নিঃসঙ্গতার একশ বছর – ১

বহু বছর পর, ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মনে পড়ে যাবে সেই দূর বিকেলের কথা, যেদিন তার বাবা তাকে বরফ চেনাতে নিয়ে গিয়েছিল। তখন মাকন্দ ছিল প্রাগৈতিহাসিক ডিমের মতো প্রকাণ্ড, মসৃণ আর সাদা পাথরের পাশ দিয়ে বয়ে-চলা কাকচক্ষু নদীর পাশে মাটি আর নল দিয়ে তৈরি কুড়িটি বাড়ির এক গ্রাম আর পৃথিবী ছিল এতই নতুন যে বহু কিছুই ছিল নামের অপেক্ষায়, আর সেগুলোর উল্লেখ করতে হলে বুঝিয়ে দিতে হতো আঙুলের ইশারায়। প্রতিবছর মার্চে ছন্নছাড়া এক জিপসি পরিবার গ্রামের পাশে তাঁবু খাটাত আর বাঁশি খোল-করতালের হল্লা তুলে দেখিয়ে বেড়াত নিত্যনতুন সব আবিষ্কার। প্রথমবার তারা আনে চুম্বক। বাবুই পাখির পায়ের মতো সরু লিকলিকে হাতওয়ালা দশাসই চেহারার ও বেয়াড়া রকমের দাড়ি-গোঁফওয়ালা জিপসি মেলকিয়াদেস দেখিয়েছিল এক জবরদস্ত প্রদর্শনী, যা ওর মতে মেসিদোনিয়ার আলকেমিদের আবিষ্কৃত অষ্টম আশ্চর্য। সেই ধাতবপিণ্ড টানতে টানতে বাড়ি বাড়ি যায় সে আর গামলা, পাইলা, কড়াই, চুলা আর আংটাগুলো সব যার যার জায়গা থেকে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এসে সবাইকে তাজ্জব করে দেয়। ক্যাঁচকেঁচিয়ে ওঠে ক্রু-পেরেকগুলো বেরিয়ে না আসতে পারার যন্ত্রণায়, এমনকি বহু দিন আগে থেকে খুঁজে না পাওয়া জিনিসগুলো বেরিয়ে আসে একই জায়গা থেকে, যেখানে সবচেয়ে বেশি খোঁজা হয়েছিল, আর জাদুকরি লোহার পেছনে সব টানতে টানতে জিপসিদের অপরিশীলিত উচ্চারণে মেলকিয়াদেস ঘোষণা করে, ‘সব জিনিসেরই নিজস্ব প্রাণ আছে; এ হচ্ছে কেবল ওদের আত্মাকে জাগিয়ে তোলার ব্যাপার।

হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার কল্পনার কাছে হার মানত প্রকৃতির উদ্ভাবন, এমনকি অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপার বা জাদুর ভেলকি। ওর কাছে মনে হলো অকেজো এই আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর পেট থেকে সোনা তোলা যাবে। সৎ মানুষ মেলকিয়াদেস ওকে সতর্ক করে, ‘এ কাজে ওটা লাগবে না।’

কিন্তু হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তখন জিপসিদের সততায় বিশ্বাসী ছিল না, ফলে নিজের খচ্চর ও এক জোড়া ছাগলের বদলে কিনে চুম্বকপিণ্ড দুটো। ওর বউ উরসুলা ইগুয়ারান, যার ভরসা ছিল জন্তুগুলো দিয়ে পালটাকে বাড়িয়ে তোলা, সে তাকে নিবৃত করতে পারে না।

‘শিগগিরই এত সোনা হবে যে সারা বাড়ি মুড়ে ফেলার পরও আরও বেঁচে থাকবে’, স্বামী উত্তর দেয়। ওর ধারণার সত্যতা প্রমাণের জন্য পরের কয়েক মাস সে প্রচুর খাটে। উচ্চ স্বরে মেলকিয়াদেসের মন্ত্র জপতে জপতে এলাকার প্রতি ইঞ্চি চষে ফেলে, এমনকি নদীটার তলা পর্যন্ত। এতে একমাত্র সে তুলতে পারে লাউয়ের খোলের মতো ফাঁপা, পাথরে ভর্তি পঞ্চদশ শতকের এক বর্ম, যার প্রতি অংশ মরিচা ধরা টুকরো দিয়ে জোড়া দেওয়া। যখন হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ও তার অভিযানের চার সঙ্গী বর্মটাকে খুলে ফেলতে পারে, তখন আবিষ্কার করে তামার লকেট গলায়, চুন হয়ে যাওয়া এক নরকঙ্কাল আর লকেটের ভেতরে মহিলার একগোছা চুল

মার্চে ফিরে আসে জিপসিরা। এবার তারা নিয়ে আসে আমস্টারডামের ইহুদিদের সর্বশেষ আবিষ্কার, একটা দুরবিন আর বড় গোলাকৃতির এক আতশ কাচ। গাঁয়ের এক মাথায় এক জিপসি মেয়েকে বসিয়ে অন্য মাথায় তাঁবুতে লাগায় ওরা দুরবিনটাকে। পাঁচ রেয়ালের বদলে লোকজন চোখ লাগাতে পারত দুরবিনটায় আর মেয়েটাকে দেখতে পাওয়া যেত এক হাত দূরত্বে। ‘বিজ্ঞান দূরত্বকে নিকেষ করেছে’, মেলকিয়াদেস ঘোষণা করে, ‘শিগগিরই লোকে ঘর থেকে না বেরিয়েই দেখতে পাবে পৃথিবীর সর্বত্র কী হচ্ছে।

এক রৌদ্রতপ্ত দুপুরে প্রদর্শিত হয় বিশাল সেই কাচ দিয়ে এক আশ্চর্য ঘটনা; রাস্তার মাঝে এক গাদা খড় রেখে সূর্যরশ্মি কেন্দ্রীভূত করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, তখনো চুম্বকের ব্যর্থতার সান্ত্বনা পায় নি, তবু এই নতুন আবিষ্কারটাকে হাতিয়ার হিসেবে লাগানোর এক বুদ্ধি এসে যায় তার মাথায়। আবার তাকে বিরত করার চেষ্টা করে মেলকিয়াদেস। কিন্তু আতশ কাচের বদলে সেই চুম্বকপিণ্ড দুটো আর তিনটে ঔপনিবেশিক যুগের স্বর্ণমুদ্রা গ্রহণ করতেই হয় তাকে।

হতাশায় কেঁদে ফেলে উরসুলা। স্বর্ণমুদ্রাগুলো ছিল ওর বাবার বঞ্চিত জীবনের সিন্দুকে জমানো ভান্ডারের একাংশ, যা উরসুলা বিছানার নিচে মাটিতে পুঁতে রেখেছিল কোনো এক জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, এমনকি স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেওয়ারও প্রয়োজনবোধ করে না, আর নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করে কৌশলগত পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। সূর্যরশ্মি কেন্দ্রীভূত হয়ে শত্রুসেনার ওপর কী রকম কাজ করে, তা দেখার জন্য নিজের গা পুড়িয়ে ফেলে, যা সারতে তার অনেক সময় লেগে যায়। এই বিপজ্জনক আবিষ্কারের ভয়ে ভীত স্ত্রীর সব প্রতিবাদ ও সতর্কতা সত্ত্বেও সে প্রায় বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছিল। তার নতুন এই হাতিয়ারের কৌশলগত সম্ভাবনা নিয়ে হিসাব-নিকাশ করে কাটিয়ে দেয় দীর্ঘসময় নিজের কক্ষে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তৈরি করতে সফল হয় শিক্ষণীয় এক আশ্চর্য স্বচ্ছ নির্দেশিকা, আর অর্জন করে এক দুর্দমনীয় আত্মবিশ্বাস পরীক্ষা- নিরীক্ষার প্রমাণ, আর বিভিন্ন বর্ণনামূলক অঙ্কন, যা সে পাঠিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষের হাতে।

পাহাড় ডিঙিয়ে জলাভূমিতে পথ ভুলে, পায়ে হেঁটে খরস্রোতা নদী পেরিয়ে প্লেগ, হতাশা আর বন্য জন্তুর উৎপাতে প্রায় খরচের খাতায় চলে যেতে যেতে বেঁচে যাওয়া ডাক-বওয়া খচ্চরগুলোর পথের দিশা পেয়ে, রাজধানী পর্যন্ত যাওয়া সে সময় প্রায় অসম্ভব ছিল। তথাপি হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া দিব্যি করে বসে যে সরকারি হুকুম পেলেই সে রওনা হয়ে যাবে। হাতে-কলমে সামরিক কর্তৃপক্ষকে সৌরযুদ্ধের জটিল বিদ্যায় প্রশিক্ষিত করে তুলবে। তারপর অনেক বছর সে জবাবের আশায় থাকে। শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত হয়ে মেলকিয়াদেসকে নিজের উদ্যোগের ব্যর্থতার কথা দুঃখ করে জানায়। এই সময় জিপসি ওকে সততার প্রমাণ হিসেবে আতশ কাচের বদলে ফিরিয়ে দেয় পিণ্ড দুটো আর কিছু পর্তুগিজ মানচিত্রসহ নৌ চালনার যন্ত্রপাতি। সঙ্গে ছিল নিজ হাতে লেখা সাধু এরমানের পরীক্ষার সংক্ষিপ্তাকার, যাতে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া অ্যাস্ট্রল্যাব দিগ্‌দর্শনযন্ত্র আর সেক্সট্যান্ট- টাকে কাজে লাগাতে পারে। তারপর বর্ষার লম্বা মাসগুলো সে কাটিয়ে দেয় বাড়ির ভেতর দিকটায় ছোট একটা ঘরে, যাতে কেউ তার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বিঘ্ন ঘটাতে না পারে। সংসারের সব দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে কাটিয়ে দেয় রাতের পর রাত আঙিনায় তারাদের গতি অনুসরণ করে। সঠিক মধ্যদুপুর বের করার পদ্ধতি আবিষ্কারের চেষ্টায় আরেকটু হলে সর্দি লেগে যেত তার। যখন সে যন্ত্রগুলো ব্যবহারে পটু হয়ে ওঠে, তখন স্থান-কাল সম্বন্ধে তার এমন ধারণা হয় যে ঘর থেকে না বেরিয়েই সে অচেনা সাগরে পথ চলার, মনুষ্যহীন অঞ্চলে ভ্রমণের আর অসাধারণ সব মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষমতা পেয়ে যায়। এটা ছিল এমন সময়, যখন সে বাড়িময় ঘুরে ঘুরে কাউকে গ্রাহ্য না করে নিজের সঙ্গেই কথা বলত আর এদিকে উরসুলা ও ছেলেরা তখন খেটে যাচ্ছিল কলা, কচু, মিষ্টি আলু, কচুর ছড়া, মিষ্টিকুমড়া আর বেগুনখেতে। কোনো রকম পূর্বাভাস ছাড়াই হঠাৎ তার কাজের নেশা বাধাপ্রাপ্ত হয়; আর তার বদলে আসে একধরনের মুগ্ধতা। অনেক দিন কেটে যায় ঘোরে-আক্রান্ত মানুষের মতো নিম্ন স্বরে আশ্চর্য সব ছড়া জপতে জপতে, যেগুলো ছিল তার নিজেরই বোধের অগম্য।

অবশেষে ডিসেম্বরের এক মঙ্গলবার, সকালে খাবার সময় আচমকা বের করে দেয় ওর ভেতরের সব চিন্তার ঘূর্ণিপাক। বাচ্চারা বাকি জীবন মনে রাখবে কী মহান গাম্ভীর্য নিয়ে ওদের বাবা টেবিলের মাথায় বসে, জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে ঘোষণা করে তার দীর্ঘ রাত জেগে কল্পনায় আবিষ্কারের কথা: ‘পৃথিবীটা কমলালেবুর মতো গোল।’

উরসুলা ধৈর্য হারিয়ে ফেলে—’যদি তুমি পাগল হয়ে থাকো, তাহলে একাই হও’ চিৎকার করে—’কিন্তু তোমার জিপসি চিন্তার সঙ্গে বাচ্চাদের জড়ানোর চেষ্টা কোরো না।’ ক্রোধের বশে অ্যাস্ট্রোল্যাবটা মেঝেতে ছুড়ে ভেঙে ফেলার পরও নির্বিকার হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া স্ত্রীর ধৈর্যহীনতায় মোটেই ভড়কে যায় না। সে আর একটা তৈরি করে আর নিজের ছোট কামরায় গ্রামের লোকদের জড়ো করে তাদের চোখের সামনে তুলে ধরে অবোধ্য এই সম্ভাবনা, যে পুব দিক বরাবর একটানা জাহাজ চালিয়ে গেলে তা আবার উৎসেই ফিরে আসবে। গায়ের লোকজন যখন হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার পাগল হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত, তখনই সবকিছু স্বাভাবিক করার জন্য ফিরে আসে মেলকিয়াদেস। বিশুদ্ধ জ্যোতির্বিদ্যাকে শুধু অনুমান দ্বারা সে এমন এক তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছে, যা বাস্তবে প্রমাণিত, যদিও মাকন্দ-এ তা ছিল অজানা। সে সবার সামনে তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে আর মুগ্ধতার নজির হিসেবে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়াকে উপহার দেয় এক আলকিমিয়ার পরীক্ষাগার, যা ভবিষ্যতে এ গ্রামের ওপর বিশাল প্রভাব ফেলবে।

সেই সময় আশ্চর্য দ্রুততায় বুড়ো হয়ে গিয়েছিল মেলকিয়াদেস। ওর প্রথম দিককার সফরের সময় মনে হতো সে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ারই বয়সী। তখনও দুই কান ধরে একটা ঘোড়াকে ধরাশায়ী করার মতো প্রবল শক্তিকে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া নিজের শরীরে ধরে রাখলেও জিপসিটাকে দেখে মনে হতো কোনো এক নাছোড় রোগে সে কাবু হয়ে গেছে। এ ছিল আসলে পৃথিবীর চারদিকে তার অগণিত ভ্রমণের সময় বিরল সব রোগ বাধানোর ফল। পরীক্ষাগারটা গড়ে তুলতে সাহায্য করার সময় নিজেই হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়াকে সে বলে যে মৃত্যু ওকে তাড়া করেছে সর্বত্র, শেষ থাবা বসানোর সিদ্ধান্ত না নিলেও তার গন্ধ শুঁকে বেড়িয়েছে ঠিকই। মানবজাতিকে তাড়িয়ে বেড়ানো যত সব মহামারি আর বিপদ-আপদের হাত থেকে পালানো ফেরারির মতো ছিল সে। পারস্যে পেলাগ্রা রোগ, মালয় দ্বীপপুঞ্জের স্কার্ভি, আলেকজান্দ্রিয়ার কুষ্ঠ, জাপানের বেরিবেরি, মাদাগাস্কারের বুবনিক প্লেগ, সিসিলির ভূমিকম্প তার ম্যাগিলান প্রণালির জাহাজডুবি থেকে বেঁচে গিয়েছিল সে। নস্ত্রাদামসের মূল রহস্যগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বলে কথিত এই অদ্ভুত লোকটি ছিল বিষাদগ্রস্ত, বিষণ্ণতার বলয়ে ঢাকা, আর চেহারা-সুরত ছিল এশীয় ধরনের, যাকে দেখলে মনে হতো যেন ঘটনার অজানা দিকগুলোও তার জানা। কাকের ডানার মতো বিস্তৃত কালো রঙের এক বিশাল টুপি পরত সে, আর গায়ে চড়ানো থাকত শতাব্দীর দাগ কাটা সবুজ, উজ্জ্বল এক মখমলের কুর্তা। বিপুল জ্ঞান আর রহস্যময় ব্যাপ্তি সত্ত্বেও তার মধ্যে এক মানবিক দায়ভার ছিল, এক পার্থিব দশার কারণে দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাটো সমস্যাগুলো তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখত, অনুযোগ করত বয়সজনিত ব্যথা নিয়ে, ভুগত একেবারেই গুরুত্বহীন আর্থিক নানা ঝামেলায়, আর স্কার্ভির কারণে দাঁতগুলো পড়ে যাওয়ায় হাসা বন্ধ করে দিয়েছিল সে অনেক আগেই। সেই রুদ্ধশ্বাস দুপুরে যখন সব গোপন কথা ফাঁস করছিল সে, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তখন নিশ্চিত হলো যে সেই সময়টাই ছিল এক মহান বন্ধুত্বের সূচনা। শিশুরা চমৎকৃত হতো তার উদ্ভট গল্প শুনে। আউরেলিয়ানোর বয়স তখন পাঁচের বেশি হবে না। আউরেলিয়ানো পরবর্তী জীবনে সেই বিকেলে লোকটাকে যেভাবে দেখেছে তার সবকিছু মনে রাখবে। জানালা থেকে আসা ধাতব শব্দ আর মৃদু আলোর বিপরীতে বসে তার গলা থেকে উঠে আসা প্রগাঢ় শব্দ দিয়ে যা উজ্জ্বল করছে কল্পনার সবচেয়ে কালো অঞ্চলগুলোকে; ততক্ষণে তার কপালের দুই রগ বেয়ে পড়ছে গরমে গলে পড়া চর্বি। ওর বড় ভাই হোসে আর্কাদিও, সেই বিস্ময়কর প্রতিমাকে এক বংশানুক্রমিক স্মৃতি হিসেবে তুলে দিয়ে যাবে তার সমস্ত উত্তরপুরুষের হাতে। অন্যদিকে, উরসুলা সেবারের সফরের মন্দ স্মৃতিটাই কেবল মনে রেখেছে; কারণ, সে ঘরে ঢোকার সময় মেলকিয়াদেস বেখেয়ালে পারদের একটা গ্লাস ভেঙে ফেলে।

‘এ তো শয়তানের গন্ধ’, বলে উরসুলা।

‘একদমই নয়’, শুধরে দিয়ে মেলকিয়াদেস বলে, ‘সবাই জানে শয়তানের মধ্যে রয়েছে গন্ধকের গুণ আর এটা তো সামান্য এক ক্ষয়কারী পদার্থ ছাড়া বেশি কিছু নয়।’

সারাক্ষণ নীতিবাগীশ মেলকিয়াদেস সিঁদুর বর্ণের পদার্থের নারকীয় গুণ সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে বসে, কিন্তু উরসুলা তাতে কান দেয় না, বরং বাচ্চাদের নিয়ে যায় প্রার্থনায়। ওই কামড় বসানো গন্ধ মেলকিয়াদেসের স্মৃতির সঙ্গে এক হয়ে সব সময় তার মনে গেঁথে থাকবে। অসম্পূর্ণ পরীক্ষাগারে বাসনকোসন, ফানেল, বকযন্ত্র, ফিল্টার ও ছাঁকনির কথা বাদ দিলেও তাতে ছিল সরু গলাওয়ালা এক লম্বা কাচের টেস্টটিউব, এক নকল পরশপাথর, আর মারিয়া দে হুদিয়ার সর্বাধুনিক সূত্রানুযায়ী জিপসিদের নিজ হাতে বানানো এক তে-হাতা পাতন যন্ত্র। এ ছাড়া মেলকিয়াদেস রেখে যায় সাত গ্রহের সঙ্গে সম্পর্কিত সাতটি ধাতুর নমুনা, আর সোনা দ্বিগুণ করার জন্য মুসা ও জোসিমার সূত্রাবলি। আর পরশপাথর বানাতে আগ্রহী কেউ যাতে এসবের অর্থোদ্ধার করতে পারে, সে জন্য মহতী শিক্ষার পদ্ধতির বিষয়ে একগুচ্ছ টীকা-টিপ্পনী ও নকশা। সোনার পরিমাণ দ্বিগুণ করার প্রক্রিয়ার সহজতায় প্রলুব্ধ হয়ে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া কয়েক সপ্তাহ ধরে ধরনা দেয় উরসুলার কাছে ঔপনিবেশিক আমলের স্বর্ণমুদ্রাগুলো মাটি খুঁড়ে তোলার জন্য, যাতে সে সোনার পরিমাণ ইচ্ছেমতো বাড়াতে পারে। সব সময়ের মতো এবারও উরসুলা হার মানে স্বামীর ক্রমাগত তাগাদার কাছে। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তিরিশটি স্বর্ণমুদ্রা, তামার গুঁড়ো, হরিতাল, গন্ধক আর সিসা এক কড়াইতে রেখে গলিয়ে ফেলে। ওগুলোকে এরপর এক পাত্র রেড়ির তেলে গনগনে আগুনে জ্বাল দিতে থাকে, যতক্ষণ না সেটা এক ঘন তরল পদার্থে পরিণত হয়, যা দেখতে সোনার উজ্জ্বলতার চেয়ে বরং কদর্য মিঠাইয়ের গাদের মতো। এই ঝুঁকিবহুল আর অসহিষ্ণু পাতনের পদ্ধতির কারণে নির্বিকার পারদ, গ্রহযুক্ত সপ্ত ধাতু, সাইপ্রাসের কাচ মুলোর তেলের অভাবে উপর্যুপরি শুয়োরের তেলে রন্ধনের ফলে উরসুলার মূল্যবান উত্তরাধিকার পরিণত হয় কয়লা হয়ে যাওয়া শুয়োরের চামড়ার মতো এক পদার্থে, যা নাকি পাত্রের তলা থেকে আর আলাদা করা যায় না।

যখন জিপসিরা ফিরে আসে, তখন উরসুলা গ্রামের সব লোকজনকে ওদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে রাখে। কিন্তু ভয়ের চেয়ে কৌতূহলই জয়ী হয়। কারণ সেবার যখন জিপসিরা সব রকম বাদ্যযন্ত্র নিয়ে কানের পর্দা ফাটানো আওয়াজ তুলে সারা গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তখন ঘোষক এসে জিপসিদের আবিষ্কৃত সবচেয়ে চমৎকার বস্তু প্রদর্শনের কথা ঘোষণা করে। যাতে করে পৃথিবীর সবাই চলে যায় তাঁবুতে, আর এক সেন্টের বিনিময়ে দেখতে পায় বলিরেখাহীন, নতুন ঝকমকে দাঁতসহ এক যুবক মেলকিয়াদেসকে। স্কার্ভিতে ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত, তোবড়ানো গাল আর চুপসে যাওয়া ঠোঁটের কথা যাদের মনে ছিল ভয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় তারা জিপসির অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা দেখে। এই ভয় আতঙ্কে পরিণত হয়, যখন মেলকিয়াদেস তার মাড়ি- সংলগ্ন অক্ষয় দাঁতগুলোকে বাইরে বের করে দর্শকদের দেখায় মুহূর্তের জন্য, আর তাৎক্ষণিকভাবে সে রূপান্তরিত হয় আগের বছরগুলোতে দেখা একই লোকে। ওগুলোকে সে আবার লাগিয়ে যৌবনকে ফিরিয়ে এনে নতুন করে কর্তৃত্বময় হাসি হাসে। স্বয়ং হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া মনে করে মেলকিয়াদেসের জ্ঞান অসহ্য রকমের চরম অবস্থায় পৌঁছে গেছে, কিন্তু যখন জিপসি লোকটা তার সঙ্গে একাকী নকল দাঁতের কারিগরি খুলে বলে, তখন অনুভব করে এক পরিপূর্ণ প্রসন্নতা। এটা তার কাছে একই সঙ্গে এতই সহজ আর এতই জ্ঞানময় মনে হয় যে আলকেমি নিয়ে গবেষণা করার সব আকর্ষণ তার রাতারাতি উবে যায়; নতুন করে সে ভোগে বদমেজাজে, আর সময়মতো না খেয়ে সারা বাড়িময় ঘুরে বেড়িয়ে দিন কাটায়। ‘পৃথিবীতে অবিশ্বাস্য সব ঘটনা ঘটে চলছে’ বলে উরসুলাকে, ‘ওইখানে, নদীর অন্য পারে আছে সব রকমের জাদুকরি যন্ত্রপাতি আর আমরা কিনা দিন কাটাচ্ছি গাধার মতো।’ যারা ওকে মাকন্দের পত্তনের সময় থেকে চিনত, তারা আশ্চর্য হতো দেখে যে মেলকিয়াদেসের প্রভাবে সে কতই না বদলে গেছে।

প্রথম দিকে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ছিল তরুণ গোত্রপতি ধাঁচের, যে চাষবাসের শিক্ষা দিত, বাচ্চাকাচ্চা আর জীবজন্তু লালন-পালনের উপদেশ দিত, গোত্রের অগ্রগতির জন্য সর্বক্ষেত্রেই সাহায্য করত, এমনকি শারীরিকভাবেও। যেহেতু প্রথম থেকেই তার বাড়িটা ছিল গাঁয়ের সেরা, তাই অন্য বাড়িগুলোও তৈরি হয়েছিল তারই বাড়ির আদলে এবং একই রকমভাবে। বসার ঘরটা ছিল বেশ বড় আর আলোময়, উঠানের মতোই খাবারঘরও আনন্দময় রঙের ফুল দিয়ে সাজানো, দুটো শোবার ঘর, বিশাল চেস্টনাটগাছসহ এক উঠান, সাজানো ফলমূলের বাগান আর শান্তিতে একসঙ্গে বসবাসরত ছাগল, শুয়োর আর মুরগির খোঁয়াড়। শুধু তার বাড়িতেই নয়, সব গ্রামেই, যেটা এক মাত্র নিষিদ্ধ প্রাণী ছিল, সেটা হলো লড়াইয়ের মোরগ।

স্বামীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করার ক্ষমতা ছিল উরসুলার। কর্মঠ, ছোটখাটো, কঠোর, যে মেয়েটা ছিল অবিনাশী স্নায়ুশক্তির অধিকারী, জীবনে কেউ তাকে গান গাইতে শোনেনি, ডাচ লিনেনের স্কার্টের মৃদু খসখসানিসহ তার উপস্থিতি ছিল সব সময়, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। পেটানো মাটির মেঝে, চুনকালিবিহীন কাদার দেয়াল, নিজেদের তৈরি করা সাদামাটা আসবাবপত্র ছিল সব সময় পরিষ্কার আর যে পুরোনো সিন্দুকে কাপড়চোপড় রাখা ছিল, সেখান থেকে বের হতো তুলসী-পাতার মৃদু গন্ধ।

হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ছিল গায়ের সবচেয়ে উদ্যমী লোক, ও রকম উদ্যমী লোক গ্রামে আর কখনোই দেখা যাবে না। বাড়িগুলোকে সে এমনভাবে বসিয়েছিল যে সব বাড়ি থেকেই নদীতে আসতে পারত সবাই এবং পানি নিতে পারত সমান পরিশ্রমে। রাস্তাগুলোকে সে এমনভাবে সারি করে বানিয়েছিল, যাতে গরমের সময় কোনো বাড়িই একটার চেয়ে অন্যটা রোদ বেশি না পায়। অল্প কয়েক বছরের মধ্যে, তিন শ অধিবাসীর মাকন্দ ছিল যেকোনো চেনাজানা গ্রামের চেয়ে অনেক বেশি সাজানো এবং সত্যিকার অর্থে ছিল এক সুখী গ্রাম, যেখানে কারোর বয়স তিরিশের বেশি ছিল না এবং কেউ মারা যায়নি তখনো।

বসতি স্থাপনের সময় থেকেই হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বানাত ফাঁদ আর খাঁচা অচিরেই সে টুপিয়াল, ক্যানারি, আসুলেহোস (ক্যানারি) আর পেতিররোহোস (রেডব্রেসট) পাখি দিয়ে শুধু নিজের বাড়িই নয়, পুরো গ্রামটাই ভরে ফেলে। এসব পাখির সমবেত গান এতই হতবুদ্ধিকর হয়ে উঠল যে উরসুলা মোম দিয়ে কান বন্ধ করে রাখত, যাতে সে বাস্তববোধ হারিয়ে না ফেলে। মেলকিয়াদেসের গোষ্ঠীটা যখন প্রথমবার এসে মাথাব্যথা সারানোর কাচের গুলি বিক্রি করে, তখন সবাই অবাক হয় এভাবে যে কী করে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন জলাভূমিতে হারিয়ে যাওয়া এই গ্রামটাকে ওরা খুঁজে পেয়েছিল, আর জিপসিরা জানায় যে পাখির কলতান শুনেই তারা দিক খুঁজে পেয়েছে।

তার সেই সামাজিক উদ্দীপনা অল্প সময়ের মধ্যেই উবে যায় চুম্বকের মোহ, জ্যোতির্বিদ্যা- সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশ, পদার্থ রূপান্তরের স্বপ্ন, আর বিশ্বের অত্যাশ্চর্যকে জানার তাড়নায়। উদ্যমী আর পরিচ্ছন্ন এক লোক থেকে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া পরিণত হয় এক অলস, পোশাকে অমনোযোগী, আর এমনই বুনো দাড়িওয়ালা এক লোকে যে একদিন দাড়িগুলো উরসুলা রান্নাঘরের ছুরি দিয়ে অতি কষ্টে একটা আকার দিয়ে দেয়। এমন কেউ ছিল না যে তাকে আজব কোনো জাদুমন্ত্রের শিকার বলে মনে করত না। তার পাগলামির ব্যাপারে সুনিশ্চিত লোকজন পর্যন্ত কাজ আর সংসার ছেড়ে দিয়ে তাকে অনুসরণ করে, যখন সে কাঁধে তুলে নেয় তার বিশ্লেষণ করার যন্ত্রপাতিগুলো আর সবাইকে যোগ দিতে বলে এক রাস্তা খোলার জন্য যা নাকি মাকন্দকে সংযুক্ত করে দেবে বড় সব আবিষ্কারের সঙ্গে।

ওই এলাকার ভৌগোলিক অবস্থান সম্বন্ধে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ছিল পুরোপুরি অজ্ঞ। তারা জানত যে পুব দিকে ছিল এক দুর্গম পর্বতমালা, আর পর্বতমালার অন্য দিকে প্রাচীন শহর রিওয়াচা, যেখানে, ওর দাদা প্রথম আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার ভাষ্যমতে, প্রাচীনকালে স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক বিশাল কুমির শিকার করেছিল কামান দেগে বিনোদনের জন্য, আর পরে খুলির ক্ষতটা জোড়া দিয়ে ভেতরে খড় ঢুকিয়েছিল রানি এলিজাবেথের কাছে পাঠানোর জন্য। যৌবনে সে যে রাস্তা দিয়ে পুরুষ, মহিলা, বাচ্চাকাচ্চা, পশু আর ঘরোয়া জিনিসপত্রসহ পর্বত পাড়ি দিয়েছিল সাগরে যাওয়ার পথ খুঁজতে আর ছাব্বিশ মাস পর ক্ষান্ত দিয়ে মাকন্দে পত্তনি গড়ে তোলে, যাতে আবার ফেরার পথ পাড়ি দিতে না হয়, ওটা ছিল এমন এক রাস্তা, যাতে তার কোনো আগ্রহ ছিল না, কারণ ওটা নিয়ে যেতে পারত কেবল অতীতের দিকে। দক্ষিণে ছিল সীমাহীন জলজ উদ্ভিদে ঢাকা জলাভূমি আর জিপসিদের কথানুযায়ী এই বিশাল জলাভূমির বিপুল বিশ্বের কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না। ভুল করে মনে হতো বিশাল পশ্চিমের জলাভূমিটা দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত, যেখানে ছিল মহিলার শরীর, মাথা, আর কোমল চামড়াসহ তিমি-জাতীয় প্রাণী, যাদের বিশাল স্তনের মোহে পড়ে নাবিকেরা দিক হারাত। জিপসিরা ছয় মাস এই পথ ধরে নৌ চালনা করে এক ফালি শক্ত জমিতে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত, যেখান দিয়ে ডাক বওয়া খচ্চরগুলো যাতায়াত করে। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার হিসাবমতে, সভ্যজগতের সংস্পর্শে আসার একমাত্র সম্ভাব্য রাস্তা ছিল উত্তরে। সুতরাং সে জঙ্গল কাটার ও শিকারের যন্ত্রপাতি তুলে দেয় তাদের হাতে যারা মার্কন্দের স্থাপনার সময় থেকে তার সঙ্গী। একটা থলির মধ্যে নির্দেশনার যন্ত্র আর মানচিত্রগুলো ভরে আরম্ভ হয় সেই দুঃসাহসী অভিযাত্রা।

প্রথম কয়েক দিন উল্লেখযোগ্য কোনো বাধাই তারা পায় না। নদীর পাথুরে তীর ধরে নিচে নামতে নামতে চলে আসে তারা সেই জায়গায়, যেখানে অনেক বছর আগে পাওয়া গিয়েছিল এক সৈনিকের বর্ম, যেখানে তারা প্রবেশ করে বুনো কমলাবনের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া পথ ধরে। প্রথম সপ্তাহ শেষ হওয়ার পর এক হরিণ শিকার করে আগুনে ঝলসায় তারা, কিন্তু শুধু অর্ধেকটা খেয়েই সন্তুষ্ট হয়, বাকি অর্ধেক নুন মাখিয়ে ভবিষ্যতের দিনগুলোর জন্য রেখে দেয়। একই সতর্কতার কারণে বড় টিয়া পাখি খাওয়ার ধারণাটাও তারা বাদ দেয়, যার নীল মাংস ছিল একই সঙ্গে আঁশটে আর সুগন্ধিময়। দশ দিন ধরে তারা সূর্যের মুখ দেখতে পায় না। আগ্নেয়গিরির ছাইয়ের মতো মাটি হয়ে আসে নরম আর স্যাঁতসেঁতে, বনজঙ্গল ক্রমাগত আরও বেশি প্রতারণাময় হয়ে ওঠে, পাখির কলরব আর বানরের কোলাহলকে আরও দূরের বলে মনে হয় আর পৃথিবী চিরকালের জন্য হয়ে ওঠে আরও বিষাদগ্রস্ত, আর অভিযাত্রীরা ওদের আদি পাপেরও আগের, আদিতম স্মৃতির তাড়নায় সেই স্যাঁতসেঁতে স্বর্গে আর নির্জনতায় ডুবে যায়, যেখানে জুতা দেবে যায় ধোঁয়াটে তেলের গর্তে আর দাগুলো ধ্বংস করে রক্তিম লিলি ফুল আর সোনালি সালামান্দার (একধরনের মাছজাতীয় প্রাণী)। এক সপ্তাহ ধরে প্রায় কথাবার্তা ছাড়া নিশাচরের মতো, দমবন্ধ করা রক্তের গন্ধে ফুসফুস ভর্তি করে ওরা অগ্রসর হয় এক শোকাবহ বিশ্বের মধ্য দিয়ে, যা কেবল আলোকিত হয়ে আছে আলোকদায়ী পোকামাকড় দ্বারা। ওরা আর ফিরতে পারত না কারণ যে পথ তৈরি হয়েছিল, অল্পক্ষণের মধ্যেই তা বন্ধ হয়ে আসছিল নতুন গাছপালায়, যেন এই মাত্র সেগুলো বেড়ে উঠছিল ওদের চোখের সামনে। ‘কিছু আসে যায় না’, বলত হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, ‘আসল কথা হচ্ছে দিক না হারানো। সেই ভূতগ্রস্ত এলাকা থেকে বেরিয়ে আসার আগে সে সারাক্ষণ কম্পাসের দিকে লক্ষ রেখে পথ দেখিয়ে যাচ্ছিল ওর লোকদের অদৃশ্য উত্তরের দিকে। সেটা ছিল নক্ষত্রবিহীন এক ঘন রাত কিন্তু অন্ধকার ভরা ছিল নতুন আর নির্মল বাতাসে। দীর্ঘ পথযাত্রায় অবসন্ন হয়ে ওরা দোলবিছানায় গভীর ঘুমে কাটিয়েছিল দুই সপ্তাহে প্রথমবারের মতো। যখন জেগে উঠে বিস্ময়ে আপ্লুত হয়ে যায় তারা। সূর্য তখনো মাথার ওপরে। ওদের সামনে, তালগাছ আর ফার্ন। সকালের শুভ্র সূক্ষ্ম কণার আলোয় বেষ্টিত নিস্তব্ধতায় দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল স্প্যানিশ জাহাজ। স্টারবোর্ডের দিকে সামান্য কাত হয়ে থাকা জাহাজের অক্ষত মাস্তুল থেকে ঝুলছিল দুভাগ হয়ে যাওয়া, দুর্বল, আর্কিদিও (অর্কিড) ফুলাঙ্কিত পালের অংশ। পাথুরে মাটিতে শক্তভাবে গেঁথে থাকা খোলটি ঢাকা ছিল শিলীভূত উজ্জ্বল শামুক আর নরম শৈবালে। নিঃসঙ্গতা আর বিস্মৃতির জায়গা নিয়ে সব কাঠামো যেন দখল করে আছে এক নিজস্ব ব্যাপ্তি, যা সময়ের কলুষ আর পাখপাখালির আচার-আচরণে দুর্ভেদ্য। জাহাজের ভেতরে অভিযাত্রীরা গোপন উদ্দীপনায় যা খুঁজে পেল, তা ফুলের এক নিবিড় বন ছাড়া বেশি কিছু না।

ধারেকাছেই সমুদ্র থাকার ইঙ্গিত বহনকারী এই জাহাজ আবিষ্কার হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার সব উৎসাহ ভেঙে দেয়। প্রচণ্ড আত্মত্যাগ আর খেসারত দেওয়া সত্ত্বেও খুঁজে না পেয়ে, আর অন্যদিকে না খুঁজতেই রাস্তার মাঝখানে এক অমোঘ বাধাস্বরূপ সমুদ্রকে দেখতে পেয়ে নিজের দুষ্ট নিয়তিকে এক বিদ্রূপের মতো মনে হয় তার কাছে। অনেক বছর পর কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া আবার যখন এই জায়গাটা অতিক্রম করে, তখন তা হয়ে গিয়েছিল ডাক চলাচলের এক নিয়মিত রাস্তা আর জাহাজের একমাত্র যে জিনিসটা সে দেখতে পেয়েছিল তা হলো, আফিম খেতের মাঝে এর পোড়া কাঠামোটা। আর তখনই সে নিশ্চিত হয় যে ওটা তার বাবার খামখেয়ালি কল্পনায় সৃষ্ট কোনো গল্প নয়, আর তখন নিজেই নিজেকে সে প্রশ্ন করে কীভাবে জাহাজটা কঠিন মাটির এতখানি দূরত্ব অতিক্রম করে ঢুকে গিয়েছে। কিন্তু আরও চার দিন ভ্রমণের পর সমুদ্রকে যখন জাহাজ থেকে বারো কিলোমিটার দূরত্বে পায়, তখন হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া এ নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করে না। তার এত আত্মত্যাগ আর ঝুঁকিপূর্ণ এই অভিযানের, স্বপ্নের, শেষ হয় এই ফেনিল, নোংরা, ছাইরঙা সমুদ্রের সামনে, যা তার প্রাপ্য নয়।

‘সর্বনাশ’, চিৎকার করে সে, ‘মাকন্দের চারদিক পানিতে ঘিরে আছে।’

অভিযান থেকে ফিরে এসে মানচিত্রে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার যুক্তিহীনভাবে আঁকা মাকন্দ উপদ্বীপের ধারণাটি অনেক দিন পর্যন্ত টিকে ছিল। রেখাগুলো সে এঁকেছিল প্রচণ্ড রাগে, যোগাযোগের প্রতিবন্ধকতাকে অতিরঞ্জিত করে, যেন চরম বুদ্ধিহীনভাবে জায়গাটা বেছে নেওয়ার জন্য নিজেকে শাস্তি দেওয়ার জন্য। ‘কখনোই পৌঁছাতে পারব না কোথায়ও’, খেদ প্রকাশ করে সে উরসুলার কাছে, ‘বিজ্ঞানের সুবিধাগুলো না পেয়ে এখানেই আমাদের জীবন পচতে থাকবে।’ ছোট্ট গবেষণাগারে কয়েক মাসের উপর্যুপরি চিন্তার ফলপ্রসূ এই নিশ্চয়তা তাকে মাকন্দকে আরও উপযুক্ত এক স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু এইবার, উরসুলা তার এই অস্থির পরিকল্পনার কথা আগেই আঁচ করে ফেলে। এরই মধ্যে স্থানান্তরের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করা পুরুষদের হুজুগের বিরুদ্ধে গোপন ও পিঁপড়ার মতো ক্লান্তিহীন এক পরিশ্রমে গ্রামের মহিলাদের সে উপযোগী করে তোলে। পুরো ব্যাপারটি একেবারে এক বিশুদ্ধ, সাধারণ মরীচিকায় রূপান্তরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বুঝতেই পারে না তার পরিকল্পনাগুলো কখন, কীভাবে কোন প্রতিকূল শক্তির গুণে নানা সব অজুহাত, বিপত্তি ও ওজরের বিশৃঙ্খলার মধ্যে জড়িয়ে পড়ে। উরসুলা তাকে নিষ্পাপ মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করে, এমনকি ওর প্রতি উরসুলার একটু দয়াও হয়, যখন গবেষণাগারের জিনিসগুলোকে তাদের মূল বাক্সের ভেতর গুছিয়ে রাখছিল আর তখন ওকে কোনার ছোট ঘরটিতে স্থান পরিবর্তনের স্বপ্নের কথা বিড়বিড় করে বলতে শোনা যায়। উরসুলা ওকে কাজগুলো শেষ করতে দেয়। বাক্সগুলোতে পেরেক ঠোকা, আর ঝরনা কলম দিয়ে বাক্সের গায়ে নামের আদ্যাক্ষর লেখাও শেষ করতে দেয় কোনো রকম গঞ্জনা ছাড়াই, যদিও উরসুলা জানত যে ও জেনে গেছে (কারণ সে শুনতে পেয়েছিল ওর বধির স্বগতোক্তি, গ্রামের পুরুষেরা তার এই উদ্যোগের সঙ্গী হবে না)। শুধু যখন সে ঘরের দরজাটা খুলতে যাচ্ছে, তখনই শুধু উরসুলা সাহস করে জিজ্ঞেস করে কেন সে খুলছে, আর তার জবাবটা সে দেয় তিক্ততার সঙ্গে—’যেহেতু কেউ যেতে চায় না, আমরা একাই যাব’, উরসুলা এতে বিচলিত হয় না।

‘আমরা যাব না’, বলল সে, ‘আমরা এখানেই থেকে যাব, কারণ এখানেই আমার এক ছেলেকে পেয়েছি।’

‘এখন পর্যন্ত কেউ মরেওনি’, সে বলে, ‘মাটির তলায় না যাওয়া পর্যন্ত কেউই কোনো জায়গার নয়।’

উরসুলা এক কোমল দৃঢ়তায় জবাব দেয়, ‘এখানে থেকে যাওয়ার জন্য যদি আমাকে মরতে হয় তবে আমি মরব।’

হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বিশ্বাস করে উঠতে পারে না তার বউয়ের ইচ্ছাশক্তি এতটা দৃঢ় হতে পারে। চেষ্টা করে তার জাদুময়ী আজগুবি কল্পনা আর বিস্ময়কর এক পৃথিবীর অঙ্গীকারের সাহায্যে ওকে প্রলুব্ধ করতে, যেখানে মাটিতে জাদুকর তরল ছেটালেই গাছ হয় মানুষের ইচ্ছানুযায়ী, যেখানে বিক্রি হয় খুব সস্তায় ব্যথা সারানোর সব যন্ত্রপাতি। কিন্তু উরসুলা ওর দূরদৃষ্টিতে নিরাসক্ত ছিল।

‘এসব আজগুবি চিন্তার চেয়ে বরং তোমার সন্তানদের দায়িত্ব নেওয়া উচিত’, উত্তর দেয়, ‘দেখো ওদের কী অবস্থা, যেন আল্লাহর ওয়াস্তে ঘুরে বেড়ানো গাধা।’ হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বউয়ের কথাগুলো আক্ষরিক অর্থেই ধরে নেয়। জানালা দিয়ে তাকিয়ে রৌদ্রতপ্ত বাগানে দুই ছেলেকে খালি পায়ে দেখতে পায় আর ওই মুহূর্তে ওর মনে হয় যেন ওদের অস্তিত্বের শুরু হয়েছে কেবল উরসুলার জাদুবলে। কিছু একটা ঘটে যায় তার ভেতরে, রহস্যময় এবং সুনির্দিষ্ট এমন একটা ব্যাপার, যা তাকে সত্যিকারের সময় থেকে উপড়ে ফেলে নিয়ে যায় স্মৃতির এক অনাবিষ্কৃত অঞ্চলে। উরসুলা যখন এ জীবনে গ্রাম ছেড়ে না যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিল, তখন সে মগ্ন হয়ে বাচ্চাদের দেখতে থাকে, চোখগুলো ছলছল হয়ে ওঠা পর্যন্ত। হাত দিয়ে দুচোখ মুছে হাল ছেড়ে দেওয়ার এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।

‘বেশ’, বলল, ‘ওদের বলো যাতে আমাকে বাক্স থেকে জিনিসগুলো বের করতে সাহায্য করে।

বাচ্চাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়, হোসে আর্কাদিওর চৌদ্দ বছর পূরণ হয়েছে তখন। ওর ছিল চৌকো মাথা, মাথাভর্তি চুল আর চরিত্র ছিল বাপের মতোই স্বেচ্ছাচারী। শারীরিক বৃদ্ধি আর শক্তিমত্তা একই রকম হলেও তখন থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যে ওর ছিল কল্পনাশক্তির কিছু অভাব। ও পেটে আসে এবং জন্ম গ্রহণ করে মাকন্দ পত্তনের আগে, কষ্টকর পর্বতসংকুল পাড়ি দেওয়ার সময়, আর বাবা-মা ও ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানায় ওর শরীরে কোনো জন্তুর অঙ্গ ছিল না বলে। আউরেলিয়ানো ছিল মাকন্দে জন্মানো প্রথম মানবসন্তান, মার্চে যার ছয় বছর পূরণ হবে। স্বভাবে সে নীরব ও মনোযোগী। মায়ের পেটে থাকতে কান্নাকাটি করত আর জন্মেছিল চোখ খোলা অবস্থায়। যখন ওর নাড়ি কাটা হচ্ছিল, তখন ঘরের জিনিসপত্র চিনতে চিনতে সে মাথা নাড়ছিল এদিক-ওদিক। লোকজনের চেহারা পরীক্ষা করছিল এক বিস্ময়হীন কৌতূহল নিয়ে। পরে, যারা ওকে দেখতে এসেছিল, তাদের দিকে গুরুত্ব না দিয়ে সব মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিল তালের পাতায় ছাওয়া ছাদটার দিকে, যেটা প্রচণ্ড বৃষ্টির চাপে প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। ওর দৃষ্টিপাতের এই তীব্রতার কথা উরসুলার আর মনে পড়ে নি সেই দিনটির আগ পর্যন্ত, যেদিন সে জ্বলন্ত উনুনে বলক দিতে থাকা স্যুপের পাতিল সরিয়ে টেবিলে রাখছিল আর সেই মুহূর্তে তিন বছরের ছোট আউরেলিয়ানো ঘরে এসে হাজির হয়ে, দরজায় দাঁড়ানো কিংকর্তব্যবিমূঢ় শিশুটি বলে, ‘ওটা তো পড়ে যাবে।’ পাতিলটা টেবিলের মাঝখানে ভালোভাবেই রাখা ছিল, কিন্তু শিশুর ঘোষণামাত্র, যেন অভ্যন্তরীণ এক গতির মাধ্যমে চালিত হয়ে টেবিলের কিনারায় চলে আসে সেটি, আর মেঝেতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ভীত উরসুলা ঘটনাটা স্বামীকে জানায়, কিন্তু সে এটাকে এক প্রাকৃতিক কোনো ব্যাপার বলে ব্যাখ্যা করে। বাচ্চাদের অস্তিত্বে উদাসীন হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া কিছুটা এ রকমই ছিল সব সময়, আর এমন থাকার কারণ শৈশবকে সে মানসিক অপর্যাপ্ততা বলেই মনে করত আর অন্যদিকে নিজের অবাস্তব কল্পনায় তন্ময় থাকাটাও ছিল আরেকটা কারণ।

কিন্তু সেই বিকেলের পর থেকে, যেদিন সে বাচ্চাদের ডাকে বাক্স থেকে জিনিসপত্রগুলো বের করতে সাহায্য করার জন্য, তখন থেকেই বেশির ভাগ সময় ওদের পেছনে ব্যয় করতে থাকে। মূল বাড়ি থেকে একটু দূরের সেই কামরাটার দেয়াল ভরে উঠেছিল ধীরে ধীরে অবিশ্বাস্য মানচিত্র, আর অলীক সব গ্রাফে, সেখানে সে ওদের শেখায় পড়তে, লিখতে, গুনতে এবং সর্বোপরি পৃথিবীর বিভিন্ন বিস্ময় যা কেবল ওর জানা জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং সেগুলো ওর অবিশ্বাস্য কল্পনার শেষ সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এভাবেই শিশুরা শেখে আফ্রিকার একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে এমন সব বুদ্ধিমান আর শান্তিপ্রিয় মানুষ আছে যাদের বিনোদন হচ্ছে শুধু বসে বসে ভাবা অথবা এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে লাফ দিয়ে ডিঙিয়ে সালোনিক বন্দর পর্যন্ত গিয়ে ইজিয়ান সাগর পাড়ি দেওয়া সম্ভব। সেসব ঘোর লাগা বৈঠক শিশুদের মনের মধ্যে এমনভাবে গেঁথে যায় যে বহু বছর পর পদাতিক বাহিনীর অফিসার ফায়ারিং স্কোয়াডকে গুলি ছোড়ার আদেশের এক মুহূর্ত আগে, কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া চলে যাবে মার্চের সেই নরম বিকেলে যখন ওর বাবা পদার্থবিদ্যায় বিরতি দিয়ে, স্থির চোখে, বাতাসে হাত তুলে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিল দূর থেকে আসা বাঁশি, ঢোল আর খরতালসহ জিপসিদের আরও একবার গাঁয়ে আসার শব্দ, আর ঘোষণা করছিল মেমফিসের বিজ্ঞ লোকদের সর্বশেষ আশ্চর্যজনক আবিষ্কারের কথা।

এরা ছিল নতুন জিপসি দল। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও মহিলার দল শুধু কথা বলতে পারে নিজেদের ভাষায়। তেলতেলে চামড়া আর বুদ্ধিদীপ্ত হাতের আদর্শ সুন্দর পুরুষগুলো নাচ আর গান দিয়ে রাস্তায় বপন করেছিল এক আনন্দময় হট্টগোলের আতঙ্ক। এদের সঙ্গে ছিল আরিয়্যা (অপেরা—ইতালীয় গাথাকাব্য) আওড়াতে সক্ষম বহুবর্ণে রাঙানো টিয়া পাখি, তামবোরিনের (একধরনের ঢোল) আওয়াজে শতেক সোনার ডিমপ্রসবী মুরগি, মানুষের চিন্তা আঁচ করতে পারা এক প্রশিক্ষিত বাঁদর, একাধিক কাজে সক্ষম যন্ত্র, যা দিয়ে বোতাম সেলাই ও জ্বর নামানো যায়, খারাপ স্মৃতি ভুলে যাওয়ার যন্ত্র, সময় ভুলে যাওয়ার বড়ি। ও, আরও হাজারটা আবিষ্কার, যা এতই উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন আর অসাধারণ যে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার খুব ভালো লাগত যদি ওগুলো মনে রাখার একটা যন্ত্র আবিষ্কার করতে পারত। মুহূর্তের মধ্যে গ্রামটা বদলে যায়। মাকন্দবাসী হারিয়ে যায় ওদের নিজেদেরই রাস্তায়, মেলার ভিড়ে বিহ্বল হয়ে।

বিশৃঙ্খলার মধ্যে যাতে না হারিয়ে যায়, তাই দুই হাতে দুই ছেলেকে ধরে সোনার দাঁতের কসরতকারী আর ছয় বাহুর ভেলকিবাজ, মল আর চন্দনকাঠের দমবন্ধ করা গন্ধের ভেতর, হোঁচট খেতে খেতে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া পাগলের মতো সর্বত্র খুঁজছিল মেলকিয়াদেসকে, যাতে সে অবিশ্বাস্য দুঃস্বপ্নের গোপন কথাগুলোর ব্যাখ্যা দিতে পারে। অনেক জিপসির কাছেই সে যায় কিন্তু কেউই তার ভাষা বুঝতে পারে না। অবশেষে সেই জায়গায় সে আসে, যেখানে মেলকিয়াদেস তাঁবু গাড়ত আর পায় এক মৃদুভাষী আর্মেনীয়কে যে কিনা স্প্যানিশ ভাষায় ঘোষণা করছে অদৃশ্য হওয়ার গুণসম্পন্ন এক সিরাপের কথা। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া দর্শকদের ভিড় ঠেলে যখন ওকে প্রশ্ন করতে পারে, তখন লোকটা এক ঢোকে পীতাভ রঙের এক পদার্থ কেবল গলাধঃকরণ করেছে। জিপসি তাকে এক বিস্ময়াবিষ্ট দৃষ্টিতে জড়িয়ে ফেলে আর ধোঁয়া ও দুর্গন্ধময় আলকাতরায় পরিণত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে তার দেওয়া উত্তরের প্রতিধ্বনি সেখানে ভাসতে থাকে: ‘মেলকিয়াদেস মারা গেছে।’ এই খবরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া অনড় হয়ে থাকে দুঃখটাকে হজম করার জন্য। ইতিমধ্যে ভিড়টা হালকা হতে শুরু করেছে অন্য কোনো প্রদর্শনী দেখার জন্য আর মিতভাষী আর্মেনীয় সম্পূর্ণরূপে বাষ্প হয়ে গেছে। আরও পরে অন্য জিপসিরা তাকে নিশ্চিত করে যে সত্যি মেলকিয়াদেস সিঙ্গাপুরের বালুর স্তূপে হার মানে জ্বরের কাছে আর তার দেহ ছুড়ে ফেলা হয়েছে জাভা সমুদ্রের সবচেয়ে গভীর জায়গায়। খবরটা বাচ্চাদের কাছে কোনো গুরুত্ব পায় না। ওরা তখন বাবাকে তাগাদা দিচ্ছে মেমফিসের বিজ্ঞদের বিস্ময়কর নতুনত্বের সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য। ঢোকার সময়েই তাঁবু থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল যে ওটার মালিক ছিল রাজা সোলেমান। এত বেশি পীড়াপীড়ি করে ওরা যে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া অবশেষে তিরিশ রিয়ালের বিনিময়ে তাঁবুর মাঝখানে প্রবেশ করে যেখানে লোমশ শরীর, কামানো মাথা, নাকে তামার নোলক, গোড়ালিতে ভারী শিকল বাঁধা এক বিশাল লোক পাহারা দিচ্ছিল জলদস্যুদের এক সিন্দুক। দৈত্যটা যখন সিন্দুকটাকে খোলে, তখন ওটার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে এক ঠান্ডাপ্রবাহ। ওর ভেতর রয়েছে বিশাল স্বচ্ছ একটি টুকরো, যাতে অগুনতি সুচ বসানো, এগুলো থেকে ঊষার নির্মলতায় বিক্ষিপ্ত হচ্ছে তারার মতো রংবেরঙের উজ্জ্বলতা। বিচলিত, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া জানে যে বাচ্চাগুলো অপেক্ষা করছে শিগগিরই এটার ব্যাখ্যা পাওয়ার জন্য, বুকে সাহস নিয়ে বিড়বিড় করল সে—

‘এটা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হিরকখণ্ড।’

‘না’, জিপসি শুধরে দেয়, ‘এটা বরফ।’

না বুঝে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া হাত বাড়িয়ে দেয় বরফের টুকরোর দিকে। কিন্তু দৈত্যটা হাত সরিয়ে দেয় ‘ছোঁয়ার জন্য আরও পাঁচ রেয়াল’ বলে। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তা-ই দেয়। বরফের ওপর হাত রাখে সে আর ওভাবেই রাখে কয়েক মিনিট, আর ততক্ষণে তার বুক ভরে উঠছে ভয় আর রহস্যময় স্পর্শের আনন্দে। কী বলবে বুঝতে না পেরে আরও দশ রিয়াল দিল, যাতে বাচ্চারাও এই আশ্চর্য অভিজ্ঞতা অনুভব করতে পারে। ছোট্ট হোসে আর্কাদিও ছুঁতে অস্বীকার করল। অন্যদিকে আউরেলিয়ানো এক পা বাড়িয়ে হাত রাখে আর সরিয়ে নেয় সঙ্গে সঙ্গে। ‘এটা বলকাচ্ছে’, চমকে গিয়ে বলে। কিন্তু ওর বাবার তাতে মনোযোগ ছিল না। সেই সময়ে এই অত্যাশ্চর্যের নিদর্শনে মাতাল হয়ে সে ভুলে যায় তার সব ব্যর্থ পরিকল্পনার হতাশা আর স্কুইডের খিদের কাছে পরিত্যক্ত মেলকিয়াদেসের দেহের কথা। আরও পাঁচ রিয়াল দিয়ে বরফের ওপর হাত রেখে পবিত্র হরফ ছুঁয়ে সাক্ষ্য দেওয়ার ভঙ্গিতে সে বলল, ‘এটা হচ্ছে আমাদের সময়ের মহান এক আবিষ্কার।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *