নিকোলাস নিকলবি – ৭

সাত

বাজে আবহাওয়ায় দুশো মাইলের ক্লান্তিকর ভ্রমণ শেষে, শক্ত বিছানাও তুলোর মত নরম ঠেকে। মিস্টার স্কুয়্যারস যখন সকালে ঘুম থেকে ওঠালেন নিকোলাসকে, তখন সে মধুর সব স্বপ্ন দেখছিল।

‘সকাল হয়ে গেছে?’ ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বলল নিকোলাস।

‘হ্যাঁ,’ বললেন স্কুয়্যারস। ‘পাম্পটাও জমে বরফ হয়ে গেছে। পানি পাবে না।’

‘পানি পাব না!’ আঁতকে উঠল নিকোলাস।

‘না,’ রূঢ় কণ্ঠে বললেন স্কুয়্যারস। ‘হাত-মুখ মুছে কাজ চালাও। বরফ ভাঙলে কিছু পানি বেরোবে। তবে তাও ছেলেদের ব্যবহারের জন্যে। জলদি ওঠো।’ ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে কাপড় পরে নিল নিকোলাস।

পরে, মিসেস স্কুয়্যারস ওঘরে এসে গজগজ করতে লাগলেন দেয়ালের কাবার্ড খুলে। ‘চামচটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। ছেলেদের ওষুধ খাওয়ানোর সময় হয়ে গেল।’

‘হ্যাঁ,’ বললেন স্কুয়্যারস। বুঝলে, নিকোলাস, ছেলেদের রক্ত পরিষ্কার রাখতে এক ধরনের সিরাপ খাওয়াই আমরা।’

‘তাই বলে মনে কোরো না যে, ছোঁড়াগুলোর স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে পয়সা খরচ করি,’ বললেন মিসেস স্কুয়্যারস।

‘এসব তুমি কি বলছ?’ ভ্রূ কুঁচকে প্রশ্ন করলেন স্কুলশিক্ষক।

‘ঠিকই বলছি!’ গর্জে উঠলেন ভদ্রমহিলা। ‘এই ছেলের যদি টীচারি করতে হয়, তবে সবই জানা থাকা দরকার। ওষুধ না খাওয়ালে অসুখ বাধিয়ে ঝামেলা পাকাবে বিচ্ছুগুলো। তাছাড়া, এই সিরাপে খিদে মরে যায়, ফলে সকালের নাস্তা আর ডিনারে রুচি হয় না ওদের। ওদেরও স্বাস্থ্য ভাল থাকল, আমাদেরও পয়সা বাঁচল।’

ব্যাখ্যা শেষে ভদ্রমহিলা কাবার্ডে মাথা গলালেন, তাঁর স্বামীও চামচটা খুঁজতে সাহায্য করছেন। পেলেন না ওঁরা। শেষ পর্যন্ত ডাক পড়ল স্মাইকের। সে-ও পাচ্ছে না বলে বেশ কিছু কান মলা খেলো। শেষতক মিসেস স্কুয়্যারসের পকেটে ও-ই চামচটা আবিষ্কার করল- সেজন্যে আক্কেল, সেলামী হিসেবে তার কানে আরেকটা মোচড় পড়ল। ‘আমার বউয়ের মত মানুষ হয় না,’ স্ত্রী স্মাইককে ঠেলে নিয়ে ঘর থেকে বেরোলে বললেন স্কুয়্যারস। ‘ছেলেদের জন্যে কী না করে! ও যা করে কোন মা তা করবে না।

‘তাই তো দেখছি, স্যার,’ ফোড়ন কাটল নিকোলাস। বুঝলেন না ভদ্রলোক। সত্যি কথাটা হচ্ছে, স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই ছাত্রদেরকে জাত শত্রু মনে করেন। তাঁদের ধারণা, ছেলেদের কাছ থেকে যথাসম্ভব শুষে নেয়াটা তাঁদের দায়িত্ব। তবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটি অমিলও রয়েছে। মিস্টার স্কুয়্যারস খোলাখুলি শত্রুতা করেন, আর তাঁর স্ত্রী রেখে ঢেকে। অন্তত নতুন শিক্ষক নিকোলাসের তাই মনে হলো। ‘এসো,’ বললেন স্কুয়্যারস। ‘স্কুলরূমে যাই।’

নিকোলাস তার চাকরিদাতার সঙ্গে উঠন পেরিয়ে, বাড়ির পেছন দিকে একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। মিস্টার স্কুয়্যারস হাতে করে বেত এনেছেন।

‘এটাই!’ একসঙ্গে ভেতরে ঢোকার সময় বললেন স্কুল শিক্ষক, ‘আমাদের পাঠশালা!’

শ্রেণীকক্ষের ভেতর কেবল মাথা আর মাথা। স্কুলরূমের ধুলো-ময়লা আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেখে থ হয়ে গেল নিকোলাস। পাঠশালা না গোশালা? নোংরা ঘরটায় দুটোমাত্র জানালা, কাঁচ ভেঙে যাওয়ায় কাগজ সাঁটানো হয়েছে। দেয়ালে কোনদিন চুনকাম করা হয়েছে কিনা সন্দেহ। ক’টা লম্বা মত ভাঙাচোরা ডেস্ক, লম্বা কাঠের বেঞ্চি, শিক্ষকের ডেস্ক দেখা যাচ্ছে। সবগুলোর বেহাল দশা! কিন্তু তারচেয়েও করুণ অবস্থা ছাত্রদের। ওদের দিকে চেয়ে অসহায় বোধ করল নিকোলাস- এখানে পড়াশোনা করাবে কি করে সে?

শুকনো ছেলেগুলোর মলিন মুখ, ম্লান চোখ নিদারুণ নিষ্ঠুরতা আর অবহেলার সাক্ষ্য দিচ্ছে। ছেলেবেলার উচ্ছলতার বদলে কচিমুখগুলোয় ফুটে উঠেছে অব্যক্ত বেদনা। কিছু ছেলের চোখের দৃষ্টি জেলখানার দাগী আসামীদেরও বুক কাঁপিয়ে দেবে, মায়ের ভালবাসা কাকে বলে জানে না এরা। নিকোলাসের অন্তর দুঃখে ভরে গেল, এমন স্কুলের অস্তিত্ব থাকতে পারে কখনও ভাবেনি সে।

ওদিকে, মিসেস স্কুয়্যারস এক সার ডেস্কের পেছনে তাঁর সিরাপ নিয়ে তৈরি। বড় এক গামলা ভর্তি করে এনেছেন। শক্ত হাতে চামচ ধরে আছেন, ছেলেরা একে একে এলে তাদের মুখে ঠুসে দিচ্ছেন ওষুধের চামচ। কারও ভাগে যাতে কম না পড়ে সেদিকে কড়া নজর তাঁর।

এক কোণে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গত রাতে আসা ছেলেগুলো, পরনের পুরানো পোশাক ওদের বলে মনে হলো না। ওদের সব ক’টা চোখ ছোট একটি ছেলের ওপর স্থির, স্মাইককে একাধারে লাথি মেরে চলেছে সে। ছেলেটি দেখতে মিস্টার স্কুয়্যারসের মত। তাকে নতুন জুতো পরাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে স্মাইককে। জুতোজোড়া গতকাল আসা ছেলেদের একজনের। চিনতে পেরেও চুপ করে রয়েছে সে বেচারা। ছেলেদের দঙ্গলের দিকে আবারও চাইল নিকোলাস, এত জীর্ণ কাপড় কাউকে কখনও পরতে দেখেনি ও।

‘ওষুধ ফুরিয়েছে?’ ডেস্কে বেতের বাড়ি মেরে জানতে চাইলেন মিস্টার স্কুয়্যারস।

‘এই তো হয়ে গেছে,’ বললেন তাঁর স্ত্রী, শেষ ছেলেটিকে ওষুধ গিলিয়ে দিলেন। ‘এই স্মাইক, গামলাটা নিয়ে যা। জলদি!’

কাছে দাঁড়ানো ছেলেটার কোঁকড়া চুলে হাত মুছে রান্নাঘরের দিকে ছুটলেন মিসেস স্কুয়্যারস। ইতোমধ্যে একটা খালি টেবিলে কাঠের ছোট ছোট পাত্র সাজানো হয়েছে। সেগুলোতে বাদামী রঙের কি একটা পদার্থ ঢালা হলো- মুখে পরিজ বললেও দেখে কাঠের গুঁড়ো বই আর কিছু মনে করার জো নেই। ছেলেরা কিন্তু এতে অভ্যস্ত, পাত পেড়ে বসে পড়ল। ছোট এক টুকরো পাউরুটি রাখা হয়েছে প্রতিটি পাত্রে, চামচ হিসেবে ব্যবহার করার জন্যে। পরিজ খাওয়া হলে ওটা খেয়ে নাস্তা সারল ছেলেরা।

এবার গম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন স্কুলশিক্ষক, ‘এই সুস্বাদু নাস্তার জন্যে, ঈশ্বর আমাদের সত্যিকারের কৃতজ্ঞ হতে শিক্ষা দিন।’ কথাগুলো বলে নাস্তা খেতে গেলেন তিনি

নিজের ভাগের পরিজ খেতে গিয়ে মুখ বিকৃত হয়ে গেল নিকোলাসের। ওর পাউরুটির টুকরোটার সঙ্গে পদমর্যাদার নিদর্শন হিসেবে খানিকটা মাখন দেয়া হয়েছে। নাস্তা শেষে ক্লাস শুরুর অপেক্ষা করতে লাগল ও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *