নিঃসঙ্গতার একশ বছর – ৭

মে মাসে যুদ্ধ শেষ হয়। সরকারপক্ষের বিদ্রোহীদের কঠিন শাস্তি দেওয়ার অঙ্গীকারে সোচ্চারিত ঘোষণার দুই সপ্তাহ আগেই ধরা পড়ে যায় কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া। আরেকটু হলেই সে আদিবাসীদের ওঝার ছদ্মবেশে পশ্চিম সীমান্তে পৌঁছে যেত। যে একুশজন ওর সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল, তাদের মধ্যে চৌদ্দজন মারা যায় যুদ্ধে, ছয়জন হয় আহত আর চূড়ান্ত পরাজয়ের সময় তাকে সঙ্গ দিয়েছিল শুধু একজন, কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস। এই খবর মাকন্দে আসে এক বিশেষ ফরমানের মাধ্যমে। ‘সে বেঁচে আছে’, উরসুলা খবরটা জানায় স্বামীকে, ‘চলো, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি যেন শত্রুপক্ষের দয়া হয়। ‘তিন দিন কান্নার পর এক বিকেলে রান্নাঘরে যখন দুধের মিষ্টি নাড়া দিচ্ছিল, তখন পরিষ্কার ছেলের গলার স্বর তার কানে আসে। ‘আউরেলিয়ানোর গলা ছিল ওটা’, চিৎকার করে চেস্টনাটগাছের দিকে ছুট লাগায় স্বামীকে খবরটা দেওয়ার জন্য, ‘জানি না কীভাবে অলৌকিক ব্যাপারটা ঘটল কিন্তু সে বেঁচে আছে এবং শিগগিরই ওকে আমরা দেখতে পাব।’ এটাকে সে নিশ্চিত বলে ধরে নেয়। ঘরের মেঝে ধোয়ার ব্যবস্থা করে আর আসবাবপত্রের জায়গা বদল করে। কয়েক সপ্তাহ পর নাটকীয়ভাবে এক অশুভ ইঙ্গিত শোনা যায়, যেটার কোনো সরকারি ফরমানের ভিত্তি ছিল না; কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দয়াকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে আর লোকজনকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য সেটা সম্পন্ন করা হবে মাকন্দেই।

এক সোমবার, সকাল দশটা বিশে উরসুলার ‘ওকে নিয়ে আসছে’-এই চিৎকার করে ঘর ভাঙার এক মুহূর্ত আগে, যখন আমারান্তা আউরেলিয়ানো হোসেকে কাপড় পরাচ্ছিল, তখন শোনা যায় দূর থেকে আসা এক রণশিঙার আওয়াজ আর সেনাদলের উপস্থিতির শব্দ। বন্দুকের কুঁদোর ঘায়ে উপচে পড়া লোকজনকে সামাল দিতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় ওদের। উরসুলা আর আমারান্তা ভিড়ের মধ্যে পথ করে নিয়ে রাস্তার বাঁকে পৌঁছায় আর দেখতে পায় আউরেলিয়ানোকে। ভিখারির মতো দেখাচ্ছিল ওকে। পরনে ছেঁড়া কাপড়, চুল দাড়ি জট পাকানো আর খালি পা ছিল ওর। গরম ধুলার দিকে আমল না দিয়ে হাঁটছিল সে, হাত দুটো ছিল দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধা আর এক অশ্বারোহী অফিসার ঘোড়ার মাথার ওপর ধরে রাখছিল দড়িটাকে। একইভাবে ছিন্ন পোশাকে বিধ্বস্ত হেরিনেলদো মার্কেসকেও নিয়ে যাচ্ছিল ওরা। কিন্তু ওরা বিমর্ষ ছিল না। বরং ওরা যেন সৈন্যদের উদ্দেশে অকথ্য ভাষায় চিৎকাররত মিছিলের ওপরই বিরক্ত। ‘বাছা আমার’-সমবেত গর্জনের মধ্যে চিৎকার করে উরসুলা আর এক সৈন্য তাকে থামানোর চেষ্টা করায় এক থাপ্পড় কষিয়ে দেয় তাকে অফিসারের ঘোড়া পিছু হটে। ফলে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া থেমে দাঁড়িয়ে কেঁপে উঠে মায়ের বাড়িয়ে দেওয়া হাত এড়িয়ে মায়ের চোখের ওপর এক কঠিন দৃষ্টিতে চোখ রাখে। ‘বাড়ি ফিরে যাও, মা, কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমতি চাও আর পরে আমার সঙ্গে দেখা কোরো জেলখানায়।’ মায়ের দুই পা পেছনে ইতস্তত আমারান্তাকে দেখে তখন, আর হেসে জিজ্ঞেস করে, ‘তোর হাতের এ অবস্থা হয়েছে কীভাবে?’

‘আমারান্তা কালো ব্যান্ডেজসহ হাতটা উঁচু করে বলে, ‘পুড়ে গিয়েছে’ আর উরসুলাকে সরিয়ে নেয়, যাতে ঘোড়াগুলো তাকে না মাড়ায়। সৈন্যদল এগিয়ে যায় আর বিশেষ এক দল বন্দীদের ঘিরে ফেলে দ্রুত নিয়ে যায় কারাগারে।

বিকেলে, উরসুলা দেখা করে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার সঙ্গে। চেষ্টা করে সে দন আপলিনার মসকতের মাধ্যমে অনুমতি নেওয়ার। কিন্তু দন আপলিনার এই প্রবল প্রতাপ মিলিটারির সামনে নিজের কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলেছে। ফাদার নিকানোর যকৃৎ সমস্যায় জ্বরে ভুগছে তখন। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত না করা কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেসের বাবা-মা দেখা করার চেষ্টা করলে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে গুঁতিয়ে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়। মধ্যস্থতা করার মতো কাউকে পাওয়া অসম্ভব বুঝতে পেরে আর পরের দিন সকালে ছেলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে নিশ্চিত হয়ে উরসুলা ছেলের জন্য কিছু জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদা করে, আর একাই চলে যায় কারাগারে।

‘আমি কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মা’, ঘোষণা করে।

কারাগারের প্রহরীরা তার পথরোধ করে। ‘যেকোনোভাবেই হোক, আমি ঢুকবই।’ সতর্ক করে ওদের উরসুলা, ‘যদি তোমাদের প্রতি গুলি করার আদেশ থেকে থাকে, তাহলে এক্ষুনি আরম্ভ করতে পার।’

ওদের একজনকে ঠেলে ধাক্কা দিয়ে সাবেক ক্লাসঘরে গিয়ে ঢোকে সে, যেখানে খালি গায়ে একদল সৈন্য অস্ত্রে গ্রিস লাগাচ্ছিল। কমব্যাট ইউনিফর্ম পরা লালমুখো পুরু লেন্সের চশমা পরা, বিধিসম্মত চালচলনের অধিকারী এক অফিসার সৈন্যদের বাইরে যাওয়ার ইঙ্গিত করে।

‘আমি কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মা’, পুনরাবৃত্তি করে উরসুলা।

‘আপনি বলতে চাইছেন, এক সদয় হাসি সহকারে শুধরে দেয় অফিসার, ‘আপনি হচ্ছেন সেনঞর আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার শ্রদ্ধেয় মা।’

তার কথা বলার শিথিল ভাব দেখে উরসুলা বুঝতে পারে, সে হচ্ছে বোগোতা অভিবাসী (যাদের বলা হয় কাচাকো) উঁচু অঞ্চলের বাসিন্দা। ‘তোমার যেভাবে ইচ্ছা বলো’, মেনে নেয় উরসুলা, ‘শুধু আমাকে দেখা করার অনুমতি দাও।’

ওপরওয়ালাদের আদেশ ছিল মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতদের সঙ্গে কাউকে দেখা করার অনুমতি না দেওয়ার কিন্তু নিজেই সে দায়িত্ব নিয়ে পনেরো মিনিটের জন্য দেখা করতে দেয় অফিসারটি। বোঁচকার ভেতর কী আছে, খুলে দেখায় অফিসারকে-এক প্রস্থ পরিষ্কার জামা, তার ছেলে বিয়ের সময় যে জুতাটি পরেছিল সেটা, যেদিন থেকে ছেলের ফেরত আসার ব্যাপারটা আঁচ করতে পারে, সেদিন থেকে তার জন্য রেখে দেওয়া দুধের মিষ্টি।

কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে পেল পায়ে বেড়ি দেওয়া; বগলে এমপেদ্রাদাস দে গলন্দ্রিনোস (Lymphatic Ganglion, একধরনের ঘা) হওয়ায় হাত ছড়িয়ে বিছানায় শোয়া অবস্থায়। ওকে দাড়ি কাটার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। দুই প্রান্ত চোখা করে পাকানো গোঁফ তার চোয়ালের হাড়গুলোকে প্রকট করে তুলছিল। উরসুলার মনে হচ্ছিল যখন সে চলে গেছে, তার থেকে আরও বেশি পাণ্ডুর আর একটু লম্বা হয়েছে সে। আর মনে হচ্ছে, অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি নিঃসঙ্গ। বাড়ির সব খুঁটিনাটি ব্যাপারই বিস্তারিতভাবে তার জানা: পিয়ে ক্রেসপির আত্মহত্যা, আউরেলিয়ানোর স্বেচ্ছাচার আর মৃত্যুদণ্ড, চেস্টনাটের নিচে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার নির্ভীক মনোভাব। জানত, আমারান্তা আউরেলিয়ানো হোসেকে লালন- পালনের উদ্দেশ্য নিয়ে কুমারী অবস্থাতেই বৈধব্য মেনে নিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করেছে। এর মধ্যে আউরেলিয়ানো হোসে খুব বুদ্ধির নমুনা দেখাতে শুরু করেছে; কথা বলতে শেখার সময়েই একসঙ্গে লিখতে আর পড়তে শিখছে। ঘরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই উরসুলার কাছে বেখাপ্পা লাগছিল ছেলের পরিণত মানসিকতা, তার গায়ের চামড়া থেকে বিচ্ছুরিত কর্তৃত্ব তার নিয়ন্ত্রণের ছটা। সে এত সব খবর রাখায় মা আশ্চর্য হয়। ‘তুমি জানো, আমি সবজান্তা’, কৌতুক করে আউরেলিয়ানো। পরে গম্ভীর হয়ে বলে, ‘আজ সকালে আমাকে যখন ওরা আনে, তখন আমার মনে হচ্ছিল, আমার জীবনেই এসব ঘটে গেছে।’ আসলেই ওর চারপাশের মানুষের ভিড় যখন চিৎকার করছিল, সে তখন, গ্রামটা এক বছরে এভাবে বুড়িয়ে যাওয়ায় আশ্চর্য হয়ে নিজের চিন্তাতেই মগ্ন ছিল। আলমন্ডগাছের পাতাগুলোতে চিড় ধরেছে। নীল রং করা বাড়িগুলো লাল রং করে পরে আবার নীল রং করায় এখন এক অবর্ণনীয় রং ধারণ করেছে।

‘কী আশা করছিলি’, দীর্ঘশ্বাস ফেলে উরসুলা, ‘সময় বয়ে যায়।’

‘ঠিক তা-ই’, মেনে নেয় আউরেলিয়ানো, ‘কিন্তু এত তাড়াতাড়ি নয়।’

আর এভাবেই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত দুজনেরই আগে থেকে ঠিক করে রাখা প্রশ্ন আর উত্তরগুলো গিয়ে ঠেকে দৈনন্দিন নিত্যনৈমিত্তিক কথোপকথনে। প্রহরী যখন সময় শেষের কথা ঘোষণা করে, আউরেলিয়ানো তখন বিছানার নিচ থেকে খামে পোরা রোল করা কিছু কাগজ বের করে আনে। ওগুলো ছিল তার পদ্য। রেমেদিওস দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা পদ্যগুলো যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে যায় সে। আর যুদ্ধের সময় কোনো ঝুঁকিপূর্ণ অবসরে লিখে চলে, ‘প্রতিজ্ঞা করো, কেউ কোনো দিনও এগুলো পড়বে না’, বলে, ‘এই রাতেই এগুলো দিয়ে চুলো ধরিয়ো।’ উরসুলা প্রতিজ্ঞা করে আর বিদায় চুম্বনের জন্য উঠে দাঁড়ায়। ‘তোর জন্য একটি রিভলবার এনেছি’, ফিসফিস করে।

কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া খেয়াল করে, কোনো প্রহরী দৃষ্টিসীমার মধ্যে নেই। ‘আমার কোনো প্রয়োজনেই আসবে না।’ নিচু স্বরে বলে, ‘তবু দাও আমাকে। বেরোনোর সময় ওরা তোমার শরীর তল্লাশি করতে পারে।

উরসুলা বড়িসের ভেতরে থেকে রিভলবারটা বের করে। সে সেটা বিছানার মাদুরের নিচে চালান করে দিয়ে শান্ত ও দৃঢ়তার সঙ্গে সাক্ষাতের ইতি টানে, ‘কারও কাছে কোনো অনুনয় কোরো না বা মাথা হেঁট কোরো না। মনে করো যে আমার মৃত্যুদণ্ড অনেক আগেই কার্যকর হয়েছে।’ উরসুলা ঠোঁট দুটো কামড়ে ধরে কান্না চেপে রাখতে। বলে, ‘ঘাগুলোতে গরম পাথরের ছেঁকা দে।’

আধপাক ঘুরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে। চিন্তিত কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া দাঁড়িয়ে থাকে দরজাটা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত। তারপর আবার সে শুয়ে পড়ে হাত দুটো ছড়িয়ে। শৈশবের প্রান্ত থেকেই যখন পূর্বলক্ষণ সম্বন্ধে সচেতন হতে শুরু করেছে, তখন থেকেই সে মনে করত, মৃত্যু আসবে সুনিশ্চিত, নির্ভুল ও অনিবার্য সংকেতের ঘোষণা দিয়ে। এখন আর কয়েক ঘণ্টা বাকি আছে, কিন্তু সংকেতটা এখনো আসছে না। একবার খুব সুন্দরী এক মেয়ে তার তুকুরিংকার সেনাছাউনিতে এসে প্রহরীদের কাছ থেকে দেখা করার অনুমতি চায়। মায়েরা তাদের মেয়েদের পরবর্তী বংশধরদের উন্নতির জন্য বিখ্যাত যোদ্ধাদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার গোঁড়ামির কথা জানা থাকায় প্রহরীরা মেয়েটাকে প্রবেশের অনুমতি দেয়। যখন মেয়েটা ঘরে ঢোকে, কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া ‘বৃষ্টিতে পথ হারিয়ে ফেলার কবিতাটাকে শেষ করছিল। যেখানে তার পদ্যগুলো রাখত, সেই আলমারিতে পদ্যটা তালা দিয়ে রাখার জন্য যখন মেয়েটার দিকে পেছন দিয়ে আছে সে, তখন অনুভব করে কারও আগমনী। আলমারি থেকে পিস্তলটা নেয় মুখ না ঘুরিয়েই বলে, ‘দয়া করে গুলি কোরো না।

যখন সে গুলি ভরা পিস্তল নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ততক্ষণে মেয়েটা তারটা নামিয়ে ফেলেছে। বুঝতে পারছে না কী করবে। এভাবেই এগারোটার মধ্যে চারটে অ্যামবুশ এড়িয়ে গিয়েছে সে। অন্যবার এক রাতে মানউরের বিপ্লবী শিবিরে তার জ্বর আসায় শরীর ঘামানোর জন্য তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু কর্নেল ম্যাগনিফিকো ভিসবালকে নিজের বিছানা ধার দেয়। যাকে কখনো ধরা যায়নি এমন এক লোক ম্যাগনিফিকোকে ছোরাঘাতে মেরে পালায়, আর নিজে সে কয়েক মিটার দূরে দোলবিছানায় একই ঘরে শুয়ে থেকেও কিছুই টের পায় না। পূর্ববোধগুলোকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার চেষ্টাগুলোও ছিল ব্যর্থ। হঠাৎ করে ওগুলো আসত, যেটাকে ঠিকমতো ধরে রাখা যায় না। কোনো কোনো সময় সেগুলো ছিল এতই স্বাভাবিক যে সেগুলোকে পূর্ববোধ বলে চিহ্নিত করা যেত না। একমাত্র ঘটে যাওয়ার পরেই বোঝা যেত যে সেগুলো ছিল পূর্ববোধ। প্রায়ই সেগুলো ভ্রান্ত অন্ধবিশ্বাসের নগ্ন ধাক্কা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু যখন তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো, আর জিজ্ঞেস করা হলো তার শেষ ইচ্ছার কথা, পূর্ববোধের ভেতরকার সেই উত্তরটাকে চিনে নিতে তার কোনো সমস্যাই হয় না: বলে, ‘আমি চাই যে, দণ্ডটা মাকন্দেই কার্যকর হোক।’

কোর্ট মার্শালের প্রেসিডেন্ট এটাকে পছন্দ করে না, ‘মতলববাজি কোরো না’, বুয়েন্দিয়াকে বলে, ‘এটা হচ্ছে তোমার সময় কেনার এক কৌশল।’

‘যদি পূরণ না করেন, সেটা আপনার ইচ্ছা’, কর্নেল বলে, ‘কিন্তু এটাই আমার অন্তিম ইচ্ছা।’

সে সময় থেকেই পূর্ববোধগুলো তাকে ত্যাগ করেছে। যেদিন জেলে উরসুলার সঙ্গে দেখা হয়, সেদিন থেকেই প্রচুর চিন্তা করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে এবার মৃত্যু ঘোষণা দিয়ে আসবে না। কারণ, সেটা দৈবের ওপর নির্ভর করছে না, বরং নির্ভর করছে জল্লাদের ওপর। ঘায়ের ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে সারা রাত জেগে কাটায় সে। ভোরের কিছুক্ষণ আগে বারান্দায় পদশব্দ শুনতে পায়। ‘এই যে আসছে’, বলে ওঠে, আর কোনো কারণ ছাড়াই হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার কথা চিন্তা করে, যে নাকি বিষণ্ণ উষায় চেস্টনাটের নিচে বসে ওর কথাই ভাবছিল। ভয় করে না তার অথবা অনুভব করে না কোনো স্মৃতিকাতরতা; বরং মানুষের আয়োজিত এই মৃত্যুটা যে তার আরম্ভ করা কাজগুলো শেষ করতে না দিয়ে কাজগুলোর সমাপ্তিকে জানতে দিচ্ছে না, তার জন্য পেটের ভেতর অনুভব করে প্রচণ্ড ক্রোধ। দরজা খুলে যায়। এক মগ কফি হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে পাহারাদার। পরের দিন একই সময় একই অনুভূতি নিয়ে বগলের যন্ত্রণায় কাতর অবস্থায় ঘটে একদম একই ঘটনা। বৃহস্পতিবার পাহারাদারদের মধ্যে দুধের মিষ্টি ভাগ করে দিয়ে পরিষ্কার জামা পরে, যেগুলো এর মধ্যে তার সঙ্গে আঁটসাঁট হয়ে লাগে আর পরে নেয় চামড়ার বুটজোড়া। শুক্রবারেও তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় না।

সত্যি বলতে কি, ওর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সাহস পাচ্ছিল না ওরা। গ্রামের বিদ্রোহীরা মিলিটারিদের ভাবতে বাধ্য করেছিল যে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলে শুধু মাকন্দে নয়, জলাভূমির সব এলাকায় ভয়াবহ রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। তারা প্রাদেশিক রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ করে শনিবার রাতে ওরা যখন রাজধানী থেকে উত্তর আসার অপেক্ষা করছে, ক্যাপ্টেন রোকে কার্নিসেরো অন্যান্য অফিসারের সঙ্গে কাতরিনার দোকানে যায়।

প্রায় হুমকির মুখে শুধু একটা মেয়ে তাকে ঘরে নিতে সাহস করে। ‘কারও মরণ নিশ্চিত অবগত হওয়ার পর, কোনো মেয়েই আর তার সঙ্গে শুতে চাইবে না।’ তার কাছে স্বীকারোক্তি করে মেয়েটা, ‘কেউই জানে না কীভাবে ব্যাপারটা ঘটবে কিন্তু সবাই বলাবলি করছে যে, কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে যে অফিসার গুলি চালাবে, সে আর তার প্লাটুনের সবাই দুনিয়ার শেষ প্রান্তে লুকালেও, আগে হোক বা পরে হোক খুন হয়ে যাবে, একের পর এক।’

ক্যাপ্টেন রোকে কার্নিসেরো অন্য অফিসারদের জানায় কথাটা, আর তারা জানায় তাদের ওপরওয়ালাদের। রোববার, যদিও কেউ খোলাখুলিভাবে বলে নি, যদিও কোনো মিলিটারি কার্যক্রম তখনকার চাপা উত্তেজনাপূর্ণ শান্ত অবস্থাতে ভাঙন ধরায় নি, তবু সারা গ্রামই জানত, অফিসাররা মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দায়িত্ব এড়াতে সব রকমের অজুহাত দেখানোর জন্য এক পায়ে খাড়া।

সোমবারের ডাকে সরকারি আদেশ আসে: চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে। সেই রাতে অফিসাররা এক টুপির মধ্যে নিজেদের নাম লেখা সাতটা কাগজ ফেলে আর পুরস্কার হিসেবে আসা কাগজটা ক্যাপ্টেন রোকে কার্নিসেরোর ঝঞ্ঝাময় নিয়তিকেই প্রকাশ করে।

‘মন্দ ভাগ্যে চিড় ধরল না কখনো’, প্রচণ্ড তিক্ততার সঙ্গে উচ্চারণ করে, ‘জন্ম নিয়েছি খানকির ছেলে হয়ে, মরবও খানকির ছেলে হয়ে।’ সকাল পাঁচটার সময় লটারি করে ফায়ারিং স্কোয়াডের সৈন্যদের বাছাই করা হয়। দণ্ডিতকে জাগায় ওরা এক সতর্কবাণী দিয়ে বলে, ‘চলো বুয়েন্দিয়া। সময় এসেছে আমাদের।’

‘আচ্ছা, এই ব্যাপার!’ উত্তর দেয় কর্নেল, ‘স্বপ্ন দেখেছিলাম যে আমার ফোঁড়াগুলো ফেটে গেছে।’

যেদিন থেকে রেবেকা বুয়েন্দিয়া জানতে পারে যে আউরেলিয়ানোকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, সেদিন থেকেই সে ভোর তিনটার সময় জেগে উঠত। আর শয়নঘরে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার নাসিকা গর্জনে কাঁপতে থাকা আধখোলা জানালা ও গোরস্থানের দেয়ালের মধ্যে দিয়ে পাহারা দিত। অন্য সময়ে যেমন পিয়েত্র ক্রেসপির চিঠির জন্য যেমন অপেক্ষা করত, তেমনি গোপন অধ্যবসায় নিয়ে অপেক্ষা করে সে সারা সপ্তাহ। ‘এখানে ওকে মারা হবে না।’ ওকে বলত হোসে আর্কাদিও।

‘ওকে মারা হবে মধ্যরাতে, শিবিরের ভেতর। ওখানেই তাকে কবর দেওয়া হবে, যাতে কেউ জানতে না পারে, কে তাকে গুলি করেছে।’ রেবেকা অপেক্ষা করতে থাকে ওকে আমল না দিয়ে। ‘ওরা কি এতই বোকা যে এখানে মৃত্যুদণ্ড দেবে!’ বলত হোসে আর্কাদিও। কিন্তু রেবেকা এতই নিশ্চিত ছিল যে আগে থেকেই ভেবে রেখেছে কীভাবে দরজা খুলে হাত নেড়ে ওকে বিদায় জানাবে। ‘ওকে রাস্তা দিয়ে নিয়ে আসা হবে না।’ জোর করত হোসে আর্কাদিও, ‘ওরা কি এতই বোকা যে লোকজন সবকিছুর জন্য প্রস্তুত তা জানা সত্ত্বেও শুধু ছয়জন ভয়ে কাঁপতে থাকা সৈন্য ওকে নিয়ে যাবে এখান দিয়ে?’ স্বামীর যুক্তির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে রেবেকা জানালার পাশে বসেই থাকত। আর বলত, ‘তুই দেখতে পাবি, ওরা আসলে ও রকমই গাধা।’

মঙ্গলবার ভোর পাঁচটায় হোসে আর্কাদিও কফি পান করে কুকুরগুলোকে ছেড়ে দিয়েছে, তখন রেবেকা জানালা বন্ধ করে আর খাটের উঁচু রেলিং ধরে নিজের পতন রোধ করে। ‘ওই যে ওকে নিয়ে আসছে’, দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘কী সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে।’ হোসে আর্কাদিও জানালার কাছে যায়। দেখতে পায় ওর যৌবনে পরা প্যান্ট পরিহিত ঊষার স্বচ্ছ আলোয় কাঁপছে সে। এরই মধ্যে দেয়ালে পিঠ ঠেকানো আর দুহাত কোমরে রাখা। কারণ, বগলতলার জ্বলুনি ধরা ঘা তাকে হাত নামাতে বাধা দিচ্ছিল। ‘লোকে এত চোঁদা চোদে এরই জন্য।’ বিড়বিড় করে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া, ‘এতই চোদে যে ছয় হিজড়া তাকে মারে আর সে কিছুই করতে পারে না!’ সে এতই রাগের সঙ্গে কথাটার পুনরাবৃত্তি করছিল, যে মনে হচ্ছিল সেটা একরকম আকুলতা; আর ক্যাপ্টেন রোকে কার্নিসেরো সেটাকে প্রার্থনা করছে মনে করলে তার মনটা নরম হয়। যখন ফায়ারিং স্কোয়াড ওকে তাক করছে, তখন ওর রাগ পরিণত হয় এক তিক্ত ঘন পদার্থে, যা ঘুম পাড়িয়ে দেয় জিবটাকে, আর ওকে বাধ্য করে চোখ বন্ধ করতে। ফলে উধাও হয়ে যায় ভোরের উজ্জ্বল আলো আর আবার নিজেকে দেখতে পায়-নিতান্তই শিশু, খাটো এক প্যান্ট আর গলায় টাই পরা অবস্থায়। এক উজ্জ্বল বিকেলে ওকে নিয়ে যাচ্ছে এক তাঁবুর মধ্যে আর দেখতে পেল বরফ। যখন চিৎকার শুনতে পেল, ওর মনে হলো, সেটাই হচ্ছে ফায়ারিং স্কোয়াডের শেষ আদেশ।

চোখ খোলে এক শিহরিত কৌতূহল নিয়ে, জ্বলন্ত বুলেটের গতিপথের অপেক্ষা করতে করতে। কিন্তু শুধু দেখতে পায় শূন্যে দুহাত তোলা অবস্থায় ক্যাপ্টেন রোকে কার্নিসেরোকে, আর হোসে আর্কাদিওকে উদ্যত রাইফেল হাতে গুলি করতে প্রস্তুত অবস্থায় রাস্তা পার হতে।

‘গুলি কোরো না’, ক্যাপ্টেন বলে হোসে আর্কাদিওকে, ‘স্বর্গীয় এখতিয়ার পাঠিয়েছে তোমাকে।’

সেখানেই আরম্ভ হয় আরেক যুদ্ধ। ক্যাপ্টেন রোকে কার্নিসেরো, ও তার ছয় সৈন্য কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার সঙ্গে রওনা হয় রিওয়াচার উদ্দেশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বিপ্লবী জেনারেল ভিক্তর মেদিনাকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে। সময় বাঁচানোর জন্য মাকন্দ পত্তনের সময় যে পথ ব্যবহার করেছিল হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া সেই পথ ধরে তারা। কিন্তু এক সপ্তাহ পার হওয়ার আগেই বুঝতে পারে, সেটা ছিল এক অসম্ভব অভিযান। ফলে পাহাড়ের পাদদেশের বিপজ্জনক পথ ধরে এগোতে হয় তাদের, শুধু ফায়ারিং স্কোয়াডের জন্য বরাদ্দকৃত গুলি নিয়ে পথে পড়া গ্রামগুলোর কাছাকাছি ঘাঁটি গাড়ত ওরা। সোনার মাছ হাতে ছদ্মবেশ নিয়ে ওদের একজন সম্পূর্ণ দিনের বেলায় বিশ্রামরত বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বেরিয়ে যেত। পরে বিপ্লবীসহ দুজন শিকারের নাম করে বেরিয়ে আর কখনো গ্রামে ফিরত না। পাহাড়ের বাঁক থেকে রিওয়াচা যখন ওদের চোখে পড়ে, ততক্ষণে জেনারেল ভিক্তর মেদিনাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে জেনারেল পদমর্যাদা দিয়ে লোকেরা ক্যারিবীয় উপকূলের বিপ্লবী বাহিনীর প্রধান বলে ঘোষণা করে। সে এই ভার গ্রহণ করলেও পদোন্নতি বর্জন করে। পাশাপাশি নিজের ওপর শর্ত আরোপ করে যে যতক্ষণ পর্যন্ত না রক্ষণশীলদের ক্ষমতা থেকে না সরাতে পারবে, তত দিন সে এই পদ গ্রহণ করবে না। মাস তিনেকের মধ্যে সে হাজারের বেশি লোকের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে পারলেও তারা সবাই যুদ্ধে নিহত হয়। যারা বেঁচে থাকে তারা পূর্ব সীমান্তে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। পরে তাদের সম্পর্কে যা জানা যায়, তা হচ্ছে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জে অন্তর্ভুক্ত ‘কাবো দে ভেলায় গিয়ে ওরা জাহাজ থেকে নেমেছে। সরকারের তরফ থেকে টেলিগ্রাফের মাধ্যমে দেশব্যাপী ঘোষণা করা হয় বিজয় উল্লাস। কিন্তু দুই দিন পরই, প্রায় আগের টেলিগ্রাফের সঙ্গে সঙ্গেই এল দক্ষিণের সমভূমির আরেক বিদ্রোহের বার্তাবাহী টেলিগ্রাম। আর এভাবেই সূত্রপাত হয় সর্বব্যাপী কর্ণেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার কিংবদন্তির। একই সঙ্গে পরস্পরবিরোধী সংবাদ আসে, বিইয়্যানুয়েবার বিজয়ের ও গুয়াকামাইয়ার পরাজয়ের, নরখাদক মেতিলনদের খাদ্যে পরিণত হয়েছে সে, জলাভূমির এক গ্রামে মারা গিয়েছে আবার আর এক খররে জানা যায় সে উরমিতায় ঘোষণা করেছে বিদ্রোহের। সেই সময়ে উদারপন্থী নেতারা সরকারের সঙ্গে পার্লামেন্টে অংশগ্রহণের জন্য দর-কষাকষি করছিল আর তারা তাকে নিঃসঙ্গ ভাগ্যান্বেষী অভিযাত্রী বলে ঘোষণা করে, যার তাদের দলে কোনো স্থান নেই। সরকার তাকে ডাকাতের তালিকাভুক্ত করে এবং তার মাথার দাম পাঁচ হাজার পেসো ধার্য করে। ষোলোবার পরাজয়ের পর কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া দুই হাজার অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত আদিবাসী নিয়ে গুয়াহিরা ত্যাগ করে আর অপ্রস্তুত আক্রমণে নিদ্রারত সৈন্যরা রিওয়াচা পরিত্যাগ করে। সেখানেই সে নিজের প্রধান সৈন্যশিবির স্থাপন করে এবং শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে। সরকারের তরফ থেকে প্রথম যে হুমকি আসে তা হচ্ছে, সে তার সৈন্যদলকে পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত সরিয়ে না নিলে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেসকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। তখনকার পদোত্তীর্ণ সেনাপতি কর্নেল রোকে কার্নিসেরো হতাশাসহকারে টেলিগ্রামটা তার হাতে দেয়। সে সেটা অভূতপূর্ব আনন্দের সঙ্গে পড়ে।

‘কী ভালো!’ উল্লাসভরা কণ্ঠে বলে, ‘আমাদের মাকন্দে এখন টেলিগ্রাফ আছে।’

সে সুস্পষ্ট ভাষায় চিঠিটার উত্তর দেয়। তিন মাসের মধ্যে সে তার প্রধান সৈন্যশিবির স্থাপন করার চিন্তা করছে। যদি ওই সময় কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেসকে জীবিত না পাওয়া যায় তাহলে কোনো রকম বিচার না করেই ওই সময়ের সব বন্দীকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। শুরু করা হবে জেনারেলদের দিয়ে আর তাদের অধীনস্তদেরও একইভাবে গুলি করার। নির্দেশ দেওয়া হবে আর যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত একইভাবে চলবে সেটা। বিজয়ী বেশে তিন মাস পর, জলাভূমির পথে সে যার সঙ্গে প্রথম আলিঙ্গনবদ্ধ হয়, সে হচ্ছে কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস।

বাড়িটা তখন শিশুদের দিয়ে ভরে গিয়েছে। আর্কাদিওর মৃত্যুর পাঁচ মাস পর জন্ম দেওয়া দুই যমজ ছেলেসহ তার বড় মেয়ে সান্তা সোফিয়া দেলা পিয়েদাদকে উরসুলা অনেক আগেই বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতের শেষ ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ‘রেমেদিওস’ নাম দিয়ে মেয়েটাকে ব্যাপটাইজ করা হয়। ‘আমি নিশ্চিত যে এটাই আর্কাদিও বলতে চেয়েছে। তর্ক করে সে, ‘ওর নাম উরসুলা রাখা হবে না। কারণ উরসুলারা জীবনে অনেক কষ্ট ভোগ করে।’ যমজ দুজনের নাম রাখা হয় হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো ও আউরেলিয়ানো সেগুন্দো। আমারাস্তা ওদের দেখাশোনার দায়িত্ব নেয়। বসার ঘরে কাঠের ছোট ছোট টুল বসিয়ে প্রতিবেশীদের অন্য বাচ্চাদের নিয়ে সে কিন্ডারগার্টেন স্থাপন করে। যখন কর্নেল আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ফিরে আসে, আতশবাজি, ঘণ্টা ধ্বনি আর বাচ্চাদের কোরাস গানের মাধ্যমে স্বাগতম জানানো হয় তাকে। দাদার মতো লম্বা, বিপ্লবী অফিসারদের মতো পোশাক পরা আউরেলিয়ানো হোসেকে সামরিক কায়দায় সম্মান জানায় তারা।

সব খবরই ভালে খবর ছিল না। কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার পালানোর এক বছর পর হোসে আর্কাদিও আর রেবেকা আর্কাদিওর বানানো এক বাড়িতে উঠে যায় বাস করার জন্য। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সময়ে হোসে আর্কাদিওর হস্তক্ষেপের কথা কেউই জানত না। প্লাজার সবচেয়ে ভালো কোনায় তিনটে রবিন পাখি যে আলমন্ডগাছে বাসা বেঁধেছে, সে গাছটার ছায়ায় অবস্থিত বাড়িটায় ছিল অতিথিদের জন্য এক বড় দরজা আর আলো আসার জন্য চারটে জানালা। বাড়িটার দরজা ছিল অতিথিদের জন্য অবারিত। রেবেকার পুরোনো বান্ধবীরা, মসকতেদের চার কুমারী বোনসহ বেগনীয়া ভরা বারান্দায় অনেক বছর আগে ছেদ পড়া এমব্রয়ডারির আসর পুনরায় আরম্ভ করে। রক্ষণশীল সরকার কর্তৃক মালিকানার স্বত্ব অনুমোদিত জোর করে দখলকৃত জমিগুলো হোসে আর্কাদিও ভোগ করতে থাকে। ওকে দেখা যেত প্রতি বিকেলেই তার দোনলা শটগানে দড়ি দিয়ে ঝোলানো খরগোশ ঝুলিয়ে, সঙ্গে শিকারি কুকুরগুলো নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বাড়ি ফিরতে। সেপ্টেম্বরের এক বিকেলে, আসন্ন ঝড়ের হুমকির মুখে অন্য সব দিনের চেয়ে আগেই বাড়ি ফেরে সে। খাবার ঘরে রেবেকাকে সম্ভাষণ জানিয়ে, উঠানে কুকুরগুলোকে বেঁধে, খরগোশগুলোকে পরে লবণ মাখানোর জন্য রান্নাঘরে ঝোলায় আর কাপড় বদলাতে যায় শোবার ঘরে। রেবেকা পরে জানায় যে যখন তার স্বামী শোবার ঘরে ঢুকে সে তখন স্নান ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিয়েছিল, ফলে সে কিছুই জানতে পারে নি। তার এই উক্তি বিশ্বাস করা কঠিন হলেও এর চেয়ে বিশ্বাসযোগ্য আর কিছু ছিল না। আর তা ছাড়া রেবেকাকে যে লোকটা সুখী করেছিল, তাকে খুন করার কোনো কারণ রেবেকার মধ্যে কেউ খুঁজে পায় নি। এটাই ছিল মাকন্দে সম্ভবত একমাত্র রহস্য, যার সত্য কখনোই উদ্‌ঘাটিত হয় নি। হোসে আর্কাদিও শোবার ঘরের দরজাটা বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে পিস্তলের এক বিকট আওয়াজে বাড়িটা কেঁপে ওঠে। সুতোর মতন রক্তের এক ধারা দরজার নিচ দিয়ে বেরিয়ে উঠান পেরিয়ে, পরে রাস্তায় বেরিয়ে উঁচু-নিচু চত্বরগুলো সোজা পার হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে উঠে পড়ে পাঁচিলের ওপর, পরে তুর্কদের সড়ক ধরে এগিয়ে গিয়ে এক কোনায় এসে প্রথমে ডানে পরে বাঁয়ে বাঁক নিয়ে বুয়েন্দিয়ার বাড়ির দিকে সরাসরি এগিয়ে বন্ধ দরজার নিচ দিয়ে ঢোকে, যাতে কার্পেটে রক্তের দাগ না লাগে আর একই কারণে অতিথিদের বসার ঘরের দেয়াল ঘেঁষে এগিয়ে গিয়ে অন্য বসার ঘর পার হয়ে, বড় একটা বাঁক নিয়ে খাবার টেবিল এড়িয়ে বারান্দা ধরে এগোতে থাকে আমারান্তার চেয়ারের নিচ দিয়ে, যেখানে আউরেলিয়ানো হোসেকে অঙ্কের এক পাঠ দেওয়ায় ব্যস্ত আমারান্তার অলক্ষ্যে গুদামে ঢুকে হাজির হয় রান্নাঘরে, যেখানে উরসুলা পাউরুটি বানানোর জন্য ছত্রিশটি ডিম ভাঙার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

‘হায় খোদা’–চিৎকার করে উরসুলা।

রক্তের সুতোর উৎপত্তি নির্ণয়ের ইচ্ছায় ওটা ধরে উল্টো দিকে অনুসরণ করে ভাঁড়ার পেরিয়ে বেগোনিয়ার ঘেরা বারান্দা, যেখানে আউরেলিয়ানো নামতা পড়ছিল তিন আর তিন ছয়, ছয় আর তিন নয় সেটা পেরিয়ে, খাবার ও বৈঠকঘরগুলোর মধ্যে দিয়ে রাস্তায় নেমে সোজা এগিয়ে প্রথমে ডানে পরে বাঁয়ে বাঁক নিয়ে তুর্কদের রাস্তায় গিয়ে নামে, তার গায়ে তখনো বেকিং করার এপ্রোন আর হাতে বানানো চপ্পল আর এসব ব্যাপারে গুরুত্ব না দিয়ে সে এগিয়ে প্লাজায় গিয়ে পড়ে আর সেখান থেকে ঢুকে পরে এমন এক বাড়ির দরজা দিয়ে যে বাড়িতে সে কখনোই ঢোকে নি; শোবার ঘরের দরজায় গিয়ে ধাক্কা দেওয়ায় পোড়া বারুদের গন্ধে তার দম বন্ধ হয়ে আসে আর কেবল খুলে রাখা লম্বা মোজার ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা অবস্থায় পায় হোসে আর্কাদিওকে, আর আবিষ্কার করে হোসে আর্কাদিওর ডান কান থেকে বের হওয়া রক্তের সুতোর উৎপত্তি। তার শরীরে কোনো ক্ষত খুঁজে পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় না অস্ত্রটাও। এমনকি লাশের গা থেকে বারুদের গন্ধটা সরানোও অসম্ভব হয়ে পড়ে। সাবান আর ছোঁবা দিয়ে তিনবার ধুয়ে প্রথমে লবণ আর ভিনিগার ঘষা হয় লাশে, পরে ছাই আর লেবু মেখে তরল ক্ষারের পিপেতে ভরে ছয় ঘণ্টা রেখে দেওয়া হয়। লাশটাকে তারা এমনভাবে ঘষে যে তার গায়ের আরবি অক্ষরের উল্কিগুলো বিবর্ণ হতে শুরু করে। পরে যখন তারা নিরুপায় হয়ে গোল মরিচ, জিরা আর তেজপাতা দিয়ে কম আঁচে সেদ্ধ করার কথা ভাবছে, ততক্ষণে লাশে পচন ধরতে শুরু করায় দ্রুত দাফন করতে বাধ্য হয়। এক বায়ুরোধক দুই মিটার দশমিক ত্রিশ সেন্টিমিটার লম্বা এবং এক মিটার দশমিক দশ সেন্টিমিটার চওড়া, ভেতর দিকে লোহার পাত দিয়ে মজবুত করে লোহার বল্টু লাগানো বিশেষভাবে তৈরি কফিনে লাশটাকে বন্ধ করা হলেও যে জায়গায় কবর দেওয়া হয়েছে, তার রাস্তাগুলোতে গন্ধ পাওয়া যেত বারুদের। যকৃৎ ফুলে ঢোল হওয়া ফাদার নিকানোর বিছানায় শুয়ে শুয়েই আশীর্বাদ করেন। যদিও পরের কয়েক মাসের মধ্যেই শক্ত দেয়াল তুলে কবরটাকে মজবুত করে চাপ ধরা ছাই, কাঠের গুঁড়া আর চুন ফেলে ওরা, তবু পরের অনেক বছর গোরস্থানে বারুদের গন্ধ থাকে, যত দিন না কলা কোম্পানির ইঞ্জিনিয়াররা এসে কংক্রিট দিয়ে সম্পূর্ণভাবে সিল করে দেয় কবরটাকে। লাশটা বের করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রেবেকা তার ঘরের দরজা বন্ধ করে এক ঘৃণার পুরু খোলের মধ্যে ঢোকায় নিজেকে। জ্যান্ত কবর দেয় সে তাকে আর জাগতিক কোনো প্রলোভনই সেটাকে কখনোই ভাঙতে পারে নি। শুধু একবারই প্রাচীন আমলের রুপালি জুতা পরে সূক্ষ্ম ফুলের হ্যাট পরে রাস্তায় বেরিয়েছিল সে যেবার গ্রামে এক পর্যটক ইহুদি এসে এমন উত্তপ্ত অবস্থার সৃষ্টি করেছিল যে পাখিরা জানালার তার ভাঙত ঘরে ঢুকে পড়ার জন্য। শেষবার তাকে কেউ জীবন্ত অবস্থায় দেখতে পায় যখন দরজা ভেঙে চুরি করতে আসা চোরকে সে এক গুলিতে মেরে ফেলে। শুধু বিশ্বস্ত চাকরানি আরহেনিদা ছাড়া কেউই তার সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখে নি। একসময় শোনা যাচ্ছিল যে সে নিজের জ্ঞাতিভাই বিবেচনা করা এক বিশপকে চিঠি লিখত কিন্তু কেউই বলে নি সে উত্তর পেত কি না। সারা গ্রাম তাকে ভুলে যায়।

বিজয়ী হয়ে ফিরে এলে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে খুব একটা উৎসাহ পায় না। কোনো রকম প্রতিরোধ ছাড়াই সরকারি সৈন্যদল প্লাজা ছেড়ে চলে যাওয়ায় উদারপন্থী লোকজনের মধ্যে বিজয়ের এক মিথ্যা ভ্রমের সৃষ্টি হয়, যাকে ভেঙে দেওয়া সংগত মনে করে না সে, কিন্তু বিপ্লবীরা সত্যটা ঠিকই জানত আর সবচেয়ে বেশি জানত কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া। যদিও এই সময়ে তার অধীনে পাঁচ হাজারের বেশি সৈন্য ছিল আর উপকূলীয় দুটো রাষ্ট্র শাসন করত তবু ভালো করেই জানত তার পিঠ ঠেকে আছে সমুদ্রে। আর সে এমন এক গোলমেলে রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়েছে যে সে যখন সৈন্যদলের গোলার আঘাতে বিধ্বস্ত গির্জার চূড়ার পুনর্নির্মাণের নির্দেশ দেয়, তখন রোগশয্যা থেকে ফাদার নিকানোর মন্তব্য করেন, ‘কী হাস্যকর! খ্রিষ্টের বিশ্বাসের রক্ষকেরাই ধ্বংস করে গির্জা আর ম্যাসনরা তা মেরামত করতে পাঠায়।’ এই অবস্থা থেকে নিষ্কৃতির এক পথ খুঁজে পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে কাটিয়ে দিত টেলিগ্রাফ অফিসে অন্যান্য প্লাজার প্রধানদের সঙ্গে আলাপ করে। কিন্তু প্রতিবারই বেরোত আরও নিশ্চিত হয়ে যে যুদ্ধটা স্থবিরাবস্থায় এসে পৌঁছেছে। যখন উদারপন্থীদের নতুন বিজয়ের সংবাদ আসত, সেটা খুব উল্লাসের সঙ্গে ঘোষণা করা হলেও মানচিত্রে সে দেখতে পেত সত্যিকার অবস্থা; আর বুঝে যেত যে তার সৈন্যরা জঙ্গলের গভীরে ঢুকে ম্যালেরিয়া আর মশার বিরুদ্ধে যুঝে এগোচ্ছে বাস্তবতার উল্টো দিকে। ‘আমরা সময় নষ্ট করছি’—অভিযোগ করত অফিসারদের কাছে। আমরা সময় নষ্ট করছি আর ওদিকে পার্টির হারামিরা এক আসনের জন্য ভিক্ষে করেছে। ‘মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে যে ঘরে ছিল, সেই একই ঘরে নিদ্রাহীন কাটিয়ে দিত ঝোলানো দোলবিছানায় চিত হয়ে শুয়ে। মনের চোখে দেখত বরফশীতল প্রভাতে কান অবধি ঢাকা কালো কোট পরিহিত উকিলরা রাষ্ট্রপতি ভবন ত্যাগ করছে হাত মর্দন করতে করতে, আর ফিসফিসিয়ে কথা বলতে বলতে আশ্রয় নিচ্ছে ভোরের বিষণ্ন ক্যাফেগুলোতে, অনুমান করত—যখন প্রেসিডেন্ট হ্যাঁ বলেছিলেন, তখন কী বলতে চেয়েছেন; যখন না বলেছিলেন, তখনই বা কী বোঝাতে চেয়েছেন আর যখন সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক কিছু বলেছিলেন, তখনই বা কী চিন্তা করছিলেন, আর সেই মুহূর্তে মশা তাড়াতে তাড়াতে, পঁয়ত্রিশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় আসন্ন ভীতিপ্রদ ঊষা অনুভব করতে করতে তাকে আদেশ করতে হবে তার লোকদের সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে।

অনিশ্চয়তার এক রাতে যখন পিলার তেরনেরা উঠানে বারান্দায় বসে সৈন্যদের সঙ্গে গান গাইছে, সে তাকে তাস দেখে ভবিষ্যৎ বলতে বলে। ‘সাবধানে কথা বোলো’–তিনবার তাস বিছিয়ে আবার গোটানোর পর একমাত্র এটাই স্পষ্টভাবে বের করতে পারে পিলার তেরনেরা। ‘জানি না এর মানে কী, কিন্তু সংকেতটা খুবই পরিষ্কার, যা বলবে খুব সাবধানে বলবে।’ দুই দিন পর এক আর্দালির হাতে কেউ একজন এক মগ চিনি ছাড়া কফি দেয়। সেই আর্দালি সেটাকে আরেক আর্দালির হাতে দেয় আর সে দেয় আরেকজনকে, এভাবে সেটা এসে পৌঁছায় কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার অফিসে। কারও কাছে সে কফি চায় নি, কিন্তু সামনেই ছিল বলে কর্নেল পান করে কফিটা। ওটাতে একটা ঘোড়াকে মেরে ফেলার মতো পর্যাপ্ত ন্যক্স ভোমিকা (একধরনের বিষ) ছিল। যখন তাকে বাড়ি নেওয়া হলো, তখন তার শরীর শক্ত আর বাঁকা হয়ে গিয়েছিল আর দুই পাটি দাঁতের মধ্যে পড়ে জিব গিয়েছিল কেটে। উরসুলা মৃত্যুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। বমি হওয়ার দাওয়াই দিয়ে ওর পাকস্থলী পরিষ্কার করিয়ে শরীরটাকে গরম কম্বলচাপা দেয় সে; আর পান করায় দুই দিন ধরে ডিমের সাদা অংশ, যতক্ষণ পর্যন্ত না শরীর তার স্বাভাবিক তাপমাত্রা ফিরে পায়। চতুর্থ দিনে সে বেরিয়ে আসে সব বিপদ থেকে। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে উরসুলা আর অন্য অফিসারদের চাপে পড়ে আরও এক সপ্তাহ বিছানায় কাটায় কর্নেল। শুধু তখনই সে জানতে পারে যে তার লেখা পদ্যগুলো পোড়ানো হয় নি। ‘আমি তাড়াহুড়ো করে কিছুই করতে চাই নি’—ব্যাখ্যা দেয় উরসুলা। ‘সেই রাতে যখন এগুলো দিয়ে চুলো ধরাতে যাচ্ছিলাম, তখন মনে হলো লাশটা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করাই ভালো।’ রেমেদিওসের ধুলোভরা পুতুলগুলোর মাঝে, আরোগ্য লাভের কুয়াশামাখা সময়ে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া নিজের পদ্যগুলোর মধ্যে খুঁজে পায় তার অস্তিত্বের তাৎক্ষণিক নিশ্চয়তা। আবার লিখতে বসে সে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে এক পরিণতিহীন যুদ্ধের কিনারায় দাঁড়িয়ে ছন্দোবদ্ধ পদ্যের মাধ্যমে মৃত্যুর প্রান্তসীমার অভিজ্ঞতাগুলোকে ফুটিয়ে তোলে সে। ফলে তার চিন্তাগুলো এতই পরিষ্কার হলো যে সে সেগুলোকে উল্টেপাল্টে খতিয়ে দেখতে পারে। এক রাতে প্রশ্ন করে কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেসকে

একটা কথা বল তো কম্পাদ্রে (বন্ধু অর্থে): কেন যুদ্ধ করছিস তুই?’

‘কেন নয়, কম্পাদ্রে’—উত্তর দেয় কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস, ‘মহান উদারপন্থীদের জন্য’-

‘ভাগ্যবান তুই, কারণটা জানিস’—উত্তর দেয় সে, ‘আমার কথা যদি বলি, আমি যুদ্ধ করছি আত্মসম্ভ্রমের কারণে।’ ‘এটা ভালো নয়’, বলে কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস। তার এই উদ্বিগ্নতা উপভোগ করে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া, ‘অবশ্যই’, বলে, ‘কিন্তু কেন যে যুদ্ধ করছি, তা না জানার চেয়ে অন্তত এটা ভালো।’ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে যোগ করে: ‘অথবা তোর মতো যুদ্ধ করার চেয়ে, যে যুদ্ধটা কারও জন্যই কোনো অর্থ বহন করে না।’

যতক্ষণ পর্যন্ত না দলের নেতারা জনসমক্ষে ‘সে ডাকাত বৈ কিছু নয়’ ঘোষণাটা প্রত্যাহার না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার আত্মমর্যাদা তাকে দেশের অভ্যন্তরের সশস্ত্র দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা থেকে বিরত করে। অবশ্য সে জানত, যখনই এসব দ্বিধা একপাশে সরিয়ে রাখবে, তখনই যুদ্ধের দুষ্টচক্রকে ভেঙে ফেলতে পারবে। আরোগ্য লাভের সময়টা তাকে চিন্তা করার অবকাশ দেয়। সুতরাং সে উরসুলাকে রাজি করায় তার মাটির নিচে পুঁতে রাখা উত্তরাধিকারের অবশিষ্টাংশ আর তার সঞ্চয়ের একটা বড় অংশ তার হাতে তুলে দিতে মাকন্দের সামরিক ও বেসামরিক নেতা হিসেবে কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেসকে ঘোষণা করে দেশের অভ্যন্তরস্থ বিদ্রোহী দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে যায় সে।

কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস যে শুধু কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার সবচেয়ে বিশ্বাসভাজন ছিল তা-ই নয়, উরসুলাও তাকে বরণ করত পরিবারের একজন হিসেবে। নরম স্বভাবের ভীরু ভঙ্গুর আর সহজাত শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষটি সরকার চালনার চেয়ে যুদ্ধের জন্যই ছিল বেশি উপযুক্ত। তার রাজনৈতিক উপদেষ্টারা সহজেই তাকে তাত্ত্বিক গোলকধাঁধায় জড়িয়ে ফেলত। যে রকমটি কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া স্বপ্ন দেখত: বৃদ্ধ বয়সে সোনার মাছ তৈরি করতে করতে মারা যেতে; মাকন্দে ঠিক একই রকম গ্রামীণ শান্তি স্থাপন করতে সক্ষম হয় সে। মা-বাবার সঙ্গেই বসবাস করলেও উরসুলার কাছেই সপ্তাহে দুই-তিনবার দুপুরের খাওয়াটা সারত। উরসুলার সম্মতি নিয়ে, আউরেলিয়ানো হোসেকে পুরুষ হিসেবে গঠন করার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র চালনায় এবং প্রাথমিক সামরিক শিক্ষা দেয় সে আর তাকে নিয়ে যায় ব্যারাকে, সেখানে কয়েক মাসব্যাপী কাটাতে। অনেক বছর আগে যখন হেরিনেলদো মার্কেস, ছিল প্রায় এক শিশু, তখন আমারান্তার প্রতি সে প্রেম নিবেদন করেছিল। আমারান্তা তখন পিয়েত্র ক্রেসপির প্রতি একপক্ষীয় প্রেমে এতই আপ্লুত ছিল যে সে তাকে হেসে উড়িয়ে দেয়। হেরিনেলদো মার্কেস অপেক্ষা করে। একবার জেল থেকে আমারান্তাকে তার বাবার নামের আদ্যাক্ষর লেখা এক ডজন বাতিস্তা (মিহি সুতি কাপড়) রুমাল বানানোর অনুরোধ করে এক চিরকুট পাঠায়। টাকাও পাঠায় চিরকুটের সঙ্গে। সপ্তাহ খানেক পর আমারান্তা এমব্রয়ডারি করা এক ডজন রুমাল নিয়ে জেলখানায় যায় আর টাকাগুলোও সঙ্গে করে নিয়ে যায় ফেরত দিতে, আর কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে দেয় অতীত দিনের গল্প করতে করতে। ‘যখন বের হব, তোমাকে বিয়ে করব আমি’–বিদায়কালে বলে হেরিনেলদো মার্কেস। আমারান্তা হেসে ফেলে ঠিকই, কিন্তু বাচ্চাদের পড়ানোর সময় তার কথা ভাবতে থাকে আর কৈশোরে পিয়েত্র ক্রেসপির প্রতি যে ভালোবাসা ছিল, তার প্রতি সেই একই রকম প্রেম জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করে। শনিবার কারাগারে দর্শনার্থীদের দিনগুলোতে বাড়ির সামনে দিয়ে যেত হেরিনেলদো মার্কেসের মা-বাবারা আর আমারান্তা তাদের সঙ্গী হতো। ওই রকমেরই এক শনিবারে উরসুলার কাছে ধরা পড়ে যায় রান্নাঘরে চুল্লির সামনে দাঁড়িয়ে বিস্কুটগুলো বেরিয়ে আসার পর সেখান থেকে সবচেয়ে ভালোগুলো বেছে নেওয়ার জন্য অপেক্ষারত অবস্থায়।

‘ওকে বিয়ে করে ফেলো’, বলে ওকে, ‘ওর মতো আর একজন খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন হবে।’

আমারান্তা কথাটা ভালো না লাগার ভান করে।

‘পুরুষ শিকারে প্রয়োজন নেই আমার’, উত্তর দেয়, ‘এগুলো নিয়ে যাচ্ছি, কারণ আজ হোক কাল হোক, ওকে গুলি করে মারবে ওরা।’

কোনো কিছু না ভেবেই কথাটা বলে আমারান্তা। কিন্তু কথাটা বলেছিল একই সময়ে, যখন সরকার রিওয়াচা দিয়ে না দিলে হেরিনেলদো মার্কেসকে গুলি করার হুমকি দিয়েছিল। জেলখানায় সাক্ষাতের নিয়মটা তখন বন্ধ করে দেওয়া হয়। রেমেদিওসের মৃত্যুতে যে আপরাধবোধ হয়, সেই একই বোধে পীড়িত হয়ে ঘর বন্ধ করে কাঁদে আমারান্তা, যেন তার বিবেচনাহীন কথা আরেকজনের মৃত্যুর কারণ হতে বসেছে। ওর মা তাকে সান্ত্বনা দেয়। ওকে আশ্বাস দিয়ে বলে যে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া নিশ্চয়ই কিছু করবে এর মৃত্যুদণ্ড রোধ করতে, আর প্রতিজ্ঞা করে যুদ্ধ শেষে হেরিনেলদো মার্কেসকে আমারান্তার প্রতি আকৃষ্ট করার। নির্দিষ্ট করে রাখা সময় উত্তরে যাওয়ার আগেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে সে। সামরিক ও বেসামরিক নেতার নতুন সম্মান নিয়ে যখন হেরিনেলদো মার্কেস বাড়িতে আসে, তাকে নিজের ছেলের মতো বরণ করে নেয় উরসুলা; বিভিন্ন তোষামুদে অবস্থার সৃষ্টি করে তাকে বেশিক্ষণ বাড়িতে আটকে রাখার জন্য, আর সমস্ত হৃদয় দিয়ে প্রার্থনা করে যেন আমারান্তাকে বিয়ে করার প্রস্তাবটা তার মনে পড়ে যায়। তার প্রার্থনা মনে হয় সফল হয়েছে। যে দিনগুলিতে দুপুরের খাবার খেতে বাড়িতে যেত, কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস বিকেলটা কাটিয়ে দিত বেগোনিয়া ভরতি বাগানে, আমারান্তার সঙ্গে চায়নিজ চেকার খেলে। উরসুলা বিস্কুট আর দুধকফি নিয়ে যেত আর লক্ষ রাখত বাচ্চারা যেন ওদের বিরক্ত না করে। সত্যি বলতে আমারান্তা তার হৃদয়ে ভুলে যাওয়া যৌবনের প্রেমের ভস্মে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করতে থাকে। অসহ্য উৎকণ্ঠা নিয়ে সে অপেক্ষা করত দুপুরে খাবারের দিনগুলোর জন্য, চায়নিজ চেকারের বিকেলগুলোর জন্য আর সময় উড়ে যেত সেই যোদ্ধার সঙ্গে, যার নাম স্মৃতিকাতরতায় ভরা আর যার আঙুলগুলো কেঁপে উঠত সূক্ষ্মভাবে, গুটি চালার সময়। কিন্তু যেদিন কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস তাকে বিয়ের ইচ্ছাটা আবারও জানায়, সে তাকে প্রত্যাখ্যান করে। ‘আমি কারও সঙ্গেই বিয়ে করব না’, বলে ওকে, ‘তোমাকে তো নয়ই। কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে তুমি এতই ভালোবাসো যে ওকে বিয়ে করতে পারবে না বলেই তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাইছ।’

কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস ছিল ধৈর্যসম্পন্ন লোক। ‘আবার জোর করতে আসব আমি’ বলে, ‘আগে বা পরে, তোমাকে রাজি করাবই।’ বাড়িতে আসাটা চালিয়ে যায় সে। ঘরে আবদ্ধ হয়ে গোপনে অশ্রু রোধ করত আমারান্তা। উরসুলাকে বলা যুদ্ধের শেষ খবরগুলো বলতে থাকা পাণিপ্রার্থীর গলার স্বর না শোনার জন্য কানে আঙুল দিত; আর যদিও তাকে দেখার জন্য প্রাণ বেরিয়ে যেত, তবু বের না হওয়ার মতো শক্তি সঞ্চয় করতে পারত সে। সে সময়টাতে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া প্রতি দুই সপ্তাহে বিস্তারিত খবর পাঠাত মাকন্দে। কিন্তু একবার, চলে যাওয়ার প্রায় আট মাস পর সে উরসুলাকে লেখে। এক বিশেষ সংবাদবাহক নিয়ে যায় সিল করা এক খাম, যার মধ্যে কর্নেলের সুন্দর হাতের লেখা: বাবাকে অনেক যত্ন কোরো, কারণ সে শিগগিরই মারা যাবে। উরসুলা ভয় পায়, আউরেলিয়ানো যেহেতু বলেছে, সে অবশ্যই জানে। আর সে সাহায্য চায় হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়াকে শোবার ঘরে নিয়ে যেতে। শুধু যে সে সব সময়ের মতো ভারী ছিল তা-ই নয়, বরং সুদীর্ঘ সময় চেস্টনাটগাছের নিচে অবস্থানের সময় ইচ্ছাকৃতভাবে ওজন বাড়ানোর এমন ক্ষমতা অর্জন করে সে, যার ফলে সাতজন পুরুষ বহন করতে না পেরে তাকে টেনেহিঁচড়ে বিছানায় তোলে। রোদ আর বৃষ্টি আপ্লুত সেই প্রাচীন প্রমাণাকৃতির শরীর যখন শ্বাস নিতে শুরু করে, তখন শোবার ঘরের আর আশপাশের বাতাস ভরে যায় কোমল ব্যাঙের ছাতা, আর ফ্লোর দে পালোর (একধরনের বনফুল) প্রাচীন ও নিবিড় খোলা হাওয়ার সুবাসে। পরের সকালে সে আর বিছানায় জেগে ওঠে না। সব ঘরে খোঁজার পর উরসুলা আবার ওকে পায় চেস্টনাটের নিচে। তাকে বিছানায় বাঁধা হয়। শরীরে শক্তি অটুট থাকলেও হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার পক্ষে বাধা দেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। ওর জন্য সবই ছিল সমান। সে চেস্টনাটগাছের নিচে ফিরে গিয়েছিল নিজের ইচ্ছায় নয়, শরীরের অভ্যস্ততার কারণে। উরসুলা তাকে যত্ন করত, খাবার খেতে দিত, আর আউরেলিয়ানোর খবর দিত। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বহুদিন ধরে একমাত্র যার সঙ্গে সে যোগাযোগ করতে পারত, সে হচ্ছে প্রুদেনসিও আগিলার। মৃত্যুর গভীর জীর্ণতার কারণে প্রায় ধুলোয় পরিণত হওয়া প্রুদেনসিও আগিলার দিনে দুবার কথা বলতে যেত। লড়াকু মোরগের কথা বলত ওরা। স্থির করত চমৎকার সব মোরগের খামার প্রতিষ্ঠা করার। মৃত্যুর পর জেতার আর প্রয়োজন নেই বলে জেতার জন্য নয়, বরং একঘেয়ে মরণের রোববারগুলোতে বৈচিত্র্য আনতে। সে ছিল প্রুদেনসিও আগিলার, যে নাকি তাকে পরিষ্কার করত, খাবার দিত আর এক অপরিচিত আউরেলিয়ানো, যে নাকি যুদ্ধে কর্নেল ছিল, তার কথা বলত। যখন একা থাকত, তখন হোসে আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া নিজেকে সান্ত্বনা দিত অগুনতি কামরার স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখত, সে বিছানা থেকে উঠছে, দরজা খুলে একই রকম রট আয়রনের মাথার কাছে ঘেরওয়ালা বিছানা, একই রকম উইলো কাঠের চেয়ার, পেছনের দেয়ালে একই রকম কুমারী রেমেদিওসের ছবিওয়ালা একই রকমের কামরায় ঢুকেছে। সেই কামরা থেকে সে যেত আর এক কামরায় যেটা ছিল একেবারে একই রকমের, যার দরজা খুলে যেত একই রকম আরেকটিতে যাওয়ার জন্য, তারপরে সম্পূর্ণভাবে একই রকম আরেকটিতে যাওয়ার জন্য। ওর ভালো লাগত সমান্তরাল আয়নার গ্যালারির মতো এক কামরা থেকে আরেক কামরায় যেতে, যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রুদেনসিও আগিলার ওর কাঁধে টোকা দিত আর তখন সে ফিরে আসত কামরার পর কামরা ধরে, উল্টো দিকের পথ বেয়ে বেয়ে আর খুঁজে পেত প্রুদেনসিও আগিলারকে, ওর বাস্তবের কামরাটাকে। কিন্তু এক রাতে, বিছানায় নিয়ে যাওয়ার দুই সপ্তাহ পর, যখন প্রুদেনসিও আগিলার ওর কাঁধে টোকা দেয়, সে মাঝপথে এক কামরাকে বাস্তবের কামরা ভেবে সেখানেই চিরদিনের জন্য রয়ে যায়।

পরদিন সকালে উরসুলা নাশতা নিয়ে যাওয়ার সময় বারান্দা ধরে এক লোককে আসতে দেখে। ছোটখাটো, শক্ত-সামর্থ্য মানুষটার পরনে ছিল কালো কাপড়ের কোট আর বিষাদমাখা চোখ পর্যন্ত নেমে আসা বিশাল আকারের টুপিটাও ছিল কালো। ‘হায় খোদা’, উরসুলা ভাবে, ‘আমি দিব্যি করে বলতে পারি যে এ হচ্ছে মেলকিয়াদেস। সে ছিল কাতাউর; অনিদ্রা রোগের সময় বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ভিসিতাসিওনের ভাই, কখনোই যার কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ভিসিতাসিওন ওকে জিজ্ঞেস করে কেন ফিরে এসেছে আর সে নিজেদের ভাষায় গাম্ভীর্য নিয়ে উত্তর দেয়, ‘এসেছি রাজার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে।’ তখন হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার ঘরে ঢুকে সব শক্তি দিয়ে একসঙ্গে ধাক্কা দেয়, কানের কাছে সকলে চিৎকার করে, নাকের ফুটোর কাছে এক আয়না ধরে, কিন্তু ওকে আর জাগাতে পারে না। কিছুক্ষণ পর যখন ছুতোর কফিন বানাতে মাপ নিচ্ছে, সবাই তখন জানালা দিয়ে দেখতে পায় একরাশ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হলুদ ফুলের গুঁড়ি বৃষ্টি। রাতভর গোটা গ্রামের ওপর সেই নীরব ফুলের ঝড় বয়ে যায়, বাড়ির ছাদগুলো ঢেকে দেয়, দরজাগুলো আটকে দেয় আর খোলা বাতাসে ঘুমানো সব জীবজন্তুর দম বন্ধ হয়ে আসে। আকাশ থেকে এত ফুল ঝরে যে রাস্তাগুলো জেগে ওঠে এক নিবিড় হলুদ ফুলের গালিচা হয়ে, আর শবযাত্রার জন্য সেগুলোকে বেলচা আর আঁচড়া দিয়ে পরিষ্কার করতে হয় ওদের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *