নিঃসঙ্গতার একশ বছর – ৯

কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেসই প্রথম বুঝতে পারে এই যুদ্ধের অসারতা। মাকন্দের সামরিক ও বেসামরিক প্রধান হিসেবে সপ্তাহে দুবার তাকে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার সঙ্গে টেলিগ্রাফের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হতো। প্রথম দিকের সাক্ষাৎগুলো সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করত এক জলজ্যান্ত যুদ্ধের প্রতি মুহূর্তের গতি প্রকৃতি আর তার ভবিষ্যৎ। যদিও কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া তার অতি ঘনিষ্ঠজনকেও বিশ্বাস করে নি, তবু তার গলার অন্তরঙ্গ ভাবটাই অন্য পাশের লোকটাকে বলে দিত তার পরিচয়। অনেকবারই এসব আলোচনা পূর্বনির্ধারিত বিষয়বস্তুর সীমা পেরিয়ে দীর্ঘায়িত হতো ঘরোয়া আলাপচারিতায়। কিন্তু আস্তে আস্তে যুদ্ধটা যখন তীব্র হতে থাকে আর ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়তে থাকে, তখন তার প্রতিচ্ছবি মিলিয়ে যেতে থাকে এক বিশাল অবাস্তবতায়। তার সুরের দাঁড়ি-কমাগুলো ক্রমেই চলে যেতে থাকে দূর থেকে দূরত্বে, অসার থেকে অসারতায়, আর তারা একত্র হতো শুধু কথার বুননির জন্য, যেগুলো হারিয়ে ফেলেছে ধীরে ধীরে তাদের অর্থবহতা। সেই সময়গুলোতে কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস যেন টেলিগ্রাফিক যোগাযোগে অন্য পাশে কোনো এক ভিন্ন গ্রহের অচেনা কারও সঙ্গে আলাপ করছে, এই ভাবনায় প্লাবিত হয়ে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখত একজন শ্রোতা হিসেবে।

‘বুঝেছি আউরেলিয়ানো’, শেষ করত যন্ত্রের মাধ্যমে, ‘উদারপন্থী দল দীর্ঘজীবী হোক।’ শেষমেশ সে হারিয়ে ফেলে যুদ্ধের সঙ্গে সব যোগাযোগ। অন্য সময়ে যা ছিল এক বাস্তব কর্মকাণ্ড, যৌবনের অপ্রতিরোধ্য উদ্দীপনা, তা-ই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে দূরের কোনো প্রাসঙ্গিক ব্যাপারে, এক অসারতায়। তার একমাত্র আশ্রয় ছিল আমারান্তার সেলাইঘর। প্রতি বিকেলেই ঢু মারত সে ওখানে। রেমেদিওস লা বেইয়্যার (সুন্দরী রেমেদিওস) সাহায্যে সেলাইকল ঘুরিয়ে আমারান্তার হাতগুলো যখন কাপড়ে কুঁচি দিত, সে তা দেখতে পছন্দ করত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিত কথাবার্তা না বলে, একে অন্যের সাহচর্যে তৃপ্ত হয়ে। কিন্তু যখন আমারান্তা আনন্দিত হতো কর্নেল হেরিনেলদোর অনুরাগের আগুনকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরে, হেরিনেলদো তখন পর্যন্ত আমারান্তার রহস্যাবৃত হৃদয়ের গোপন পরিকল্পনা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। সে যখন ফিরে আসে আমারান্তা তখন ডুবে যায় উৎকণ্ঠায়। কিন্তু তার মোহভঙ্গ হয়ে মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম হয়, যখন কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে হট্টগোল তোলা সরব দলের সঙ্গে, নির্বাসনের হাতে বিধ্বস্ত, বয়স আর বিস্মৃতির হাতে বুড়িয়ে গিয়ে, ঘাম ধুলোমাখা শরীরে, পশুর মতো দুর্গন্ধ নিয়ে কুৎসিত অবস্থায়, বাঁ হাতটাকে স্লিংয়ের সঙ্গে ঝুলিয়ে আসতে দেখে। ‘হায় ঈশ্বর’, ভাবে, ‘এ তো সে নয়, যার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। অবশ্য পরের দিন সে দাড়ি কামিয়ে, পরিচ্ছন্ন হয়ে, রক্তবিহীন স্লিং নিয়ে, গোঁফে ল্যাভেন্ডারের সুগন্ধি নিয়ে আবার বাড়িতে আসে। আমারান্তাকে উপহার দেয় কৃত্রিম মুক্তো বাঁধানো প্রার্থনা পুস্তক। ‘পুরুষগুলো কী অদ্ভুত’, ভেবে অন্যকিছু না পেয়ে বলে, ‘পাদরিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে করে জীবন দিয়ে দেয়, আর বই উপহার দেয় প্রার্থনা করার জন্য!’

সেদিন থেকে এমনকি যুদ্ধের সবচেয়ে কঠিন দিনগুলোতেও রোজ বিকেলে সে দেখা করত আমারান্তার সঙ্গে। অনেকবারই রেমেদিওস লা বেইয়্যা উপস্থিত না থাকায় সে নিজে সেলাইকলের হাতল ঘোরাত। বৈঠকখানার বাইরে অস্ত্র রেখে সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় সেলাইঘরে চলে আসা প্রবল ক্ষমতাশীল এই ব্যক্তিটির লেগে থাকা, বিশ্বস্ততা ও আনুগত্য আমারান্তাকে বিচলিত করে তোলে। কিন্তু চার বছর ধরে যখনই হেরিনেলদো তার ভালোবাসার কথা আবারও জানায়, আমারান্তা তার মনে আঘাত না দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়ার একটা উপায় কোনো না কোনোভাবে বের করে ফেলে, কারণ যদিও সে তাকে ভালোবাসতে পারে নি তবু তাকে ছাড়া আমারান্তার বেঁচে থাকা অসম্ভব ছিল। রেমেদিওস লা বেইয়্যা, যে নাকি সবকিছু সম্বন্ধে ছিল নিস্পৃহ, যাকে মনে হতো মানসিকভাবে অপরিণত, এমনকি সে পর্যন্ত এই গভীর ভালোবাসায় সাড়া না দেওয়ায় কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেসের পক্ষ নেয়। আমারাস্তা হঠাৎ লক্ষ করে যে মেয়েটিকে সে লালন করে বড় করেছে, যে কেবল বয়ঃসন্ধির দিকে পা বাড়াচ্ছে, সে ইতিমধ্যেই মাকন্দের সবচেয়ে সুন্দরী। সঙ্গে সঙ্গে তার হৃদয়ে পুনর্জন্ম নেয় সেই একই হিংসা, যা অন্য সময়ে অনুভব করত রেবেকার বিরুদ্ধে আর ঈশ্বরের কাছে সে প্রার্থনা করে, যাতে মেয়েটার মৃত্যু কখনোই তাকে কামনা করতে না হয়, আর সেলাইঘর থেকে বের করে দেয় তাকে। এগুলো ঘটেছিল সেই সময়ে যখন কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস যুদ্ধের প্রতি অবসাদ বোধ করে। যে যশের জন্য সে জীবনের মহার্ঘ সময়টা উৎসর্গ করেছে, সেই যশ পর্যন্ত বিসর্জন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে, ওকে বিশ্বাস করানোর প্রত্যয় নিয়ে, তার বিশাল চেপে থাকা সব কোমলতা দিয়ে আবেদন করে হেরিনেলদো, কিন্তু রাজি করাতে পারে না আমারান্তাকে। তার নাছোড়বান্দা প্রেমিককে শেষ জবাব দেওয়ার পর, আগস্টের এক বিকেলে নিজের একগুঁয়েমিপনার ভারে অতিষ্ঠ আমারান্তা তার একাকিত্বের লক্ষ্যে আমৃত্যু কান্নার জন্য শোবার ঘরে দরজা বন্ধ করে। ‘চিরদিনের জন্য ভুলে যাব আমরা’, ওকে বলে, ‘এগুলো করার বয়স আমাদের পার হয়ে গেছে।’

সেই বিকেলে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার ডাক আসে কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেসের কাছে। সেটা ছিল এক রুটিনমাফিক আলাপ, যেটাতে নিশ্চল যুদ্ধটার নতুন কোনো দরজা খোলার মতো কিছু ছিল না। আলাপটা শেষ হওয়ার পর জনহীন রাস্তার দিকে দৃষ্টি ফেলে আলমন্ডের জমে থাকা স্ফটিক জলের দিকে তাকিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করে নিঃসঙ্গতার মধ্যে।

‘আউরেলিয়ানো’, বিষণ্নতার সঙ্গে যন্ত্রটার মধ্য দিয়ে জানায়, ‘মাকন্দে বৃষ্টি হচ্ছে।’

টেলিগ্রাফের লাইনে এক দীর্ঘ নৈঃশব্দ্য বিরাজ করে। হঠাৎ করেই কর্নেল আউরেলিয়ানো মার্কেসের কিছু নির্দয় সংকেত নিয়ে লাফিয়ে ওঠে যন্ত্রটা।

‘গাধা নাকি তুই, হেরিনেলদো’, সংকেতগুলো বলে, ‘আগস্টে যে বৃষ্টি হচ্ছে, এটাই তো স্বাভাবিক।’

দীর্ঘদিন সাক্ষাৎ না হওয়ার কারণে এই আক্রমণাত্মক প্রক্রিয়ায় আহত বোধ করে কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস। দুই মাস পর যখন কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া ফিরে আসে মাকন্দে, তখন তার অবস্থা দেখে এই আহতবোধ পরিণত হয় হতবুদ্ধিকর বিস্ময়ে। এমনকি উরসুলা পর্যন্ত বিস্ময়াহত হয় তার এই প্রবল পরিবর্তনে। নিঃশব্দে, দেহরক্ষীহীন, প্রচণ্ড গরম সত্ত্বেও নিজেকে কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে তিন প্রেমিকাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসে সে, আর তিন প্রেমিকা একই বাড়িতে তার সঙ্গে আস্তানা গাড়ে, যাদের সঙ্গে সে অধিকাংশ সময়ই কাটিয়ে দেয় দোলবিছানার মধ্যে। রুটিনমাফিক টেলিগ্রাফের মাধ্যমে আসা যুদ্ধের খবরগুলো সে পড়তই না বললে চলে। একবার কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস সীমান্তের এক জায়গায় যুদ্ধ বেধে গেলে ব্যাপারটা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলে যাওয়ার আশঙ্কায় সৈন্য সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ নিতে যায়।

‘ছোটখাটো ব্যাপারে আমাকে বিরক্ত করিসনে’, ওকে আদেশ দেয়, ‘স্বর্গীয় বাক্যাবলি খুলে দেখ, তাতে কী লেখা আছে।’

খুব সম্ভবত ওটাই ছিল যুদ্ধের সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সময়। উদারপন্থী ভূস্বামীরা যারা প্রথম দিকে বিদ্রোহে সমর্থন জুগিয়েছিল তারা সম্পত্তির মালিকানার যাচাই এড়াতে গোপনে রক্ষণশীল ভূস্বামীদের সঙ্গে আঁতাত করে। নির্বাসন থেকে যেসব রাজনীতিবিদ এই যুদ্ধে মদদ জোগাত, তারা জনসমক্ষে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার চরম সিদ্ধান্তগুলো বাতিল করে; কিন্তু তাদের এই অননুমোদনেও সে সতর্ক হয় না। তার পাঁচ খণ্ডে বিভক্ত কবিতা সংকলন বিস্মৃত অবস্থায় পড়ে থাকে, সে ওগুলো আর খুলেও দেখে না। রাতে বা দুপুরে ঘুমের সময় তার প্রেমিকাদের দোলবিছানায় ডেকে নিত আর তা থেকে পেত এক আদিম পরিতৃপ্তি, আর পরে ঘুমাত পাথরের মতো; সামান্যতম দুর্ভাবনায়ও সে প্রশান্তি ভঙ্গ করত না। শুধু সেই জানত তার বিধ্বস্ত মনটা চিরদিনের মতো বিতাড়িত হয়েছে অনিশ্চয়তার মধ্যে। প্রথম দিকে অবিশ্বাস্য বিজয় নিয়ে প্রত্যাবর্তনে মাতাল হয়ে, সে উঁকি দিয়েছিল মহত্ত্বের অতল গভীরে। যুদ্ধশিল্পের মহান শিক্ষক ডিউক অব মার্লবোর; যার চামড়ার পোশাক ও বাঘের নখ বড়দের কাছ থেকে সম্ভ্রম আর শিশুদের মাঝে সৃষ্টি করে বিস্ময়, তাকে নিজের ডান পাশে রাখতে পেরে পরিতৃপ্তি পেত সে। তখনই সে সিদ্ধান্ত নেয় নিজের তিন মিটারের মধ্যে কোনো মানবকুল এমনকি উরসুলাও আসতে পারবে না। যেখানেই পা ফেলত, সেখানেই তার মনরঞ্জনকারী সহকারীরা চক দিয়ে যে বৃত্ত একে দিত, সেখানে সেই শুধু ঢুকতে পারত। সেই বৃত্তের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে সে সংক্ষিপ্ত আর তর্কাতীত, পৃথিবীর ভাগ্য নির্ধারক আদেশ দিত। জেনারেল মঙ্কাদার মৃত্যু দণ্ডের পর প্রথমবার যখন মানউরে পৌঁছায়, তখন সে বলির পাঁঠার শেষ ইচ্ছা পূরণে তৎপর হয়, আর বিধবা চশমা, মেডেল, ঘড়ি ও আংটি গ্রহণ করলেও তাকে দরজা পার হতে দেয় না।

‘কর্নেল ঢুকবে না’, ওকে বলে, ‘তোমার আদেশে যুদ্ধ চললেও আমার বাড়ি চলে আমার আদেশে।’

কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মুখাবয়বে কোনো ক্রোধের চিহ্ন প্রকাশ না পেলেও তার আত্মা প্রশান্তি পায় যখন তার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী বিধবার বাড়িটা লুট করে জ্বালিয়ে ছাইভস্মে পরিণত করে। ‘মনটার যত্ন নে আউরেলিয়ানো’, তখন কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস ওকে বলত, ‘জীবদ্দশাতেই তোর পচন ধরেছে।’ সেই সময়ে বিদ্রোহের প্রধান কমান্ডারদের দ্বিতীয় সমাবেশের আহ্বান জানায় সে। সব রকম লোকই পায় সে ওখানে; আদর্শবাদী, লোভী, দুঃসাহসী সমাজের ওপর ক্ষুব্ধ, এমনকি সাধারণ অপরাধী পর্যন্ত। এমনকি ছিল রক্ষণশীল দলের এক সাবেক কর্মকর্তা যে নাকি তহবিলের টাকা আত্মসাতের অভিযোগের বিচার এড়াতে বিদ্রোহীদের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে এমনকি জানতও না কেন তারা যুদ্ধ করছে। এই বিভিন্ন রঙের ভিড়ের মাঝে, যেখানে মূল্যবোধের পার্থক্যগুলো প্রায় এক অভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণ ঘটাতে উন্মুখ, সেখানে দৃষ্টি কাড়ে গাঢ় রঙের এক কর্তৃত্ব: জেনারেল তেওফিলো ভারগাস। সে ছিল এক খাঁটি আদিবাসী, দুর্বিনীত, নিরক্ষর, স্বভাবগতভাবেই তার ছিল লুকায়িত ধূর্ততা, ত্রাণকর্তাসুলভ আচরণ, যা নাকি তার লোকদের মধ্যে জাগিয়ে তুলত এক মৌলবাদী উন্মাদনা। কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া তাদের একত্র করে রাজনীতিবিদদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্দেশ্য। জেনারেল তেওফিলো ভারগাস এগিয়ে যায় তার নিজস্ব লক্ষ্য নিয়ে; অল্প কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভেঙে দেয় সবচেয়ে যোগ্য কমান্ডারদের জোট, আর দখল করে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব। ‘লোকটা সম্বন্ধে সতর্ক হওয়া উচিত, এমন হিংস্র জানোয়ার’, নিজের অফিসারদের উদ্দেশে বলে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া, ‘আমাদের জন্য এই লোকটা যুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের চেয়েও বেশি বিপজ্জনক।’ এই সময় কম বয়সী এক যুবক ক্যাপ্টেন যে সব সময়ই তার মুখচোরা প্রকৃতির জন্য ছিল স্বতন্ত্র, সে সতর্কতার সঙ্গে তর্জনী উঁচু করে।

‘এটা তো মামুলি ব্যাপার, কর্নেল’, প্রস্তাব করে, ‘ওকে মেরে ফেলা উচিত।’

প্রস্তাবটার শীতলতার জন্য নয়, বরং কীভাবে তার নিজস্ব চিন্তাধারা লোকটা সেকেন্ডের ভগ্নাংশ আগে ধরে ফেলেছে, তা দেখে চমকে যায় কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া। ‘আমার থেকে এ আদেশের জন্য অপেক্ষা কোরো না তোমরা’, বলে।

সত্যিই সেই আদেশ সে দেয়নি। কিন্তু পনেরো দিন পর এক গুপ্ত হামলায় কর্নেল তেওফিলো ভারগাসকে মাচেতে (লম্বা দা) দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলা হয়, আর কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া দখল করে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব। সেই একই রাতে, যে রাতে সব বিদ্রোহী কমান্ডার তার কর্তৃত্বে স্বীকৃতি দেয়, সে ঘুম থেকে ভয়ে চমকে জেগে উঠে চিৎকার করে একটা কম্বল চায়। ভেতর থেকে একটা প্রচণ্ড শীত তার হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছিল, এমনকি প্রখর সূর্যের নিচেও আর যেটা তাকে অনেক মাস ধরে ঘুমাতে দেয়নি; যত দিন পর্যন্ত না অনিদ্রাটা পরিণত হয় এক অভ্যাসে। অস্বস্তির চমকগুলো তার ক্ষমতার মাদকতায় পচন ধরাতে শুরু করে। শীত থেকে মুক্তি পেতে সেই তরুণ ক্যাপ্টেনের মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা করে, যে নাকি জেনারেল তেওফিলো ভারগাসকে খুনের প্রস্তাব করেছিল। ওর আদেশগুলো পালন করা হতো আদেশগুলো মুখ থেকে বের হওয়ার আগেই, এমনকি সে নিজে সেগুলো ভাবার আগেই, আর ওরা সেগুলো নিয়ে এত দূর অতিক্রম করে ফেলত যে সে নিজেও তাদের দিয়ে অত দূর অতিক্রম করার সাহস পেত না। প্রচণ্ড ক্ষমতার অহংকারে হারিয়ে গিয়ে দিগ্‌ভ্রষ্ট হতে শুরু করে কর্নেল। বিজিত গ্রামগুলোর লোকেরা হর্ষধ্বনি করলে একই হর্ষধ্বনি শত্রুরাও পায় মনে করে বিরক্ত হতো সে। সব জায়গাতেই সে পেয়ে যেত শিশুদের, যারা তাকে নিজের চোখ দিয়ে দেখত, তাকে সম্ভাষণ করত একই অবিশ্বাস নিয়ে, সে নিজে যেমনটি করত ওদের বেলায়, আর নিজেদের তার সন্তান বলে দাবি করত। সে অনুভব করত বিক্ষিপ্ততা, মনে করত সে পুনরাবৃত্ত, আর অনুভব করত এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিঃসঙ্গতা। এমনকি তার বিশ্বাস জন্মায় যে তার নিজের অফিসাররাও তাকে মিথ্যা বলে। সে মার্লবোরর ডিউকের সঙ্গে ঝগড়া করে। ‘মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু হচ্ছে’, তখন মাঝেমধ্যে বলত, ‘যে এই মাত্র মারা গেছে।’ অনিশ্চয়তার প্রাচুর্যে ক্লান্ত হয়ে পড়ে সে, অন্তহীন গোলকধাঁধার মধ্যে পড়া সেই যুদ্ধ, যেটা তাকে পেত সব সময় একই জায়গায়, প্রতিবারই তাকে করে তোলে আরও বৃদ্ধ, আরও বিধ্বস্ত, আরও কারণ, কীভাবে ও কখন এর উত্তর না জানা অবস্থায়। সর্বক্ষণই কেউ না কেউ থাকত চকের বৃত্তের বাইরে। কেউ একজন যার টাকার দরকার, কেউ একজন যার ছেলের হুপিং কাশি হয়েছে অথবা কেউ একজন চিরদিনের তরে ঘুমাতে চাইছে কারণ মুখের ভেতর যুদ্ধের বিষ্ঠার মতো গন্ধ আর সহ্য করতে পারছে না, আর তদুপরি মিলিটারি কায়দায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত শরীরে সঞ্চিত শক্তির শেষ বিন্দু দিয়ে এই বলতে যে, ‘সবকিছুই ঠিক আছে, আমার কর্নেল।’

আর সেই অন্তহীন যুদ্ধে স্বাভাবিকতাটাই হচ্ছে সবচেয়ে ভয়াবহ, যেখানে কিছুই ঘটছে না। একাকী, পূর্ববোধগুলো দ্বারা পরিত্যক্ত, আমরণ সঙ্গী শীত থেকে সর্বক্ষণ পলায়নপর, কর্নেল শেষ পর্যন্ত তার আগের স্মৃতির উষ্ণতম জায়গা মাকন্দে আশ্রয় নেয়। তার ঔদাসীন্য এমন অবস্থায় পৌঁছায় যে যুদ্ধের অচলাবস্থা নিয়ে আলোচনার জন্য তার দল থেকে ভারপ্রাপ্ত কিছু লোকের আগমনী সংবাদ পাওয়ায় সে সম্পূর্ণরূপে না জেগে দোলবিছানায় পাশ ফিরে শোয়, ‘বেশ্যাদের কাছে নিয়ে যা ওদের’, বলে। ওরা ছিল লম্বা কোট আর লম্বা হ্যাট পরিহিত ছয় উকিল; যারা নভেম্বরের প্রখর রোদ নির্বিকারে সহ্য করে। উরসুলা ওদের বাড়িতেই থাকতে দেয়। ওরা দিনের অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দিত শোবার ঘরে রুদ্ধদ্বার আলোচনা করে। আর রাত্রি আসন্ন হলে একজন পথপ্রদর্শক ও অ্যাকর্ডিয়ান বাদক দল নিয়ে কাতরিনার দোকানে গিয়ে নিজের পয়সায় পান করে।

‘ওদের বিরক্ত কোরো না’, আদেশ দিত কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া, ‘শত হলেও আমি তো জানিই ওরা কী চায়।’

দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সেই আলোচনা, যেটাকে অনেকেই ভেবেছিল আলোচনা হবে দীর্ঘ সময় ধরে, সেটা ডিসেম্বরের প্রথম দিকে এক ঘণ্টারও কম সময়ে শেষ হয়ে যায়।

বৈঠকখানার গরমে সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা পিয়ানোলাটার দিকে অপচ্ছায়ার পাশে বসা কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া এবার তার সহকারীদের আঁকা চকের বৃত্তের মাঝে বসে না। রাজনৈতিক উপদেষ্টাদের সঙ্গে একটা চেয়ারে স্থান নেয় সে আর পশমের চাদরে আবৃত কর্নেল, প্রতিনিধিদের সংক্ষিপ্ত প্রস্তাবগুলো নীরবে শুনে যায়। প্রথম শর্তে তারা জানায় উদারপন্থী ভূস্বামীদের সমর্থন পেতে জমির স্বত্বাধিকার যাচাই করা বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয় শর্তে ছিল ক্যাথলিকদের সমর্থন আদায়ের জন্য চার্চের প্রতিপত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করা। আর শেষ শর্ত হচ্ছে অবৈধ ও বৈধ সন্তানদের সমান অধিকারের দাবি যেন সে ত্যাগ করে পরিবারের অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য।

‘বলতে চাইছেন’, শর্ত দাখিলের পর হেসে বলে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া, ‘আমরা শুধু ক্ষমতা দখলের জন্য লড়ছি।’

‘এটা হচ্ছে কৌশলগত পরিবর্তন’, উত্তর দেয় প্রতিনিধিদের একজন, ‘এখন গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জনসমর্থন আদায় করা। পরের কথা পরে ভাবা যাবে।’

কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার এক উপদেষ্টা দ্রুত হস্তক্ষেপ করে, ‘এটা হচ্ছে পরস্পরবিরোধী, যদি এই পরিবর্তনগুলো ভালো হয়, তার অর্থ হচ্ছে রক্ষণশীল দলও ভালো। যেভাবে তোমরা বলছ, সেভাবে যদি এই পরিবর্তনগুলোর মাধ্যমে আমরা জনসমর্থন বৃদ্ধি করতে পারি, তার অর্থ হচ্ছে সরকারের রয়েছে এক ব্যাপক জনসমর্থন। সারমর্ম হচ্ছে প্রায় বিশ বছর ধরে আমরা জাতির মতামতের বিপক্ষে যুদ্ধ করে আসছি।’

সে চালিয়ে যেতে উদ্যত ছিল কিন্তু ইশারায় কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া তাতে বিঘ্ন ঘটায়, ‘সময় নষ্ট কোরো না, ডাক্তার’, বলে, ‘গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই মুহূর্ত হতে আমরা লড়ছি ক্ষমতার জন্য।’ মুখ থেকে হাসি বর্জন না করে প্রতিনিধিদল যে কাগজ দিয়েছিল তাকে, সেটি নিয়ে সই করতে উদ্যত হয়।

‘এটাই যখন আসল ব্যাপার’, ইতি টানে, ‘আমাদের এটা মেনে নিতে কোনোই অসুবিধে নেই।’ তীব্র হতাশা নিয়ে পরস্পরের দিকে তাকায় তার লোকজন। ‘আমাকে ক্ষমা করবেন কর্নেল’, বিনম্র স্বরে বলে কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস, ‘এটা কিন্তু সম্পূর্ণ বিশ্বাসঘাতকতা।’ কালি চোবানো কলমটা শূন্যে থামিয়ে ওর ওপর কর্তৃত্বের সম্পূর্ণ ভার নামিয়ে আনে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া, ‘অস্ত্র সমর্পণ করো আমার কাছে’, আদেশ দেয়। উঠে দাঁড়ায় কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস আর অস্ত্র রাখে টেবিলের ওপর।

‘ব্যারাকে হাজির হও’, আদেশ করে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া, ‘তোমার ভাগ্য নির্ভর করবে বিপ্লবী আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর।’ পরে বিবৃতিতে সই করে কাগজগুলো প্রতিনিধিদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতে থাকে: ‘মহোদয়গণ, এই যে কাগজগুলো, এগুলো থেকে ফায়দা লুটেন’। দুই দিন পর বড় বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেসকে। ক্ষমা প্রদর্শনের জন্য অনুরোধগুলো, দোলবিছানায় পরে থাকা কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মনকে ছুঁতে পারে না। মৃত্যুদণ্ডের আগের রাতে বিরক্ত করার আদেশ না মেনে উরসুলা ওর সঙ্গে দেখা করে শোবার ঘরে। কালো কাপড় পরিহিত উরসুলা এক দুর্লভ গাম্ভীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সাক্ষাতের পুরো তিন মিনিট। ‘জানি যে, গুলি করে মারতে যাচ্ছিস হেরিনেলদোকে’, বলে শান্ত স্বরে, ‘আর আমি কিছুতেই তা রোধ করার জন্য কিছুই করতে পারব না। কিন্তু একটা ব্যাপারে তোকে সাবধান করি, যখনই আমি ওর লাশটা দেখতে পারব, আমার বাপ-মায়ের হাড্ডির কিরে, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার স্মৃতির কিরে, ঈশ্বরের কিরে, যেখানেই লুকোস না কেন, তোকে খুন করব নিজের হাতে।’ শোবার ঘর পরিত্যাগের আগে কোনো উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে ইতি টানে ‘শুয়োরের লেজ নিয়ে জন্মালেও এই একই কাজ করতে হতো আমাকে।’

সেই অনন্ত রাতে, যখন কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস তার জীবনের মৃত বিকেলগুলোর কথা স্মরণ করছে আমারান্তার সেলাই ঘরে বসে, কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া তখন নিঃসঙ্গতার কঠোর খোলসটাকে ভাঙার জন্য অনেক ঘণ্টা ধরে খামচাখামচি করে। সেই সুদূর বিকেল থেকে, যেদিন তার বাবা বরফ চেনাতে নিয়ে গিয়েছিল, সেই দিন থেকে তার তাৎক্ষণিক সুখ এসেছিল রুপোর কামারশালায় যখন সে সময়গুলোকে পার করত সোনার মাছ বানিয়ে। বত্রিশটি যুদ্ধ করে, মৃত্যুর সঙ্গে করা সব কটি চুক্তি ভঙ্গ করে, গৌরবের পরে শুয়োরের মতো গড়াগড়ি করতে হয়েছে তাকে শুধু সফলতার সুবিধাগুলো বুঝতে, যেটা তার চল্লিশ বছর আগেই বোঝা উচিত ছিল। ভোরবেলায় বিক্ষুব্ধ রাত জেগে কাটিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের এক ঘণ্টা আগে সে বন্দীর ঘরে গিয়ে হাজির হয়। ‘অভিনয় শেষ হয়েছে কম্পাদরে’, বলে কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেসকে, ‘মশাগুলো তোকে মেরে ফেলার আগেই চল এখান থেকে ভাগি।’ তার এই ভাবভঙ্গিতে, তৈরি হওয়া অবজ্ঞাকে চেপে রাখতে পারে না কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস।

‘না, আউরেলিয়ানো’, উত্তর দেয়, ‘তোকে স্বৈরাচারীতে পরিবর্তিত হতে দেখার চেয়ে মরণও ভালো।’ ‘আমাকে সেভাবে দেখবি না’, বলে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া, ‘জুতাটা পরে নে আর আমার সঙ্গে হাত লাগা এই বিশ্রী যুদ্ধটাকে শেষ করতে।’

যখন সে কথাটা বলে, তখন সে কল্পনাও করে নি যে একটা যুদ্ধ শুরু করা সমাপ্তি টানার চেয়ে অনেক সহজতর। বিপ্লবীদের কাছে গ্রহণযোগ্য শর্তাবলির প্রস্তাব দেওয়ায় সরকারকে বাধ্য করার জন্য প্রায় এক বছরব্যাপী রক্তক্ষয়ী চেষ্টা চালাতে হয়, আরও এক বছর লাগে তার শর্তগুলোর সুবিধাবলি তার নিজের দলের লোকদের বোঝাতে। তার নিজস্ব অফিসারদের বিদ্রোহ দমাতে চরম নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নিতে হয় তাকে। বিজয়ের জন্য প্রতিরোধ গড়ে তোলা এসব অফিসারকে বাগে আনতে শেষ পর্যন্ত শত্রুপক্ষের সাহায্য নিতে হয় তাকে।

এর আগে কখনোই সে এত বড় যোদ্ধা ছিল না। শেষ পর্যন্ত সে নিশ্চিত হয় যে, লড়ছে নিজের মুক্তির জন্য, কোনো বিমূর্ত আদর্শের জন্য বা অবস্থা মোতাবেক যে রাজনীতিবিদেরা সবকিছুকে উল্টে ফেলে তাদের জন্য নয়। আর ফলে প্রচণ্ড উদ্দীপনায় ভড়ে ওঠে সে। কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেসও একই রকম বিশ্বাস আর আনুগত্য নিয়ে পরাজয় বরণের জন্য যুদ্ধ করে, যেমনটি করত আগে বিজয়ের জন্য, আর খামখেয়ালির কারণে অর্থহীন তিরস্কার করত কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে। ‘দুশ্চিন্তা করিস না’ হেসে বলত সে, ‘যেমনটি মনে করা হয়, তার চেয়ে মৃত্যু বরণ করা ঢের কঠিন।’ ওর বেলায় কথাটা ছিল সত্যি। তার মৃত্যুদিন যে ঠিক করা আছে, এই বিশ্বাস তাকে দেয় এক রহস্যময় নিরাপত্তা, যা নাকি যুদ্ধের সব ঝুঁকি নেওয়ার পর, বলতে গেলে তাকে দেয় অমরত্ব আর শেষ পর্যন্ত অনুমতি দেয় এক পরাজয় বরণ করার, যেটা ছিল বিজয়ের চেয়েও অনেক বেশি রক্তক্ষয়ী ও মূল্যবান

যুদ্ধের প্রায় বিশ বছরে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া অনেকবারই বাড়িতে গিয়েছিল। কিন্তু জরুরি ভিত্তিতে যেভাবে সব সময়ে সে আসত, সব সময় যেভাবে মিলিটারি দল সর্বত্রই তাকে সঙ্গ দিত, তার উপস্থিতিতে যে কিংবদন্তির জ্যোতি ছিল, তা এমনকি উরসুলাও অনুভব করত, আর সেটা তাকে পরিণত করেছিল এক আগন্তুকে। শেষবার যখন মাকন্দে ছিল, তখন তিন রক্ষিতার জন্য আলাদা বাড়ি নেয় আর তাকে নিজের বাড়িতে দুই-তিনবারের বেশি দেখা যায়নি। তা-ও শুধু যখন সময় করতে পেরেছিল খাবারের নিমন্ত্রণ রক্ষা করার। সুন্দরী রেমেদিওস ও যুদ্ধকালীন জন্ম নেওয়া যমজ, ওকে কোনো রকমে চিনত। যে ভাইকে আমারান্তা সোনার ছোট মাছ বানিয়ে বয়ঃসন্ধি কাটাতে দেখেছে তার প্রতিচ্ছবির সঙ্গে, এখনকার এই কিংবদন্তির যোদ্ধা, যে নাকি নিজের আর সব মানবতার মাঝে তিন মিটার দূরত্ব তৈরি করেছে, তাকে কিছুতেই এক করতে পারে না। কিন্তু যখন যুদ্ধ বিরতির সময় ঘনিয়ে আসার সংবাদ পায় আর ভাবে একজন মানুষরূপে সে আবার ফিরে আসছে, ফিরে আসছে শেষ পর্যন্ত তার হৃদয়টাকে উদ্ধার করে, তখন এই দীর্ঘ সময়ে ঘুমিয়ে থাকা পারিবারিক অনুভূতিগুলো সর্বকালের মধ্যে বেশি শক্তি নিয়ে পুনর্জন্ম লাভ করে।

‘শেষ পর্যন্ত’, বলে উরসুলা, ‘আবার বাড়িতে এক পুরুষমানুষ পাব আমরা।’

আমারান্তাই প্রথমে সন্দেহ করে যে হয়তো চিরকালের জন্যই হারিয়ে ফেলেছে তাকে। যুদ্ধবিরতির দুই সপ্তাহ আগে, দেহরক্ষীহীন দুই খালি পায়ের আর্দালি তাকে অনুসরণ করে বাড়িতে এসে, খচ্চরের জিন ও তার পুরোনো দিনের রাজকীয় সম্পদের একমাত্র অবশিষ্টাংশ কবিতাভর্তি তোরঙ্গটা বারান্দায় নামিয়ে রাখে। আর আমারান্তা তাকে সেলাইঘরের সামনে দিয়ে যেতে দেখে ডাকে। কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার কষ্ট হয় তাকে চিনে উঠতে। ‘আমি আমারান্তা’, তার ফিরে আসায় খুশি হয়ে আনন্দের সঙ্গে বলে আর কালো ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতটা দেখায়, ‘দেখো।’

সেই সুন্দর সকালে মৃত্যুদণ্ড নিয়ে মাকন্দে এসে প্রথমবার ব্যান্ডেজ পরা হাত দেখে যেমন হেসেছিল, সেই একই হাসি হাসে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া। ‘কী ভয়ংকর’, বলে, ‘সময় কীভাবে চলে যায়।’

নিয়মিত বাহিনীকে বাড়ির নিরাপত্তার ভার নিতে হয়। বেশি দামে বিনিময়ের জন্য যুদ্ধটাকে আরও খারাপ অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে গায়ে থুতু মেখে অপমানিত হয়ে ফিরে আসে সে। জ্বরে আর শীতে কাঁপছিল সে আর আবার দেখা দিয়েছিল বগলতলার গলন্দ্রিনা ঘা-টা। ছয় মাস আগে যুদ্ধবিরতির খবর শোনায়, কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া ফিরে এসে রেমেদিওসের স্যাঁতসেঁতে পুতুলগুলোর মাঝে আস্তে ধীরে বুড়ো হবে এই ভেবে। উরসুলা বিয়ের ঘরটা খুলে ঝাড়পোঁছ করে আর কোনায় কোনায় সুগন্ধি জালায়। কিন্তু সত্যিকার অর্থে শেষের দুই বছরে বার্ধক্যসহ জীবনের সর্বশেষ দেনা চুকিয়ে দিয়েছে সে। বিশেষ যত্ন নিয়ে ওর জন্য প্রস্তুত করে রাখা রৌপ্যশালার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সে এমনকি খেয়ালও করে না যে চাবিটা তালার সঙ্গে ঝুলছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হওয়া বাড়ির হৃদয়বিদারক সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলোও তার চোখে পরে না, দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতির পর যেগুলো নাকি স্মৃতিতে ধরে রাখা যেকোনো মানুষের চোখেই বিরাট পরিবর্তন হিসেবে দেখা দিত। দেয়াল থেকে খসে পড়া চুনকাম, কোনায় কোনায় জমে থাকা মাকড়সার নোংরা তুলো, উইয়ে খাওয়া করি কাঠের ফাটল, কবজায় পড়া শেওলা অথবা তার স্মৃতিকাতরতায় ভেতরে ভেতরে বেড়ে ওঠা ফাঁদ—এগুলোর কিছুই তাকে কষ্ট দেয় না। কম্বল জড়িয়ে পায়ের বুটজোড়া না খুলেই বারান্দায় বসে পরে সে, যেন বৃষ্টি শেষের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু সারা বিকেল কাটিয়ে দেয় সে বেগোনিয়ার ওপর বৃষ্টি দেখে দেখে। উরসুলা তখন বুঝতে পারে যে বাড়িতে তাকে দীর্ঘদিনের জন্য পাবে না, ‘যদি যুদ্ধ না হয়’, ভাবে সে, ‘তাহলে সেটা হবে মরণ।’ অনুমানটা ছিল এতই স্বচ্ছ, এতই বিশ্বাসযোগ্য যে সে সেটাকে দেখে পূর্ববোধ হিসেবে। সে রাতে, খাবার সময়, আউরেলিয়ানো সেগুন্দো নামের সম্ভাব্য ছেলেটি পাউরুটি ছেঁড়ে বাঁ হাত দিয়ে, আর স্যুপ খায় ডান হাত দিয়ে। আর তার যমজ সম্ভাব্য হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো নামের ছেলেটি রুটি ছেঁড়ে ডান হাত দিয়ে আর স্যুপ খায় বামটা দিয়ে। এই মহড়াটা এতই নিখুঁত সমন্বয়ে চলতে থাকে যে তাদের মুখোমুখি বসে থাকা দুই ভাই বলে মনে হয় না, মনে হয় দর্পণের কারসাজি। যখন থেকে ওরা বুঝতে পারে যে ওরা দেখতে একই রকম, তখন থেকেই খেলাটা তাদের মাথায় আসে আর সদ্য আগতের সম্মানে খেলাটা পুনরাবৃত্তি হয়। কিন্তু কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া খেয়াল করে না সেটা। সবকিছু থেকে তাকে এতই দূরের মনে হয় যে যখন রেমেদিওস, লা বেইয়্যা (সুন্দরী) নগ্ন অবস্থায় শোবার ঘরে যায়, এমনকি তখনো সে ব্যাপারটা খেয়াল করে না। একমাত্র উরসুলাই তার অন্যমনস্কতায় ভাঙন ধরাতে সাহস করে। ‘যদি আবার তোকে চলে যেতেই হয়’, খাওয়ার মাঝপথে বলে সে, ‘অন্তত আজকের রাতে আমরা কেমন ছিলাম, তা মনে করার চেষ্টা করিস।’

ফলে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া বুঝতে পারে উরসুলাই হচ্ছে একমাত্র মানুষ, যে তার কষ্টের পাক খুলতে পেরেছে, আর বহু বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো সে তার মুখের দিকে তাকাতে সাহস করে। তার চামড়া ছিল বলিরেখায় ভরা, দাঁতগুলো ছিল ক্ষয়ে যাওয়া, চুলগুলো ছিল রং-বিহীন মলিন আর দৃষ্টি ছিল বিস্ময়াবিষ্ট। যে বিকেলে তার পূর্ববোধ হয় যে বলক দিতে থাকা স্যুপের পাত্র টেবিল থেকে পড়ে যাবে, সবচেয়ে পুরাতন এই স্মৃতি উরসুলার সঙ্গে মিলিয়ে, তাকে দেখতে পায় ক্ষতবিক্ষত। মুহূর্তের মধ্যেই সে আবিষ্কার করে অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়জুড়ে দৈনন্দিন জীবন, উরসুলার ওপর কেটে গিয়েছে নখের আঁচড়, রেখে গিয়েছে চাবুকের দাগ, দিয়েছে বিষণ্ণতা, করেছে ক্ষতবিক্ষত, আর রেখে গেছে ক্ষতচিহ্ন। আর প্রমাণ পায় যে এসব কিছু তার মনে এমনকি কোনো করুণার অনুভূতিরও উদ্রেক করে না। সুতরাং সে শেষ চেষ্টা করে তার হৃদয়ের মাঝের জায়গাটা খুঁজে পাওয়ার, সেখানে তার অনুভূতিগুলো পচে গিয়েছে, কিন্তু খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয় সে। অন্য সময়ে নিজের চামড়ায় উরসুলার গন্ধ যখন তাকে চমকে দিত, তখন অন্তত লজ্জা মাখানো এক বিচিত্র অনুভূতির সৃষ্টি হতো, আর কয়েকবারই সে অনুভব করে তার চিন্তাধারায় বাধার সৃষ্টি করছে উরসুলার প্রতি তার ভাবনা। কিন্তু যুদ্ধ এগুলোর সবই মুছে দিয়েছে। এমনকি রেমেদিওস, তার স্ত্রীর স্মৃতি পর্যন্ত এমন মলিন হয়ে গিয়েছে, যে কিনা তার মেয়েও হতে পারত। ভালোবাসার মরুতে যে অগুনতি মেয়ের সঙ্গে সে পরিচিত হয়েছে, যারা তার বীজ উপকূলজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছ, তারাও তার মনে কোনো অনুভূতির দাগ কাটেনি। তাদের বেশির ভাগই অন্ধকারে ঘরে ঢুকে ঊষার আগেই ফিরে যেত, আর পরের দিন শুধু ক্লান্তির সঙ্গে তারা জড়িয়ে থাকত সামান্য শারীরিক স্মৃতিতে। সময়ের আর যুদ্ধের প্রতিকূলে একমাত্র যে অনুভূতি জীবিত ছিল তা হচ্ছে, হোসে আর্কাদিওর প্রতি সে যা অনুভব করত, যখন তারা দুজনেই ছিল শিশু, যা ভালোবাসার ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি, গড়ে উঠেছে দুষ্কর্মের যোগসাজশের ভিত্তিতে।

‘ক্ষমা করো’, উরসুলার চাহিদার ভিত্তিতে ক্ষমা চায় সে, ‘এই যুদ্ধটা শেষ করে দিয়েছে সবকিছুই।’

পরের দিনগুলোতে ব্যস্ত থাকে সে, পৃথিবীতে তার ফেলা সব পদচিহ্ন ধ্বংস করার কাজে। রৌপ্যশালাটা এমনভাবে কাটছাঁট করে ফেলে যে শুধু পড়ে থাকে অব্যক্তিগত জিনিসগুলো, বিলিয়ে দেয় নিজের জামাকাপড় আর্দালিদের মাঝে, পরে নিজের অস্ত্রগুলো উঠানে পুঁতে ফেলে, তার বাবার মতো একই বোধ থেকে প্রুদেনসিও আগিলারের মৃত্যু নিয়ে আসা বর্শাটাকে মাটিতে পুঁতেছিল। শুধু রেখে দেয় একটা পিস্তল, সঙ্গে একটি মাত্র গুলি। উরসুলা বাধা দেয় না ওর কার্যকলাপে, শুধু একবারই তাকে নিরস্ত্র করে, যখন সে দিনরাত জলতে থাকা একটি বাতির আলোয় আলোকিত রেমেদিওসের দাগেরোটাইপ ছবিটা ধ্বংস করতে উদ্যত হয়। ‘এই ছবিটা অনেক আগেই তোর নিজস্ব জিনিসের অন্তর্ভুক্তি থেকে বেরিয়ে গেছে’, বলে তাকে, ‘এটি হচ্ছে আমাদের পারিবারিক স্মৃতিচিহ্ন।’ যুদ্ধবিরতির আগের দিন যখন আর বাড়িতে তার স্মৃতি ফিরিয়ে দেওয়ার মতো এমন কিছুই নেই, তখন সে কবিতা ভরা তোরঙ্গটা রুটির কারখানায় নিয়ে যায়। যখন সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ চুল্লি জ্বালাতে উদ্যত।

‘এগুলো দিয়ে জ্বালা’, হলুদ হয়ে যাওয়া প্রথম কাগজের তোড়াটা ওর হাতে দিয়ে বলে ‘এগুলো ভালো জ্বলে কারণ এগুলো হচ্ছে অনেক পুরাতন’, সব সময়ই নীরব সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ, যে নাকি এমনকি নিজের সন্তানদেরও কোনো বিরুদ্ধাচরণ করে নি, এমনকি তারও মনে হয় কাজটা হচ্ছে নিষিদ্ধ।

‘কাগজগুলো গুরুত্বপূর্ণ’, বলে।

‘না না, ওসব কিছু না’, বলে কর্নেল, ‘এগুলো হচ্ছে এমন কিছু, যা কেউ একজন নিজের জন্যই লেখে।

‘যদি তা-ই হয়’, বলে সেফিয়া, ‘আপনি নিজেই পুড়িয়ে ফেলুন।’

সে শুধু যে কেবল তা-ই করে না তা না, একটি ছোট কুড়োল দিয়ে তোরঙ্গটা টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে চলাগুলো আগুনে ফেলে। তারও কয়েক ঘণ্টা আগে পিলার তেরনেরা এসেছিল দেখা করতে। এত বছর দেখা না হওয়ায় ওকে দেখে আশ্চর্য হয় কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া: কতটা বুড়িয়ে গেছে, কত মোটা হয়েছে পিলার কিন্তু আরও বেশি আশ্চর্য হলো তার তাস পড়তে পারার ক্ষমতার গভীরতা দেখে। ‘যা বলিস সাবধানে বলিস’, তাকে বলে পিলার। কর্নেল নিজেকে প্রশ্ন করে যখন সে গৌরবের শিখরে ছিল, তখন এই একই কথা যে তাকে বলেছিল, সেটা তার নিয়তির ব্যাপারে চমকে দেওয়া কোনো আগাম আভাস দিয়েছিল কি না। তারও কিছুক্ষণ পরে যখন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক গলদ্ৰিনাকে উৎপাটন করা শেষ করেছে, তখন সে সুনির্দিষ্ট কোনো ঔৎসুক্য না দেখিয়ে জানতে চায়, হৃৎপিণ্ডের সঠিক অবস্থান। ডাক্তার স্টেথো দিয়ে পরীক্ষা করে আয়োডিন-ভেজা নোংরা তুলো দিয়ে বুকে এক বৃত্ত আঁকে।

যুদ্ধবিরতির মঙ্গলবারটা ছিল বৃষ্টিভেজা, মোলায়েম। কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া রান্নাঘরে হাজির হয় ভোর পাঁচটার আগেই, আর পান করে অভ্যেসমতোই চিনি ছাড়া কফি। ‘এমনই একদিন পৃথিবীতে এসেছিস তুই’, বলে উরসুলা। ‘সবাই ভয় পেয়েছিল তোর খোলা চোখ দেখে।’ কর্নেল মনোযোগ দেয় না ওর কথাতে, কারণ তার মনোযোগ ছিল সৈন্য জমায়েত, শিঙার ফুঁক, আর আদেশের আওয়াজে যা ভেঙে ফেলবে শান্তিময় প্রভাতকে। যদিও এত বছরের যুদ্ধের পর এসব কিছুই তার অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কথা তবু এবার যৌবনে এক নগ্ন মেয়ের কাছে যেমনটি তার চামড়ার ঢেউ অনুভব করেছিল, সেই রকম একই অনুভূতি হয় তার। সে চিন্তা করে করে বিহ্বল হয়ে শেষ পর্যন্ত বন্দী হয় স্মৃতিকাতরতার কাছে, যদি মেয়েটাকে বিয়ে করত হয়তো বা সে পরিণত হতো যুদ্ধ আর বিজয়বিহীন এক লোকে, নামধামহীন এক হস্তশিল্পী, এক সুখী জানোয়ারে। সকালের নাশতাকে বিস্বাদ করে তোলা এই অপ্রত্যাশিত শিহরণে তার পূর্ববোধে ছিল না। সকাল সাতটায় যখন কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস একদল বিপ্লবী অফিসারকে সঙ্গে করে তাকে নিতে আসে, তাকে পায় এ পর্যন্ত দেখা সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নির্বাক, চিন্তিত আর নিঃসঙ্গ রূপে। উরসুলা তার কাঁধে এক নতুন চাদর জড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে। ‘সরকার কী মনে করবে’, বলে সে, ‘ওরা ভাববে তুই পরাজয় বরণ করেছিস বলে তোর কাছে, এমনকি নতুন একটা চাদর কেনার পয়সাও নেই।’ কিন্তু সে চাদরটা নেয় না। দরজায় গিয়ে যখন দেখে বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই তখন সে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার পুরোনো একটা ফেলটের হ্যাট পরাতে দেয় তার মাকে। ‘আউরেলিয়ানো’, ওকে বলে তখন উরসুলা, ‘প্রতিজ্ঞা কর ওখানে যদি প্রতিকূল অবস্থা দেখিস, তাহলে তোর মাকে স্মরণ করবি।’

সে ক্ষীণ এক হাসি হেসে সবগুলো ছড়ানো আঙুলসহ হাত তুলে, একটিও কথা না বলে গৃহত্যাগ করে আর মুখোমুখি হয় চিৎকারের, নিন্দার আর অপবাদের, যা কিনা গ্রামের প্রান্ত পর্যন্ত ওকে অনুসরণ করে। উরসুলা জীবনে কখনো খুলবে না এই চিন্তা করে দরজায় আগল দেয়। ‘আমরা এখানে, ভেতরেই পচে মরব’, ভাবে, ‘পুরুষবিহীন এই বাড়িতে ছাই হয়ে যাব আমরা তবু আমাদের কান্না দেখে আনন্দ করার সুযোগ, এই হতচ্ছাড়া গ্রামটাকে দেব না। সারাটা সকাল ছেলের স্মৃতিচারণা করার মতো এক জিনিস খুঁজে বেড়ায় সে, এমনকি বাড়ির সবচেয়ে গোপন কানিঘুপচিগুলোতেও, কিন্তু সে খুঁজে পায় না।

চুক্তিটা অনুষ্ঠিত হয় মাকন্দ থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে, এক বিশাল সেইবা গাছের (ceiba tree) তলায়, পরে যে গাছকে ঘিরে পত্তন হবে নিরলান্দিয়া গ্রামের। সরকার এবং বিভিন্ন দলের প্রতিনিধি আর অস্ত্র সমর্পণকারী বিপ্লবীদের আপ্যায়ন করে সাদা পোশাক পরা শিক্ষানবিশ এক কোলাহলপূর্ণ দল, যাদের দেখে মনে হবে বৃষ্টিতে ভেজা একঝাঁক কবুতর। কর্নেল আউরেলিয়ানো আসে এক কাদামাখা খচ্চরের পিঠে চড়ে। দাড়ি না কামানো গলন্দ্রিনার ব্যথার চেয়েও বেশি জর্জরিত তার বিশাল স্বপ্নভঙ্গে সে চলে এসেছে তার সব প্রত্যাশার শেষ সীমানায়, পৌঁছেছে বিজয়ের চেয়েও দূরে, এমনকি বিজয়ের স্মৃতিকাতরতার চেয়েও দূরত্বে। তারই ইচ্ছায় কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজানো হলো না, পোড়ানো হলো না আতশবাজি, বাজল না বিজয়ের ঘণ্টাধ্বনি। হয় নি কোনো উল্লাসধ্বনি অথবা অন্য কোনো কিছু, যা যুদ্ধবিরতির শোকাচ্ছন্ন অবস্থাটাকে ভেঙে দিতে পারে। এক ভ্রাম্যমাণ ক্যামেরাম্যান সংরক্ষণ করার জন্য তার একমাত্র যে ছবিটি তুলতে পারে, তাকে বাধ্য করা হয় সেটিকে ডেভেলপ না করেই প্লেটটা ধ্বংস করে ফেলতে।

অনুষ্ঠানটা স্থায়ী হয় শুধু স্বাক্ষর করতে যতটুকু সময়ের প্রয়োজন ততক্ষণই। সার্কাসের তালি দেওয়া তাঁবুর মাঝখানে হাতে বানানো এক টেবিলের ধারে, যেখানে প্রতিনিধিদল ছিল সেখানেই ছিল শেষ পর্যন্ত কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার প্রতি বিশ্বস্ত অফিসাররা। স্বাক্ষরের আগেই প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত প্রতিনিধি উচ্চ স্বরে আত্মসমর্পণের শর্তগুলো পড়তে চেষ্টা করে কিন্তু বাধা দেয় কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া, ‘সময় নষ্ট করব না আমরা আনুষ্ঠানিক ব্যাপারগুলোতে’, বলে সে, আর উদ্যত হয় শর্তগুলোতে স্বাক্ষর করতে, না পড়েই। তার এক অফিসার তাঁবুর নিদ্রাদায়ক নীরবতা ভঙ্গ করে। ‘কর্নেল’, বলে, ‘দয়া করুন যাতে আমরা প্রথম স্বাক্ষরকারী না হই।’

কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া মেনে নেয়। যখন কাগজে-কলমের খসখসানি শোনা যাবে এমনতর নিখাঁদ নীরবতার মাঝে কাগজগুলো টেবিল ঘুরে আসে, তখনো প্ৰথম স্বাক্ষরকারীর জায়গাটা খালি থাকে। কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া জায়গাটা ব্যবহার করতে প্রস্তুত হয়।

‘কর্নেল’, বলে অন্য অফিসার, ‘এখনো সময় আছে আমাদের সবকিছু সঠিকভাবে করার।’ মুখের অভিব্যক্তি না বদলিয়ে আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া প্রথম কপিতে স্বাক্ষর করে। শেষ কপিটাতে স্বাক্ষর শেষের আগেই তাঁবুর দরজায় হাজির হয় দড়ি দিয়ে বাঁধা এক খচ্চরের পিঠে দুটো তোরঙ্গসহ এক বিপ্লবী কর্নেল। বয়সে প্রচণ্ড যুবক হওয়া সত্ত্বেও তার অভিব্যক্তিতে ছিল শুষ্কতা আর প্রসন্নতা। সে ছিল মাকন্দের বিপ্লবী কোষাধ্যক্ষ। ক্ষুধায় কাতর খচ্চর টেনে ছয় দিনের এক কষ্টকর যাত্রা শেষ করতে হয়েছে তাকে যুদ্ধবিরতির অনুষ্ঠানে ঠিক সময়ে পৌঁছানোর জন্য। সময় নিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তোরঙ্গ দুটি খালি করে সে; খুলে একটা একটা করে আর টেবিলের ওপর রাখে একের পর এক বাহাত্তরটা সোনার ইট। এই সম্পদের অস্তিত্বের কথা কারোরই মনে ছিল না। বিপ্লবের শেষ বছরের বিশৃঙ্খলতায় যখন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব খণ্ড-বিখণ্ড, যখন বিদ্রোহ পরিণত হয়েছিল নেতাদের রক্তাক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, তখন কার যে কী দায়িত্ব তা ঠিক করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। গলিয়ে ইটের আকৃতি দিয়ে তার ওপর পোড়ানো কাদার প্রলেপ দেওয়া বিপ্লবীদের ইটগুলো রয়ে গিয়েছিল সব নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া বাহাত্তরটি ইট আত্মসমর্পণের তালিকায় ঢুকিয়ে কাউকে কোনো বক্তৃতার সুযোগ না দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করে। নোংরা সেই যুবক সিরাপ রঙের শান্ত চোখ তার চোখে রেখে সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। ‘আর কিছু?’ ওকে জিজ্ঞেস করে আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া। যুবক কর্নেল দাঁতে দাঁত পিষে —

‘রশিদ’, বলে।

নিজ হাতে রশিদ লিখে দেয় কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া। পরে শিক্ষানবিশদের পরিবেশিত একটা বিস্কুটের টুকরো মুখে দিয়ে এক গ্লাস লেমনেট পান করে, তার বিশ্রাম নেওয়ার জন্য প্রস্তুত তাঁবুর উদ্দেশে যায়। সেখানে সে জামা খুলে ক্যাম্প খাটের কিনারায় বসে আর বিকেল সোয়া তিনটের সময় তার ব্যক্তিগত ডাক্তার আয়োডিন দিয়ে বুকে যে বৃত্ত এঁকেছিল, তার মাঝখানে গুলি করে। মাকন্দে সেই সময় দেরি হচ্ছে দেখে বলক দেওয়ার জন্য আগুনে বসানো দুধের কড়াইয়ের ঢাকনা খোলে উরসুলা আর দেখতে পায় তা কীটে ভরে গেছে।

‘আউরেলিয়ানোকে মেরে ফেলেছে ওরা, চিৎকার করে।

উঠোনের দিকে তাকায় সে নিঃসঙ্গতার অভ্যেসবশত আর দেখতে পায় ভেজা হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়াকে, করুণ চেহারা আর যখন মারা গিয়েছে, তখনকার চেয়েও অনেক বেশি বৃদ্ধ। ‘ওকে মারা হয়েছে বিশ্বাসঘাতকতা করে।’ আরও বর্ণনা দেয় উরসুলা, ‘এমনকি ওর চোখ দুটো বুজিয়ে দেওয়ার মতো দয়াটুকুও দেখায়নি কেউ।’ রাতের বেলা অশ্রুভরা চোখে আকাশের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত কমলা-উজ্জ্বল এক গোলাকার বস্তুকে দ্রুত চলে যেতে দেখলে তার মনে হয় সেটা হচ্ছে মৃত্যুর ইশারা। সে তখনো চেস্টনাটের নিচে স্বামীর হাঁটুর কাছে বসে ফোঁপাচ্ছে, যখন শুকনো রক্ত দিয়ে শক্ত হওয়া চাদর মোড়া কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে নিয়ে যাওয়া হলো; ওর চোখ দুটো ছিল খোলা আর তাতে ছিল প্রচণ্ড ক্রোধ।

সে ছিল সব বিপদমুক্ত। গুলিটা এমনি পরিষ্কার রাস্তা ভেদ করেছে যে ডাক্তার আয়োডিন-ভেজা দড়ি বুক দিয়ে ঢুকিয়ে পিঠ দিয়ে বের করে। ‘এটা হচ্ছে আমার জীবনের সেরা কাজ’, সন্তুষ্ট হয়ে বলে ডাক্তার ‘এটাই ছিল একমাত্র জায়গা, যেখান দিয়ে গুলি ঢুকে জীবনের জন্য অপরিহার্য কোনো অঙ্গের ক্ষতি না করে বেরিয়ে যেতে পারে।’ কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া দেখতে পায় ওকে ঘিরে আছে শিক্ষানবিশরা আর তার আত্মার অসীম শান্তির জন্য উন্মত্তের মতো মন্ত্র উচ্চারণ করছে আর তখনই তার অনুশোচনা হয় পিলার তেরনেরার ভবিষ্যদ্বাণীকে বিদ্রূপ করার জন্য, কেন সে টাকরায় গুলি করে নি যেমনটি ভেবে রেখেছিল।

‘যদি এখনো আমার হাতে কর্তৃত্ব থাকত’, বলে সে ডাক্তারকে, ‘কোনো বিবেকদংশন ছাড়াই আপনাকে গুলির আদেশ দিতাম। আমার প্রাণ বাঁচানোর কারণে নয়, বরং আমাকে বিদ্রূপের পাত্র বানানোর কারণে।’

অল্প কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার মৃত্যুর ব্যর্থতা ফিরিয়ে আনে হারানো সম্মান। সেই একই লোকজন যারা গল্প ফেঁদেছিল যে যুদ্ধটাকে বিক্রি করে দিয়েছে সে এক ঘরের বিনিময়ে, যে ঘরের দেয়ালগুলো সোনার ইট দিয়ে তৈরি, তারাই আত্মহত্যার চেষ্টাকে এক বীরোচিত ব্যাপার ব্যাখ্যা দিয়ে তাকে শহীদ বলে ঘোষণা করে। পরে যখন প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্টের দেওয়া ‘অর্ডার অব মেরিট’ প্রত্যাখ্যান করে, তখন তার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বীরাও তার ঘরের কাছে সারি বাঁধে, আর অনুরোধ করে যুদ্ধবিরতির শর্তাবলি অমান্য করে আরেকটা যুদ্ধ বাধাতে। ঘর ভরে যায় ক্ষমাপ্রার্থনামূলক উপহারে। প্রাক্তন সহযোদ্ধাদের এই প্রচুর সমর্থনে দেরিতে হলেও আশ্চর্য হওয়া কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া ওদের খুশি করার সম্ভাবনাকে নাকচ করে না। বরং তার উল্টো মাঝে মাঝে নতুন একটা যুদ্ধের সম্ভাবনায় তাকে এতই উৎসাহী মনে হতো যে কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস ভাবে যে সে শুধু যুদ্ধ শুরু করার জন্য একটা অজুহাতের অপেক্ষায় আছে। আসলেই অজুহাতটা এসে যায়। যখন প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট রক্ষণশীল ও উদারপন্থী উভয় দলের সাবেক সেনাদের কাগজপত্রসহ যতক্ষণ পর্যন্ত না এক বিশেষ কমিশন পরীক্ষা করে আর কংগ্রেস তার অনুমোদন দেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের অবসর-ভাতা দিতে অস্বীকার করে। ‘এটা হচ্ছে ক্ষমতার অপব্যবহার’, ক্রোধে ফেটে পড়ে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া, ‘ওরা সবাই বৃদ্ধ হয়ে মারা যাবে অনুমোদনের অপেক্ষায়।’ সুস্থ হওয়ার জন্য কেনা দোলচেয়ারটা প্রথমবারের জন্য ত্যাগ করে ঘরময় পায়চারি করতে করতে প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্টের উদ্দেশে শক্ত এক চিঠি ডিক্টেট করে। কখনোই প্রচারিত না হওয়া এই টেলিগ্রামটিতে সে নিরলান্দা চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ করে আর আমরণ যুদ্ধ করার হুমকি দেয়, যদি-না পনেরো দিনের মধ্যে অবসর-ভাতার ব্যাপারটা সুরাহা না হয়। তার এই দাবি এতই সংগত মনে হয় যে, প্রাক্তন রক্ষণশীল যোদ্ধাদের সমর্থনেরও আশা রাখে। কিন্তু তার একমাত্র যে জবাব সরকারের পক্ষ থেকে আসে তা হচ্ছে বাড়ির বাইরে সামরিক পাহারা আরও জোরদার করা, আর তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অজুহাতে সব রকমের সাক্ষাতের নিষেধাজ্ঞা। একই রকমের ব্যবস্থা নেওয়া হয় সারা দেশব্যাপী প্রহরাধীন অন্য নেতাদের বেলায়ও। ব্যবস্থাটি এতই জুতসই, চূড়ান্ত আর ফলপ্রসূ হয় যে দুই মাস পর যখন কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া সুস্থ হয়ে ওঠে, তখন বিদ্রোহের সবচেয়ে অনুপ্রাণিত লোকগুলো হয় মৃত নতুবা নির্বাচিত বা প্রশাসনযন্ত্রের সঙ্গে চিরদিনের জন্য সম্পৃক্ত।

কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া সুস্থ হয়ে ঘর থেকে বের হয় ডিসেম্বরে। বেরিয়ে বারান্দার দিকে এক লহমার দৃষ্টিই যথেষ্ট ছিল যুদ্ধের কথা পুনর্বার চিন্তা না করার। বয়সের কারণে অস্বাভাবিক জীবনীশক্তি দিয়ে উরসুলা বাড়িটাকে পুনর্যৌবন দান করে। ‘এখন সবাই বুঝবে আমি কে’, বলে যখন বুঝতে পারে যে তার ছেলে বেঁচে যাবে, ‘এই উন্মত্তদের বাড়ির চেয়ে সারা পৃথিবীতে কোনো সুন্দর বাড়ি থাকবে না, যেটা হবে সবার জন্য খোলা।’ বাড়িটা ধোয়ামোছা করিয়ে রং চড়ায়, আসবাব বদল করায়, বাগানটাকে অন্যভাবে সাজিয়ে নতুন ফুল লাগায়, গ্রীষ্মের চোখধাঁধানো উজ্জ্বলতা শোবার ঘর পর্যন্ত ঢোকানোর জন্য সব দরজা-জানালা খুলে দেয়। অসংখ্য চাপিয়ে দেওয়া শোকপর্বের সমাপ্তি ঘোষণা করে, আর নিজে তার চিরাচরিত পুরোনো পর্দাশীল কাপড়চোপড়ের বদলে যৌবনের উচ্ছলতাময় কাপড় পরে। পিয়ানোলার সুর আবার বাড়িটার আনন্দ ফিরিয়ে আনে। সুরটা শোনার পর আমারান্তার পিয়েত্র ক্রেসপির কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে তার গোধূলি পর্বের গার্ডেনিয়ার কথা, তার ল্যাভেন্ডারের সুগন্ধির কথা আর তার জীর্ণ হৃদয়ে ফুটে ওঠে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার হয়ে যাওয়া তিক্ততা। এক বিকেলে যখন বৈঠকখানা ঠিক করছিল, তখন প্রহরারত সৈন্যদের তার সঙ্গে হাত লাগাতে বলে উরসুলা। যুবক কমান্ডার অনুমতি দেয় ওদের। ধীরে ধীরে ওদের নতুন নতুন কাজের ভার দেয়। ওদের সে খাওয়ার আমন্ত্রণ জানাত, জামাকাপড় আর জুতো উপহার দিত, আর শেখাত লিখতে ও পড়তে। যখন সরকার পাহারায় ইতি টানে, ওদের একজন থেকে যায় বাড়িতে আর অনেক বছর পর্যন্ত উরসুলার কাজ করে চলে। নববর্ষের দিন, রেমেদিওস লা বেইয়্যার অবজ্ঞায় প্রেমে পাগল তরুণ কমান্ডারকে ভোরবেলায় জানালার পাশে পাওয়া যায়; মৃত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *