নাইয়রি – ৫

হুঁক্কা সাজানো হচ্ছে। কাজটি করছে কুদ্দুস। সে মির্জাবাড়ির কামলা। বয়স ত্রিশের ঘরে। সব রকম কাজই সে করে। তবে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তার প্রধান কাজ হচ্ছে চেয়ারম্যান সাহেবের জন্য হুঁক্কা সাজানো। কিছুক্ষণ আগেই হুঁক্কার পানি বদল করে এনেছে সে। রস নষ্ট হয়ে গেলে সেটা পুড়িয়ে চিটাগুড় বানানো হয়। তামাকপাতা কুচি করে চিটা গুড় দিয়ে বিশেষ কায়দায় মাখাতে হয় হুঁক্কার জন্য। এই কাজটায় খুব দক্ষ কুদ্দুস। অন্য কারও হুঁক্কা সাজানো পছন্দ হয় না চেয়ারম্যান সাহেবের। তামাকপাতা মাখানো হয়ে গেলে তা হুঁক্কার কলকিতে দিল কুদ্দুস। তার ওপর জ্বলন্ত কয়লা। অমনি হুঁক্কা প্রস্তুত। চেয়ারম্যান সাহেবের হাতে হুঁক্কা দিয়ে কাছারিঘর থেকে বের হয়ে গেল সে। কাছারিঘরে চেয়ারম্যান সাহেব ছেলেদের নিয়ে বসলে সেখানে কারও যাওয়া মানা।

জালাল-জব্বার দুই ভাই জয়নাল মির্জার সামনে বসে আছে। তিনি হুঁক্কায় টান দিয়ে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বলো কী তোমাদের জরুরি কথা?”

‘আব্বা, হারুন ব্যাপারীর ভাবসাব ভালো না।’

‘ব্যাপারীরে লইয়া এত মাথা ঘামাইস না, জব্বার। তোরে আগেও মানা করছি।’

জালাল বলল, ‘জব্বারের মাথাডা গেছে, আব্বা। ওরে আমি কইছি যে বিষয়টা আব্বা আমাগো চেয়ে ভালো বোঝে।’

জব্বার বলল, ‘আব্বা, আমার কথাখান শোনেন। আইজ একখান খারাপ খবর আছে।’

‘কী খবর?’

‘কালিশুরির জমির দলিল লইয়া হারুন ব্যাপারী টাউনের এক উকিলের কাছে গেছিল।’

‘যাউক। তার কি টাউনে যাওনের আগে তোমার অনুমতি নেওয়া লাগবে?’

‘আব্বা, আমনে ব্যাপারডা একটু আমলে লন। হারুন ব্যাপারী আগেও ওই উকিলের কাছে গেছে। শেষে না আবার জমিখান হাতছাড়া হয়। কত বড় জমি!’

‘জব্বার, তুমি এই সব ছোডখাডো বিষয় লইয়া আমারে বিরক্ত করবা না। জালাল, তোমার ছোট ভাইরে বোঝাও। এই সব ছোডখাডো বিষয়ে এত মাথা ঘামাইলে ভবিষ্যতে রাজনীতি ক্যামনে করবা তোমরা?’

.

সত্যি সত্যি প্রতিদিন রঞ্জু জেসমিনদের বাড়ির আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করে। ঘুরে ঘুরে সে জেসমিনদের পুরো বাড়িটাই মুখস্থ করে ফেলল। জেসমিনের ঘর কোন দিকে, তা-ও আবিষ্কার করল। কোনো কোনো দিন জেসমিনকে না দেখেই ফিরে যেতে হয় তাকে। তবে সে এটা ঠাহর করতে পেরেছে যে প্রতিদিন বিকেলে জেসমিন তাদের বাড়ির দক্ষিণের ভিটায় প্রতিবেশী ও ভাতিজা-ভাতিজিদের সাথে খেলতে যায়। নানান রকম খেলা খেলে তারা। কখনো বৌছি, কখনো সাতচারা, কখনোবা আবার গোল্লাছুট। পাশেই খাল, মাছ ধরার ছুতোয় খালে বড়শি পেতে বসে থাকে রঞ্জু। চোরাচোখে দেখে জেসমিনকে। ভেবে অবাক হয় সে, এত রূপ কী করে আল্লাহ একটি মানুষের মধ্যে দিল? যাকে একবার দেখে চোখ ফেরানো যায় না। বারবার দেখতে ইচ্ছা করে!

কিছুদিন যাওয়ার পর মাঝে একদিন রঞ্জু দেখে জেসমিন খেলছে না। চুপচাপ বসে আছে। সেদিন সে উপলব্ধি করল, সে শুধু জেসমিনের সৌন্দর্যেই মুগ্ধ নয়, সে জেসমিনের উচ্ছ্বলতায়ও মুগ্ধ।

.

জেসমিন সন্ধ্যার আগে আগে খেলা শেষ করে হাত-পা ধুয়ে ঘরে ঢুকল। কোহিনুর বানু সরতা দিয়ে সুপারি কাটছিলেন।

জেসমিনকে দেখেই বললেন, ‘এত ডালে ডালে ঘুরোস ক্যা লো ছেড়ি? বোলাইয়া মইরা গেলেও তোরে পাওন যায় না।’

জেসমিন খুব অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘ডালে ডালে কই ঘুরলাম, মা? দক্ষিণের ভিডায় খেলছি। হেই ভিডা তো আমাগোই। কোনো দরকার থাকলে তুমি কাউরে খবর দিয়া পাডাইতা।’

‘এ ছেড়ি, খেলার কথা কইতে শরম করে না? খেলার বয়স আছে তোর?’

‘আছে দেইক্কাই তো খেলি। কী এমন বয়স অইছে মোর?’

‘তোর বয়সে পোলা পয়দা কইরা মা অইছি আমি।’

‘মোর তো আর বিয়া হয় নাই। ক্যামনে পোলা পয়দা করমু?’

কোহিনুর বানু এবার ভীষণ রেগে গেলেন। বললেন, ‘তোর বাপে আহুক, খাড়া। বিয়া দিয়া এই আপদ যদি বিদায় না করছি! তোর মতো মাইয়া পালা মোর কাম না।’

‘কওগা যাইয়া।’

জেসমিন মুখ ঝামটা দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকল। সন্ধ্যা হতেই পোকামাকড় ঢুকবে, তাই সবার আগে জানালা লাগিয়ে দিল। পরনের শাড়িটায় কাদা লেগেছে, ঝটপট শাড়িটা পাল্টে ফেলল। তারপর হারিকেন জ্বালাল, ঘরের ভেতর তেমন আলো ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে আসবে। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে চুলের বেণি খুলছিল সে, ঠিক তখনই টেবিলের ওপর বইখাতার ভেতর একটা খাম দেখতে পেল। এই খামটা তো এখানে ছিল না। এটা কোত্থেকে এল? জেসমিন খামটা খুলে দেখে ভেতরে একটা ভাঁজ করা কাগজ আর কিছু কামিনী ফুল। সে কাগজটা তুলে ভাঁজ খুলল। ভেতরে লেখা :

কোথাও কি এমন কলি হয়?
যে কলিতে ফুটলে ফুল
শুকাবে না তার পাপড়িগুলো
ঘ্রাণ রবে অক্ষয়?

প্রিয় জেসমিন,

এমন ঘ্রাণফুলের সাধ জাগছে তোমারে দেখার পর। সাথে জাগল মনে, এই তো প্রথম কিছু হারানোর ভয়।

ইতি রঞ্জু

চিঠিটা কে দিল না-জানা পর্যন্ত কোথাও কোনো শান্তি নেই জেসমিনের। হ্যাঁ, চিঠির শেষে নাম লেখা আছে রঞ্জু। কিন্তু রঞ্জুটা কে? সে তো রঞ্জু বলে কাউকে চেনে না! পুরো কেশবপুরে কোনো রঞ্জু আছে বলেও শোনে নি কখনো। জেসমিনের মাথা ভালো। চিঠির মর্মার্থ বুঝতে তার কোনো সমস্যা হয় নি। বরং খুব ভালোভাবে বুঝেছে। এ জন্য আরও বেশি অস্থির লাগছে। এমন আকুতি নিয়ে কে লিখল তাকে?

খামের ভেতরের কামিনী ফুলের ঘ্রাণ নিল সে। কামিনী ফুলের ইংরেজি নাম অরেঞ্জ জেসমিন। স্কুলের ইংরেজি স্যার বলেছিলেন, মনে আছে তার। সেটা জেনেই কি অচেনা মানুষটা তাকে কামিনী ফুল দিয়েছে? নাকি কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে?

জেসমিন চিঠিটা এই নিয়ে ২৯ বার পড়েছে। হাতের লেখাটা দারুণ! আরও একবার পড়ে ৩০ পূরণ করল। এরপর ভাঁজ করে বালিশের তলায় রেখে দিল।

জেসমিন খোলা চুলগুলো আঁচড়ে আবার বেঁধে নিল। তারপর পড়তে বসল। কিন্তু কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারল না। পত্রদাতা মনের ভেতর ঢুকে খুব বিরক্ত করছে! মানুষটা যে চিঠিটা টেবিলের ওপর রেখে গেছে, এতেই বোঝাই যাচ্ছে জানালা দিয়ে রেখেছে। এত বোকামি কেউ করে? চিঠিটা যদি অন্য কারও হাতে পড়ত? এমন অনেক প্রশ্ন মনের ভেতর ঘুরছে।

পরদিন জেসমিন সারা দিন কোথাও বের হলো না। নিজেকে ঘরবন্দী করে অপেক্ষায় রইল। মানুষটা যদি চিঠি দিতে আবার আসে, অমনি তাকে ধরে ফেলবে! আচ্ছা, সে এভাবে কেন চিঠি দিচ্ছে? জেসমিনের উত্তর দেওয়ার তো কোনো সুযোগ নেই। একতরফাভাবে চিঠি দিয়ে কী লাভ?

আচ্ছা, মানুষটার বয়স কেমন হবে? দেখতে কেমন সে? তাকে দেখে যদি জেসমিনের ভালো না লাগে? ভালো না লাগলে এই সুন্দর হাতের লেখার সুন্দর চিঠিটার জন্য তার ভীষণ মনখারাপ হবে!

সপ্তাহখানেক পার হয়ে গেল। চিঠি দিতে কেউ এল না। জেসমিন আশা ছেড়ে দিল। ভাবল, বুঝি কেউ দুষ্টুমি করে চিঠিটা দিয়েছিল। অথচ সে বোকার মতো সব বিশ্বাস করেছে!

তারপর এক বিকেলে জেসমিন আবার খেলতে গেল। অবাক কাণ্ড হচ্ছে, তাদের খেলায় যাকে দুধভাত বানানো হয়, সেই মতি খেলা শেষে ফেরার সময় একটা খাম দিল। খামটা দেখে ঘটনা বুঝতে বাকি রইল না জেসমিনের।

সে খামটা হাতে নিয়ে জানতে চাইল, ‘খামডা কেডা দিছে, মতি?’

মতি ঘার নেড়ে জবাব দিল, ‘চিনি না।’

জেসমিন ধমক দিয়ে বলল, ‘না চিনলে আনছোস ক্যা?’

মতি ঠোঁট উল্টে বলল, ‘কইল যে অনেক জরুলি কাম।’

‘যে দিছে হে কি ব্যাডা না ছ্যামড়া?’

‘ছ্যামড়া।’

ধলা না কালা?’

‘ধলা।’

‘লম্বা না বাটু?’

‘কইতারি না।’

জেসমিন বিরক্ত মুখে বলল, ‘আচ্ছা, যা তুই এহন।’

শাড়ির প্যাচের ভেতর খামটি লুকিয়ে বাড়ি ফিরল সে। ইচ্ছা করেই খামটি খুলল না তখন। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পর দরজায় খিল দিয়ে হারিকেনের আলো বাড়িয়ে খামটা খুলল। যথারীতি ভেতরে কামিনী ফুল এবং একটি চিঠি। আজকের চিঠি বেশ বড়। জেসমিন পড়া শুরু করল :

আমার এলোমেলো মনের কারণ খুঁজতে গিয়ে
অহর্নিশি ভাবি তোমায়,
নিত্য সন্ধ্যার শীতল কোমল আঁধার
স্পর্শ করে যায় আমায়,
নিশুতি রাতের বুকে গলানো আকাশ ঝরে
চেয়ে থাকি অসীম এক প্রত্যাশায়
কখনো দেখি ঝড়ের আকাশে উড়ন্ত কোনো বিহঙ্গ
ডানা ঝাপটায় অচেনা কোনো সুখে,
মেঘের পরে মেঘ ছুটে যায় বৃষ্টি হয়ে ঝরে,
আমিও ছুটে যাই দুই ক্রোশ দূরে
দেখব বলে তোমায় বৃষ্টিস্নাত মুখে।
অথচ জানালায় দেখি বসে আছ একাকী অন্ধকার ঘরে
তখন আমার ভীষণ বলতে ইচ্ছা হয়
প্রেয়সী, তুমি কি মেঘ, ভয়ে আছ ভীত?

প্রিয় জেসমিন,

গত সাত দিন তুমি ঘর থেকে বের হও নাই। জানি না কেন সারাটা দিন জানালার কাছে বসে ছিলে। আমাকে হাতেনাতে ধরবে বলে নয়তো? তুমি জানালায় বসে ছিলে বলেই সেদিকে যাওয়ার আর সাহস করে উঠতে পারি নাই। আচ্ছা, তুমি এখন আর খেলতে যাও না কেন? জানো, তোমার উচ্ছলতা আমাকে উচ্ছ্বসিত করে! প্রতিদিন এত দূর থেকে তোমার সেই উচ্ছলতা দেখতে ছুটে যাই।

জানি তুমি ভাবছ কেন এভাবে লুকিয়ে চিঠি দিচ্ছি? সামনে কেন আসি না? সামনে আসার মতো সাহস নাই, যদি প্রত্যাখ্যান করো? জানি না তোমার মধ্যে কী আছে! শুধু জানি, প্রথম দেখায় তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি, আমার কামিনী ফুল।

ইতি রঞ্জু

আজ আরও বেশি মেজাজ খারাপ হলো জেসমিনের। প্রেম নিবেদন করে বসেছে বাছাধন কিন্তু নিজের পরিচয় দেয় নি। দুই ক্রোশ দূর থেকে আসে উল্লেখ করেছে, তার মানে দুই-এক গ্রাম পার হয়ে তার বাড়ি। এর বেশি কিছুই জানার উপায় নেই। একতরফাভাবে চিঠি দিয়ে যাচ্ছে। কোনো উত্তর লাগবে না তার? এ কোন রামবলদ?

জেসমিন এবার একটা দুই লাইনের চিঠি লিখল। চিঠিটা এমন :

ভিতু রঞ্জু সাহেব,

সামনে আসার সাহস না থাকলে আর চিঠি দিয়েন না। ভিতুরা এই কামিনী ফুলের চোখের বালি।

ইতি জেসমিন

পরদিন জেসমিন চিঠিটা মতির হাতে দিয়ে বলল, ‘যে মোরে চিডি দিছিল, হে আবার আইলে এইডা হ্যারে দিবি।’

মতি ঠোঁট উল্টে বলল, ‘ক্যা দিমু?’

‘হ্যার চিডি মোরে ক্যা দিছিলি?’

‘হে মোরে হাটের থিকা নারকলি আর বাদামের সন্দেশ কিন্যা দিছে।’

জেসমিন ভ্রুকুটি করল। বাচ্চা ছেলেটাকে ঘুষ দিয়ে নষ্ট করছে লোকটা! সে বলল, ‘মোরটা তারে দিলে তোরে মোগো খেলায় লমু। তোর আর দুধভাত থাহা লাগবে না।’

মতি দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘হাছা কইতাছ, জেসমিন বু?’

‘আল্লাহর কিরা।’

.

জেসমিনের চিঠি পড়ে হেসে ফেলল রঞ্জু। তার এখন আর ঢাকা যাওয়ার জন্য কোনো হুতাশ নেই। বরং না যেতে পারলে সে বাঁচে। প্রতিদিন জেসমিনকে দেখতে যায়। মাঝে একদিন বাড়িতে কাজ থাকায় যেতে পারে নি। সেদিন যে কতটা অস্থিরতায় কেটেছে, তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। আজ যেতেই মতি এই চিঠিটা দিল। রঞ্জু সাথে করে আনা চিঠিটা আর দিল না, নতুন করে চিঠি লিখতে হবে। সে মতির কাছ থেকে কাগজ-কলম নিয়ে চিঠি লিখতে পারত অবশ্য। কিন্তু সে গভীর রাতে বারান্দায় বা জানালার ধারে বসে যে চিঠি লিখবে, সেই চিঠিতে যতটা আবেগ, যত্ন মিশিয়ে দিতে পারবে, তা কি এখন পারবে? অসম্ভব! বিশেষ মানুষটার জন্য সবকিছুই বিশেষ হওয়া চাই।

.

পরদিন জয়নাল মির্জা-বাড়িতে থাকায় খেলতে যেতে পারে নি জেসমিন সন্ধ্যার পর যখন জেসমিন পড়তে বসেছে, তখন মতি বন্ধ জানালার ধারে এসে ডাক দিল, ‘ও জেসমিন বু, আছ এহেনে?’

জেসমিন জানালা খুলে বলল, ‘কী অইছে? তুই এত রাইতে?’

‘রাইত কিয়ের? সন্ধ্যা অইছে হপায়। তুমি তো আইজ খেলতে আহো নাই, তাই আইছি, কী আর করমু? এই নেও তোমার চিডি।’

জেসমিন খামটা হাতে নিয়ে বলল, ‘আইজ কী দিছে তোরে?’

মতি দাঁত বের করে বলল, ‘কাইল হাটে লইয়া যাইবে।’

‘হাটে যাওনের আগে আমার লগে দেহা কইরা যাইস।’

‘আচ্ছা বু।’

জেসমিন খামটা খুলল। কিছু কামিনী ফুলের পাশ থেকে চিঠিটা তুলে নিল।

প্রিয় জেসমিন,

তোমার কি কাচের চুড়ি পছন্দ? সেদিন যখন খেলছিলে, তোমার দুহাতের চুড়িগুলো রিনিঝিনি করে বাজছিল। এর আগে কখনোই উপলব্ধি করতে পারি নাই কাচের চুড়ি জিনিসটা যে এত সুন্দর। নাকি তোমার হাতে উঠেছে বলেই তার মাধুর্য বেড়ে গেছে? সূর্যমণির হাটে সুন্দর কাচের চুড়ি ওঠে। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ, আমি সূর্যমণি গ্রামের ছেলে।

সূর্যমণিতে আমাদের বাড়ির দোতলায় আমার একলার রাজত্ব। এখানে ঘরের সামনেই বারান্দা। কিছুদিন আগে বারান্দায় একটা কাঠের চার কোনা টব বানিয়েছি নিজ হাতে। সেই টবে কামিনী ফুলের গাছ লাগিয়েছি। জানি না ফুল কবে ফুটবে। আচ্ছা, এই গাছে পানি দেওয়ার দায়িত্বটা কি তুমি নেবে ফুল?

তোমার চোখের বালি নয়, চোখের মণি হতে চাই। কখন কোথায় আসব বলে দাও। বান্দা সময়মতো হাজির হয়ে যাবে।

ইতি রঞ্জু

চিঠি পড়তে পড়তেই জেসমিনের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছে, দেখাটা করবে কোথায়? কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। অন্তত কেশবপুরের মধ্যে কোথাও দেখা করা যাবে না। তাহলে উপায়?

.

জেসমিন-রঞ্জুর প্রথম দেখা হলো মতিদের পানের বরে। মানিক পুরোটা সময় তাদের পাহারা দিল। জেসমিন-রঞ্জু দুজনের কারও কোনো ভয় নেই, কিন্তু সেস ভয়ে তটস্থ। এই সম্পর্কের কথা জানাজানি হলে কী হতে পারে, সে ধারণা তার আছে। কারণ, সে চেয়ারম্যানকে চেনে। চেয়ারম্যান হিসেবে লোক ভালো, তবে স্বার্থে উনিশ-বিশ হলে সে মানুষ খুন পর্যন্ত করতে পারে। রঞ্জুকে শত বুঝিয়েও লাভ হয় নি। ওদিকে জেসমিন যে দাপুটে মেয়ে, স্কুলে এক ছেলে ওর চুল ধরে টান দিয়েছিল বলে মেয়ে হয়েও সেই ছেলেকে যে ধোলাই দিয়েছিল, ভিড় জমিয়ে দেখেছিল লোকে। সেই ঘটনা মুখে মুখে রটে গিয়েছিল। এর পর থেকে আর কোনো ছেলে চোখ তুলে তাকাতে সাহস পায় নি। আজ সেই মেয়ে রঞ্জুর চিঠি পড়ে পাগল হয়ে দেখা করতে এল! কী এমন লিখেছে রঞ্জু!

রঞ্জুকে দেখে মাথা ঘুরছে জেসমিনের। এত সুদর্শন ছেলে এ তল্লাটে সে কখনো দেখে নি। জামাকাপড়, চালচলন, কথাবার্তা—সবকিছুতেই একটা শহুরে ভাব। জেসমিনের সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে তার স্বভাবতই রঞ্জুকে সেসব বুঝতে দিতে চাইছে না। তাকে চুপ দেখে রঞ্জু বলল, ‘কী ব্যাপার, চিঠিতে তো খুব কথা শোনানো হয় আমাকে। এখন যে একদম চুপ?’

জেসমিন হেসে বলল, ‘অত সুন্দর কইরা কথা কইতে পারি না।’

‘বেশি সুন্দর মানুষের অত সুন্দর কথা না বললেও চলে।’

‘আমনে কি শহরে থাকেন?’

‘আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। সেখানকার হলে থাকি। ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকলে গ্রামে থাকি।’

‘এহন কি ইনভার্সিটি বন্ধ?’

‘হ্যাঁ, অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। কিছু গন্ডগোল চলছে। তাই বাড়ি এসেছি।’

‘তার মানে আপনে আবার চইলা যাইবেন?’

‘ইউনিভার্সিটি খুললে যাব।’

‘আচ্ছা, আপনের গ্রাম না সূর্যমণি? তাইলে আপনে কেশবপুরে ক্যামনে আইলেন আর আমারেই-বা ক্যামনে পাইলেন?’

রঞ্জু প্রথম দেখার ঘটনাটা বিস্তারিত বলতেই জেসমিন চোখ পাকিয়ে বলল, ‘ও! আমনেই সেই লোক, যার জন্য মায় আমারে গাইলাইছিল!’

রঞ্জুর ঘটনাটা মনে পড়ায় সে হেসে ফেলল। জেসমিন বলল, ‘হাইসেন না। আমনেরে একখান কথা আগেই কইয়া রাখি, আমি কিন্তু কামচোর। আমারে দিয়া কোনো কাম করাইতে পারবেন না।’

রঞ্জু হেসে ফেলল। এই মেয়েটি সবার থেকে আলাদা। এই মেয়েটিকে তার লাগবেই

তাদের পত্র আদান-প্রদান চলমান রইল। দুই পক্ষেই ফি বাড়িয়েছে মতি ডাকপিয়ন। ইদানীং বেশ বড় বড় আবদার করে বসে সে রঞ্জুর কাছে। রঞ্জুও হাসিমুখে সেই আবদার পূরণ করে। এই ডাকপিয়ন হারালে যোগাযোগ বন্ধ। এর চেয়ে বিশ্বস্ত ডাকপিয়ন আর হয় না। দেখা খুব কমই হয়, তবে হয়। কখনো উত্তরের শাপলার বিলে, কখনো কালিশুরির মেহগনিবাগানে, কখনো মতিদের পানের বরে।

মামুনের বিয়ের প্রস্তাবে তার বাবা মোকসেদ ও মা হালিমা বিবি মহাখুশি। এ রকম বড়লোক ঘরের মেয়ে বউ হয়ে এলে গ্রামের লোকের চোখ কপালে উঠে যাবে। আবার মামুনকে নাকি চাকরিও দেবে। সংসারের টানাটানি দূর হবে। কিন্তু আব্বাসের বউ রেনু বড় টেনশনে পড়ে গেছে। অত বড়ঘরের মেয়ে আনাও তো একটা খরচের ব্যাপার। বউয়ের সোনা-কাপড়, পান-মিষ্টির খরচ, দেনমোহর, অতিথি খাওয়ানো! বড়ঘরের মেয়ে আনতে গেলে কোনোটাই তো যেমন-তেমন করে করা যাবে না। এসব কীভাবে হবে?

সবচেয়ে বেশি চিন্তায় পড়েছে মামুন। গ্রামে তার বয়সী ছেলেরা বিয়ে করে ফেলে, কিন্তু তার তো অন্য রকম ইচ্ছা ছিল। ভেবেছিল ঢাকায় পড়াশোনা করতে যাবে। পড়াশোনা শেষ করে বড় চাকরি করবে, তারপর তার পছন্দমতো পড়াশোনা জানা কোনো মেয়েকেই বিয়ে করবে। এই মেয়েটিকে বিয়ে করলে তার শেষ ইচ্ছাটি বাদে সকল ইচ্ছাই পূরণ হবে। আর বিয়ে না করলে তার কোনো ইচ্ছাই পূরণ হবে না। হয়তো ঢাকায় গিয়ে কোনো কেরানি গোছের চাকরি করতে হবে, তা-ও যদি জোটে! নাহয় এই গ্রামেই পচে মরতে হবে। এই চিন্তা করে সে মোটামুটিভাবে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। কিন্তু বড্ড ভয় করে তার। এত বড়লোকের মেয়ে সামলাতে পারবে তো সে? খালপাড়ে মনমরা হয়ে বসে এসবই ভাবছিল।

মুকুল খাল থেকে মাছ মেরে বাড়ি যাচ্ছিল, ছোট ভাইকে দেখে পাশে এসে দাঁড়াল, ‘এ ব্যাডা, এহেনে কী করো?’

মামুন মুকুলকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভাইজান, আমার ডর করে।’

মুকুল কপাল কুঁচকে বলল, ‘ডর কিসের?’

মামুন সব খুলে বলতেই মুকুল বলল, ‘ডরাইস না। মাইয়াডার তো বয়স কম। আদর-যত্ন করলেই হাতে রাখতে পারবি। তোর স্বপ্ন পূরণের লাইগ্যা এর চাইয়া ভালো সুযোগ আর কই পাবি, ক?’

‘হেলে আমি কলিকাতা যাইতে চাই। ঢাকা গেলে শ্বশুরের টাহায় চলা লাগবে। কলিকাতা গেলে তো চাকরি দেবে। টাহা লওনেইত্যা চাকরি লওয়া ভালো। নিজের টাহায় নিজে পড়মু।’

‘হয়, এইডা ঠিক।’

‘কিন্তু আমি এই কতা বড় ভাইজানরে কইতে পারমু না। আমার ডর লাগে। তুমি কইয়া দেবা?’

মুকুল হেসে বলল, ‘আচ্ছা, আইজই কইয়া দিমুয়ানে। এহন বাড়ি ল, দেখ তোর পছন্দের শৌল মাছ পাইছি। কত্ত বড় বড় শৌল! ভাবিরে কমু বেশি কইর‍্যা ঝাল দিয়া ভুনা করতে।’

এবার কস্টিউম তৈরি করে তা আর বাড়িতে আনল না মুকুল। ফয়েজের কাছে রাখতে দিল। মুরগি বিক্রির টাকায় কস্টিউম হয়ে সামান্য কিছু পয়সা বাঁচল। সেই পয়সায় ছেলের জন্য কিছু নেবে, নাকি বউয়ের জন্য কিছু নেবে, ভেবে কোনো কূল পাচ্ছিল না। শেষে ঠিক করল, বউয়ের জন্যই নেবে। বউটা রেগে আছে। কিছু উপহার পেলে খুশি হবে। কিন্তু সারা বাজার ঘুরেও এই সামান্য পয়সায় ভালো কিছুই পাওয়া গেল না। অনেক ঘুরেফিরে অবশেষে সে এক ডজন কাচের চুড়ি কিনল। চুড়ি খুব পছন্দ করে বউটা।

কদিন ধরে মিনার মনমেজাজ প্রচণ্ড খারাপ। কারও সাথে কথা বলতে গেলেই ঝগড়া লেগে যাচ্ছে, তাই পারতপক্ষে কারও সাথে কথা বলছে না সে। মুকুল আজ সন্ধ্যার পরপরই বাড়ি ফিরে এল। মিনা তার সাথে একটি কথাও বলে নি। সে এখন ব্যস্ত, তাদের তিন বছর বয়সী ছেলে মধুকে পড়তে বসিয়েছে। এত দিন পড়ানোর পরও ছেলে এখনো অ আ শিখতে পারল না। এই ছেলে নিশ্চিত বাপের মতো হবে। এ কথা মনে হতেই মধুকে মারল মিনা। মধু কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল।

মুকুল বলল, ‘এইডু একটা পোলা এত তাড়াতাড়ি পড়াশোনা শিখবে ক্যামনে? হুদাহুদি মারলা অরে।’

মিনা গর্জে উঠল, ‘মারমু না তয় কি চুমা দিমু? এইডু কই? অর বয়স তিন বছর। হারা দিন দেহি পড়র পড়র করতে পারে, তয় পড়তে বহাইলে এত নাটক ক্যা? বাপের মতো নাটক হিকছে।’

মুকুল মিনার সামনে বসে বলল, ‘আরে, রাগ হইয়ো না। আরেকটু বড় অইলেই চাচার মতো ভালো পড়ালেহা করবেয়ানে। এই দেহো তোমার লাইগ্যা কি আনছি।’

এ কথা বলে মুকুল পেছনে লুকিয়ে রাখা হাতটা সামনে আনল। হাতে কাচের চুড়ি। চুড়িগুলো দেখে মিনার মেজাজ আরও খারাপ হলো। সে চুড়িগুলো ধরে ছুড়ে মারল। নিমেষেই কাচের চুড়িগুলো ভেঙে গেল। মুকুলের মনটা খারাপ হয়ে গেল। এর চেয়ে মধুর জন্য কিছু আনলেই পারত, ছেলেটা খুশি হয়ে যেত।

মিনা রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল, ‘বউ-পোলার লাউগ্যা খাওন জুটাইন্যার মুরোদ নাই, হে আবার চুড়ি কিন্না আনে।’

মুকুল মৃদু গলায় বলল, ‘এইয়া তুমি কী কও, মিনা? মুই বর্গা দিয়া চাউল আইন্না এই সংসারেই তো দিছি। যেদিন সময় পাই, মাছ কোপাই আইন্যা কি দেই না? এইয়া কি কিছুই না? খালি পয়সাই কামাইয়া আইন্যা দিতে অইবে?’

‘তোমার মায় পয়সাই চায়। হেইয়াই দিতে অইবে। আল্লাহর তিরিশটা দিন তোমার মায় কয় তুমি মোরে আর পোলারে লইয়া হেগোডা বইয়া বইয়া খাও। আর কত সইহ্য করমু? হয় যাত্রাপালা ছাইড়া কোনো কামে নামো, নাইলে মোরে ছাইড়্যা দেও।’

‘কাম তো পাই না, মিনা।’

‘কাঠের কাম পাও না, অন্য কাম করবা।’

‘তুমি এত চ্যাতলা ক্যা? মায় ত আজনমকাল এ রহমই। বড় ভাবিরেও তো কত জ্বালায়, তুমি তো জানো। কী অইছে তোমার?’

এ কথার পর মিনা মুকুলের দিকে সরাসরি তাকাল। তার চোখ জলে ভরে উঠেছে।

মুকুল তার গালে হাত রেখে বলল, ‘কান্দ ক্যা?’

মিনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘বাচ্চা আইছিল প্যাটে। নষ্ট কইরা দিছি। বাচ্চার দুঃখে কান্দি।’

মুকুল স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল।

একমুহূর্ত পর বলল, ‘এইডা তুমি কী করলা, মিনা? ক্যান করলা?’

মিনা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আর কী করমু? এক পোলার খাওন জুটাইতে পারো না, আরেকটা ক্যামনে আনি?’

‘মিনা, তুমি একলা সিদ্ধান্ত নিতে পারো না। বাচ্চা তোমার একলার না। আমারে জানান দরকার আছিল।’

মুকুলের গলায় রাগ।

মিনা চোখ মুছে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ‘বউ-বাচ্চার খাওন জুটাইতে পারে না, আবার রাগ দেহায়। যা করছি ভালো করছি, একশবার করমু। আল্লায় ইট্টু শরমও দেয় নাই বেডারে।’

মুকুল সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তার চোখে কান্নার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে।

হারাধন চক্রবর্তী উত্তরাধিকারসূত্রে বাপ-দাদার অনেক জমিজমা পেয়েছিলেন কিন্তু তার নগদ অর্থ ছিল না। তিনি অলস ও ভীরু প্রকৃতির হওয়াতে নিজে চাষবাস করতে পারতেন না। বর্গা দিয়ে দিতেন। পাকিস্তান আমলে একবার তার স্ত্রীর কঠিন অসুখ হয়। চিকিৎসার জন্য ভারত যেতে হবে। প্রচুর নগদ অর্থ প্রয়োজন। তিনি ছুটে গেলেন বিত্তশালী জয়নাল মির্জার কাছে। হারাধন চক্রবর্তীর জমিজমা সব এক দাগে কালিশুরিতে। এই কারণেই জয়নাল মির্জা কিনে নিতে চাইলেন। কিন্তু হারাধন চক্রবর্তী বিক্রি করতে নারাজ। তিনি জমি বন্ধকি দিয়ে কিছু টাকা নিতে চান। জয়নাল মির্জা বন্ধকি দলিলে হারাধন চক্রবর্তীর টিপসই নিয়ে টাকা দিলেন। জয়নাল মির্জা সেই জায়গা ভোগদখল করতে শুরু করলেন। বছর কয়েক বাদে হারাধন চক্রবর্তী টাকা ফেরত দিতে এলেন।

জয়নাল মির্জা বললেন, ‘আরে মিয়া, রাখো তোমার টাকা। এই টাকার লগে আরও কিছু দেই আমি। জমি আমার ধারে বেইচা দাও। এমনেও এই জমি তুমি কামে লাগাও না। বর্গা দিয়া রাহো। তার চেয়ে নগদ ট্যাকা পাইলে তোমার কামে লাগবে।’

হারাধন চক্রবর্তী আতঙ্কিত হয়ে বললেন, ‘জয়নাল ভাই, আমার টাকার অনেক দরকার আছিল তখন, এই কথা সত্য। আপনের কাছে আমি ঋণী। কিন্তু বাপ-দাদার জমি আমি বেচতে চাই না দেইখাই বন্ধক রাখছিলাম। আমারে ক্ষ্যামা করেন।’

কিন্তু লাভ হয় নি। জয়নাল মির্জা টাকাও নেন নি। জমির দখলও ছাড়েন নি। এই জমির জন্য হারাধন চক্রবর্তী অনেক ঘুরেছেন জয়নাল মির্জার পেছনে। স্বাধীনতার পর তিনি চেয়ারম্যান হলেন। তার ক্ষমতা আরও বেড়ে গেল। কিছুতেই তার সাথে পেরে উঠলেন না হারাধন চক্রবর্তী। অবশেষে ভাবলেন, জমি বিক্রিই করে দেবেন। কিন্তু জয়নাল মির্জা দাম বলেন নিতান্তই কম। ১০ ভাগের ১ ভাগ। তারপর বিভিন্ন ধরনের হুমকিধামকি তো আছেই।

এর মধ্যেই হারাধনের পরিচয় হয় হারুন ব্যাপারীর সাথে। সে ঢাকার লোক। মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। এখানে তার এক বন্ধু ছিলেন, তিনিই তখন থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। এখানে থাকতে থাকতে এই জায়গার প্রতি তার প্রগাঢ় এক মায়া জন্ম নেয়। তিনি এখানেই স্থায়ী হতে চান। ঢাকা শহরের বাড়ি বিক্রি করে আসায় তার কাছে ম্যালা নগদ অর্থ। এখানে ভিটাবাড়িসহ কিছু জমিজমা ক্রয় করতে ইচ্ছুক। হারাধন চক্রবর্তী খবর পেয়ে তার ভিটাবাড়ি সব বিক্রি করে পাকাপাকিভাবে ভারতে চলে গেলেন। সেখানে তার নানাবাড়ি।

হারুন ব্যাপারী হারাধনের ভিটাবাড়িতে উঠলেন। সেখানে কোনো সমস্যা হলো না। কিন্তু ভেজালটা লাগল কালিশুরির জমির বেলায়। জমি দখল নিতে এলে জয়নাল মির্জা হারাধনের টিপসই দেওয়া দলিল বের করলেন। দলিলে স্পষ্ট যে ক্রয়সূত্রে এই জমির মালিক জয়নাল মির্জা। হারাধন লোক ছিলেন সোজা, পড়াশোনা জানতেন না। জয়নাল মির্জাকে বিশ্বাস করে দলিলে টিপসই দিয়েছিলেন। তার স্ত্রী তখন মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন, তাই যাচাই- বাছাইয়ের সময়ও তার ছিল না।

অন্য দিকে হারুন ব্যাপারীর কাছেও ক্রয়সূত্রে পাওয়া দলিল রয়েছে। হারাধন চক্রবর্তীর সাথে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি। পরবর্তী সময়ে হারাধনের বন্ধুর কাছ থেকে হারুন ব্যাপারী জয়নাল মির্জার কারসাজির কথা জানতে পেরেছিলেন। তার পর থেকেই জয়নাল মির্জার সাথে হারুন ব্যাপারীর বিরোধ। সামনাসামনি তাদের সম্পর্ক মধুর। ভাবখানা এমন যে দুজনেই একই ব্যক্তি দ্বারা ঠকেছেন। তবে হারুন ব্যাপারীও ঝানু লোক। তিনি তার নগদ অর্থে কেনা জমি এত সহজে ছাড়বেন না।

.

মানিক গরিব ঘরের ছেলে। অল্প বয়স থেকেই সে খেয়াঘাটের মাঝি। প্ৰথমে বর্গা নৌকা চালাত। বছরখানেক হলো নিজের নৌকা হয়েছে। বাপ বর্গাচাষি ছিলেন। এখন অসুস্থতার জন্য তিনি কাজ করতে পারেন না। ছোট ছোট পাঁচ ভাইবোন। সুতরাং পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মানিক। দিন আনি দিন খাই অবস্থা। জেসমিন-রঞ্জুর প্রতিবার দেখা করার সময় পাহারাদার হিসেবে থাকতে হয় তার। গরিবের ক্ষমতা সীমিত, তাই ভয় অধিক। মানিকও তার ব্যতিক্রম নয়। চেয়ারম্যান সাহেব জানতে পারলে রঞ্জুর সাথে সাথে তার পরানটাও যাবে।

জেসমিন আজ ক্লাস না করে স্কুলের পেছনের খেয়াঘাট থেকে মানিকের নৌকায় উঠেছে। নৌকা কেশবপুরের সীমানার বাইরে যাওয়ার পর রঞ্জু নৌকায় উঠবে। এমনই পরিকল্পনা হয়েছে চিঠিতে। মানিক দ্রুতহাতে বইঠা বেয়ে পাড় থেকে দূরে চলে গেল। তবে এর জন্য বেশ কসরত করতে হলো। কারণ, ভাটার সময় স্রোতের প্রতিকূলে দাঁড় টানতে হচ্ছে। তার জীবনের কোনো কিছুই স্রোতের অনুকূলে থাকে না। আর এ তো নদীর স্রোত। এ আর কী!

জেসমিন গুনগুন করে কোনো একটা গান গাইছিল বোধ হয়। রঞ্জু নৌকায় ওঠার আগেই মানিকের কথা সেরে ফেলা উচিত। জেসমিন বয়সে তার চেয়ে অনেক ছোট। তার ছোট বোনের সাথে এক ক্লাসে পড়ে। একই গ্রামের বাসিন্দা। কাছাকাছি বাড়ি। ছোট থেকে বড় হতে দেখেছে।

আচমকাই কথা শুরু করল মানিক, ‘জেসমিন, তোর ডর লাগে না?’

জেসমিন খুব স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিল, ‘ইট্টু সাহস না থাকলে তো প্রেমে ডুব দিতাম না, মানিক ভাই।’

মানিকের চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল জেসমিন। যেন এমন প্রশ্ন আসতে পারে জেনে উত্তরটা তৈরি রেখেছিল সে। এমন দৃঢ় দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। মানিক এমনিতেও মেয়েছেলের দিকে তাকাতে অস্বস্তি বোধ করে। সে নদীর পানে চেয়ে দাঁড় বাইতে বাইতে বলল, ‘সাহস ভালো। তয় সবকিছুতে না। লোক জানাজানি হইলে কেলেঙ্কারি অইবে, তোর বদনাম অইবে, জেসমিন। ‘

জেসমিন খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। মানিক বিরক্ত মুখে তাকাল। জেসমিন হাসতে হাসতেই বলল, ‘চান্দেরও কলঙ্ক থাকে, মানিক ভাই। আমিও তো চান্দের লাহান সুন্দর। আমার একটু কলঙ্ক না থাকলে ক্যামনে হয়, কন তো?’

আজকের সূর্যের বড় তেজ। মানিকের ঘিলু যেন গলে পড়বে মনে হচ্ছে। দুশ্চিন্তায় আজ সে গামছা আনতে ভুলে গেছে। গামছা আনলে মাথাটা ঢেকে নিতে পারত। সে কিছুটা বিরক্ত মুখে বলল, ‘তোগো দুইডার একটারও ডরভয় বইলতে কিছু নাই। একবার ভাবছস জয়নাল চাচা জানতে পারলে কী অইবে?’

‘আমনে এক কাজ করেন, মানিক ভাই, বন্ধুরে তালাক দিয়া দেন। তাইলে আর আমনের ফাঁসার চান্স নাই। যা যাইবে, আমাগো ওপর দিয়া যাইবে।’

মানিক জবাব দিল না। সে এমনিতেও কথা কম বলে।

.

নৌকা নদীর পাড়ে ভেড়াল মানিক। রঞ্জুকে সেখানে একটা গাছের শিকড়ের ওপর বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। নৌকা ভিড়তেই রঞ্জু দ্রুত নৌকায় উঠে সোজা ছইয়ের ভেতর চলে গেল। মানিক নিজের মাথায় একটু পানি দিল। তারপর আবার নৌকা ভাসাল। বইঠা বাইতে শুরু করল অজানার উদ্দেশে। তার হাতে এখন অফুরন্ত সময়, যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। স্কুল ছুটির সময় হলে রঞ্জুকে আবার এখানে নামিয়ে তারা ফিরে যাবে। এই সময়টায় তার যা আয় হতো, তা রঞ্জু দিয়ে দেবে।

জেসমিন নৌকায় উঠেই শাড়ির আঁচল দিয়ে লম্বা ঘোমটা দিয়ে ফেলেছিল, যাতে বাইরে থেকে দেখলে কেউ চিনে না ফেলে। রঞ্জু তাকে এভাবে দেখে বলল, ‘তোমাকে কিন্তু নতুন বউয়ের মতো লাগছে, ফুল।’

জেসমিন মুখ টিপে হেসে বলল, ‘তাইলে বাড়ি লইয়া লও।’

‘তুমি কি এখনই যেতে চাও? তাহলে বাবাকে বলে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই?’ জেসমিন চোখ বড় বড় করে বলল, ‘তুমি কি পাগল? আমি এমনেই মজা করছি। আমার আব্বা এই সব টের পাইলে মাইরা ফালাইবে।’

‘ও মা, তাহলে কি আমরা সারা জীবন এভাবে লুকিয়েচুরিয়ে দেখা করে যাব?’

‘না, আগে কাজকাম করো। বেকার পোলার কাছে আমার বাপে মাইয়া দেবে না।’

‘দাঁড়াও, দ্রুত বেকারত্ব ঘোচাচ্ছি। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করব। তার আগপর্যন্ত বাবার সাথে ব্যবসায় কাজ করি।’

রঞ্জু সত্যি সত্যিই তার বাবার সাথে ব্যবসায় কাজ করা শুরু করল। তার বাবার বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা রয়েছে। যখনই ছেলে কাজ করতে চাইল, তিনি ভীষণ খুশি হয়ে ছেলেকে কাজে লাগিয়ে দিলেন।

আমিন মুন্সির আজ বড় খুশির দিন। মামুন ও তার পরিবারের সবাই বিয়েতে রাজি হয়েছে। তবে মামুনের কিছু আরজি রয়েছে। শ্বশুরের টাকায় পড়তে ইচ্ছুক নয় সে। তবে চাকরি নিতে আপত্তি নেই। চাকরি করে তারপর সে নিজের মতো টাকাপয়সা জমিয়ে পড়াশোনা করবে এবং রেহানাকেও অবশ্যই আবার পড়াশোনা শুরু করতে হবে। ক্লাস ফাইভ পাস করতেই দেশে যুদ্ধ লেগে গেল। স্বাধীনের পর বিয়ে, বছর না ঘুরতেই ছাড়াছাড়ি। আর পড়াশোনা হয় নি মেয়েটির। মামুনের এমন আরজিতে আমিন মুন্সি যারপরনাই আনন্দিত। এমন করে ভাবতে পারে কয়জনে?

আব্বাস মিস্ত্রির খানিক সংকোচ ছিল, আমিন মুন্সির সাথে মানানসই আয়োজন তো সে করতে পারবে না। এই সংকোচ অবশ্য দূর করে দিয়েছেন স্বয়ং আমিন মুন্সিই। ন্যূনতম দেনমোহর আর একটা সুতি শাড়ি পরিয়ে মেয়েকে তুলে নিলেই তিনি খুশি। কোনো বউভাতের আয়োজনের প্রয়োজন নেই।

আব্বাস তার সামর্থ্য অনুযায়ী ভাইয়ের বিয়ের আয়োজন করল। খুব বেশি কিছু নয়, ন্যূনতম দেনমোহর; সোনা-কাপড় বলতে একটা নাকফুল আর হালের জনপ্রিয় একটি মালা শাড়ি। মোকসেদেরও কিছু জমানো টাকা ছিল, সেগুলো বের করল। সেই টাকায় পান-মিষ্টি নেওয়া আর মেহমানদারি করা হলো। এত বড় ঘরে ছেলের বিয়ে, কিছু না করলে তো মান-ইজ্জত যায়।

শুরু থেকেই কেমন একটা ভয় করছিল! ভালোয় ভালোয় বউ নিয়ে বাড়ি ফিরে আব্বাস স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।

.

মুকুল যাত্রাদল ছেড়ে দিয়েছে। মায়ের বা ভাবির বকাবকিতে নয়, স্ত্রীর গঞ্জনাতেও নয়। ছাড়ল বাচ্চাটার দুঃখে। সে যে বাচ্চাকাচ্চার বিষয়ে খুবই আগ্রহী, বিষয়টা তা নয়। কিন্তু একটা বাচ্চা এসে গেছে আর মিনা তাকে না জানিয়েই মেরে ফেলল, এটা সে মেনে নিতে পারছে না। কোনোভাবেই না। ভীষণ রকম ভঙ্গুর অনুভব করছে। রাগ নাকি জেদ, তা সে জানে না, শুধু যাত্রাদলে আর থাকতে ইচ্ছা করছিল না।

খবরটা চাউর হতে সময় লাগে নি। গৌরনদী বাসস্ট্যান্ডে চায়ের দোকানে বসে ছিল মুকুল। মানুষ দেখছিল সে। কে কী কাজ করে, সেই সব দেখছিল। নতুন কোনো কাজের সন্ধানে। এখানে নিত্যনতুন মানুষের আনাগোনা। ছোটখাটো অনেক রকম ব্যবসা করার সুযোগ আছে। কিন্তু ব্যবসা করার মতো পুঁজি তার নেই। কাঠের কাজ বাদে কোনো কাজও জানে না। কোনো কূলকিনারা পায় না।

এসব ভাবনায় যখন বিভোর হয়ে ছিল, ঠিক তখনই পাশ থেকে বাস ড্রাইভার আনোয়ার বলল, “কিগো মুকুল ভাই! এই সব কি সর্বনাইশ্যা কতা হুনি? তুমি বোলে যাত্রাদল ছাইড়া দেছো? কতা কি হাছা?’

আনোয়ার মুকুলের অভিনয়ের বিরাট ভক্ত। কোনো পালা সে বাদ দেয় না। দুজনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্বও রয়েছে।

মুকুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘কী করমু কও, যাত্রা কইর্যা কি সংসার চলে?’

আনোয়ার আহত গলায় বলল, ‘টাহাপয়সা ঠিকমতো দেয় না?’

‘মোডেও দেয় না।’

‘কও কী! মোরা যে এত পয়সা দিয়া টিগিট কাইড্যা দেহি?’

‘হেইয়া বোলে সেট আর কস্টিউমেই লাগে। হাছামিছা জানি না। তয় ম্যালা মানুষ অইলে মোরা সামান্য কিছু পাই। অতে কিছুই অয় না, দাদো।’

‘আহা রে! তোমার পালা আর দেখতে পামু না মনে অইতেই মনডা পুড়তেয়াছে।’

মুকুল আচমকাই জিজ্ঞেস করল, ‘আনোয়ার ভাই, গাড়ি ক্যামনে চালায়?’

‘হ্যা তো শেকতে অইবে। ম্যালা টাহাপয়সার মামলা। মোর নিজের গাড়ি থাকলে হেলে তোমারে শেখাইতে পারতাম।’

মুকুল আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। টাকা ছাড়া কিছুই কেন সম্ভব না? মামুন কলকাতা চলে যাচ্ছে আজ। ভীষণ মনখারাপ রেহানার

মামুনের ব্যাগ গোছানোর সময় সে বলল, ‘আমিও আমনের লগে যামু।’

মামুন হেসে বলল, ‘তোমারে ক্যামনে নিমু?’

রেহানা গাল ফুলিয়ে বলল, ‘নিতে না পারলে বিয়া করছেন ক্যা?’

রেহানার ছেলেমানুষি দেখে মামুনের কেবল হাসি পাচ্ছে। কিন্তু সে হাসলে আবার রেহানা রাগ করবে। মেয়েটি কথায় কথায় রাগ করে। আবার মুহূর্তেই হেসে গড়িয়ে পড়ে। তাকে বোঝা বড় মুশকিল।

রেহানা ধমকে উঠল, ‘চুপ কইরা রইছেন ক্যা? কথার উত্তর দেন।’

মামুন কাছে এসে বলল, ‘আগে তো আমি যাই। তারপর সুযোগ বুইঝা তোমারে নিয়া যামু।’

রেহানা ফোঁস করে উঠে বলল, ‘নিবেন না, আমি জানি।’

‘ক্যামনে জানো?’

‘যারা শহরে চাকরি করতে যায়, অরা কেউই বউরে নিয়া যায় না। কত মাইনষেরে দেখলাম!’

‘আমারে সুযোগ তো দেবা। আগেই সবার কথা কও ক্যা?’

‘কই যাতে এহনই লগে কইরা লইয়া যান।’

মামুন রেহানার হাত ধরে বলল, ‘শোনো, এখন আমি যাইয়া কই উঠমু, তাই জানি না। হয়তো কোনো মেসে। তোমারে লইয়া গিয়া কি মেসে উঠতে পারমু, কও? আগে আমি যাই। টাকাপয়সা জমাই। সবকিছু গুছাইয়া নিয়া এরপর তোমারে নিমু।’

‘সত্য?’

‘সত্য।’

রেহানা আহ্লাদী গলায় জানতে চাইল, ‘এত দিন আমি কার কাছে থাকমু?’

‘ক্যান, আব্বা-আম্মা, ভাইজানেরা, ভাবিরা, তাগো পোলাপানেরা—সবাই তো আছে।’

রেহানা মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, ‘আমার কাউরে ভাল্লাগে না।’

অবাক হলো মামুন, ‘ভাল্লাগে না ক্যা?’

রেহানা বলল, ‘সবাই জানি কেমন! আমাগো বাড়ির কেউ এমন না।’

‘এমন কেমন?’

বুঝতে পারছে না মামুন।

রেহানা এবার ইতস্তত করে বলল, ‘সবার কাপড়চোপড় ময়লা, চুল ময়লা। গরিবের মতো থাকে। ক্যামনে কইরা তাকায়।’

মামুন ম্লান হেসে বলল, ‘আমরা তো গরিবই। তোমাগো পরিবারের লগে আমাগো পরিবারের সম্পর্কডাই আসলে বেমানান।’

‘আমারে বিয়া কইরা কি এহন আফসোস অইতাছে?’

‘আফসোস তো তোমার হওনের কথা। আমার ক্যান হবে?’

‘আমার কোনো আফসোস নাই। কারণ, আমার আমনেরে অনেক ভাল্লাগে।’

মামুন লজ্জা পেয়ে গেল এবার। লজ্জায় লাল হয়ে যেতে যেতেই দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘তাইলে কি কয় দিন তোমাগো বাড়ি গিয়া থাকবা?’

রেহানা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, ‘নাহ্। আমনে আমারে যত দিন না নিয়া যান, আমি এহেনেই থাকমু। আমনের ঘরে।’

মামুন হেসে বলল, ‘আচ্ছা, তোমার যেহেনে ইচ্ছা থাকো। এই বাড়িতে থাকতে কষ্ট হবে জানি। তোমাগো বাড়ির মতো কোনো সুযোগ-সুবিধাই এইখানে নাই। কষ্ট কইরা কয়টা দিন থাকো। কথা দিলাম, শিগগিরই তোমারে কলকাতা নিয়া যামু।’

রেহানা মাথা নেড়ে বলল, “আচ্ছা। কিন্তু এই যে আমি কইলাম আমনেরে আমার ভাল্লাগে, আমারে আমনের কেমন লাগে, এইডা তো কইলেন না?’

মামুন হেসে বলল, ‘তুমি তো বুদ্ধিমতী। তুমিই কও এই কয় দিনে কী বুঝলা?’

রেহানা আঙুলে চুল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলল, ‘আমি যা বুঝলাম তা হইল, প্রথম প্রথম আমারে আমনের ভাল্লাগত না। দেখতে ভালো না, তার উপে কালা; ভাল্লাগার কথাও না। কিন্তু আমি তো আবার ছলাকলা জানি, তাই পইট্যা গেছেন। এখন আবার ভাল্লাগে।’

মামুন এবার হো হো করে হেসে দিল। রেহানা মুচকি হাসছে। মামুনের এই ভুবনভোলানো হাসি যতবার সে দেখে, ততবার তার মন উতলা হয়।

উঠোনে মরিচ শুকানো হচ্ছিল। হালিমা বিবি সেখানে বসে মরিচ পাহারা দিচ্ছিলেন। এত জোরে হাসির শব্দ শুনেই তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘দুহাইর্যাকালে এত হাহা হিহি কিসের?’

রেনু রান্না বসিয়েছে। মিনা তরকারি কুটছিল। মিনা রেনুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভাবি, দেখছ কাণ্ড? আমাগো লগে কইরা খায়েশ মিটে না। এহন নতুন বউয়ের লগে শুরু করছে।’

রেনু চাপা গলায় বলল, ‘আহ মিনা, চুপ কর।

‘চুপ করমু ক্যা, ভাবি? বেচারা নিজের বউয়ের লগে হাসবে না তয় কি অন্য ব্যাডাগো বউয়ের লগে হাসবে?

‘থাক মিনা, তুই থাম। কানে গেলে আবার অশান্তি করবে।’

মিনা রাগে গজগজ করতে করতে একনিমেষেই সব তরকারি কুটে ফেলল।

এদিকে মায়ের হুংকার শুনে মামুন চুপ হয়ে গেল। তখনই ঘর থেকে বের হয়ে যেতে চাচ্ছিল, রেহানা তাকে আটকে বলল, কই যান? ‘

‘এমনেই বাইরে যাই। মা কি-না-কি মনে করতাছে।’

রেহানা মামুনকে কাছে টেনে বলল, ‘করতে দেন। বিয়া করছেন না? এত শরম কিসের?’

.

মুকুলের যাত্রাদল ছাড়ায় সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে মিনা। নতুন কোনো কাজে নামুক না-নামুক, যাত্রাদল ছেড়েছে, এতেই সে মহা খুশি। কিন্তু সেদিনের পর থেকে মুকুল একবারও তার কাছে আসে নি। প্রতিটা দিন উল্টো ঘুরে ঘুমিয়ে থাকে। রাগ হয়েছে। এই রাগ ভাঙতে কত দিন লাগে কে জানে। এভাবে তো আর চলতে দেওয়া যায় না। তাই ভেবেছে আজ সে একটু রাগ ভাঙাবার চেষ্টা করবে। কিন্তু আজই মধু সবচেয়ে বেশি জ্বালাচ্ছে। ঘুমের কোনো নামগন্ধ নেই।

অনেক জ্বালাতনের পর মধু ঘুমিয়ে পড়লে মিনা মুকুলের কাছে গেল। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই মুকুল সরিয়ে দিল।

মিনা বলল, ‘ওকি, দূরে সরাইয়া দেও ক্যা? পোলায় ঘুমাইছে তো।’

মুকুল স্পষ্ট গলায় বলল, ‘দূরে থাকনই ভালো। আবার কোন বিপদ হয় কওন যায় না। কয়বার আর বাচ্চা ফালান যাইবে? রাইত অনেক অইছে, ঘুমাও।’

মিনা আর কথা বলতে পারল না। ঘুমাতেও পারল না, ঘুম উড়ে গেছে তার।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *