নিঃসঙ্গতার একশ বছর – ১৪

১৪

মেমের শেষের দিকের ছুটিগুলো পড়ে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মৃত্যুতে শোকপর্বের সময়। অবরুদ্ধ বাড়িতে পার্টি করার মতো অবস্থা ছিল না। সবাই কথা বলত ফিসফিসিয়ে, খাওয়াদাওয়া সারত নীরবে, জপমালা জপত দিনে তিনবার, এমনকি সিয়েস্তার গরমের সময়ও ক্লাভিকর্ডে বাজত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সুর। গোপনে বিদ্বেষ পোষণ করলেও শোক পালনের কঠোরতা ফের্নান্দাই আরোপ করে, কারণ সরকার কর্তৃক মৃত শত্রুর শোক পালনের আড়ম্বর তাকে মুগ্ধ করে ফেলেছিল। আগের অভ্যেসমতোই আউরেলিয়ানো সেগুন্দো মেয়ের ছুটির দিনগুলোতে বাড়ি ঘুমাতে আসলে ফের্নান্দা আইনানুগ স্ত্রীর অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য কিছু করে থাকবে, কারণ পরের বছর মেমে তার এক সদ্যোজাত বোন পায় ফের্নান্দার অমতেই যাকে ব্যাপটাইজ করা হয় আমারান্তা উরসুলা নাম দিয়ে।

মেমের লেখাপড়ার পর্যায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। কনসার্ট বাজিয়ে হিসেবে পাওয়া ডিপ্লোমাটা সঠিক অনুমোদন পায়, যখন সে তার পাঠসমাপ্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অসাধারণ নৈপুণ্যের সঙ্গে সপ্তদশ শতকের কিছু জনপ্রিয় সুর বাজায় আর একই সঙ্গে সমাপ্তি ঘটে শোকপর্বের। আমন্ত্রিতরা তার শিল্পকলার দক্ষতার চাইতেও বেশি তারিফ করে তার সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী চরিত্রের জন্য। তার শিশুসুলভ প্রগল্ভতার জন্য, কোনো ভারিক্কি কাজ তার দ্বারা সম্ভব বলে মনে হতো না। কিন্তু যখন সে ক্লাভিকর্ডের সামনে বসত, তখন রূপান্তরিত হতো সম্পূর্ণ অন্য এক মেয়েতে, যাকে মনে হতো পরিণতবয়স্কা। সব সময়ই সে এ রকম ছিল। সত্যি বলতে ওর সুনির্দিষ্ট কোনো ঝোঁক ছিল না, কিন্তু মায়ের মতের বিরুদ্ধে কিছু না করার ইচ্ছায় অনমনীয় নিয়মানুবর্তিতা দিয়ে সে অর্জন করে স্কুলে সবচেয়ে ভালো ফলাফল, আর ওকে যে-কোনো অন্য বিষয়ে পড়ালেখা করতে দিলেও সে একই রকমের ফলাফলই অর্জন করত। আর শুধু মায়ের একরোখা চরিত্রকে না মাড়ানোর জন্যই ক্লাভিকর্ডের অনুশীলনের চাইতেও আরও বেশি কিছু ত্যাগ স্বীকার করার মতো ক্ষমতা ছিল তার।

গ্র্যাজুয়েশনের দিনে সে অনুভব করে গথিক অক্ষরে লেখা পার্চমেন্ট কাগজের বড় হাতের বর্ণগুলো থেকে এক আপস, যেটা সে যতটা না অর্জন করেছে বাধ্যতার, তার চেয়েও বেশি করেছে স্বাচ্ছন্দ্যের কারণে আর সে ভাবে, সেই সময় থেকে যে বাদ্যযন্ত্রটাকে নানরা জাদুঘরের ফসিল বলে গণ্য করে, সেটা নিয়ে এমনকি একরোখা ফের্নান্দা পর্যন্ত আর মাথা ঘামাবে না। প্রথম কয়েক বছর তার মনে হয় যে হিসাবে কোথায়ও গোলমাল হয়েছে, কারণ বৈঠকখানাতে, শহরের অর্ধেক লোক ঘুমানোর পর তার বাজনা শোনার জন্য লোক ডেকে আনাই নয়, দাতব্য অনুষ্ঠানে, স্কুলের অনুষ্ঠানে, এমনকি মাকন্দের জনহিতকর অনুষ্ঠানেও তার মা সদ্য আগত যাকেই মনে হয় যে তার মেয়ের গুণের সমঝদার হতে পারে, তাকেই সে আমন্ত্রণ করে। শুধু আমারান্তার মৃত্যুর পর পরিবারের সবাই, যখন আবার এক শোকপর্বে প্রবেশ করে, তখনই মেমে ওর ক্লাভিকর্ডকে তালাবদ্ধ করে চাবিটা পোশাকের ড্রয়ারে রেখে সেটার কথা ভুলে যায় আর ফের্নান্দাও কার দোষে কখন সেটা হারিয়েছে, এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে বিরক্ত হয় না। যে রকমের নিস্পৃহতা নিয়ে সে তার শিক্ষা শেষ করেছিল, একই ধরনের নিস্পৃহতা নিয়ে মেমে বাজায় ওই অনুষ্ঠানগুলোতে। ওটা ছিল তার মুক্তিমূল্য। ফের্নান্দা ওর বাধ্যবাধকতায় এতই আপ্লুত হয় ও তার শিল্পের প্রশংসায় এতই গর্ববোধ করে যে বাড়িভর্তি বান্ধবী নিয়ে এলে বা প্ল্যান্টেশনে সমস্ত বিকেল কাটালে অথবা আউরেলিয়ানো সেগুন্দো বা কোনো বিশ্বাসী মহিলার সঙ্গে সিনেমায় গেলে তাতেও বাধা দেয় না। একমাত্র শর্ত ছিল যে সিনেমাটি ফাদার আন্তনিও ইসাবেল দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে। ওই চিত্তবিনোদনের মুহূর্তগুলোতেই মেমের সত্যিকারের ভালো লাগা প্রকাশ পেত। ওর আনন্দ ছিল নিয়মশৃঙ্খলার অপর প্রান্তে, কোলাহলপূর্ণ পার্টিতে, প্রেমিকদের সঙ্গে প্যাচালে, বান্ধবীদের সঙ্গে লম্বা সময় ঘরে আবদ্ধ থাকায়, যেখানে ওরা ধূমপান করতে শিখত ও পুরুষদের সম্বন্ধে আলাপ করত; যেখানে একবার তিন বোতল আখের রাম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলায় মধ্যরাতে সবাই নগ্ন হয়ে নিজেদের অঙ্গ মেপে একে অন্যের সঙ্গে তুলনা করে। সেদিনের কথা মেমে কখনোই ভুলতে পারবে না, যেদিন সে নিজেদের মানসিক কষ্ট ওদের বুঝতে না দিয়ে, যষ্টিমধু চিবুতে চিবুতে বাড়ি ঢুকে ফের্নান্দা ও আমারান্তা বাগ্‌বিনিময় না করে খেতে থাকা টেবিলে বসে। তার আগে সে এক বান্ধবীর শোবার ঘরে দুই ঘণ্টা দারুণ সময় কাটিয়েছে, যেখানে হাসতে হাসতে সে কেঁদে ফেলে। আর যেখানে কষ্টের অন্যদিকে খুঁজে পায় এক বিরল অনুভূতি, সে অনুভব করে তার দুঃসাহসের অভাব, যেটাও প্রয়োজন ছিল স্কুল পালিয়ে মাকে এই কথাগুলো অথবা অন্য কথা দিয়ে বলা যে ক্লাভিকর্ডটা তার জন্য কোনো অর্থ বহন করে না। টেবিলের মাথায় চেয়ারে বসে পান করছিল মুরগির স্যুপ যেটা তার পেটে পড়ছিল সর্বরোগ নিরাময়ের সিরাপের মতো, যেটা তাকে দিচ্ছিল পুনর্জীবন, আর তখন মেমে দেখতে পায় ফের্নান্দা ও আমারান্তাকে ঘেরা বাস্তবতার এক অভিযোগপূর্ণ দীপ্তি। প্রচণ্ড কষ্ট করতে হয়, এই শালীনতার অভিনয়, আত্মিক দৈন্য, মহত্ত্বের প্রলাপ ওদের মুখের ওপর ছুড়ে না মারার জন্য। দ্বিতীয়বার ছুটির সময়ই সে জেনে গিয়েছিল যে ওর বাবা বাড়িতে বাস করে শুধু বাহ্যরূপ রক্ষার খাতিরে, আর ফের্নান্দা চেনার পর যেমন ওকে চিনত আর পরে পেত্রা কতেসকে জানার জন্য এক সাক্ষাতের ব্যবস্থার পর সে বাবার এই কাজে সায় দেয়। এমনকি তার মনে হয় সে উপপত্নীর মেয়ে হলেই বরং ভালো হতো। সুরার ঘোরের মধ্যে মেমে ভাবে, কী কেলেঙ্কারিই না হতো যদি সে সেই মুহূর্তে প্রকাশ করতে পারত নিজের চিন্তাকে, ভেবে মজা পায় আর তার এই দুষ্টুমিপনার পরিতৃপ্তি এতই গভীর ছিল যে ফের্নান্দার চোখে ধরা পড়ে যায়।

‘কী হয়েছে’, জিজ্ঞেস করে।

‘কিছুই না’, উত্তর দেয় মেমে, ‘কেবল আবিষ্কার করছি তোমাদের দুজনকে কি ভালোবাসাই না বাসি।’

আমারান্তা ভয় পেয়ে যায় বুঝতে পেরে যে, এই কথার পেছনে কতটা ঘৃণা লুকিয়ে আছে। কিন্তু ফের্নান্দা এতই অভিভূত হয়ে পড়ে যে যখন মেমে মধ্যরাতে প্রচণ্ড ব্যথায় মাথা টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার অবস্থা নিয়ে জেগে ওঠে আর প্রচণ্ড পিত্তবমি করে, তখন তার পাগল হওয়ার অবস্থা হয়। ওকে এক বোতল রেড়ির তেল খাওয়ায়, পেটে পুলটিশ দিয়ে সেঁক আর মাথায় দেয় বরফের ব্যাগ আর বাধ্য করে ফ্রান্স থেকে নবাগত এক উদ্ভট ডাক্তার দুই ঘণ্টার বেশি সময় নিয়ে পরীক্ষা করে দেওয়া ডায়েট পালন করতে ও পাঁচ দিন ঘরে আবদ্ধ থাকতে। কারণ, ডাক্তারের ধোঁয়াটে ধারণা অনুযায়ী তার মেয়েলি রোগ হয়েছে। সাহস দ্বারা তাড়িত, মনোবলহীন, করুণ দশায় পড়া মেমের এ অবস্থাকে সহ্য করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না। সম্পূর্ণ অন্ধ কিন্তু স্থিরমস্তিষ্ক ও তখন পর্যন্ত কর্মক্ষম উরসুলাই হচ্ছে একমাত্র ব্যক্তি যে নাকি সঠিকভাবে অনুমানে রোগটা ধরতে পারে। ‘আমার মতে, মাতালদেরই এ ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়’, কিন্তু সে চিন্তাটা শুধু বাতিল করে দেয় তা-ই নয়, এ ধরনের হালকা চিন্তাভাবনার জন্য নিজেকে ভর্ৎসনাও করে। মেমের এই অসহায় অবস্থার জন্য আউরেলিয়ানো সেগুন্দো বিবেকদংশন অনুভব করে ও প্রতিজ্ঞা করে, ভবিষ্যতে মেয়েটার দিকে আরও ভালো করে নজর দেওয়ার। আর এভাবেই বাপ-মেয়ের গড়ে ওঠে এক আনন্দঘন বন্ধুত্বের সম্পর্ক, যা নাকি ওকে কিছুদিনের জন্য রেহাই দেয় পার্টির তিক্ততাপূর্ণ নিঃসঙ্গতা থেকে আর মেমেকে মুক্তি দেয় ফের্নান্দার সর্বক্ষণের পাহারাদারি থেকে। অবশ্যম্ভাবী পারিবারিক সংকটকে ত্বরান্বিত না করেই মেমের সঙ্গে থাকার জন্য। ওকে সিনেমায় বা সার্কাসে নেওয়ার জন্য অন্য সবকিছুকে একপাশে সরিয়ে রাখত আউরেলিয়ানো সেগুন্দো। ও অবসরের বেশির ভাগ সময়ই কাটাত ওর সঙ্গে। শেষের দিনগুলোতে তার অস্বাভাবিক স্থূলত্বের কারণে নিজের জুতার ফিতে বাঁধাও অসম্ভব হয়ে পড়ে তার পক্ষে আর সব ধরনের খাবারের প্রতি তার প্রচণ্ড বাড়াবাড়ি তার মেজাজকেও করে তুলেছিল তিক্ত। নিজের মেয়েকে নতুন করে আবিষ্কারের পর আগের দিনের আমুদেভাব ফিরে আসে আর তার সঙ্গে থাকার আনন্দ ধীরে ধীরে তাকে অবক্ষয় থেকে সরিয়ে দেয়। মেমে তখন বয়সের দিক থেকে পরিপূর্ণ। সে সুন্দরী ছিল না, যেমনটি আমারান্তাও কখনোই ছিল না সুন্দরী, কিন্তু তার বদলে সে ছিল হাসিখুশি, সরল এক মেয়ে, যার ছিল প্রথম সাক্ষাতেই লোকজনের প্রিয়পাত্র হওয়ার মতো গুণ। তার ছিল আধুনিক একটা মন, যা নাকি ফের্নান্দার সেকেলে সংকীর্ণ ও আবদ্ধ মনকে করে আহত আর অন্যদিকে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো আনন্দ পায় সেটাকে উৎসাহ জুগিয়ে। সে-ই মেমেকে ছেলেবেলা থেকে ব্যবহৃত শোবার ঘর থেকে বাইরে নিয়ে আসে। যে ঘরে সেন্টদের ভীতিপ্রদ চোখগুলো ওর বয়ঃসন্ধিকালের আতঙ্ককে এখনো খোরাক জোগায় আর রাজকীয় বিছানা, বিশাল ড্রেসিং টেবিল, মখমলের পর্দা দিয়ে এক ঘর সাজায়, আর খেয়ালই করে না যে নিজের অজান্তেই সে পেত্রা কতেসের ঘরের দ্বিতীয় সংস্করণ তৈরি করে ফেলেছে। মেমের প্রতি সে এতই দিলদরিয়া ছিল যে নিজেও জানত না ওকে কত অর্থ দিচ্ছে, কারণ মেমে নিজেই তার পকেট থেকে টাকা বের করে নিত আর কলা কোম্পানির কমিসারিতে যত ধরনের নিত্যনতুন সৌন্দর্যবর্ধক জিনিসপত্র আসত, আউরেলিয়ানো সেগুন্দো সেগুলোর কথা ওকে জানাত। নখ পালিশ করার জন্য ঝামা পাথরের পুঁটলি, চুল কোঁকড়া করার উপাদান, চোখের দৃষ্টিতে স্বপ্নালু ভাব আনার ড্রপ, নিত্যনতুন সাজার জিনিসে মেমের ঘর এমনভাবে ভরে ওঠে যে প্রতিবারই ফের্নান্দা যখন ওর ঘর গোছানোর জন্য যেত, ড্রেসিং টেবিলটা ফরাসি রমণীদের টেবিলের মতো মনে করে চিন্তিত হয়ে মর্মাহত হতো। তখন ফের্নান্দার সময় বিভক্ত ছিল দুটো কাজে; জেদি, রুগ্‌ণ আমারান্তা উরসুলার জন্য ও অদৃশ্য ডাক্তারদের সঙ্গে পত্রবিনিময়ের মধ্যে। ফলে যখন সে বাবা ও মেয়ের মধ্যে এই ঘনিষ্ঠতা লক্ষ করে, আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর কাছ থেকে একমাত্র যে প্রতিশ্রুতি সে আদায় করে তা হচ্ছে কখনোই মেমেকে পেত্রা কতেসের বাড়িতে না নেওয়ার। আসলে এই সতর্কতার কোনো প্রয়োজন ছিল না, কারণ আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর উপপত্নী তার সঙ্গে মেয়ের ঘনিষ্ঠতায় এতই বিরক্ত ছিল যে মেমের নামটাও শুনতে পারত না। এক অজানা আতঙ্ক তাকে উত্ত্যক্ত করে তুলত; তার সহজাত প্রবৃত্তি যেন ওকে বলে দিচ্ছিল, শুধু ইচ্ছা করলেই ফের্নান্দা যা করতে পারে নি, মেমে তা সহজেই করতে পারবে; তাকে বঞ্চিত করতে পারবে এমন এক ভালোবাসা থেকে যা কিনা আমৃত্যু নিজের জন্য নিশ্চিত বলে জানত। প্রথমবারের মতো আউরেলিয়ানো সেগুন্দোকে উপপত্নীর কঠোর মুখ ও তীব্র ক্ষোভ সহ্য করতে হয়, এমনকি সে ভয়ও পায় যে তার এবাড়ি ওবাড়ি করা তোরঙ্গগুলো আবার স্ত্রীর বাড়ির রাস্তায় রয়েছে। অবশ্য সে রকমটি ঘটে না। কেউই পেত্রা কতেসের চাইতে ভালো করে তার প্রেমিককে চিনত না, আর ভালো করেই জানত, একবার তোরঙ্গগুলো পাঠানো হলে সেগুলো সেখানেই থেকে যাবে, কারণ আউরেলিয়ানো সেগুন্দো যদি কোনো কিছুকে অপছন্দ করে তা হচ্ছে বাড়ি বদল বা পরিবর্তনের মাধ্যমে জীবনটাকে জটিল করে তোলা। ফলে তোরঙ্গগুলো থেকে যায় যেখানে ছিল সেখানেই আর পেত্রা কতেস নিজেকে নিয়োগ করে একমাত্র সেই অস্ত্রগুলো ধার দিয়ে স্বামীকে পুনরায় জয়ে, যে অস্ত্রগুলো দিয়ে মেয়ে তার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবে না। সেটাও ছিল এক অপ্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা, কারণ বাবার নিজস্ব ব্যাপারগুলোতে হস্তক্ষেপ করার ইচ্ছা মেমের কখনোই ছিল না, আর সে ইচ্ছা যদি থাকতও, তাহলে সেটা যেত উপপত্নীর পক্ষে। কাউকে বিরক্ত করার মতো সময় তার বেঁচে থাকত না। সে নিজেই শোবার ঘর ঝাড়ু দিত, বিছানা ঠিক করত যেভাবে নানরা ওকে শিখিয়েছিল, সকালে সে তার পোশাকের পরিচর্যা করত বারান্দায় এমব্রয়ডারি করে বা হাত কলে সেলাই করে। অন্যেরা যখন দুপুরে ঘুমুত, সে তখন দুঘণ্টা ধরে ক্লাভিকর্ড অনুশীলন করত; জানত যে প্রতিদিনের দুঘণ্টার এই স্বার্থত্যাগ ফের্নান্দাকে শান্ত রাখবে। একই কারণে ধর্মীয় মেলায় ও স্কুলের অনুষ্ঠানগুলোর কনসার্টগুলোতে নিজের সব কিছু উজাড় করে দিত, যদিও আস্তে আস্তে তার ডাক কমতে থাকে। সন্ধে হলে প্রসাধন সেরে সাদাসিধে পোশাক গায়ে চড়িয়ে উঁচু জুতা পায়ে গলিয়ে যদি বাবার সঙ্গে কিছু করার না থাকত, তবে বান্ধবীদের বাড়ি যেত, যেখানে থাকত রাতের খাবারের সময় হওয়া পর্যন্ত। আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর সঙ্গে সিনেমায় যাওয়াটাই ছিল তার একমাত্র ব্যতিক্রম।

বান্ধবীদের মধ্যে আমেরিকার তিনটি মেয়েই বিদ্যুতায়িত মুরগির জালের বেড়া ভেঙে মাকন্দের মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে। ওদের একজন ছিল পাত্রিসিয়া ব্রাউন। আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর আতিথেয়তায় কৃতজ্ঞ ব্রাউন সাহেব মেমের জন্য তার দুয়ার খুলে দেয়, আর শনিবারের নাচের আমন্ত্রণ করে ওকে, যে নাকি গ্রিংগোদের মাঝে ছিল একমাত্র স্থানীয়। ফের্নান্দা যখন ব্যাপারটা জানতে পারে, তখন আমারান্তা উরসুলা আর অদৃশ্য ডাক্তারদের কথা ভুলে গিয়ে বিশাল এক নাটকীয়তার সৃষ্টি করে। ‘ভেবে দেখো’, বলে মেমেকে, ‘কবর থেকে কর্নেল কী ভাববে।’ অবশ্যই উরসুলার সমর্থন সে আশা করছিল। কিন্তু সেই প্রাচীন মহিলা, সবাই যা আশা করছিল, তার সম্পূর্ণ উল্টো: তার মতে, নাচের আসরে যোগ দিয়ে ওর একই বয়সের দক্ষিণ আমেরিকার মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার মধ্যে রাগ হওয়ার মতো কিছু নেই, যদি সে নিজের নীতিতে অটল থাকে ও নিজেকে প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত না করতে দেয়। মেমে তারপর দাদির চিন্তাধারা ভালো করেই বুঝতে পারে এবং নাচের পরের দিন খুব ভোরে ওঠে মাসে যাওয়ার জন্য। যত দিন পর্যন্ত না দক্ষিণ আমেরিকানরা তার ক্লাভিকর্ড বাজানো শুনতে চেয়েছে, আর এই খবর দিয়ে মেমে তোলপাড় শুরু করে, তত দিন পর্যন্ত ফের্নান্দার বিরোধিতা অনড় থাকে। যন্ত্রটা আর একবার বাড়ি থেকে বের হয় ও ওটাকে নিয়ে যাওয়া হয় ব্রাউন সাহেবের বাড়ি, যেখানে তরুণী বাদিকা আন্তরিক বাহবা পায় ও পায় উষ্ণতম অভিনন্দন। সেই থকে শুধু সে নাচেরই নিমন্ত্রণ পায় না, পায় রোববারে সুইমিং পুলে যোগ দেওয়ার ও সপ্তাহে একবার দুপুরের খাবারের নিমন্ত্রণ। মেমে পেশাদারদের মতো সাঁতার শেখে, খেলতে শেখে টেনিস, আর শেখে আনারসের ফালি দিয়ে ভার্জিনিয়া হ্যাম খেতে। নাচ ও সুইমিং পুলের মধ্য দিয়ে দ্রুত তার ইংরেজির জড়তা কাটতে থাকে। মেয়ের উন্নতিতে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো এতই উৎসাহী হয় যে এক ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতার কাছ থেকে রঙিন ছবিওয়ালা ছয় খণ্ডের বিশ্বকোষ কেনে যেগুলো মেমে তার অবসরে পড়ত। আগে সে যে সময় ব্যয় করত প্রেমিক-প্রেমিকাদের নিয়ে গল্পের মধ্যে বা বান্ধবীদের নিয়ে পরীক্ষামূলক ঘরে আবদ্ধ হওয়ার পেছনে, তা এখন লাগায় পড়ার পেছনে, তার কারণ এই নয় যে তার ওপর নিয়ম করে এটা চাপানো হয়েছে, বরং এর কারণ হচ্ছে সর্বসাধারণের গুপ্তরহস্যের ব্যাপার নিয়ে আলাপের উৎসাহ সে এরই মধ্যে হারিয়ে ফেলেছে। তার মনে পড়ে যায় শৈশবের মাতাল হওয়ার দুঃসাহসিক ঘটনাটাকে, আর ব্যাপারটাকে এতই মজাদার মনে হয় যে সে আউরেলিয়ানো সেগুন্দোকে সে তা জানায় আর আউরেলিয়ানো সেগুন্দো মজা পায় ওর থেকেও বেশি, ‘যদি তোর মা জানতে পারত’, বলে ওকে হাসতে হাসতে খাবি খেতে খেতে; যেমনটি সে সব সময়ই বলত মেয়ের কাছে গোপন কিছু বলার সময়। সে একই বিশ্বাসের ভিত্তিতে মেয়ের কাছ থেকে কথা আদায় করে নিয়েছে যে মেয়ের প্রেমসম্পর্কিত যেকোনো ব্যাপারই সে বাবাকে জানাবে আর বাবা-মার সঙ্গে ছুটি কাটাতে আসা লালচুলো এক দক্ষিণ আমেরিকান যুবককে ভালো লাগার কথা মেমে জানায় ওকে। ‘কী কাণ্ড’, হাসে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো, ‘যদি তোর মা জানতে পারত।’ কিন্তু মেমে এ-ও বলে যে যুবক তার দেশে ফিরে গিয়েছে, আর কখনোই তার দেখা পাওয়া যায় নি। মেমের পরিণত বিচারবুদ্ধি বাড়িতে শান্তি বজায় রাখে। তখন আউরেলিয়ানো সেগুন্দো পেত্রা কতেসকে আরও বেশি সময় দিত। যদিও তার দেহ-মনে আগের মতো পার্টি করার সামর্থ্য থাকে না, তার পরও জুতোর ফিতে দিয়ে বিড বাঁধা অ্যাকর্ডিয়ানটা বের করে সর্বসমক্ষে বাজানোর সুযোগ সে হাতছাড়া করত না। বাড়িতে আমারান্তা বুনে চলে ওর অন্তহীন শবাচ্ছাদন বস্ত্র আর বার্ধক্য দ্বারা অন্ধকারের গভীর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া উরসুলার কাছে একমাত্র যা দৃশ্যমান ছিল তা হলো চেস্টনাটের নিচে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার প্রেতাত্মা। ফের্নান্দা তার কর্তৃত্ব পাকা করে ফেলে। ছেলে হোসে আর্কাদিওর কাছে তার লেখা মাসিক চিঠিতে আর এক লাইন ও মিথ্যে থাকে না, শুধু গোপন রাখে অদৃশ্য চিকিৎসকদের সঙ্গে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগের ব্যাপারটা, যারা তার বৃহদন্ত্রের মধ্যে এক অক্ষতিকারক টিউমার পেয়েছে আর তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে এক টেলিপ্যাথিক চিকিৎসার জন্য।

আমারান্তার আকস্মিক মৃত্যু এক নতুন আলোড়ন না তুললে বলা যেত যে বুয়েন্দিয়াদের ক্লান্ত ম্যানশনে দীর্ঘদিনব্যাপী সুখ-শান্তি বজায় ছিল। সবার থেকে আলাদা ও বৃদ্ধা হলেও ওকে দেখাত ঋজু ও শক্ত, পাথরের মতো স্বাস্থ্যসম্পন্ন, সব সময়ই যেমনটি ছিল। চিরকালের জন্য কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেসকে প্রত্যাখ্যান করে কান্নার জন্য ঘরের দরজা বন্ধের পর কেউই আর তার চিন্তাধারাকে ধরতে পারে নি। কান্নার পর যখন সে ঘর থেকে বের হয়, তখন তার চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল। সুন্দরী রেমেদিওসের স্বর্গারোহণের সময়, আউরেলিয়ানোদের নিধনের সময়, এমনকি কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া, যাকে এই পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালোবেসেছিল, তার মৃত্যুতেও ওকে কাঁদতে দেখা যায় নি; যদিও তার মরদেহ চেস্টনাটের নিচে পাওয়ার পর সেই ভালোবাসার নিদর্শন সে দিয়েছিল। দেহটা তুলতে সাহায্য করে সে। যোদ্ধার পোশাক পরায় সে দেহটাকে আর দাড়ি কামিয়ে, চুল আঁচড়িয়ে, গোঁফে এমনভাবে মোম লাগায় যে স্বয়ং কর্নেলও তার গৌরবের শিখরের দিনগুলোতে এমনভাবে করত না। কারও মনে হয় নি ভালোবাসার কারণেই সে এগুলো করছে, কারণ মৃত্যুর আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে আমারান্তার ঘনিষ্ঠতা দেখে ওরা অভ্যস্ত ছিল। ফের্নান্দা মর্মাহত হতো যখন সে জীবনের সঙ্গে ক্যাথলিক ধর্মের সম্বন্ধ বুঝতে না পেরে শুধু বুঝত মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কটা, এটা যেন কোনো ধর্ম নয়, শুধু অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আচার-অনুষ্ঠানের সংক্ষিপ্তসার। আমারান্তা স্মৃতির এক জগাখিচুড়ি অবস্থার মধ্যে এমনভাবে জড়িয়েছিল যে, খ্রিষ্টীয় ধর্মতত্ত্বের ওই সব সূক্ষ্ম বিষয়গুলো বোঝার সময় তার ছিল না। সে তার সব স্মৃতিকাতরতাকে অক্ষুণ্ণ রেখেই বৃদ্ধ অবস্থায় পৌঁছেছিল। যখন সে পিয়েত্র ক্রেসপির ওয়ালটজ শুনত, তখন সে বোধ করত একই রকম কান্নার ইচ্ছা, যেমনটি হতো বয়ঃসন্ধিকালে, যেন সময়ের নির্মম শিক্ষা ওর ওপর কোনো ছাপই ফেলে নি। স্যাঁতসেঁতে হয়ে পচে যাচ্ছে এই অজুহাতে সংগীতের কাগজের যে রোলগুলো সে নিজেই আবর্জনায় ফেলে দিয়েছিল, তা সর্বক্ষণই তার স্মৃতির মধ্যে ঘুরছিল আর ছোট ছোট হাতুড়ির আঘাত হানছিল। ভাইপো আউরেলিয়ানোকে যে ভালোবাসার অধিকার দিয়েছিল, সেগুলোকে ডুবিয়ে দিতে চেয়েছিল পচা জলাভূমিতে, আর আশ্রয় নিতে চেয়েছিল কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেসের ছত্রচ্ছায়ায়, কিন্তু তা সে পারে নি, এমনকি তার বৃদ্ধ বয়সের সবচেয়ে মরিয়া কার্যকলাপের মধ্য দিয়েও নয়, সেমিনারিতে পাঠানোর তিন বছর আগে যখন সে ছোট্ট হোসে আর্কাদিওকে গোসল করাত, তখন সে ওকে আদর করত, দাদিরা যেভাবে নাতিকে আদর করে সেভাবে নয়, আদর করত যেভাবে কোনো নারী এক পুরুষকে করে, যেভাবে বলা হয় ফরাসি রমণীরা করে, যেভাবে সে বারো বছর, চৌদ্দ বছর বয়সে করতে চেয়েছে পিয়েত্র ক্রেসপিকে, যখন ওকে দেখত নাচের প্যান্ট পরা অবস্থায় জাদুকরি দণ্ড হাতে, যেটা দিয়ে ও মেট্রোনমির তাল রাখত। মাঝেমধ্যে জীবনের পদক্ষেপে এত সব দৈন্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখার জন্য দুঃখ হতো তার, মাঝেমধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভে আঙুলে সুচ ফোটাত সে কিন্তু তাতে আরও ব্যথা পেত, আরও বাড়ত তার ক্ষোভ আর আরও তিক্ততায় ও কীট দিয়ে ভরে দিত মৃত্যুর পানে নিয়ে যাওয়া সুবাসপূর্ণ ভালোবাসার পেয়ারাবাগানটিকে। কোনোভাবেই এড়াতে না পেরে যেভাবে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া যুদ্ধের কথা ভাবত, আমারান্তা তেমনিভাবে ভাবত রেবেকাকে। কিন্তু তার ভাই যখন স্মৃতিগুলোকে অক্ষম করে ফেলেছিল, তখন সেগুলোকে করেছিল আরও জ্বলন্ত। বহু বছর ধরে সে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছে, যাতে করে ঈশ্বর তাকে রেবেকার আগেই মৃত্যুর মতো শাস্তি না পাঠান। প্রতিবার যখন রেবেকার বাড়ির পাশ দিয়ে যেত, দেখতে পেত ধ্বংসের আগ্রাসন, আর সে আনন্দ পেত এই ভেবে যে ঈশ্বর তার প্রার্থনায় কান দিচ্ছে। এক বিকেলে যখন বারান্দায় সেলাই করছিল, তখন হঠাৎ তার স্থির বিশ্বাস আসে যে যখন তার কাছে রেবেকার মৃত্যুসংবাদ নিয়ে আসবে, সে তখন এই জায়গাতেই একই ভাবে, এই একই আলোর নিচে বসে থাকবে। সে অপেক্ষায় বসে রইল, যেমনটি লোকে বসে থাকে এক চিঠির অপেক্ষায়, আর এটা সত্য যে একসময় সে বোতাম ছিঁড়ে ফেলত আবার নতুন করে লাগানোর জন্য, যাতে করে অলসতা তার অপেক্ষার সময়টাকে আরও দীর্ঘ ও উৎকণ্ঠাময় করে না তোলে। বাড়ির কেউই টের পায় না যে তখন আমারান্তা রেবেকার জন্য সুন্দর এক সমাধিবস্ত্র সেলাই করেছে। পরে যখন আউরেলিয়ানো ত্রিস্তে বলে ফেটে যাওয়া চামড়া ও মাথার খুলির ওপর অল্প কয়েকটি গোছা হলদেটে সুতোর প্রতিমূর্তিকে দেখতে পেয়েছে, আমারান্তা অবাক হয় না, কারণ বর্ণিত অপচ্ছায়াটা ছিল একই রকম, যা সে অনেক দিন যাবতই কল্পনা করে আসছে। সে সিদ্ধান্ত নেয় রেবেকার মৃতদেহে আগের চেহারা পুনরুদ্ধার করার, মুখের বিকৃতি প্যারাফিন দিয়ে ঢেকে দেওয়ার, আর এক সেন্টদের পরচুলা বানানোর, তার জন্য। সুন্দর এক মৃতদেহ সাজাবে সে মখমলের সমাধিবস্ত্ৰ দিয়ে, বেগুনি রঙের ঝালর-ঢাকা কফিন দিয়ে আর জাঁকজমকপূর্ণ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর অর্পণ করবে কীটদের হাতে। সে এই পরিকল্পনা এতই ঘৃণা দিয়ে করে যে ভালোবেসে করলেও ফলাফলটা একই হতো। কিন্তু কোনো বিভ্রান্তি থেকে সে বিহ্বল হয় না, বরং সে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খুঁটিনাটিগুলোকে নিখুঁত করে তোলে, এক বিশেষজ্ঞের চেয়েও ভালো করে, যেন সে এক মৃত্যুর আচার-অনুষ্ঠানের ওস্তাদ। একমাত্র যেটা সে চিন্তা করে নি তা হচ্ছে ঈশ্বরের কাছে এত অনুনয়ের পরও রেবেকার আগেই সে মারা যেতে পারে, আর সত্যি সত্যি তাই ঘটে। কিন্তু শেষ মুহূর্তগুলোতে আমারান্তা কোনো রকমের ক্ষোভ অনুভব করে না, বরং ঘটে উল্টো, সকল প্রকারের তিক্ততা থেকে সে ছিল মুক্ত, কারণ কয়েক বছর আগে থেকে মৃত্যু তাকে মৃত্যুর কথা ঘোষণা করে সৌভাগ্যবতী করে।

এক জ্বলন্ত মধ্যদিনে, মেমের স্কুলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর তার বারান্দায় সেলাইরত অবস্থায় দেখতে পায় তাকে। সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে পারে তাকে আর মৃত্যুর মধ্যে ভীতিপ্রদ কিছু ছিল না, কারণ সে ছিল নীল পোশাক পরিহিত লম্বা চুলের এক মেয়ে, চেহারাটা একটু সেকেলে, কিছু কিছু দিক থেকে পিলার তেরনেরা যখন রান্নাঘরে সাহায্য করত, অনেকটা সেই সময়ের তার মতো। যদিও সে ছিল ভীষণ বাস্তব, ভীষণ মানবিক। এতই বাস্তব যে আমারান্তার কাছে সুইয়ে সুতো পরানোর জন্য সাহায্য চায়। তা সত্ত্বেও ফের্নান্দা অনেকবারই সেখানে উপস্থিত হলেও দেখতে পায় না তাকে। মৃত্যু ওকে বলে না কবে সে মারা যাবে, বা বলে না ওর জন্য নির্দেশিত ঘণ্টা রেবেকার আগে কি না, বরং ওকে আদেশ করে পরের এপ্রিলের ছয় তারিখের মধ্যে নিজের সমাধিবস্ত্র সেলাই আরম্ভ করতে। ওকে অনুমতি দেয় নিজের ইচ্ছেমতো জটিল ও সুন্দর করে তৈরি করতে। কিন্তু করতে হবে রেবেকারটির মতো একই রকম আন্তরিকতা দিয়ে, আর তাকে সতর্ক করে দেয় যে, যেদিন সে বস্ত্র সেলাই শেষ করবে, সেই রাতেই সে মারা যাবে ব্যথা, ভয় বা তিক্ততা ছাড়া। যত বেশি সময় নষ্ট করা সম্ভব তা করার জন্য, আমারান্তা কিছু বায়াল (বিশেষ ধরনের লিলেন) লিলেনের মোটা সুতোর অর্ডার দেয় আর নিজেই বোনে কাপড় তা থেকে। সে এতই সতর্কতার সঙ্গে কাজটা করে যে এতেই কেটে যায় চার বছর। এরপর আরম্ভ করে এমব্রয়ডারি। এভাবে যখন অবশ্যম্ভাবী সেলাইয়ের সমাপ্তি নিকটবর্তী হতে থাকে, তখন বুঝতে পারে একমাত্র কোনো অলৌকিক ঘটনাই তার এই কাজকে রেবেকার মৃত্যুর পর পর্যন্ত লম্বা করতে সক্ষম হবে; কিন্তু সেই একই মনোযোগ তাকে প্রদান করে হতাশাটাকে মেনে নেওয়ার জন্য শেষতক যতটুকু প্রশান্তির প্রয়োজন। এই সময়েই সে বুঝতে পারে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার সেনার মাঝের দুষ্টচক্রের ব্যাপারটাকে। পৃথিবী ছোট হয়ে অবস্থান নেয় তার ত্বকের ওপর আর তার ভেতরটা মুক্ত হয় সব রকমের তিক্ততা থেকে। এই উন্মোচন বহু বছর আগে ঘটে নি বলে দুঃখ হয় তার, তখন, যখন সমস্ত স্মৃতিকে পরিশোধন করে, বিশ্বমণ্ডলের নতুন আলোয় পুনর্গঠন করে, সন্ধেবেলায় পিয়ে ক্রেসপি থেকে ছড়ানো গন্ধে একটুও না কেঁপে, রেবেকাকে তার দুঃখের ক্লিষ্টতা থেকে মুক্ত করা সম্ভব ছিল; ঘৃণা বা ভালোবাসার জন্য নয় বরং অপরিমেয় নিঃসঙ্গতা মোচনের জন্য। এক রাতে মেমের কথা থেকে যে ঘৃণা সে লক্ষ করে তাতে সে বিচলিত হয় না, কারণ তাকে উদ্দেশ করে বলা হলেও সে বোধ করে আর এক নিষ্কলুষ বয়ঃসন্ধিকালের পুনরাবৃত্তি, যেটা নাকি তারটার মতোই হতে পারত কিন্তু এরই মধ্যে সেটা বিদ্বেষের কলুষে পূর্ণ। কিন্তু তখন তার নিয়তিকে সে এমন গভীরভাবে মেনে নিয়েছে যে সব রকমের সংশোধনের পথ যে তার জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে, তা নিশ্চিতভাবে জানার পরও একটুও বিচলিত হয় না। তখন তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল সমাধিবস্ত্রটাকে শেষ করা। প্রথম দিকে যেমন অপ্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি দিয়ে কাজটাকে শ্লথ করছিল, তা না করে ত্বরান্বিত করে শেষ করতে। এক সপ্তাহ আগে সে হিসাব করে দেখে শেষ ফোরটা দেবে সে চারই ফেব্রুয়ারি রাতে, আর মেমের কাছে উদ্দেশ্য না ভেঙে বলে, সে পরের দিন হওয়ার কথা, ক্লাভিকর্ডের কনসার্টটা যেন এগিয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু মেমে তাতে কান দেয় না। আমারান্তা মৃত্যুকে আটচল্লিশ ঘণ্টা পিছিয়ে দেওয়ার জন্য উপায় খোঁজে, এমনকি তার মনে হয় মৃত্যু তার কথায় কান দিয়েছে, কারণ চৌঠা ফেব্রুয়ারির রাতে এক ঝড়ে বৈদ্যুতিক প্ল্যান্ট বিকল হয়ে পড়ে, কিন্তু পরের দিন সকাল আটটায়, সে দেয় তখন পর্যন্ত কোনো নারীর দ্বারা শেষ করা সবচেয়ে সুন্দর কাজের ওপর শেষ ফোঁড়টা, আর কোনো নাটকীয়তা ছাড়াই ঘোষণা করে যে সন্ধে নামার পর সে মারা যাবে। পরিবারের সবাইকেই সে শুধু সতর্ক করে না, সতর্ক করে সাড়া শহরকে, কারণ সে ভেবেছিল, পৃথিবীর লোকদের শেষবারের মতো এক উপকার করে এক জঘন্য জীবনের শোধন করা যেতে পারে, ভাবে মৃতদের কাছে চিঠিপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য তার চেয়ে উপযুক্ত আর কেউ হতে পারে না।

আমারান্তা বুয়েন্দিয়ার গোধূলি আলোয় মৃত্যুর উদ্দেশ্যে চিঠি নিয়ে যাওয়ার জন্য নোঙর তোলার খবর দুপুরের আগেই সারা মাকন্দে ছড়িয়ে পড়ে; আর বেলা তিনটের সময় বসার ঘরে ছিল এক বাক্সভর্তি চিঠি। যারা চিঠি লিখতে চায় নি, তারা আমারান্তাকে মৌখিক বার্তা দেয় যে বার্তার প্রাপকদের নাম, মৃত্যুর তারিখ সে খাতায় লিখে নেয়। ‘দুশ্চিন্তা কোরো না’, প্রেরকদের আশ্বস্ত করে সে, ‘পৌছানোর পর প্রথমেই ওদের কথা জিজ্ঞেস করে তোমাদের বার্তা পৌঁছে দেব।’ মনে হচ্ছিল সে একজন প্রবঞ্চনাকারী। শারীরিক বা মানসিক বৈকল্যের কোনো লক্ষণ বা কোনো ব্যথার চিহ্ন আমারান্তার মাঝে দেখা যায় না, এমনকি সবকিছু শেষ করার ফলে মনে হচ্ছিল তার যেন একটুখানি বয়স কমে গিয়েছে। সব সময়ের মতোই সে ছিল ঋজু ও কৃশকায়। যদি না উঁচু হয়ে থাকত ও কিছু দাঁত পড়ে গিয়ে না থাকত, তাহলে ওকে সত্যিকার বয়সের তুলনায় অনেক কম বয়সীই মনে হতো। পিচ দেওয়া এক বাক্সে চিঠিগুলো রাখার ব্যবস্থা সে- ই করে আর নির্দেশ দেয় এমনভাবে বাক্সটা তার কফিনে রাখতে, যাতে আর্দ্রতা থেকে যতটা সম্ভব রক্ষা পায়। সকালে ডেকে আনা এক ছুতোর বৈঠকখানায় দাঁড়িয়ে এমনিভাবে কফিনের মাপ নেয়, যেন পোশাক বানানোর মাপ নিচ্ছে। শেষের ঘণ্টাগুলোতে সে এমন প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে, যাতে করে ফের্নান্দার মনে হয় সে সবার সঙ্গে প্রহসন করছে।

উরসুলা, যার অভিজ্ঞতা ছিল যে বুয়েন্দিয়ারা অসুস্থতা ছাড়াই মারা যায়, তার কোনো সন্দেহ থাকে না যে আমারান্তা মৃত্যুর পূর্ববোধ পেয়েছে, কিন্তু তার পরও তাকে উদ্বিগ্ন করে তোলে বাক্সভর্তি চিঠিগুলো, আশঙ্কা করে দ্রুত পৌঁছানোর জন্য প্রেরকেরা তাকে না জ্যান্তই কবর দেয়। কাজেই সে অনাহূতদের সঙ্গে চিৎকার করে বাড়ি খালি করার কাজে নেমে পড়ে। আর বেলা চারটার সময় সে সফল হয়। সে সময়ে আমারান্তা নিজের সবকিছু গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া শেষ করেছে। শুধু পালিশ না করা কাঠের করুণ কফিনের ওপর রাখা ছিল মৃত্যুর মধ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য এক প্রস্থ পোশাক ও একজোড়া কর্ড কাপড়ের চপ্পল। সে এই সতর্কতা অবলম্বন করে, কারণ তার মনে পড়ে যায় যখন কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া মারা যায়, তখন নতুন একজোড়া জুতো কিনতে হয়েছিল, কারণ তার অবশিষ্ট বলতে ছিল একজোড়া ঘরে পরার চপ্পল, যেটাকে সে কর্মশালায় ব্যবহার করত। পাঁচটা বাজার কিছু আগে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো আসে মেমেকে কনসার্টে নেওয়ার জন্য। সে আশ্চর্য হয়ে দেখে যে বাড়ি প্রস্তুত করা হয়েছে এক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য। কাউকে যদি তখন সত্যিকার অর্থে জীবন্ত বলে মনে হতো, সে ছিল প্রশান্ত আমারান্তা। যেন তখনো তার ফসল কেটে ঘরে তোলার মতো যথেষ্ট সময় হাতে ছিল। আওরেলিয়ানো সেগুন্দ ও মেমে ওর কাছ থেকে ব্যঙ্গাত্মক বিদায় নেয় আর প্রতিশ্রুতি দেয় পরের শনিবার তার পুনরুজ্জীবন উৎসবের। আমারান্তা মৃতদের কাছে চিঠি নিয়ে যাওয়ার সংবাদ জনসাধারণের কাছে শুনে আকর্ষিত ফাদার অ্যান্তনিও ইসাবেল পাঁচটার সময় আসে বিয়াতিকো (মরণাপন্নদের মুখে দেওয়ার জন্য ছোট ছোট রুটি) সঙ্গে নিয়ে, আর পনেরো মিনিট তাকে অপেক্ষা করতে হয় মরণাপন্নের বাথরুম থেকে বের হওয়ার জন্য। যখন পিঠের ওপর চুল ছাড়া ম্যাডাপোলাম কাপড়ের রাতপোশাক পরিহিতা আমারান্তাকে দেখে থুথুড়ে যাজকের মনে হয় ব্যাপারটা এক কৌতুক ছাড়া কিছুই নয়, উপাসনায় সাহায্যকারী বালককে বিদায় দেয়। ভাবে, এসে যখন পড়েছেই, সে বিশ বছর জীবনের পাপ স্বীকার করতে না চাওয়া আমারান্তার কাছ থেকে পাপ স্বীকারোক্তি আদায় করে নেবে। সহজভাবে আমারান্তা অস্বীকার করে আর জানায়, আত্মিক কোনো সাহায্যে তার দরকার নেই, কারণ তার বিবেক সম্পূর্ণরূপে অমলিন। ফের্নান্দা শিউরে ওঠে। তার কথা অন্যে শুনতে পাবে, তার তোয়াক্কা না করে উঁচু স্বরে জিজ্ঞেস করে কী ভয়ংকর পাপ সে করেছে যে স্বীকারোক্তির লজ্জার চেয়ে পাপপূর্ণ এক মৃত্যুকে সে বেছে নিচ্ছে, ফলে আমারান্তা শুয়ে পড়ে এবং উরসুলাকে বাধ্য করে তার কুমারীত্ব সম্পর্কে জনসমক্ষে সাক্ষ্য দিতে।

‘কেউ যেন মনে না করে অন্য কিছু’, চিৎকার করে উরসুলা যাতে করে ফের্নান্দা শুনতে পায়, ‘আমারান্তা বুয়েন্দিয়া যে অবস্থায় এসেছিল, সেই একই অবস্থায় এই দুনিয়া থেকে চলে যাচ্ছে।’ আর সে উঠে দাঁড়ায় না। বালিশে হেলান দেয়, যেন সত্যি সত্যি সে অসুস্থ। সে তার লম্বা বেণি বাঁধে আর সেগুলোকে কানের ওপর গোল করে চূড়া করে, যেন মৃত্যু তাকে বলেছিল এভাবেই কফিনে থাকতে হবে। পরে উরসুলার কাছে এক আয়না চেয়ে নিয়ে চল্লিশ বছরের বেশি সময়ের মধ্যে প্রথমবারের মতো বয়সের কারণে জীর্ণ মুখটা দেখে আর মনের মধ্যে নিজের যে প্রতিচ্ছবি তার ছিল, তার সঙ্গে মিলে যাওয়ায় আশ্চর্য হয়ে পড়ে। শোবার ঘরে নীরবতা নেমে আসায় অন্ধকার নেমে আসছে, বুঝতে পারে উরসুলা। ‘ফের্নান্দার কাছ থেকে বিদায় নে’, ওকে অনুনয় করে, ‘এক মিনিটের মীমাংসা সারা জীবনের বন্ধুত্বের চেয়েও দামি।’

‘আর কোনো লাভ নেই, এতে’, অস্বীকার করে আমারান্তা।

পূর্বপরিকল্পনানুযায়ী মঞ্চে আলো জ্বলে অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হলে ওর কথা না ভেবে পারে না মেমে। বাজনাটার অর্ধেক শেষ হওয়ার পর কেউ একজন খবরটা ওর কানে দেয় আর অনুষ্ঠানটা স্থগিত হয়ে যায়। প্রচণ্ড ভিড়ে ঠেলাঠেলি করে পথ করে নিতে হয় আউরেলিয়ানো সেগুন্দোকে, কুশ্রী বিবর্ণ হয়ে যাওয়া, হাতে কালো ব্যান্ডেজ বাঁধা, জাঁকজমকপূর্ণ সমাধিবস্ত্র পরিহিত জরাজীর্ণ কুমারীর মরদেহ দেখতে। বসার ঘরে তাকে দেখানোর জন্য রাখা হয়েছিল চিঠির বাক্সটার পাশে।

আমারাস্তা যাওয়ার নয় রাত পর্যন্ত বিছানা ছেড়ে ওঠে না উরসুলা। সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ ওর দেখাশোনার ভার নেয়। ওর জন্য শোবার ঘরে খাবার নিয়ে যেত, নিয়ে যেত বিহা (bija-একধরনের কাঁকরোলের মতো লাল ফল) ভেজানো পানি গোসলের জন্য, আর মাকন্দে যা ঘটত, সে সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল রাখত তাকে। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো ঘন ঘন দেখতে যেত তাকে, আর পড়ার কাপড়চোপড় ও দৈনন্দিন জীবনের জন্য অপরিহার্য জিনিসগুলো তার বিছানার কাছে রাখার অল্প সময়ের মধ্যেই তার হাতের নাগালের মধ্যে এক বিশ্ব গড়ে ওঠে। অবিকল তারই মতো দেখতে, যে আমারান্তা উরসুলাকে সে লিখতে শিখিয়েছে, তার প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা তৈরি হয় তার। তার চিন্তার স্বচ্ছতা, নিজের কাজ নিজে করার ক্ষমতা দেখে প্রাকৃতিক এক শ বছরের ভারের কাছে স্বাভাবিকভাবেই হার মানার ব্যাপারে সাধারণের মনে সন্দেহ তৈরি হতো আর যদিও তা স্পষ্ট ছিল যে তার দৃষ্টিতে সমস্যা আছে, কিন্তু কেউ সন্দেহও করতে পারে নি যে সে ছিল সম্পূর্ণরূপে অন্ধ। সে সময় বাড়ির জীবনটাকে লক্ষ করার জন্য তখন সে এতই সময় ব্যয় ও নীরবতা ব্যয় করত যে সে-ই প্রথম বুঝতে পারে মেমের ভেতরের নিঃশব্দ অস্থিরতা। ‘এদিকে আয়’, ওকে বলে, ‘এখন যখন আমরা দুজনেই এখানে একা, এবার তাহলে এই থুথুড়ে বুড়ির কাছে স্বীকার কর তোর কী হয়েছে।’

মেমে এক থামা থামা হাসি দিয়ে এড়িয়ে যায় ব্যাপারটা। উরসুলা জোর করে না, কিন্তু তার সন্দেহ সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়, যখন থেকে মেমে আর ওকে দেখতে আসে না। জানত যে সে স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও বেশি সাজগোজ করে, এক মুহূর্তও স্থির থাকে না, রাস্তায় বের হওয়ার ঘণ্টা আসার জন্য অপেক্ষার সময়টা তার পাশের শোবার ঘরের বিছানায় এপাশ- ওপাশ করে রাত কাটায় আর এমনকি প্রজাপতির ডানা ঝাপটানিতেও উত্ত্যক্ত হয় সে। একবার সে বলতে শোনে যে মেমে যাচ্ছে আউরেলিয়ানো সেগুন্দোকে দেখতে, কিন্তু অবাক হয়ে যায় যখন ফের্নান্দার স্বামী বাড়িতে আসে মেমেকে খুঁজতে, আর ফের্নান্দা কিছুই সন্দেহ না করাতে অবাক হয়ে যায় ফের্নান্দার কল্পনার সীমাবদ্ধতা দেখে। এক রাতে সিনেমা হলে মেমের সঙ্গে এক লোককে চুমু খেতে দেখে ফের্নান্দা বাড়ি তোলপাড় করে তোলার অনেক আগেই এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে মেমে গোপন জরুরি কোনো ব্যাপারে জড়িয়ে চাপা উৎকণ্ঠায় আছে।

মেমে এই সময় এতই বুদ্ধিহীন হয়ে পড়ে যে উরসুলা তার বিরুদ্ধে নালিশ করেছে বলে সে অনুযোগ করে। আসলে সে নিজের কাছেই নিজের বিরুদ্ধে নালিশ করে। অনেক আগে থেকেই সে চলার পথে এমন কিছু চিহ্ন রেখে যাচ্ছিল, যা জাগিয়ে দিত ঘোর তন্দ্রাচ্ছন্ন কাউকেও আর ফের্নান্দার, ব্যাপারটাকে আবিষ্কার করতে এত সময় লাগে কারণ সে-ও অদৃশ্য চিকিৎসকদের সঙ্গে তার সম্পর্কের কারণে আচ্ছন্ন ছিল এক প্রচণ্ড ঘোরে। এমনকি তার পরও শেষ পর্যন্ত তার নজরে পড়ে মেয়ের গভীর নীরবতা, হঠাৎ ক্রোধোন্মত্ত অবস্থা, মনমেজাজের আকস্মিক পরিবর্তন, আর মেয়ের কথায় স্ববিরোধিতা। সে আরম্ভ করে এক অনমনীয় কিন্তু গোপন পাহারার। আগের মতোই বান্ধবীদের সঙ্গে বাইরের যেতে দেয় তাকে। শনিবারের পার্টির জন্য পোশাক পরায় সাহায্য করে, আর এমন কোনো প্রশ্ন করে না যাতে করে মেমে সতর্ক হয়। ফের্নান্দার কাছে এমন অনেক প্রমাণ ছিল যে মেমে যা বলে তার বদলে অন্য কিছু করে। কিন্তু তারপর তার সন্দেহ সম্পর্কে কোনো ইঙ্গিত দেয় না। অপেক্ষা করে মোক্ষম সময়ের। এক রাতে মেমে ঘোষণা করে যে সে বাবার সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাচ্ছে। খানিক পর ফের্নান্দা শুনতে পায় পার্টিতে বাজির শব্দ ও নির্ভুলভাবে শোনে আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর বাজানো অ্যাকর্ডিয়ানের সুর পেত্রা কতেসের বাড়ির দিক থেকে ভেসে আসতে। গায়ে কাপড়ও চড়ায় সে, ঢুকে গিয়ে সিনেমা হলে, লেন্সের আলো আঁধারের মধ্যে চিনতে পারে মেয়েকে। অনুমান নিশ্চিত হওয়ার কারণে তার স্তম্ভিত অনুভূতি বাধা দেয়, যার সঙ্গে মেমে চুমু খাচ্ছিল তাকে দেখতে, কিন্তু দর্শকদের কান ফাটানো হাসির মধ্যেও শুনতে পায় লোকটার কাঁপা কাঁপা গলার স্বর। ‘দুঃখিত ভালোবাসা আমার’, বলতে শোনে, ওকে আর কোনো কথা না বলে হল থেকে বের করে কোলাহলপূর্ণ তুর্কদের সড়ক দিয়ে লজ্জাজনকভাবে মেমেকে নিয়ে এসে শোবার ঘরে ঢুকিয়ে তালাবদ্ধ করে।

পরের দিন সন্ধে ছয়টায় লোকটার গলা চিনতে পারে, যখন সে মেমের সঙ্গে দেখা করতে যায়। সে ছিল অল্প বয়সী, গায়ের রং ফ্যাকাশে, তার চোখ দুটি ছিল কালো বিষাদমাখা। যেটা দেখে ফের্নান্দা হয়তো এতটা আশ্চর্য হতো না যদি না জিপসিদের সঙ্গে তার পরিচয় থাকত, আর যুবকটার মধ্যে এমন এক স্বপ্নালু ভাব ছিল যে ফের্নান্দার চেয়ে কম কঠোর যেকোনো মা-ই বুঝতে পারত মেমের প্রেমে পড়ার কারণ। সুতা বেরিয়ে পড়া লিলেনের পুরোনো জামা গায়ে, অন্য উপায় না পেয়ে সাদা দস্তার পাতের তালি দেওয়া জুতা পরা যুবকের হাতে ছিল গত শনিবারে কেনা এক খড়ের হ্যাট। সেই সময়ের মতো ভীত সে সারা জীবনে কখনোই ছিল না বা কখনোই সে আর এত ভয় পাবে না। কিন্তু তার আত্মসম্মানবোধ ও রাশভারী চালচলন তাকে অপমান থেকে বাঁচায় আর সেই সঙ্গে ছিল তার নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য, যেটা মলিন করে দিয়েছে তার রুক্ষ শ্রমিকের হাত ও নখ। তার পরও ফের্নান্দার এক নজরই বোঝার জন্য যথেষ্ট ছিল যে সে ছিল এক দক্ষ কারিগর। তার চোখে পড়ে পরনের একমাত্র রোববারের স্যুটের নিচে কলা কোম্পানিতে কাজ করার ফলে চর্মরোগে ক্ষয়ে যাওয়া ত্বক। ছেলেটাকে কোনো কথাই বলতে দেয় না সে। এমনকি দরজা পার হতেও দেয় না তাকে, আর এক মুহূর্ত পরই দরজা বন্ধ করে দিতে হয় তাকে, কারণ বাড়ি ভরে যায় হলুদ প্রজাপতিতে।

‘দূর হয়ে যা’, ওকে বলে, ‘ভদ্র লোকদের সঙ্গে দেখা করতে চাওয়ার মতো কোনো কারণই থাকতে পারে না তোর।’

ছেলেটার নাম ছিল মাউরিসিও ব্যাবিলনিয়া। মাকন্দেই তার জন্ম ও বড় হয়েছে সেখানেই, আর কলা কোম্পানিতে সে ছিল শিক্ষানবিশ মেকানিক। মেমের সঙ্গে ওর পরিচয় ঘটনাক্রমে। এক বিকেলে প্যাট্রিসিয়া ব্রাউনের সঙ্গে কলা প্ল্যান্টেশনে ভ্রমণের জন্য গাড়ি খুঁজতে যায় মেমে। ড্রাইভার অসুস্থ থাকায় ওকে চালক হিসেবে পাঠানো হলে শেষ পর্যন্ত মেমের সুযোগ হয় চালকের পাশে বসে গাড়ি চালানো দেখার ইচ্ছাটাকে পূরণ করার। আসল ড্রাইভারের উল্টো, মাউরিসিও ব্যাবিলনিয়া ওকে হাতে-কলমেও একবার প্রদর্শন করে। সেটা ছিল যখন মেমে ব্রাউন সাহেবের বাড়ি বেড়াতে যেত এবং মেয়েদের জন্য গাড়ি চালানোটা অসম্মানজনক বলে মনে করা হতো তখনকার কথা। কাজেই শুধু তথ্যগত জ্ঞান নিয়েই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আর কয়েক মাসের মধ্যে মাউরিসিও ব্যাবিলনিয়ার সঙ্গে তার দেখা হয় না। পরে তার মনে পড়ে যাবে যে, ভ্রমণের সময় হাতের রুক্ষতা বাদ দিলে ওর পৌরুষোচিত সৌন্দর্য তাকে আকর্ষণ করেছিল। প্যাট্রিসিয়া ব্রাউনকে খুলে বলাতে সে বলে, তার নিরাপত্তাবোধে হুমকি মনে হওয়াতে হাতের রুক্ষতা তার ভালো লাগে নি। বাবার সঙ্গে প্রথম শনিবার সিনেমায় যাওয়ার পর অদূরে লিলেনের জামা পরা মাউরিসিয়ো ব্যাবিলনিয়াকে বসা দেখে, আর লক্ষ করে ওকে বারবার দেখতে গিয়ে ছবিতে মনোযোগ দিচ্ছে না সে। আর শুধু দেখার জন্যই দেখা নয়, সে যে দেখেছে, এটা মেমেকে বোঝানোর জন্যই দেখা। ব্যাপারটার নগ্নতায় ক্রুদ্ধ হয় মেমে। ছবি শেষে আউরেলিয়ানো সেগুন্দোকে সম্ভাষণ জানাতে নিকটে আসে আর কেবল তখনই মেমে জানতে পারে যে ওরা একে অপরকে চেনে, কারণ সে আগে আউরেলিয়ানো ত্রিস্তের সেকেলে ইলেকট্রিক প্ল্যান্টে কাজ করত, আর ওর বাবার সঙ্গে তার ব্যবহার ছিল অধস্তন ব্যক্তির মতো, ফলে তার যে অহংকারবোধ, মেমেকে পীড়া দিচ্ছিল, তা কেটে যায়। যে রাতে ওকে স্বপ্ন দেখে যে একটা জাহাজডুবি থেকে সে তাকে বাঁচাচ্ছে, তার আগে একাকী কখনোই ওরা দুজনে দেখা করে নি অথবা সম্ভাষণ ছাড়া ওর সঙ্গে কোনো কথাও বলে নি মেমে, তবু তখন তার কৃতজ্ঞতার বদলে প্রচণ্ড রাগ হয় যেন ও যে সুযোগটা চাইছে, মেমে সেই সুযোগ দিয়ে দিয়েছে, যেখানে মেমে ছিল তার সম্পূর্ণ উল্টো আর সে তা শুধু তার বেলায়ই নয়, মেমের ব্যাপারে আগ্রহী যেকোনো পুরুষের বেলায়ই। কাজেই স্বপ্ন দেখার পর তার এতই বেশি রাগ হয় যে ঘৃণার বদলে দেখা করার এক অদম্য ইচ্ছা দেখা দেয় তার মধ্যে। এক সপ্তাহের মধ্যে উৎকণ্ঠাটা আরও তীব্র হয় আর শনিবারটায় ওর সঙ্গে দেখা করা এতই জরুরি হয়ে পড়েছিল যে তাকে প্রচণ্ড কসরত করতে হয় যখন মাউরিসিও ব্যাবিলনিয়া ছবি দেখার সময় ওকে সম্ভাষণ জানালে তার হৃৎপিণ্ডটা যে লাফ দিয়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে, তা ওকে বুঝতে না দেওয়ার জন্য। ক্রোধ বা ভালো লাগার এই কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় প্রথমবারের মতো ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় আর শুধু তখনই মাউরিসিও ব্যাবিলনীয় নিজেকে তার হাত ঝাঁকাতে দেয়। মুহূর্তের এক ভগ্নাংশের জন্য এই আবেগের কারণে অনুশোচনা বোধ করলেও অনুশোচনাটা নিষ্ঠুর এক সন্তুষ্টিতে রূপান্তরিত হয় ওর হাত ভেজা আর ঠান্ডা দেখে। এই রাতেই বুঝতে পারে যে মাউরিসিও ব্যাবিলনিয়াকে তার উচ্চাশার অসারতা না দেখানো পর্যন্ত সে মুহূর্তের জন্যও স্বস্তি পাবে না, আর সপ্তাহটা কাটায় সে এই উৎকণ্ঠায় খাবি খেতে খেতে। গাড়ি খুঁজতে যাওয়ার সমস্ত নিষ্ফল অজুহাত শেষ করে ফেলে সে পাত্রিসিয়া ব্রাউনের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত সে সেই উত্তর আমেরিকার লালচুলোর শরণাপন্ন হয়, কারণ তখন সে মাকন্দে ছুটি কাটাচ্ছিল, আর নতুন মডেলের গাড়ি চেনানোর অজুহাতে ওকে গ্যারেজে নিয়ে যেতে বাধ্য করে। যে মুহূর্ত থেকে তাকে দেখে, তখন থেকে নিজেই নিজের সঙ্গে প্রতারণা করে। বুঝতে পারে সত্যিকার অর্থে মাউরিসিও ব্যাবিলনিয়ার সঙ্গে একাকী কাটানোর ইচ্ছাটাকে আর সহ্য করতে পারছিল না, আর তার প্রচণ্ড রাগ হয়, যখন বুঝতে পারে যে তাকে আসতে দেখে মাউরিসিও সেটা ধরে ফেলেছে।

‘নতুন মডেলগুলো দেখতে এসেছি’, বলে মেমে। ‘হ্যাঁ, এটা ভালো এক অজুহাত’, সে বলে। মেমে বুঝতে পারে যে সে অহংকারের আগুনে টগবগ করে ফুটছে, আর মরিয়া হয়ে অপমান করার উপায় খোঁজে। কিন্তু সে তাকে সময় দেয় না। ‘ভয় পেয়ো না’, নিচু স্বরে বলে, ‘এটাই প্রথমবার কোনো মেয়ে কোনো পুরুষের জন্য পাগল হয় নি।’ মেমে এতই অসহায় বোধ করে যে নতুন মডেলগুলো না দেখেই গ্যারেজ ত্যাগ করে আর প্রচণ্ড রাগে কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে রাতটা কাটায়। লালচুলো দক্ষিণ আমেরিকান, সত্যিকার অর্থে যাকে তার ভালো লাগতে শুরু করে ছিল, তাকে মনে হয় ডায়াপার পরা এক বাচ্চা ছেলে। আর তখনই বুঝতে পারে হলুদ প্রজাপতিগুলো মাউরিসিও ব্যাবিলনিয়ার উদয় হওয়ার আগে আগে আসে। এর আগেও সে দেখেছে ওগুলোকে, বিশেষ করে গ্যারেজের ভেতরে আর দেখে ভেবেছিল, রঙের গন্ধে ওগুলো হয়তো এসে থাকবে। মাঝেমধ্যে ওগুলোকে অনুভব করছে সিনেমা হলে ওর মাথার ওপর ডানা ঝাপটাতে। কিন্তু মাউরিসিও ব্যাবিলনিয়া যখন তাকে এমন এক অপচ্ছায়ার মতো অনুসরণ করতে থাকে, যার উপস্থিতি শুধু সেই বুঝতে পারত, তখনই সে বুঝতে পারে যে হলুদ প্রজাপতিগুলোর সঙ্গে ওর কোনো সম্পর্ক আছে। মাউরিসিও ব্যাবিলনিয়া সব সময় উপস্থিত থাকত সর্বসাধারণের কনসার্টে, সিনেমায়, হাই মাসে আর ওকে বের করতে মেমের চোখ দিয়ে দেখতে হতো না, কারণ প্রজাপতিগুলোই সেটা নির্দেশ করত। একবার দমবন্ধ করা এত ডানা ঝাপটানো আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর কাছে অসহ্য হয়ে পড়লে মেমের প্রচণ্ড ইচ্ছা জাগে বাবার কাছে সবকিছু স্বীকার করতে, যেমনটি সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, কিন্তু তার সহজাত প্রবৃত্তি তাকে বলে এইবার সে সব সময়ের মতো হাসবে না: ‘তোর মা কী বলবে যদি জানতে পারে।’ এক সকালে গোলাপগাছগুলোকে ছাঁটার সময় ফের্নান্দা পিলে চমকে দেয়, এক চিৎকার করে মেমেকে সরিয়ে দেয়, বাগানের যে জায়গা থেকে রেমেদিওস লা বেইয়্যা স্বর্গারোহণ করেছিল, সেখান থেকে। হঠাৎ করে এই অনবরত ডানা ঝাপটানোর ফলে ফের্নান্দার মনে হয় অলৌকিক সেই ব্যাপারটার পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে আর তার মেয়ের বেলাতে ওগুলো ছিল প্রজাপতি। মেমে দেখে ওগুলোকে, যেন অকস্মাৎ জন্ম হয়েছে ওদের আলো থেকে, আর তার বুকটা ধক করে ওঠে। ওই মুহূর্তে তার কথামতো পাত্রিসিয়া ব্রাউনের দেওয়া উপহারস্বরূপ এক প্যাকেট নিয়ে ঢোকে মাউরিসিও ব্যাবিলনিয়া। মুখের আরক্তিম ভাব লুকিয়ে, মানসিক তোলপাড় আড়ালে করে, কোনো রকমে মুখে স্বাভাবিক হাসি এনে বলে প্যাকেটটা রোলিংয়ের ওপর রাখতে, কারণ তার আঙুলগুলো মাটির লেগে নোংরা হয়ে আছে। আগে কোথায় দেখেছে তা মনে না করতে পেরে কয়েক মাস পর যাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে, তার মধ্যে ফের্নান্দা একমাত্র যা লক্ষ করে তা হচ্ছে তার চামড়ার জন্ডিসে আক্রান্ত রোগীর মতো হলদেটে রং।

‘লোকটা খুবই অদ্ভুত’, বলে ফের্নান্দা, ‘মুখ দেখে মনে হয় শিগগিরই মারা যাবে।’

মেমে ভাবে, তার মা প্রজাপতিগুলোর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আছে। গোলাপের ঝাড় ছাঁটা হলে হাত ধোয় সে আর প্যাকেটটা শোবার ঘরে নিয়ে যায় খোলার জন্য। ভেতরে ছিল একধরনের চীনা খেলনা, যেটা পাঁচটা সমকেন্দ্রিক বাক্সের সমন্বয়ে বানানো আর শেষ বাক্সটায় ছিল কোনো রকমে লিখতে পারে, এমন কারও দ্বারা বহু কষ্টে আঁকা: শনিবার সিনেমায় দেখা হবে। মেমে দেরি করে আসা হতবুদ্ধি অবস্থায় অনুভব করে এই ভেবে যে রোলিংয়ের ওপর বাক্সটা অনেক সময় ধরে ফের্নান্দার কৌতূহলের সীমার মধ্যে ছিল, যদিও মাউরিসিও ব্যাবিলনিয়ার সাহস দেখে আনন্দিত হয় আর মেমে তার কথামতো সিনেমায় দেখা করবে, তার এই সরল বিশ্বাস মেমেকে দোলা দিয়ে যায়। তখন থেকেই মেমে জানত শনিবার রাতে আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর এক কাজ আছে, কিন্তু সারা সপ্তাহ জুড়ে উৎকণ্ঠার আগুনে তাকে এমনভাবে জড়িয়ে রাখে যে সে বাবাকে রাজি করায় একাকী ওকে সিনেমায় রেখে যেতে আর শো শেষ হলে ফিরে আসতে। বাতিগুলো জ্বলা অবস্থায় এক রাতের প্রজাপতি তার মাথার ওপর ডানা ঝাপটায়। আর তখনই ঘটে ব্যাপারটা। যখন বাতিগুলো নেভে মাউরেসিয়ো ব্যাবিলনিয়া বসে তার পাশে। মেমে অনুভব করে খাবি খাচ্ছে সে এক উৎকণ্ঠাজড়িত ভয়ে, যেখান থেকে স্বপ্নে যেমনটি ঘটেছিল, একমাত্র যে তাকে উদ্ধার করতে পারে সে হচ্ছে মোটরের তেলের দুর্গন্ধে ভরা আলো আঁধারে কোনো রকমে দেখতে পারা পাশের লোকটা।

‘যদি না আসতেন’, বলে সে, ‘আমাকে কখনোই আর দেখতে পেতেন না।’ মেমে ওর হাতের ভার অনুভব করে হাঁটুতে আর জানে যে সেই মুহূর্তে উভয়েই চলে এসেছে এক অসহায়ত্বের অন্য পাশে।

‘তোমার যা আমাকে ধাক্কা দেয়’, হাসে, ‘তা হচ্ছে নিখুঁতভাবে তুমি তাই বলো, যা তোমার বলা উচিত নয়।’

মেমে ওর প্রেমে পাগল হয়ে যায়। ঘুম ও খিদে নষ্ট হয় তার, আর সে ডুবে যায় নিঃসঙ্গতার এতই গভীরে যে এমনকি বাবাও হয়ে ওঠে এক উৎপাতবিশেষ। ফের্নান্দাকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য মিথ্যে কাজের জটিল এক জাল তৈরি করে সে, বান্ধবীদের আর দেখতে যায় না, আর সমস্ত গতানুগতিকতার বেড়া ডিঙিয়ে মাউরিসিও ব্যাবিলনিয়ার সঙ্গে দেখা করে যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গায়। প্রথম প্রথম ওর রুক্ষতা তাকে বিরক্ত করত। প্রথমবার যখন গ্যারেজের পেছন দিককার দূর্বা ঘাসে ভরা মরুভূমিতে নির্জনে মিলিত হয়, তখনো তাকে দয়ামায়াহীনভাবে টানতে টানতে এমন এক জান্তব অবস্থায় নিয়ে আসে যে তাকে করে ফেলে বিধ্বস্ত। মেমে কয়েক দিন দেরি করে বুঝতে পারে যে এটাও একধরনের কোমলতা আর তখন অস্থির হয়ে ওঠে সে, ক্ষার দিয়ে তেল পরিষ্কার করার গন্ধের নিশ্বাসে ধাক্কা খাওয়ার উৎকণ্ঠায় পাগল হয়ে বাঁচে শুধু ওরই জন্য। আমারান্তা মৃত্যুর কিছুদিন আগে পাগলামির ভেতরেও এক প্রকৃতিস্থতার জায়গায় প্রবেশ করলে ভয়ে কাঁপে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার সামনে। তখনই তার কানে আসে তাস দেখে ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে, এমন এক রমণীর কথা আর গোপনে দেখা করতে যায় তার সঙ্গে। সে ছিল পিলার তেরোনেরা। ভেতরে ঢুকতে দেখেই মেমের গোপনীয়তার কারণ বুঝতে পারে সে। ‘বসো’, ওকে বলে, ‘এক বুয়েন্দিয়ার ভবিষ্যৎ বুঝতে আমাকে তাস দেখতে হবে না।’ মেমে জানতও না আর তার কাছে সব সময় অজানা থেকে যাবে যে এই শতবর্ষী ভবিষ্যৎ বক্তা হচ্ছে তার পরদাদি। সে যখন কঠোর বাস্তবতার সঙ্গে উন্মোচন করে যে প্রেমের উৎকণ্ঠা মোচন একমাত্র বিছানাতেই ঘটে, বিশ্রামে নয়; মেমের তখন তা বিশ্বাস করতে বাঁধে। মাউরিসিও ব্যাবিলনিয়া যদিও একই মত পোষণ করত, তবু মেমে তাতে বিশ্বাস করে না, কারণ ভেতরে ভেতরে তখনো তার কাছে ওটা ছিল এক মেকানিকের ভুল বিচারবুদ্ধির ফল। তখন সে ভাবত, একধরনের ভালোবাসা অন্য ধরনের ভালোবাসাকে পরাজিত করত, কারণ পুরুষদের ভালোবাসার প্রকৃতিই হচ্ছে একবার খিদে মিটে গেলে সেই ক্ষুধার অস্তিত্ব অস্বীকার করা। পিলার তেরোনেরা শুধু যে সেই ভুল ভেঙে দেয় তা-ই নয়, ওদের সাধে সেই ক্যানভাসের বিছানাটা, যেখানে তার পেটে এসেছিল মেমের দাদা আর্কাদিও আর পরে সে ধারণ করেছিল আউরেলিয়ানো হোসেকে। পরে ওকে শেখায় শর্ষের পুলটিস থেকে বাষ্প বানিয়ে কীভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ এড়ানো যায়, আর দেয় এক পানীয় বানানোর প্রণালি, যা দিয়ে সমস্যার সময় ‘এমনকি বিবেকের অনুশোচনা পর্যন্ত দূর করে দেয়।’ এই সাক্ষাতের সময় মেমের ভেতর অনুপ্রবেশ করে সেই সাহস, যেটা নাকি সে অনুভব করেছিল মাতাল হওয়ার বিকেলটাতে। অবশ্য আমারান্তার মৃত্যু তাকে বাধ্য করে সিদ্ধান্তটাকে স্থগিত রাখতে। মৃত্যুর পরের নয় রাত বাড়ি উপচে পড়া ভিড়ের মধ্যে এক মুহূর্তের জন্যও সে মাউরিসিও ব্যাবিলনিয়ার কাছছাড়া হয় নি, এরপর আসে লম্বা শোকপর্ব আর বাধ্যতামূলক ঘরে আবদ্ধ থাকার কাল, আর কিছু সময়ের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ওরা। দিনগুলো ছিল এতই অন্তর্জালাপূর্ণ, এতই অদম্য উৎকণ্ঠাপূর্ণ, এতই অবদমিত কামনাপূর্ণ যে প্রথম সন্ধ্যায়ই মেমে বের হতে পেরে, সরাসরি গিয়ে উঠে পিলার তেরনেরার বাড়ি। মাউরিসিও ব্যাবিলনিয়ার কাছে নিজেকে অর্পণ করে প্রতিরোধবিহীন, লজ্জাহীন, কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া, এমন এক সহজাত বহমানতা ও স্বজ্ঞা দিয়ে যে তার চেয়ে বেশি সন্দেহপ্রবণ লোক হলে মেমের পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে বলে মনে করে সহজেই তাকে ভুল বুঝতে পারত। তিন মাসের বেশি সময় ধরে ওদের মিলন ঘটে সপ্তাহে দুই দিন করে, আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর অকপট যোগসাজশের দ্বারা নিরাপত্তা পেয়ে, যে নাকি মায়ের কড়াকড়ি থেকে রেহাই দেওয়ার জন্য মেয়ের যেকোনো অজুহাতকে কোনো খারাপ ধারণা না নিয়েই বিশ্বাস করত।

যে রাতে ফের্নান্দা ওদের সিনেমা হলে ধরে ফেলে অবাক করে দেয় আউরেলিয়ানো সেগুন্দো নুয়ে পড়ে বিবেকের ভারে, আর মেমের সঙ্গে কথা বলতে যায় তার শোবার ঘরে, যেখানে ফের্নান্দা ওকে বন্দী করে রাখে, এই বিশ্বাসে যে মেমে তার কাছে প্রতিশ্রুতির মতো সবকিছু উগরে দেবে। কিন্তু মেমে সবই অস্বীকার করে। সে এতই আত্মবিশ্বাসী যে ও নিজের নিঃসঙ্গতায় এতই দৃঢ়চিত্ত থাকে যে আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর মনে হয়, ওদের মধ্যে এখন আর কোনো বন্ধন নেই আর সেই বন্ধুত্ব ও যোগসাজশ অতীতের মরীচিকা ছাড়া আর কিছুই নয়। সে মাউরিসিও ব্যাবিলনিয়ার সঙ্গে কথা বলতে স্থির করে এই ভেবে যে প্রাক্তন ওপরওয়ালা হিসেবে সে কথা বললে মাউরিসিও তার উদ্দেশ্য ত্যাগ করবে, কিন্তু পেত্রা কতেস এগুলো মেয়েলি ব্যাপার, এই বলে তাকে নিবৃত্ত করে, ফলে সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভাসতে থাকে আর প্রায় বিশ্বাসই করতে পারে না যে এই বন্দিদশা তার মেয়ের দুর্দশার অবসান ঘটাবে।

বেদনার কোনো চিহ্নই প্রকাশ করে না মেমে। বরং তার উল্টো, পাশের শোবার ঘর থেকে উরসুলা পায় তার ঘুমের প্রশান্ত ছন্দ, তার ঘরের কাজকর্মের ধীরস্থিরতা, তার সময়মতো খাবার আর তার হজমের সুস্থতা। দুই মাস শাস্তি শেষে উরসুলার মনে একমাত্র যা সন্দেহ জাগিয়ে তোলে তা হচ্ছে, সে অন্য সবার মতো সকালে গোসল সারে না, সারে রাত সাতটার সময়। মাঝেমধ্যে তার মনে হতো বিছে সম্বন্ধে সাবধান করে দেবে তাকে। কিন্তু প্রপিতামহী ওর সম্বন্ধে কানকথা লাগিয়েছে এই ভেবে মেমে ওকে এমনভাবে এড়িয়ে চলে যে সে স্থির করে অনধিকারচর্চা করে তাকে বিরক্ত না করার। বিকেল হলেই হলুদ প্রজাপতিগুলো বাড়ি দখল করে নিত। গোসল সেরে প্রতি রাতেই ফের্নান্দাকে দেখতে পেত, মরিয়া হয়ে কীটনাশক গোলা দিয়ে প্রজাপতিগুলোকে মারত। ‘এটা খুবই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, বলত, ‘সারা জীবন বলতে শুনেছি যে রাতের প্রজাপতি অমঙ্গল ডেকে আনে।’ এক রাতে মেমে যখন গোসল সারছিল, ঘটনাচক্রে ফের্নান্দা তার শোবার ঘরে ঢোকে আর সেখানে এত প্রজাপতি ছিল যে সে কোনো রকম শ্বাস নিতে পারে না। ওগুলোকে তাড়ানোর জন্য হাতের কাছে পাওয়া কাপড় তুলতে গিয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পরা শর্ষের পুঁটলির সঙ্গে মেয়ের সন্ধেস্নানের সম্পর্ক ধরতে পেরে ভয়ে তার বুক হিম হয়ে যায়। প্রথমবারের মতো মোক্ষম সময়ের জন্য সে আর অপেক্ষা করে না। পরের দিন সকালে নতুন মেয়রকে দুপুরের খাবারের নিমন্ত্রণ জানায়, যে নাকি ওর মতোই পাহাড়ি এলাকা থেকে নেমে এসেছে, আর তাকে অনুরোধ করে পেছনের আঙিনায় এক রাতের পাহারাদার বসাতে, কারণ তার ধারণা, মুরগির বাচ্চাগুলো চুরি হচ্ছে। সেই রাতে পাহারাদার নামিয়ে আনে মাউরিসিও ব্যাবিলনিয়াকে, যখন সে গোসলখানায় ঢোকার জন্য টাইল সরাচ্ছিল, যেখানে মেমে অপেক্ষা করছিল ওর জন্য নগ্ন অবস্থায় কামনার জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে, বিছে ও প্রজাপতির দঙ্গলের মাঝে, যেমনটি সে অপেক্ষা করেছে শেষের মাসগুলোর প্রায় প্রতি রাতে। মেরুদণ্ডের মধ্যে এক বুলেট নিয়ে মাউরিসিওকে বিছানায় বন্দী হতে হয় সারা জীবনের জন্য। একবারের জন্যও বিশ্বস্ততা ভঙ্গের চেষ্টা না করে, স্মৃতির দংশনে জর্জরিত হয়ে, হলুদ প্রজাপতিগুলোর জ্বালায় এক মুহূর্তের জন্যও শান্তি না পেয়ে, আর মুরগি চোর হিসেবে সমাজ থেকে বিতাড়িত হয়ে, আপসহীন, প্রতিবাদহীন মৃত্যু হয় তার বৃদ্ধাবস্থায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *