নিঃসঙ্গতার একশ বছর – ৩

জন্মানোর দুই সপ্তাহ পরে পিলার তেরনেরার ছেলেকে নিয়ে যাওয়া হয় ওদের দাদা-দাদির বাড়িতে। ওকে অনিচ্ছার সঙ্গে বরণ করে উরসুলা। স্বামীর গোঁয়ার্তুমির কাছে আবার হার মানে সে, কারণ তার স্বামী সহ্য করতে পারছিল না যে তার রক্তের একটি কুঁড়ি বিপথে প্রবাহিত হবে। তবে শর্ত দেওয়া হয় ছেলেটার কাছে তার প্রকৃত পরিচয় গোপন করা হবে। যদিও ওর নাম রাখা হলো হোসে আর্কাদিও কিন্তু বিভ্রান্তি এড়ানোর জন্য তাকে শেষ পর্যন্ত আর্কাদিও নামেই ডাকা হয়। সেই সময় গ্রামে এত কর্মতৎপরতা আর বাড়িতে এত ক্লান্তিকর কাজ ছিল যে বাচ্চাদের দেখাশোনাটা পরিণত হয় গৌণ কর্মে। অনিদ্রা নামক মহামারির হাত থেকে বাঁচার জন্য গুয়াহিরা উপজাতিদের দল থেকে কয়েক বছর আগে পালিয়ে আসা বিসিতাসিওন নামের এক আদিবাসী মহিলা আর তার ভাইয়ের হাতে ওদের ভার অর্পণ করা হলো। উভয়ই এত অনুগত আর শান্ত প্রকৃতির ছিল যে উরসুলা ওদেরকে ঘরের যাবতীয় কাজের ভার দেয়। এভাবেই আর্কাদিও আর আমারান্তা কাস্তেইয়্যানোর আগে গুয়াহিরা ভাষায় কথা বলে। উরসুলার অজান্তেই গিরগিটির স্যুপ আর মাকড়ের ডিম খেতে শিখে তারা, কারণ উরসুলা মিস্ত্রি দিয়ে তৈরি জীবজন্তুদের এক সম্ভাবনাময় ব্যবসার কাজে ছিল ভীষণভাবে ব্যস্ত। মাকন্দ বদলে যাচ্ছিল। উরসুলার সঙ্গে যে লোকেরা এসেছিল, ওরা মাকন্দের মাটির উর্বরতা আর জলাভূমির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অবস্থানের কথা প্রচার করে দিয়েছিল, ফলে আগের সেই সাদামাটা গ্রামটাই দ্রুত হয়ে উঠল কর্মচঞ্চল, দোকানপাট আর হস্তশিল্পে ভরপুর। আর স্থায়ী এক নিত্যবাণিজ্যের পথ দিয়ে ঢোলা পাজামা, কানে মাকরি পড়ে প্রথম আরবীয়রা আসে গলার হারের সঙ্গে গুয়াকামাইয়ার (বড় টিয়া পাখি) বদলের জন্য। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া একমুহূর্তও বিশ্রাম পাচ্ছিল না। আকর্ষণীয় বাস্তবতা তার কাছে কল্পনাপ্রসূত বিশাল বিশ্বের চেয়ে অনেক বেশি আকৃষ্টকর বলে মনে হয়। আলকেমির পরীক্ষাগারের প্রতি সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, মাসের পর মাস রূপ বদলানোর পর প্রায় তলানীতে ঠেকা পদার্থটাকে বিশ্রাম দেয় সে। আবার হয়ে ওঠে প্রথম দিককার মতো সেই একই উদ্যোক্তা, যার উদ্যমে রাস্তাগুলো আর নতুন বাড়িগুলোর অবস্থান এমনভাবে বিন্যাস করা হয়েছিল, যাতে কেউ কারও চেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করতে না পারে। সে তখন এমন ক্ষমতা অর্জন করে যে নতুন আসা লোকগুলো ওর মতামত না নিয়ে বাড়ির ভিত্তি স্থাপন বা দেয়াল পর্যন্ত বানাত না। এমনকি ঠিক করা হয় যে জমি বিলির ব্যাপারটাও সে-ই পরিচালনা করবে। যখন ছোট, ঘুরে বেড়ানো এক দলকে জুয়া আর অন্যান্য খেলাধুলার দলকে বিশাল এক মেলায় পরিণত করে দড়াবাজ জিপসি দলটা ফিরে আসে, তখন তাদের আনন্দের সঙ্গে বরণ করে নেওয়া হয় কারণ সবাই মনে করেছিল ওদের সঙ্গে হোসে আর্কাদিও ফিরে এসেছে। কিন্তু আর্কাদিও ফিরে আসে নি, এমনকি ওরা আনেনি সর্পমানবকেও—উরসুলা ভেবেছিল একমাত্র সর্পমানবই তার ছেলের সন্ধান দিতে পারবে। যার ফলে জিপসিদের গ্রামে তাঁবু ফেলতে দেওয়া হয় না এমনকি ভবিষ্যতেও গ্রামে পা ফেলতে নিষেধ করা হয়, কারণ মনে করা হয় ওরা হচ্ছে যৌনলিপ্সা আর বিকৃতির প্রচারক। অবশ্য আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া খুব ভালোভাবে বলে দেয় যে সেই মেলকিয়াদেসের আদি জিপসির দল, যারা এই গ্রামের উন্নতিতে বিরাট অবদান রেখেছে তাদের প্রাচীন জ্ঞান আর অপূর্ব ঘটনাবলি দিয়ে, ওদের জন্য গ্রামের দরজা সব সময় থাকবে খোলা। কিন্তু ভূ-পর্যটকেরা জানাল, মেলকিয়াদেসের উপজাতির প্রজ্ঞা মানুষের জানার সীমানা লঙ্ঘন করে যাওয়ায় উধাও হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে।

দিবাস্বপ্ন থেকে সেই সময়ের জন্য হলেও মুক্তি পেয়ে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া অল্প সময়ের মধ্যেই শৃঙ্খলা আর কাজে প্রত্যাবর্তন করে, যার ভেতর শুধু অনুমতি দেয়-গ্রাম পত্তনের সময় থেকে যে পাখিগুলো ওদের বাঁশির সুরে আনন্দমুখর করে রাখত, তাদের মুক্তি দিয়ে তার বদলে প্রতিটা বাড়িতে সুরেলা ঘড়ি বসানোর। ওগুলো ছিল খোদাই করা কাঠের খুব সুন্দর সব ঘড়ি, যেগুলোকে আরবরা গুয়াকামাইয়ার সঙ্গে বদল করত। যেগুলোকে হোসে আর্কাদিও এমন সুন্দরভাবে মিলিয়ে নিল যে প্রতি আধঘণ্টা পর পর পুরো গ্রাম আনন্দিত হয়ে ওঠে ক্রমানুসারী একই সংগীতের অংশগুলো বেজে ওঠায়, আর ঠিক মধ্য দিনে সেটা পরিণত হয় এক সম্পূর্ণ ওয়ালট্সে। ওই বছরগুলোতে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়াই ছিল সেই লোক, যে স্থির করে সোনাঝুড়িগাছের বদলে আলমন্ডগাছ লাগানোর। কারণ যদিও কাউকে সে বলে নি কিন্তু আবিষ্কার করেছিল গাছগুলোকে অমর করার প্রক্রিয়া। অনেক বছর পর যখন মাকন্দ পরিণত হয়েছিল কাঠের বাড়ি আর দস্তার চালের শিবিরে, তখনো সবচেয়ে পুরোনো রাস্তাগুলোতে দেখা যেত ভাঙা আর ধুলোময় আলমন্ডগাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে, যদিও কেউ জানত না ওগুলোকে কে লাগিয়েছে। যখন বাবা ব্যস্ত গ্রামে শৃঙ্খলা স্থাপন করতে, তখন মা শক্ত করে তুলছে পারিবারিক উত্তরাধিকার। দিনে দুবার বালসা কাঠে গাঁথা অবস্থায় বাড়ি থেকে বের হওয়া চিনি মাখানো ছোট মোরগ আর মাছের অভাবনীয় শিল্পের মাধ্যমে। আর তখন আউরেলিয়ানো কাটাচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিত্যক্ত পরীক্ষাগারে নিজে নিজেই অনুসন্ধান করে রৌপ্যকর্ম শিখে। অল্প সময়ে সে এত বেশি লম্বা হয়েছিল যে ছোট হয়ে যায় ভাইয়ের রেখে যাওয়া জামা কাপড়, আর পরতে আরম্ভ করে বাবারগুলো। তবে ভিসিতাসিওনকে জামার কুঁচি আর প্যান্টের কোমর সেলাই করতে হয়েছে কারণ আউরেলিয়ানোর অন্য সবার মতো পেশিবহুল শরীর হয় নি। বয়ঃসন্ধি কেড়ে নিয়েছিল তার গলার কোমলতা, আর হয়ে গিয়েছিল শান্ত আর নিঃসঙ্গ; কিন্তু তার বদলে ছিল জন্মের সময় থেকে পাওয়া প্রখর চাহনি। রৌপ্যকর্মের পরীক্ষাতে এতই আত্মনিয়োগ করেছিল যে শুধু খাওয়ার প্রয়োজনেই পরীক্ষাগার ত্যাগ করত। তার এই অন্তর্মুখিতার কারণে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া মনে করে তার মেয়ে মানুষের দরকার, এই ভেবে ওকে বাড়ির চাবি আর কিছু টাকা দেয়। কিন্তু আউরেলিয়ানো টাকাগুলো খরচ করে আকুয়া রেজিয়া বানানোর জন্য, আর মুরিয়াটিক অ্যাসিড কিনে, তা দিয়ে চাবিগুলোকে সোনার গিলটি করে তাদের সৌন্দর্য বাড়ায়। ওর বাড়াবাড়িগুলো কোনো রকমে তুলনা করা যায় আর্কাদিও আর আমারান্তার বাড়াবাড়ির সঙ্গে। ওদের দাঁত নড়তে শুরু করেছে কিন্তু তখনো সব সময় আদিবাসীদের আঁচল ধরে থাকে। তারা ছিল এত জেদি যে কাস্তেইয়ানোতে (স্প্যানিশ) কথা না বলে গুয়াহিরা (আদিবাসীদের ভাষা) ভাষায় কথা বলার ব্যাপারে ছিল অনড়। ‘এমন কিছুই হয় নি যে তুমি অনুযোগ করতে পারো’–উরসুলা স্বামীকে বলে, ‘ছেলেমেয়েরা বাপ-মায়ের পাগলামি উত্তরাধিকার সূত্রেই পায়।’ যখন তাদের ছেলেমেয়েদের উদ্ভট কাজকর্মকে শুয়োরের লেজের মতোই একটা ব্যাপার হিসেবে ধরে নিয়ে উরসুলা অনুতাপ করছে, তখন আউরেলিয়ানো ওর দিকে এমন এক দৃষ্টি দিয়ে তাকায় যে তাতে ঘরজুড়ে অনিশ্চয়তাময় এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

‘কেউ একজন আসবে’–উরসুলাকে বলে সে। সব সময়ই যেমন করে থাকে, তেমনি উরসুলা এবারও নিরুৎসাহিত করে ওর ভবিষ্যদ্বাণীকে। কেউ যে আসবে এটা তো একটা সাধারণ ব্যাপার। আগে থেকে ঘোষণা না করে কারও মনে কোনো উদ্বেগ তৈরি না করে প্রতিদিন প্রচুর অজ্ঞাত লোক মাকন্দ দিয়ে যাতায়াত করে। কিন্তু সব যুক্তির পরও আউরেলিয়ানো ওর ভবিষ্যদ্বাণীতে অনড় থাকে। ‘জানি না কে’ জোর দিয়ে বলে, ‘যে আসবে, সে রাস্তায় আছে।’

রোববার, সত্যিই রেবেকা আসে। ওর বয়স এগারোর বেশি ছিল না। এক কষ্টকর যাত্রা শেষে মানাউর থেকে কতগুলো চামড়ার ব্যবসায়ী দায়িত্ব নেয় একটি চিঠিসহ রেবেকাকে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার হাতে পৌঁছে দেওয়ার। ছোট একটা কাপড়চোপড়ভরা তোরঙ্গ, হাতে রংবেরঙের ফুল আঁকা এক দোলচেয়ার, বাপ-মায়ের হাড়গোড় ভরা এক থলে, যা সারাক্ষণ শব্দ করত ক্লক, ক্লক, ক্লক; আর শুধু এসবই ছিল তার মালপত্র। স্নেহপূর্ণ ভাষায় লেখা চিঠিটা ছিল আর্কাদিও বুয়েন্দিয়াকে উদ্দেশ্য করে, লিখেছে এমন একজন যে প্রচুর দূরত্ব এবং অনেক সময় পার হওয়ার পরও আর্কাদিও বুয়েন্দিয়াকে স্নেহ করে। সে মানবতার খাতিরে বাধ্য হয়ে উরসুলা ও আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার দূর-সম্পর্কের এতিম সহায়হীন জ্ঞাতি বোনকে পাঠিয়ে দিচ্ছে। যদিও দূরত্বটা খুব দূরের, তবু কখনো ভোলা সম্ভব নয়, এমন বন্ধু মৃত নিকানোর (ঈশ্বর তাদের পবিত্র রাজ্যে স্থান দিন) উইয়্যোহা এবং তার সম্মানীয় স্ত্রী রেবেকা মন্তিয়েলর বাপ-মায়ের দেহের দেহাবশিষ্ট মেয়ের সঙ্গে পাঠিয়ে দিচ্ছে, যাতে খ্রিষ্টধর্মীয় মতে তাদের শেষকৃত্য করা হয়। যদিও চিঠিতে উল্লেখিত নামগুলো এবং স্বাক্ষর সঠিকভাবে পড়া যাচ্ছিল, তবু আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বা উরসুলা মনে করতে পারছিল না এই নামের কোনো আত্মীয়ের অস্তিত্ব, অথবা চেনে না চিঠির লেখককে, মানাউর নামের সেই দূরবর্তী গ্রামের কথা তো বলাই বাহুল্য। অসম্ভব হয় মেয়েটার কাছ থেকেও অন্য কোনো তথ্য বের করা। আসামাত্রই তাকে জিজ্ঞেস করা প্রশ্নগুলো যে বুঝতে পারছে, এমন কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করে না সে। আসার পর থেকেই দোলচেয়ারে বসে আঙুল চুষতে চুষতে বড় বড় চোখগুলোতে ভয় নিয়ে চারদিক দেখছে সে। কালো রঙের বহুল ব্যবহারে মলিন, আড়াআড়ি এক পোশাক ছিল তার পরনে আর পায়ে ছিল চল্‌ল্টা উঠে যাওয়া চামড়ার জুতো। কালো লেসের ফুল বানিয়ে কানের পেছনে চুলগুলো ছিল তার বাঁধা। গলায় পরা ঘামে প্রায় মুছে যাওয়া প্রতিমূর্তিসহ এক হার। আর ডান কবজিতে পরা ছিল চোখ-লাগা প্রতিরোধের জন্য তামার ওপর বসানো এক মাংসাশী জন্তুর সদন্ত বালা। নীলাভ গায়ের রং, গোলাকার আর ঢোলের মতো টানটান পেট, খারাপ স্বাস্থ্য তার বহু দিনের ক্ষুধারই ইঙ্গিত বহন করে। কিন্তু ওকে যখন খাবার দেওয়া হলো, স্বাদ গ্রহণ না করেই পায়ের ওপর থালা রেখে বসে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না আদিবাসীরা ওদের নিজস্ব ভাষায় ওকে জিজ্ঞেস করে সামান্য কিছু পানি চায় কি না আর সে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে, ততক্ষণ পর্যন্ত ওকে ভাবা হলো বোবা আর কালা। অন্য কোনো উপায় না থাকায় সে ওদের সঙ্গেই রয়ে যায়। আউরেলিয়ানো ধৈর্য ধরে ওর সামনে সব সানতরাল (সন্তদের নাম লেখা বই) পড়ে যাওয়ার পরও সে কোনো নামেই সাড়া না দেওয়ায় চিঠি অনুযায়ী ওর মায়ের নামে নাম হয় রেবেকা। যেহেতু মাকন্দে তখন পর্যন্ত কেউ মারা যায়নি, ফলে কোনো কবরস্থান না থাকায় দেহাবশিষ্টের হাড়ভর্তি থলেটা সঠিক মতে শেষকৃত্যের অপেক্ষায় রাখা হয়েছিল অনেক সময় পর্যন্ত। আর যেখানে থাকার কথা নয়, সেখানে উপস্থিত হয়ে থলেটা ডিমে তা দেওয়া মুরগির মতো ক্লক ক্লক শব্দ করে সবার বিরক্তির উদ্রেক করত। অনেক সময় লাগে রেবেকার পারিবারিক জীবনের সঙ্গে একাত্ম হতে। ছোট দোলচেয়ারটিতে বসত আঙুল চোষার জন্য বাড়ির সবচেয়ে দূরের কোনায়। শুধু ঘড়িগুলোর বাজনা ছাড়া কিছুই তার মনোযোগ আকর্ষণ করত না। ভয়াতুর চোখে প্রতি আধঘণ্টা অন্তর ঘড়িগুলোকে খুঁজে বেড়াত, যেন ওগুলোকে খুঁজে পাওয়া যাবে শূন্যের ভেতর। অনেক দিন পর্যন্ত ওকে কিছুই খাওয়ানো যায় না। আদিবাসীরা বিরামহীন নিঃশব্দ চরণে বাড়িময় ঘুরে বেড়ানোর কারণে সবকিছু সম্বন্ধেই অবগত ছিল আর এভাবেই তারা আবিষ্কার করে, কেন সে না খেয়ে এত দিন মারা যায় নি। ওরা বের করে, রেবেকা শুধু উঠানের নরম মাটি আর নখ দিয়ে খুলে ফেলা বাড়ির দেয়ালের চুনের পরত খেতে পছন্দ করে। বোঝাই যায় ওর বাবা-মা বা যারাই ওকে লালন করছে, তারা এই অভ্যাসটার দরুন ওকে তীব্র ভর্ৎসনা করত, কারণ কাজটা করত সে লুকিয়ে, একটা অপরাধবোধ নিয়ে, আর পরের বরাদ্দটা লুকিয়ে রাখত, যাতে কারও চোখ না পড়ে। সুতরাং, সেই সময় থেকে ওকে পাহারা দেওয়া হতো নিশ্ছিদ্রতায়। তার এই অভ্যাসটাকে দমন করতে বাড়ির উঠান লেপা হতো গরুর পিত্ত দিয়ে, দেয়ালে মাখা হতো ঝালমরিচ, কিন্তু সে মাটি জোগাড়ের জন্য এমন চতুরতা আর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয় যে উরসুলা আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়। কড়াইতে কমলার রসের সঙ্গে রেউচিনি মিশিয়ে সারা রাত ফেলে রাখা হতো শিশিরে আর সিরাপটা খালি পেটে খাওয়ানো হতো ওকে।

যদিও কেউই উরসুলাকে বলে দেয়নি যে ওটাই ছিল মাটি খাওয়ার অভ্যাসের মোক্ষম দাওয়াই, তবু সে ভেবেছিল খালি পেটে যেকোনো তিক্ত জিনিসই যকৃৎকে সাড়া দিতে বাধ্য করবে। রেবেকা অবাধ্য আর দুর্বলতা সত্ত্বেও এতই শক্তিশালী ছিল যে ওষুধ খাওয়ানোর জন্য তাকে বাছুরের মতো বাঁধতে হতো আর ওরা কোনো রকমে সহ্য করে নিত ওর লাথি, কামড়, ছিটানো থুতু আর দুর্বোধ্য সব কুৎসাপূর্ণ শব্দ, যেগুলো ছিল আদিবাসীদের কথানুযায়ী ওদের ভাষার জঘন্যতম গালি। উরসুলা যখন জানতে পারে, তখন ওর সঙ্গে যোগ হয় কোমরবন্ধনী দিয়ে চাবকানি। কেউ কখনোই স্থির করতে পারে না রেউচিনি না চাবকানি অথবা দুটোরই সম্মিলিত গুণের ফলে রেবেকা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আরোগ্যের চিহ্ন দেখাতে শুরু করে। আর্কাদিও আর আমারান্তার সঙ্গে খেলায় অংশগ্রহণ করে সে, যারা ওকে বড় বোন হিসেবে দেখত, আর আরম্ভ করে ছুরি, কাঁটাচামচ ব্যবহার করে পেট ভরে খেতে। শিগগিরই জানা গেল সাবলীলভাবে কাস্তেইয়ানো বলতে পারে যেমনটি পারে আদিবাসীদের ভাষাও। তা ছাড়া হাতের কাজে ছিল তার উল্লেখযোগ্য দক্ষতা। আর সে যখন ঘড়িগুলোর সঙ্গে ওয়ালটস গাইত, তখন গাইত সে নিজের বানানো কিছু শব্দ দিয়ে, যা ছিল কৌতুকপূর্ণ। ওকে পরিবারের আরেকজন সদস্য হিসেবে গণ্য করতে বেশি দেরি হলো না। উরসুলা হয়েছিল ওর সবচেয়ে বেশি অনুরক্ত, যা সে নিজের কোনো ছেলেমেয়ের কাছ থেকেও পায় নি। আর আর্কাদিও আমারান্তাকে ডাকত ভাইবোন বলে। আউরেলিয়ানোকে কাকা আর আর্কাদিও বুয়েন্দিয়াকে ডাকত দাদা বলে, যাতে আর সবার মতোই সে যোগ্যতা পেল রেবেকা বুয়েন্দিয়া নামের। এই নামটিই ছিল সব সময় তার একমাত্র নাম আর আমৃত্যু এই নামটিকে সে বহন করে গৌরবের সঙ্গে।

রেবেকা যখন মাটি খাওয়ার রোগ থেকে সুস্থ হয়, তখন ওকে নিয়ে যাওয়া হয় অন্য শিশুদের সঙ্গে ঘুমানোর জন্য। আদিবাসী মহিলাও ওদের সঙ্গে ঘুমাত এবং এক রাতে ঘটনাচক্রে সে জেগে যায় ঘরের কোণ থেকে আসা আশ্চর্যজনক এক অবিরাম শব্দ শুনে। প্রথম সে সতর্ক হয় ঘরে কোনো জন্তু ঢুকে পড়েছে ভেবে। এমন সময় দেখতে পায় রেবেকাকে অন্ধকারে বিড়ালের মতো জ্বলন্ত চোখ নিয়ে দোলচেয়ারে বসে আঙুল চুষতে। ভয়ার্ত, ভাগ্যের ফেরে নিপীড়িত ভিসিতাসিওন চোখগুলোর ভেতর দিয়ে চিনতে পারে সেই রোগের উপসর্গ, যার হুমকি ওকে আর ওর ভাইকে বাধ্য করেছিল এক সুপ্রাচীন দেশ ত্যাগ করতে, যেখানে ওরা ছিল রাজকুমার আর রাজকুমারী। রোগটা হচ্ছে অনিদ্রারোগ।

কাতাউরে নামের আদিবাসী ছেলেটা বাড়ি ত্যাগ করে, ওর বোন রয়ে যায় কারণ ওর অদৃষ্টবাদী মন ওকে জানিয়ে দেয় যে সে যা-ই করুক না কেন এই প্রাণঘাতী কষ্টটা ওকে অনুসরণ করবে পৃথিবীর শেষ কোনা পর্যন্ত। ভিসিতাসিওনের এই আতঙ্কের কারণ বাড়ির কেউ বুঝতে পারে না। ‘কেউ যদি না ঘুমায়, সেটাই তো ভালো’, খুশিমনে বলে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, ‘এভাবে আমাদের জীবনটা আরও দীর্ঘ হবে কাজে লাগানোর জন্য।’ কিন্তু ভিসিতাসিওন বুঝিয়ে বলে যে না ঘুমানো অসুখের সবচেয়ে ভীতিকর দিকটা হচ্ছে ঘুমাতে না পারাটা নয়, কারণ শরীর কোনো ক্লান্তিই বোধ করে না। ভীতিকর দিকটা হচ্ছে এর স্মৃতিবিলোপের অবশ্যম্ভাবী ক্রমবিকাশ। যা বলতে চাইছে, সেটা হচ্ছে অসুস্থ মানুষটা যখন রাত্রি জাগরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন তার শৈশবের স্মৃতিগুলো মুছে যেতে আরম্ভ করে। তারপর ভুলে যায় নিজের নাম, বস্তু সম্পর্কে ধারণা, শেষ পর্যায়ে মানুষের পরিচয়, এমনকি ভুলে যায় তার নিজস্ব সত্তা, যতক্ষণ পর্যন্ত না পরিণত হয় অতীতবিহীন এক মূর্খ প্রজাতিতে। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, হাসতে হাসতে মরে এই ভেবে যে অনেকগুলোর মতো এটাও একটা আদিবাসীদের আবিষ্কৃত কুসংস্কারগ্রস্ত ব্যাধি। যদি বা সত্য হয় এই ভেবে উরসুলা রেবেকাকে অন্য শিশুদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।

কয়েক সপ্তাহ পর, যখন মনে হচ্ছিল ভিসিতাসিওনের আতঙ্ক নিভে এসেছে, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া এক রাতে ঘুমাতে না পেরে নিজেকে আবিষ্কার করে শয্যায় গড়াগড়ি দিতে। উরসুলা নিজেও জেগেছিল বলে, প্রশ্ন করে তার কী হয়েছে। আর সে উত্তর দেয়, ‘আবার আমি প্রুদেনসিও আগিলারের কথা ভাবছি’, যদিও দুজনে এক দণ্ড ঘুমায়নি তবু পরের দিন ওরা একই কাজ করে আর বিশ্রী গত রাতটার কথা ভুলে যায়। দুপুরের খাবার সময় আউরেলিয়ানো আশ্চর্যের সঙ্গে মন্তব্য করে যে সে সারা রাত জেগে উরসুলার জন্মদিনে উপহার দেওয়ার জন্য পরীক্ষাগারে এক ব্রোচ বানিয়ে কোনো ক্লান্তি বোধ করছে না। তৃতীয় দিন পর্যন্ত ওরা সতর্ক হয় না, যতক্ষণ না দেখে শোবার সময় হলেও ঘুম আসছে না, আর তখন খেয়াল করে যে তারা নির্ঘুমে কাটিয়েছে পঞ্চাশ ঘণ্টারও বেশি সময়। ‘শিশুরাও জেগে আছে’, অদৃষ্টবাদী দৃঢ়তা নিয়ে বলে আদিবাসী মেয়েটা, ‘বাড়ির কেউই রেহাই পায় না একবার কোন বাড়িতে রোগটা ঢুকলে।’

সত্যিই অনিদ্রারোগে ধরছে ওদের, বুঝতে পারে তারা। উরসুলা তার মায়ের কাছে শিখেছিল ঔষধি গাছের উপকারিতা। আর সে আকোনিত (একজাতীয় ঔষধি গুল্ম) গাছ দিয়ে পানীয় বানিয়ে এক মাত্রা করে খাইয়ে দেয় সবাইকে। কিন্তু এতে ওরা না ঘুমিয়ে সারা দিন স্বপ্ন দেখে জাগ্রত অবস্থায়। এই মতিভ্রম, সুস্থতার স্বচ্ছ অবস্থায় ওরা শুধু যে নিজেরা নিজেদের স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি দেখছিল তা-ই নয়, এতে দেখছিল অন্যের দেখা স্বপ্নের প্রতিচ্ছবিও। এটা এমন ছিল, যেন সারা বাড়ি অতিথিতে ভরে গেছে। রান্নাঘরের কোনায় দোলচেয়ারে বসে রেবেকা স্বপ্ন দেখে যে প্রায় ওর মতোই দেখতে এক লোক, পরনে গলাবন্ধ, সোনার বোতামওয়ালা সাদা লিনেনের শার্ট, ওর জন্য নিয়ে এসেছে এক তোড়া গোলাপ, লোকটাকে সঙ্গ দিচ্ছে এক মাৰ্জিত হাতের মহিলা, যে তোড়া থেকে একটি গোলাপ আলাদা করে গুঁজে দেয় রেবেকার চুলে। উরসুলা বুঝতে পারে ভদ্রলোক আর মহিলা ছিল রেবেকার বাবা ও মা, কিন্তু অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও রেবেকা ওদের চিনতে পারে না, এমনকি দৃঢ়তার সঙ্গে নিশ্চিত করে ওদের সে কখনোই দেখে নি। সেই সময়ে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার অসতর্কতার ফলে বাড়িতে বানানো মিষ্টির জীবজন্তুগুলো গ্রামজুড়ে বিক্রি হতে থাকে, যার দরুন সে নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না। শিশুরা আর বড়রা আনন্দের সঙ্গে চুষতে থকে সবুজ মজাদার অনিদ্রার ছোট ছোট মুরগি, মজাদার গোলাপি অনিদ্রা মাছ আর সুন্দর হলুদ রঙের অনিদ্রার ছোট ছোট ঘোড়া। ফলে সোমবারের ঊষা চমকে দেয় জেগে থাকা সারা গ্রামকে। প্রথম দিকে কেউই গুরুত্ব দেয় না। উল্টো না ঘুমিয়ে সবাই খুশিই হয়, কারণ তখন সারা গ্রামে এত কাজ ছিল যে কোনোভাবেই সময়ে কুলাত না সব কাজ শেষ করার জন্য। ওরা এতই কাজ করে যে শিগগিরই করার মতো আর কিছুই থাকে না আর ভোর তিনটার সময় নিজেদের আবিষ্কার করে কিছুই না করে ঘড়িগুলোর মাত্রা গুনতে। ক্লান্তির জন্য নয় বরং ঘুমের অতীত আর্তিতে কাতর হয়ে যারা ঘুমাতে চায়, তাদের করা সব চেষ্টা বিফল হয়। ওরা একত্রিত হতো বিরতিহীন আলাপ করতে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই কৌতুক বলতে আর খাসি করা মোরগের কাহিনিটাকে জটিল বিরক্তিকর চরম সীমায় নিয়ে যাওয়ার জন্য, সেটা ছিল এক অন্তহীন খেলা, যেখানে গল্পকার প্রশ্ন করে খাসি করা মোরগের গল্প বলবে কি না, যখন ওরা জবাব দেয় হ্যাঁ, তখন গল্পকার বলে ‘হ্যাঁ’ বলতে বলে নি; প্রশ্ন করেছে তাদের সে খাসি করা মোরগের গল্প বলতে বলেছে কি না, যদি বলে না, তখন গল্পকার বলে ‘না’ বলতে বলে নি; প্রশ্ন করেছে তাদের যে খাসি করা মোরগের গল্প বলবে কি না, আর যদি চুপ করে থাকে তখন গল্পকার বলে চুপ করে থাকতে বলে নি সে; সে প্রশ্ন করেছে তাদের যে খাসি করা মোরগের গল্প বলতে বলেছে কি না, কেউ উঠে চলে যেতে পারত না কারণ যদি কেউ চলে যেতে চাইত, তখন গল্পকার বলত সে ওদের চলে যেতে বলে নি; প্রশ্ন করেছে তাদের খাসি করা মোরগের গল্প বলতে বলেছে কি না—আর এভাবেই বারবার চলতে থাকত খেলাটা, যেখানে আরম্ভ সেখানেই ফিরে আসা অব্যাহত বৃত্তের মতো।

যখন হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বুঝতে পারে যে অভিমারিটা সারা গ্রাম দখল করে নিয়েছে, তখন পরিবারের সব প্রধানকে ডেকে অনিদ্রা রোগ সম্বন্ধে তার যা জানা ছিল, তা জানায়। আর জলাভূমির অন্যান্য জনবসতিকে এই রোগের রোষানল থেকে রক্ষার জন্য সবাই মিলে কার্যক্রম ঠিক করে। এভাবেই কাকাতুয়ার সঙ্গে বদল করা ঘন্টিগুলো ছাগলের গলা থেকে খুলে গ্রামের প্রবেশপথে ঝুলিয়ে দেয় তাদের উদ্দেশে, যারা উপদেশ গ্রাহ্য না করে বা পাহারাদারদের অনুরোধ রক্ষা না করে গ্রাম ভ্রমণের জেদ করে। তখনকার সব আগন্তুককে, যারা মাকন্দের পথ অতিক্রম করত, তাদের অবস্থানের সময় খাবার বা পান করা নিষিদ্ধ ছিল। কারণ, এ ব্যাপারে কারও সন্দেহ ছিল না যে রোগটা ছড়ায় মুখ দিয়ে, আর সব খাবার এবং পানীয় কলুষিত ছিল অনিদ্রা দিয়ে। এভাবেই প্লেগটা ছিল গ্রামের সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কোয়ারানটিনটা এতই ফলপ্রসূ হয় যে এমন একদিন আসে, যখন জরুরি সময়টাই স্বাভাবিক বলে গণ্য হয় আর জীবন ও কাজের ছন্দ এমনভাবে সুসংবদ্ধ হয়ে আসে যে কেউই আর নিদ্ৰা নামের অপ্রয়োজনীয় অভ্যাসটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করে না।

আউরেলিয়ানো ছিল সেই ব্যক্তি, যে কয়েক মাসের মধ্যেই স্মৃতিবিলোপ প্রতিরোধের সূত্র আবিষ্কার করে। ঘটনাবশত ব্যাপারটা আবিষ্কার করে সে। আক্রান্ত হওয়া প্রথম কয়েকজনের একজন হওয়ায় অনিদ্রায় অভিজ্ঞ আউরেলিয়ানো শিখে ফেলে রৌপ্যকর্ম নিখুঁতভাবে। একদিন ধাতু পিটিয়ে পাতে পরিণত করার জন্য ব্যবহৃত ছোট্ট নেহাই খুঁজছিল সে। আর তার নাম মনে করতে পারছিল না। ওর বাবা বলে নেহাই। আউরেলিয়ানো এক টুকরো কাগজে নামটা লিখে নেহাইর হাতলে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেয়। এভাবেই সে ভবিষ্যতে নামটা ভুলে না যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়। জিনিসটার নামটা কঠিন বিধায় ওর তখনো মনে হয় নি যে সেটা হচ্ছে স্মৃতিবিলোপের প্রথম ঘটনা।

কিন্তু অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই বুঝতে পারে যে পরীক্ষাগারের প্রায় প্রতিটি জিনিসেরই নাম মনে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। সুতরাং যথাযথভাবে নামাঙ্কিত করে প্রতিটি জিনিসকে, যাতে শুধু বর্ণনা পড়ার ফলেই জিনিসটাকে শনাক্ত করতে পারে। যখন তার কাছে ওর বাবা ছোটবেলায় সবচেয়ে হৃদয়গ্রাহী ঘটনাগুলোও ভুলে যাওয়ার উদ্বেগ প্রকাশ করে তখন আউরেলিয়ানো তার পদ্ধতি বর্ণনা করে, আর হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ওটাকে বাস্তবে কাজে লাগায় সারা বাড়ি আর পরে আরোপ করে গ্রামে। কালিমাখানো এক বুরুশ দিয়ে প্রতিটি জিনিসকে নামাঙ্কিত করে—টেবিল, চেয়ার, ঘড়ি, দরজা, দেয়াল, বিছানা, কড়াই। খোঁয়াড়ে গিয়ে একইভাবে নামাঙ্কিত করে জীবজন্তুর আর গাছপালার—গর—, ছাগল, শূকর, মুরগি, ইউকা (মিষ্টি আলুজাতীয় একধরনের গাছের শিকড়, যা খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত), মালাংগা (গাছের শিকড়, যা দিয়ে ময়দাজাতীয় খাদ্য বানানো হয়), কলা। আস্তে আস্তে ভুলে যাওয়ার অনন্ত সম্ভাবনার কথা বিশ্লেষণ করে ওরা বুঝতে পারে যে একদিন এমন হবে, পরে জিনিসগুলোকে চিনতে পারবে।

কিন্তু মনে থাকবে না তাদের ব্যবহার। সুতরাং বর্ণনা লিখে আরও বিশদভাবে। স্মৃতিবিলুপ্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত মাকন্দবাসী গরুর গলায় যে লেখাটা ঝুলিয়েছিল, সেটা ছিল এক আদর্শ নমুনা: ‘এটা হচ্ছে গরু, প্রতি সকালে এটাকে দোয়াতে হয়, যাতে দুধের উৎপাদন হয়, আর দুধকে ফোটাতে হয় কফিতে মিশিয়ে, দুধসহ কফি বানানোর জন্য।

আর এভাবেই ওরা বাস করতে লাগল পালিয়ে যেতে থাকা এক বাস্তবতায়, কিছুক্ষণের জন্য শব্দের দ্বারা বন্দী হয়ে। কিন্তু লেখা শব্দগুলোর মূল্য বিস্মৃত হলে সেই বাস্তবতা হারিয়ে ফেলার আর কোনো বিকল্প ছিল না।

জলাশয়ে যাওয়ার রাস্তায় ঢোকার মুখে টাঙানো ছিল এক ঘোষণা, যেটাতে লেখা ছিল মাকন্দ, আর প্রধান রাস্তায় আরেকটি ছিল আরও বড় করে লেখা: ‘ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে।’

সব কটি বাড়িতেই লেখা ছিল জিনিসপত্রের আর অনুভূতি মনে রাখার সংকেত। কিন্তু প্রক্রিয়াটায় এত বেশি সতর্কতা আর নৈতিক দায়িত্বের প্রয়োজন ছিল যে অনেকেই এক কাল্পনিক বাস্তবের জাদুর দ্বারা বশীভূত হয়ে পড়ে, যা ছিল তাদের নিজেদের দ্বারাই উদ্ভাবিত; তা যতটা না বাস্তবানুগ তার চেয়ে বরং আরামপ্রদ। এই রহস্যময়তাকে আরও জনপ্রিয় করে তোলার ব্যাপারে বেশি অবদান রাখে পিলার তেরনেরা, তাস দেখে অতীত বাণী করে যেমনটা আগে করত ভবিষ্যদ্বাণী। এভাবেই অনিদ্রা রোগীরা বাস করতে শুরু করে তাস দিয়ে গড়া এক অনিশ্চয়তার বিকল্প জগতে, যেখানে আবছাভাবে বাপকে মনে রাখা হয় এপ্রিলের শুরুতে আসা এক গাঢ় রঙের পুরুষ হিসেবে, আর মাকে অস্পষ্টভাবে মনে রাখা হয় এক বাদামি রঙের মহিলা হিসেবে, যে বাঁ হাতের আঙুলে সোনার আংটি পরত, যেখানে জন্মদিন হতো : সেদিন তেজপাতাগাছে গান গেয়েছিল আলন্দ্রা পাখি। ওই সব সান্ত্বনাময় চর্চার কাছে হার মেনে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া সিদ্ধান্ত নেয় স্মৃতি-উদ্ধার যন্ত্রটা তৈরি করার, যেটাকে একবার বানাতে চেয়েছিল জিপসিদের সব আশ্চর্যজনক আবিষ্কারগুলোকে মনে রাখার জন্য। যন্ত্রটার ভিত্তি ছিল প্রতিদিন সকালে মানুষের জীবনে যত অভিজ্ঞতা আছে, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ঝালিয়ে নেওয়ার ওপর, সেটাকে কল্পনা করে একটা ঘুরন্ত অভিধান হিসেবে যেটা এক অক্ষের ওপর বসানো এবং যে কেউ ওটাকে হাতলের মাধ্যমে চালিয়ে অল্প কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় ব্যাপারগুলোকে ঝালিয়ে নেবে। যখন জলাশয়ের রাস্তা ধরে ঘুমের মানুষের করুণ ঘণ্টা বাজিয়ে, দড়ি দিয়ে বাঁধা পেট মোটা বাক্স আর কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা গাড়ি নিয়ে উদয় হয় এক অদ্ভুতদর্শন বৃদ্ধ, ততক্ষণে প্রায় চৌদ্দ হাজার তালিকা লিপিবদ্ধ হয় গেছে। সে সোজা এসে ঢোকে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার বাড়ি।

দরজা খোলার সময় ভিসিতাসিওন চিনতে পারে না, আর অনিরাময়যোগ্য বিস্তৃতির চোরাবালিতে ডুবে যাওয়া এই গ্রামে যে কিছু বিক্রি হয় না, তা অবজ্ঞা করে ভাবে, হয়তো সে কিছু বিক্রি করতে এসেছে। লোকটা ছিল ভগ্নদশাগ্রস্ত। যদিও তার গলার স্বর অনিশ্চয়তার ফলে ভাঙা ছিল; আর হাত জিনিসপত্রের অস্তিত্বে ছিল সন্দিহান, তবু নিশ্চিত যে সে এসেছে সেই পৃথিবী থেকে, যেখানে মানুষ এখনো ঘুমাতে পারে আর মনে রাখতে পারে। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ওকে পেল বৈঠক ঘরে বসা অবস্থায়, তালি দেওয়া এক কালো টুপি দিয়ে বাতাস নিচ্ছে আর মনোযোগ সহকারে অনুকম্পার দৃষ্টি দিয়ে দেয়ালে লাগানো লেখাগুলো পড়ছে। লোকটাকে পরম আন্তরিকতার সঙ্গে সম্ভাষণ জানায় এই ভয়ে যে, হয়তো অন্য সময়ে তাকে চিনত আর এখন তা মনে পড়ছে না। কিন্তু অতিথি তার এই মিথ্যা অভিনয় বুঝতে পারে। বিস্মৃতিতে হারিয়ে যাওয়া মানুষ হিসেবে নিজেকে মনে হয় তার। নিরাময়যোগ্য হৃদয় থেকে বিস্মৃতি নয়; বরং তার থেকেও নিষ্ঠুর, অনিবার্য বিস্মৃতি, যাকে সে ভালো করেই চেনে। কারণ, সেটা হচ্ছে মরণের বিস্মৃতি। সুতরাং তা সে মেনে নিল। অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব নয় এমন জিনিসে ভরা বাক্সটা খুলে তা থেকে অনেকগুলো বোতল ভরা ছোট একটা বাক্স বের করে সে। আর্কাদিও বুয়েন্দিয়াকে পান করতে দেয় এক পাণ্ডুর কয়েক ফোঁটা পদার্থ আর আলোকরশ্মি ফুটে ওঠে তার স্মৃতিতে। নামাঙ্কিত জিনিসপত্রে ভরা উদ্ভট বসার ঘরে নিজেকে দেখতে পাওয়ার আগে এবং দেয়ালে লেখা অর্থহীন শব্দগুলোর জন্য লজ্জা পাওয়ার আগেই, সর্বোপরি হতবুদ্ধিকর আনন্দের উজ্জ্বলতায় পাওয়া এই সদ্য আগত লোকটাকে চিনে ওঠার আগেই তার চোখ জলে ভিজে ওঠে। সদ্যাগত লোকটা ছিল মেলকিয়াদেস।

মাকন্দ যখন পুনরায় স্মৃতিজয়ের উৎসব যাপন করছে, তখন হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া আর মেলকিয়াদেস পুরোনো বন্ধুত্ব পুনর্জীবিত করে নেয়। জিপসি লোকটা গ্রামেই থেকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। সত্যিই মৃত ছিল সে কিন্তু একাকিত্ব সহ্য না করতে পেরে ফিরে এসেছে। নিজের লোকদের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে জীবনের প্রতি বিশ্বস্ততার শাস্তি হিসেবে অপ্রাকৃতিক সব ক্ষমতাবর্জিত মেলকিয়াদেস স্থির করে পৃথিবীর এমন এক কোনায় আশ্রয় নিতে মৃত্যু যার সন্ধান তখনো পায় নি; আর নিজেকে উৎসর্গ করে এক দাগেরোটাইপ (ধাতব পাতের ওপর অ্যাসিড দিয়ে ছবি তোলার পদ্ধতি) পরীক্ষাগারে। আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া কখনো এই আবিষ্কারের কথা শোনেনি। কিন্তু যখন সে তাকে আর তার পুরো পরিবারকে এক উজ্জ্বল ধাতব পাতের মধ্যে বন্দী হয়ে থাকতে দেখে, তখন সে বিস্ময়ে নির্বাক, নিশ্চল হয়ে পড়ে। তখনকার দিনে মরচে পড়া ধাতব পাতে যে দাগেরোটাইপ চিত্র ধারণ করা হতো, তাতে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার চুলগুলো ছিল ছাই রঙের এবং খাড়া খাড়া। শক্ত কাগজের কলারের শার্টটা আটকানো ছিল এক তামার বোতাম দিয়ে। আর মুখের ভাবে প্রকাশ পাচ্ছিল এক বিশাল গাম্ভীর্য, যাকে উরসুলা ‘এক ভীত সেনাপতি’ বলে ব্যঙ্গ করে হাসতে হাসতে মরে।

সেই স্বচ্ছ পরিষ্কার ডিসেম্বরের সকালে যখন দাগেরোটাইপটি ধারণ করা হয়েছিল, তখন সত্যি ভয় পেয়েছিল আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া। কারণ সে ভেবেছিল তারা প্রতিবারই একটু একটু করে ক্ষয় হয় ধাতব পাতে গিয়ে ঠাঁই নিয়ে। আশ্চর্যজনকভাবে উরসুলা তার চরিত্রের সম্পূর্ণ উল্টোটা করে এ ক্ষেত্রে। আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার মাথা থেকে বের করে দেয় ছবি সমন্ধে তার ভুল ধারণাকে, আর একইভাবে অতীতের তিক্ততা ভুলে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যে মেলকিয়াদেস বাড়িতেই থেকে যাবে। যদিও কখনো আর দাগেরোটাইপ করতে দেয় নি। কারণ (তার নিজের ভাষায়) সে কখনো নাতি-নাতনিদের হাসির পাত্র হয়ে থাকতে চায় না ছবিতে। সেই সকালে বাচ্চাদের পরায় সবচেয়ে ভালো জামাকাপড়, মুখে দেয় পাউডার, খাইয়ে দেয় এক চামচ মজ্জার সিরাপ, যাতে প্রায় দুই মিনিট মেলকিয়াদেসের ক্যামেরার সামনে সম্পূর্ণ অনড় হয়ে থাকতে পারে। আউরেলিয়ানোকে কালো মখমলের পোশাক পরা অবস্থায় দেখা যায় শুধু পারিবারিক দাগেরোটাইপেই; আর সেখানে সে দাঁড়িয়ে ছিল আমারান্তা আর রেবেকার মাঝখানে, ছিল সেই একই উদ্যমহীনতা, একই ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টার দৃষ্টি, যেমনটি হবে অনেক বছর পর ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে। কিন্তু তখনো সে তার ভাগ্যলিপি সম্বন্ধে কোনো পূর্বাভাস পায় নি। ওর কাজের সূক্ষ্মতার দরুন জলাভূমির চারপাশে সে পরিগণিত হয় এক দক্ষ রৌপ্যকার হিসেবে। মেলকিয়াদেসের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া উন্মত্ত পরীক্ষাগারে সে এতই নিমগ্ন থাকত যে তার নিশ্বাসেরও শব্দ পাওয়া যেত। যখন ওর বাবা আর জিপসির মধ্যে নস্ত্রাদামুসের ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে উচ্চ স্বরে তর্ক চলে ফ্লাস্ক আর বালতির কর্কশ আওয়াজ হয়, কনুইয়ের ধাক্কায় পড়ে যাওয়া সিলভার ব্রোমাইড আর অ্যাসিডের মধ্যে পিছলে পড়ে গিয়ে সৃষ্টি হয় চরম বিশৃঙ্খলার, তখন সে যেন আশ্রয় নিয়েছে এক অন্য জগতে। কাজের প্রতি এই আত্মনিমগ্ন আর যে সুনিপুণভাবে নিজের স্বার্থকে সে পরিচালনা করত, তাতে অল্প সময়ের মধ্যেই বানিয়ে ফেলে উরসুলার মজাদার মিছরির জীবজন্তু বিক্রির ব্যবসার চেয়েও বেশি টাকা। তার মতো একজন সৎ ও দস্তুরমতো পুরুষের যেকোনো মেয়ের সঙ্গে ভাব হবে না, তা ছিল একরকম অসম্ভব। সত্যিই তার কারও সঙ্গে ভাব ছিল না।

কয়েক মাস পর ফিরে আসে বিশ্বভ্রমণকারী পুরুষ হুয়ান ফ্রান্সিসকো, ফ্রান্সিসকো এল অমব্রে, যার বয়স ছিল প্রায় ২০০ বছর; আর সে নিজের রচিত গান পরিবেশন করে যেত প্রায়ই মাকন্দতে এসে। গানগুলোতে ফ্রান্সিসকো এল অমব্রে মানাউর থেকে জলাভূমি পর্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করত ঘটে যাওয়া সব গ্রামের ঘটনাবলি। আর কেউ যদি কাউকে কোনো বার্তা পাঠাতে চাইত অথবা কোনো ঘোষণা করার ইচ্ছা থাকত, তাহলে তাকে দুই পয়সা দিত, যাতে সে ঘটনাবলিকে তার খবরের সঙ্গে সংযুক্ত করে নেয়। এভাবেই ঘটনাচক্রে, ছেলে হোসে আর্কাদিও সম্বন্ধে কিছু জানা যায় কি না, এই আশায় যখন উরসুলা গান শুনছিল, জানতে পারে তার মায়ের মৃত্যুসংবাদ। ওর নাম ছিল ফ্রান্সিসকো এল অমব্রে। কারণ সে তাৎক্ষণিকভাবে রচিত সংগীতের এক দ্বৈরথে শয়তানকে হারিয়ে দেয়; আর ওর সত্যিকারের নাম কেউ কখনো জানে নি। অনিদ্রা রোগের মহামারীর সময় সে গ্রাম থেকে উধাও হয়ে যায় আর কোনো আগাম সংবাদ না দিয়ে হঠাৎ আবার এক রাতে হাজির হয় কাতরিনার দোকানে। কী ঘটছে পৃথিবীতে জানার জন্য গ্রামসুদ্ধ সবাই হাজির হয় সেখানে। এবার ওর সঙ্গে আসে এক মোটা মহিলা। এতই মোটা যে চারজন আদিবাসীর দরকার হতো ওকে দোলচেয়ারে বসিয়ে বহন করতে, আর এক অবহেলিত মুলাতো (সাদা ও কালোর দোঁআশলা) কিশোরী, যে ওকে রোদ থেকে রক্ষা করত একটা ছাতা ধরে। ওই রাতে আউরেলিয়ানো যায় কাতরিনার দোকানে। সে ফ্রান্সিসকো এল অমব্রেকে পায় গোল হয়ে থাকা একদল উৎসুক শ্রোতাদের মাঝখানে কামালেওনের (একজাতীয় গিরগিটি) মতো বসা অবস্থায়, পুরোনো বেসুরো গলায় খবর গেয়ে যাচ্ছিল গায়ানার স্যার ওয়াল্টার র‍্যালের কাছ থেকে পাওয়া সেই একই অ্যাকর্ডিয়ান বাজিয়ে আর হাঁটতে পটু সোরার (saltpeter) কারণে ফেটে যাওয়া বড় বড় পা দিয়ে তাল রেখে যাচ্ছিল। পেছনের দিকে একটা দরজা দিয়ে কিছু লোক ঢুকছিল আর বেরিয়ে যাচ্ছিল, আর তার সামনে নীরবে দোলচেয়ারে হাওয়া খাচ্ছিল সেই সম্ভ্রান্ত চেহারার মহিলা, কানে ফেল্টের (কাপড়) তৈরি একটা গোলাপ গুঁজে। কাতরিনা দর্শকদের কাছে বিক্রি করছিল গাঁজানো আখের রসে ভর্তি কাপ আর এই সুযোগে লোকদের কাছে গিয়ে হাত দিচ্ছিল এমন সব জায়গায়, যেখানে হাত দেওয়া উচিত নয়। মধ্যরাতের দিকে গরম ছিল অসহ্য। আউরেলিয়ানো খবরের শেষ পর্যন্ত শুনেও ওর পরিবারের জন্য আগ্রহজনক কিছুই পেল না। যখন সে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, তখন মহিলা তাকে হাত দিয়ে ইশারা করে—’তুইও ঢুকে যা’, বলে, ‘দাম হচ্ছে কেবল কুড়ি সেন্ট।’ আউরেলিয়ানো কিছুই না বুঝে ওর কোলের ওপর রাখা টাকার বাক্সে একটি মুদ্রা ফেলে ঢুকে যায়। কুকুরীর মতো ছোট ছোট স্তন নিয়ে মুলাতো কিশোরী নগ্ন অবস্থায় শোওয়া ছিল বিছানায়। আউরেলিয়ানোর আগেই তেষট্টিজন পুরুষের আগমন ঘটেছিল সেই ঘরে। এতবার ব্যবহারের ফলে কাদা হয়ে যেতে আরম্ভ করেছিল ঘাম আর দীর্ঘশ্বাসে মাখামাখি ঘরের বাতাস। কিশোরী মেয়েটা ভেজা চাদরটা সরিয়ে নিয়ে এক প্রান্ত ধরতে বলে আউরেলিয়ানোকে। ওটা ছিল ক্যানভাসের মতো ভারী। দুই পাশ ধরে নিংড়ে চলে দুজনে যতক্ষণ পর্যন্ত না ওটা ফিরে পায় তার স্বাভাবিক ওজন। মাদুরটাকে উল্টে দেয় ওরা আর এতে ঘাম ঝরছিল মাদুরের অন্য পাশ থেকে। আউরেলিয়ানো উদগ্র মনে চাচ্ছিল যে এই কাজটা যেন কখনোই শেষ না হয়। প্রণয়ের তাত্ত্বিক প্রক্রিয়াগুলো তার জানা ছিল, কিন্তু হাঁটু দুটোর সাহসহীনতার কারণে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না সে। যদিও কামনায় তার চামড়া জ্বলছিল আর লোমগুলো খাড়া হয়ে গিয়েছিল, তবু পেটের ভার মুক্ত করার আশু প্রয়োজনীয়তাটা কিছুতেই রোধ করতে পারছিল না। যখন মেয়েটা বিছানা পাতা শেষ করে, ওকে আদেশ দেয় নগ্ন হতে আর সে চিন্তাভাবনা ছাড়াই একটা ব্যাখ্যা দেয়—’আমাকে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমাকে বলল বিশ সেন্ট টাকার বাক্সে ফেলতে আর বলল দেরি না করতে।’ মেয়েটা তার অজ্ঞতার কথা বুঝতে পারে। ‘যদি বেরোনোর সময় আরও বিশ সেন্ট ফেলে দিস তবে আরও কিছুক্ষণ দেরি করতে পারিস’, নরম স্বরে বলে। ওর নগ্নতা ওর ভাইয়ের নগ্নতার কাছে টিকবে না, এই ধারণার লজ্জায় পীড়িত আউরেলিয়ানো নগ্ন হয়। মেয়েটার উপর্যুপরি চেষ্টা সত্ত্বেও ও বোধ করে প্রতিবারই অনাসক্তি, প্রতিক্ষণই বোধ করে ভয়ংকর একাকিত্ব। ‘আরও বিশ সেন্ট রাখব’, বলে হিমশীতল স্বরে। মেয়েটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নীরবতার সঙ্গে।

পিঠের হাড় বেরিয়ে গিয়েছিল ওর, বুকের হাড়ের সঙ্গে চামড়া ছিল এক হয়ে আর ভীষণ ক্লান্তির ফলে শ্বাস-প্রশ্বাস ছিল অনিয়মিত আর গভীর। এখান থেকে অনেক দূরে, দুই বছর আগে মোমবাতি না নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ও। আর জেগে ওঠে চারদিকে জ্বলন্ত আগুন নিয়ে। ছাইভস্মে পরিণত হয় দাদির বাড়িটা যেখানে ওর দাদি ওকে লালন করেছিল। সেই সময় থেকেই ওর দাদি বিশ সেন্টের বিনিময়ে ওকে পুরুষদের সঙ্গে শোয়ানোর জন্য নিয়ে যেত এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে, যাতে পুড়ে যাওয়া বাড়িটার দাম শোধ করতে পারে মেয়েটা। মেয়েটার হিসাব অনুযায়ী তখনো বাকি আছে প্রতি রাতে সত্তর জন পুরুষ ধরে হিসাব করে আরও দশ বছর। কারণ শুধু বাড়ির টাকাই নয়, তাকে বহন করতে হতো দুজনের যাতায়াত ভাড়া, খাবারদাবার, আর যে আদিবাসীরা দোলচেয়ার বহন করত, তাদের বেতন। যখন মহিলা দ্বিতীয়বারের জন্য দরজায় টোকা দেয়, তখন আউরেলিয়ানো কান্নার ঘোর নিয়ে বের হয়ে যায় কিছুই না করে। ওই রাতে কামনা আর করুণার মিশ্র অনুভূতি নিয়ে আউরেলিয়ানো ঘুমাতে পারে না। অনুভব করে ওকে রক্ষার আর ভালোবাসার এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা। ভোরে অনিদ্রার প্রচণ্ড অবসাদ আর জ্বর নিয়ে স্থির সিদ্ধান্ত নেয় বিয়ে করে মেয়েটাকে অত্যাচারী দাদির হাত থেকে মুক্ত করার আর প্রতি রাতে সত্তর জন লোককে যে তৃপ্তি মেয়েটা দিত, তা একা একা উপভোগ করার। কিন্তু সকাল দশটার সময় যখন সে কাতরিনার দোকানে উপস্থিত হয়েছে ততক্ষণে মেয়েটা গ্রাম থেকে চলে গিয়েছে।

সময়ই তার এই অপরিণামদর্শী ইচ্ছাটাকে প্রশমিত করে কিন্তু বেড়ে যায় তার হতাশা। এতে করে সে আশ্রয় নেয় কাজের মধ্যে। নিজের অনুপযোগিতার লজ্জা লুকাতে সিদ্ধান্ত নেয় সারা জীবন মেয়েদের সংস্পর্শহীন পুরুষ হয়ে থাকার। অন্যদিকে, মেলকিয়াদেস মাকন্দের ধারণযোগ্য সব চিত্রই তার দাগেরোটাইপে ধারণ করার কাজ শেষে দাগেরোটাইপের পরীক্ষাগার পরিত্যাগ করে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার উন্মত্ততার কাছে, যে নাকি ঈশ্বরের অস্তিত্বের বৈজ্ঞানিক প্রমাণে ওটাকে কাজে লাগাতে চায়। সে নিশ্চিত হয় যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব যদি থাকেই, তবে সুপারইম্পোজড এক্সপোজারের এক জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাড়ির নানা জায়গায় তোলা দাগেরোটাইপে ঈশ্বর ফুটে উঠবেন নতুবা চিরদিনের জন্য ঈশ্বরের অস্তিত্বের ধারণাকে সে ক্ষান্ত দেবে। নস্ত্রাদামুসের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে মেলকিয়াদেস। রংচটা মখমলের জামার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় চড়ুই পাখির পায়ের মতো সরু হাত দিয়ে হিবিজিবি এঁকে চলে কাগজের ওপর অনেক রাত পর্যন্ত, যে হাতের আংটিগুলো হারিয়ে ফেলেছে আগেকার সেই উজ্জ্বলতা। এক রাতে তার মনে এই বিশ্বাস জেগে ওঠে যে সে জেনে ফেলেছে মাকন্দের ভবিষ্যৎ। মাকন্দ হবে কাচের বাড়িঘরওয়ালা এক ঝলমলে শহর, যেখানে বুয়েন্দিয়া বংশের কোনো চিহ্নই থাকবে না। ‘এটা একটা ভুল ধারণা’, গর্জন করে ওঠে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, ‘বাড়িগুলো কাচের হবে না, হবে বরফের, আমি যেমনটি স্বপ্নে দেখেছি; আর সব সময়ই বুয়েন্দিয়ারা থাকবে, শতাব্দীর পর শতাব্দী।’ ওই উদ্ভট বাড়িতে সাধারণ মানুষের বুদ্ধিতে যা আসে, তা দিয়ে উরসুলা প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে চলে মিছরির জীবজন্তুর ব্যবসাটাকে প্রসারিত করতে। একটি চুল্লিতে সারা রাত ধরে ঝুড়ির পর ঝুড়ি পাউরুটি, বিভিন্ন ধরনের পুডিং, মেরেঙ্গে (একধরনের পিঠা) বিসকোচুয়েলস (স্পঞ্জ কেক) তৈরি হতো আর সেগুলো উধাও হয়ে যেত জলাভূমির বন্ধুর রাস্তা ধরে। এমন বয়সে সে পৌঁছেছে যে তার অধিকার ছিল অবসর নেওয়ার কিন্তু প্রতিদিনই সে আরও বেশি কাজ করত। সে এতই ব্যস্ত ছিল তার সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসা নিয়ে যে যখন এক আদিবাসী মেয়ে তাকে ময়দার তালে মিষ্টি মেশাতে সাহায্য করছে তখন, গোধূলির আলোয় সে অন্যমনস্কতার সঙ্গে দেখে অপরিচিত দুই সুন্দরী মেয়ে উঠানে এমব্রয়ডারি করছে। ওরা ছিল রেবেকা আর আমারান্তা, যারা তিন বছরব্যাপী অনমনীয় দৃঢ়তায় ধরে রাখা নানির মৃত্যুতে শোকের পোশাক কেবল ত্যাগ করছে। আর রঙিন পোশাক যেন এই পৃথিবীতে ওদের তৈরি করে দিয়েছে এক নতুন জায়গা। রেবেকা সম্বন্ধে যা ভাবা হচ্ছিল তা উল্টে দিয়ে সে ছিল অপেক্ষাকৃত সুন্দরী। ওর গায়ের রং ছিল স্বচ্ছ, চোখগুলো ছিল শান্ত আর বড় বড়। অদৃশ্য সুতো দিয়ে জাদুকরি হাতগুলো যেন বুনে চলেছে ফ্রেমের ওপর এমব্রয়ডারি কাজ। বয়সে ছোট আমারাস্তা ছিল সামান্য মাধুর্যহীন কিন্তু সে ছিল স্বভাবসুলভভাবে স্বতন্ত্র আর মনটা ছিল মৃত নদীর মতো বিশাল। ওদের সঙ্গে আর্কাদিওর মধ্যে যদিও বাপের শারীরিক গঠন প্রকাশ পাচ্ছে তবু তখনো তাকে দেখে মনে হতো শিশু। আর্কাদিও নিজেকে নিবেদন করেছিল আউরেলিয়ানোর কাছে রৌপ্যকর্ম শেখায়। এ ছাড়া আউরেলিয়ানো তাকে শেখায় লিখতে আর পড়তে। হঠাৎ করেই উরসুলা খেয়াল করে তাদের বাড়ি লোকজনে ভরে গিয়েছে, ছেলেমেয়েরা কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে করবে, তাদের বাচ্চা হবে আর জায়গার অভাবে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হবে। সুতরাং বের করে আনে অনেক দিনের কষ্টার্জিত জমানো টাকা, ক্রেতাদের সঙ্গে ব্যবসা-সংক্রান্ত বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় আর আরম্ভ করে বাড়ি বাড়ানোর কাজ। স্থির করে তৈরি করার: অতিথিদের জন্য একটা আনুষ্ঠানিক বসার ঘর, প্রতিনিয়ত ব্যবহারের জন্য আর একটা বসার ঘর যেটা আরও বেশি শীতল ও আরামপ্রদ, বাড়ির সবাই, অতিথিসহ একসঙ্গে বারোজন লোকের বসার ব্যবস্থা থাকা খাবার টেবিল-সমেত খাবার ঘর, উঠানের দিকে জানালাসমেত নয়টা শোবার ঘরের মধ্যদিনের রৌদ্রের তীক্ষ্ণতা থেকে আড়াল করতে গোলাপের বাগান দিয়ে ঘেরা টানা বারান্দা আর ফার্ন ও বেগোনিয়ার টব রাখার জন্য চওড়া রেলিংয়ের। স্থির করে রান্নাঘরটাকে আরও বড় করার, যাতে দুটো চুল্লি এঁটে যায় ভেতরে; যে খামারে পিলার তেরনেরা হোসে আর্কাদিওর হাত দেখেছিল সেটাকে ধ্বংস করে দ্বিগুণ বড় করতে, যাতে কখনোই বাড়ির খাবারের কোনো অভাব হবে না। উঠানে চেস্টনাটগাছের তলায় বানানো আরম্ভ হলো একটা মেয়েদের গোসলখানা, অন্যটি পুরুষদের; একেবারে পেছন দিকে সুপরিসর আস্তাবল, তার দিয়ে ঘেরা মুরগির খোঁয়াড়; দুধ দোয়ানোর গোয়াল আর চতুর্দিকে খোলা পাখির আবাসস্থল, যাতে নির্দিষ্ট জায়গায় সব সময় না থেকে নিজেদের খুশিমতো যেখানে-সেখানে থাকতে পারে পাখিগুলো। সে ডজন খানেক রাজমিস্ত্রি আর কাঠমিস্ত্রিদের আলো আর উত্তাপের অবস্থান নির্দিষ্ট করে দিয়ে সবকিছুর জায়গা ভাগ করে দেয় সীমাহীনভাবে, যেন স্বামীর চিত্তবিভ্রম তার ওপর ভর করেছে। পত্তনকারীদের প্রকৌশলের প্রাথমিক পর্যায়ে নির্মিত ভবনটা ভরে ওঠে যন্ত্রপাতি আর মালপত্রে, ঘেমে-নেয়ে ওঠা আর মানুষের হাড়ের নিঃশব্দ ঝংকারে সব জায়গায় ধাবিত হওয়া মজুরে, যারা নিজেরাই সবাইকে বিরক্ত করছে, সেটা চিন্তা না করে সবাইকে বলছে তাদের বিরক্ত না করতে। সেই অস্বস্তিকর অবস্থায়, কেউ ভালো করে বুঝতে পারে না কীভাবে চুন আর আলকাতরা নিশ্বাস নিতে নিতে মাটি থেকে আশ্চর্যজনকভাবে গড়ে উঠেছে শুধু গ্রামের সবচেয়ে বড় বাড়িই নয় বরং সব জলাভূমির মধ্যে সবচেয়ে বড়, অতিথিপরায়ণ আর ঠান্ডা বাড়ি, যে রকমটি আর কখনোই বানানো হবে না। আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বুঝতে পারে সবচেয়ে কম, কারণ সে তখন বিশাল ওলট-পালটের মাধ্যমে স্বর্গীয় দূরদর্শিতাকে চমকে দিতে ব্যস্ত। বাড়িটা যখন প্রায় শেষের দিকে তখন উরসুলা একদিন আর্কাদিও বুয়েন্দিয়াকে তার অবাস্তব পৃথিবী থেকে বের করে এনে জানায় যে ওরা বাড়িটার সামনে সাদা রং করতে স্থির করেছিল, কিন্তু সেটা না করে নীল রং করার আদেশ এসেছে। ওকে দেখায় সরকারি এক কাগজে লেখা আদেশনামাটা। বউ কী বলছে না বুঝতে পেরে স্বাক্ষরটা পড়ে সে।

‘কে এই লোকটা’, জিজ্ঞেস করে।

‘ম্যাজিস্ট্রেট’, ক্রোধান্বিত উরসুলা জবাব দেয়, ‘সবাই বলে যে সে হচ্ছে কর্তৃপক্ষ, যাকে সরকার পাঠিয়েছে।’ ম্যাজিস্ট্রেট, দন আপলিনার মসকতে মাকন্দে আসে বিশেষ কোনো ঘোষণা না করে। এসে প্রথম রাত কাটায় বিভিন্ন হাবিজাবি জিনিসের বিনিময়ে ম্যাকাও পাখি নেওয়া আরবদের একজনের বানানো; হোটেল দে জ্যাকবে। আর পরের দিন ভাড়া নেয় বুয়েন্দিয়ার বাড়ি থেকে দুই ব্লক দূরে রাস্তার দিকে দরজাওয়ালা ছোট এক কামরা। জ্যাকব থেকে কেনা একটা টেবিল আর চেয়ার বসায় সেখানে, দেয়ালে তারকাটা গেঁথে লাগায় ওর সঙ্গে আনা প্রজাতন্ত্রের ফলকটা আর কালি দিয়ে দরজায় লেখে ‘ম্যাজিস্ট্রেট।’ তার প্রথম আদেশ ছিল জাতীয় স্বাধীনতাবার্ষিকী উপলক্ষে সব বাড়ি নীল রং করার। আদেশনামাটা হাতে নিয়ে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ওকে পেল তার ছোট অফিসের মধ্যে ঝুলন্ত এক দোলবিছানায় দিবানিদ্রায় মগ্ন অবস্থায়। ‘তুমি লিখেছ এটা’, জিজ্ঞেস করে। অভিজ্ঞ, লাজুক কিন্তু রাগে লাল হয়ে যাওয়া চেহারার দন আপলিনার মসকতে জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ’। ‘কোন অধিকারে?’ আবার জিজ্ঞেস করে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া। দেরাজ থেকে একটা কাগজ খুঁজে বের করে দেখিয়ে বলে, ‘আমাকে নিয়োগ করা হয়েছে এই গ্রামের ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে।’ হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া এমনকি দেখেও না কাগজটা, ‘এই গ্রামে আমরা কেউ কাগজ দিয়ে আদেশ দিই না’, শান্তভাবে নিয়ন্ত্রণ না হারিয়ে বলে, ‘প্রথম আর শেষবারের মতো বলে দিচ্ছি যে এখানে ম্যাজিস্ট্রেটের কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ এখানে শোধরানোর মতো কিছু নেই।’ দন আপলিনারের ভয়হীন দৃষ্টির সামনে কখনোই গলা উঁচু না করে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনা করে কীভাবে গ্রাম পত্তন করেছে, কীভাবে জমি বিলি করেছে, কীভাবে রাস্তা বের করেছে আর গ্রামের অন্যান্য উন্নতি করেছে সরকারকে কোনো বিরক্ত না করে আর কারও দ্বারা কোনো রকম ত্যক্ত না হয়ে। ‘আমরা এতই শান্তিপূর্ণভাবে বাস করছি যে এখন পর্যন্ত আমাদের কেউই স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে নি। বলল, ‘দেখেছ এখনো আমাদের কোনো কবরস্থান নেই। ‘সরকার যে তাদের সাহায্য করে নি, তাতে তাদের কোনো কষ্টই হয় নি, বরং আনন্দিত হয়েছে কারণ তখন পর্যন্ত ওদের শান্তির সঙ্গে বেড়ে উঠতে দিয়েছে। আর আশা করছিল এভাবেই ওদের বেড়ে উঠতে দেওয়া হবে, কারণ ওরা এমন কোনো গ্রামের পত্তন করে নি, যেখানে প্রথম আগন্তুক এসেই বলে দিতে পারবে কোথায় কী করতে হবে। প্যান্টের মতোই সাদা ডেনিমের কোট পরিহিত দন আপলিনার মসকতে সব সময়ই তার অভিব্যক্তিতে পবিত্রতা বজায় রেখে চলছিল। ‘সুতরাং, যদি অন্য যেকোনো সাধারণ নাগরিকের মতো এখানে থাকতে চাও, তাহলে তোমাকে স্বাগতম’, ইতি টেনে বলে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, ‘কিন্তু যদি লোকজনের বাড়ি নীল রং করতে বাধ্য করিয়ে বিশৃঙ্খলা বাধাতে চাও, তাহলে তোমার তল্পিতল্পা গুটিয়ে যেখান থেকে এসেছ, সেখানে ভাগতে পারো, কারণ আমার বাড়ি হবে কবুতরের মতো সাদা।’ পাণ্ডর বর্ণ ধারণ করে দন আপলিনার মসকতে। এক পা পেছনে হেঁটে চোয়াল শক্ত করে কাতরতার সঙ্গে বলে, ‘তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি যে আমার কাছে অস্ত্র আছে।’ হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া টেরও পেল না কখন তার হাতে যুবক বয়সের ঘোড়া বশ করার শক্তি এসে ভর করে। দন আপলিনার মসকতের কোটের বুকের সামনের অংশটা ধরে তাকে নিজের চোখের উচ্চতায় তুলে ফেলে। ‘এটাই করব’ বলে, ‘কারণ আমার বাকি সারা জীবন, মৃত অবস্থায় তোমাকে বহন করার চেয়ে জীবিত বহন করাটাই শ্রেয় বলে মনে করি।’ এভাবেই বুকের সামনেটা আঁকড়ে ধরে বয়ে নিয়ে যায় রাস্তার মাঝখান পর্যন্ত আর ছেড়ে দেয়, যাতে তার পা দুটো জলাভূমিতে যাওয়ার রাস্তাটা স্পর্শ করতে পারে। এক সপ্তাহ পরে খালি পা ও জীর্ণ বস্ত্রের ছয়জন শটগানধারী সৈন্য নিয়ে ফিরে আসে সে। সঙ্গে ছিল তার স্ত্রী আর সাত মেয়ে বহনকারী গরুর গাড়ি। মাকন্দের পত্তনকারীরা ওদের বেড়ে ওঠা ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে অনুপ্রবেশকারীদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্তে নিশ্চিত হয়ে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়াকে সাহায্যের ইচ্ছা জানায়। কিন্তু সে তার বিরোধিতা করে, কারণ দন আপলিনার মসকতে ফিরে এসেছে তার বউ ও মেয়েদের নিয়ে, একজন পুরুষমানুষকে তার পরিবারের সামনে অপ্রস্তুত করা পুরুষোচিত কাজ নয়। আর এই কারণেই সিদ্ধান্ত নেয় ব্যাপারটা ভালোয় ভালোয় মিটিয়ে ফেলতে।

এবার আউরেলিয়ানো তার সঙ্গী হয়। তখন কেবল তার সুচালো গোঁফ গজিয়েছে, গলার স্বর হয়েছে গমগমে, আর এগুলোই যুদ্ধের সময় তাকে এনে দেবে বৈশিষ্ট্য। গার্ডদের অগ্রাহ্য করে খালি হাতে অফিসের বারান্দায় উপস্থিত হয় ওরা। দন আপলিনার মসকতে ধৈর্য হারায় না। ঘটনাক্রমে ওইখানে থাকা তার দুই মেয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, ষোলো বছরের আমপারো, মায়ের মতোই শ্যামলা আর রেমেদিওস, বয়স কেবল নয় হয়েছে; লিলি ফুলের মতো গায়ের রং আর সবুজ চোখ নিয়ে খুব সুন্দরী এক কিশোরী। ওরা ছিল আনন্দোচ্ছল আর শিক্ষিত। যখন ঘরে ঢোকে, পরিচয়পর্বের আগেই মেয়ে দুটো চেয়ার এগিয়ে দেয় বসার জন্য কিন্তু ওরা উভয়েই দাঁড়িয়ে থাকে। ‘ঠিক আছে বন্ধু’ বলে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, ‘তুমি এখানে থাকতে পারবে কিন্তু দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ওই শটগানধারী দস্যুদের কারণে নয়, তোমাকে থাকতে দিচ্ছি তোমার বউ আর মেয়েদের কথা বিবেচনা করে।’

দন আপলিনার মসকোতে বিচলিত হয়ে পড়ে কিন্তু তাকে উত্তর দেওয়ার সময় দেয় না হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, ‘শুধু দুটো শর্ত আরোপ করছি’ যোগ করে, ‘প্রথমটি হচ্ছে সবাই যার যার ইচ্ছেমতো নিজেদের বাড়ি রং করবে। দ্বিতীয়টি সৈনিকদের চলে যেতে হবে এই মুহূর্তেই, আমরা শৃঙ্খলার নিশ্চয়তা দিচ্ছি।’ ম্যাজিস্ট্রেট তার ডান হাত উঁচু করে সব কটি আঙুল বিস্তৃত করে।

‘সম্মানের শপথ।’

‘শত্রুর শপথ’, বলে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া আরও তিক্ত স্বরে যোগ করে, ‘কারণ, একটা কথা তোমাকে বলতে চাই, তুমি আর আমি পরস্পরের শত্রুই থাকছি।’

সেই বিকেলেই বিদায় নেয় সৈন্যরা। কয়েক দিন পরই ম্যাজিস্ট্রেটের পরিবারের জন্য একটা বাড়ি জোগাড় করে দেয় আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া। আউরেলিয়ানো ছাড়া সবাই শান্তি পায়। ম্যাজিস্ট্রেটের ছোট মেয়ে, বয়সের তুলনায় যে নাকি আউরেলিয়ানোর মেয়ে হতে পারত, সেই রেমেদিওসের প্রতিচ্ছবি আউরেলিয়ানোর শরীরের কোনো এক জায়গায় ব্যথার সৃষ্টি করতে থাকে। যেটা ছিল এক শারীরিক অনুভূতি, যেন জুতোর ভেতরে ছোট্ট এক নুড়িপাথর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *