবার সে–ওকি, চা না খেয়েই যাবেন?

হা।

আমার বান্ধবীর পরিচয়টা…

থাক, দরকার নেই।

 বসুন না আর একটু রঞ্জন বাবু।

এখন নয়।

 তবে আবার আসছেন তো?

আসবো। বলে বেরিয়ে যায় বনহুর।

মাসুমা হাসে।

মনিরা এবার এসে দাঁড়ায় মাসুমার পাশে–একি তামাসা শুরু করলি মাসু?

এই তো সবে শুরু। বলে হাসে মাসুমা।

বনহুর চলে গেলো বটে, কিন্তু তার মন সচ্ছ হলো না। সুযোগের প্রতীক্ষায় রইলো সে। যেমন করে লোক দেখবে–কে আছে ঐ বোরখার নিচে।

*

সন্ধ্যার পর আবার এলো বনহুর, এখন তার মুখমণ্ডল সকালের মত গম্ভীর নয়।

হাশেম চৌধুরী আজ সন্ধ্যায় বাসায় আছেন। তিনি রঞ্জন বাবুকে পেয়ে খুশি হলেন অনেক।

 মাসুমাও আনন্দিত হলো।

ভিতরে গিয়ে মনিরার কানে মুখ নিয়ে বললো সে–মনিরা, ঔষধ ধরেছে।

মনিরা হাসলো শুধু।

সন্ধ্যায় চায়ের আসর জমলো ভাল।

হাশেম চৌধুরী বললেন–চলুন না আজ লেকের পানিতে নৌকা-ভ্রমণ করে আসা যাক।

খুশি হলো মাসুমা সত্যি কত দিন নৌকা ভ্রমণে যাওয়া হয়নি। আলেয়াও যাবে আমাদের সঙ্গে।

 বনহুর অমত করতে পারলো না।

সবাই মিলে চললো ওর লেকের ধারে।

আজ বনহুর একটা কৌশল অবলম্বন করলো। সে দেখবে, কে ঐ বোরখাধারিনী। বনহুর নিজে একটা বৈঠা নিয়ে নৌকায় মাঝি হয়ে বসলো।

মনিরা বুঝতে পারলো স্বামীর মনোভাব। সে বললো–আমার শরীর বড় অসুস্থ লাগছে, নৌকায় যাবো না।

মনিরাকে কিছুতেই রাজি করানো গেলো না। শেষ পর্যন্ত মনিরাকে ছেড়েই ওরা নৌকা বিহারে গমন করলো।

ব্যর্থ হলো বনহুরের মনোভাব। সে ভেবেছিলো, আজ নৌকাডুবি করবে এবং উদ্ধারের ছলনায় বোরখাধারিনীর বোরখা উন্মোচন করে ফেলবে।

মনিরা তীরেই বসে রইলো, আর রইলো কয়েকজন মহিলা। অবশ্য মহিলাগণ সন্ধ্যা ভ্রমণেই এসেছিলো লেকের ধারে। মনিরা অল্পক্ষণে তাদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিলো।

গল্পসল্প করে কেটে গেলো কিছু সময়। ফিরে এলো ওরা।

 বনহুরের মুখোভাব খুব সচ্ছ নয়, সবার কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেলো সে।

মনিরা মাসুমার কানে মুখ নিয়ে কিছু বলে হাসলো। তারপর সবাই মিলে ফিরে চললো বাসার দিকে।

*

বনহুর গাড়ি রেখে নামতে যাবে এমন সময় গাড়ির আসনে একটা চিঠি পেলো সে। বুঝতে পারলো, নিশ্চয়ই বোরখাধারিনীর কাজ। কাগজের টুকরাটা উঁচু করে ধরলো চোখের সামনে। ওতে লিখা আছে দেখলো বনহুর

বন্ধু, সব আশা ব্যর্থ হলো, কেমন তাই নয় কি? নৌকাডুবি থেকে নিজেকে বাঁচাতে পেরেছি বলে নিজেকেই ধন্যবাদ দিচ্ছি–বান্ধবী।

 বনহুর সোজা চলে গেলো নিজের ঘরে, রাগে-ক্ষোভে দাঁতে দাঁত পিষতে লাগলো। এতো বড় ধূর্ত মেয়ে বোরখাধারিনী! তার মনের কথা জানলো কি করে! আবার তার ঢং দেখো, আমাকে সে ভালবেসে ফেলেছে। সব শয়তানি, সব চালাকি।

বনহুর ওকে কি করে হাতের মুঠায় পাবে সে চিন্তা করতে লাগলো। যেমন করে লোক, বোরখাধারিনীকে একবার কৌশলে কোথাও নিয়ে যেতে হবে। তারপর কেমন করে তার খোলস খুলে ফেলতে হয় দেখে নেবে।

পরদিন মনিরা বাইরে যাবে বলে তৈরি হয়ে নিলো। মাসুমা আজ যাবে না, হাশেম চৌধুরীর শরীর অসুস্থ থাকায় সে আজ বাসায় রয়েছে।

মনিরা বোরখা পরেই গাড়িতে চেপে বসলো।

ড্রাইভিং আসনে উপবিষ্ট একজন পুলিশ ড্রাইভার। বললো মনিরা–চলো ফজলে এলাহির দোকানে।

বহুৎ আচ্ছা।

চমকে উঠলো মনিরা, এ কণ্ঠ যে তার চির পরিচিত। বললো মনিরা–একটু দেরী করো, আমার ব্যাগটা ফেলে এসেছি।

মনিরা গাড়ি থেকে নেমে গেলো।

মাসুমা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো–ব্যাপার কি? ফিরে এলে যে?

হেসে বললো মনিরা–বন্ধু ড্রাইভার সেজে এসেছে, কাজেই রিভলভারটা দাও, হঠাৎ যদি আত্নরক্ষার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

ভ্যানিটি মধ্যে রিভলভার নিয়ে ফিরে আসে মনিরা। গাড়ির পিছন আসনে না বসে এবার বসলো ডে ড্রাইভিং আসনের পাশে।

ড্রাইভার গাড়িতে স্টার্ট দিলো।

ড্রাইভার বেরিয়ে এলো বাংলোর গেট পেরিয়ে।

দিল্লীর রাজপথ বেয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। মনিরা লক্ষ্য করলো–গাড়ি সোজা পথে না গিয়ে একটা গলির মধ্যে প্রবেশ করলো।

সঙ্গে সঙ্গে মনিরা দক্ষিণহস্তে রিভলভার চেপে ধরলো ড্রাইভারবেশী বনহুরের পাঁজরে–খবরদার, একচুল বদমাইসি করলে মরবে।

বনহুর কল্পনাও করতে পারেনি, ছদ্মবেশ বুঝতে পারবে বোরখাধারিনী। হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে ফেললো, বললো–গাড়ি তো নেহি চলেগা বিবি সাব।

কোনোরকম চালাকি কোরো না, আমি জানি তুমি এমনিভাবে আমাকে বিপদে ফেলবে, তাই আমি প্রস্তুত হয়েই এসেছি।

গাড়ি নেহি চলেগা তব হাম কিয়া করেগা বিবি সাব?

তাহলে গাড়ি থেকে নেমে যাও।

বনহুর উঠতে যাচ্ছিলো।

মনিরা বললো–থামো।

বনহুর চুপ করে বসলো।

মনিরা দক্ষিণহস্তে রিভলভার বনহুরের পাঁজরে চেপে বামহস্তে তার পকেট হাতড়ে ওর ছোট্ট পিস্তলটা বের করে নিলো। তারপর বললো–গাড়ি চালাও।

গাড়ি নেহি চলেগা।

তবে কি মরতে চাও?

এবার বনহুর হেসে উঠলো–হাঃ হাঃ হাঃ কে তুমি নারী? তোমার কাছে দস্যু বনহুর আজ পরাজিত…বলো, বলো কে তুমি?

মনিরা বললো আমার পরিচয় জানতে তুমি পারবে না।

ভালবাসার বিনিময়েও তুমি..

না।

আমি জানি তুমি আমাকে ভালবাসো।

হাঁ বাসি, তাই বলে পরিচয় দিতে রাজি নই।

 তুমি বান্ধবী, বন্ধুর কাছে আত্মগোপন করে লাভ?

বন্ধু, আমি তোমাকে ভালবাসি, কিন্তু আমার কুৎসিত মুখ তোমাকে দেখাতে পারবো না। তুমি আমাকে দেখলে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেবে।

তাই তুমি আমার কাছে আত্মগোপন করে থাকো?

 হাঁ। আমি একজন অসহায় নারী। আমার জীবন অত্যন্ত বিষাদময়।

সব শুনেছি তোমার বান্ধবী মিসেস চৌধুরীর কাছে। সত্যই কি তোমার স্বামী…

 হাঁ, যা শুনেছো সব সত্য।

 বলো আমার পরিচয় তুমি জানলে কি করে?

সে কথা আজ নয়, বলবো একদিন। বন্ধু, বলো তুমি আমার মুখ কোনোদিন দেখতে চাইবে না?

 তা হলে তুমি সুখী হবে?

হাঁ, আমি সুখী হব। আর শপথ করছি, কাউকে কোনো দিন বলবো না তোমার পরিচয়।

 বেশ, চাই না আমি তোমার মুখ দেখতে।

 বাঁচালে বন্ধু।

রিভলভার সরিয়ে নাও।

তুমি যদি জোরপূর্বক আমার বোরখা উন্মোচন করো?

 দস্যু বনহুর যা বলে তার অন্যথা করে না। তুমি আমাকে বিশ্বাস করো।

মনিরা বনহুরের বুকের কাছ থেকে রিভলভার সরিয়ে নেয়। সে জানে, তার স্বামী যা বলে তা মিথ্যা। নয়।

বনহুর বললো এবার–আলেয়া।

 বলো?

আমাকে তুমি চেনো অথচ তুমি পুলিশ সুপারের আত্নীয়া হয়েও আমার পরিচয় তাকে জানাওনি কেন?

তোমাকে আমি ভালবাসি বলে।

আমাকে তুমি ভালবাসো? কিন্তু তাতে তোমার লাভ কি আলেয়া?

লাভ তোমার ভালবাসা পাবো বলে।

আলেয়া, তুমি বিবাহিতা। জানো না অপর পুরুষকে ভালবাসা তোমার পাপ?

যে নারীকে তার স্বামী অবহেলা করে, যাকে ত্যাগ করে স্বামী ভুলে থাকে সুদূর কোনো দেশে কি করে সে স্বামীর ভালবাসাকে আঁকড়ে ধরে একটা নারী জীবন কাটাতে পারে বলো?

আলেয়া!

তুমি জানো না, দিনের পর দিন আমি তার প্রতীক্ষায় প্রহর গুণেছি। কত রাত আমার কেটেছে অনিদ্রায়। কত রাত আমি তার পথ চেয়ে নীরবে অশ্রু বর্ষণ করেছি। তবু সে ফিরে আসেনি–নিষ্ঠুর পাষাণ সে।

দেশপ্রেমিক স্বামীর স্ত্রী তুমি, তাই তোমাকে এটুকু সহ্য করে নিতে হবে। তোমার স্বামী যে একজন মহান ব্যক্তি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আলেয়া, তুমি সৌভাগ্যবতী নারী।

না না, আমি অমন সৌভাগ্য চাই না। বন্ধু, আমাকে তুমি মিথ্যা সান্ত্বনা দিও না। আমার মন আছে, প্রাণ আছে। স্বামী-সংসার নিয়ে সুখে ঘর করি–এ সাধ আমারও আছে। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে মনিরা।

এ কাদা তার অভিনয় নয়, স্বামীর সান্নিধ্য তার অন্তরকে বিচলিত করে তোলে। মনিরা যা বলে চলে সেকথা তার হৃদয়ের কথা। মিথ্যা সে বলেনি, সত্যই তার কথাই সে ব্যক্ত করে চলেছে।

বনহুর সত্যই সঙ্কোচিত হয়ে পড়ে, বলে সে–আলেয়া, নারীর স্বামীই যে সবকিছু। স্বামীর জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দেওয়াই নারীর ধর্ম।

উঃ কি নিষ্ঠুর তুমি!

হাঁ, একথা সত্য। আলেয়া, আমিও কম অপরাধী নই। আমার জীবনটাও অত্যন্ত বেদনাভরা। আলেয়া, তুমি আমাকে অভিসম্পাত করো।

আমি চাই না তোমাকে অভিসম্পাত করতে। বলো তুমি আমাকে ভালবাসতে পারবে কিনা?

আমার জীবন সম্বন্ধে তুমি সব জানো না আলেয়া, তাই আমার মত একটা জঘন্য দস্যুর ভালবাসার জন্য তুমি লালায়িত হচ্ছে। তোমার স্বামীর চেয়েও আমি বেশি দোষী–বেশি অপরাধী।

হোক, আমি কিছু জানতে চাই না। আমি চাই তোমার মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দিতে।

আলেয়া, নিজেকে সংযত করো।

না, আমি তোমার জন্য পাগল হয়ে যাবো।

চলো তোমাকে বাংলোয় পৌঁছিয়ে দিয়ে আসি।

আমি বাংলায় যাবো না।

যাবে না?

না।

কোথায় যাবে?

 তোমার সঙ্গে।

হেসে উঠলো বনহুর–আমার সঙ্গে? কিন্তু জানো আমার সঙ্গে গেলে তুমি নিজেকে গোপন রাখতে পারবে না?

তবু তুমি আমাকে গ্রহণ করবে তো?

আলেয়া-না না, তা হয় না।

কেন হয় না, আমি কুৎসিত কদাকার বলে?

না, আমি দস্যু কিন্তু শয়তান, পাপাচার নই। আলেয়া, তুমি আমাকে ক্ষমা করো।

বনহুর এবার ড্রাইভিং আসনে সোজা হয়ে বসে গাড়িতে স্টার্ট দিলো।

 আলেয়া নিশ্চুপ বসে রইলো মূর্তির মত।

 মনিরা বাংলোয় ফিরে এলো।

মাসুমা অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিলো, মনিরাকে নিয়ে প্রবেশ করলো তার কক্ষে। বললো মাসুমা–কি ঘটলো বোন্ এবার?

মনিরা সব খুলে বললো।

মাসুমা আনন্দভরা কণ্ঠে বললো–তোর স্বামীকে আমি শ্রদ্ধা জানাই মনিরা। নির্জন পথে একটা নারীর প্রেমকে যে পুরুষ উপেক্ষা করতে পারে সে সত্যি কত বড় হৃদয়বান–কত বড় মহৎ-চরিত্র।

*

বনহুর বাসায় ফিরে গভীরভাবে চিন্তা করে, আজ নতুন করে মনে পড়ে তার মনিরার কথা। সত্যি কতদিন তার সংবাদ জানে না সে। সেও তো নারী, তারও তো মন আছে, প্রাণ আছে–স্বামী, সংসার। নিয়ে ঘর করার বাসনা আছে। ছিঃ ছিঃ কি ভুলই না সে করেছে। একটা নিষ্পাপ ফুলের মত জীবনকে সে এভাবে বিনষ্ট করে দিয়েছে। আজ মনিরার জন্য কোথাও বিয়ে হলে সে কত সুখী হতো! আর আজ। তার মনে অহরহ দুর্বিসহ জ্বালা বহন করে চলেছে। আবার কতদিন পর ফিরে যেতে পারবে সে কান্দাই শহরে, তবেই না তার দেখা হবে মনিরার সঙ্গে।

তবে কি মনিরাও আলেয়ার মত অপর কোনো পুরুষের কাছে প্রেমভিখারিনী! না, না, মনিরা সে রকম মেয়ে নয়, সে ধর্মশীলা নারী। তার মধ্যে পাপ বাসনা কোনোদিন উদয় হতে পারে না। মা আছেন, নূর আছেন, সরকার সাহেব আছেন….

বনহুর শয্যায় গা এলিয়ে দেয়।

 রাত বেড়ে আসে।

আজ বনহুরের চোখে ঘুম নেই–আলেয়ার সান্নিধ্য তাকে মনিরার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। বার বার চোখের সম্মুখে ভেসে উঠেছে ঐ মুখখানা। কতদিন মনিরাকে দেখেনি সে।

বনহুর পায়চারী করছে।

সিগারেটের পর সিগারেট নিঃশেষ করে চলেছে সে।

 রাত গম্ভীর হয়ে আসে।

হঠাৎ একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পায় বনহুর। থমকে দাঁড়ায়, কোনো শব্দ উচ্চারণ করে না সে।

ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসে।

 বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বলে–আলেয়া তুমি!

হাঁ, পারলাম না থাকতে।

এতো রাতে এলে কেন?

 বন্ধু, আমাকে ফিরিয়ে দিও না।

আলেয়া, তুমি আমার মনে আগুন ছড়িয়ে দিয়েছো। তবু আমি তোমাকে ক্ষমা করলাম–যাও, যাও আলেয়া, ফিরে যাও তুমি।

বন্ধু, তুমি এত হৃদয়হীন!

আমি তার চেয়েও কঠিন।

 কিন্তু একদিন আমার কাছে তুমি ধরা দিতে বাধ্য হবে।

আমি শুনতে চাই না তোমার কোনো কথা। যাও তুমি। তোমার মত মনোবৃত্তিসম্পন্না মেয়েকে আমি ঘৃণা করি।

বনহুরের কঠিন কথাগুলো মনিরার হৃদয়ে যেন সুধা বর্ষণ করলো। তার স্বামীর চরিত্র সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হলো আজ মনিরা। অনাবিল এক আনন্দ নিয়ে ফিরে এলো সে বাংলোয়।

*

কয়েকদিন বেশ কেটে গেলো।

একদিন সন্ধ্যায় মনিরা নিজের কামরা থেকে শুনতে পেলো মাসুমার কণ্ঠস্বর–রিভলভারে গুলী ভরে কোথায় যাচ্ছো শুনি?

চাপা স্বরে বললেন হাশেম চৌধুরী–চৌকানিপুরে যাবো। সেখানে এক বাড়িতে আজ রাত্রির ভয়ঙ্কর হানা দেবে বলে জানা গেছে।

কি বললে রাত্রির ভয়ঙ্কর হানা দেবে? মাসুমার গলার আওয়াজ কম্পিত মনে হলো!

হাশেম চৌধুরী বললেন–এটা আমাদের চক্রান্ত, বুঝলে? চৌকানিপুরের ব্যবসায়ী হরিনাথ আজ এক কোটি টাকা ব্যাংক থেকে উঠিয়ে কিছু হীরা-মনি-মুক্তা ক্রয় করেছে। এই হীরা-মনি-মুক্তা ক্রয় সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে দিল্লীর নগরীতে। কাজেই রাত্রির ভয়ঙ্করের কানেও এ সংবাদ পৌঁছতে বিলম্ব হয়নি। নিশ্চয় সে ঐ মনি-মুক্তা সংগ্রহে সেখানে গমন করবে।

সর্বনাশ, পারবে তাকে গ্রেফতার করতে? শুনেছি সেই রাত্রির ভয়ঙ্কর নাকি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর

তার চেয়েও আমরা ভয়ঙ্কর ব্যবস্থা অবলম্বন করেছি। বাড়ির চারদিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে বিদ্যুৎ নেই। নিশ্চয়ই আজ রাত্রির ভয়ঙ্করের শেষ রাত্রি। আজ সে তড়িতাহত হয়ে মৃত্যুবরণ করবে। সে টেরও পাবে না আমাদের এ ষড়যন্ত্রের কথা।

তাহলে রিভলভার কি হবে শুনি?

কোনো সময় অস্ত্র ছাড়া পথ চলতে নেই। এটা রেখে দিলাম হঠাৎ যদি কোনো প্রয়োজন বোধ করি তখন কাজে লাগবে।

মনিরার মুখ কালো হয়ে উঠলো। স্বামীর অমঙ্গল চিন্তায় মন তার অস্থির হয়ে পড়লো। কেমন করে আজ ওকে আটকানো যায়। সত্যি যদি চৌকানিপুরে যায় সে, তাহলে তড়িতাহত হয়ে মৃত্যুবরণ করবে তাতে কোনো ভুল নেই। যেমন করে হোক বাঁচাতেই হবে তাকে।

হাশেম চৌধুরী পোশাক পরে পুলিশ ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

মনিরা অমনি মাসুমার কক্ষে এসে হাজির হলো–হ্যাঁ রে, চৌধুরী সাহেব কোথায় গেলেন?

ও নাম করতে আমার ভয় হয়। রাত্রির ভয়ঙ্করকে গ্রেফতার করতে গেলো। কিন্তু কি যে হবে, আমার কিন্তু বড্ড ভয় করছে।

সত্যি, আমারও কিন্তু বড্ড ভয় হচ্ছে মাসুমা। হঠাৎ যদি সে আমাদের বাংলোয় হানা দিয়ে বসে! মানে উল্টা কাজ করে?

তাই তো, রাত্রির ভয়ঙ্করের অসাধ্য কিছু নেই।

এক কাজ করবি মাসুমা?

কি কাজ?

ওকে যদি ধরে এনে আজ রাতটা এখানে রাখা যেতো।

 ঠিক বলেছিস মনিরা। এখন আমাদের আপন জন বলতে ঐ রঞ্জন বাবু ছাড়া আর কে আছে বল। হাঁ, ওকেই আনতে হবে। বাংলো পাহারা দেওয়াও হবে, পিয়ানো শোনাও হবে। সত্যি, ঠিক বুদ্ধি বের করেছিস্ মনিরা।

তাহলে চল্ যাওয়া যাক্।

হ চল্।

মনিরা আর মাসুমা স্বপনদের বাড়ি এসে হাজির হলো। কল্পনা তো ওদের দু’জনাকে দেখে আনন্দে উচ্ছল হয়ে উঠলো। স্বপন ছুটে গেলো রঞ্জন বাবুর ঘরেরঞ্জনদা, দেখবে এসো কারা এসেছেন!

বনহুর এলো, দেখলো মিসেস চৌধুরী আর বোরখাধারিনী এসে তাদের হলঘরে দাঁড়িয়েছে।

 বললো মাসুমা–রঞ্জন বাবু, বিশেষ প্রয়োজনে এলাম আপনার কাছে।

আমার কাছে?

 হাঁ, শুধু আপনার কাছে।

 কেন বলুন তো?

 আজ আমাদের বাংলোয় আপনাকে যেতে হবে।

 অসম্ভব।

কেন?

আমার একান্ত প্রয়োজন আছে, একটু পরে বাইরে যেতে হবে।

এবার বোরখাধারিনী বলে উঠলো–আমাদের চরম বিপদ, না গেলেই নয়।

কিন্তু আমার পক্ষে আজ সম্ভব হবে না।

আর যদি সে-পথ বন্ধ হয়ে যায়?

বনহুর ক্রুদ্ধভাবে তাকালো বোরখাধারিনীর দিকে।

বোরখাধারিনী বললো–আমি বললাম আজ আমাদের বাংলোয় তোমাকে যেতে হবে। এসো, এক্ষুণি এসো আমার সঙ্গে।

স্বপন আর কল্পনা আশ্চর্য হয়ে গেছে।

মাসুমা কিন্তু মুখ টিপে হাসছে।

বনহুর বললো–আচ্ছা আপনারা যান, আমি যাবো।

তা হবে না, আমাদের সঙ্গে এসো। এসো বলছি,

 চলুন…বনহুর অন্য সময় হলে বোরখাধারিনীকে তুমি বলে সম্বোধন করতো, কিন্তু এ মুহূর্তে সে তাকে আপনি বলে।

বনহুরসহ ফিরে এলো মাসুমা আর মনিরা বাংলোয়।

মাসুমা বললো–আমাদের বিপদকালে আপনি আমাদের সহায়। উনি নেই, আপনিই আমাদের ভরসা।

ভয় কি, পুলিশ ফোর্স আছে।

আপনার পিয়ানো শুনে রাত কাটিয়ে দেবো রঞ্জন বাবু।

উঁহু, আজ পিয়ানো বাজবে না আমার হাতে।

কেন?

মনের অবস্থা ভাল নেই।

 তাহলে আমার বান্ধবীর বীণার সুর শুনুন। কি রে আলেয়া, রাজি আছিস তো?

উনি যখন পিয়ানো শোনাবেন না তখন আমি বীণা বাজাতে রাজি আছি। কিন্তু এক শর্তে আমি বীণা বাজাবো।

বল কি সে শর্ত?

আমি যতক্ষণ বীণা বাজাবো ততক্ষণ তোরা শুনবি। কারো ঘুমানো চলবে না কিন্তু।

মাসুমা বললো–বেশ আমি রাজি। কি বলেন রঞ্জন বাবু, আপনি?

আমার শরীর আজ ভাল নয়, কাজেই..

ও, আপনি তাহলে ঘুমাবেন এই তো? বেশ যতক্ষণ পারেন জেগে থাকবেন…নাও শুরু করো আলেয়া।

আলেয়া বোরখার মধ্য হতে তার সুন্দর সুকোমল হাত দু’খানা বের করে বীণাটা তুলে নিলো কোলের উপর।

ইতিমধ্যে বীণা এসে গিয়েছিলো মাসুমার নির্দেশে। আর এসেছিলো চা-নাস্তা।

পরিবেশন করলো মাসুম।

মনিরার হাতে বীণার ঝঙ্কার উঠলো।

বিস্ময়ে তন্ময় হয়ে গেলো বনহুর, সুর তার সমস্ত মনকে আচ্ছন্ন করে ফেললো।

 চা পান করছে বনহুর। রাত বেড়ে আসছে।

 মনিরার হাতে বীণা আর থামতে চায় না।

 বনহুর বিমুগ্ধ হয়ে গেছে।

মাসুমার দু’চোখ মুদে আসছে নিদ্রায়।

মনিরার হাত অবশ হয়ে আসে, তবু সে বীণা বাজিয়ে চলে। বীণা থেমে গেলে ওকে আর আটকে রাখতে পারবে না মনিরা। হয়তো সে ঘুমিয়ে পড়বে, সেই ফাঁকে পালিয়ে যাবে ও। না না, তা হবে না, বীণা তাকে বাজাতেই হবে।

মাসুমা সোফায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে।

 মনিরা আসনে বসে বীণা বাজিয়ে চলেছে।

পাশের সোফায় বনহুর স্বয়ং বসে, তার দু’চোখে এক উন্মাদনা।

বীণার সুর তাকে আত্নহারা করে ফেলেছে যেন। আকাশ-বাতাস সব যেন মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে সে সুরে।

বনহুর উঠে দাঁড়ালো আসন ত্যাগ করে। তাকালো নিদ্রিত মাসুমার মুখের দিকে। এগিয়ে গেলো মনিরার পাশে। বসলো ঘনিষ্ঠ হয়ে, হাত রাখলো মনিরার হাতের উপর–বন্ধ করো আলেয়া তোমার বীণার সুর। আমাকে মুক্তি দাও…

মনিরার হাতে বীণা থেমে যায়।

বলে মনিরা–আজ তুমি মুক্তি পাবে না।

আলেয়া, আমাকে যেতেই হবে। রাত্রির ভয়ঙ্কর আসবে না। কোনো ভয় নেই তোমাদের।

ভয় আমরা করি না।

তবে কেন আমাকে এভাবে আটকে রাখলে?

 আজ নয়, বলবো আর একদিন।

আমাকে যেতে দাও আলেয়া?

না।

সব নষ্ট করে দিলে?

আমি সব জানি, তোমাকে আজ ছেড়ে দিতে পারবো না। প্রাণ গেলেও না।

মনিরা আবার বীণায় ঝঙ্কার তুললো।

 বনহুর ফিরে এসে বসলো তার আসনে। সিগারেট ধরালো।

 মনিরা বীণা রেখে উঠে দাঁড়ালো।

মাসুমা আর জেগে থাকতে না পারায় চলে গিয়েছিলো নিজের ঘরে। শুয়ে পড়েছিলো বিছানায়, গোটা রাত জেগে থাকা তার পক্ষে অসহ্য।

বনহুর কখন যে সোফায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে।

মনিরা বীণা রেখে উঠে গিয়ে চাদরটা এনে বনহুরের শরীরে চাপা দিলো। মাথার নিচে একটি নরম বালিশ যত্ন সহকারে গুঁজে দিলো। তারপর বনহুরের মাথার চুলে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে চললো।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো বনহুরের।

 ঘুম ভাঙলেও সে ঘুমের ভান করেই শুয়ে রইলো। চোখ মেললো না সে।

 মনিরা তখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে চলেছে। কোমল মধুময় সে স্পর্শ।

বনহুরের শিরায় শিরায় একটা অনুভূতি আলোড়ন জাগালো। নিজেকে সে কিছুতেই ধরে রাখতে পারছে না যেন; তবু নিশ্চুপ রইলো, দেখবে কি করে আলেয়া। বনহুর নিজের ললাটে একটি উষ্ণ নিশ্বাস অনুভব করে। দুটি ওষ্ঠ স্পর্শ করে তার কপাল। ধৈর্যচ্যুত হয় না তবু সে।

ঠিক সে মুহূর্তে কোনো মসজিদ থেকে ভেসে আসে মোয়াজ্জেমের কণ্ঠ সুমধুর আযানধ্বনি।

ভোর হয়ে গেছে।

একি, আলেয়া তার পায়ে মাথা রেখে অশ্রু বিসর্জন করছে! আশ্চর্য হলো বনহুর। এবার বনহুর সোজা হয়ে বসলো, অবাক কণ্ঠে বললো–আলেয়া তুমি!

সঙ্গে সঙ্গে বোরখাধারিনী মনিরা ছুটে চলে গেলো।

স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো বনহুর। মনের মধ্যে নানারকম চিন্তা হতে লাগলো তার। আশ্চর্য মেয়ে আলেয়া, এমন মেয়ে তো সে কোনোদিন দেখেনি। তাকে ভালবাসে বলে অথচ ধরা দেওয়া বা নিজেকে কোনোসময় মুক্ত করে না তার সামনে।

বনহুর সোফা ছেড়ে উঠে পড়ে।

বাথরুমে প্রবেশ করে সে।

তারপর যখন বাথরুম থেকে ফিরে আসে তখন সে দেখতে পায় তার সোফায় একটা চিঠি পড়ে আছে। ভাঁজ করা একখানা কাগজ।

বনহুর কাগজখানা উঠিয়ে নেয় হাতে; ওটাতে লিখা আছে কয়েক লাইন—

 বন্ধু, তোমাকে ধরে রেখেছিলাম কেন নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো? আজ রাতে তোমার চৌকানিপুরে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু সেখানে গেলে তুমি আর ফিরে আসতে না জানি। ওখানে তোমাকে হত্যার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছিলো। তড়িতাহত হতে তোমাকে উদ্ধার করতে সক্ষম। হয়েছি বলে খোদার কাছে আমি হাজার শুকরিয়া করছি। তোমার –বান্ধবী

বনহুর চিঠিখানা হাতে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোখের সম্মুখে ভাসতে লাগলো একটা মৃত্যু-বিভীষিকা রাত।

এমন সময় বাইরে মোটরের হর্ণ শোনা গেলো।

হলঘরে প্রবেশ করলেন হাশেম চৌধুরী। বনহুরকে দেখে খুশিতে আনন্দধ্বনি করে উঠলো– হ্যালো রঞ্জন বাবু, গুড মর্নিং।

গুড মর্নিং মিঃ চৌধুরী।

হাশেম চৌধুরী রিভলভারসহ বেল্ট খুলতে খুলতে বললেন–ওরা বুঝি আজ রাতে আপনার শরণাপন্ন হয়েছিলো?

হাঁ, দেখতেই পাচ্ছো। উনি না হলে উদ্ধার ছিলো আমাদের? কথাটা বলতে বলতে হলঘরে প্রবেশ করে মাসুমা। একটু থেমে বলে–কি হলো, পাকড়াও করেছে তোমার সেই রাত্রির ভয়ঙ্কর দস্যুটাকে?

হাশেম চৌধুরী বেল্টসহ রিভলভারখানা টেবিলে রেখে একটা সোফায় বসে পড়লেন, হাই তুলে বললেন–সব ব্যর্থ হয়েছে। এতো পরিশ্রম সব পণ্ড হয়ে গেছে।

বনহুর আলগোছে চিঠিখানা পকেটে রেখে বসে পড়লো। বললো সে–কেন সব পণ্ড হলো মিঃ। চৌধুরী?

আর বলবেন না, রাত্রির ভয়ঙ্করকে গ্রেফতারের জন্য আজ প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে চৌকানিপুরে একটা বাড়িতে কৌশলে ফাঁদ পেতেছিলাম। প্রায় বিশ হাজার টাকা খরচ করে সমস্ত বাড়িটার ইলেকট্রিক কারেন্ট দ্বারা তড়িৎ প্রবাহ সৃষ্টি করা হয়েছিলো।

বনহুর অবাক হয়ে শুনছে, সত্যি তো এতোটা জানতো না। সে শুধু এটুকুই জানতো, চৌকানিপুরের ব্যবসায়ী হরিনাথ প্রায় কোটি টাকার মনি-মুক্তা ক্রয় করে এনেছে। তাই বনহুর প্রস্তুতি নিয়েছিলো ঐ মনি-মুক্তাগুলো হরিনাথের কবল থেকে উদ্ধার করে ছড়িয়ে দেবে যমুনার জলে, নয়তো দিল্লীর পথে পথে।

এ তো জানতো না সে নিশ্চয়ই আজ সেখানে গেলে মৃত্যু তার সুনিশ্চয় ছিলো। বনহুর বোরখাধারিনীকে অন্তরে অন্তরে ধন্যবাদ জানায়।

তারপর চলে চা-নাস্তা পর্ব।

খেতে খেতে নানারকম গল্পসল্প বলে। হাশেম চৌধুরীর কথা শুনে হাসে বনহুর। রাত্রির ভয়ঙ্করই যে স্বয়ং দস্যু বনহুর!

এক সময় বনহুর বিদায় নিয়ে চলে এলো। কিন্তু গত রাতের ঘটনা তার মনের আকাশটাকে আচ্ছন্ন করে রাখলো। বার বার দুটি উষ্ণ ওষ্ঠের কোমল স্পর্শ অনুভব করতে লাগলো নিজের ললাটে। সব সময় মনে পড়তে লাগলো–বোরখাধারিনী তার পায়ে মাথা রেখে অশ্রু বিসর্জন করছিলো কেন।

সমস্ত দিন বনহুর একটি মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারলো না বোরখাধারিনীকে।

স্বপন আর কল্পনা এ কথা সে-কথা নিয়ে তাকে কত কি প্রশ্ন করতে লাগলো কিন্তু আজ বড় গম্ভীর উদাসীন মনে হলো রঞ্জন দাদাকে!

বিকেলে বনহুর একাই গাড়ি নিয়ে বের হলো। কোথায় চলেছে, কেন চলেছে, সে নিজেই জানে না।

দিল্লীর রাজপথ।

অগণিত-পথচারী ফুটপাত ধরে এগিয়ে চলেছে! সবাই কর্ম ব্যস্ত।

এদিক-সেদিন ছুটে চলেছে অগণিত যানবাহন।

বনহুর আপন মনে গাড়ি চালাচ্ছে। মনের মধ্যে তার নানা চিন্তাজাল ঘুরপাক খাচ্ছিলো। দৃষ্টি ছিলো তার সম্মুখে। হঠাৎ একটা আর্ত চিৎকারে বনহুর ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে ফেলে।

একটা বৃদ্ধ সাপুড়ে চাপা পড়েছে তার গাড়ির নিচে।

বনহুর দ্রুত নেমে গিয়ে বৃদ্ধকে তুলে ধরলো, মাথায় আঘাত লাগায় লোকটা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। বনহুর তাড়াতাড়ি তাকে গাড়িতে তুলে নিলো, তারপর চললো হসৃপিটালে।

হসপিটালে ভর্তি করে দিলো বনহুর বৃদ্ধ সাপুড়েকে। যত টাকা-পয়সা লাগে দেবো আশ্বাস দিলো ডাক্তারকে বনহুর। নিজে বসে রইলো তার পাশে, যতক্ষণ সংজ্ঞা ফিরে না আসে ততক্ষণ বনহুর উঠলো না।

হসপিটালের বড় ডাক্তার চিকিৎসা শুরু করলেন।

বনহুর বিপুল উদ্বিগ্নতা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। তার দস্যুপ্রাণ আজ ব্যথায় কাতর হয়ে পড়লো, এক বৃদ্ধ সাপুড়ের জন্য তার মনে শুরু হলো দারুন অস্থিরতা। একি হলো, এমন ভাবে একটা জীবন তার গাড়ির তলায় বিনষ্ট হবে, এ যেন সে ভাবতেও পারেনি। না জানি বৃদ্ধের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, আত্নীয়স্বজন তারা কত আশা নিয়ে প্রতীক্ষা করছে। হয়তো বা বৃদ্ধ সাপুড়ের রোজগারের উপরই নির্ভর করছিলো তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব-ভার। এখন কে দেখবে তাদের, কে জোগাবে তাদের মুখে আহার। বনহুর এসব চিন্তা করতে লাগলো।

*

সেদিন গোটা রাত প্রায় হসপিটালে কাটিয়ে অনেক রাতে ফিরে এলো বনহুর।

স্বপন আর কল্পনা পরদিন উদ্বিগ্নভাবে জিজ্ঞাসা করলো, কাল কোথায় গিয়েছিলে রঞ্জনদা? কেন ফেরেননি? কোনো বিপদ ঘটে নি তো!

বললো বনহুরহ, বিপদই ঘটেছিলো। তারপর সব কথা খুলে বললো বনহুর স্বপন ও কল্পনার কাছে।

এরপর থেকে বনহুর রোজ হসপিটালে যাওয়া-আসা শুরু করে দিলো। ঔষধপথ্য, টাকা-পয়সা যা লাগে সব দিতে লাগলো অজস্রভাবে।

চিকিৎসায় একদিন আরোগ্য লাভ করলো বৃদ্ধ সাপুড়ে।

আনন্দ ধরে না বনহুরের। বৃদ্ধ সাপুড়েকে জড়িয়ে ধরে বুকে, তারপর এক থলে টাকা গুঁজে দেয় তার হাতে, বলে তাকে–যতদিন বাঁচবে বসে খেও। সাপ খেলা আর তোমাকে দেখাতে হবে না।

আনন্দে বৃদ্ধ সাপুড়ের চোখ দুটো চক্ চক্ করে উঠে। খুশি হয় সাপুড়ে বৃদ্ধ বনহুরের ব্যবহারে।, তাদের সাপুড়ে ভাষায় আশীর্বাদ করে সে তাকে।

বনহুর তো অবাক।

তার গাড়ির নিচে চাপা পড়ে প্রাণ যাচ্ছিলো, অথচ তাকেই এতো সমীহ! বললো বনহুর–চলো তোমাকে তোমার আস্তানায় পৌঁছে দিয়ে আসি।

সাপুড়ে বললো–আপনার বড় দয়া বাবুজী।

বনহুর নিজের গাড়িতে তুলে নেয় সাপুড়ে বৃদ্ধকে।

 শহরের শেষ প্রান্তে সাপুড়ে পল্লী।

বনহুর গাড়ি ড্রাইভ করে চলেছে।

পিছন আসনে বসে আছে সাপুড়ে বৃদ্ধ।

শহরের মধ্যপথ ধরে গাড়ি এগিয়ে চলেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বনহুরের গাড়ি শহরের প্রান্তে এসে পৌঁছলো।

এক জায়গায় কতগুলো লোক হইহুল্লোড় করে চিৎকার করছে। সমস্ত কণ্ঠ ছাপিয়ে একটা নারীকণ্ঠ শোনা গেলো–বাচাও, বাঁচাও…

বৃদ্ধ সাপুড়ে বলে উঠলো–বাবুজী, আমার মাইয়াকে কেউ ধরিয়া নিয়া যাইতেছে। ঐতো হামার ম্যাইয়ার আওয়াজ পাইতেছি। বাবুজী ঐ যে দেখা যাইতেছে।

বনহুরের দৃষ্টি চলে গেলো সম্মুখের ভীড়ের দিকে কিছু দুরে। দেখলো একটা সাহেবী পোশাক-পরা লোক একটি ঘাগড়া-পরা মেয়েকে টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে তুলছে।

বনহুর মুহূর্তে নেমে পড়লো গাড়ি থেকে। দ্রুত এগিয়ে চললো ভীড় ঠেলে। কিন্তু সে গাড়ির নিকটে পৌঁছবার পূর্বেই লোকটা মেয়েটিকে গাড়ির মধ্যে তুলে নিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিলো।

থমকে দাঁড়ালো বনহুর।

সাপুড়ে ততক্ষণে নেমে এসে বনহুরের পা জাপটে ধরলো। বাবুজী বাঁচাইয়া নিন। ওকে বাঁচাইয়া নিন বাবুজী…

বনহুর কোনোদিকে লক্ষ্য না করে ক্ষিপ্রগতিতে এসে গাড়িতে চেপে বসলো, সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি উল্কা বেগে ছুটতে শুরু করলো।

সম্মুখের গাড়ি তখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। গাড়িতে দু’জন আছে বুঝতে পারে বনহুর। কোনোদিকে না তাকিয়ে সামনের গাড়িখানাকে ফলো করে চললো সে। অগণিত ভীড়ের মধ্যে সাবধানে তাকে গাড়ি চালাতে হচ্ছে, কিন্তু সামনের গাড়িখানা যেন দৃষ্টির আড়ালে চলে না যায় সেদিকে বনহুরের তীব্র নজর রয়েছে।

সামনের গাড়িখানা শহর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো বাইরের বাঁকা পথ ধরে। বনহুর এবার খুশি হলো, এতে তার সুবিধা হলো আরও বেশি, কারণ এখন গাড়ি চালাতে তাকে বেশি বেগ পেতে হচ্ছে না।

সম্মুখের গাড়ি তীরবেগে ছুটে চলেছে। পাকা সড়ক ত্যাগ করে মেঠো পথ ধরে গাড়িখানা অগ্রসর হলো।

বনহুরের গাড়িও নেমে পড়লো মেঠো পথে।

 উঁচু-নীচু অসমতল পথ।

হঠাৎ সম্মুখে আর একটি পথ দেখতে পেয়ে বনহুর সে পথে ডবলস্পীডে গাড়ি চালিয়ে দিলো। এবং কৌশলে সম্মুখস্থ গাড়ির পথ আগলে দাঁড়িয়ে পড়লো।

বাধ্য হলো শয়তান দুষ্ট লোক গাড়ি থামিয়ে ফেলতে।

বনহুর লাফিয়ে নেমে পড়লো, তরপর দ্রুত ছুটে গিয়ে গাড়ির ড্রাইভ আসন থেকে লোকটাকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে নিলো। তারপর চললো ঘুসির পর ঘুসি। তুমুল ধস্তাধস্তি শুরু হলো।

গাড়ির মধ্যে ছিলো দ্বিতীয় এক ব্যক্তি। সে-ই মেয়েটিকে এঁটে ধরে ছিলো।

বনহুর আর ড্রাইভার যখন ধস্তাধস্তি হচ্ছিলো তখন লোকটা মেয়েটিকে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে পালাবার আয়োজন করছিলো। টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে সে মেয়েটিকে।

বনহুর ড্রাইভারের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করলেও তার দৃষ্টি ছিলো মেয়েটির দিকে। এবার সে ড্রাইভারকে পরপর কয়েকটা ঘুসি লাগিয়ে কাবু করে ফেলে ছুটে চলে যে দুষ্ট লোক মেয়েটি নিয়ে পালাচ্ছিলো তার দিকে।

লোকটা মেয়েটিকে নিয়ে অনেকটা এগিয়ে গেছে জঙ্গলের দিকে!

বনহুর ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো লোকটার উপর। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে লোকটা আক্রমণ করলো বনহুরকে।

শুরু হলো আবার মল্লযুদ্ধ।

 সেকি ভীষণ লড়াই!

ধূলো-মাটি আর বালির মধ্যে তুমুল ধস্তাধস্তি।

বনহুরের সঙ্গে পেরে উঠে সাধ্য কার!

বনহুরের ঘুসি খেয়ে অল্পক্ষণেই দুষ্ট লোকটার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়লো। এবার সে ভো দৌড় দিলো জঙ্গলের দিকে।

লোকটা পালিয়ে যেতেই বনহুর ফিরে দাঁড়ালো।

 অমনি ছুটে এসে বনহুরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো মেয়েটি।

বনহুর বিস্ময়ভরা কণ্ঠে উচ্চারণ করলো–নূরী!

 হুর, কোথায় ছিলে তুমি এতোদিন?

 বনহুর এবার গম্ভীর হয়ে পড়লো, নূরী প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে বললো–কেশব কোথায়?

 ও আছে। হুর, আমি ভাবতেও পারিনি, তুমি এসময় আসবে। কোথায় এতোদিন ছিলে বলো তো?

বনহুর কোনো জবাব দিলো না, বললো–চলো কেশবের নিকটে তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

বনহুর গাড়ির দিকে অগ্রসর হলো।

নূরী পিছনে পিছনে এগুলো।

ড্রাইভ আসনে বনহুর উঠে বসতেই, নূরী তার পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো–হুঁর, তুমি কোথায় ছিলো এতোদিন? আমি যে তোমার জন্য কেঁদে কেঁদে পাগল হয়ে পড়েছি।

হেসে উঠলো বনহুর…অট্টহাসি। তারপর হাসি থামিয়ে দাঁত পিষে বললো–পাগল! জানতাম না। তোমার মধ্যে এতোখানি ছলনা লুকিয়ে ছিলো।

হুর, একি বলছো তুমি! আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না।

বনহুর গাড়িতে স্টার্ট দেয়। গাড়ি ছুটে চলে শহর অভিমুখে।

 নূরী কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো–কথা বলছো না কেন? কি হলো তোমার হুর, বলো?

বনহুর তবু নীরব।

নূরী হ্যাণ্ডেলের উপর বনহুরের হাতখানা চেপে ধরে–বলো কি ছলনা আমি করেছি তোমার সঙ্গে? বলো জবাব দাও?

বনহুরের মুখমণ্ডল রাগে রক্তের মত লাল হয়ে উঠছে। অধর দংশন করছে সে।

নূরী এবার ব্রেক কষে ধরলো–জবাব না দিলে আমি তোমাকে গাড়ি চালাতে দেবো না।

নূরী! কঠিন কণ্ঠে বনহুর গর্জে উঠলো।

 হুর, বলো আমি কি অন্যায় করেছি যার জন্য তুমি আমার উপর ক্রুদ্ধ হচ্ছো?

এবার বনহুর গাড়ি থামিয়ে ফেললো, গম্ভীর গলায় বললো–কেন তুমি আমাকে পূর্বে বলেছিলে না। কেশবকে তুমি ভালবাসো? আমি তাহলে তোমাকে স্পর্শ করতাম না।

নূরী অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলো–হুর!

আমার কাছে কোনোরকম মিথ্যা কথা বলবে না নূরী।

তুমি বিশ্বাস করো, কেশবকে আমি ভালবাসি কিন্তু ভাই-এর মত। হুর, তোমার নূরী কোনোদিন অপরের হবে না বা হতে পারে না। এখনও তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

বনহুর বললো–কেশবের সঙ্গে তোমার যদি ভাই-এর সম্বন্ধ, তাহলে ওর সঙ্গে কেন তুমি পালিয়েছিলে?

কে বললো আমি কেশবের সঙ্গে পালিয়েছি? হুর, একথা তুমি ভাবতে পারলে? এবার বুঝতে পেরেছি সব…বলো তুমি কতদিন পর সেই জঙ্গলে ফিরে গিয়েছিলে?

কয়েকদিন পর জঙ্গলে ফিরে গিয়ে তোমাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাইনি।

ওঃ তুমি তাহলে আবার গিয়েছিলে? আজ আমি সব কথা বলবো তোমাকে। বাবাজী মরে যাবার পর তোমার জন্য দুদিন অপেক্ষা করেছিলাম আমরা সেই জঙ্গলে, কিন্তু বাবাজী নেই, তুমি নেই–শুধু কেশব ভাই আর আমি কি করে ঐ জঙ্গলে দুটি প্রাণী বাস করি বলো? তার তোমার সন্ধানে শহরের দিকে রওয়ানা হলাম। তারপর থেকে খুঁজে ফিরছি তোমাকে। এক সাপুড়ে সর্দার আমাকে কন্যার মত স্নেহ করে, তাই তার ওখানেই আমরা থাকি।

বনহুর নূরীর পা থেকে মাথা অবধি লক্ষ্য করে ব্যঙ্গপূর্ণ হাসি হেসে বললো–পেট চালানোর জন্য নাচনেওয়ালী সেজেছো, না?

হা, মিথ্যা আমি কোনোদিন তোমাকে বলিনি; কোনোদিন বলতে পারবো না।

 বেশ তো, ভালই এক পথ বেছে নিয়েছে। চলো তোমার আস্তানায় পৌঁছে দিয়ে আসি।

আর তুমি?

 বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বললো এবার আমার অনেক কাজ আছে।

না, আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না, হুর, আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।

নূরী, আমি যেখানে থাকি সেখানে তোমাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না।

 কেন?

পরে বলবো, আজ চলো তোমাকে কেশবের কাছে পৌঁছে দিয়ে আসি।

তাই চলো তবে।

 গাড়ি পুনরায় চলতে শুরু করলো।

নূরী বনহুরের কাঁধে মাথা রেখে বললো–হুর, আজ আমার কি আনন্দ হচ্ছে জানো? আকাশের চাঁদ পেলেও এতো খুশি হতাম না। ইস, কি যে আনন্দ…

বনহুরের মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠে, বিশেষ করে নূরীকে পেয়ে সে নিজেও কম খুশি হয়নি! তবু নিজেকে যতদূর সম্ভব গম্ভীর রাখার চেষ্টা করে বনহুর।

নূরী বলে আবার–হুর, আমাকে রেখে চলে যাবে–আবার আসবে তো?

 চেষ্টা করবো।

না, সত্যি করে আমাকে কথা দিয়ে যেতে হবে। যদি আবার এসো তবেই আমি তোমাকে ছেড়ে দেবো।

আসবো।

শপথ করো আমাকে স্পর্শ করে?

গাড়ি চালাচ্ছি, দেখছো না আমার দু’হাত বন্ধ?

 নূরী দুটি বাহু দিয়ে বনহুরের গলা জড়িয়ে ধরে বলো সত্যি?

 হেসে বলে বনহুর–সত্যি!

বনহুরের মুখের হাসি নূরীর গোটা মনে ছড়িয়ে পড়ে। উচ্ছল হয়ে উঠে নূরী, বনহুরের বুকে মুখ লুকিয়ে বলে–আমার হুর!

সাপুড়েদের আস্তানায় পৌঁছবার পূর্বে বনহুর নূরীকে নিয়ে ফিরে আসে এক জায়গায়, যেখান থেকে নূরীকে জোর করে দুষ্ট লোক দুটো ধরে নিয়ে গিয়েছিলো।

বনহুর আর নূরী ফিরে এসে দেখলো, সাপুড়ে সর্দার নূরীর জন্য মাথা ঠুকে বিলাপ করছে…সত্যি সে নূরীকে এতোখানি ভালবেসে ফেলেছিলো! কেশবও অশ্রু বিসর্জন করে চলেছে।

চারদিকে ঘিরে ধরেছে অসংখ্য জনতা।

বনহুর আর নূরী নেমে দাঁড়াতেই সাপুড়ে সর্দার বনহুরকে জড়িয়ে ধরলো–বাবুজী, তুই বহুৎ ভাল কাম করিয়ছি। হামার মাইয়ারে তুই বাঁচাইয়া নিয়াছি…

কেশব তো বনহুরকে দেখতেই ছুটে এসে জাপটে ধরলো–বাবু তুমি? তুমি ফুলকে উদ্ধার করেছে।!

অগণিত জনতা সবাই স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছে।

এমন সময় রংলাল কোথা থেকে ভীড় ঠেলে এগিয়ে আসে, বনহুরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলে–হামাদের মাইয়্যাকে তুমি বাঁচাইবার কে। তুমি নিজের পথ দেখো।

বনহুর তখন প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট কেসটা বের করে একটা সিগারেট ঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরে অগ্নি সংযোগ করে নিলো, তারপর একমুখ ধূয়া সম্মুখে ছুঁড়ে দিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বললো–তুমি কে?

বুক ফুলিয়ে, দক্ষিণ হস্ত মুষ্ঠিবদ্ধ করে বললো রংলাল–হামি হীরালালের ভাতিজা রংলাল। হামাকে এ গাঁয়ের সবাই ভয় করে। আইসেছো, আর কোনোদিন এ পথে পা দিবে না।

রংলালের কথায় বনহুরের রাগ চরমে উঠে, পূর্বের ন্যায় কণ্ঠে বলে–আসবো, হাজার বার আসবো, তাতে তোমার কি?

খবরদার, এলে জান নিয়ে ফিরে যেতে পারবে না….

রংলালের কথা শেষ হয় না, বনহুরের বলিষ্ঠ হাতের ভয়ংঙ্কর একটি ঘুসি গিয়ে পড়ে তার নাকের উপর, সঙ্গে সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে ছিটকে পড়ে রংলাল ভূতলে।

এতোক্ষণে রংলাল বুঝতে পারে, যার সঙ্গে সে তাচ্ছিল্যভাবে কথা বলছে সে সাধারণ লোক নয়। গায়ের ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়ায় রংলাল, নাক বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে তার।

বনহুর কোনো কথা না বলে ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে একবার রংলালের দিকে তাকিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠে বসে।

গাড়ি দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়।

সাপুড়ে সর্দার হীরালাল ফিরে তাকায় রংলালের মুখে। রাগে-ক্ষেভে অধর দংশন করে বলে সে– এতো বড় হারামি লোক তুই, বাবুজী ফুলেরে বাঁচাই নিলো আর কিনা..

হাতের পিঠে নাকের রক্ত মুছে ফেলেছিলো রংলাল, দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললো–জানো, ও বাবুজী তুহার ফুলের রূপ দেইখ্যা পাগল হই গেছে। তাই তো ওহারে বাঁচাইয়া নিছে…

খুব ভাল কাম করিয়াছে। বাবুজী তো তোমার মত শয়তান আছে না। চল মাই ফুল, ঘর চল।

সাপুড়ে সর্দার হীরালাল নূরী আর কেশবকে নিয়ে ফিরে যায় তাদের সাপুড়ে পল্লীতে।

*

বনহরের দেখা পেয়েছে নূরী–আর কি তার মন স্থির থাকে! সব সময় তার প্রতীক্ষায় প্রহর গুণে সে। দিন যায়, রাত আসে রাত যায়, দিন হয়।

চঞ্চল হয়ে উঠে নূরী।

গভীর রাতে সমস্ত সাপুড়ে পল্লী যখন সুপ্তির কোলে ঢলে পড়ে তখন নূরী শয্যা ত্যাগ করে পা টিপে টিপে বেরিয়ে আসে বাইরে।

কুঠিরের দাওয়ায় শোয় কেশব। সে যেন জেগে না উঠে তাই পায়ের নূপুর জোড়া খুলে রাখে বালিশের তলায়।

সাপুড়ে পল্লীর অদুরে বেশ কিছু ফাঁকা জায়গা আছে, আশেপাশে আছে ছোট-বড় কিছু সংখ্যক শাল, পিয়াল আর দেবদারু গাছ।

নূরী দস্যু-কন্যা, সাহসী তার প্রাণ। ভয় বলতে কিছু জানে না সে। এগিয়ে যায় নূরী সেই নির্জন ফাঁকা প্রান্তরে। উঁচু একটা স্থানে দাঁড়িয়ে ইংগিতপূর্ণ শব্দ করে। সুমিষ্ট কণ্ঠের মিষ্টি একটা সুর ছড়িয়ে পড়ে সাপুড়ে পল্লীর চারদিকে।

নূরী তার আকুল কণ্ঠে আহ্বান করে বনহুরকে। যদি সে ফিরে যায়, চিনতে না পারে তার কুঠির।

প্রহর কেটে যায়।

নূরীর আশা সফল হয় না। আসে না তার আকাঙ্খিত জন। শেষ রাতের আকাশে জেগে উঠে ধ্রুবতারা, ফিরে আসে নূরী নিজের কুঠিরে, বিছানায় লুটিয়ে পড়ে কাঁদে। অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে নূরীর তেলচিটে বালিশটা।

হঠাৎ কারো করস্পর্শে চমকে উঠলো নূরী। মুখ মুলে তাকালো, সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলোতার চোখ দুটো। অস্পষ্ট স্বরে বললো–হুঁর!

নূরী! বনহুর ওর নামটা উচ্চারণ করলো। তারপর ওকে নিবিড় করে টেনে নিলো কাছে।

 নূরীর আনন্দ-অশ্রু ঝরে পড়তে লাগলো, ভিজে গেলো বনহুরের জামার কিছু অংশ।

গভীর আবেগে বনহুর বললো–কেন কাঁদছিলে?

বাস্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো নূরী–সেই যে চলে গেলে, কই তারপর তো একদিন এলে না?

অনেক কাজ ছিলো নূরী, শেষ করলাম।

চিরদিন তোমার কাজ আর কাজ। অবসর হবে না?

এবার হয়েছি, তোমাকে নিতে এসেছি নূরী। চলো আবার আমরা ফিরে যাই কান্দাই নগরে। রহমান কেমন আছে, আমার অনুচরগণ সবাই কেমন আছে কে জানে! তাজ হয়তো এতোদিনে শুকিয়ে মরে গেছে। নূরী, আর আমি দেশে থাকতে চাই না..

তোমার মত আমার মনও অস্থির হয়ে উঠেছে হুর। কতকাল আমি জন্মভূমি ত্যাগ করে এসেছি। আমিও যেতে চাই।

তবে চলো আমার সঙ্গে, আমি প্রস্তুত হয়ে এসেছি।

তা হয় না হুর। সাপুড়ে বাবা আমাকে নিজের মেয়ের মত স্নেহ করে, তাকে না বলে কি করে যাবো বলো? তাছাড়া কেশব ভাইকে একা ফেলে আমার যাবার উপায় কই?

নূরী, সাপুড়ে সর্দার যদি কোনোরকম আপত্তি করে বসে?

না না, বাবা তেমন লোক নয়।

সেদিনের সেই দুষ্ট লোকটা…

রংলাল! ওর কথা রেখে দাও। তুমি যদি পাশে থাকো তাহলে কাউকে ভয় করি না।

নূরী! বলো?

ভোর হয়ে এলো প্রায়।

হাঁ। ভোর হয়ে আসছে।

বনহুর ওকে বলিষ্ঠ বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে ফেললো। মুখখানা নেমে এলো ওর মুখের কাছে, আবেগভরা কণ্ঠে ডাকলো–নূরী!

বললো নূরী–ছিঃ, বাইরে কেশব ভাই আছে।

তাকে বলেই আমি এসেছি, কাজেই…

 তাই তো এতো স্পর্ধা তোমার!

হঠাৎ বনহুরের দৃষ্টি চলে যায় নূরীর গলায়, চমকে উঠে বনহুর। লণ্ঠনের আলোতে নূরীর গলায় মনিরার দেওয়া চেন-মালাটাই তার নজরে পড়েছে।

বনহুর নূরীকে মুক্তি দিয়ে লণ্ঠনটা তুলে নেয় হাতে। সলতে বাড়িয়ে উঁচু করে ধরে নূরীর গলার কাছে, তারপর বামহস্তে চেন-মালাটা উল্টেপাল্টে দেখে এক জায়গায় চাপ দিয়ে ঢাকনাটা খুলে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে পাশাপাশি ছোট্ট দুটি মুখ বেরিয়ে আসে।

বনহুর বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলে-নূরী, এ মালা তুমি কোথায় পেলে?

নূরীও অবাক হয়ে গেছে, সে জানতো না চেনের লকেটের মধ্যে দুটি শিশুর মুখ লুকিয়ে আছে। এমনি একটা চেন-মালা সে তার হুরের গলায় দেখেছিলো, সে কথা সম্পূর্ণ ভুলেই গিয়েছিলো নূরী। আজ স্মরণ হয় স্পষ্টভাবে। বলে নূরী–আমার নাচ দেখে খুশি হয়ে এক যুবতী আমাকে এ মালা দান করেছে।

যুবতী!

 হাঁ। কিন্তু এ মালা যে তোমার গলায় ছিলো?

যদিও জামার নিচে আজও বনহুরের গলায় তার সেই দস্যু-পিতা কালু খাঁর দেওয়া স্মৃতি চেন মালাটা পরা রয়েছে, তবু সে-কথা গোপন রেখে বললো বনহুর–আমার মালাটা চুরি গিয়েছিলো। বলো, বলো নূরী কে সে যুবতী? কোথায় থাকে সে?

আমি ঠিক জায়গাটা খেয়াল করতে পারবো না, তবে কেশব ভাই বলতে পারবে। চলো হুর, রাত ভোর হয়ে গেছে; কেশবের কাছে জেনে নেবে চলো।

তাই চলো নূরী।

বনহুর আর নূরী কুঠিরের মধ্য হতে বেরিয়ে এলো।

 কেশব ঘুম থেকে জেগে উঠেছে অনেকক্ষণ, বনহুর আর নূরীর আগমনে উঠে বসলো।

বনহুর বললো–কেশব, নূরীর গলায় এ মালা কে দিয়েছে জানো?

কেশব নূরীর মালায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো–ও মালা এক মহিলা দিয়েছেন ওর নাচ দেখে খুশি হয়ে।

সে কথা আমি শুনেছি। আমি জানতে চাইছি কে সে মহিলা? কোথায় থাকে সে? আমি তার পরিচয় জানতে চাই।

বেশ তো বলছি–সেলুকা রোড আছে না?

 হ আছে। বললো বনহুর।

ঐ রোড দিয়ে কিছুদূর গেলে সাবেরা কোয়ার্টার আছে। তার ওদিকে….

অতো বলতে হবে না, একবার বলো–আমি দিল্লীর সব পথঘাট চিনি।

পুলিশ সুপারের বাংলো চেনো বাবু?

 আচমকা একটু চমকে উঠলো যেন বনহুর, বললো-হা-হা চিনি।

ঐ বাংলোয় ফুল নাচ দেখিয়েছিলো তাই বেগম সাহেবা ঐ মালাটা দিয়েছেন।

বলে উঠে নূরী–বেগম সাহেবা না কে জানি না, দু’জন মেয়ে ছিলো; তার মধ্যে একজন টাকা দিয়েছিলো আর একজন এই মালাটা।

হাঁ তারপর?

তারপর আবার কি, ঐ তো মালা নিয়ে চলে এলাম খুশি হয়ে। তখন কি আমি খেয়াল করেছি এ মালা তোমার?

নূরীর কথায় বলে উঠে কেশব–কি বলো ফুল? ও মালা তোমার বাবুর?

হাঁ কেশব, এ মালা আমার।

 তাহলে ওটা কি করে…

বললো নূরী–চুরি গিয়েছিলো।

বনহুরের মনে তখন নানারকম চিন্তার জাল ছড়িয়ে পড়েছে। এ মালা যে তার মনিরার কণ্ঠে সব সময় পরা থাকে। এ মালা ভারতে এলো কি করে? পুলিশ সুপারের বাড়ির মহিলার কণ্ঠেই বা গেলো কি করে? তবে কি ঐ বোরখাধারিনী তার মনিরা? বনহুরের কানে বোরখাধারিনীর কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি বেজে উঠে। তাই তো, আজ যেন মনে হচ্ছে–ও স্বর তার কত পরিচিত। এতোদিন বনহুর ভাবতেও পারেনি–তার মনিরা এই সুদূর ভারতে আসতে পারে।

বনহুরের মুখোভাব লক্ষ্য করছিলো নূরী, বললো সে–হঠাৎ কি হলো তোমার হুর?

আনমনা ভাবে উচ্চারণ করলো বনহুর–উ।

 মালা তো পেয়েছো আর কি?

হাঁ মালা পেলাম, কিন্তু চোরকে শায়েস্তা না করে ছাড়বো ভেবেছো?

 কি দরকার। বড় ভাল মেয়ে বলেই আমার মনে হলো।

ওঃ বখসীশ মোটা পেয়েছিলে তাই এতো দরদ! আচ্ছা বলো তো, বাংলোয় দুটো মেয়ে থাকে– একজন বোরখা পরে আর একজন অতো পর্দার বাড়াবাড়ি নেই, কোন্ জনা তোমাকে এ মালা খুশি। হয়ে দিয়েছিলো?

চট করে বললো নূরী–যে বোরখা পরে থাকে সেই দিয়েছে।

হুঁ এবার বুঝেছি। বনহুর কথাটা বলে মৃদু হাসে।

নূরী বলে–দেখো আমি তোমাকে অনুরোধ করছি তাকে জানে মেরো না।

তাহলে বন্দী করে নিয়ে আসবো?

 তাই এনো।

 কিন্তু তুমি কিছু মনে করে বসবে না তো?

না।

বেশ তাই করবো।

 বনহুর ভাবে, নূরী ইতিপূর্বে কান্দাই জঙ্গলে মনিরাকে বেশ কিছু সময়ের জন্য দেখেছিলো। তার জন্যই বনহুরকে সে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলো। নূরী সব ভুলে গেছে, ভুলে গেছে সম্পূর্ণভাবে মনিরার চেহারা। সরল সহজ মেয়ে নূরী…হাসে বনহুর।

নূরী বলে–হাসলে কেন?

 হাসলাম, একটা নারী সে কি করে একজন পুরুষের গলার চেন চুরি করলো?

কেশব অবাক হয়ে বললো–ও চেন বাবুর?

 বললো নূরীহ, ও চেন-মালা ওর।

বনহুরের আর বিলম্ব সইছিলো না, নূরীকে নিয়ে সে বিদায় নেবে দিল্লী নগরী থেকে ভেবে এসেছিলো আজ–কিন্তু সে আর হলো না।

বনহুর বললো–নূরী, আজ তাহলে চললাম।

 যাও কিন্তু মেয়েটিকে যেন হত্যা করো না।

না, ওকে নিয়ে আসবো তোমার কাছে।

তাই এনো।

বনহুর কেশবের করমর্দন করে বিদায় নিলো।

*

বনহুর সেদিন স্বপন আর কল্পনার নিকটে বিদায় চেয়ে বসলো–এবার তোমাদের মায়াজাল আমাকে বিচ্ছিন্ন করতে হচ্ছে ভাই।

অবাক হয়ে বললো স্বপন আর কল্পনা–তার মানে?

মানে আমাকে এবার বিদায় নিয়ে চলে যেতে হচ্ছে দূরে–অনেক দূরে।

বনহুরের কথা শুনে স্বপন আর কল্পনার মাথায় যেন বাজ পড়লো। তারা ভাবতেও পারেনি রঞ্জনদা একদিন তাদের ছেড়ে চলে যাবে। প্রায় কেঁদে ফেললো দু’জনা।

স্বপন বললো–রঞ্জনদা, আপনি চয়ে যাবেন? কিন্তু আমাদের কে দেখাশোনা করবে বলুন তো?

হেসে বলে বনহুর–এখন তোমার বড় হয়েছে। জ্ঞান-বুদ্ধি অনেক বেড়েছে। তাছাড়া তোমাদের যে সব কর্মচারী বা আত্মীয়-স্বজন আছে সবাই তোমাদের সমীহ করে। কাজেই আমি না থাকলে কোনো অসুবিধাই হবে না তোমাদের।

শেষ পর্যন্ত বনহুরকে বিদায় দিতে হল স্বপন আর কল্পনাকে।

ওদের ছেড়ে যেতে বনহুরের যে কষ্ট হচ্ছিলো না, তা নয়। কিন্তু কি করবে সেবনহুরের স্বভাব নয় স্থির হয়ে চিরদিন এক স্থানে আবদ্ধ হয়ে থাকা। এমন কোনো শক্তি নেই তাকে ধরে রাখতে পারে।

বনহুর স্বপন আর কল্পনার কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেলেও সে সত্যিই একেবারে দূরে চলে গেলো না। কারণ এখনও তার কিছু কাজ বাকী আছে।

দিল্লীর অনতিদূরে এক নির্জন স্থানে সে একটি বাড়ি ভাড়া নিলো। বাড়িখানা বহুদিনের পুরানো বাদশাদের আমলের তৈরি। এককালে বাড়িখানার জৌলুস ছিলো। রাজ প্রাসাদের মত বিরাট বাড়ি। সিংহাদ্বারের পরেও পর পর কয়েকটি দ্বার আছে। এককালে এ সব দ্বারে খোঁজা দারওয়ান পাহারা থাকতো। ভিতরে ছিল বেগম মহল। হয়তো কোনো রাজা বা বাদশাহ সখ করে নির্জন স্থানে বসবাস করবার জন্য এ বাড়িটা তৈরি করেছিলেন। আজ পূর্বের ন্যায় সুন্দর আর ঝকঝকে নেই, ভেঙে ধসে পড়েছে অনেক জায়গা। সিংহদ্বারের উপরে জন্মেছে অসংখ্য আগাছা।

বনহুর এ বাড়িটাই ভাড়া নিলো এক মহাজনের নিকট হতে। এ বাড়ির আশেপাশে কোনো বাড়ি নেই, নেই কোনো লোকজনের বসবাস।

এ বাড়িটাই বনহুরের পছন্দ হলো।

দিল্লীতে বাকী যে ক’দিন কাটাবে এ বাড়িটাই তার এখন প্রয়োজন। এ বাড়ির ভিতরে ঘুরেফিরে দেখে নিজের পছন্দ মত একটা ঘর বেছে নিয়েছে থাকার জন্য। শুধু একা বনহুর থাকবে। ঘরটা ঠিক মাঝের একটা ঘর, ভাঙাচুরা তেমন নয়, পরিস্কারও বটে।

বনহুর এ ঘরেই তার আস্তানা গাড়লো।

বাড়িখানার আশেপাশে বেশ জনভূমি এবং উঁচু-নীচু জায়গা। ঝোপঝাড়ও জন্মেছে অনেক। বনহুরের এ সব পছন্দই হলো। সে তার গাড়িখানা রাখবার জন্য গ্যারেজ না পেলেও ভাঙা ধসে-পড়া ঘর পেলো ঠিক গ্যারেজের মতই। বনহুর তার উপার্জিত লক্ষ লক্ষ টাকা বিলিয়ে দিলেও এখনও তার নিকটে যে সোনা-দানা, মনি-মুক্তা ছিল তা কোটি কোটি টাকা মূল্যের চেয়েও বেশি হবে।

বনহুর এসব মূল্যবান মনি-মুক্তা, সোনা-দানা লুকিয়ে রাখলো তারই কক্ষের এক গোপন প্রকোষ্ঠে। ইচ্ছামতো সে বিলিয়ে দিতে দীনদুঃখী আর অনাথদের মধ্যে।

নিজের প্রয়োজন তার কতটুকুই বা লাগতো! তবু বনহুরের স্বভাব–যদি কোনো দুষ্ট ধনপতির সন্ধান পেতো, যেমন করে হোক তার সর্বস্ব লুটে নিতে দ্বিধা বোধ করতে না সে এতটুকু।

স্বপন আর কল্পনাদের বাড়ি ত্যাগ করে চলে এলেও বনহুর এক বৃদ্ধ আত্নীয়ের বেশে মাঝে মাঝে গিয়ে তাদের সব খোঁজ-খবর নিয়ে আসতো।

স্বপন আর কল্পনা এতটুকু বুঝতে পারতো না কিন্তু বৃদ্ধের ব্যবহারে আত্নহারা হয়ে যেতো। বনহুর। বৃদ্ধ সেজে তাদের বাবার কাকার বলেই পরিচয় দিয়েছিলো।

 স্বপন আর কল্পনা সরল বিশ্বাসে তাকে স্থান দিয়েছিলো অন্তরে। বৃদ্ধ রায়বাবুর বেশে যখন যেতো। বনহুর তখন স্বপন আর কল্পনার আনন্দের সীমা থাকতো না। কোথায় বসাবে, কি খাওয়াবে–ভেবে আকুল হতো ওরা।

বনহুরও বৃদ্ধের মত গলা কাঁপিয়ে কথা বলতো, স্নেহ-আদরে ভরে দিতে দুটি ভাই-বোনকে। যতক্ষণ ওদের মধ্যে থাকতো পরম আনন্দে সময় কাটতো তার।

*

 বেশ কয়েকদিন রঞ্জন বাবুর সন্ধান না পেয়ে পুলিশ সুপার হাশেম চৌধুরী এবং তার পরিবারবর্গ উদ্বিগ্ন হলো। কোনো অসুখ-বিসুখ করেনি তো রঞ্জন বাবুর! বেশি করে চিন্তিত হলো মনিরা–হঠাৎ এমন করে কোথায় নিখোঁজ হলো!

একদিন মনিরা আর মাসুমা হাজির হলো গিয়ে স্বপন আর কল্পনাদের বাড়িতে।

স্বপন আর কল্পনা মনিরা আর মাসুমাকে দেখে খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠলো।

 হলঘরেই তারা বসেছিলো। তাদের রায় দাদু এসেছেন। তার কাছেই বসে গল্পসল্প করছিলো ওরা।

বনহুর রায়বাবু সেজে স্বপন আর কল্পনাকে নিয়ে মেতে থাকলেও তারও মন ছিলো ঐ বোরখাধারিনীর সন্ধানে। সে বুঝতে পেরেছে, ঐ বোরখার নিচেই রয়েছে তার মনিরা। তাই রঞ্জন যখন স্বপন আর কল্পনাদের বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো তখন সে বাংলোয় কাউকে বলে গেলো না। কারণ তার মনে ছিলো একটু দুষ্ট অভিসন্ধি।

আজও মনিরা বোরখা পরে এসেছে।

কল্পনা আর স্বপন মনিরা আর মাসুমার সঙ্গে দাদু রায় বাবুর পরিচয় করিয়ে দিলো।

ইনি আমাদের বাবার কাকা রায় দাদু। আর এরা পুলিশ সুপারের বাড়ি থেকে এসেছেন। কথাটা বললো স্বপন।

রায়বাবু শুধু মাথা নেড়ে তাদের অভিবাদনের জবাব দিলেন।

একজন বৃদ্ধের কাছে লজ্জার কি আছে। তাই মাসুমা আর মনিরা হলঘরেই বসলো।

 মাসুমা বললো–স্বপন, তোমার রঞ্জনদাকে দেখছি না তো? তিনি কোথায়?

স্বপন আর কল্পনার চোখ অশ্রু ছলছল হলো। বললো স্বপন–রঞ্জনদা আজ ক’দিন হলো চলে গেছেন।

সঙ্গে সঙ্গে মনিরা বোরখার মুখের আচ্ছাদনটা সরিয়ে ফেলে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো–চলে গেছেন!

মাসুমাও অবাক হয়ে বললো–রঞ্জন বাবু চলে গেছেন?

হাঁ, তিনি তো আমার কাছে চিরদিন থাকতে পারেন না। তার অনেক নাকি কাজ আছে, তাই তিনি চলে গেছেন।

মনিরা আর মাসুমা উভয়ে তাকালো উভয়ের মুখের দিকে। ব্যথা-বেদনার মুহূর্তে মনিরার মুখ করুণ হয়ে উঠেছে। রায়বাবুর বেশে স্বয়ং দস্যু বনহুর তাদের সম্মুখে উপবিষ্ট। বনহুর বহুদিন পর আজ প্রথম দেখলো মনিরার মুখমণ্ডল। খুশিতে দীপ্ত হয়ে উঠলো বনহুরের আঁখি দুটি! মনিরার ব্যথাকাতর মুখোব তাকে আরও চঞ্চল করে তুললো। ওকে নিবিড়ভাবে পাবার জন্য ব্যাকুল হলো তার হৃদয়।

বললো মাসুমা–সর্বনাশ হয়ে গেছে মনিরা। না জানি কোথায় সে চলে গেছে কে জানে!

মনিরা হঠাৎ দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে উচ্ছ্বসিতভাবে।

রঞ্জন বাবু চলে যাওয়ার সংবাদ শুনে মাসুমা আর মনিরার ভাব লক্ষ্য করে অবাক হয়ে গেছে স্বপন আর কল্পনা। এবার মনিরাকে রোদন করতে দেখে আরও অবাক হয়। রঞ্জন বাবুকে তারাও ভালবাসতো কিন্তু তাই বলে পুলিশ সুপারের স্ত্রী, বোন–এরা তার জন্য কাঁদবে কেন!

মনিরাকে মাসুমা হাশেম চৌধুরীর বোন বলেই পরিচয় দিতো সবার কাছে। স্বপন আর কল্পনাও জানতো–আলেয়া পুলিশ সুপারের বোন।

মনিরা বললো এবার–রঞ্জন বাবু কোথায় গেছেন বলে গেছেন কিছু?

স্বপন জবাব দিলো না, তিনি কোথায় গেছেন বলে যাননি।

এরপর বেশিক্ষণ মাসুমা আর মনিরা স্বপনদের বাড়িতে অপেক্ষা করলো না।

বিদায় নিয়ে চলে গেলো ওরা।

রায়বাবুও উঠে পড়লেন–আজ চলি কেমন?

স্বপন আর কল্পনা আপত্তি তুললো, এক্ষুণি চলে যাবেন রায়দাদু। আরও কিছু সময় থেকে যান না?

না ভাই, আজ আর দেরী করবো না, আসবো আবার। রায়বাবুবেশী দস্যু বনহুর বিদায় নিয়ে চলে গেলো।

*

পেয়েও তাকে হারাবো ভাবতে পারিনি মাসুমা। মাসুমার বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে উঠে মনিরা।

 মাসুমা ওর মাথায়-পিঠে সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে হয়তো দিল্লী নগরীতেই আছে সে, অধৈর্য হচ্ছো কেন বোন!

না, সে দিল্লীতে থাকলে নিশ্চয়ই স্বপন আর কল্পনাদের ওখান থেকে যেতো না। বড্ড খেয়ালী হয়তো চলে গেছে দূরে কোথাও।

যদি তোর কথা মনে পড়ে থাকে তাহলে দেশেও চলে যেতে পারে।

মিথ্যা নয় মাসুমা। আমার মন যেন বলছে সে আবার ফিরে গেছে কান্দাই শহরে। আমাকে যদি গিয়ে না পায় তাহলে কি হবে মাসুমা?

আমি বলেছিলাম এবার ওকে পরিচয় দে। বেশিদিন এমন করে নিজেকে বঞ্চিত রাখিস্ না মনিরা, কিন্তু তুই আমার কথায় কান দিসনি এবার হলো তো?

মাসুমা, আমি দেখতে চেয়েছিলাম কেন সে সুদূর কান্দাই থেকে এই ভারতবর্ষে আত্নগোপন করে আছে। কেন সে নিজেকে রঞ্জন বাবু সাজিয়ে হিন্দু ভদ্রলোক সেজেছেন। কিন্তু সব আমার ব্যর্থ হয়ে গেলো মাসুমা, আমি নিজের পায়ে নিজেই কুঠারাঘাত করলাম।

মনিরার বেদনা-বিধুর দিনগুলো এমনি নিরানন্দভাবে কেটে চললো।

বান্ধবীর মনঃকষ্টে মাসুমার মনেও শান্তি নেই, সব সময় কেমন একটা থমথমে ভাব বাংলোতে বিরাজ করতে লাগলো।

স্ত্রী এবং মনিরার গম্ভীর চিন্তাযুক্ত ভাব দেখে হাশেম চৌধুরীও উদ্বিগ্ন হলেন, ব্যাপার কি-বাংলোয় যেন কেউ মারা পড়েছে। শেষ পর্যন্ত স্বামীর জেদে মাসুমা সব কথা তাকে খুলে বলতে বাধ্য হলো।

ঘটনা শুনে হাশেম চৌধুরী হাসবেন না কাঁদবেন ভেবে পান না। এমন একটা ব্যাপার অথচ তিনি তার কিছু জানেন না। জানলে আজ এমন হতেও পারতো না। কবে তিনি ওদের দু’টিকে মিলন সূত্রে গেঁথে দিতেন।

হাশেম চৌধুরীও এবার রঞ্জন বাবুর সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

*

সেদিন হাশেম চৌধুরী স্বয়ং গাড়ি নিয়ে বের হলেন, সন্ধান করে ফিরলেন সমস্ত দিল্লী নগরী কিন্তু রঞ্জন বাবুর সন্ধান তিনি পেলেন না।

বাড়ি ফিরে এসে শুনলেন তার ড্রাইভার হঠাৎ অসুস্থ হওয়ায় নতুন এক শিখ ড্রাইভার এসেছে তার জায়গায়। দোহারা লম্বা চেহারা, মাথায় পাগড়ি, মুখে চাপদাড়ি। চোখে চশমা, হাতে লোহার এক গাছা বালা। বিশেষ করে শিখ ড্রইভারের চোখ দুটি তীক্ষ্ণ এবং বুদ্ধিদীপ্ত বলে মনে হলো।

হাশেম চৌধুরী নাম জিজ্ঞাসা করলেন–তোমার নাম কি ড্রাইভার?

 শিখ ড্রাইভার বললো–শিবাজী।

বাঃ বহুৎ আচ্ছা নাম তোমহারা হেসে বললেন হাশেম চৌধুরী।

শিখ ড্রাইভারটির ব্যবহারে খুশি হলেন হাশেম চৌধুরী। যেমন চেহারা, তেমনি অমায়িক লোক।

কয়েকদিনেই সে অনেকটা আপনজনের মত হয়ে গেলো। ভাল বাংলা বলতে পারে না সে, ভাংগা ভাঙা উর্দু কথা বলে।

শিখ ড্রাইভারের ছদ্রবেশে বনহুর স্বয়ং এসে হাজির হয়েছে পুলিশ সুপারের বাংলোয়। উদ্দেশ্য মনিরাকে একবার আয়ত্তের মধ্যে আনা; তাকে যেমন নাকানি-চুবানি খাইয়ে ছেড়েছে তেমনি ওকেও খানিকটা কাদিয়ে তবে ছাড়বে।

মনিরার চোখের পানি মাঝে মাঝে বনহুরকে বিচলিত করে তুলতো। বাগানে বসে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করতো যখন মনিরা তখন দূর থেকে লক্ষ্য করতো বনহুর, হাসতো মনে মনে–স্বামীর সঙ্গে ছলনার এবার হচ্ছে সাজা।

মনিরা হয়তো সারাদিন শয্যায় শুয়ে চিন্তা করতো। পাশে বসে বোঝাতো মাসুমা, সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করতো অনেক। এমন কি হাশেম চৌধুরী পর্যন্ত নানাভাবে মনিরাকে প্রকৃতিস্থ করার চেষ্টা করতেন।

শিখ ড্রাইভারের বেশে বনহুর সব দেখতো, সব শুনতো। কতদিন হাশেম চৌধুরী শিখ ড্রাইভার শিবাজীকে নিয়ে বের হতেন, এখানে-সেখানে সন্ধান করে ফিরতেন রঞ্জন বাবুর। এ-পথ সে-পথ চষে ফিরতেন হাশেম চৌধুরী।

বলতো শিবাজী হুজুর আপ কিসুকে লিয়ে দিন তামাম ঘুমতে?

বলতেন হাশেম চৌধুরী–এক আদমীকে লিয়ে হাম বাহুৎ পেরেশান হুয়ে। উছিকে লিয়ে এনা রাহা ঘুমুতে শিবাজী।

হাশেম চৌধুরীর কথায় হাসতো শিবাজী হুজুর আদমীতো জানোয়ার নেহি। যো রাহা পর ঢুরনেছে ফায়দা হুয়ে।

এমনি কতদিন হতাশ হয়ে ফিরে এসেছেন হাশেম চৌধুরী।

স্বামী ফিরে আসতেই মাসুমা ছুটে এসেছে গাড়ির পাশে, ব্যাকুল আগ্রহে জিজ্ঞাসা করেছে–পেলে তাকে?

গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলেছেন হাশেম চৌধুরী–কই আর পেলাম! হতাশ ভরা কণ্ঠস্বর তার।

গাড়ির দরজা ধরে তখন দাঁড়িয়ে শিখ ড্রাইভার শিবাজী। ভিতরে ভিতরে হাসে সে। যার সন্ধানে তোমরা ঘাবড়ে মরছো সে যে তোমাদের পাশে দাঁড়িয়ে।

*

একদিন হাশেম চৌধুরী পুলিশ ভ্যান নিয়ে কোনো ডাকাতি কেসের তদারক করতে গেছেন।

মাসুমার শরীর আজ ভাল নেই।

মনিরা বললো–মাসু, আমি একটু বাইরে যাব।

তা কি করে হয়, একা যাবি? আমার যে অসুখ।

তা হোক তোদের ড্রাইভারকে বলে দে একটু নিয়ে যেতে।

বুঝেছি, নিজে খোঁজ করতে যাবি–এই তো?

যা বলবি তাই।

মাসুমা কলিং বেলে চাপ দেয়।

 বয় কক্ষে প্রবেশ করে–মা-জী।

এই শোন্ ড্রাইভারকে একবার ডেকে দে দেখি।

 আচ্ছা মা-জী। বেরিয়ে যায় বয়।

একটু পরে শিখ ড্রাইভার শিবাজীসহ বয় ফিরে আসে।

শিবাজী দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে লম্বা সেলুট ঠুকে বলে–বিবিজী আল্ হামকো বোলাতে?

হাঁ শিবাজী, আমার বান্ধবী বাইরে যাবেন। গাড়ি বের করে নাও। আর শোন, সাবধানে নিয়ে যেও।

বহুৎ আচ্ছা বিবিজী। সেলুট করে চলে গেলো শিবাজী।

মনিরা তৈরি হয়ে ফিরে এলো মাসুমার পাশে।

 মাসুমা বললো–একি, আজও ঐ বোরখা পরেছিস? এখন কার কাছে আত্নগোপন বলতো?

 অভ্যাস হয়ে গেছে, আর যে ভাল লাগে না।

চল তোকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে আসি।

চিরবিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছি না যে অসুখ শরীরে তাই বিদায় সম্ভাষণ জানাতে হবে। চুপ করে শুয়ে থাক দিকি।

শীগগীর ফিরে আসবি কিন্তু।

 আচ্ছা।

মনিরা বোরখা আচ্ছাদিত শরীর নিয়ে গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালো।

 শিখ ড্রাইভার দরজা খুলে ধরলো।

 পিছন আসনে উঠে বসলো মনিরা।

ড্রাইভিং আসনে বসলো শিখ ড্রাইভারবেশী বনহুর নিজে। তার ঠোঁটের ফাঁকে দুষ্টামির হাসি ফুটে। উঠেছে। এমনি এক সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো সে।

গাড়িতে স্টার্ট দেবার পূর্বে বললো বনহুর–আপ কঁহা যাওগি?

বেলুচা বাজার।

হাসলো বনহুর মনে মনে, বেলুচা বাজার দিল্লীর সবচেয়ে বড় ফুলের বাজার। এখানে কেন যাবে মনিরা ফুলের বাজারে যদি তার স্বামীকে খুঁজে পায় সেই আশায় কি?

গাড়ি ছুটতে শুরু করলো।

 ড্রাইভ আসনে বনহুর। আর পিছন আসনে মনিরা।

এ-রাস্তা সে-রাস্তা করে গাড়ি ছুটে চলেছে।

বেলুচা বাজারের পথ চিনতো মনিরা, মাসুমা আর হাশেম চৌধুরীর সঙ্গে আরও কয়েকবার এসেছিলো সে। আজ তো এটা সে-পথ নয়। মনিরা একটু চিন্তিত হলো ড্রাইভারের ভাবগতিক ভাল। বলে মনে হচ্ছে না তার। হঠাৎ বলে উঠলো সে–এ কোন্ পথে আমাকে নিয়ে যাচ্ছো?

বললো শিবাজী–চুপচাপ আপ বয়ঠিয়ে বিবিসাব।

অগত্যা মনিরা বসেই রইলো, মনে করলো এটা হয়তো অন্য কোনো পথ ধরে তাকে বেলুচা বাজার নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই মনিরা বুঝতে পারে তার সন্দেহ সত্য। ড্রাইভার তার গাড়িখানা নিয়ে নির্জন পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছে। এ পথ বেলুচা বাজার যাবার পথ নয়।

মনিরা এবার ভীত আশঙ্কিত হয়ে পড়লো। এ যে মেঠো অসমতল পথ বেয়ে তার গাড়ি চলেছে। নিশ্চয়ই ড্রাইভারের মনে কোনো কুমতলব আছে। মনিরার সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। দুরু দুরু বক্ষে কম্পিত কণ্ঠে বললো–এ তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে চলেছে ড্রাইভার?

আপ চুপ সে বইঠিয়ে বিবিসাব।

মনিরার সমস্ত শরীর ঘেমে চুপসে উঠতে লাগলো হায়, একি হলো! কেন সে ড্রাইভারকে বিশ্বাস করেছিলো এখন উপায়? গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়বে কি? তাই ভাল-মৃত্যু হয় সেও ভাল তবু ইজ্জৎ হারাবে না।

মনিরা গাড়ির দরজার দিকে এগিয়ে সরে বসলো।

শিবাজী তার সম্মুখের আয়নায় সব লক্ষ্য করছিলো, বললো কই চালাকি মত করিয়ে! গাড়িছে গিরনেছে খতম হো জায়েগি বিবিসাব।

না আমি যাবো না, আমাকে বাসায় নিয়ে চলো। বাসায় নিয়ে চলো বলছি।

গাড়ির স্পীড তখন অত্যন্ত বেড়ে গেছে। ভীষণ ঝাঁকুনির পর ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ি তীরবেগে ছুটে চলেছে।

মনিরা বোরখা-পরা অবস্থায় থরথর করে কাঁপছে, শেষ অবধি তার পরিণতি এই ছিলো। তবুও সাহস করে বললো মনিরা ড্রাইভার পুলিশ সুপার জানতে পারলে তোমার কি অবস্থা হবে জানো?

কোনো জবাব না দিয়ে হঠাৎ হেসে উঠলো ড্রাইভার…হাঃ হাঃ হাঃ।

গাড়ির ঝাঁকুনির সঙ্গে সে হাসি যেন খণ্ড খণ্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়লো গাড়ির মধ্যে।

মনিরা গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলো। কিন্তু তার পূর্বেই শিবাজী বুঝতে পারলো তার মনোভাব। ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে ফেললো সঙ্গে সঙ্গে। তারপর মনিরাকে পিছন আসন থেকে টেনে নামিয়ে ড্রাইভিং আসনের পাশে বসিয়ে নিলো জোর করে। বামহস্তে মনিরাকে চেপে ধরে রাখলো আর দক্ষিণ হস্তে সে গাড়ি চালিয়ে চললো।

শিবাজীর বামহস্তে চাপেই মনিরা একটুও নড়তে পারলো না। চিৎকার করে কোনো লাভ নেই, কারণ আশেপাশে কোনো লোকজন বা বাড়িঘর নেই যে তাকে উদ্ধার করবে।

একটা পোড়াবাড়ির সম্মুখে গাড়ি থামিয়ে ফেললো শিবাজী। মনিরার মুখমণ্ডল এখনও বোরখায় ঢাকা রয়েছে। সে বোরখার মধ্য হতেই তাকিয়ে দেখলো–বাড়ির আশেপাশে একটি জন-প্রাণী নেই। অসহায় কণ্ঠে বললো মনিরা–তুমি যা চাও তাই দেবো, আমাকে বাংলোয় পৌঁছে দিয়ে এসো ড্রাইভার। যত টাকা চাও তাই পাবে।

ড্রাইভার কোনো কথা না বলে মনিরাকে টেনে-হিঁচড়ে বাড়ির ভিতরে নিয়ে চললো। সিংহদ্বার পেরিয়ে পর পর আরও কত গেট পার করে নিয়ে এলো অন্দর মহলের একটি কক্ষে।

মনিরার দু’চোখে অশ্রুর বন্যা বয়ে চলেছে, সমস্ত মুখমণ্ডল ভয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠেছে। করুণ কণ্ঠে বললো মনিরা–এ তুমি আমায় কোথায় নিয়ে এলে?

মেরা ঘর!

আমাকে এখানে কেন তুমি নিয়ে এলে?

হাঃ হাঃ হাঃহাঃ হাঃ হাঃ–কেন নিয়ে এলাম জানতে চাও? হাঃ হাঃ হাঃ…

সে হাসির শব্দে সমস্ত বাড়িখানা যেন দুলে দুলে উঠে।

অবাক হয়ে তাকায় মনিরা, বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলে–তুমি–তুমি….

হাঁ, আমিই দস্যু বনহুর। আলেয়া, আজ তোমাকে আমি আয়ত্তের মধ্যে পেয়েছি। কেউ তোমাকে আমার কবল থেকে বাঁচাতে পারবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

প্রতিধ্বনি

প্রতিধ্বনি

প্রতিধ্বনি

মানুষের চরিত্র যতটুকু দেখিয়াছি, তাহাতে সে শুরু হইতে শেষ পর্যন্ত অবিচলিত ভাবে সঙ্গতি ও সামঞ্জস্য রক্ষা করিয়া চলিবে এরূপ মনে করিবার কোনও কারণ ঘটে নাই। বরং একটানা সঙ্গতি দেখিলেই কেমন একটা বিস্ময় জাগে, সন্দেহ হয় কোথাও বুঝি কিছু গলদ আছে।

কিন্তু যে লোকটার জীবনধারা গত ত্রিশ বৎসর ধরিয়া প্রায় একই খাতে প্রবাহিত হইতে দেখিয়াছি, সে যদি কেবল একটা বাড়ি কিনিবার ফলে অকস্মাৎ সম্পূর্ণরূপে বদলাইয়া যায়, তাহা হইলে বন্ধুবান্ধবদের মনে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার সৃষ্টি হওয়া বিচিত্র নয়। সোমনাথ সম্বন্ধে আমরাও একটু বিশেষ রকম উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিয়াছিলাম।

সোমনাথ বরদার আষাঢ়ে গল্পের আসরে বড় একটা যোগ দিত না বটে, তবু সে আমাদের। সকলেরই অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। একেবারে প্রাণখোলা লোক—অত্যন্ত মিশুক ও আমুদে হাসিয়া-খেলিয়াই জীবনটা কাটাইয়া দিতেছিল। বাপ মৃত্যুকালে টাকা রাখিয়া গিয়াছিলেন, সুতরাং অন্নচিন্তা ছিল না। বিবাহের তিন-চার বছরের মধ্যে স্ত্রীও মারা গিয়াছিল, কিন্তু নিঃসন্তান অবস্থায় বিপত্নীক হইয়াও সে আর বিবাহ করে নাই। প্রাণখোলা লোক হইলেও তাহার সুবুদ্ধির দ্বারে যে অর্গল ছিল, একথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। মারাত্মক রকম বদখেয়ালও তাহার কিছু ছিল না। বিহার-প্রান্তের বৈচিত্র্যহীন শহরে জীবনটা নেহাত একঘেয়ে হইয়া পড়িলে কলিকাতায় গিয়া কিছু দিন নিদোষ আমোদ-প্রমোণ করিয়া আসিত। তারপর আবার হৃষ্ট মনে বিলিয়ার্ড খেলায় মনোনিবেশ করিত। তাহার জীবনে একটি মাত্র নেশা ছিল—ঐ বিলিয়ার্ড খেলা। সিগারেট পর্যন্ত তাহাকে কোনও দিন খাইতে দেখি নাই; কিন্তু শহরে থাকিয়াও সন্ধ্যার পর বিলিয়ার্ড খেলিবার জন্য ক্লাবে আসে নাই, এমন একটা দিনও মনে করিতে পারি না।

বাড়ি কেনার ব্যাপারটাও যে বিলিয়ার্ড খেলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট তাহাতে সন্দেহ নাই। তাহার পৈতৃক বাড়ি ছিল—মন্দ বাড়ি নয়–একটু সেকেলে-গোছের হইলেও ভদ্রলোকের বাসের সম্পূর্ণ উপযোগী। তবু সে সতের হাজার টাকা খরচ করিয়া আর একখানা বাড়ি কিনিয়া বসিল কেন, তাহার কারণ অনুসন্ধান করিতে গেলে এক বিলিয়ার্ড ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না।

আমাদের মিউনিসিপ্যাল সীমানার এক প্রান্তে গঙ্গার ধারে একটি পুরাতন বাড়ি ছিল এবং বাড়িতে একটি অতি পুরাতন মেম বাস করিত। বস্তুত বাড়ি অথবা বুড়ি কোটি বেশি পুরাতন এ লইয়া আমাদের মধ্যে অনেক দিন তর্ক হইয়া গিয়াছে। শেষে আমাদের মধ্যে কেহ একজন গেজেটিয়ার খুলিয়া প্রমাণ করিয়া দিয়াছিল যে, বাড়িটাই অগ্রজ। প্রায় দেড় শত বৎসর পূর্বে এক নীলকর সাহেব এই কুঠি তৈয়ার করাইয়াছিল, ক্রমে নীলের ব্যবসা উঠিয়া যাওয়ায় উহা পারিবারিক বাসভবনে পরিণত হইয়াছিল। তারপর তিন পুরুষ ধরিয়া নীলকর সাহেবের বংশধরেরা এইখানেই বাস করিতেছে। বুড়ি শেষ উত্তরাধিকারিণী।

আমাদের তর্কের নিষ্পত্তি হইয়াছিল বটে, কিন্তু আর একটা প্রশ্ন উঠিয়াছিল বাড়ি অথবা বুড়ি শেষ পর্যন্ত কোটি টিকিয়া থাকিবে? কিন্তু এ ক্ষেত্রেও বুড়ি হারিয়া গেল। একদিন শুনিলাম তাহার গঙ্গালাভ হইয়াছে।

বুড়ি চিরকুমারী, তাই সাক্ষাৎ ওয়ারিস কেহ ছিল না। অল্প দিন পরে শোনা গেল বাড়ি বিক্রয় হইবে। নেহাত খেয়ালের বশেই একদিন বৈকালে আমরা কয়েকজন দেখিতে গেলাম। সোমনাথের মোটর আছে, তাহার মোটরে চড়িয়াই অভিযান হইল।

ফাঁকা মাঠের মতো বিস্তৃত গঙ্গার তীরে অনুচ্চ পাঁচিলে ঘেরা ভিলা-জাতীয় বাড়ি। চতুষ্কোণ বাড়ি, চারিদিকে নীচু বারান্দা—মধ্যস্থলটা প্রায় দ্বিতলের মতো উঁচু হইয়া আছে। একটা প্রকাণ্ড ঝাউগাছ নিতান্ত সঙ্গীহীন ভাবে এক পাশে দাঁড়াইয়া আছে। বাড়ির পিছন দিয়া গঙ্গা প্রবাহিত; সম্মুখে ফটকের স্তম্ভে শ্বেত পাথরের ফলকের উপর নাম লেখা আছে—Echoes–প্রতিধ্বনি।

বাড়ির একজন মুসলমান চৌকিদার ছিল, সেও বোধ করি বুড়ির সমসাময়িক। চাবি খুলিয়া বাড়ির ভিতরটা আমাদের দেখাইল। সুসজ্জিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘরগুলি, চেয়ার সোফা পালঙ্ক ঘরে ঘরে যেমন ছিল তেমনি সাজানো আছে। বাড়ির ঠিক মধ্যস্থলে একটি প্রকাণ্ড হল-ঘর। ছাদ খুব উচ্চবহু ঊর্ধ্বে কাচে ঢাকা স্কাই-লাইট দিয়া আলো আসার ব্যবস্থা। তবু ঘরটি ছায়াচ্ছন্ন।

চৌকিদার সুইচ টিপিয়া আলো জ্বালিয়া দিল, কয়েকটা বা একসঙ্গে জ্বলিয়া উঠিল। তখন দেখিলাম, ঘরের মাঝখানে একটি বিলিয়ার্ড টেবিল রহিয়াছে। টেবিলের উপর সবুজ আবরণে ঢাকা তিনটি বাল্ব, কেবলমাত্র টেবিলের সমতল পৃষ্ঠের উপর আলো ফেলিয়াছে। ঘরে অন্য আভরণ বিশেষ কিছু নাই। দেয়ালের ধারে দুইটি সেটি, একধারে বিলিয়ার্ড-যষ্টি রাখিবার র্যাক—তাহাতে সারি সারি কয়েকটি কু রাখা আছে। দেয়ালের গায়ে একটি কালো রঙের মার্কিং বোর্ড, কত দিনের পুরানো বলা যায় না, তাহাতে অঙ্কের চিহ্নগুলি একেবারে অস্পষ্ট হইয়া গিয়াছে।

চারিদিকে তাকাইয়া সোমনাথ মৃদুস্বরে বলিয়া উঠিল, বাঃ!

সত্যই ঘরের আধা অন্ধকার মোলায়েম আবহাওয়া মনের উপর একটা অনির্বচনীয় প্রভাব বিস্তার করে, ঘরে প্রবেশ করিয়াই আমি তাহা উপলব্ধি করিয়াছিলাম। তাই সোমনাথকে সমর্থন করিয়া আমিও ঐ জাতীয় একটা কিছু বলিতে যাইতেছি, এমন সময় আমার কানের কাছে কে যেন চাপা গলায় বলিল, আ—!

চমকিয়া পিছনে তাকাইলাম।

আমার সঙ্গে সঙ্গে আর সকলেও পিছনে তাকাইয়াছিল—কিন্তু পিছনে কেহই নাই। আমরা উদ্বিগ্নভাবে পরস্পর দৃষ্টিবিনিময় করিতে লাগিলাম। তখন বৃদ্ধ চৌকিদার ভাঙা গলায় বুঝাইয়া দিল যে উহা প্রতিধ্বনি। এ ঘরে প্রতিধ্বনি আছে, কথা কহিলে অনেক সময় কথার ভগ্নাংশ ফিরিয়া আসে।

আশ্বস্ত হইলাম বটে, কিন্তু মনে একটু ধোঁকা লাগিয়া রহিল। চৌকিদার অতগুলা কথা কহিল, কই তাহার একটা কথাও তো ফিরিয়া আসিল না।

যা হোক, পরিদর্শন শেষ করিয়া ফিরিয়া আসিলাম। ফিরিবার পথে সোমনাথ একবার বলিল, খাসা বাড়িখানি। আর ঐ বিলিয়ার্ডরুমটা—চমৎকার।

বিলিয়ার্ড রুমের চমৎকারিত্ব তাহাকে কত দূর মন্ত্রমুগ্ধ করিয়াছে তাহা বুঝিতে পারিলাম দিন-দশেক পরে, যখন শুনিলাম সে বাড়িখানি খরিদ করিয়াছে। তারপর আরও বিস্ময়কর সংবাদ, সে পৈতৃক বাড়ির বাস তুলিয়া দিয়া নবক্রীত বাড়িতে উঠিয়া গেল। গৃহপ্রবেশের দিন আমাদের সকলকে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াইল বটে, কিন্তু কেন জানি না সমস্ত ব্যাপারটাতে আনন্দ-উৎসবের স্পর্শ লাগিল না। কেবলই মনে হইতে লাগিল এটা সোমনাথের চিরবিদায় ভোজ।

দাঁড়াইলও তাই। দুই মাইল দূরে উঠিয়া গেলে পুরাতন বন্ধু কিছু পর হইয়া যায় না, কিন্তু সোমনাথ যেন মনের দিক দিয়াও আমাদের অনেক দূরে সরিয়া গেল। মাঝে মাঝে সে ক্লাবে আসিত এবং আগের মতো হাসিগল্প করিবার চেষ্টা করিত বটে, কিন্তু দেখিলাম তাহার মনটা আগাগোড়া বদলাইয়া গিয়াছে। পূর্বে যেমন সমস্ত গল্প কৌতুক ও খেলায় মনপ্রাণ ঢালিয়া যোগ দিতে পারিত, এখন আর তেমন পারে না। তাহার প্রাণখোলা হাসিটাও যেন কেমন অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছে, যে এত দিন রক্ত-মাংসের মানুষ ছিল সে যেন অকস্মাৎ অবাস্তব ছায়ায় পরিণত হইয়াছে।

ক্লাবে বসিয়া সোমনাথ সম্বন্ধেই কথা হইতেছিল।

পৃথ্বী বলিল, ক্ষুধিত পাষাণ। বাড়িটা সোমনাথকে গিলে খেয়েছে। কদ্দিন এদিকে আসেনি?

আমার হিসাব ছিল, বলিলাম, আমাদের জনা অভিনয়ের রাত্রে তাকে শেষ দেখেছি। মাসখানেক হল।

অমূল্য বলিল, ক্ষুধিত পাষাণ-টাষাণ নয়। আসলে নিজের বিলিয়ার্ড টেবিল পেয়েছে, রাতদিন তাই খেলছে।

বরদা এক পাশে বসিয়া ছিল, কড়িকাঠের দিকে চোখ তুলিয়া বলিল, হুঁ।

অমূল্য ভ্রূ তুলিয়া তাহার দিকে ফিরিল, হুঁ মানে? বলতে চাও কি? তাকে ভূতে পেয়েছে?

বরদা উত্তর দিল না, কড়িকাঠের দিকে তাকাইয়া রহিল। তারপর চক্ষু নামাইয়া আমাকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, যে রাত্রে সোমনাথ আমাদের নেমন্তন্ন করে খাইয়েছিল, সে রাত্রির কথা মনে আছে?

কোন্ কথা?

খাওয়া-দাওয়ার পর তুমি আর সোমনাথ বিলিয়ার্ড খেলেছিলে–বোধ হয় ভোলনি। আমি বসে তোমাদের খেলা দেখছিলুম। সে সময় তোমার নিজের খেলার কোনও বিশেষত্ব লক্ষ্য করনি?

লক্ষ্য যে করিয়াছিলাম তাহা নিজের কাছেও এত দিন স্পষ্টভাবে স্বীকার করি নাই, অথচ বরদা তাহা লক্ষ্য করিয়াছে। ভাল খেলোয়াড় বলিয়া আমার অহঙ্কার নাই, কিন্তু সেদিন আমার খেলা আশ্চর্য রকম খুলিয়া গিয়াছিল। শুধু তাই নয়, একটা অদ্ভুত অনুভূতি আমাকে অভিভূত করিয়া ফেলিয়াছিল। প্রত্যেক বার বল মারার সময় মনে হইয়াছিল আমি খেলিতেছি না, আর কেহ আমার। হাত ধরিয়া খেলিয়া দিতেছে। আমি হয়তো পট রেড মারিবার চেষ্টা করিয়াছি, কিন্তু বলের সহিত কু-এর সংস্পর্শ ঘটিবার পূর্ব মুহূর্তে যেন একটা অদৃশ্য হাত আমার হাতে ঈষৎ নাড়া দিয়া আমাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করিয়া দিয়াছে। ফলে আমার বল রেড়কে স্পর্শ করিয়া সমস্ত টেবিল ঘুরিয়া একটা অসম্ভব পকেটে প্রবেশ করিয়াছে। এমনি অনেক বার ঘটিয়াছিল। ক্রমে আমার মনে এমন একটা মোহাচ্ছন্ন ভাব আসিয়া পড়িয়াছিল যে, যন্ত্রচালিতের মতো খেলিয়া গিয়াছিলাম। সোমনাথ সেদিন আমাকে হারাইতে পারে নাই।

খেলার শেষে মোহের অবস্থা কাটিয়া গেলে এই বলিয়া নিজেকে বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছিলাম যে, খেলার ক্ষেত্রে দৈবাৎ এরকম অঘটন ঘটিয়া যায়, নিকৃষ্ট খেলোয়াড়ও হঠাৎ ভাল খেলিয়া ফেলে। কিন্তু ইহার মধ্যে অলৌকিক কিছু আছে, তাহা তখন ভাবি নাই। আজ বরদা স্মরণ করাইয়া দিতেই সমস্ত ঘটনা মনে পড়িয়া বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকিয়া উঠিলাম।

আমি বিস্ফারিত নেত্রে চাহিয়া আছি দেখিয়া বরদা বলিল, তাহলে লক্ষ্য করেছিলে। আমি আর একটা জিনিস শুনেছিলুম যা তোমরা কেউ শোননি। খেলায় তন্ময় ছিলে বলেই বোধ হয় শুনতে পাওনি।

কি?

হাততালির শব্দ। সোমনাথ একটা খুব সুন্দর মার মেরেছিল; তিনটে বলে ঠোকাঠুকি হয়ে তিনটেই একই পকেটে গেল। ঠিক তারপর কে যেন খুব মোলায়েম হাতে হাততালি দিয়ে উঠল।

অমূল্য বলিল, ওটা প্রতিধ্বনি। যেখানে সহজ স্বাভাবিক ব্যাখ্যা সম্ভব সেখানে ভূত-প্রেত টেনে আনার মানে বুঝি না।-বলে বলে ঠোকাঠুকি হওয়ার আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হলে সেটা হাততালির মতোই মনে হয়।

বরদা বলিল, আশ্চর্য বলতে হবে। বল ঠোকাঠুকি তো বরাবরই হচ্ছিল, তবে প্রতিধ্বনিটা ঠিক সেই সময়েই হল কেন?

কিছুক্ষণ কোনও কথা হইল না। এইখানে একটা কথা উল্লেখ করা আবশ্যক। বহুরূপী নাম দিয়া যে ব্যাপারটা পূর্বে লিপিবদ্ধ করিয়াছি তাহা ঘটিবার পর হইতে বরদার গল্প সম্বন্ধে আমাদের মনের ভাব বেশ একটু পরিবর্তিত হইয়াছিল। সকলেরই নাস্তিকতার গোড়া একটু আলগা হইয়া গিয়াছিল। চুনী তো বিস্তর বই কিনিয়া মহা উৎসাহে প্রেততত্ত্বের চর্চা আরম্ভ করিয়া দিয়াছিল।

অমূল্য যদিও এখনও তর্ক করিতে ছাড়ে নাই, তবু তাহার ঝাঁজ অনেকটা কমিয়া আসিয়াছিল।

হৃষী আমাদের আলোচনাকে সিধা পথে ফিরাইয়া আনিল, বলিল, সে যা হোক, কথাটা শেষ পর্যন্ত দাঁড়াচ্ছে কি?—সোমনাথ যে বাড়ি কিনে একেবারে আলাদা মানুষ হয়ে গেল, আমাদের সংসর্গ পর্যন্ত ছেড়ে দিলে, এর কারণটা তো কেউ দেখাতে পারল না। তাকে ভূতে পেয়েছে একথায় শ্রদ্ধা করা যায় না। তবে হয়েছে কি তার?

বরদা আস্তে আস্তে বলিল, আমার কি মনে হয় জান? সোমনাথ আমাদের চেয়ে ঢের বেশী মনের মতো সঙ্গী পেয়েছে। পুরনো বাঁধনের পাশে খুব শক্ত নূতন বাঁধন পড়েছে, তাই পুরনো বাঁধন ঢিলে হয়ে গেছে।

বরদার কথার ইঙ্গিতটা ভুল করিবার মতো নয়, কিন্তু এতই উহা আজগুবি যে নির্বিচারে মানিয়া লওয়াও যায় না। অমূল্য আমাদের সকলের মনের ভাব যেন প্রতিধ্বনি করিয়া বলিল, অর্থাৎ, তুমি বলতে চাও, এক দঙ্গল ভূতের সঙ্গে সোমনাথের এতই দহরম-মহরম হয়ে গেছে যে, মানুষের সঙ্গ আর তার ভাল লাগছে না?

এবারও বরদা সোজাসুজি উত্তর দিল না, বরঞ্চ যেন নিজের চিন্তায় নিমগ্ন হইয়া গিয়াছে এমনি ভাবে চুপ করিয়া রহিল। মিনিট দুই-তিন পরে কতকটা আত্মগতভাবেই বলিল, Echoes প্রতিধ্বনি! অদ্ভুত নাম বাড়িটার। যে-লোক বাড়ি তৈরি করিয়েছিল সেই হয়তো নামকরণ করেছিল। কিংবা তার পরবর্তীরা বাড়ির আবহাওয়া দেখে নাম রেখেছিল—প্রতিধ্বনি!

চুনী এতক্ষণ বসিয়া আলোচনা শুনিতেছিল, কথা বলে নাই। এখন একবার গলা খাঁকারি দিয়া বলিল, কিছু দিন থেকে একটা থিওরি আমার মাথায় ঘুরছে

কিসের থিওরি?

এই সব হানাবাড়ি সম্বন্ধে। এখনও থিওরিটা খুব স্পষ্ট রূপ গ্রহণ করেনি, তবু

কি থিওরি তোমার শুনি।

চুনী একটু ইতস্তত করিয়া বলিল, ঐ প্রতিধ্বনি শব্দটার মধ্যেই আমার থিওরির বীজ নিহিত রয়েছে। দেখ, শব্দের যেমন প্রতিধ্বনি আছে, তেমনি বাস্তব ঘটনারও প্রতিধ্বনি থাকতে পারে না কি? প্রতিধ্বনি না বলে তাকে প্রতিবিম্বও বলতে পারব্যাপারটা মূলে একই। ধ্বনির প্রতিধ্বনি সব সময় থাকে না, এই ঘরের মধ্যে তোমরা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও এতটুকু প্রতিধ্বনি পাবে না। আবার এমন এক-একটা স্থান আছে যেখানে চুপি চুপি একটা কথা উচ্চারণ করলেও কোন্ অদৃশ্য প্রতিবন্ধকে ধাক্কা খেয়ে সেটা দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসে। আমার মনে হয় হানা বাড়িগুলোও এই জাতীয় স্থান। গ্রামোফোন রেকর্ডের মতো তারা অতীতের কতকগুলো বাস্তব ঘটনা সঞ্চয় করে রাখে, তারপর সুবিধে পেলেই তার প্রতিধ্বনি করতে থাকে। বরদা, তোমার কি মনে হয়?

থিওরিটা অভিনব বটে, কিন্তু বরদার মুখ হইতে ইহার অনুমোদন আশা করা যায় না। সে গোঁড়া ভূত-বিশ্বাসী, অথচ থিওরি সত্য হইলে ভৌতিক কাণ্ড মাত্রেই একটা যান্ত্রিক ব্যাপার হইয়া দাঁড়ায়—প্রেতযোনির স্বাধীন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব কিছু থাকে না।

বরদা ক্ষণেক চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, তাহলে তোমার মতে প্রেতযোনি নেই! যেগুলোকে ভৌতিক phenomenon বলে মনে হয় সেগুলো অতীতের প্রতিধ্বনি মাত্র?

চুনী বলিল, না, তা ঠিক নয়। আমি বলতে চাই, প্রেতযোনি থাকে থাক, কিন্তু হানাবাড়িতে সাধারণত যে-সব ব্যাপার ঘটে থাকে, সেগুলো হয়তো অধিকাংশই এই প্রতিধ্বনি-জাতীয়।

আমি বলিলাম, সোমনাথের বাড়িতে প্রতিধ্বনি আছে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সেটা কোন্ জাতীয়?

চুনী বলিল, সেইটেই আমি পরীক্ষা করে দেখতে চাই।–তোমরা কেউ রাজী আছ?

কি করতে হবে?

আমি স্থির করেছি একদিন সোমনাথের বাড়িতে গিয়ে রাত্রি যাপন করব। সে হঠাৎ এমন বদলে গেল কেন, তার একটা সন্তোষজনক কৈফিয়ত আবশ্যক, সুতরাং মনস্তত্ত্বের দিক দিয়েও পরীক্ষাটা তুচ্ছ হবে না; আর যদি সে এমন কিছু পেয়ে থাকে যার তুলনায় তার আজন্মের সমস্ত বন্ধন ঢিলে হয়ে গেছে, তাহলে সেই অপূর্ব বস্তুটি কি তাও আমাদের জানা দরকার।

অমূল্য একটু মুখ বাঁকাইয়া কবিতা আবৃত্তি করিল—

যে ধনে হইয়া ধনী মণিরে মান না মণি
        তাহারই খানিক
        মাগি আমি নতশিরে— যদি সুবিধে হয় গোটাকয়েক প্রেতাত্মা বরদার জন্যে চেয়ে নিয়ে এস, আমাদের এই ক্লাব-ঘরে পুষে রাখা যাবে।

আমি চুনীর দিকে ফিরিয়া বলিলাম, বেশ, আমি তোমার সঙ্গে যেতে রাজী আছি। কালই চল তাহলে, শনিবার আছে।

.

পরদিন সন্ধ্যাবেলা সোমনাথের বাড়ির সম্মুখে যখন পৌঁছিলাম, তখন ঘোর ঘোর হইয়া আসিয়াছে। প্রকাণ্ড হাতার মাঝখানে বাড়িখানা যেন একেবারে জনশূন্য মনে হইল।

বাড়ির বারান্দায় উঠিয়াও কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। আমি ও চুনী পরস্পর মুখ তাকাতাকি করিতে লাগিলাম। চাকরবাকর কেহই কি নাই? সব গেল কোথায়?

হাঁক দিব মনে করিতেছি, এমন সময় ভিতর হইতে খট খট শব্দ শুনিতে পাইলাম। ভুল হইবার নয়, বিলিয়ার্ড বলের ঠোকাঠুকি লাগার শব্দ। আশ্চর্য বোধ হইল। এই ভর-সন্ধ্যাবেলা সোমনাথ বিলিয়ার্ড খেলিতেছে! কাহার সহিত খেলিতেছে?

দুজনে ভিতরে প্রবেশ করিলাম। কোনও ঘরে এখনও বাতি জ্বলে নাই, কেবল বিলিয়ার্ড-রুম হইতে আলো আসিতেছে। আমরা নিঃশব্দে দরজার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলাম।

টেবিলের উপরকার সবুজ শেড-ঢাকা বাতি তিনটি শুধু জ্বলিতেছে—তাহাদের আলোকচক্রের। বাহিরে ঘর অন্ধকার। এই আলো-অন্ধকারের সীমানায় টেবিলের ধারে দাঁড়াইয়া সোমনাথ আত্মনিমগ্ন ভাবে কু-এর মুখাগ্রে খড়ি লাগাইতেছে। ঘরে আর কেহ নাই।

চুনী বলিয়া উঠিল, কি হে, একলাই খেলছ?

কে? সোমনাথ চমকিয়া মুখ ফিরাইল। তারপর দ্রুত দ্বারের কাছে আসিয়া সুইচ টিপিল; ঘরের অন্য আলোগুলা জ্বলিয়া উঠিল। আমাদের দেখিয়া সে প্রথম কিছুক্ষণ নিষ্পলক চক্ষে চাহিয়া রহিল, যেন ভাল করিয়া চিনিতেই পারিল না। আমরাও অপ্রতিভভাবে তাহার মুখের পানে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। বুঝিলাম, আমাদের সহিত তাহার মনের সংযোগ এমন পরিপূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছে যে, সহসা জোড়া লাগাইতে পারিতেছে না।

যাহোক, শেষ পর্যন্ত হাসির একটি চেষ্টা করিয়া সে বলিল, আরে তোমরা! তারপর হঠাৎ? কি ব্যাপার?

সোমনাথের কণ্ঠে যে সহজ অকৃত্রিম সমাদরের সুর শুনিতে আমরা অভ্যস্ত তাহা যেন ফুটিল না। আমি সঙ্কুচিতভাবে বলিলাম, ব্যাপার কিছু নয়, তোমার ঘরকন্না দেখতে এলুম।একলা বিলিয়ার্ড খেলছিলে নাকি?

একলা! কথাটা বলিয়াই সে সামলাইয়া লইল, মুখের উপর দিয়া একবার হাত চালাইয়া বলিল, হ্যাঁ, একলাই খেলছিলুম।—এস, বাইরে বসা যাক।

ঘরের আলো নিবাইয়া সোমনাথ আমাদের বারান্দায় লইয়া গিয়া বসাইল। এতক্ষণে বাহিরেও অন্ধকার হইয়া গিয়াছিল, ঝাউগাছটাতে অসংখ্য জোনাকি জ্বলিতেছিল। সে বলিল, আলো জ্বেলে দেব, না অন্ধকারেই বসবে?

চুনী বলিল, ক্ষতি কি, অন্ধকারেই বসা যাক।

বেতের মোড়ায় তিনজনে চুপচাপ বসিয়া আছি, কাহারও মুখে কথা নাই। হঠাৎ সোমনাথ বলিল, চা খাবে?

চুনী উত্তর দিল, না, আমরা চা খেয়ে বেরিয়েছি।—তারপর একবার গলাটা ঝাড়িয়া বলিল, তুমি দিন-দিন যেরকম ড়ুমুরফুল হয়ে উঠছ, ভয় হল দু-দিন বাদে হয়তো চিনতেই পারবে না। তাই আজ তোমার বাড়িতে রাত কাটাব বলে এসেছি। পুরনো বন্ধুত্ব মাঝে মাঝে ঝালিয়ে নিতে হবে তো?

এক মুহূর্ত সোমনাথ জবাব দিল না, তারপর যেন একটু বেশী মাত্রায় ঝোঁক দিয়া বলিয়া উঠিল, বেশ তো বেশ তো। তা, দাঁড়াও–আমি আসছি।

কোথায় যাচ্ছ?

বাবুর্চিটাকে খবর দিই, তোমাদের খানার ব্যবস্থা করুক। সোমনাথ উঠিয়া গেল।

মনে মনে ভারি কুণ্ঠা বোধ করিতে লাগিলাম। বন্ধুত্বের দাবিতে আতিথ্য গ্রহণ করিতে গিয়া অপর পক্ষের মনে অনাগ্রহের আভাস পাইলে গ্লানির আর অন্ত থাকে না। সোমনাথ বাহিরে হৃদ্যতার ভান করিতেছে বটে, কিন্তু অন্তরের সহিত আমাদের সাহচর্য চায় না—তাহা বুঝিতে কষ্ট হইল না। আগেকার অবাধ স্বচ্ছন্দ আত্মীয়তা আর নাই। শুধু তাই নয়, আমরা হঠাৎ আসিয়া পড়ায় সে বিশেষ বিব্রত হইয়া পড়িয়াছে, যেন তাহার সুনিয়ন্ত্রিত কার্যধারায় আমরা বিঘ্ন ঘটাইয়াছি। চুনী খাটো গলায় বলিল, কি হে, কি রকম মনে হচ্ছে?

সুবিধের নয়। ফিরে গেলেই বোধ হয় ভাল হত।

উহু—থাকতে হবে।

চুনী আরও কিছু বলিতে যাইতেছিল কিন্তু থামিয়া গেল। পরিপূর্ণ অন্ধকারে কেহ কাহাকেও দেখিতে পাইতেছিলাম না, অস্পষ্ট শব্দে বুঝিলাম সোমনাথ ফিরিয়া আসিয়া মোড়ায় বসিল। মোড়ার মচমচ শব্দ যে শুনিয়াছিলাম তাহা শপথ করিয়া বলিতে পারি।

চুনী সহজ আলাপের সুরে সোমনাথকে উদ্দেশ করিয়া বলিল, তারপর, একলা থাকতে তোমার কোনও কষ্ট হচ্ছে না?

সোমনাথ উত্তর দিল না।

এই সময়, কেন জানি না, আমার ঘাড়ের রোঁয়া হঠাৎ শক্ত হইয়া খাড়া হইয়া উঠিল। চুনীও হয়তো কিছু অনুভব করিয়া থাকিবে, কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া সে হঠাৎ দেশলাই জ্বালিল। দেখিলাম সোমনাথের মোড়ায় কেহ বসিয়া নাই।

দেশলাইয়ের কাঠি শেষ পর্যন্ত জ্বলিয়া আস্তে আস্তে নিবিয়া গেল। অবরুদ্ধ নিশ্বাস মোচন করিয়া চুনী মৃদুস্বরে বলিল, প্রতিধ্বনি।

এইবার সোমনাথের স্পষ্ট পদশব্দ শুনিতে পাইলাম, শব্দটা কাছে আসিলে চুনী বলিয়া উঠিল, সোমনাথ?

হ্যাঁ।

আলোটা জ্বেলে নাও ভাই, অন্ধকার আর ভাল লাগছে না। কথার শেষে হাসিতে গিয়া তাহার গলাটা কাঁপিয়া গেল।

বারান্দার আলো জ্বালিয়া দিয়া সোমনাথ আসিয়া বসিল। সাদা ঢাকনির মধ্যে মৃদুশক্তি বা স্নিগ্ধ আলো বিকীর্ণ করিতে লাগিল। অন্ধকারের চেয়ে এ ভাল, তবু পরস্পর মুখ দেখা যায়।

সোমনাথ বলিল, বাবুর্চিকে বলে এলুম। শুধু মুর্গির কারি আর পরটা। তার বেশী কিছু যোগাড় হয়ে উঠল না।

ইতিমধ্যে যে ক্ষুদ্র ব্যাপারটি ঘটিয়াছিল তাহার উল্লেখ না করিয়া চুনী বলিল, যথেষ্ট যথেষ্ট। অমৃতের ব্যবস্থা থাকলে পাঁচ রকম ব্যঞ্জনের দরকার হয় না কিন্তু তুমি বাবুর্চি রেখেছ যে!

সোমনাথ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, রাখিনি ঠিক। বাড়ির যে বুড়ো চৌকিদারটা ছিল সে-ই রেঁধে দেয়—

রাঁধুনী বামুন পেলে না?

দরকার বোধ করি না। আমি একলা মানুষ

চাকরও তো দেখছি না। চাকর রাখনি কেন?

রেখেছিলাম একজন, কিন্তু

রইল না? চুনী মোড়া টানিয়া লইয়া সোমনাথের নিকটে ঘেঁষিয়া বসিল, বলিল, আসল কথাটা কি বল তো সোমনাথ। বাড়িতে কিছু আছে না?

মুখে একটা বিস্ময়ের ভাব আনিয়া সোমনাথ বলিল, কি থাকবে?

সেই কথাই তো জানতে চাইছি। শহরের এক টেরে এই পুরনো বাড়ি, চাকর বামুন থাকতে চায় কিছু থাকা বিচিত্র নয়।

সোমনাথের চোখের উপর অদৃশ্য পর্দা নামিয়া আসিল। সে হাসিবার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করিয়া বলিল, পাগল না ক্ষ্যাপা। ওসব কিছু নয়। শহর থেকে দুর পড়ে তাই চাকরবাকর থাকতে চায় না।

বুঝিলাম, কিছু বলিবে না। ইচ্ছা করিলে যে অনেক কিছু বলিতে পারে তাহাও বুঝা গেল; কারণ সোমনাথ মনের ভাব গোপন করিতে পারে না, মুখে চোখে প্রকাশ হইয়া পড়ে। কিন্তু লুকাইতে চায় কেন? যাহা সে জানিয়াছে তাহার অংশীদার রাখিতে চায় নাকৃপণের মতো একা ভোগ করিতে চায়? কিংবা অবিশ্বাসীর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের ভয়ে বলিতে চায় না?

চুনী কিন্তু ছাড়িবার পাত্র নয়। সোজাসুজি জেরায় ফল হইল না দেখিয়া সে অন্য পথ ধরিল। কিছুক্ষণ একথা সে কথার পর হানাবাড়ি সম্বন্ধে নিজের থিওরির কথা পাড়িল। বেশ ফলাও করিয়া লেকচারের ভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করিয়া নিজের থিওরির সম্ভাব্যতা প্রমাণ করিতে লাগিল। সোমনাথও দেখিলাম একমনে গালে হাত দিয়া শুনিতেছে।

ইতিমধ্যে আমাদের চারিপাশে যে একটি অতীন্দ্রিয় ব্যাপার ঘটিতে আরম্ভ করিয়াছে, তাহা বোধ করি ইহারা দুজনে জানিতে পারে নাই। প্রথমটা আমিও লক্ষ্য করি নাই, কিন্তু হঠাৎ এক সময় মনে। হইল কাহারা নিঃশব্দে আসিয়া আমাদের ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া একাগ্র মনে চুনীর কথা শুনিতেছে। চোখে কিছুই দেখিলাম না, এমন কি কানে কিছু শুনিয়াছিলাম এমন কথাও জোর করিয়া বলিতে পারি না, তবু কেমন করিয়া এই অদৃশ্য আবির্ভাবের কথা জানিতে পারিলাম তাহা আমার কাছে এক প্রহেলিকা। কিন্তু জানিতে যে পারিয়াছিলাম তাহাতে বিন্দুমাত্র সংশয় নাই। ইহা অনুমান বা উত্তেজনাজনিত কল্পনার রূপায়ণ নয়—স্পর্শ করিবার মতো অত্যন্ত বাস্তব অনুভূতি। অপরিস্ফুট আলোকে তাহাদের দেখিতে পাইতেছি না বটে, কিন্তু তাহারা যে আমাদের গা ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া উৎকর্ণ ভাবে চুনীর কথা শুনিতেছে ইহা প্রত্যক্ষ অনুভূতির মতোই সত্য।

ক্রমে একটি অতিমৃদু সুগন্ধ নাকে আসিতে লাগিল। তাজা ফুলের বা আতর এসেন্সের গন্ধ নয়—পপৌরির মতো একটু বাসি অথচ সুমিষ্ট সৌরভ। ধীরে ধীরে গন্ধ স্পষ্টতর হইয়া উঠিতে লাগিল। তখন বুঝিতে পারিলাম, জিয়ানো ল্যাভেন্ডার ফুলের গন্ধ।

চুনী তখনও থিওরি ব্যাখ্যা করিতেছিল, তাই গন্ধ নাকে গেলেও সে বোধ হয় উহা লক্ষ্য করে নাই। আলোচনা শেষ করিয়া সে বলিল, অবশ্য এটা আমার মনগড়া কাল্পনিক থিওরি। তবু কিছু ভিত্তি কি এর নেই? তোমার কি রকম মনে হচ্ছে?

সোমনাথ মুখ তুলিয়া বোধ করি একটা কিছু উত্তর দিতে যাইতেছিল, চুনী সচকিতভাবে চারিদিকে চাহিয়া বলিল, গন্ধ! কিসের গন্ধ!

আমি বলিলাম, পেয়েছ তাহলে। ল্যাভেন্ডারের গন্ধ।

সোমনাথের চোখের মধ্যে যেন বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল, সে ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ল্যাভেন্ডারের গন্ধ! না না, ও তোমাদের ভুল। গন্ধ কই? আমি তো কিছু পাচ্ছি না।

চুনী বলিল, সত্যি পাচ্ছ না?

না কিছু না বলিয়া সজোরে মাথা নাড়িল। সে যেন জোর করিয়াই গন্ধটা উড়াইয়া দিতে চায়।

কিন্তু গন্ধকে উড়াইয়া লইয়া গেল অন্য জিনিস। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া বাড়ির ভিতর দিক হইতে আসিয়া সমস্ত গন্ধটুকু এক নিমেষে ভাসাইয়া লইয়া চলিয়া গেল। বিস্মিতভাবে বাহিরের দিকে তাকাইলাম; ঝাউগাছের জোনাকিমণ্ডিত বিরাট দেহ অন্ধকারে চোখে পড়িল। ঝাউগাছ একেবারে নিস্তব্ধ; অল্পমাত্র বাতাস বহিলে যে-গাছ মর্মরধ্বনি করিয়া উঠে, তাহাতে শব্দমাত্র নাই।

সোমনাথ আবার মোড়ায় বসিয়া পড়িয়াছিল; চুনী প্রখর জিজ্ঞাসু নেত্রে চারিদিকে চাহিতেছিল। আমি নিম্নস্বরে বলিলাম, চলে গেছে যারা এসেছিল তারা আর নেই। চুনী, গন্ধটাও কি প্রতিধ্বনি?

তারপর, গরুর গাড়ি যেমন ভাঙা অসমতল পথ দিয়া চলে, তেমনি অসংলগ্ন বাধাবহুল আলোচনার ভিতর দিয়া আহারের পূর্বের ঘন্টা-দুই সময় কাটিয়া গেল। সোমনাথ মুহ্যমান হইয়া রহিল, আমরাও মনের মধ্যে একটা নামহীন অস্বাচ্ছন্দ্য লইয়া বসিয়া রহিলাম। অসাধারণ আর কিছু অনুভব করিলাম না। যাহারা আসিয়াছিল, তাহারা যেন আমাদের অধিকার বহির্ভূত কৌতূহল দেখিয়া সন্ত্রস্তভাবে চলিয়া গিয়াছে।

নিঃশব্দে আহার শেষ হইল; বুড়া চৌকিদার পরিবেশন করিল। অনুভবে বুঝিলাম সেও আমাদের উপর খুশি নয়। তাহার সাদা ভ্রূযুগল নীরবে আমাদের ধিক্কার দিতে লাগিল। অবরোধের পদার ভিতর উঁকি মারিবার চেষ্টা করিয়া আমরা যেন বর্বরোচিত অশিষ্ট করিয়াছি।

বারান্দার এক প্রান্তে তিনটি ক্যাম্প-খাট পাড়িয়া শয়নের ব্যবস্থা হইয়াছিল। তাড়াতাড়ি শুইয়া পড়িলাম। কোনও মতে রাত্রিটা কাটিলে যেন বাঁচা যায়।

তিনজনে পাশাপাশি শুইয়া আছি; কথাবার্তা নাই। চুনী শুইয়া শুইয়া সিগারেট টানিতেছে, অন্ধকারে তাহার সিগারেটের আগুন উজ্জ্বল হইয়া আবার নিস্তেজ হইয়া পড়িতেছে। সোমনাথ একেবারে নিশ্চল হইয়া আছে; হয়তো ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। কয়েকটা জোনাকি আমাদের বিছানার চারিপাশে উড়িয়া উড়িয়া যেন পাহারা দিতেছে।

নানা কথা মনে আসিতে লাগিল। আজ যাহা যাহা ঘটিয়াছে, চুনীর থিওরির সহিত তাহা একেবারে বে-খাপ নয়। তবু যাহারা চুনীর কথা শুনিতেছিল তাহারা কি শুধুই অতীতের প্রতিবিম্ব? সোমনাথ এ-বিষয়ে এমন একগুঁয়ে ভাবে নীরব কেন? অতীতের ছায়ার সহিত বর্তমানের মানুষের এমন সাক্ষাৎ-সম্বন্ধ ঘটে কি করিয়া? আর, যদি সজীব স্বতন্ত্র আত্মা হয়, তবে উহারা কাহারা? ল্যাভেন্ডার ফুলের গন্ধ কেন আসিল? সেকালে ইংরেজ মেয়েদের ল্যাভেন্ডার ফুল একটা সৌখীনতা ছিল শুনিয়াছি। সেই গন্ধ অতীতের কোন্ দেহ-সৌরভের সহিত মিশিয়া ভাসিয়া আসিল।…

বোধ হয় তন্দ্রাচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছিলাম, এক মুহূর্তে সমস্ত চেতনা সতর্ক হইয়া জাগিয়া উঠিল। কিছুক্ষণ নিস্পন্দভাবে শুইয়া রহিলাম, তারপর বাড়ির ভিতর হইতে পরিচিত খটখট শব্দ কানে আসিল।

ঘাড় তুলিয়া দেখিলাম, চুনী বিছানায় উঠিয়া বসিয়াছে। সে নিঃশব্দপদে উঠিয়া আসিয়া আমার কানে কানে বলিল, শুনতে পাচ্ছ?—সোমনাথ বিছানায় নেই, কখন উঠে গেছে। এস—দেখা যাক। শব্দ করো না।

তন্দ্রার মধ্যে এক ঘণ্টা কাটিয়া গিয়াছে, রেডিয়াম-যুক্ত হাতঘড়ি দেখিয়া বুঝিতে পারিলাম। রাত্রি সাড়ে এগারটা। অন্ধকারে পা টিপিয়া দুজনে বিলিয়ার্ড-ঘরের দিকে চলিলাম।

দ্বার পর্যন্ত গিয়া আমরা আর অগ্রসর হইলাম না। টেবিলের উপর তেমনি তিনটি আলো জ্বলিতেছে বাকি ঘর অন্ধকার। সোমনাথ টেবিলের উপর ঝুঁকিয়া বল মারিতেছিল, তাহার মুখ স্পষ্ট দেখিতে পাইলাম। মুখের চেহারা একেবারে বদলাইয়া গিয়াছে-সন্ধ্যাবেলার সেই অবসাদগ্রস্ত মুহ্যমান ভাব আর নাই। চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল, খেলার আনন্দ প্রতি অঙ্গ সঞ্চালনে ফুটিয়া বাহির হইতেছে। মনে পড়িল, কয়েক মাস আগে সোমনাথ এমনিই ছিল, বাড়ি কিনিবার পর হইতে তাহার এই প্রাণখোলা আমোদে-মাতিয়া-ওঠা মূর্তি আর দেখি নাই।

বল মারিয়া সোমনাথ লঘু কণ্ঠে হাসিয়া উঠিল, তারপর নিজেই সচকিতে ঠোঁটের উপর আঙুল রাখিয়া মৃদু স্বরে কি একটা বলিল। পরক্ষণে আর একটি সুমিষ্ট হাসির শব্দ কানে আসিল। হয়তো ইহা সোমনাথের হাসির প্রতিধ্বনি, কিন্তু পদায় ও মিষ্টতায় এত প্রভেদ যে, রমণীকণ্ঠের হাসি বলিয়া ভ্রম হয়।

খেলা চলিতে লাগিল। সোমনাথ একা খেলিতেছে, তবু যেন একা খেলিতেছে না; কাহারও সঙ্গে কৌতুকপূর্ণ প্রতিযোগিতা চলিতেছে। সম্মোহিতের মতো দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিলাম; সোমনাথ খেলিতেছে, মৃদুস্বরে কাহাদের সহিত কথা কহিতেছে, সন্তর্পণে গলা নামাইয়া হাসিতেছে। প্রতিধ্বনিও তাহার সহিত তাল রাখিয়া চলিয়াছে, কখনও ভারী গলায় গম্ভীর আওয়াজ হইতেছে, আবার কখনও কোমল কণ্ঠের অধোচ্চারিত মৃদুভাষণ কানে কানে অর্থহীন কথা বলিয়া যাইতেছে।

সমস্তই যেন চুপি চুপি। লুকাইয়া লুকাইয়া আমোদ-কৌতুক চলিতেছে, তাই রঙ্গ রস আরও গাঢ় হইয়াছে। বুঝিতে পারিলাম, আমরাই এই লুকোচুরির লক্ষ্যবস্তু, আমাদের জন্যই ইহারা প্রকাশ্য মজলিশ জমাইতে পারিতেছে না। সন্ধ্যাবেলা আসিয়া রঙ্গ-ভঙ্গ করিয়াছিলাম, পাছে জাগিয়া উঠিয়া আবার বিঘ্ন করি তাই গভীর রাত্রে এই ত্রস্ত সতর্কতা।

আমাদের পাশ দিয়া কে একজন চলিয়া গেল। চুনী নিঃশব্দে আমার হাত ধরিয়া টানিয়া লইল। ফিরিয়া আসিয়া বিছানায় বসিলাম। চুনী জিজ্ঞাসা করিল, সোেমনাথ ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেলে?

না। চোখে দেখিনি—কিন্তু

জানি। কিন্তু সেগুলো যে আমাদের মনের কল্পনা নয় তার প্রমাণ কি? সোমনাথ হয়তো পাগল হয়ে গেছে। তাই নিজের মনে হাসছে, কথা কইছে।

কিন্তু গন্ধ? আওয়াজ? এগুলো কি?

এগুলো প্রতিধ্বনি হতে পারে। হয়তো এই প্রতিধ্বনিই সোমনাথকে পাগল করে দিয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা চোখে কিছু দেখিনি; শুধু শব্দ আর গন্ধ। অতীতের কতকগুলো শব্দ-গন্ধ এই বাড়িটাকে আঁকড়ে ধরে আছে। তাতে দেহ-বিমুক্ত স্বতন্ত্র আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণ হয় না।

প্রমাণ যে হয় তার পরিচয় সঙ্গে সঙ্গে পাইলাম। জোনাকির উল্লেখ আগে কয়েকবার করিয়াছি; এখন দেখিলাম কয়েকটা জোনাকি আমাদের মুখের সামনে আসিয়া শুন্যে তাল পাকাইতে লাগিল। তাহাদের সঞ্চরমান নীল আলো ক্রমশ ঘনীভূত হইয়া জমাট আকার ধারণ করিতেছে। দেখিতে দেখিতে একখানি মুখ ঐ জোনাকির আলোয় শুন্যে ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। কেমন করিয়া ইহা সম্ভব হইল জানি না, কিন্তু একটি পাংশু নীলাভ নারীমুখ স্পষ্ট আমাদের চোখের সামনে ফুটিয়া উঠিল—যেন অন্ধকারের পটে জোনাকির আলো দিয়া একটি ছবি আঁকা হইতেছে! মোমে গড়া মুখোশের মতো নিশ্চল মুখ, কিন্তু চোখে কটাক্ষ রহিয়াছে। ক্ষণেকের জন্য একটি জীবন্ত মানুষী অস্তিত্বের স্পর্শ অনুভব করিলাম।

তারপর জোনাকিরা ছত্রভঙ্গ হইয়া গেল। দেহের সমস্ত পেশী শক্ত করিয়া রহিলাম, বুকের স্পন্দন দপ দপ করিয়া কণ্ঠের কাছে ধাক্কা খাইতে লাগিল। কতক্ষণ এইভাবে কাটিয়া গেল জানি না।

আমিই প্রথম কথা কহিলাম, চুনী, এবার চোখে দেখা হয়েছে? এও কি প্রতিধ্বনি?

চুনী উত্তর দিল না; আস্তে আস্তে বিছানায় শুইয়া পড়িল।

.

পরদিন সকালে বিলিয়ার্ড রুমে দাঁড়াইয়া সোমনাথের নিকট বিদায় লইলাম। চুনীর চোখের কোলে কালি পড়িয়াছিল; সম্ভবত আমার মুখখানাও নিশ্চিহ্ন ছিল না, কিন্তু আয়নার অভাবে নিজের অবস্থা ঠিক বুঝিতে পারিতেছিলাম না।

চুনী বলিল, একটা রাত্রি তোমাকে খুবই জ্বালাতন করলুম। কিছু মনে করো না সোমনাথ।

সোমনাথ বলিল—না না—সে কি কথা—

চুনী বলিল, যাহোক, আমাদের দিক থেকে অভিযান একেবারে নিস্ফল হয়নি, কতকগুলো নূতন অভিজ্ঞতা লাভ করা গেল। আমাদের দুঃখ শুধু এই যে, তোমার অভিজ্ঞতা তুমি আমাদের কাছে লুকিয়েই রাখলে, প্রকাশ করলে না।

সোমনাথ কুণ্ঠিত চক্ষে চাহিয়া রহিল।

আমার থিওরি কাল তোমায় বলেছি, সেটা সত্যি কিনা ইচ্ছে করলেই তুমি বলতে পারতে।

কি—কি বলতে পারতুম? সোমনাথ ঢোক গিলিল।

এখনও বলতে পার। কাল রাত্রে আমরা যা যা অনুভব করেছি, সেগুলো কি এই বাড়িতে সঞ্চিত কতকগুলো স্মৃতির ছায়া, না সত্যিকার জীবন্ত কিছু আছে?

সোমনাথ উত্তর দিল না, ঘাড় হেঁট করিয়া বসিয়া রহিল। উত্তর দিল প্রতিধ্বনি; কানের কাছে চুপি চুপি বলিল, আছে! আছে! আছে!

২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *