নিকোলাস নিকলবি – ১২

বারো

হাঁটার ফাঁকে মনস্থির করে নিল নিকোলাস। লণ্ডনে ফিরে যাবে। পকেটে মাত্র চার শিলিং আর কয়েক পেন্স রয়েছে, যেতে হবে প্রায় আড়াইশো মাইল। ক্ষতি নেই, প্রয়োজন পড়লে এর দ্বিগুণ রাস্তা হাঁটবে ও, সরে যাবে এখান থেকে যতদূর সম্ভব।

মুখ তুলতে দেখতে পেল এক অশ্বারোহী ওর দিকেই আসছে। চিনতেও পারল। মিস্টার জন ব্রাউডি। স্কুয়্যারসের স্কুলে পরিচয় হয়েছিল। কর্কশ ইয়র্কশায়ারীয় কণ্ঠে নিকোলাসকে অভিবাদন জানালেন ভদ্রলোক।

‘কি ব্যাপার- মুখে কি হয়েছে?’

‘কেটে গেছে,’ জবাব দিতে গিয়ে লাল হয়ে গেল চেহারা। তবে হাতের সুখ মিটিয়ে বদলাও নিয়েছি।

‘বাহ্, ভাল করেছেন,’ উৎসাহ জোগালেন ভদ্রলোক।

‘আসল ঘটনা হচ্ছে আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়েছে,’ বলল নিকোলাস, কিভাবে ব্যাখ্যা করবে বুঝতে পারছে না।

‘তাই নাকি? কে করেছে?’

‘স্কুয়্যারস,’ বলল নিকোলাস। ‘ওকে ধোলাই করে চলে যাচ্ছি।’

কি! স্কুলমাস্টারকে মেরেছেন!’ বিস্ময়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন ব্ৰাউডি। ‘হো! হো! হো! এমন কথা কেউ কখনও শুনেছে? আপনার হাতটা দিন দেখি। স্কুলমাস্টারকে পিটিয়েছেন! খুব ভাল কাজ করেছেন, সাহেব!’ ভদ্রলোক হাসতে হাসতে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যান আরকি।

‘তা চললেন কোথায়?’ অবশেষে জানতে চাইলেন।

‘লণ্ডন।’

‘যাবেন কিভাবে?’

‘হেঁটে।’

ভদ্রলোকের মুখ হাঁ হওয়ার জোগাড়। ‘সঙ্গে কত টাকা আছে?’

‘বেশি না,’ বলল নিকোলাস। তবে ম্যানেজ করে ফেলব। ইচ্ছাটাই আসল, উপায় হয়েই যায়।’

জবাব না দিয়ে মানিব্যাগ বার করলেন ব্রাউডি, প্রয়োজন অনুযায়ী ধার নিতে সাধতে লাগলেন নিকোলাসকে। ‘নিন না,’ বললেন উনি, ‘ফেরার পয়সাটা অন্তত রাখুন। শোধ তো একদিন করবেনই জানি।’ অবশেষে ভদ্রলোকের ঝুলোঝুলির কাছে হার মানতে হলো। অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে এক পাউণ্ড ধার নিল নিকোলাস।

‘এই লাঠিটাও রাখুন, পথে কাজে আসতে পারে,’ রওনা দেয়ার সময় বললেন ব্রাউডি। ‘আপনার মঙ্গল হোক!’ করমর্দন করে ঘোড়া ছোটালেন। ওঁকে যতক্ষণ দেখা যায় চেয়ে রইল নিকোলাস। তারপর ঘুরে হাঁটা ধরল।

সে সন্ধ্যেয় বেশিদূর যেতে পারল না। তুষারপাত শুরু হয়েছে, ঘুটঘুটে অন্ধকার। একটা সরাইখানায় রাতটা কাটিয়ে ভোরে আবার যাত্রা করল।

সারাদিন একটানা হেঁটে রাতে আবার সস্তার সরাইখানা খোঁজ করতে লাগল। পেল না। শেষমেশ একটা গোলাঘর দেখতে পেয়ে সেঁধিয়ে পড়ল। এক কোণে এলিয়ে দিল ক্লান্ত শরীরটা, কখন ঘুমিয়ে পড়েছে জানতেও পারল না।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলে ধড়ফড় করে উঠে বসল, চোখ কচলে দেখতে পেল কে যেন শুয়ে রয়েছে ওর পাশে। স্বপ্ন দেখছে না তো? ওটা স্মাইক নাকি? হ্যাঁ, সে-ই। হঠাৎ হাঁটু গেড়ে ওর পাশে বসে পড়ল ছেলেটি

‘আমাকে আপনার সঙ্গে নিয়ে চলুন- যেখানে বলবেন যার- আপনি বললে কবরে যেতেও রাজি আছি, নিকোলাসের হাত আঁকড়ে ধরে অনুনয় করল স্মাইক। ‘আপনিই আমার ভরসা- আমাকে সঙ্গে নিন, প্লীজ!’

‘আমার ওপর ভরসা করে তো কিছু পাবে না,’ বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল নিকোলাস। ‘নিজেরই নাজেহাল অবস্থা। আমাকে খুঁজে পেলে কিভাবে?’ গত দুদিন ধরে নাকি ওকে অনুসরণ করেছে স্মাইক। আগে দেখা দেয়নি, নিকোলাস যদি ওকে ফিরিয়ে দেয় সেই ভয়ে।

‘বেচারা!’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল নিকোলাস। ‘একটাই মাত্র বন্ধু তোমার, সে-ও তোমার মতই হতদরিদ্র, অসহায়!’

‘তবু আমাকে সঙ্গে নিন,’ মিনতি ঝরল স্মাইকের কণ্ঠে। ‘আমি সারাজীবন আপনার চাকর হয়ে থাকব। আমি শুধু আপনার কাছে কাছে থাকতে চাই, ব্যস।’

‘থাকবে!’ বলল নিকোলাস। ‘দু’জনে একসঙ্গে দুনিয়াকে মোকাবেলা করব। এসো!’ কাপড়ের পোঁটলা নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে, হাত বাড়িয়ে দিল স্মাইকের দিকে। গোলাঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল দু’জনে।

বেশ অনেকদিনের যাত্রাশেষে লণ্ডনে পৌঁছল ওরা। নগসের ঠিকানা জেনে নিয়ে ওর আস্তানায় হাজির হতে বেগ পেতে হলো না। স্কুলে কেলেঙ্কারি ঘটিয়ে এসেই বাড়িতে উঠতে চায়নি নিকোলাস। নিউম্যান নগসের কাছ থেকে মা-বোন- চাচার সব খবরই জানতে পারল। ওর চাচাকে নাকি লম্বা এক চিঠি পাঠিয়েছে। ফ্যানী স্কুয়্যারস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *