নিঃসঙ্গতার একশ বছর – ৫

আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া আর রেমেদিওস মসকতের বিয়ে হয় মার্চের এক রোববারে, অতিথিদের বসার ঘরে ফাদার নিকোলাস রেইনার দ্বারা বানানো এক বেদির সামনে। মসকতের বাড়িতে ঘটনার আকস্মিকতার ধাক্কা চার সপ্তাহ ধরে ছিল চরম সীমায়, কারণ বিছানায় প্রশ্রাবের বাল্যাভ্যাস ত্যাগের আগেই তার যৌনলোম গজিয়ে যায়। যদিও ওর মা ওকে বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনের ব্যাপারে শিক্ষা দিয়েছিল তবু প্যান্টিতে মাখানো গাঢ় বাদামি চকলেট বর্ণের এক পড়তা তরল পদার্থ দেখিয়ে চিৎকার করে আউরেলিয়ানো এবং তার বোনদের আলাপচারিতায় বাধার সৃষ্টি করে। ঠিক করা হয় বিয়েটা হবে এক মাসের মাথায়। এই সময়টুকুতে শুধু ওকে শেখাতে পারা গিয়েছিল গোসল করা, নিজেই নিজের কাপড় পরা, আর বোঝাতে পারা গিয়েছিল গৃহস্থালির মৌলিক কিছু কাজ। বিছানা ভেজানোর অভ্যাস বর্জন করানোর জন্য তাকে প্রস্রাব করানো হয় গরম ইটের ওপর। বৈবাহিক জীবনের গোপনীয়তার অলঙ্ঘনীয়তার কথা তাকে বোঝাতে প্রচুর কষ্ট করতে হয় কারণ রেমেদিওস ব্যাপারটা খোলাসা করে বলায় এতই অভিভূত হয় আর একই সঙ্গে এতই আশ্চর্যান্বিত হয় যে সমস্ত পৃথিবীকে জানিয়ে দিতে চায় বিয়ের রাতের বিস্তারিত বিষয়গুলো। ভীষণ ক্লান্তিকর চেষ্টার ফলে দেখা গেল উৎসবের নির্দিষ্ট দিনে জাগতিক বিষয়াবলি সম্বন্ধে সে তার অন্য বোনদের মতোই ছিল পটু। ফুল আর পুষ্পমালা দিয়ে সাজানো রাস্তায় বাজির শব্দ আর বিভিন্ন বাদ্যদলের বাজানো গানের মধ্য দিয়ে দন আপলিনার যখন ওর বাহু ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন হাসি উপহার দিয়ে আর হাত নেড়ে ধন্যবাদ জানাচ্ছিল সে যারা ওকে জানালা থেকে শুভকামনা জানাচ্ছিল তাদেরকে। অল্প কয়েক বছর পর ফায়ারিং স্কোয়াডের সম্মুখের সেই একই ধাতব বন্ধনীসহ একই জুতো আর কালো কোট-প্যান্ট পরিহিত আউরেলিয়ানোকে যখন বাড়ির দোরে বরণ করে বেদির সম্মুখে নিয়ে যায়, তখন তার মুখ ছিল পাণ্ডুর আর গলায় অনুভব করছিল গিলতে না পারা একটা দলা। তখন রেমেদিওসের ব্যবহার এতই স্বাভাবিক ছিল, ছিল এত বিচক্ষণ যে কখনোই সে তার শান্ত ভাব হারায় না। এমনকি যখন আংটি পরানোর চেষ্টা করা হয় আউরেলিয়ানোকে, তখনো না। আপ্যায়িতদের গুঞ্জরন আর বিশৃঙ্খলার মাঝে সে তার লেসের দস্তানা পরা হাত উঁচু করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না তার প্রেমিক বুট দিয়ে পরে যাওয়া আংটিটাকে থামাতে পারে দরজা পর্যন্ত গড়িয়ে যাওয়ার আগেই আর বেদিতে ফিরে আসে লজ্জায় লাল হয়ে। উৎসবের সময় সে কোনো অশোভন কাজ করে বসে এই ভয়ে ওর মা আর বোনেরা এতই তটস্থ ছিল যে শেষ পর্যন্ত তারাই ওকে একটা চুমু খাওয়ার জন্য কোলে নেওয়ার মতো অশিষ্টতা দেখায়। প্রতিকূল অবস্থায় সে যে রকম দায়িত্বের, স্বাভাবিক মাধুর্য আর স্বচ্ছন্দ নিয়ন্ত্রণের পরিচয় দেবে, সেটা সেদিন থেকেই প্রকাশিত হয়। সে-ই নিজের উদ্যোগে বিয়ের কেকটার সবচেয়ে ভালো অংশ আলাদা করে রাখে আর একটা থালা ও একটা কাঁটাচামচ সঙ্গে নিয়ে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়াকে দেয়। চেস্টনাটগাছের গুঁড়ির সঙ্গে বাঁধা তাল-পাতার ছাউনির নিচে এক কাঠের টুলের ওপর উবু হয়ে বসে থাকা, রোদ আর বৃষ্টির ফলে বিবর্ণ এই অতিকায় বৃদ্ধ এক কৃতজ্ঞতার হাসি দেয় আর অবোধগম্য এক স্তব উচ্চারণ করতে করতে আঙুল দিয়ে ধরে খেয়ে নেয়। সোমবার সকাল পর্যন্ত চলতে থাকা সেই হট্টগোলে ভরা উৎসবে একমাত্র অসুখী ছিল রেবেকা বুয়েন্দিয়া। এটা ছিল ওর জন্য বিরক্তিকর উৎসব। উরসুলার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একই দিনে ওর বিয়েও উদ্‌যাপন করার কথা ছিল কিন্তু শুক্রবার মায়ের মরণাপন্নতার সংবাদসহ এক চিঠি পায় পিয়েত্র ক্রেসপি। সুতরাং তার বিয়ের দিন বদলানো হয়। চিঠি পাওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে পিয়েত্র ক্রেসপি প্রাদেশিক রাজধানীতে চলে যায় অন্যদিকে শনিবার দিন ঠিক সময়মতো তার মা একই সময় রাস্তায় বেরিয়ে পথে পিয়েত্রকে অতিক্রম করে। তার মা আউরেলিয়ানোর বিয়েতে এলে সে আরিজা ত্রিস্তে গানটা গায়, যেটাকে সে ছেলের বিয়েতে গাওয়ার জন্য তৈরি করেছিল। এদিকে পিয়েত ক্রেসপি সঠিক সময়ে বিয়েতে পৌছানোর চেষ্টায় রাস্তায় পাঁচ-পাঁচটি ক্লান্ত ঘোড়া বদলিয়েও রোববার মধ্যরাতে উৎসবের ছাই ঝাড়ু দিতে ফিরে আসে। চিঠিটার প্রেরকের ব্যাপারে সে কখনোই কোনো অনুসন্ধান করে নি। উরসুলার জেরায় ক্লিষ্ট আমারান্তা তখনো ছুতোরদের দ্বারা সম্পূর্ণরূপে অবিচ্ছিন্ন বেদিটার সামনে তার নির্দেশিত শপথ করে। বিয়ে পড়ানোর জন্য জলাভূমি থেকে দন আপলিনার নিয়ে এসেছিল ফাদার নিকানোর রেইনাকে, যে ছিল তার নিজের যাজক গোষ্ঠীর প্রতি অকৃতজ্ঞতায় মন কঠিন হওয়া এক বৃদ্ধ। গায়ের চামড়া ছিল কোঁচকানো আর দেহটা ছিল শুধুই হাড়বিশিষ্ট, পেটটা ছিল লক্ষণীয় আর গোলাকার, আর চেহারায় ছিল এক বৃদ্ধ দেবদূতের অভিব্যক্তি যেটা যতটা না ছিল ভালোমানুষির জন্য তার চেয়েও বেশি ছিল সরলতার জন্য। বিবাহোৎসবের পর নিজের গির্জায় ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল তার কিন্তু মাকন্দবাসীদের বিধর্মিতা দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে সে, কারণ ছেলেমেয়েদের ব্যাপটাইজ না করিয়ে, উৎসবগুলোকে ধর্মীয়ভাবে না উদ্‌যাপন করে এরা সাধারণ আদি প্রাকৃতিক নীতিতে চলে আর বিভিন্ন কুকাজের মধ্য দিয়েও উন্নতি করে চলছে এরা। এখানকার চেয়ে পৃথিবীর আর কোনো জায়গাতেই ঈশ্বরের বীজমন্ত্রের এত প্রয়োজন নেই বুঝতে পেরে খতনাধারী আর পৌত্তলিকদের খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা দেওয়ানোর, বিয়ে না করে সহাবস্থানকারীদের বিয়ের মন্ত্র পড়িয়ে বৈধ করার আর মুমূর্ষুদের সাক্রামেন্ট (খ্রিষ্টধর্মীয় বাঁধনে বাঁধা) করার জন্য আরও এক সপ্তাহ থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু কারোরই মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় না সে। মাকন্দবাসী তাকে বলে যে তারা পাদরিবিহীন বাস করে চলছে অনেক দিন ধরে। আত্মার ব্যাপারগুলো তারা সরাসরি ঈশ্বরের সঙ্গে ঠিকঠাক করে। যার ফলে নশ্বর পাপের খারাপ ব্যাপারটা কেটে গেছে তাদের। মরুভূমিতে ধর্মোপদেশ দিয়ে দিয়ে ক্লান্ত হয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হয় এক গির্জা তৈরি করার যেটা হবে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড়, থাকবে প্রমাণ আকারের সেইন্টদের মূর্তি, দেয়াল হবে রংবেরঙের কাচ দিয়ে তৈরি, যাতে রোম থেকেও লোক আসবে এই নাস্তিকতার মাঝখানে ঈশ্বরকে সম্মান জানাতে। তামার এক বাসন নিয়ে সব জায়গায় দাক্ষিণ্য চেয়ে বেড়ায়। ওকে অনেক দেওয়া হতো কিন্তু সে চাইত আরও বেশি কারণ গির্জাটার ঘণ্টাটা এমন হতে হবে যে ঘণ্টার গর্জন ডুবন্তদেরও ভাসিয়ে তুলবে। এতই অনুনয় করত যে এতে তার গলা ভেঙে যায়, আর হাড়গোড় ভরে ওঠে শব্দে। এক শনিবার, তখনো এমনকি দরজাগুলোর খরচের টাকাও একত্র করতে পারেন নি, প্রচণ্ডভাবে হতাশ হয়ে পড়ে। প্লাজায় বেদি তৈরি করে হাতে অনিদ্রার সময়ের মতো এক ঘণ্টি নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়িয়ে উন্মুক্ত উপাসনা উৎসবের ঘোষণা করে। কৌতূহলবশত অনেকেই যোগ দেয়, অন্যরা যোগ দেয় স্মৃতিকাতরতায়, আর অন্যরা যোগ দেয় ঈশ্বর যেন তাঁর এই মধ্যস্থতার অবজ্ঞা নিজস্ব অপমান হিসেবে না নেন। এভাবেই সকাল আটটার সময় অর্ধেক গ্রাম গিয়ে জমায়েত হয় প্লাজায়, যেখানে ফাদার নিকানোর রেইনা ধর্মীয় সংগীত গায় তার অনুনয়ের কারণে ভাঙা গলায়। উপাসনা শেষে যোগদানকারীদের দলটা যখন বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছে, তখন সে হাত তোলে, সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে। ‘এক মিনিট’, বলেন, ‘এবার আমরা দেখব ঈশ্বরের বিতর্কাতীত অসীম ক্ষমতার প্রমাণ।’

যে ছেলেটা তাকে এই উপাসনা উৎসবে সাহায্য করে সে এক কাপ ঘন ধূমায়িত কফি এগিয়ে দেয় আর ফাদার এক নিশ্বাসে তা পান করে। পরে আস্তিন থেকে একটি রুমাল বের করে ঠোঁটগুলো মুছে হাত ছাড়িয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে। এ সময়ই মাটি থেকে বারো সেন্টিমিটার ওপরে উঠে যায় সে। এটা ছিল বিশ্বাস জন্মানোর এক ভালো পন্থা। এভাবেই পরের দিকে অনেক দিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে চকলেট দিয়ে বানানো উত্তেজকের মাধ্যমে শূন্যে উঠে ঈশ্বরের ক্ষমতার প্রমাণ দেখাত সে আর তার বেদিতে সাহায্যকারী বালক তখন এক থলিতে টাকা তুলত। এভাবেই এক মাসের কম সময়ের মধ্যে আরম্ভ করে দেওয়া হলো গির্জা বানানোর কাজ। এক সকালে যখন আর একবার সেই শূন্যে উত্তোলনের প্রদর্শনী দেখতে একদল লোক চেস্টনাটের নিচে জমায়েত হয়, তখন একমাত্র হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ছাড়া কেউই তার এই স্বর্গীয় প্রদর্শনীর উৎসের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করে না। একটু সোজা হয়ে বসে কাঁধটাকে নিচু করে যখন ফাদার নিকানোর রেইনা যে চেয়ারটায় বসেছিল সেটা শুদ্ধ মাটির ওপরে উঠে যেতে শুরু করে, তখন হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বলে, ‘হক এস্ত সিমপ্রিসিসিমাস। হোমো ইস্তে স্ট্যাটাম কোয়ারটাম ম্যাটারিয়ে ইনভেনিট। (এটা তো খুবই সহজ ব্যাপার। মানুষই আবিষ্কার করেছে এই জিনিসটা) ফাদার নিকানোর হাত দুটো উঁচু করে আর চেয়ারটার চারটে পা একই সঙ্গে মাটিতে স্থান নেয়। ‘নেগ’, বলে, ‘ফ্যাকটুম হক একজিস্টেনসিয়াম দেই প্রোব্যাত সিনে দুবিও।’ ( না-বলে, এটাই হচ্ছে ঈশ্বরের অস্তিত্বের সন্দেহাতীত প্রমাণ) এভাবেই সে বুঝতে পারে যে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার শয়তানে ভর করা দুর্বোধ্য বুলিটা হচ্ছে লাতিন। আর সেই একমাত্র লোক যে লাতিনে তার সঙ্গে যোগাযোগে সক্ষম। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে ফাদার নিকোনার তার শৃঙ্খলাহীন মস্তিষ্কে ঈশ্বরের বিশ্বাস রোপণের চেষ্টা করে। প্রতি বিকেলে চেস্টনাটের গুঁড়ির পাশে বসে লাতিনে তাকে ধর্মোপদেশ দিত কিন্তু হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া একগুঁয়েমির সঙ্গে এই বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথার মারপ্যাচ, এমনকি চকলেটের রূপান্তরকেও গ্রহণযোগ্য মনে করে না আর দাবি করে যে একমাত্র দাগেরোটাইপই হচ্ছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের একমাত্র উপায়। সুতরাং ফাদার নিকানোর তার কাছে নিয়ে যায় মেডেল, বিভিন্ন ধর্মীয় ছবি, এমনকি ভেরনিকার ছবি আঁকা কাপড়ের এক প্রতিরূপ কিন্তু হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া এগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে কারণ এগুলো হচ্ছে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিহীন হস্তশিল্প। সে ছিল এতই একগুঁয়ে যে শেষ পর্যন্ত ফাদার নিকোনার তার খ্রিষ্টধর্মী প্রচেষ্টায় ক্ষান্ত দিয়ে তার সঙ্গে দেখা করা চালাতে থাকে মানবতার খাতিরে

অতএব হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া উদ্যোগ নেয় যুক্তি দিয়ে ফাদারের ঈশ্বর বিশ্বাস ভেঙে দিতে। মাঝে মাঝে ফাদার নিকোনার চেস্টনাটের কাছে নিয়ে যেত পাশা খেলার বোর্ড আর এক ঘুঁটি তাকে খেলায় আমন্ত্রণ জানাত কিন্তু আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া খেলতে অস্বীকার করে। কারণ হিসাবে জানায় যে খেলাগুলোর নিয়মকানুনে প্রতিদ্বন্দ্বীরা আগে থেকেই একমত, সেই খেলাগুলোর উদ্দেশ্য সে কখনোই বুঝতে পারে নি। ফাদার নিকোনার কখনোই পাশা খেলাকে এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে নি আর এতে সে কখনোই আর খেলাটা খেলে নি। প্রতিবারই আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার প্রাঞ্জলতায় আরও বেশি বিস্মিত হয়ে একদিন তাকে জিজ্ঞেস করে যে এটা কী করে সম্ভব যে সে একটা গাছের সঙ্গে বাঁধা। ‘হক এস্ত সিমপ্লিসিজম’ সে উত্তর দেয়, ‘কারণ আমি পাগল।’

সেই সময় থেকে নিজের ঈশ্বর বিশ্বাসের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে আর কখনোই তার সঙ্গে দেখা করতে না গিয়ে সম্পূর্ণরূপে গির্জা তৈরিতে আত্মনিয়োগ করে ফাদার, যাতে সেটা দ্রুত শেষ হয়। রেবেকা নতুন করে আশার আলো দেখতে পায়। এক রোববার যেদিন ফাদার নিকানোর বাড়িতে একই টেবিলে বসা বাড়ির অন্য সবার সঙ্গে সকালের নাশতা সারছিল, আর গির্জা তৈরি শেষ হওয়ার পর ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো কী রকম ধর্মীয় আড়ম্বর ও জৌলুশপূর্ণ হবে এই নিয়ে আলাপ করছিল, সেদিন থেকেই রেবেকার ভবিষ্যৎ ছিল গির্জা তৈরি শেষের সঙ্গে শর্তাধীন। ‘সবচেয়ে ভাগ্যবতী হবে রেবেকা’, বলে আমারাত্তা। আর যেহেতু রেবেকা বুঝতে পারে নি তার কথার গূঢ় অর্থ, সেহেতু এক সরল হাসি দিয়ে ব্যাখ্যা করে, ‘বিয়ের মধ্য দিয়ে গির্জাটাকে উদ্বোধন করতে হবে তোকে’, রেবেকা মন্তব্য শোনার আগেই বলতে চেষ্টা করে। ‘যে গতিতে গির্জা নির্মাণকাজ এগোচ্ছে, তাতে দশ বছরের আগে ওটা শেষ হবে না।’ ফাদার নিকানোর একমত হয় না; ক্রমবর্ধমান বিশ্বাসীদের বদান্যতার ফলে সময়ের হিসাবটা আরও আশাব্যঞ্জক বলে মনে হয় তার। অপমানিত রেবেকা কিছু না বললেও নাশতা শেষ করতে পারে না। ফলে উরসুলা আমারাস্তার প্রস্তাবটার সঙ্গে একমত হয়ে গির্জাটা তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করে। ফাদার নিকানোরের হিসাব অনুযায়ী এ রকম আরও একটা সাহায্য অন্য জায়গা থেকে পেলে গির্জার কাজ তিন বছরের মধ্যেই শেষ হবে। আমারান্তা যে সরলতার ভাব দেখিয়ে প্রস্তাবটা করেছে, আসলে তা ছিল না বুঝতে পারার কারণে। ওই সময় থেকে রেবেকা আর আমারান্তার সঙ্গে কথা বলে না। ‘এটাই হচ্ছে সবচেয়ে কম খারাপ তোর জন্য’, সেই বিদ্বেষপূর্ণ তর্কের রাতে আমারাস্তা বলে, ‘এতে পরবর্তী তিন বছর তোকে খুন করতে হবে না।’ রেবেকা গ্রহণ করে তার এই চ্যালেঞ্জ। পিয়েত্র ক্রেসপি বিয়ের সময় পেছানোর নতুন এই খবরে হতাশায় ভোগে, কিন্তু রেবেকা তাকে বিশ্বস্ততার স্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে বলে, ‘যখনই তুমি বলবে আমরা পালিয়ে যাব।’ পিয়েত্র ক্রেসপি দুঃসাহসিক কাজে পা দেওয়ার লোক ছিল না। দয়িতার আবেগপ্রবণ স্বভাবের বিরোধিতা করে সে তার কথা রক্ষার ব্যাপারটাকে এমন এক সম্পদ বলে বিবেচনা করে যেটাকে অপচয় করা যায় না। সুতরাং রেবেকা আরও দুঃসাহসী উপায়ের আশ্রয় নেয়। যখন রহস্যময় এক বাতাস বৈঠকখানার বাতি নিভিয়ে দিত, উরসুলা চমকে যেত প্রেমিক-প্রেমিকাদের অন্ধকারে চুমু খেতে দেখে। পিয়েত্র ক্রেসপি আধুনিক বাতিগুলোর নিম্নমান সম্বন্ধে এক অপরিণামদর্শী ব্যাখ্যা দিত, এমনকি বৈঠকখানায় উচ্চমানের আলোর ব্যবস্থার সাহায্যের প্রস্তাব করে সে। কিন্তু আবার জ্বালানির সংকট ঘটত বা সলতে আটকে যেত আর উরসুলা রেবেকাকে পেত প্রেমিকের কোলে বসা অবস্থায়, ফলে উরসুলা আর কোনো কৈফিয়তই গ্রহণ করত না। রুটি বানানোর কারখানার ভার আদিবাসীর হাতে ন্যস্ত করে দোলচেয়ারে বসে প্রেমিক জুটির ওপর নজর রাখত, আর তার কম বয়সেই সেকেলে হয়ে যাওয়া সব কায়দার কাছে যেন এই জুটির অভিনব পন্থা যাতে হার না মানে তা নিশ্চিত করত। ‘বেচারি মা’, একঘেয়ে সাক্ষাতে হাই তুলতে দেখে ব্যঙ্গ করে বলে রেবেকা, ‘মৃত্যুর পরও রেহাই পাবে না এই দোলচেয়ারে বসার শাস্তি থেকে।’ তিন মাস নজর রাখা প্রেমে আর গির্জার নির্মাণকাজের ধীরগতিতে বিরক্ত হয়ে পিয়েত্র ক্রেসপি গির্জার কাজ শেষ করার জন্য প্রয়োজনীয় বাকি টাকাটা ফাদার নিকানোরকে দিয়ে দেয়। এতে অধৈর্য হয় না আমারান্তা। প্রতিদিন এমব্রয়ডারি করার সময় বান্ধবীদের সঙ্গে গল্প করতে করতে অথবা বারান্দায় সেলাই করতে করতে নতুন নতুন ফন্দি বের করতে চেষ্টা চালিয়ে যায়। সেটা ছিল গির্জা শেষ হওয়ার দুই মাসেরও কম সময় বাকি থাকতে। শোবার ঘরের আলমারিতে বিয়ের পোশাকের সঙ্গে রেবেকার ন্যাপথলিনগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু রেবেকা বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসায় এতই অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে যে আমারান্তার ভেবে রাখা সময়ের আগেই বিয়ের পোশাকটার সব আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি শেষ করার। আলমারি খুলে প্রথমে কাগজগুলো সরিয়ে লিলেনের আবরণ খোলার পর পেল পোশাকের হেম, নেকাবের সেলাই এমনকি আসার (AZAR); ফুলের মুকুটটা পর্যন্ত মথে কেটে ধুলোয় পরিবর্তিত হয়েছে। যদিও রেবেকা নিশ্চিত ছিল যে পোশাকটা মুড়ে রাখার সময় সে দুই মুঠো ন্যাপথলিন ঢুকিয়েছিল তবু ঘটনাটা স্বাভাবিক দুর্ঘটনা বলে চিহ্নিত হবে মনে করে সে আমারান্তাকে দোষী করার সাহস পায় না। বিয়ের মাত্র এক মাস বাকি ছিল তখন। আমপারো মসকতে এক সপ্তাহের মধ্যে এক নতুন বিয়ের পোশাক সেলাইয়ের অঙ্গীকার করে। এক বৃষ্টিঝরা দুপুরে যখন শেষবারের মতো রেবেকার গায়ে লাগে কি না তা দেখার জন্য, একঝলক গুঁড়ি বৃষ্টিতে আবৃত আমপারো ঘরে ঢোকে, তখন আমারান্তার মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম হয়। বারোধ হয়ে আসে তার আর ঠান্ডা এক ঘামের সুতো নামে মেরুদণ্ড বেয়ে। দীর্ঘ অনেক মাস ধরে সে এই সময়টার অপেক্ষায় কাটিয়েছে ভয় আর উৎকণ্ঠার কাঁপুনি নিয়ে, কারণ রেবেকার বিয়েতে যদি চূড়ান্ত বাধার সৃষ্টি না করতে পারে, তবে শেষ সময়ে যখন তার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, তখন বিষ পান করানোর জন্য তার যে সাহসের অভাব হবে না, এ ব্যাপারে সে ছিল নিশ্চিত।

সেই বিকেলে, আমপারো হাজার আলপিন দিয়ে অসীম ধৈর্যসহকারে শরীরের চারপাশে সার্টিনের বর্ম তৈরি করায় রেবেকা যখন গরমে হাঁসফাঁস করছে, আমারান্তা তখন উলের বুননিতে কয়েকবার ভুল করে ফেলে। আঙুলে সুচ ফোটায় কয়েকবার কিন্তু ভীতিকর শীতলতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয় যে দিনটা হবে বিয়ের পূর্বের শেষ শুক্রবার আর, প্রয়োগ করা হবে কফির সঙ্গে কয়েক ফোঁটা আফিমের আরক। যেমন অনতিক্রমণীয়, তেমনি এক বিরাট বাধা বিয়ের দিনটাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে দিতে বাধ্য করে। নির্দিষ্ট করা বিয়ের দিনের ঠিক এক সপ্তাহ আগে ছোট্ট রেমেদিওস মাঝরাতে জেগে ওঠে তার অন্ত্রের মধ্যে মর্মান্তিক উদ্‌গিরণের মধ্য দিয়ে, বিস্ফোরিত এক গরম স্যুপের মধ্যে ভিজে জবজবে অবস্থায়, আর মারা যায় তিন দিন পর নিজের পরিবার প্রয়োগকৃত বিষ পান করে, সঙ্গে মারা যায় তার পেটের মধ্যে আড়াআড়ি অবস্থায় থাকা এক জোড়া যমজ শিশু। আমারান্তা বিবেক দংশনে ভোগে। ঈশ্বরের কাছে সে প্রার্থনা করেছিল যেন এমন ভয়ংকর কিছু ঘটে, যাতে রেবেকাকে বিষ খাওয়াতে না হয় আর ফলে সে রেমেদিওসের মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করে। রেমেদিওস বাড়িতে নিয়ে এসেছিল এক পরম আনন্দের দমকা হাওয়া। সে ঠাঁই নিয়েছিল কর্মশালার কাছেই এক শোবার ঘরে, যেটাকে সাজিয়েছিল তার সদ্য পার হওয়া শৈশবের খেলনা আর পুতুল দিয়ে, আর তার প্রাণবন্ত আনন্দময় শোবার ঘরের চার দেয়াল পেরিয়ে উপচে পড়ত বেগোনিয়াঘেরা বারান্দায় এক স্বাস্থ্যময় দমকা হাওয়ার মতো। ভোরবেলা থেকে আরম্ভ করত গান গাইতে। একমাত্র সে-ই সাহস করেছিল রেবেকা আর আমারান্তার বিরোধে মধ্যস্থতা করতে। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার দেখাশোনা করবার মতো ধকলপূর্ণ কাজও নিজের কাঁধে নেয় সে। তাকে খাবার দিত, নিত্যনৈমিত্তিক কাজগুলোতে সাহায্য করত, তার পা ধুয়ে দিত সাবান আর ছোবা দিয়ে। তার চুল, দাড়ি, উকুন ও উকুনের ডিমমুক্ত রাখত। তালপাতার ছাউনিটাকে সব সময় ঠিক করে রাখত আর ঝড়ের সময় সেটাকে আরও মজবুত করতে ছাউনির ওপর চাপিয়ে দিত পানিনিরোধক ক্যানভাস। জীবনের শেষের কয় মাস লাতিন ভাষার প্রাথমিক বুলি দিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারত রেমেদিওস। যখন আউরেলিয়ানো আর পিলার তেরনেরার ছেলে জন্ম নেয়, আর বাড়িতে নিয়ে এসে তার নাম আউরেলিয়ানো হোসে রেখে এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে ব্যাপটাইজ করা হয়, তখন রেমেদিওস সিদ্ধান্ত নেয় বাচ্চাটাকে তার প্রথম ছেলে হিসেবে পরিচয় দেওয়ার। তার মাতৃপ্রবৃত্তি অবাক করে দেয় উরসুলাকে। অন্যদিকে আউরেলিয়ানো বেঁচে থাকার সংগত কারণ খুঁজে পায় ওর ভেতর। প্রতিদিনই কর্মশালায় কাজ করত সে, আর মধ্য সকালে চিনি ছাড়া এক কাপ কফি নিয়ে দিত রেমেদিওস তাকে। দুজনে প্রতি রাতে বেড়াতে যেত মসকতেদের বাড়ি। যখন আউরেলিয়ানো অন্তহীন দোমিনো খেলত তার শ্বশুরের সঙ্গে, তখন রেমেদিওস বোনদের সঙ্গে গল্প করত অথবা মায়ের সঙ্গে বয়স্কদের ব্যাপারগুলো নিয়ে আলোচনা করত। গ্রামটাতে বুয়েন্দিয়ার কর্তৃত্ব আরও পোক্ত হয় দন আপলিনার মসকতের কর্তৃত্বের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। দন আপলিনার মসকতে প্রাদেশিক রাজধানীতে বারবার যাতায়াত করে সরকারকে রাজি করাতে সক্ষম একটা স্কুল বানাতে যেখানে ভর্তি হয় আর্কাদিও, যে তার উত্তরাধিকার সূত্রে দাদার কাছ থেকে পেয়েছে শিক্ষার উদ্দীপনা। অটল প্রত্যয় দিয়ে জাতীয় স্বাধীনতা দিবস আসার আগেই বেশির ভাগ বাড়ি নীল রং করাতে সক্ষম হয় দন আপলিনার মসকতে। ফাদার নিকানোরের ক্রমাগত অনুরোধে কাতরিনার দোকানটাকে সরানো হলো দূরের এক রাস্তায়, বন্ধ করা হলো গ্রামের কেন্দ্রের বিভিন্ন লজ্জাজনক জায়গাগুলো, যেগুলো প্রতিদিনই প্রচুর উন্নতি করে যাচ্ছিল। একবার সে ফিরে আসে অস্ত্রধারী পুলিশ সঙ্গে করে আর তাদের দেওয়া হয় শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব। কারোরই মনে থাকে না গ্রামে অস্ত্রধারী লোক না রাখার আদি চুক্তিটার কথা। শ্বশুরের দক্ষতা আনন্দিত করত আউরেলিয়ানোকে। ‘তুইও ওর মতোই মোটা হয়ে যাবি’, বলত তার বন্ধুরা। কিন্তু প্রচুর সময় বসে কাটানোর ফলে উঁচু হওয়া তার চোখের দীপ্তিকে কেন্দ্রীভূত করলেও, ওজন বাড়ে না তার বা চরিত্রের শান্ত ভাব হারায় না সে, বরং তার ঠোঁটের ওপর নির্জন মগ্নতার ও দৃঢ় সংকল্পের রেখাটাকে স্থায়ী করে তোলে। সে আর তার স্ত্রী দুই পরিবার থেকেই এত গভীর মমতা অর্জন করেছিল যে যখন রেমেদিওস তার আশু সন্তান আগমনের সংবাদ দেয় তখন, এমনকি রেবেকা আর আমারাস্তাও ঝগড়া বাদ দিয়ে চুক্তি করে, ছেলে হলে নীল উলের আর মেয়ে হলে গোলাপি উলের পোশাক বোনার। অল্প কয়েক বছর পর আর্কাদিও ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে সবার শেষে চিন্তা করে রেমেদিওসের কথা।

অতি আবশ্যিক কারণগুলো ছাড়া দরজা-জানালা বন্ধ রেখে সবার আগমন বা নির্গমন বন্ধ করে এক শোক পর্বের আয়োজন করে উরসুলা; এক বছর উচ্চ স্বরে কথাবার্তা নিষিদ্ধ করা হয়, আর যেখানে মৃতদেহের নিশি শোকের ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেখানে এক কালো লেস বাঁধা রেমেদিওসের দাগেরোটাইপ স্থাপন করা হয় এক অনির্বাণ তেলের বাতির সঙ্গে। ভবিষ্যৎ বংশধরেরা, যারা কখনোই সেই বাতিটাকে নিভতে দেয় নি, তাদের হতবুদ্ধি করে দেবে কুঁচি দেওয়া স্কার্ট, সাদা জুতো আর অর্গান্ডির লেস বাঁধা মেয়েটার প্রতিচ্ছবি, যেটাকে গত্বাঁধা পরদাদির অবয়বের সঙ্গে কিছুতেই মেলাতে পারবে না তারা। আমারান্তা আউরেলিয়ানো হোসের যত্নের ভার নেয়। ছেলে হিসেবে গ্রহণ করে তাকে, যে নাকি তার একাকিত্বের অংশীদার হয়ে উপশম করবে তার ঠিক জায়গামতো না লাগা প্রার্থনা, আর অনিচ্ছাকৃত আফিমের আরক কফিতে মিশে যাওয়ার ভার। সন্ধ্যাবেলা পা টিপে, টুপিতে কালো লেস লাগিয়ে ঘরে ঢুকত পিয়েত্র ক্রেসপি রেবেকাকে দেখে যেতে, আর মনে হতো হাতের মুঠি পর্যন্ত কালো পোশাকের মধ্যে রেবেকার রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ওই সময়ে, বিয়ের নতুন একটা দিনের চিন্তা এতই শ্রদ্ধাহীন হতো যে ওদের প্রেম পরিণত হলো এক চিরন্তন সম্পর্কে, এক ক্লান্তিকর তত্ত্বাবধানহীন প্রণয়ে। অন্যদিনে যে প্রেমিকেরা চুমু খাওয়ার জন্য বাতি নষ্ট করে ফেলত তাদের প্রেমকে যেন মৃত্যুর ইচ্ছার হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। লক্ষ্যহীন সম্পূর্ণরূপে হতোদ্যম রেবেকা আবার মাটি খেতে আরম্ভ করে।

যখন শোকপর্বটা দীর্ঘায়িত হতে হতে এমন অসহ্য পর্যায়ে আসে যে উলের কাটার বুননির পর্বটা আবার আরম্ভ হয়। তখন নিঃশব্দ দুপুর দুটোর প্রাণান্তকর গরমের মধ্যে কেউ একজন এমনভাবে রাস্তার দিকের দরজাটা ধাক্কা দেয় যে দরজার সঙ্গে লাগানো সিমেন্টের পিলারগুলো কেঁপে ওঠে প্রচণ্ড শক্তির প্রবলতায়, আর গোল-চেয়ারে আঙুল চোষণরত রেবেকা, রান্নাঘরে উরসুলা, কর্মশালায় আউরেলিয়ানো, এমনকি নিঃসঙ্গ চেস্টনাটের নিচে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ারও মনে হয় যেন এক ভূমিকম্প বাড়িটাকে ছিন্নভিন্ন করছে। বিশাল শরীরের এক লোক ভেতরে ঢোকে। তার চতুর্ভুজ পিঠটা কোনো রকমে দরজার মধ্যে এঁটে যায়। তার বাইসনের মতো গলা থেকে ঝুলছিল ভার্জিন রেমেদিওসের মেডাল, বাহুগুলো আর বুক ছিল সম্পূর্ণভাবে রহস্যময় সব উল্কি দিয়ে ঢাকা। আর ডান কবজিতে শক্ত করে লাগানো তামার বালাতে খোদাই করে করা নিনঞস-এন-ক্রস (ক্রসের ভেতর শিশু) ওর গায়ের চামড়া ছিল উন্মুক্ত, লবণাক্ত বাতাসের কারণে তামাটে চুল খাটো করে খচ্চরের কেশরের মতো করে ছাঁটা, চোয়াল দুটো লোহার মতো শক্ত আর এক করুণ চাহনি। ঘোড়ার জিনের দ্বিগুণ চওড়া কোমরবন্ধনী, হাঁটু পর্যন্ত লম্বা মোজাসহ ঘোড়া দাবড়ানোর কাঁটাওয়ালা ও লোহা দিয়ে আবৃত বুটসহ লোকটার উপস্থিতি চারপাশে এক ভূকম্পনের মতো অবস্থার সৃষ্টি করে। বৈঠকখানা পার হয়ে ভেতরে বসার ঘর পার হয়ে, প্রায় ছিন্ন কিছু চামড়ার থলে (SADLLE BAG) হাতে নিয়ে বজ্রের মতো আবির্ভূত হয় সে বেগোনিয়ার বাগানে, যেখানে আমারান্তা আর তার বান্ধবীরা বাতাসে সুচ তুলে ধরে চলৎ-শক্তিহীন হয়ে পড়ে। ‘শুভ দুপুর’ বলে ক্লান্ত স্বরে, আর থলেগুলো কাজের টেবিলের ওপর ফেলে বাড়ির পেছন দিকে পা বাড়ায়। ‘শুভ দুপুর’ চমকে ওঠা রেবেকাকে বলে, যখন রেবেকা তার শোবার ঘরের দরজার সামনেটা পার হতে দেখছিল তাকে। ‘শুভ দুপুর’ বলে পঞ্চম ইন্দ্রিয় কেন্দ্রীভূত করে সতর্ক অবস্থায় রৌপ্যকর্মের টেবিলে বসা আউরেলিয়ানোকে। কারও সঙ্গেই সময় কাটানোর জন্য দাঁড়ায় না সে। সরাসরি গিয়ে উপস্থিত হয় রান্নাঘরে আর সেখানেই প্রথমবারের জন্য থামে এক সফর শেষে, যে সফর শুরু করেছিল পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে। ‘শুভ দুপুর’, বলে। উরসুলা এক সেকেন্ডের জন্য মুখ হাঁ করে থ হয়ে থাকে। চোখগুলোকে দেখে, চিৎকার করে লাফিয়ে উঠে তার গলা জড়িয়ে ধরে আর চিৎকার করতে থাকে আনন্দমণ্ডিত কান্নায়। সে ছিল হোসে আর্কাদিও, যে নিঃস্ব অবস্থায় চলে গিয়েছিল, ওভাবেই খালি হাতে ফিরে এসেছে। এতটাই নিঃস্ব সে যে তার ঘোড়া ভাড়া বাবদ দুই পেসো দিতে হলো উরসুলাকে। এসপানঞলের (স্প্যানিশ) সঙ্গে নাবিকদের খিস্তি মিশিয়ে কথা বলছিল সে। কোথায় ছিল জিজ্ঞেস করা হলে উত্তর দিল, ‘এখানে-ওখানে’। যে ঘরটা ওকে বরাদ্দ করা হলো, সেখানে দোলবিছানা ঝুলিয়ে ঘুমিয়ে নিল তিন দিন। যখন জেগে উঠল ষোলোটা কাঁচা ডিম পান করে সোজা কাতরিনার দোকানের দিকে রওনা দিল যেখানে ওর প্রমাণ সাইজের শরীর, মেয়েদের মাঝে আতঙ্কভরা কৌতূহলের সৃষ্টি করে। ওর খরচে সবার জন্য পান আর আখের রসের মদ দিতে বলে। একই সঙ্গে পাঁচজনের সঙ্গে পাঞ্জার বাজির প্রস্তাব করে সে। ‘এটা অসম্ভব’, ওর বাহু নাড়াতে পারবে না এটা নিশ্চিত হয়ে ওরা বলে, ‘ওর কাছে নিনঞস-এন-ক্রস (বাচ্চাদের চোখ লাগা এড়ানোর জন্য ব্যবহৃত শিশু যিশু) আছে।’ মনে মনে কাতরিনা দৈবশক্তিতে বিশ্বাস না করে ভারী কাউন্টারটাকে নাড়াতে পারবে না, বারো পেসো বাজি ধরে। হোসে আর্কাদিও সেটাকে জায়গা থেকে সরিয়ে মাথার ওপর তুলে পরে নামিয়ে রাখে রাস্তার ওপর। এগারোজন লোকের প্রয়োজন হয় সেটাকে ভেতরে ঢোকাতে। নীল আর লাল অক্ষরে জট লাগানো বিভিন্ন ভাষার উলকিতে সারা শরীর ঢাকা হোসে আর্কাদিও প্রতিপক্ষের ওপর অবিশ্বাস্য পুরুষত্ব দেখানোয় এক উৎসবেরও আমেজ তৈরি হয়। লোলুপতা নিয়ে ঘিরে থাকা মেয়েদের জিজ্ঞেস করে, কে ওকে বেশি দাম দেবে। যার সবচেয়ে বেশি ছিল, সে ‘বিশ পেসো’ বলে সুতরাং সে লটারির প্রস্তাব জনপ্রতি দশ পেসো করে। দামটা ছিল অচিন্তনীয় কারণ সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত মেয়েটির আয় ছিল এক রাত্রের জন্য আট পেসো। তবু ওরা প্রস্তাবে একমত হয়ে ওদের নাম লেখে চৌদ্দ টুকরো কাগজে আর ঢোকায় এক টুপিতে প্রতিজনে একটা কাগজ তোলার জন্য। যখন মাত্র দুটো কাগজ বাকি থাকে, তখন সবাই বুঝতে পারে ও দুটোর মালিক কারা। ‘প্রতিজনে আরও পাঁচ পেসো করে দাও’, প্রস্তাব করে হোসে আর্কাদিও আর আমাকে ভাগ করে দেব তোমাদের দুজনের মধ্যে।

এটাই ছিল তার জীবিকা। নাম-পরিচয়হীন নাবিকদের দলে নাম লিখিয়ে পঁয়ষট্টিবার পাক খেয়েছে পৃথিবীটাকে। কাতরিনার দোকানে সেই রাতে ওর সঙ্গে বিছানায় যাওয়া মেয়ে দুটো ওকে ন্যাংটো অবস্থায় নাচঘরে নিয়ে যায় এটা দেখানোর জন্য যে ওর শরীরের এক মিলিমিটার জায়গাও খালি নেই। সর্বত্রই উল্কি আঁকা আছে: বুকে, পিঠে আর গলা থেকে আরম্ভ করে পায়ের আঙুলের ডগা পর্যন্ত। পরিবারের সঙ্গে মিশতে পারে না সে। সারা দিন ঘুমোত আর রাত কাটাত নিষিদ্ধ এলাকাগুলোতে নিজের শক্তির ভাগ্য পরীক্ষা করে। মাঝে মাঝে উরসুলা যখন ওকে টেবিলে বসাতে সমর্থ হতো, তখন সে খুব দরদের পরিচয় দিত, বিশেষ করে দূর দেশগুলোতে তার অভিযানের বর্ণনার সময়। জাপান সাগরের জাহাজডুবিতে দুই সপ্তাহ সাগরে বেঁচে ছিল প্রচণ্ড সূর্যালোকে দগ্ধ হয়ে মৃত এক সঙ্গীর গায়ের মাংস খেয়ে। মৃতের গায়ের নোনা মাংস সাগরের পানিতে আরও লবণাক্ত আর সূর্যকিরণে রান্না হওয়া সেই মাংসের স্বাদ ছিল দানা দানা আর মিষ্টি। এক রৌদ্রদগ্ধ দুপুরে ওর জাহাজ পরাজিত করে এক সমুদ্র ড্রাগনকে আর তার পেট চিরে পায় শিরস্ত্রাণ, বক্লেস আর ক্রুসেডে ব্যবহৃত অস্ত্র। ক্যারিবীয় সাগরে দেখতে পায় ভিক্টর উগোর (হুগো) জাহাজের অপচ্ছায়া, মৃত্যুর হাওয়ায় জাহাজটার পালগুলো ছিল ছেঁড়া, মাস্তুল খেয়ে ফেলেছিল সামুদ্রিক আরশোলা, আর চিরদিনের জন্য হারিয়েছিল গুয়াদালুপের পথ। উরসুলা কাঁদত খাবার টেবিলে, ‘আর এত বড় বাড়ি এখানে, বাছা আমার’, ফোঁপাত সে, ‘আর এত খাবার ফেলে দেওয়া হয় শুয়োরদের জন্য।’ কিন্তু ভেতর থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারত না যে, তার যে ছেলেকে জিপসিরা নিয়ে গিয়েছিল সে আর এই লোক একই বর্বর যে নাকি অর্ধেকটা দুধ ছাড়ানো শূকরছানা এক দুপুরের খাবার বেলায় সাবাড় করে আর যার ঢেকুরের গন্ধে শুকিয়ে যায় সব ফুল। পরিবারের অন্য সবারও একই অনুভূতি ছিল এ ব্যাপারে, আর জানোয়ারের মতো ঢেকুর যে বিরক্তির উদ্রেক করত, আমারান্তা তা কিছুতেই চেপে রাখতে পারত না। আর্কাদিও ওদের মধ্যকার সম্পর্ক কখনোই জানতে পারে নি আর সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টায় হোসে আর্কাদিওর করা প্রশ্নগুলোর উত্তর কোনো রকম দায়সারাভাবে দিয়ে শেষ করত। আউরেলিয়ানো, যখন তার সঙ্গে একই কামরায় ঘুমাত, সেই ছেলেবেলার স্মৃতি জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে কিন্তু সমুদ্রের জীবনের এত সব ঘটনা তার স্মৃতিকে এমনভাবে পূর্ণ করে রেখেছে যে হোসে আর্কাদিও ওসব কথা ভুলে গিয়েছে। একমাত্র রেবেকাই প্রথম থেকে প্রভাবিত হয় তার দ্বারা। সেই বিকেলে যেদিন তাকে তার শোবার ঘরের সামনে দিয়ে যেতে দেখে, সেদিনই তার মনে হয় যে সারা বাড়ি শুনতে পায় যার আগ্নেয়গিরির মতো নিশ্বাস, সেই আদিম পৌরুষের তুলনায় পিয়েত্র ক্রেসপি নেহাতই এক রোগা-পটকা ফুলবাবু। তখন থেকেই রেবেকা সব সময় অজুহাত খুঁজে বেড়াত তার কাছে ভেরার। একসময় হোসে আর্কাদিও নির্লজ্জ মনোযোগ দিয়ে তার দেহে চোখ বোলায় আর বলে, ‘ছোট্ট বোনটি, আসলেই তুমি এক পূর্ণ বয়স্কা মেয়ে।’ রেবেকা নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। আবার মাটি আর দেয়ালের চুন খাওয়া শুরু করে অন্য সববারের মতোই আগ্রহভরে, আর এতই উৎকণ্ঠা নিয়ে আঙুল চুষতে শুরু করে যে তার বৃদ্ধাঙ্গুলে কড়া পরে যায়। মৃত জোঁকসমেত সবুজ রঙের বমি করে সে। জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে বিকারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে হোসে আর্কাদিওর ভোরবেলায় বাড়ি ফেরা পর্যন্ত সে ঘুমহীন রাত কাটায়। এক বিকেলে, সবাই যখন দিবানিদ্রায় মগ্ন, নিজেকে সামলাতে না পেরে ঢুকে পড়ে তার শোবার ঘরে। সে হোসে আর্কাদিওকে পায় জাহাজ বাঁধার চেইন দিয়ে কড়িকাঠ থেকে ঝোলানো দোলবিছানায় জেগে থাকা শুধু জাঙ্গিয়া পরে শোয়া অবস্থায়। তার এই বিশাল, চোখ কপালে ওঠানোর মতো নগ্নতা, রেবেকাকে এতই মুগ্ধ করে যে সে ফিরে আসার তাড়া অনুভব করে। ‘ক্ষমা করো’, দুঃখ প্রকাশ করে সে। ‘জানতাম না যে তুমি এখানে আছ।’ অন্য কেউ যেন জেগে না ওঠে, তাই খুব নিচু স্বরে বলে সে, ‘এদিকে আয়।’ রেবেকা তার বাধ্য হয়। বরফ শীতল ঘাম নিয়ে অন্ত্রের মধ্যে গিঁট অনুভব করতে করতে দোলবিছানার পাশে দাঁড়ায় রেবেকা। ততক্ষণে হোসে আর্কাদিও আঙুলের ডগা দিয়ে আদর করছে তার হাঁটুতে, পরে পায়ের পেশিতে, তারপর ঊরু আদর করতে করতে বিড়বিড় করে, ‘ওরে আমার বোনটি, আমার ছোট্ট বোন।’ মরে যাওয়া ঠেকাতে এক অপ্রাকৃতিক চেষ্টা চালাতে হয় রেবেকাকে যখন বিস্ময়করভাবে নিয়ন্ত্রিত এক ঝোড়ো শক্তি তাকে কোমর ধরে উঁচু করে ফেলে আর তিন থাবায় হরণ করে তার লজ্জা আর ছিন্নভিন্ন করে ফেলে তাকে ছোট পাখির মতো। রেবেকা শুধু জন্মানোর জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানানোর সময় করে উঠতে পারে আর অসহ্য যন্ত্রণার অকল্পনীয় সুখানুভবে জ্ঞান হারানোর আগেই বিশাল ভেজা তরলে খাবি খেতে থাকে আর দোলবিছানাটা টিস্যু পেপারের মতো শুষে নেয় সেই রক্তের বিস্ফোরণ।

তিন দিন পর পাঁচ তারিখের প্রার্থনায় বিয়ে করে ওরা। তার আগের দিন হোসে আর্কাদিও গিয়েছিল পিয়েত্র ক্রেসপির দোকানে। পিয়েত্র তখন গিটারের একটা পর্ব শেখাচ্ছে ছাত্রদের। কথা বলার জন্য আর্কাদিও তাকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যায় না। ‘রেবেকার সঙ্গে বিয়ে করছি আমি’, বলে সে। পিয়েত্র ক্রেসপি পাণ্ডুর মতো হয়ে পরে। সেতারটা এক ছাত্রের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ক্লাস শেষ করে দেয়। বাদ্যযন্ত্র আর দড়ি ও স্প্রিংয়ের খেলনায় ঠাসা ঘরটায় যখন শুধু দুজন তখন পিয়েত্র ক্রেসপি বলে—

‘সে হচ্ছে তোমার বোন।’

‘আমার কাছে সেটার গুরুত্ব নেই’, উত্তর দেয় আর্কাদিও।

ল্যাভেন্ডার মাখা রুমাল দিয়ে কপাল মোছে পিয়েত্র ক্রিসপি।

‘এটা প্রকৃতিবিরুদ্ধ’, ব্যাখ্যা করে, ‘তা ছাড়া সর্বোপরি আইনবিরুদ্ধ।’

অধৈর্য হয়ে পড়ে হোসে আর্কাদিও যতটা না বিতর্কের কারণে, তার চেয়েও বেশি পিয়েত্র ক্রেসপিকে পাণ্ডুর হয়ে যেতে দেখে।

‘প্রকৃতির ওপর আমি দুবার হাগি’, বলে, ‘আর শুধু বলতে এসেছি যে রেবেকাকে কোনো কিছুই জিজ্ঞেস করার কষ্টটা যেন তোমাকে না করতে হয়।’

কিন্তু পিয়েত্র ক্রেসপির চোখ ভিজে ওঠায় তার পাশবিক আচরণে ভাঙন ধরে।

‘আর শোনো’, বলে অন্য স্বরে, ‘যা তোমার ভালো লাগে, তা যদি আমাদের পরিবারই হয় তাহলে আমারান্তা তো আছেই।’

রেবেকা আর হোসে আর্কাদিও যে সম্পর্কে ভাইবোন নয়, তা রোববারের ধর্মোপদেশের সময় ফাদার নিকানোর সর্বসমক্ষে উন্মোচন করে। উরসুলা এটাকে কখনোই ক্ষমা করতে পারে না, কারণ তার বিবেচনায় কাজটা হচ্ছে অসম্মানজনক, আর যখন তারা গির্জা থেকে ফেরে, তখন নবদম্পতিকে এ বাড়িতে পুনর্বার পা ফেলতে নিষেধ করে। তার কাছে, ওরা আগেই মারা গেছে। যার দরুন গোরস্থানের সামনে ওরা এক বাড়ি ভাড়া করে, আর শুধু হোসে আর্কাদিওর দোলবিছানাটাই ছিল ওদের একমাত্র আসবাব। বিয়ের দিন রেবেকাকে চপ্পলের মধ্যে ঢুকে থাকা এক কাঁকড়া-বিছে কামড় দেয়। ফলে তার জিব অবশ হয়ে পড়লেও সেটা ওদের হট্টগোলপূর্ণ মধুচন্দ্রিমায় বাধার সৃষ্টি করে না। এলাকার প্রতিবেশীরা চমকে যেত যখন এক রাতে আটবার আর দুপুরে ঘুমের সময় তিনবার জেগে উঠত ওদের শিৎকার শুনে আর অনুনয় করত, যেন ওদের বন্ধনহীন যৌনাবেগ মৃতদের শান্তি ভঙ্গ না করে।

একমাত্র আউরেলিয়ানোই ওদের জন্য উদ্বিগ্ন হয়। ওদের কিছু আসবাব কিনে দেয় আর কিছু টাকা দেয় যত দিন পর্যন্ত না হোসে আর্কাদিও বাস্তববোধ পুনরুদ্ধার করে আর বাড়ির সংলগ্ন মালিকবিহীন জমিতে কাজ শুরু করে। অন্যদিকে আমারান্তা কখনোই রেবেকার ওপর ঈর্ষাপূর্ণ ঘৃণাকে জয় করতে পারে না, যদিও জীবন তাকে এনে দিয়েছে এমন এক সন্তুষ্টি, যা সে স্বপ্নেও দেখে নি। উরসুলার কাছে এই লজ্জা ঢাকার উপায় ছিল সম্পূর্ণ অজানা, আর তার উদ্যোগেই এক ধীরস্থির আত্মমর্যাদাকে ব্যর্থতার গ্লানির ওপরে আসন দিয়ে পিয়েত্র ক্রেসপি প্রতি মঙ্গলবার দুপুরের খাবারটা এ বাড়িতেই খেয়ে চলে একইভাবে। টুপিতে একইভাবে কালো ফিতাটা ব্যবহার করে চলে পরিবারটার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আর সে উরসুলার প্রতি দরদ প্রদর্শনের জন্য সব সময় নিয়ে যেত বিচিত্র সব উপহার: পর্তুগিজের সার্ডিন, তুর্কি গোলাপের জ্যাম আর এক বিশেষ উপলক্ষে ম্যানিলায় তৈরি চমৎকার এক শাল। আমারান্তা তাকে আপ্যায়ন করত আদরভরা যত্নশীলতায়। তার পছন্দগুলোকে আগে থেকেই আন্দাজ করত, জামার আস্তিনে সেলাই খুলে যাওয়া সুতো ছিঁড়ে দিত আর এক জন্মদিন উপলক্ষে তার নামের আদ্যাক্ষর এমব্রয়ডারি করে এক ডজন রুমালে। প্রতি মঙ্গলবার দুপুরের খাবার শেষে যখন সে অলিন্দে এমব্রয়ডারি করত তখন পিয়েত্র ক্রেসপি তাকে এক আনন্দঘন সঙ্গ দিত। যে মেয়েটাকে সব সময় বালিকা হিসেবে গণ্য করেছে, সে হয়ে উঠেছে তার কাছে এক বিস্ময়কর উন্মোচন। আমারান্তার মধ্যে মাধুর্যের অভাব থাকলেও জাগতিক বিষয়বস্তু সম্বন্ধে এক বিরল সংবেদনশীলতা ছিল আর ছিল এক গোপন কমনীয়তা। ঘটনাটা যে ঘটতে যাচ্ছে, এ নিয়ে যখন কারও মনেই কোনো সন্দেহ ছিল না, এমনই এক মঙ্গলবার পিয়েত্র ক্রেসপি তাকে বিয়ের প্রস্তাব করে। আমারান্তা তার কাজ বন্ধ করে না, সে অপেক্ষা করে কানের কাছে হয়ে ওঠা লাল ভাবটা ম্লান হওয়ার আর এক ধীরস্থির ও পরিণত স্বর নিয়ে এসে বলে, ‘অবশ্যই ক্রেসপি’, যোগ করে, ‘কিন্তু যখন আমরা নিজেদের ভালো করে চিনব। তাড়াহুড়ো করা কোনো কিছুতেই ভালো না।’ উরসুলা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। পিয়েত্র ক্রেসপিকে বিশেষ মর্যাদা দিলেও রেবেকার সঙ্গে তার সুদীর্ঘ সময়ে বাগদানের ঘটনা প্রচারিত হওয়ায় এ বিয়ের ব্যাপারে সে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটাকে সে গ্রহণ করে ভালো খারাপ চিন্তা ছাড়াই, কারণ অন্য কেউই ব্যাপারটার নৈতিকতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে না। বাড়ির কর্তা আউরেলিয়ানো তার হেঁয়ালিপূর্ণ চূড়ান্ত মতামত দিয়ে আরও বিভ্রান্ত করে উরসুলাকে।

‘বিয়ে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার সময় নয় এখন’–এই মন্তব্যটির অর্থ বুঝতে উরসুলার কয়েক মাস লেগে যায়। সত্যিকার অর্থে মন্তব্যটা ছিল যথেষ্ট আন্তরিক। কারণ, শুধু বিয়ে নয়, ওই মুহূর্তে যুদ্ধ ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করার সময় আউরেলিয়ানোর ছিল না। ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজেও ভালো করে বুঝে উঠতে পারবে না কীভাবে সূক্ষ্ম কিন্তু অলঙ্ঘনীয় ঘটনাক্রমের ধারাবাহিক বন্ধন তাকে এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে। রেমেদিওসের মৃত্যু তাকে যে রকম নাড়া দেবে বলে ভয় করছিল, বাস্তবে তা হয় নি, বরং তৈরি হয়েছিল এক বোবা ক্রোধের, যা আস্তে আস্তে পরিণত হয়েছিল এক অসাড় নিঃসঙ্গতার, একই রকম হতাশার, যেমনটা সে অনুভব করেছিল মহিলাসঙ্গ বর্জন করে। কাজের গভীরে ডুবে গেলেও শ্বশুরের সঙ্গে দোমিনো খেলার অভ্যাসটা ঠিক রাখে সে। শোকাচ্ছন্ন এক বাড়িতে দুই পুরুষের রাতের আলাপ ওদের বন্ধুত্বের ভিতটা শক্ত করে তোলে।

‘আবার বিয়ে কর আউরেলিতো’, ওকে বলত শ্বশুর, ‘পছন্দমতো নির্বাচন করার জন্য আমার আরও ছয়টি মেয়ে আছে।’

সে প্রায়ই সফরে যেত আর তেমনি এক সফর থেকে ভোটের আগে ফিরে আসে দেশের রাজনৈতিক অবস্থায় উদ্বিগ্ন হয়ে। উদারপন্থীরা যুদ্ধ আরম্ভের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সময়ে উদারপন্থী আর রক্ষণশীলদের নিয়ে আউরেলিয়ানোর ধারণা খুব অস্পষ্ট থাকায় তার শ্বশুর সুনির্দিষ্ট বিন্যাসে ওগুলোর পাঠ দিত। ‘উদারপন্থীরা হচ্ছে ফ্রিম্যানস, খারাপ ধরনের লোক’, বলত সে, ‘যারা পাদরিদের ফাঁসি দিতে চায়, সিভিল বিবাহের আর বিবাহবিচ্ছেদের প্রবর্তন করতে চায়, তারা বৈধ আর অবৈধ সন্তানদের সমান অধিকারে বিশ্বাসী আর এক ফেডেরাল সিস্টেমের অধীনে দেশটাকে টুকরো টুকরো করে ভাগ করতে চায়, যাতে সর্বোচ্চ কেন্দ্রীয় শাসনকর্তার হাতে ক্ষমতা থাকবে। আর অন্যদিকে রক্ষণশীলরা সরাসরি ঈশ্বরের কাছ থেকে ক্ষমতা পেয়েছে, তারা জনশৃঙ্খলা পারিবারিক মূল্যবোধের প্রবক্তা, খ্রিষ্টধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতিরোধকারী, কেন্দ্রীয় শাসনতন্ত্রে বিশ্বাসী আর তারা দেশটাকে স্বায়ত্তশাসনের অধীনে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে দিতে প্রস্তুত নয়।’ মানবিক মনোবৃত্তির কারণে আউরেলিয়ানো অবৈধ সন্তানদের অধিকারের ব্যাপারে উদাহরণপন্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয় কিন্তু কিছুতেই সে বুঝে উঠতে পারছিল না হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায় না এমন কিছু কীভাবে যুদ্ধের মত এক চূড়ান্ত অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে। রাজনৈতিক উদ্দীপনা নেই এমন এক শহরে এক সার্জেন্টের নেতৃত্বে যে সশস্ত্র সৈন্য নিয়ে আসার মতো শ্বশুরের নেওয়া সিদ্ধান্তকে, বাড়াবাড়ি বলে মনে হয় তার। ওরা শুধু এসেই ক্ষান্ত হয় না, তারা একুশ বছরের বেশি বয়সের পুরুষদের ভেতর রক্ষণশীল প্রার্থীদের নাম নীল রঙের কাগজের টুকরায় আর উদারপন্থী প্রার্থীদের নাম লাল রঙের কাগজের টুকরায় বিলি করার আগেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাজেয়াপ্ত করে শিকার করার অস্ত্র, মাসেতে, (বড় ধরনের ছুরি বা দা) এমনকি রান্নাঘরের ছুরি পর্যন্ত। নিজেই এক ফরমান পড়ে শোনায় যেখানে শনিবার মধ্যরাত থেকে পরবর্তী আটচল্লিশ ঘণ্টা অ্যালকোহলজনিত পানীয় বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়, আর নিষিদ্ধ করা হয় একই পরিবারভুক্ত নয় এমন তিনজন লোকের সমাবেশ। কোনো ঘটনা ছাড়াই সম্পন্ন হয় নির্বাচন। রোববার সকাল আটটা থেকে প্লাজায় সৈন্যদের পাহারায় এক কাঠের ব্যালট বাক্স রাখা হয়। আউরেলিয়ানো নিজেই যাচাই করে, যেন সবাই ভোট দেয় স্বাধীনভাবেই, কারণ প্রায় সারা দিন সে শ্বশুরের সঙ্গে পাহারা দেয়, যাতে একবারের বেশি কেউ ভোট দিতে না পারে। বিকেল চারটায় প্লাজায় ড্রাম বাজিয়ে নির্বাচনী পর্বের সমাপ্তি ঘোষণা করা হলে দন আপলিনার মসকতে ব্যালট বাক্স সিল করে একটি লেবেল বাক্সের মুখে আড়াআড়িভাবে সেঁটে দিয়ে তাতে স্বাক্ষর করে। সেই রাতে দন আপলিনার মসকতে যখন আউরেলিয়ানোর সঙ্গে দোমিনো খেলছিল সার্জেন্টকে আদেশ করে ভোট গোনার জন্য ব্যালটের মুখ খুলতে। ব্যালট বাক্সে প্রায় যতগুলো লাল কাগজ ছিল, একই রকম ছিল নীল কাগজও। কিন্তু সার্জেন্ট মাত্র দশটি লাল কাগজ রেখে বাকি লাল কাগজের বদলে সমানসংখ্যক নীল কাগজ ঢুকিয়ে ব্যালট বাক্সটাকে নতুন করে সিল করে আর পরের দিন প্রথম ঘণ্টায় প্রাদেশিক রাজধানীতে নিয়ে যায় সেটা। ‘উদারপন্থীরা যুদ্ধে যাবে’, বলে আউরেলিয়ানো। দন আপলিনার দোমিনোর গুটি থেকে মনোযোগ সরায় না। ‘যদি কাগজগুলো বদলের জন্য বলে থাক তাহলে বলব যে ওরা যুদ্ধে যাবে না’, বলে, ‘এর জন্যই কিছু লাল কাগজও রেখে দেওয়া হয়েছে, যাতে কোনো প্রতিবাদ না হয়।’

বিরুদ্ধ পক্ষের প্রতিকূলতা বুঝতে পারে আউরেলিয়ানো, ‘যদি আমি উদারপন্থী হতাম’, বলে, ‘এই কাগজগুলোর জন্যই যুদ্ধে যেতাম।’

‘তুমি যদি উদারপন্থী হতে, তাহলে আমার মেয়েজামাই হয়েও এই কাগজ বদলের ব্যাপারটা দেখতে পেতে না।’

আসলে সারা গ্রামে অসন্তুষ্টি ছড়িয়ে পড়ে নির্বাচনের ফলাফলের কারণে নয়, বরং সৈন্যরা বাজেয়াপ্ত করা অস্ত্রগুলো ফিরিয়ে না দেওয়ায় আউরেলিয়ানোর সঙ্গে একদল মহিলা কথা বলে, যাতে সে তার শ্বশুরের সঙ্গে কথা বলে রান্নাঘরের ছুরিগুলো ফেরতের ব্যবস্থা করে। দন আপলিনার মসকতে কঠিন গোপনীয়তার সঙ্গে জানায় যে উদারপন্থীরা যে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তারই প্রমাণ হিসেবে বাজেয়াপ্ত করা অস্ত্রগুলো নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই ভাষ্যের লজ্জাহীনতার কারণে সতর্ক হয় আউরেলিয়ানো কিন্তু কোনো মন্তব্যই করে না। কিন্তু এক রাতে যখন হেরিনেলদো মার্কেস আর ম্যাগনিফিকো ভিসবাল তাদের অন্য বন্ধুদের সঙ্গে ছুরিগুলোর ব্যাপারে আলাপ করছিল তখন তারা জিজ্ঞেস করে যে, সে উদারপন্থী না রক্ষণশীল? আউরেলিয়ানো হেঁয়ালি করে না-’যদি কিছু করতে হয় তাহলে উদারপন্থীই হব’ বলে, ‘কারণ রক্ষণশীলরা হচ্ছে একদল ঠগ।’

পরদিন বন্ধুদের অনুরোধে এক মনগড়া যকৃতের ব্যথার অজুহাতে চিকিৎসক আলিরিও নগুয়েরার সঙ্গে দেখা করতে যায় সে। এমনকি সে জানতও না মিথ্যা অজুহাত দেওয়ার কারণটা। আলিরিও নগুয়েরা মাকন্দে আসে কয়েক বছর আগে স্বাদহীন বড়ির এক বাক্স আর এক বাক্য লেখা চিকিৎসার প্রতীক (সিলমোহর) নিয়ে, যে বাক্য কেউই বিশ্বাস করত না। ‘এক পেরেক বের করে আরেক পেরেক।’ আসলে লোকটা ছিল মেকি। এক নিরীহ চিকিৎসকের চেহারার আড়ালে লুকানো ছিল এক সন্ত্রাসী যে নাকি তার পাঁচ বছর কারাবাসের ফলে গোড়ালিতে উৎকীর্ণ বেড়ির দাগ ঢেকে রাখত এক জোড়া বুট জুতো দিয়ে। প্ৰথম ফেডেরালপন্থী অভিযানের সময় গ্রেপ্তার হলেও কুরাসাওয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় সে এমন এক পোশাক দিয়ে ছদ্মবেশ ধারণ করে যে পোশাককে সে ঘৃণা করত সবচেয়ে বেশি: যাজকদের পোশাক। অনেক বছরের নির্বাসন শেষে সব ক্যারিবীয় অঞ্চল থেকে নির্বাসিতদের কাছ থেকে গরম গরম খবর শুনে উত্তেজিত হয়ে চোরাকারবারিদের এক ছোট্ট পালতোলা নৌকায় চেপে রিওয়াচায় আবির্ভূত হয় সে বিভিন্ন ছোট ছোট জার ভর্তি পরিশোধিত চিনি দিয়ে বানানো বড়ি নিয়ে আর নিজ হাতে জালকরা লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নকল ডিপ্লোমা নিয়ে। মোহভঙ্গে কাঁদে সে। নির্বাসিতদের বর্ণিত উদ্দীপনা, যেটাকে ওরা তুলনা করেছিল এক বারুদের সঙ্গে, যেটা যেকোনো মুহূর্তেই বিস্ফোরিত হতে পারে, তা মিইয়ে যায় এক মিথ্যা নির্বাচনের মোহের মধ্য দিয়ে। ব্যর্থতায় তিক্ত হয়ে বৃদ্ধ বয়সে একটা নিশ্চিত আশ্রয়ের খোঁজে উদ্বিগ্ন হয়ে এই ভুয়া হোমিওপ্যাথ এসে আশ্রয় নেয় মাকন্দে। প্লাজার পাশে খালি দোতলা বাসার ছোট এক কামরা ভাড়া নেয় সে আর সব ধরনের চিকিৎসায় ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত চিনির বড়ি নিয়ে সান্ত্বনা পাওয়া রোগীদের দেখে কয়েক বছর কাটিয়ে দেয় সেখানে। যত দিন পর্যন্ত দন আপলিনার মসকতের নামে মাত্র কর্তৃত্ব ছিল, তত দিন তার আন্দোলন করার প্রবৃত্তিগুলো ছিল ঘুমন্ত। সময়গুলো পার হচ্ছিল তার স্মৃতিচারণা করে আর হাঁপানির সঙ্গে যুদ্ধে। আসন্ন নির্বাচন তার জন্য নতুন করে আন্দোলনে ঢোকার সুতাস্বরূপ কাজ করে। রাজনৈতিক জ্ঞানহীন গ্রামের যুবকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে আর গোপনে আরম্ভ করে উসকানিমূলক কাজের প্রচার-অভিযান। ব্যালট বাক্সে এত লাল কাগজের উপস্থিতি যেটাকে দন আপলিনার মসকতে তরুণদের দিবাস্বপ্ন বলে গণ্য করে, সেটা ছিল আলিরিও নগুয়েরার পরিকল্পনার অংশ: নির্বাচন যে একটা প্রহসন, এই ব্যাপারটা বোঝাতে সে তার শিষ্যদের ভোট দিতে বাধ্য করে। ‘সন্ত্রাসই হচ্ছে একমাত্র কার্যকর পদ্ধতি’, বলত সে। আউরেলিয়ানোর অধিকাংশ বন্ধুই রক্ষণশীলদের কর্তৃত্বকে উৎখাত করার ব্যাপারে উৎসাহী থাকলেও কেউই তাকে পরিকল্পনার অংশীদার করতে সাহস করে নি। কারণ শুধু ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে তার নৈকট্যের কারণেই নয়, বরং তার একাকিত্বে ভরা সবকিছু এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতার জন্যও বটে। এ ছাড়া ওরা জানত যে শ্বশুরের নির্দেশমতো আউরেলিয়ানো নীলে ভোট দিয়েছে। ফলে ঘটনাচক্রে তার এই রাজনৈতিক মতামতের জন্যই বন্ধুরা কৌতূহলবশত এক কৃত্রিম ব্যথা নিরাময়ের জন্য তাকে পাঠায় চিকিৎসকের কাছে। নিজেকে আবিষ্কার করে সে এক মাকড়সায় আচ্ছাদিত ঝুপড়ির মধ্যে, এক ধুলাভরা ইগুয়ানার সামনে, যার নিশ্বাসের সঙ্গে শিস বের হয়। কোনো কিছু প্রশ্ন করার আগেই চিকিৎসক তাকে জানালার কাছে নিয়ে যায় এক চোখের ভেতরে পাপড়ি পরীক্ষা করে। ‘ওখানে নয়’, বলে আউরেলিয়ানো, যেভাবে তার বন্ধুরা নির্দেশ দিয়েছিল, যকৃতের জায়গাটা ভেতর দিকে দাবিয়ে দিয়ে আঙুলের ডগা দিয়ে দেখিয়ে যোগ করে: ‘এখানেই, যেখানে আমার ব্যথা করে আর আমাকে ঘুমাতে দেয় না।’ সুতরাং চিকিৎসক নগুয়েরা প্রচুর রোদের অছিলায় জানালাটা বন্ধ করে আর সহজভাবে ব্যাখ্যা করে, কেন রক্ষণশীলদের খুন করা দেশ প্রেমিকদের জন্য কর্তব্য। এরপর অনেক দিন আউরেলিয়ানো শার্টের পকেটে এক ছোট বোতল বহন করে। ওটাকে সে বের করত প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর। শিশিটা বের করে হাতের তালুতে তিনটি গুলি নিয়ে এক ধাক্কায় মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিত, যাতে আস্তে আস্তে সেগুলো চলে যায় জিবের ভেতর। হোমিওপ্যাথির ওপর বিশ্বাসের কারণে দন আপলিনার মসকতে বিদ্রূপ করে ওকে কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা ঠিকই ওকে চিনতে পারে নিজের দলের একজন হিসাবে। প্রায় সব পত্তনকারীর ছেলেরাই দলভুক্ত হয়, যদিও তাদের কেউই নিশ্চিতভাবে জানে না তাদের ষড়যন্ত্রের কারণ। যাহোক, যেদিন চিকিৎসক গোপন ব্যাপারটা আউরেলিয়ানোর কাছে উন্মোচন করে সে সম্পূর্ণ ষড়যন্ত্রটাই আলোয় টেনে বের করে। যদিও রক্ষণশীল দলকে ক্ষমতাচ্যুত করার আশু প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে সে নিশ্চিত ছিল তবু পরিকল্পনাটা ছিল রোমহর্ষক। লোকজনকে হত্যা করার ব্যাপারে চিকিৎসক নগুয়েরা ছিল এক বিশেষজ্ঞ। তার কর্মপদ্ধতি ছিল ধারাবাহিকভাবে একের পর অফিসারদের এবং তাদের পরিবারসহ বিশেষ করে শিশুদের নিকেশ করার মধ্যে সমন্বয় সাধন করে দেশজুড়ে রক্ষণশীলদের মূলসহ উৎপাটনের এক ওস্তাদি মার দেওয়ায়। অবশ্যই তাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল দন আপলিনার মসকতে, তার স্ত্রী আর ছয় মেয়েরা। ‘আপনি উদারপন্থী নন, এমনকি কিছুই নন’, উত্তেজিত না হয়ে বলে আউরেলিয়ানো, ‘আপনি শুধু এক কসাই ছাড়া আর কিছুই নন।’ ‘সে ক্ষেত্রে’, চিকিৎসক উত্তর দেন একই রকম ঠান্ডা মাথায়, ‘আমাকে ছোট শিশিটা ফেরত দাও, তোমার আর ওটার প্রয়োজন নেই।’

শুধু ছয় মাস পরই আউরেলিয়ানো জানতে পারে যে তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে কাজে লাগবে এমন লোকদের তালিকা থেকে, কারণ সে ছিল ভবিষ্যহীন এক ভাবপ্রবণ লোক, যে ছিল নিঃসঙ্গ আর নিরুদ্যম চরিত্রের। ষড়যন্ত্রটা জানিয়ে দেবে এই ভয়ে ওরা চোখে চোখে রাখে তাকে। আউরেলিয়ানো ওদের আশ্বস্ত করে যে সে একটা কথাও বলবে না, কিন্তু যে রাতে মসকতে পরিবারকে খুন করতে যাবে তখন আউরেলিয়ানো দরজায় থাকবে প্রতিরোধ করতে, এই সিদ্ধান্তটা ওদের এতই স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় যে পরিকল্পনাটা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য মুলতবি করা হয়। এসব দিনেই উরসুলা পিয়েত্র ক্রেসপি আর আমারান্তার বিয়ের ব্যাপারে তার মতামত জানতে চেয়েছিল। আর সে উত্তর দিয়েছিল ওগুলো ভাবার সময় এখন নয়।

এক সপ্তাহ ধরে সে বহন করত এক প্রাচীন আমলের পিস্তল, আর নজর রাখত বন্ধুদের ওপর। বিকেলের দিকে কফি পান করতে যেত হোসে আর্কাদিও ও রেবেকার ওখানে, যারা তাদের ঘর সাজানো আরম্ভ করেছে তখন। আর সন্ধ্যা সাতটা থেকে দোমিনো খেলত শ্বশুরের সঙ্গে। দুপুরের খাবার সময় আলোচনা করত দশাসই হয়ে ওঠা কিশোর আর্কাদিওর সঙ্গে। আর তাকে পেত আসন্ন যুদ্ধের আঁচে ক্রমেই আরও উত্তেজিত অবস্থায়। স্কুলে কেবল বোল ফুটেছে এমন শিশু থেকে শুরু করে ওর থেকেও বয়সে বড় এমন সব ছাত্র ছিল আর্কাদিওর অনুসারী আর তাদের গায়েও এসেছিল উদারপন্থী জ্বর। ওরা আলাপ করত ফাদার নিকানোরকে গুলি করে খুন করার, গির্জাটাকে স্কুলে পরিবর্তন করার আর বাধাহীন মিলনে স্বীকৃতি দেওয়ার। ওদের এই উত্তেজনাকে শান্ত করার চেষ্টা করে আউরেলিয়ানো। ওদের পরামর্শ দেয় গোপনীয়তার আর সতর্কতার। ওর ওই ঠান্ডা মাথার বাস্তব বুদ্ধিতে কান না দিয়ে সবার সামনেই আর্কাদিও তাকে দুর্বল চরিত্রের লোক আখ্যা দিয়ে তিরস্কার করে। আউরেলিয়ানো অপেক্ষা করে। শেষ পর্যন্ত ডিসেম্বরের প্রথম দিকে ট্রসুলা কর্মশালায় উত্তেজনার ঝড় তোলে।

‘যুদ্ধ বেধে গেছে।’

সত্যিকার অর্থে যুদ্ধ বেধেছে আরও তিন মাস আগে। সামরিক আইন জারি হয়েছে সারা দেশে। একমাত্র দন আপলিনার মসকতেই জেনেছিল সময়মতো কিন্তু সবাইকে আশ্চর্য করে এক সেনাবাহিনী গ্রামটাকে দখল করার আগ পর্যন্ত এমনকি ব্যাপারটা তার স্ত্রীকেও জানায়নি সে। ওরা ঢুকে নিঃশব্দে ভোর হওয়ার আগে খচ্চরে টানা দুটো হালকা কামান নিয়ে আর স্কুলটাকে বানায় সামরিক ঘাঁটি। সন্ধ্যা ছটায় কারফিউ জারি হলো। তল্লাশি হলো বাড়ি বাড়ি গিয়ে আর এবারেরটা হলো আগেরটার চেয়েও কড়া। এমনকি এবার বাজেয়াপ্ত হলো চাষবাসের যন্ত্রপাতিগুলোও। টেনে ছেঁচড়িয়ে বের করে আনে তারা চিকিৎসক নগুয়েরাকে, বাঁধে প্লাজার এক গাছের সঙ্গে আর বিচারহীন গুলি করে মারে তাকে। ফাদার নিকানোর শূন্যে ভাসার অলৌকিকতা দেখিয়ে সামরিক কর্তৃত্বদের মন জয়ের চেষ্টা করলে এক সৈনিক রাইফেলের বাঁট দিয়ে তার মাথা ফাটিয়ে দেয়। উদারপন্থী উন্মাদনা নিভে যায় এক ভয়াবহ নীরবতায়। পাণ্ডুর, রহস্যময় আউরেলিয়ানো দোমিনো খেলে চলে তার শ্বশুরের সঙ্গে। সে বুঝতে পারে যে বেসামরিক ও সামরিক পদমর্যাদা থাকা সত্ত্বেও দন আপলিনার মসকতে পরিণত হয়েছে এক আলংকারিক কর্তৃত্বে। সামরিক বাহিনীর ক্যাপ্টেন নিত সব সিদ্ধান্ত, যে নাকি নাগরিক শৃঙ্খলা রক্ষার খাতিরে প্রতি সকালে অসাধারণ রকমের অঙ্কের টোল আদায় করত। তার অধীনের চারজন সৈন্য পাগলা কুকুরে কামড় দেওয়া এক মহিলাকে পরিবারের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বন্দুকের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে সবার সামনে রাস্তার ওপর। সামরিক দখলের দুই সপ্তাহ পর এক রোববার আউরেলিয়ানো ঢোকে হেরিনেলদো মার্কেসের বাড়ি তার স্বভাবজাত শান্তভাব নিয়ে আর চিনি ছাড়া এক কাপ কফি চায়। যখন রান্নাঘরে শুধু দুজন, তখন আউরেলিয়ানো তার গলায় আনে এক কর্তৃত্বের স্বর, যেটা কখনোই কেউ জানত না, ‘ছেলেগুলোকে তৈরি হতে বলো’, বলে, ‘যুদ্ধে যাচ্ছি আমরা।’ হেরিনেলদো বিশ্বাস করে না।

‘কোন অস্ত্র দিয়ে’… জিজ্ঞেস করে।

‘ওদের অস্ত্র দিয়ে’—উত্তর দেয় আউরেলিয়ানো। এক মঙ্গলবার মধ্যরাতে আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার আজ্ঞাধীন তিরিশ বছরের কম বয়স্ক একুশজন যুবক খাবারের টেবিলের ছুরি ও ধারালো লোহা দিয়ে এক অভাবনীয় অকস্মাৎ হামলা চালিয়ে দখল করে সেনাশিবির, নিয়ে নেয় তাদের অস্ত্রশস্ত্র, উঠানেই গুলি করে মেরে ফেলে ক্যাপ্টেন আর সঙ্গে চারজন সৈনিককে যারা হত্যা করেছিল মহিলাকে।

ওই একই রাতে যখন সৈনিকদের মেরে ফেলার গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল, তখনই আউরেলিয়ানোর আত্মপ্রকাশ ঘটে সামরিক কর্তৃত্ব হিসেবে। কোনো রকমে সময় পায় বিবাহিত বিদ্রোহীরা নিজেদের স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার আর তারা স্ত্রীদের বলে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই যেন করে নেয়। আতঙ্কমুক্ত লোকজনের আনন্দধ্বনির মধ্য দিয়ে ভোরবেলায় ওরা চলে যায় বিদ্রোহী জেনারেল ভিক্তর মেদিনার শক্তির সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য, শেষ খবর অনুযায়ী সে তখন ছিল মানাউরের পথে। যাওয়ার আগে আউরেলিয়ানো দন আপলিনার মসকতেকে বের করে আনে এক জামাকাপড় রাখার দেয়াল আলমারি থেকে। ‘আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন’ বলে তাকে, ‘নতুন সরকার সম্মানজনক কথা দিচ্ছে পারিবারিক ও নাগরিক নিরাপত্তার।’ এই উঁচু বুট পরিহিত, পিঠে বন্দুক ঝোলানো লোকটাকে তার সঙ্গে রাত নয়টা পর্যন্ত দোমিনো খেলার মানুষটাকে মেলাতে কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায় দন আপলিনা মসকতের জন্য। ‘এটা এক পাগলামি আউরেলিতো’, কাতর কণ্ঠে বলে সে। ‘কোনো পাগলামিই নয়’, বলে আউরেলিয়ানো, ‘এটা হচ্ছে যুদ্ধ। আর আমাকে কখনোই আউরেলিতো বলবেন না, আমি হচ্ছি কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *