নিঃসঙ্গতার একশ বছর – ৮

উইলো কাঠের দোলচেয়ারে বসে, হাতের কাজটা কোলের ওপর ফেলে রেখে আমারান্তা দেখছিল আউরেলিয়ানো হোসেকে, চিবুকে ফেনা মেখে, চামাটিতে ক্ষুরধার দিতে, বসে আছে জীবনে প্রথমবারের মতো দাড়ি কামানোর জন্য। তার ব্রণ থেকে রক্ত বেরিয়ে পড়ে, আর ওপরের ঠোঁটের মিহি গৌরবর্ণ গোঁফ বাগে আনতে গিয়ে কেটে ফেলে। আর সব শেষ করার পর, তার চেহারা থেকে যায় আগে যেমন ছিল তেমনি। কিন্তু তার এই কষ্টসাধ্য প্রক্রিয়া আমারান্তার মনের ওপর এক তাৎক্ষণিক ছাপ ফেলে। তার বয়স বাড়তে শুরু করেছে। ‘যখন আউরেলিয়ানো তোর বয়সী ছিল, তুই দেখতে অবিকল তারই মতো’, বলে, ‘এখন তুই এক পুরুষমানুষ।’

অনেক আগে থেকেই সে পুরুষ ছিল। সেই পুরোনো দিনটি থেকে যখন আমারান্তা এখনো শিশু ভেবে স্নান ঘরে ওর সামনে নগ্ন হতো; পিলার তেরনেরা ওকে লালন করার জন্য যখন ওর হাতে তুলে দেয় সেই দিনটি থেকে, যেমনটি সে অভ্যস্ত হয়েছে তখন থেকেই। প্রথমবারের মতো আউরেলিয়ানো যখন ওকে দেখে, একমাত্র যেটা তার নজর কাড়ে, সেটা হচ্ছে তার বুকের মাঝের গভীর খাঁজ। তখন সে এতই নিষ্পাপ ছিল যে প্রশ্ন করে তার ওখানটায় কী হয়েছে, আর আমারান্তা আঙুলের ডগা দিয়ে বুকের মাঝে অনুসন্ধানের ভঙ্গিতে বলে, ‘এখান থেকে ওরা বিভিন্ন টুকরা কেটে তুলে নিয়েছে।’ আরও পরে, যখন পিয়েত্র ক্রেসপির আত্মহত্যার ধাক্কা কাটিয়ে ওঠে, আবার ওর সঙ্গে গোসল করে তখন তার বুকের গভীরতা আউরেলিয়ানো হোসের আর মনোযোগ টানে না। বরং অনুভব করে এক অচেনা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠার অনুভূতি। আমারান্তাকে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে আর আবিষ্কার করে একটু একটু করে তার গূঢ় অলৌকিকতা। অনুভব করে তার গায়ের চামড়ার লোম খাড়া হয়ে ওঠা, যেমনটি আমারান্তার বেলায় ঘটে ঠান্ডা পানির সংস্পর্শে। শিশুকাল থেকেই দোলবিছানা ত্যাগ করে সকালবেলা আমারান্তার বিছানায় জেগে ওঠার অভ্যাস ছিল তার; যার উদ্দেশ্য ছিল অন্ধকারের ভয়টা দূর করা। কিন্তু যেদিন থেকে নগ্নতার ব্যাপারে সে সচেতন হয়, সেদিন থেকে অন্ধকারের ভীতি তাকে আমারান্তার মশারির ভেতর ঠেলে না দিয়ে বরং ভোরে তাকে ধাবিত করত আমারান্তার কোমল নিশ্বাসের তীব্র আকর্ষণ। এক কাকভোরে, সেই সময় যখন সে ফিরিয়ে দিয়েছিল হেরিনেলদো মার্কেসকে, আউরেলিয়ানো হোসে জেগে ওঠে দমবন্ধ করা অনুভূতি নিয়ে। অনুভব করে, আমারান্তার আঙুলগুলোকে কতগুলো গরম কেন্নোর মতো, তার পেটের ওপর উৎকণ্ঠিতভাবে কী যেন খুঁজছে। তার কাজ সহজ করে দিতে ঘুমের ভান করে পাশ ফিরে সে; আর অনুভব করে কালো কাপড়ের ব্যান্ডেজবিহীন হাতটা এক অন্ধ শামুকের মতো ডুব দিচ্ছে উৎকণ্ঠার শৈবাল দঙ্গলে। যদিও দুজনেই যা জানে, তা অগ্রাহ্য করার ভান করে, তবু একজনে যা জানত, অন্যজনও তা জানে। আর সেই রাত থেকে ওরা বাঁধা পড়ে যায় এক অলঙ্ঘনীয় নিষিদ্ধ কাজের বন্ধনে। বৈঠকখানার ঘড়িতে বারোটার ওয়াল্টজ শোনা পর্যন্ত আউরেলিয়ানো হোসের চোখে ঘুম আসত না, আর সেই পরিণতা কুমারী, যার চামড়া দুঃখভারাক্রান্ত হতে শুরু করেছে; সে একমুহূর্ত শান্তি পেত না, যতক্ষণ না অনুভব করত মশারির ভেতর নিশিপাওয়া ছেলেটাকে পিছলে ঢুকে পড়তে, যাকে সে লালন করেছে, আর কখনোই ভাবেনি যে সে-ই হবে তার নিঃসঙ্গতার উপশম। পরে শুধু নগ্ন হয়ে শুয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়া পর্যন্ত পরস্পরকে আদর করত, তা-ই নয়, একে অন্যকে তাড়া করে বেড়াত বাড়ির আঙিনার অন্ধকার কোণগুলোয়। আর ঘুমানোর ঘরগুলোতে ঢুকে দরজা লাগাত দিনের যেকোনো সময়ে নিরবচ্ছিন্ন উত্তেজনা নিয়ে। একবার যখন গোলাঘরে চুমু খেতে উদ্যত, তখন উরসুলার কাছে প্রায় ধরা পড়ে যাচ্ছিল ওরা। ‘খুব ভালোবাসিস ফুফুকে?’ নিষ্পাপ প্রশ্ন করে উরসুলা আউরেলিয়ানো হোসেকে। সে ইতিবাচক জবাব দেয়। ‘ভালোই করিস’—ইতি টানে উরসুলা আর রুটি তৈরির জন্য ময়দা মেপে রান্নাঘরে ফিরে যায়। এই ঘটনা চিত্তবিভ্রম থেকে মুক্ত করে আমারান্তাকে। সে অনুধাবন করতে পারে যে অনেক দূর এগিয়ে গেছে, তারা আর শিশুদের চুম্বনের খেলা খেলছে না, বরং, এক শারদীয় কামনায় মাতামাতি করছে। আর ভবিষ্যহীন এই কামনায় ইতি টেনে দেয় সঙ্গে সঙ্গেই। এই সময়ে আউরেলিয়ানো হোসে তার সামরিক প্রশিক্ষণ শেষ করতে চলেছে। সে বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে ঘুমাতে যেত সৈন্যশিবিরে। শনিবার দিন সৈন্যদের সঙ্গে যেত কাতরিনার দোকানে তার এই অপ্রত্যাশিত নিঃসঙ্গতাকে আর অপরিণত বয়ঃসন্ধির অন্ধকারকে মাঝে মাঝে সান্ত্বনা দিতে; মৃত ফুলের গন্ধযুক্ত মেয়েদের দিয়ে ও উৎকণ্ঠিত কল্পনাশক্তি দিয়ে ওদের রূপায়িত করত আমারান্তায়।

কিছুদিন পরই সবাই পেতে থাকে পরস্পরবিরোধী যুদ্ধবার্তা। যখন খোদ সরকার বিদ্রোহীদের অগ্রগতির কথা স্বীকার করছে, তখন মাকন্দের অফিসারদের কাছে গোপন খবর ছিল দরাদরি করা এক অত্যাসন্ন শান্তি চুক্তির বিষয়। এপ্রিলের প্রথম দিকে বিশেষ এক সংবাদবাহক আত্মপরিচয় দেয় কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেসের কাছে। সে নিশ্চিত করে যে সত্যিই দলের নেতারা দেশের অভ্যন্তরে বিদ্রোহী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছে; আর উদারপন্থীদের জন্য তিনটে মন্ত্রিত্ব, পার্লামেন্টে সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব ও অস্ত্র জমা দেওয়ার সাধারণ ক্ষমার বিনিময়ে এক সন্ধি সন্নিকট। কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার কাছ থেকে সংবাদবাহক এক অতি গোপন আদেশ নিয়ে এসেছে যে সে এই শর্তগুলোর সঙ্গে একমত নয়। পাঁচজন সেরা লোককে বেছে নিয়ে কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেসকে দেশত্যাগে প্রস্তুত হতে হবে। সে এই আদেশ পালন করে অতি গোপনীয়তার সঙ্গে। সন্ধিচুক্তি ঘোষণার এক সপ্তাহ আগে, পরস্পরবিরোধী গুজবের ঝড়ের মাঝে, কর্নেল রোকো কার্নিসেরোসহ দশজন বিশ্বস্ত অফিসার নিয়ে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া মধ্যরাতের পর নিঃশব্দে মাকন্দে এসে হাজির হয়ে গ্যারিসনটাকে ভেঙে দেয়; সব অস্ত্র মাটির নিচে পুঁতে ফেলে ধ্বংস করে রেকর্ডসহ সব ফাইল। কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস তার পাঁচ অফিসারসহ প্রভাতের আগেই উধাও হয়ে যায়। অপারেশনটা এতই গোপনীয়তা ও দ্রুততার সঙ্গে সারা হয় যে উরসুলা একেবারে শেষ মুহূর্তে ব্যাপারটা জানতে পারে, যখন একজন কেউ তার শোবার ঘরের জানালায় আলতো করে টোকা দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে দেখতে চাইলে এখনই দরজার দিকে আসুন। উরসুলা লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে রাতের পোশাক গায়ে নিয়েই দরজা দিয়ে বেরিয়ে কেবল দেখতে পায় নিঃশব্দ ধুলোর ঝড় তুলে গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া ঘোড়সওয়ারদের। পরদিন সকালেই কেবল জানতে পারে যে আউরেলিয়ানো হোসে চলে গেছে তার বাবার সঙ্গে।

সরকার ও বিরোধী দল যুক্ত বিবৃতিতে ঘোষিত যুদ্ধবিরতির দশ দিনের মাথায় কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার পশ্চিম সীমান্তে প্রথম সশস্ত্র বিদ্রোহের খবর পায় ওরা। অস্ত্রসহ তার ছোট্ট দলটা এক সপ্তাহেরও কম সময়ে হেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। কিন্তু একই বছরে যখন উদারপন্থী আর রক্ষণশীলেরা সমঝোতার কথা সারা দেশকে বিশ্বাস করাতে ব্যস্ত, কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া আরও সাতটি সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘটানোর চেষ্টা করে। এক রাতে রিওয়াচার ওপর কামান দাগে এক স্কুনার থেকে আর এর ফলে নগররক্ষী সৈন্যরা সবচেয়ে উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত এলাকার চৌদ্দজন লোককে বিছানা থেকে নামিয়ে এনে গুলি করে প্রতিশোধ হিসাবে। সে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে দখল করে রাখে সীমান্তের এক শু আদায়ের অফিস আর সেখান থেকে জাতির উদ্দেশে সর্বাত্মক যুদ্ধের আহ্বান জানানো হয়। রাজধানী শহরের উপকণ্ঠে যুদ্ধ ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছায় পনেরো শ কিলোমিটারের বেশি দুর্ভেদ্য জঙ্গল পাড়ি দেওয়ার উদ্ভট প্রচেষ্টায় তার এক সামরিক অভিযাত্রী দল তিন মাসের জন্য হারিয়ে যায়। একেকবার মাকন্দের বিশ কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসে আর সরকারের পাহারাদার সৈন্যদের কারণে বাধ্য হয় যেখানে তার বাবা বহু বছর আগে স্প্যানিশ জাহাজের অবশেষ আবিষ্কার করেছিল সেই মায়াবী জায়গার খুব কাছের পাহাড়ে আশ্রয় নিতে।

ওই সময়টাতে মৃত্যু হয় ভিসিতাসিওনের। অনিদ্রা রোগের ভয়ে সিংহাসন প্রত্যাখ্যান করে স্বাভাবিক মৃত্যুকে বরণ করার সৌভাগ্য হয় তার, আর তার অন্তিম বাসনা ছিল বিশ বছরের বেশি সময় ধরে জমানো বেতন তার বিছানার নিচ থেকে খুঁড়ে বের করে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে পাঠিয়ে দেওয়ার, যাতে সে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সেই সময় প্রাদেশিক রাজধানীর কাছে জাহাজ থেকে নামার সময় কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া মারা গিয়েছে বলে গুজব ওঠায় উরসুলা আর টাকাগুলো বের করার কষ্ট করে না। সেই সরকারি ঘোষণা, যেটা ছিল দুই বছরের মধ্যে চতুর্থবার, ছয় মাস ধরে এটাকেই সত্য বলে ধরে নিয়েছিল সবাই, কারণ কেউই তার সম্পর্কে কিছু জানত না। পরে যখন আমারান্তা ও উরসুলা আগের শোকপর্বের সঙ্গে নতুন একটি শোকের জন্য নিশ্চিতভাবে প্রস্তুত, তখনই অপ্রত্যাশিত খবরটা আসে; কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া বেঁচে আছে, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে নিজ দেশের সরকারকে বিব্রত করা ক্ষান্ত দিয়ে অন্যান্য বিজয়ী ফেডেরালিস্ট ক্যারিবীয় প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। প্রতিবারই ওর নাম প্রকাশিত হতো তার গ্রাম থেকে ক্রমেই দূরে, দূরান্তরে। পরে জানা যাবে যে সেই সময়ে তার চিন্তা ছিল আলাস্কা থেকে পাতাগোনিয়া পর্যন্ত সব রক্ষণশীলকে উৎপাটন করার, মধ্য আমেরিকার সব ফেডেরালিস্টকে একত্র করা। অনেক বছর পার হওয়ার পর সান্তিয়াগো দে কুবা থেকে হাতে হাতে এক দোমড়ানো- মোচড়ানো চিঠির মাধ্যমে প্রথম সরাসরি ওর খবর পায় উরসুলা।

‘ওকে আমরা চিরকালের জন্য হারিয়েছি’—পড়ার পর হাহাকার করে উরসুলা, ‘এভাবে চলতে থাকলে ও বড়দিন পালন করবে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে।’

যাকে কথাটা বলা হয়েছিল, সে হচ্ছে রক্ষণশীলদের জেনারেল হোসে রাকেল মঙ্কাদা, যুদ্ধ শেষের পর থেকেই মাকন্দের মেয়র আর সে-ই চিঠিটা উরসুলার কাছে নিয়ে এসেছিল। ‘দুঃখজনক হচ্ছে’, মন্তব্য করে জেনারেল মক্কাদা, ‘আউরেলিয়ানো রক্ষণশীলদের একজন নয়।’ সত্যিকার অর্থেই সে আউরেলিয়ানোকে শ্রদ্ধা করত। অনেক বেসামরিক রক্ষণশীলের মতোই হোসে রাকেল মঙ্কাদা তার দলকে রক্ষা করতে যুদ্ধে যোগ দেয়, আর সামরিক বাহিনীর লোক না হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধক্ষেত্রে জেনারেল খেতাব অর্জন করে। তার দলের আরও অনেকের মতোই সে ছিল সামরিক বাহিনীর বিরোধী। তার বিবেচনায় সামরিক লোকেরা হচ্ছে নীতিবোধহীন কুড়ে, উচ্চাকাঙ্ক্ষী কুচক্রী আর জনগণের বিশৃঙ্খলার সুযোগে নিজেদের উন্নতি করায় ওস্তাদ। বুদ্ধিমান, দরদি, লাল, ভোজনরসিক মোরগের লড়াইয়ের ভক্ত এই লোকই কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার সবচেয়ে ভয়ংকর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। উপকূলের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সামরিক অফিসারদের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সমর্থ হয় সে। একবার কৌশলগত কারণে যখন সে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার দলের কাছে প্লাজা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, তখন কর্নেল আউরেলিয়ানোর জন্য দুটো চিঠি লিখে রেখে আসে। ওর একটি চিঠির মধ্যে বিস্তারিতভাবে কর্নেলকে আহ্বান করে যুদ্ধটাকে যৌথভাবে মানবিক করে তোলার, আর অন্য চিঠিটা ছিল উদারপন্থীদের এলাকায় বসবাসরত তার স্ত্রীর জন্য, যেটাকে সে স্ত্রীর হাতে পৌঁছে দিতে অনুরোধ করে ওই চিঠিতে। সেই সময় থেকে যুদ্ধের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী দিনগুলোতেও বন্দী বিনিময়ের জন্য সাময়িক যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করত দুই কমান্ডার। যুদ্ধ বিরতিগুলো ছিল অনেকটা উৎসবের পরিবেশ, যেখানে জেনারেল মঙ্কাদা সুযোগ নিত কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে দাবা খেলা শেখানোর। তাদের মধ্যে বিশাল বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এমনকি সামরিক বাহিনী আর পেশাদার রাজনীতিকদের প্রভাবমুক্ত করে দুই দলের জনপ্রিয় নেতাদের নিয়ে এক নতুন মানবতাবাদী দল গঠন করার চিন্তাও করে তারা, যেখানে তারা দুই মতবাদের শ্রেষ্ঠ অংশগুলো প্রতিষ্ঠা করবে। যুদ্ধ শেষে যখন কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া চিরস্থায়ী অন্তর্ঘাতের সংকীর্ণাবস্থায় পিছলে পড়ছিল, তখন মঙ্কাদাকে মাকন্দের ম্যাজিস্ট্রেটের পদ দেওয়া হয়। সৈন্যদের বদলে মোতায়েন করে সে বেসামরিক পোশাক গায়ে নিরস্ত্র পুলিশ, আর সাধারণ ক্ষমার আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে যুদ্ধে মৃত কিছু উদারপন্থীর পরিবারের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। মাকন্দকে এক পৌরসভায় প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় সে আর ফলে সে হয় মাকন্দের প্রথম মেয়র আর সে এমন এক পরিবেশের সৃষ্টি করে, যাতে যুদ্ধকে মনে হয় অতীতের এক অবাস্তব দুঃস্বপ্ন। যকৃৎপ্রদাহ জ্বরে শেষ হয়ে যাওয়া ফাদার নিকানোরের বদলে আসেন প্রথমে ফেডেরালিস্ট যুদ্ধে অবসরপ্রাপ্ত ফাদার কর্নেল, যাকে ডাকা হতো এল কাচোররো (ছোট খোকা)। আমপারো মসকতের সঙ্গে বিবাহিত ব্রুনো ক্রেসপি, যার খেলনা আর বাদ্যযন্ত্রের দোকানটা ক্রমাগতই উন্নতি করতে করতে ক্লান্ত হচ্ছে না, সে এক থিয়েটার স্থাপন করে আর স্পেনের পর্যটন কোম্পানিগুলো তাদের ভ্রমণসূচিতে সেটা যোগ করে। থিয়েটারটা ছিল উন্মুক্ত আকাশের নিচে কাঠের বেঞ্চ পাতা, গ্রীষ্মের বিভিন্ন মুখোশওয়ালা ভেলভেটের পর্দাওলা বিশাল হল, যেটায় সিংহের মাথার আকৃতি দিয়ে বানানো তিনটি টিকিট কাউন্টার ছিল। সিংহের খোলা মুখ দিয়ে দর্শকদের কাছে টিকিট বিক্রি করা হতো। প্রায় একই সময়ে স্কুলটাকেও পুনর্নির্মাণ করা হয়। জলাভূমি থেকে আসা এক বর্ষীয়ান শিক্ষক, দন মেলচোর এস্কালোনা স্কুলটার ভার গ্রহণ করে। সে ক্লাসের নিরুদ্যম ছাত্রদের হাঁটুতে ভর দিয়ে চুন করা উঠানে হাঁটাত, আর বাবা- মায়ের অনুমতি নিয়ে ক্লাসে বাচাল ছাত্রদের ঝাল মরিচ খেতে বাধ্য করত। সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদের যমজ দুই ছেলে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো (দ্বিতীয়) ও হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো (দ্বিতীয়) তাদের শ্লেট চক আর নিজেদের নামাঙ্কিত অ্যালুমিনিয়ামের ছোট জগ নিয়ে সবার আগে ক্লাসে যোগ দেয়। নিজের মায়ের কাছ থেকে পাওয়া নিখুঁত সৌন্দর্যের অধিকারী রেমেদিওস পরিচিত হতে শুরু করে সুন্দরী রেমেদিওস হিসেবে। এতটা সময় উপর্যুপরি শোক ও পুঞ্জীভূত যন্ত্রণা পার করার পরও উরসুলা বার্ধক্যকে ঠেকিয়ে রেখেছে। সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদের সাহায্য নিয়ে তার বেকারিটাকে এক ধাক্কায় নতুন শক্তি দান করে, যার ফলে শুধু কয়েক বছরের মধ্যে সেটা যুদ্ধে খরচ হয়ে যাওয়া বিশাল সম্পদ পুনরুদ্ধার করে তা-ই নয়, বরং শোবার ঘরের নিচের লাউয়ের খোলগুলোও ভরে ফেলে সম্পূর্ণভাবে। ‘যত দিন ঈশ্বর আমাকে আয়ু দেয়’, সে বলত, ‘এই পাগলে ভরা বাড়িতে টাকাপয়সার অভাব হবে না।’ এভাবেই চলছিল সবকিছু যখন আউরেলিয়ানো হোসে নিকারাগুয়ার ফেডারেল বাহিনী ছেড়ে এক জার্মান জাহাজে যোগ দেয় আর আদিবাসীর মতো গাঢ় রং ও লম্বা চুলসহ ঘোড়ার মতো তাগদ নিয়ে আমারান্তাকে বিয়ে করার গোপন সংকল্প নিয়ে হাজির হয় রান্নাঘরে।

যখন ওকে ঢুকতে দেখে, মুখ খুলে না বললেও সঙ্গে সঙ্গেই আমারান্তা বুঝতে পারে তার ফিরে আসার কারণ। খাবার টেবিলে একে অপরের মুখের দিকে তাকানোর সাহস করে না। কিন্তু ফিরে আসার দুই সপ্তাহ পরে উরসুলার উপস্থিতিতেই আমারান্তার চোখে চোখ রাখে আর বলে, ‘সারাক্ষণই তোমার কথা অনেক ভেবেছি আমি।’ আমারান্তা ওকে এড়িয়ে যেতে থাকে। সব সময়ই চেষ্টা করত রেমেদিওস, লা বেইয়্যার (সুন্দরী) সঙ্গে সঙ্গে থাকার। তার গাল লজ্জায় অপমানে লাল হয়ে যায় যেদিন তার ভাস্তে জিজ্ঞেস করে কত দিন সে তার হাতের কালো ব্যান্ডেজ পরে থাকার কথা ভাবছে, কারণ সে ভাবে যে কথাটা তার কুমারীত্বকে ইঙ্গিত করেই বলা হয়েছে। প্রথম সে আসার পর থেকে আমারান্তা ভালো করে দরজা লাগিয়ে ঘুমাত কিন্তু রাতের পর রাত পাশের ঘরে তার শান্তিপূর্ণ নাক ডাকার আওয়াজে অভ্যস্ত হয়ে সেই প্রতিরোধে শিথিলতা আসে। ফিরে আসার প্রায় দুই মাস পর এক ভোরে শোবার ঘরে ওর উপস্থিতি অনুভব করে আমারান্তা। ফলে পালানোর বদলে, যেমনটি ভেবে রেখেছিল, তেমনিভাবে চিৎকার করার বদলে, নিজেকে সে সমর্পণ করে এক প্রশান্ত বিশ্রামের অনুভূতির কাছে। তাকে অনুভব করে মশারির নিচে পিছলে ঢুকে যেতে যেমনটি করত শিশুবেলায়, যেমনটি সে সব সময়ই করে এসেছে, তবু তার শরীরের ঠান্ডা ঘাম আর দাঁতের বাড়ি রোধ করতে পারে না যখন বুঝতে পারে যে ও এসেছে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে। ‘চলে যা’, ফিসফিসায়, ঔৎসুক্যের মধ্যে খাবি খেতে খেতে, ‘চলে যা, নতুবা আমি চিৎকার করব।’ কিন্তু আউরেলিয়ানো হোসে জানত কী করতে হবে কারণ সে আর অন্ধকারকে ভয় পাওয়া এক শিশু ছিল না বরং সে ছিল এক ব্যারাকের পশু। সেই রাত থেকে পুনরায় আরম্ভ হয় পরিণামবিহীন এক বোবা যুদ্ধের যেটা ভোর পর্যন্ত চলত। ‘আমি তোর ফুপু’, ক্লান্ত আমারান্তা ফিসফিসাত, ‘এটা হচ্ছে প্রায় মায়ের সমান, একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে তোকে আমি বুকের দুধ খাওয়াতে পারিনি।’ আধো অন্ধকারে পালিয়ে যেত আউরেলিয়ানো আর আমারান্তাও খিল লাগাত না, এই প্রমাণ পেয়ে ফিরে আসত পরের ঊষায়, প্রতিবারই আরও বেশি উত্তেজিত অবস্থায়। একমুহূর্তের জন্যও আমারান্তাকে বাসনা করা থেকে বিরত হয় নি সে। ওকে খুঁজে পেত সে বিজিত গ্রামগুলোর শোবার ঘরে, বিশেষ করে সবচেয়ে পরিত্যক্তগুলোতে, আর রূপদান করত আহতদের ব্যান্ডেজের শুকনো রক্তের গন্ধে তাৎক্ষণিক মৃত্যুর আতঙ্কে, সব সময় ও সর্বত্র। দূরত্বের সঙ্গে সঙ্গে শুধু স্মৃতিগুলোকে উপড়ে ফেলার জন্যই যে আমারান্তার কাছ থেকে সে পালিয়ে গিয়েছিল তা-ই নয়, বরং পালিয়েছিল এক উন্মত্ত ক্রোধ নিয়ে যেটাকে তার সহযোদ্ধারা তার সাহস বলে ধরে নিত। কিন্তু সে আমারান্তার ছবিকে যতই যুদ্ধের খোঁয়াড়ে সেঁধিয়ে দিত, ততই যুদ্ধ পরিণত হতো আমারান্তায়। এভাবেই নিজের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমারান্তাকে শেষ করার উপায় খুঁজতে খুঁজতে কাটত তার নির্বাসন, যত দিন না সে একজনের কাছে পুরোনো এক গল্প শোনে, যেখানে এক লোক এমন এক মেয়েকে বিয়ে করে যে তার ফুপুও হয় আবার জ্ঞাতি বোনও হয়। ফলে তার ছেলে নিজেই হয়ে দাঁড়ায় নিজের দাদা।

‘ফুফুকে বিয়ে করা যায়?’ আশ্চর্যান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করে সে।

‘শুধু ফুপুর সঙ্গেই নয়’, উত্তর দেয় এক সৈনিক, ‘আমরা পাদরিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি, যাতে নিজের মাকেও বিয়ে করা যায়।’

পনেরো দিন পর সে ব্যারাক ছেড়ে পালায়। তার স্মৃতিতে যেমনটি ছিল তার থেকে নির্জীব অবস্থায় পায় আমারান্তাকে, ওকে পায় আরও বেশি বিষণ্ণ ও লাজুক, সত্যিকার অর্থে পরিপক্বতার শেষ অধ্যায়ের ভারে অবনত কিন্তু শোবার ঘরের অন্ধকারে সবচেয়ে বেশি জ্বরতপ্ত ও প্রতিরোধের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি হুঁশিয়ার ও কঠোর: ‘তুই হচ্ছিস এক জানোয়ার’, আউরেলিয়ানোর পশুসুলভ আচরণের শিকার হয়ে বলত, ‘পোপের বিশেষ অনুমতি না নিয়ে, অভাগা ফুপুর সঙ্গে যে এ কাজ করা জায়েজ, এ কথা সত্যি নয়।’ আউরেলিয়ানো হোসে রোমে গিয়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে হেঁটে সারা ইউরোপ পাড়ি দিয়ে পনটিফের চপ্পলে চুমু খাওয়ার প্রতিজ্ঞা করে, যাতে আমারান্তা তার তুলে ফেলা সেতুটা নামিয়ে দেয়। ‘শুধু তা-ই নয়’, তর্ক করে আমারান্তা, ‘বাচ্চা হলে জন্মায় শুয়োরের লেজ নিয়ে।’ এসব যুক্তি আউরেলিয়ানো হোসের কানে ঢোকে না।

‘পিঁপড়ে হয়ে জন্মালেও আমার আপত্তি নেই’–আকুতি করে সে।

এক ভোররাতে, অবদমিত কামনার অসহ্য জ্বালায় ভেঙে পড়ে কাতরিনার দোকানে যায় সে। সেখানে স্তন ঝুলে যাওয়া মমতাময়ী সস্তা এক মেয়েকে পেয়ে পেটের নিচের অংশটাকে শান্ত করে। অবজ্ঞা করার ওষুধটাকে আমারান্তার ওপর প্রয়োগ করার চেষ্টা চালায় সে। এত দিনে শিখতে পারা সেলাইকল প্রশংসনীয় দক্ষতায় চালাতে থাকা আমারান্তাকে বারান্দায় দেখতে পেয়েও তার সঙ্গে কোনো কথা বলত না, আমারান্তার মনে হতো বিশাল এক বোঝা থেকে সে মুক্তি পেয়েছে আর তখন সে নিজেও বুঝতে পারে না কেন আবার চিন্তা করে কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেসের কথা, কেনই বা মনে পড়ে তার সঙ্গে চায়নিজ চেকার খেলার বিকেলগুলোর স্মৃতিকাতরতার কথা, এমনকি বুঝতেও পারে না কেনই বা তাকে কামনা করে শোবার ঘরের পুরুষ হিসেবে, আর যে রাতে অবজ্ঞার মিথ্যা প্রহসনটাকে সহ্য না করতে পেরে আবার আমারান্তার ঘরে ফিরে যায়, তখন চিন্তাও করতে পারে না কতটুকু অবস্থান সে হারিয়ে ফেলেছে এরই মধ্যে। অনমনীয় নির্ভুল দৃঢ়তার সঙ্গে আমারান্তা প্রত্যাখ্যান করে তাকে আর চিরদিনের জন্য আটকে দেয় দরজার খিল।

আউরেলিয়ানো হোসের ফেরার অল্প কয়েক মাস পর জেসমিনের সুগন্ধি মাখা পাঁচ বছর বয়সী এক ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এক উচ্ছল রমণী বাড়িতে এসে হাজির হয়। সে নিশ্চিত করে যে শিশুটা কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার ছেলে আর নিয়ে এসেছে যাতে উরসুলা ওকে ব্যাপটাইজ করে। নামবিহীন ছেলেটার জন্মরহস্য নিয়ে কেউ সন্দেহ প্রকাশ করে না কারণ যে বয়সে কর্নেলকে বরফ চেনাতে নেওয়া হয়েছিল, ছেলেটা ছিল অবিকল একই রকম দেখতে। মেয়েটা বর্ণনা করে, তার জন্ম হয়েছে খোলা চোখ নিয়ে লোকজনকে বড়দের মতো পরখ করতে থাকো অবস্থায় আর ওর পলকহীন চোখে যেভাবে সবকিছুর দিকে তাকাত তা দেখে ভয় পেয়ে যেত মেয়েটা। ‘অবিকল একই রকম’, বলে উরসুলা, ‘একমাত্র যা বাকি আছে, তা হচ্ছে কেবল দৃষ্টি দিয়ে চেয়ারগুলোকে ঘোরানোর ক্ষমতা।’ ওকে ব্যাপটাইজ করা হলো আউরেলিয়ানো নামকরণ করে আর মায়ের পদবি দিয়ে কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত না বাবা তাকে ছেলে বলে স্বীকৃতি না দেয়, আইনত সে বাবার পদবি ধারণ করতে পারে না। জেনারেল মঙ্কাদা হলো গডফাদার (ধর্মপিতা)। যদিও আমারান্তা চাইছিল তাকে মানুষ করার ভার দিতে কিন্তু ছেলেটার মা তাতে দ্বিমত করে।

যেমনটি করে ভালো জাতের মোরগের সামনে মুরগিগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হয়, তেমনি করে কুমারী মেয়েদের যোদ্ধাদের শোবার ঘরে পাঠানোর রীতিটা উরসুলার জানা ছিল না, কিন্তু ওই একই বছরের মধ্যে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার আরও নয়টি ছেলেকে নিয়ে যাওয়া হলো ব্যাপটাইজ করানোর জন্য। সবচেয়ে বড় জন ছিল গাঢ় বর্ণ সবুজ চোখের অদ্ভুত এক ছেলে, যে বাবার বংশের কিছুই পায় নি, তার দশ বছরের বেশি বয়স হয়েছে। নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সব বয়সের শিশুদের ও সব বর্ণের, কিন্তু সবাই ছিল ছেলে আর সবার চেহারাতেই ছিল এক নিঃসঙ্গতার ছাপ, ফলে তাদের পিতৃপরিচয় সম্বন্ধে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না। এই দলের মধ্যে শুধু দুজনই ছিল সবার থেকে পৃথক। একজন, বয়সের তুলনায় সে ছিল অনেক বর্ধিষ্ণু, যে নাকি ফুলদানি ও থালাবাটিগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো করে। মনে হয় তার হাত যা ছোঁয়, তা-ই ভেঙে ফেলার এক ক্ষমতা আছে। আর একজন ছিল মায়ের মতো বড় বড় চোখের স্বর্ণালি চুলের একে ছেলে। যে মেয়েদের মতো লম্বা ও কোঁকড়া চুল রেখে দিয়েছে। সে স্বাভাবিকতার সঙ্গে ঘরে ঢোকে যেন এ বাড়িতেই বড় হয়েছে আর সরাসরি উরসুলার শোবার ঘরের এক সিন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে দাবি করে, ‘কলের দম দেওয়া নর্তকীটা দাও।’ উরসুলা চমকে ওঠে। সিন্দুকটা খুলে প্রাচীন আমলের আর ধুলোমাখা মেলকিয়াদেসের সময়ের জিনিসগুলোর মধ্যে থেকে খুঁজে পায়, একজোড়া লম্বা মোজা দিয়ে মুড়িয়ে রাখা এক কলের নর্তকী, যেটা নাকি কোনো এক সময় পিয়েত্র ক্রেসপি বাড়ি নিয়ে এসেছিল, আর যেটার কথা কারোরই মনে ছিল না। দুই বছরের কম সময়ের মধ্যে মায়ের উপাধি আর আউরেলিয়ানো নামকরণ করে ব্যাপটাইজ করা হয়, লম্বায় যুদ্ধ চলাকালীন ও চওড়ায় যুদ্ধক্ষেত্রের সমান বিস্তৃতির এলাকার ভেতর বীজ বপন করে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া যেসব ছেলেসন্তানের জন্ম দিয়েছে তাদেরকে; সতেরোজন। প্রথম দিকে উরসুলা ওদের পকেট ভর্তি করে টাকা দিত, আমারাস্তা রেখে দিতে চাইত লালন করতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেদের তারা সীমিত করে, একটি করে উপহার দিয়ে আর ব্যাপটাইজ করার সময় ধর্মমাতা হয়ে। ‘ওদের ব্যাপটাইজ করে আমরা আমাদের কর্তব্য পালন করেছি।’ একটা খাতায় তাদের নাম, মায়েদের ঠিকানা, জন্মস্থান ও জন্মতারিখ লিখে বলত উরসুলা।

‘আউরেলিয়ানো অবশ্যই ভালো করে ওদের হিসাব রেখেছে, সুতরাং সে এসেই যা করার করবে।’ দুপুরে খাবার সময় জেনারেল মঙ্কাদার সঙ্গে এই বর্ধিষ্ণু ও বিচলিত হওয়ার মতো ব্যাপারটা নিয়ে মন্তব্য করার সময় জানায় যে তার ইচ্ছা কোনো একদিন কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া যেন ফিরে আসে বাড়িতে; তার সব ছেলেকে জড়ো করতে। ‘দুশ্চিন্তা কোরো না কম্মাদ্রে (ব্যাপটাইজের সময় ধর্মপিতা এক ধর্মমাতা পরস্পরকে কম্পাদ্রে বা কম্মাদ্রে বলে থাকে। অর্থ: সহপিতা বা সহমাতা), হেঁয়ালিভরে মঙ্কাদা বলে, ‘তোমার আন্দাজ করা সময়ের আগেই এসে পড়বে সে।’

যা জেনারেল জানত আর দুপুরের খাবার সময় সেটা উদ্ঘাটিত করতে চায় নি, তা হচ্ছে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া এ পর্যন্ত যতগুলো বিদ্রোহ ঘটানোর চেষ্টা চালিয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ভিত নাড়ানো ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধটাতে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য পথে আছে।

পরিস্থিতি আবার প্রথম যুদ্ধের মাসগুলোর মতো উদ্বেগপূর্ণ হয়ে ওঠে। স্বয়ং মেয়র প্রবর্তিত মোরগলড়াই স্থগিত করা হয়। নগররক্ষীদের কমান্ডার আকিলেস রিকার্দো পৌরক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নেয়। উদারপন্থী তাকে উসকানিদাতা হিসেবে চিহ্নিত করে।

‘ভয়ংকর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে’, আউরেলিয়ানো হোসেকে বলে উরসুলা, ‘বিকেল ছয়টার পর রাস্তায় বের হবি না।’ সেগুলো ছিল নিছক নিষ্ফল আকুতি। অন্য সময়ের আর্কাদিওর মতোই আউরেলিয়ানো হোসে আর তার এখতিয়ারে ছিল না। যেন দৈনন্দিন প্রয়োজনীয়তায় নিজেকে বিরক্ত না করে তার চাচা হোসে আর্কাদিওর মতোই যৌনকামনা আর অলসতা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্যই তার ফিরে আসা। মনে কোনো দাগ না রেখেই আমারান্তার প্রতি তার কামনা নিভে যায়। বিলিয়ার্ড খেলায় নিজের নিঃসঙ্গতাকে ক্ষণিকের মেয়ে মানুষদের দিয়ে সান্ত্বনা জুগিয়ে, উরসুলা টাকা রেখে ভুলে যাওয়া জায়গাগুলো হাতড়ে উচ্ছন্নে যাওয়া দিন কাটাতে থাকে সে। শেষমেশ বাড়ি ফিরে আসত শুধুই কাপড় বদলানোর প্রয়োজনে। ‘সবই এক রকমের’, অনুশোচনা করত উরসুলা, ‘প্রথম দিকে সবাই ভালো মানুষ, সবাই অনুগত, নিয়মনিষ্ঠ, যেন একটা মাছি মারতেও মনে কষ্ট পায়, আর যেই দাড়ি ওঠা শুরু করে, এমনি সব নষ্ট হয়ে যায়।’ আর্কাদিওর উল্টো, আউরেলিয়ানো জেনে ফেলে যে পিলার তেরনেরা হচ্ছে তার মা আর দুপুরের ঘুমটা তার বাড়িতেই সারার জন্য এক দোলবিছানা টাঙিয়ে দেয় পিলার। ওদের সম্পর্ক ছিল মা-ছেলের সম্পর্কের চেয়েও গভীর, একে অন্যের নিঃসঙ্গতার সঙ্গী। পিলার তেরনেরা তত দিনে তার আশা-প্রত্যাশার শেষ চিহ্নটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। তার হাসি তখন অর্গানের মতো বাজে, তার বুক নতি স্বীকার করেছে মাঝেমধ্যে বিতৃষ্ণাকর আদরের কাছে, তার পেট আর ঊরু শিকার হয়েছে বহুজনে ভোগ করা মহিলাদের অপরিবর্তনীয় ভাগ্যলিপির কাছে, কিন্তু তার মনের বয়স বাড়ছে কোনো রকমের তিক্ততা ছাড়াই। মোটা, বাচাল, অসুখী ভদ্রবাড়ির মেয়েদের ভাগ্য গণনার জন্য হাত দেখা ছেড়ে দিয়ে সে সান্ত্বনা খুঁজে পায় অচেনা লোকদের সুখ দিয়ে। যে বাড়িতে আউরেলিয়ানো হোসে দুপুরে ঘুমাত, সেখানেই প্রতিবেশী মেয়েরা আপ্যায়ন করত তাদের সাময়িক প্রেমিকদের। ‘তোমার ঘরটা আমাকে ধার দেবে, পিলার?’ শুধু এটুকুই বলত তারা আর ভেতরে ঢোকার পর ‘অবশ্যই’ বলত পিলার, আর অন্য কেউ যদি সেখানে উপস্থিত থাকত, সে ব্যাখ্যা দেওয়ার সুরে বলত, ‘মানে, লোকজন তাদের বিছানায় সুখী হলেই আমিও সুখী।’

কখনোই এ জন্য টাকা নিত না সে। কখনোই কাউকে ফিরিয়ে দিত না যেমনটি ফিরিয়ে দেয়নি অগুনতি লোকদের যারা খুঁজে বেড়িয়েছে ওকে তার পরিণত বয়সের প্রারম্ভ পর্যন্ত, যাদের কাছ থেকে সে কখনো টাকাপয়সা বা ভালোবাসা পায় নি, মাঝে মাঝে পেয়েছে একটুকু সুখ। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া গরম রক্তের অধিকারী তার পাঁচ মেয়ে বয়ঃসন্ধিকালেই জীবনের বন্ধুর পথে হারিয়ে গেছে। যে দুই ছেলেকে বড় করতে পেরেছে তাদের একজন মারা গেছে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার বাহিনীতে যুদ্ধ করতে গিয়ে আর অন্যজন জলাভূমির এক গ্রামে চৌদ্দ বছর বয়সে মুরগি চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে আহত হয়ে। একদিক থেকে দেখতে গেলে অর্ধশতাব্দীজুড়ে তাসের রাজা তাকে যে দীর্ঘদেহী গাঢ় বর্ণের ব্যক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে আউরেলিয়ানো হোসে ছিল সেই ব্যক্তি। আর যেমনি তাসগুলো সব খবর তাকে পাঠাত, সেই একইভাবে তার হৃদয়ে এসে পৌঁছায় যে আউরেলিয়ানো এরই মধ্যে মৃত্যুছাপ দিয়ে চিহ্নিত। সে তাসগুলোতে স্পষ্টভাবে দেখতে পায় সেটা।

‘আজ রাতে বাইরে যাসনে’, ওকে বলে পিলার, ‘এখানেই ঘুমো, তোর বিছানায় তাকে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে কাৰ্মেলিতা মান্তিয়েল।’ ওই নৈবেদ্য ও আকুতির পেছনে যে গভীর অর্থ লুকিয়ে আছে আউরেলিয়ানো হোসে তা ধরতে পারে না। ‘ওকে বলো মধ্যরাতে আমার জন্য অপেক্ষা করতে’, উত্তর দেয় আউরেলিয়ানো।

সে যায় স্প্যানিশ কোম্পানি ঘোষিত শিয়ালের ছোরা নাটকটা দেখার জন্য, সত্যিকারে অর্থে যেটা ছিল (হোসে সোরিয়া-র স্প্যানিশ নাট্যকার ও কবি) লিখিত। আর সেটার নাম বদলে দেওয়া হয়েছে ক্যাপ্টেন আকিলেস রিকার্দোর আদেশে। কারণ উদারপন্থীরা রক্ষণশীলদের গথ (বর্বর) নামকরণ করেছিল। প্রবেশপথে টিকিট দেখানোর সময় হোসে আউরেলিয়ানো টের পায় যে ক্যাপ্টেন আকিলেস রিকার্দো তার দুই অস্ত্রধারী সৈন্যকে দিয়ে দেহ তল্লাশি করছে। ‘সাবধান ক্যাপ্টেন!’ সতর্ক করে আউরেলিয়ানো হোসে, ‘আমার পায়ে হাত তোলে এমন মরদ জন্ম নেয় নি এখনো।’ জোর করে তল্লাশি চালাতে চেষ্টা করে ক্যাপ্টেন আর নিরস্ত্র আউরেলিয়ানো হোসে দৌড় দেয়। সৈন্যরা খুনের আদেশ অমান্য করে, ‘ও একজন বুয়েন্দিয়া’, ব্যাখ্যা দেয় এক সৈন্য। রাগে অন্ধ ক্যাপ্টেন রাইফেল কেড়ে নিয়ে রাস্তার মাঝখানে চলে আসে আর তাক করে। ‘হারামজাদারা’, চিৎকার করার সময়টুকু পায়, ‘আরও ভালো হতো এটা যদি কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া হতো।’

বিশ বছরের কুমারী কার্মেলিতা মন্তিয়েল কমলার সুগন্ধিযুক্ত পানিতে গোসল সেরে পিলার তেরনেরার বিছানায় যখন রোজমেরির পাতা ছড়াচ্ছে, তখনই ভেসে এল গুলির শব্দটা। আউরেলিয়ানো হোসের কপালে লেখা ছিল যে সুখ তাকে যে সুখ থেকে আমারান্তা বঞ্চিত করেছে, সেই সুখ কার্মেলিতার কাছ থেকে পাওয়ার আর সাত সন্তানের বাবা হয়ে বৃদ্ধ অবস্থায় তার হাতে মাথা রেখে মরার কথা ছিল। কিন্তু যে বুলেটটা তার পিঠ দিয়ে ঢুকে বুক ঝাঁঝরা করে দেয়, সেটা চলছিল তাসের এক ভুল ব্যাখ্যার আদেশে। যখন গুলির শব্দ হলো, একই সঙ্গে অন্য দুটো গুলি এসে শুইয়ে দিল ক্যাপ্টেনকে, যে গুলির উৎস কখনোই জানা যায়নি। সঙ্গে সঙ্গে ভেসে আসে অনেক গুলির সম্মিলিত রাত কাঁপানো চিৎকার।

‘উদারপন্থীদের জয় হোক! জয় হোক কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার।’

বারোটার সময় যখন কার্মেলিতা মন্তিয়েল দেখতে পায় তার ভবিষ্যৎ নির্দেশক তাসে কিছুই লেখা নেই, যখন আউরেলিয়ানো হোসের রক্তক্ষরণ শেষ হয়েছে, তখন থিয়েটারের সামনে চার শরও বেশি লোক জমায়েত হয় তাদের রিভলবার খালি করে ক্যাপ্টেন আকিলেস রিকার্দোর পরিত্যক্ত শরীরের ওপর। সিসায় সিসায় ভারী হয়ে যাওয়া ফুলে ওঠা রুটির মতো শরীরটাকে ঠেলাগাড়িতে তুলতে একদল লোকের প্রয়োজন হয়।

নিয়মিত সৈন্যবাহিনীর দৌরাত্ম্যে উত্ত্যক্ত জেনারেল হোসে রাকেল মঙ্কাদা নিজের রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে আবার গায়ে ইউনিফর্ম চড়ায় আর আবার মাকন্দের সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করে। সে আশা করে নি যে তার আপসমূলক নীতিমালা অবশ্যম্ভাবীকে ঠেকিয়ে দিতে পারবে। সেপ্টেম্বরের সব খবরই ছিল পরস্পরবিরোধী। যখন সরকার ঘোষণা করছিল যে সারা দেশে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখছে, তখন বিদ্রোহীরা খবর পেত দেশের অভ্যন্তর থেকে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার গোপন সংবাদ। সরকার কোনো ঘোষণা না পাওয়ার ফলে যুদ্ধাবস্থাকে স্বীকার করে না আর তার অনুপস্থিতিতেই কোর্ট মার্শালে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মৃত্যুদণ্ড ধার্য করা হয়। আদেশ দেওয়া হয়, যে দল প্রথমে তাকে বন্দী করতে পারবে, তারাই যেন তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। ‘তার মানে সে ফিরে এসেছে’, জেনারেল মঙ্কাদার সামনে আনন্দিত উরসুলা বলে, কিন্তু জেনারেলের কাছে উত্তরটা অজানা ছিল।

আসলে এক মাসের বেশি সময় ধরে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া দেশে অবস্থান করছে। পরস্পরবিরোধী গুজবের তাড়ায় আর একই সময়ে দূরবর্তী দুই স্থানে তার অবস্থানের কথা শুনে যত দিন পর্যন্ত না সরকারিভাবে তার দ্বারা উপকূলের দুটো রাজ্য দখলের ঘোষণা না আসে, তত দিন পর্যন্ত খোদ জেনারেল মঙ্কাদা বিশ্বাস করে না তার ফিরে আসার কথা

‘অভিনন্দন, কম্মাদ্রে’, টেলিগামটা দেখিয়ে উরসুলাকে বলে সে, ‘অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এখানে পাবেন ওকে।’ সেই প্রথমবারের মতো উদ্বিগ্ন হয় উরসুলা, ‘আর আপনি কী করবেন কম্পাদ্রে?’ প্রশ্ন করে সে, ‘ও যা করত তাই করব, কম্মাদ্রে’, উত্তর দেয়, ‘আমার কর্তব্য পালন করব।’

অক্টোবরের প্রথম দিকে ভোরে সুসজ্জিত হাজার সৈন্য নিয়ে মাকন্দ আক্রমণ করে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া আর নগররক্ষীরা আদেশ পায় শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার। দুপুরবেলা যখন জেনারেল মঙ্কাদা উরসুলার সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজন সারছিল, এক বিদ্রোহী কামানের গোলা সারা গ্রামকে কাঁপিয়ে দিয়ে মিউনিসিপ্যাল কোষাগারের সামনেটা ধুলো করে দেয়। ‘ওরাও আমাদের মতোই অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত’, দীর্ঘশ্বাস ফেলে জেনারেল মঙ্কাদা, ‘আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে ওরা যুদ্ধ করে অন্তর দিয়ে।’ বেলা দু’টোর সময় যখন দুপক্ষের কামানের গোলার প্রকটে পৃথিবী কাঁপছে সে উরসুলার কাছ থেকে বিদায় নেয় এক নিশ্চিত বিশ্বাস নিয়ে যে হেরে যাওয়া এক যুদ্ধ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে সে।

‘ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি যেন আপনি এই রাতে আউরেলিয়ানোকে বাড়িতে না পান, বলে, ‘আর যদি পেয়েই যান, তাহলে আমার পক্ষ থেকে ওকে একবার জড়িয়ে ধরবেন, কারণ কখনোই ওকে দেখার আশা আর রাখি না।’

মাকন্দ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়ে যায় জেনারেল। সেই রাতে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে যুদ্ধটাকে মানবিক করে তোলার অভিন্ন লক্ষ্য আর সামরিক নেতা ও দুই পক্ষেরই উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে সুনিশ্চিত বিজয় কামনা করে এক সুদীর্ঘ পত্র লিখে পালানোর সময় ধরা পড়ে যায় সে। পরের দিন উরসুলার বাড়িতে তার সঙ্গে দুপুরের খাবার খায় কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া আর সেখানেই বন্দী হয়ে থাকে, যত দিন না বিপ্লবী যুদ্ধোপদেষ্টারা তার ভাগ্য নির্ধারণ করে। সেটা ছিল এক পারিবারিক মিলন। কিন্তু যখন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী স্মৃতি রোমন্থনের জন্য যুদ্ধের কথা ভুলে যায়, তখন উরসুলার এক বিষাদপূর্ণ অনুভূতি হয় যে তার ছেলে হচ্ছে এক অনুপ্রবেশকারী। যেদিন উরসুলা দেখে কোলাহলমুখর একদল মিলিটারি আউরেলিয়ানোকে পাহারা দিয়ে বাড়িতে এনে শোবার ঘরগুলোকে খুব ভালোভাবে পরীক্ষা করে কোনো রকম বিপদ অপেক্ষা করছে না ভেবে নিশ্চিন্ত হয়ে রেখে যায়, সেদিন থেকেই তার এ রকমটি মনে হচ্ছিল। কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া সেদিন মিলিটারিদের কার্যকলাপ শুধু মেনে নিয়েছিল তা-ই নয়, সে কড়া আদেশ জারি করে যেন কেউই তার তিন মিটারের কাছে ভিড়তে না পারে, এমনকি উরসুলাও নয়, যত দিন পর্যন্ত না তার দেহরক্ষীরা বাড়ির চারপাশে এক ভালো রক্ষাব্যূহ তৈরি করতে পারে। সে সাধারণ সৈনিকদের ইউনিফর্ম পরত যেটাতে কোনো পদভেদ বোঝা যেত না আর পায়ে ছিল সিল লাগানো কাদা আর শুকনো রক্তমাখা উঁচু বুট। কোমরবন্ধনীতে সব সময় ঝুলত মুখখোলা পিস্তলের খাপ আর যে হাতটা পিস্তলের বাঁটে রাখত, তাতে থাকত তার চোখের দৃষ্টির মতোই এক সার্বক্ষণিক সতর্কতা। কপালে গভীর টাকের আভাসসহ তার মাথাটাকে মনে হচ্ছিল অল্প আঁচে ওটাকে চুল্লিতে ঢোকানো হয়েছিল। ক্যারিবিয়ান লবণের বদৌলতে মুখমণ্ডলে চিড় ধরায় সেটা এনে দিয়েছিল এক ধাতব কাঠিন্য। আসন্ন বার্ধক্যকে ঠেকিয়ে রাখা প্রাণশক্তি যেন তার আন্ত্রিক শীতলতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। চলে যাওয়ার সময়ের চেয়ে সে ছিল আরও লম্বা, আরও পাণ্ডুর ও কৃশকায়, আর স্মৃতিকাতরতা প্রতিরোধের প্রথম চিহ্নগুলো ফুটে উঠেছে ওর ভেতরে। ‘ঈশ্বর’, ভয় পেয়ে উরসুলা বলে, ‘এখন মনে হচ্ছে ও সব পারে।’ সে আসলেই সব পারত। আমারান্তার জন্য যে আজটেক শালটা নিয়ে আসে, মধ্যাহ্নের খাবার সময়ে যে স্মৃতি রোমন্থন করে, মজাদার ছোটগল্পগুলো যে শোনায়, সেগুলো ছিল অন্য সময়ের রসবোধের অবশিষ্টাংশ। এক গণকবরে মৃতদেহগুলো গোর দেওয়ার আদেশ দিয়ে কর্নেল রোকে কার্নিসেরোকে নিযুক্ত করে সামরিক বিচার দ্রুত শেষ করতে, আর নিজে হাতে নেয় রক্ষণশীল দলের মৌলবাদী আইনগুলো আমূল সংস্কার সাধনের ক্লান্তিকর কাজ, যাতে রক্ষণশীল দলের পুনরাগমন হলেই পরবর্তীকালে আইনগুলো সংস্কার করা তাদের পক্ষে সহজ না হয়। ‘দলের রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে এগিয়ে থাকতে হবে আমাদের’, বলত তার উপদেষ্টাদের, ‘যখন ওরা চোখ খুলে বাস্তবতাকে দেখতে পাবে, ততক্ষণে আমাদের সব কাজ শেষ হয়ে গেছে।’ ওই সময়ই সে জমির বৈধ স্বত্বতা পরীক্ষা করে আর আবিষ্কার করে তার ভাই হোসে আর্কাদিওর জবরদস্তি করে দখল করা জমিগুলো। কলমের এক খোঁচায় খারিজ করে দেয় সব রেজিস্ট্রি। শুধু সৌজন্য দেখাতে এক ঘণ্টার জন্য নিজের কাজ মুলতবি করে রেবেকাকে দেখতে যায় তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিতে।

বাড়ির অন্ধকারে বসবাসরত এই নিঃসঙ্গ বিধবা, যে নাকি একসময়ে তার অবদমিত ভালোবাসার সব আলাপের অংশীদার ছিল, যার নাছোড় মনোভাব তার জীবন বাঁচিয়েছিল, সে পরিণত হয়েছে এক অতীত অধ্যায়ে। হাতের কবজি পর্যন্ত কালো রঙে আবৃত পোশাক, আর ছাই হয়ে যাওয়া হৃদয় নিয়ে রেবেকা, খুব সামান্যই যুদ্ধের খবর রাখত। কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মনে হচ্ছিল যেন তার হাড় থেকে বের হওয়া প্রভা চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসছিল, ঘুরে বেড়াচ্ছিল আলেয়ার আলোয় আর যে বদ্ধ বাতাস তখন পর্যন্ত গ্রহণ করছিল, তা ভরা ছিল বারুদের গন্ধে। কর্নেল উপদেশ আরম্ভ করে তার শোকের মাত্রা একটু কমাতে, ঘরের ভেতর আলো-বাতাস ঢোকাতে, আর হোসে আর্কাদিওর মৃত্যুর জন্য পৃথিবীকে ক্ষমা করতে। কিন্তু এরই মধ্যে সে এই বিশ্বসংসারের সবকিছুর ঊর্ধ্বে। মাটির স্বাদের মধ্যে, পিয়েত্র ক্রেসপির সুগন্ধিযুক্ত চিঠির মধ্যে, স্বামীর উত্তাল বিছানার মধ্যে বৃথাই অর্থ খুঁজে বেড়ানোর পর সে শান্তি খুঁজে পেয়েছিল এই বাড়িতে, যেখানে স্মৃতিগুলো বিমূর্ত হয়ে উঠত অপ্রশম্য শক্তির মধ্য দিয়ে, আর ফলে বাতিল করে দেওয়া ঘরগুলোতে সে ঘুরে বেড়াত মানুষের মতো। বেতের দোলচেয়ারে হেলান দিয়ে সে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে দেখছিল, যেন সে অতীত থেকে উঠে আসা কোনো দৃশ্য। এমনকি আর্কাদিও জোর করে দখলকৃত জমিগুলো আসল মালিকের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার সংবাদটাও তাকে কোনো রকম বিচলিত করে না। ‘তুই যা বলবি, তা-ই হবে আউরেলিয়ানো’, দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে, ‘সব সময় বিশ্বাস করে আসছি, আর আবার তার প্রমাণ পেলাম যে তুই হচ্ছিস এক অকৃতজ্ঞ।’

সম্পত্তির স্বত্বাধিকার পরীক্ষার সময়েই কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেসের করা বিচারের সমাপ্তি ঘটে বিদ্রোহীদের হাতে বন্দী হওয়া সব অফিসারকে গুলি করে মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে। শেষটা ছিল জেনারেল হোসে রাকেল মঙ্কাদার বিচার। উরসুলা হস্তক্ষেপ করে এর মধ্যে, ‘এ পর্যন্ত যতগুলি গভর্নর এসেছে, সে হচ্ছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো।’ কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে বলে সে, ‘অবশ্যই তার হৃদয়টা বিশাল আর সে কথা তোর চেয়ে ভালো কেউই জানে না।’ কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া উরসুলার দিকে ভর্ৎসনার দৃষ্টি নিয়ে তাকায়—’বন্দীদের বিচার করার ভার আমি নিজ হাতে নিতে পারব না’, উত্তর দেয়, ‘যদি আপনার কিছু বলার থাকে তবে কোর্ট মার্শালদের বলতে পারেন।’

উরসুলা শুধু যে বলে তা-ই নয়, মাকন্দে বাসরত সব বিদ্রোহীর মায়েদের জড়ো করে নিয়ে যায় কোর্ট মার্শালের বিচারকদের কাছে সাক্ষী দেওয়ার জন্য। প্রাচীন মাকন্দ পত্তনকারী যাদের মধ্যে কেউ কেউ ভয়ংকর পাহাড় পাড়ি দিয়েছিল, তারা একের পর এক জেনারেল মঙ্কাদার গুণগান গেয়ে যায়। সারির মধ্যে সবার শেষে ছিল উরসুলা। তার বিষণ্ণ আত্মমর্যাদাপূর্ণ আবির্ভাব, তার নামে গুরুত্ব, নিশ্চিত প্রত্যয় ও তীব্র আবেগপূর্ণ জবানবন্দি মুহূর্তের জন্য বিচারের ভারসাম্যকে টলিয়ে দেয়। ‘তোমরা এই ভয়ংকর খেলাটাকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছ আর খুবই ভালো করেছ কারণ তোমরা কর্তব্য পালন করেছ।’ কোর্টের সদস্যদের লক্ষ্য করে বলে, ‘কিন্তু ভুলে যেয়ো না, যত দিন ঈশ্বর আমাদের আয়ু দিয়েছেন, আমরা তোমাদের মাঝে থাকব আর যত বিদ্রোহীই হও না কেন, আমাদের অধিকার আছে তোমাদের প্যান্ট নামিয়ে কোমরবন্ধনী দিয়ে দুই ঘা লাগিয়ে দেওয়ার, যখন প্রথমবারের মতো তোমরা আমাদের অশ্রদ্ধা করবে।’ বিতর্কের জন্য জুরিরা যখন স্থান ত্যাগ করে সেনা সদরে পরবর্তী সময়ে স্কুলের ব্যাপ্তিতে তখন পর্যন্ত তার কথা প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। মধ্যরাতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলো জেনারেল হোসে রাকেল মঙ্কাদা। উরসুলার মারমুখী ভর্ৎসনা সত্ত্বেও কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া এই দণ্ড সরাতে রাজি হয় না। ভোর হওয়ার কিছু আগে বন্দিশালায় সাজাপ্রাপ্তর সঙ্গে দেখা করতে যায় সে। ‘মনে রাখিস কম্পাদ্রে, বলে তাকে, ‘আমি তোকে গুলি করছি না, তোকে গুলি করছে বিপ্লব।’

জেনারেল ওকে ঢুকতে দেখার জন্য এমনকি মাথা তুলেও তাকায় না।

‘জাহান্নামে যা’, উত্তর দেয়।

কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া ফিরে আসার পর থেকে এই সময় পর্যন্ত কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার সুযোগ হয় নি জেনারেলকে অন্তর দিয়ে তাকানোর। এই সময়ের মধ্যে সে কতটুকু বুড়িয়ে গেছে, কীভাবে তার হাত কাঁপছে, কীভাবে বাধ্য হয়ে নিয়মমতো মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে—এসব দেখে আশ্চর্য হয়ে যায় সে। তার নিজের ওপরই করুণা জড়ানো বিরক্তির উদ্রেক হয়। ‘তুই আমার চেয়ে ভালো করেই জানিস’, বলে, ‘সব কোর্ট মার্শালই হচ্ছে এক মিথ্যা প্রহসন আর তোকে মাশুল দিতে হচ্ছে অন্য লোকের অপরাধের কারণে, এইবারের যুদ্ধটা আমরা জিতব যেকোনো মূল্যেই হোক না কেন। আমার জায়গায় যদি তুই হতি তাহলে কী করতি?’

জেনারেল মঙ্কাদা কাছিমের খোল দিয়ে বানানো মোটা চশমাটা শার্টের কোনা দিয়ে মুছতে ব্যস্ত হয়। ‘সম্ভবত তা-ই’, বলে, ‘যা আমাকে উদ্বিগ্ন করেছে তা আমার এই মৃত্যু নয়, কারণ শেষ পর্যন্ত আমাদের মতো মানুষের জন্য এটাই হচ্ছে স্বাভাবিক মৃত্যু।’ চশমাটা বিছানার ওপর রেখে চেনসহ পকেট ঘড়িটা খোলে। ‘যা আমাকে উদ্বিগ্ন করেছে’, যোগ করে, ‘মিলিটারিদের প্রতি এ ঘৃণা, ওদের বিরুদ্ধে এত যুদ্ধ, আর ওদের নিয়ে এত চিন্তা করে তুইও রূপান্তরিত হয়েছিস ওদেরই একজনে। আর জীবনে এমন কোনো আদর্শ নেই যার জন্য তোকে এত নিচে নামতে হবে।’ সে বিয়ের আংটিটা ও পবিত্র কুমারীর মেডালটা খুলে চশমা আর ঘড়ির সঙ্গে রাখে। ‘এভাবে চলতে থাকলে’, সমাপ্তি টানে, ‘তুই শুধু যে আমাদের ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য রক্তক্ষয়ী স্বৈরাচারী শাসক হবি তা-ই নয়, আমার কম্মাদে উরসুলাকে গুলি করে মারবি, তোর বিবেককে শান্ত করার চেষ্টায়।’

কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া দাঁড়িয়ে থাকে নিশ্চল হয়ে, আর জেনারেল মঙ্কাদা চশমা, মেডেল, ঘড়ি ও আংটিটা ওর হাতে দিয়ে গলার স্বর বদলায়। ‘কিন্তু তোকে তিরস্কারের জন্য এখানে ডেকে পাঠাই নি’, বলে, ‘এই জিনিসগুলো আমার বউকে পাঠিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করতে তোকে ডেকেছি।’ কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া ওগুলো পকেটে ঢোকায়।

সে কি এখনো মানাউরে আছে?

‘হ্যাঁ, এখনো মানাউরেই আছে’, নিশ্চিত করে জেনারেল মঙ্কাদা, ‘গির্জার পেছনের সেই একই বাড়িতে যেখানে পাঠিয়েছিলি সেই চিঠিটা।’

‘অনেক আনন্দের সঙ্গেই কাজটা করব আমি, হোসে রাকেল’, বলে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া।

কুয়াশা থেকে যখন সুনীল হাওয়া বের হয়, যখন তার মুখ আর্দ্র হয় অতীতের এক ভোরের ছোঁয়ায় শুধু তখনই সে বুঝতে পারে কেন সে মৃত্যুদণ্ডটা গোরস্থানের দেয়ালের বদলে উঠানে কার্যকর করতে আদেশ দিয়েছিল। দরজার সামনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়ানো প্লাটুন তাকে রাজ্যপ্রধানের সম্মান জানায়।

‘ওকে নিয়ে আসতে পারো’—আদেশ দেয় সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *