দ্য পিকউইক পেপার্স – ২

দুই

রচেস্টার ও আশপাশের শহরগুলোর বাসিন্দারা পরদিন চরম উত্তেজনায় বিছানা ছাড়ল সকাল সকাল। রচেস্টারে সামরিক বাহিনীর জমকালো কুচকাওয়াজ হবে। ছটা রেজিমেন্টকে পর্যবেক্ষণ করবেন কমান্ডার-ইন-চীফ। অস্থায়ী একটা দুর্গ বানানো হয়েছে, আক্রমণ করে দখল করা হবে সেটিকে। ফাটানো হবে বোমা।

মি. পিকউইক’ সেনাবাহিনীর একজন অত্যুৎসাহী ভক্ত। মি. জিঙ্গলের সঙ্গে মন মাতানো ডিনারের পর তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা একটু রাত করে শুতে গেছিলেন কিন্তু পরদিন ভোর নাগাদ উঠে পড়ে ময়দানের উদ্দেশে হাঁটা দিলেন; চারদিক থেকে জনতা এসে ভিড় জমাচ্ছে সেখানে।

প্যারেড গ্রাউন্ডে সাজ সাজ রব, এলাহী কাণ্ড। সেন্ট্রি রয়েছে পাহারায়, সেনাবাহিনীর জন্যে ময়দান ফাঁকা রাখতে। সার্জেন্টরা কাগজপত্র বগলদাবা করে ছোটাছুটি করছে। পূর্ণ সামরিক পোশাকে সজ্জিত কর্নেল ঘোড়া ছুটিয়ে এদিক- ওদিক যাচ্ছেন আর বাজখাঁই গলায় চেঁচাচ্ছেন। অফিসাররা সামনে পিছে দৌড়াদৌড়ি করে রিপোর্ট করছেন কর্নেলকে, সার্জেন্টদের আদেশ দিয়ে একযোগে ছুটে চলে যাচ্ছেন। এমনকি প্রাইভেটরাও গম্ভীর।

মি. পিকউইক ও তাঁর বন্ধুরা সামনের কাতারে জায়গা দখল করে প্যারেডের জন্যে ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করছেন। দ্রুত বৃদ্ধি পেল জনতা এবং দু’ঘণ্টা ধরে জায়গাটুকু দখলে রাখতে ব্যস্ত সময় কাটল তাঁদের। এই হয়তো পেছন থেকে গুঁতো খেয়ে অপমানজনক ভাবে সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন মি. পিকউইক; আবার পরমুহূর্তে ‘পিছু হটুন!’ আদেশ শোনার সঙ্গে সঙ্গে হয়তো বন্দুকের কুঁদো পড়ল তাঁর পায়ের পাতায়। মি. স্নডগ্রাস ও মি. উইঙ্কলও যথারীতি ঠেলা-গুঁতো হজম করছেন। মি. টাপম্যান সহসা কোথায় যে হাওয়া হয়ে গেলেন আর খুঁজে পাওয়া গেল না। অর্থাৎ মহান নেতা ও তাঁর বাহিনী যে খুব একটা আরামদায়ক অবস্থায় নেই তা বলাইবাহুল্য।

শেষমেশ বহু কণ্ঠের অনুচ্চ’ গর্জনে সেনাবাহিনীর আগমন বার্তা ঘোষিত হলো। সবকটা চোখ ঘুরে গেল প্রবেশপথের দিকে। পতপত করে উড়ছে পতাকা, রোদ পড়ে ঝিকিয়ে উঠল অস্ত্র-শস্ত্র, প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রবেশ করল ট্রুপস। ওরা থমকে পড়ে নতুন করে অবস্থান নিল। একটা আদেশ ভেসে গেল সারিবদ্ধ লোকগুলোর মাঝ দিয়ে। সেনাবাহিনী স্যালুট করলে অস্ত্রের ঝংকার উঠল; এবং কমান্ডার-ইন-চীফ, কর্নেল ও অন্যান্য অফিসাররা ঘোড়া দাবড়ে সামনে চলে এলেন। বাজনা বেজে উঠল একসঙ্গে। ঘোড়াগুলো দু’পায়ে উঠে দাঁড়াল, কান ঝালাপালা করে দিল কুকুরের ডাক, আর্তচিৎকার করে উঠল জনতা এবং লাল কোট ও সাদা ট্রাউজার পরা লোকগুলোকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা ছাড়া কারও চোখে আর কিছু ধরা পড়ল না।

মি. পিকউইক এ অবধি তাল সামলাতে ও ঘোড়ার লাথি খাওয়া এড়াতে এতই ব্যস্ত ছিলেন, প্যারেড উপভোগ করার অবকাশ পাননি। অবশেষে দৃঢ়ভাবে যখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারলেন তখন তাঁর খুশি বাঁধ মানল না।

‘এরচেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে?’ মি. উইঙ্কলকে প্রশ্ন করলেন তিনি। ‘কিছুই না,’ জবাব দিলেন ভদ্রলোক, গত পনেরো মিনিট ধরে যদিও এক লোক তাঁর পায়ের ওপর দাঁড়ানো।

‘এই প্রদর্শনীর কোন তুলনা হয় না,’ বললেন মি. স্নডগ্রাস, কাব্যের বল্গাহীন স্রোত অন্তরটাকে তাঁর ভাসিয়ে দিচ্ছে, ‘শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের সামনে রাষ্ট্রের অকুতোভয় সৈনিকদের এই অনবদ্য কুচকাওয়াজ- কী উজ্জ্বল তাদের মুখ- যুদ্ধের নৃশংসতা নেই, আছে শুধু সভ্য বিনম্রতা। চোখ ধকধক করে জ্বলছে তাদের- প্রতিশোধস্পৃহায় নয়, মানবতা আর বুদ্ধিমত্তার স্নিগ্ধ আলোয়।’

কিন্তু আদপে, ‘চোখ সামনে,’ আদেশটি দেয়া হলে দেখা গেল কয়েক হাজার চোখ ফাঁকা দৃষ্টিতে সামনে চেয়ে আছে, কোন অভিব্যক্তির প্রকাশ নেই।

‘দারুণ মুহূর্ত এখন, চারদিকে চেয়ে বললেন মি. পিকউইক। চারধার থেকে ক্রমান্বয়ে সরে পড়েছে জনতা এবং এখন নিঃসঙ্গ প্রায় তাঁরা তিনজন।

‘দারুণ!’ প্রতিধ্বনি করলেন মি. স্নডগ্রাস ও মি. উইঙ্কল।

‘ওরা এখন কি করছে?’ প্রশ্ন মি. পিকউইকের।

‘আমার- আমার মনে হয় গুলি করবে,’ ফ্যাকাসে মুখে বললেন মি. উইঙ্কল।

‘ধ্যেত,’ বললেন মি. পিকউইক।

‘আমার- আমারও কিন্তু তাই মনে হচ্ছে,’ আতঙ্কমাখা স্বরে বললেন মি. স্নগ্রাস।

‘অসম্ভব!’ বললেন মি. পিকউইক। কথাটা বলেছেন কি বলেননি ছয় রেজিমেন্ট একই সঙ্গে অস্ত্র বাগিয়ে ধরল- লক্ষ্য যেন তাদের একটাই— পিকউইকবাহিনী- এবং কান ফাটানো শব্দটা কাঁপিয়ে দিল মাটি।

পিকউইকবাহিনী ঘুরে দৌড় মারতে যাবে দেখে ওপাশে আরেক দল সৈন্য জড় হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। দু’দল সৈন্যের মধ্যখানে এখন ওঁরা! মহা বিপজ্জনক পরিস্থিতি। কিন্তু মি. পিকউইক এবার মহান নেতার অন্যতম গুণাবলী অর্থাৎ সাহস ও স্থৈর্যের অসামান্য উদাহরণ রাখলেন। মি. উইঙ্কলকে বাহু ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে নিজেকে তাঁর ও মি. স্নড়গ্রাসের মাঝখানে দাঁড় করালেন। আকুল কণ্ঠে তাঁদের বোঝাতে চাইলেন ভয়ের কিছু নেই— সৈন্যরা ফাঁকা গুলি ছুঁড়ছে। তাঁর একমাত্র ভয় কান না বয়রা হয়ে যায়।

‘কিন্তু ধরুন কেউ কেউ যদি সত্যিকারের গুলি করে বসে?’ প্রতিবাদ জানালেন মি. উইঙ্কল, মলিন তাঁর মুখের চেহারা। ‘বাতাসে এইমাত্র শিস কেটে গেল শুনলাম- একেবারে কান ঘেঁষে।’

‘মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ি?’ জিজ্ঞাসা মি. স্নডগ্রাসের।

‘না, না- গোলাগুলি শেষ হয়ে গেছে,’ অভয় দিলেন নেতা।

তিনি ঠিকই বলেছেন। গোলাগুলি থেমে গেছে। কিন্তু তাঁর কথাগুলো মাটিতে পড়ার আগেই ত্বরিত নড়াচড়া লক্ষ করা গেল সেনাদের মাঝে। একটি আদেশ ঘোষিত হলে, ছটি রেজিমেন্ট সহসা বেয়োনেট উঁচিয়ে তেড়ে এল ঠিক যেখানটিতে মি. পিকউইক ও তাঁর বন্ধুরা দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

মানুষ তো মানুষই, অতিমানব তো আর নয়- এবং মানুষের সাহসেরও একটা সীমারেখা আছে। মি. পিকউইক গোল চশমার ভেতর থেকে আগুয়ান সৈন্যদের দিকে একটি মুহূর্ত চেয়ে রইলেন এবং তারপর পৃষ্ঠপ্রদর্শন করলেন। বলতে নেই তিনি আসলে ছুটে পালালেন। দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটার ফলে নিজের বেকায়দা অবস্থাটা উপলব্ধি করতে অনেক দেরি হয়ে গেল মহাপুরুষটির।

পেছনের সৈন্যরা দুর্গ রক্ষার্থে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে আক্রমণকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে। মি. পিকউইক ও তাঁর বন্ধুরা লম্বা দুটি সারির ফাঁকে ধরা পড়লেন, একদল দ্রুত এগোচ্ছে এবং অন্যপক্ষ সংঘর্ষের জন্যে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে।

‘হোই!’ আগুয়ান পক্ষের অফিসাররা গর্জন ছাড়ল।

‘পথ ছাড়ো!’ অপর পক্ষের অফিসারদের তীব্র চিৎকার।

‘যাব কোথায় আমরা?’ আতঙ্কিত পিকউইকবাহিনীর সম্মিলিত আর্তনাদ।

‘হোই-হোই-হোই,’ এই ছিল শেষ জবাব।

বিভ্রান্তিকর একটি মুহূর্ত, গুরুভার পদধ্বনি, প্রচণ্ড সংঘাত, অট্টহাসি। ছয় রেজিমেন্ট চার্জ করলে চিৎপাত হয়ে পড়ে গেলেন মি. পিকউইক। একটা করে ডিগবাজি খেলেন মি. স্নডগ্রাস ও মি. উইঙ্কল। মি. উইঙ্কল ধাতস্থ হতে প্রথমেই দেখতে পেলেন, তাঁদের প্রাণপ্রিয় নেতা ফুরফুরে বাতাসে নিজের উড়ে যাওয়া হ্যাটটা বাগে পেতে ছোটাছুটি করছেন।.

মি. পিকউইকের হ্যাট মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হালকা বাতাস উঠছে, মি. পিকউইকের দম বেরিয়ে যাচ্ছে এবং হ্যাট তার নিজের মত গড়াগড়ি খেয়ে চলেছে। কোনদিনই হয়তো হ্যাটটার নাগাল পেতেন না ভদ্রলোক,’ যদি না তাঁকে হাল ছেড়ে দিতে দেখে থেমে পড়ত ওটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *