দ্য পিকউইক পেপার্স – ১

এক

তেরোই মে-র ভোরে সূর্য সবে উঠেছে, এসময় আরেকটি সূর্য, মি: স্যামুয়েল পিকউইকও ঘুম থেকে উঠলেন। জানালাটা এক ধাক্কায় খুলে নিচে পৃথিবীর দিকে চাইলেন তিনি। যদ্দূর দৃষ্টি চলে গসওয়েল স্ট্রীট তাঁর পায়ের কাছে; কিন্তু মি. পিকউইক চিরদিন গসওয়েল স্ট্রীট দেখে সন্তুষ্ট থাকার পাত্র নন। রাস্তাটার ওপাশে যে সত্য লুকিয়ে আছে সেগুলো জানতে চান তিনি। কাজেই ফিটফাট হয়ে, সুটকেস গোছগাছ করে শীঘ্রিই তৈরি হতে হলো। এক হাতে সুটকেস নিয়ে, আর দু’পকেটে টেলিস্কোপ ও নোটবুক পুরে গটগট করে ঘর ছাড়লেন তিনি।

নতুনত্ব আবিষ্কারে সদাসতর্ক মি. পিকউইক সেন্ট মার্টিনের কোচস্ট্যান্ডে এসে হাজির হলেন। প্রথম ক্যাবটিতে চড়াও হয়ে চালককে আদেশ দিলেন গোল্ডেন ক্রস কোচ স্টেশনে যেতে।

‘ঘোড়াটার বয়স কত হলো, বন্ধু?’ ক্যাব চালু হতে প্রশ্ন করলেন মি. পিকউইক।

‘বিয়াল্লিশ,’ জবাব দিল চালক, পাশ থেকে এক ঝলক দেখে নিল আরোহীকে।

‘কি!’ প্ৰায় চেঁচিয়ে উঠলেন সওয়ারী, ত্বরিত নোটবুক বেরিয়ে এল। চালক তার কথার পুনরাবৃত্তি করল। কটমট করে লোকটিকে দু’মুহূর্ত জরিপ করে শেষমেশ তথ্যটা টুকে নিলেন মি. পিকউইক।

‘কতক্ষণ খাটাও ওকে?’ ফের জিজ্ঞেস করলেন মি. পিকউইক।

‘একটানা দুই কি তিন হপ্তা।’

‘হপ্তা!’ মি. পিকউইক বিস্ময়ে বাদ্ধ প্রায়- মহার্ঘ নোটবইটা বের করলেন আবারও।

‘পেন্টনভিলে বাসা ওর, শান্ত স্বরে বলল চালক, ‘কিন্তু অসুস্থতার কারণে ওখানে ওর যাওয়ার দরকার হয় না বললেই চলে। ক্যাব থেকে খুলে নিলেই বেচারা মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। কিন্তু কষে জুতে রাখলে আর সে ভয় থাকে না। আমাদের চাকা দুটো প্রকাণ্ড, ফলে ও নড়লেই তারা ধাওয়া দেয়, তখন ছুটতেই হয় ওকে— উপায় নেই।’

চালকের প্রতিটি কথা উঠে গেল মি. পিকউইকের নোটবুকে। ক্লাবে পাঠাতে হবে এটা, প্রতিকূল পরিবেশে ক্যাব ঘোড়ার অকল্পনীয় দীর্ঘ জীবন সম্পর্কে চমৎকার একটা রিপোর্ট হবে নিশ্চিত। লেখা মাত্র শেষ করেছেন এমনিসময় গোল্ডেন ক্রসে এসে থামল ক্যাব। মি. টাপম্যান, মি. স্নডগ্রাস ও মি. উইঙ্কল উদ্বেগের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁদের মহান নেতার আগমনের অপেক্ষায়, এবার তাঁকে ঘিরে ধরে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন।

‘এই নাও,’ বলে মি. পিকউইক একটা শিলিং বাড়িয়ে দিলেন ক্যাব চালকের উদ্দেশে।

আজব লোকটা তাঁকে হতবাক করে দিয়ে ফুটপাথে ছুঁড়ে মারল মুদ্রাটা এবং উত্তেজিত কণ্ঠে মি. পিকউইককে লড়াইয়ে আহ্বান জানাল।

‘তুমি পাগল নাকি,’ বললেন মি. স্নডগ্রাস।

‘নাকি মাতাল,’ বললেন মি. উইঙ্কল।

‘কে জানে, হয়তো দুটোই,’ বললেন মি. টাপম্যান।

‘আসেন!’ বলল চালক, মুঠো নাচিয়ে লাফ-ঝাঁপ শুরু করেছে। ‘চারজনই আসেন!’

‘আরে, খেল জমে গেছে দেখি,’ আরও কয়েকজন ক্যাব চালক চিৎকার করে বলল, ‘চালিয়ে যাও, স্যাম!’

‘এত গোলমাল কিসের, স্যাম?’ একজন ঠাণ্ডা মাথার ক্যাব চালক জানতে চাইল।

‘আরে, এই লোক আমার নাম্বার চায়!’ তড়পে উঠল চালক লোকটা।

‘আমি তোমার নাম্বার চাইনি,’ হতভম্ব মি. পিকউইক বললেন।

তবে লিখলেন কেন?’ জিজ্ঞেস করল চালক। ‘বললেই হলো? কেউ বিশ্বাস করবে?’ সমবেত জনতাকে সাক্ষী মানল খেপাটে লোকটা। ‘কেউ বিশ্বাস করবে? শুধু যে নাম্বার নিয়েছে তাই-ই না; আমার প্রতিটা কথা টুকে নিয়েছে।’

মি. পিকউইক হঠাৎ বুঝতে পারলেন, যত নষ্টের গোড়া তাঁর নোটবইটা! ‘আসো দেখি!’ গর্জন ছেড়ে হ্যাট মাটিতে ছুঁড়ে ফেলল ক্যাব চালক, এক ঝটকায় মি. পিকউইকের চশমা খসিয়ে, দুম করে এক ঘুসি বসিয়ে দিল নাকের ওপর, আরেকটা ঝাড়ল মহান নেতার বুকে, তৃতীয় আঘাতটা সইল মি. স্নড়গ্রাসের চোখ, আর চার নম্বরটা হজম করল মি. টাপম্যানের ওয়েস্ট কোট। তারপর এদিক সেদিক নেচে কুঁদে শেষ অবধি ঘুসি মেরে মি. উইঙ্কলের দম বের করে ছাড়ল লোকটা- সমস্তটা ঘটে গেল মাত্র ছ’সেকেন্ডের মধ্যে

জনতা একচেটিয়া সমর্থন জুগিয়ে গেল ক্যাব চালককে। কপালে আরও হয়তো ভোগান্তি ছিল চার বন্ধুর যদি না এক নবাগত রঙ্গমঞ্চে এসে উপস্থিত হত। ‘এত ফুর্তি কিসের?’ সবুজ কোট পরা লম্বা, একহারা গড়নের এক যুবক প্রশ্ন করল, কোচ ইয়ার্ড থেকে আচমকা উদয় হয়েছে সে।

‘গুপ্তচর ধরা পড়েছে!’ জনতার গর্জন।

‘আমরা গুপ্তচর না!’ পাল্টা গর্জালেন মি. পিকউইক।

‘তাই বুঝি?’ বলে কনুইয়ের গুঁতোয় জায়গা করে নিয়ে মি. পিকউইকের কাছে এগিয়ে এল যুবক।

মহামানবটি অল্প কথায় তড়বড় করে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করলেন।

‘আসুন দেখি,’ বলল সবুজ কোট, মি. পিকউইককে টেনে নিয়ে চলল। ‘এই যে, ড্রাইভার, টাকা নিয়ে কেটে পড়ো- সম্মানিত ভদ্রলোক- আমি ভাল করে চিনি— গর্দভের গুষ্টি— এদিকে, স্যার- আপনার বন্ধুরা কোথায়?— পুরোটাই একটা ভুল বোঝাবুঝি- কিছু মনে করবেন না- দুর্ঘটনা ঘটেই থাকে— তাই বলে হাল ছাড়বেন কেন— হতভাগাগুলো অযথা আপনাদের- বজ্জাতের দল। এবং একই ধরনের অসংখ্য ভাঙা ভাঙা বাক্য দ্রুত আওড়ে, সবুজ কোট যাত্রীদের ওয়েটিং রূমের দিকে নিয়ে গেল মি. পিকউইক ও তাঁর অনুসারীদের

ওখানে নিশ্চিন্তে বসার পর, আগন্তুক ব্র্যান্ডি ও পানির অর্ডার দিলে, মি. পিকউইক তাঁদের নতুন বন্ধুটিকে নিরীখ করার অবকাশ পেলেন।

লোকটা মাঝারি উচ্চতার, কিন্তু শুকনো দেহ আর লম্বা পা দুখানায় তাকে অনেক বেশি ঢ্যাঙা দেখায়। সবুজ কোটটা একদা চটকদার ছিল যদিও কিন্তু এখন ওটা স্পষ্টতই আগন্তুকের চাইতে খাটো লোকের উপযোগী, কারণ মাটি মাখা মলিন হাতা দুটো এর কব্জিও স্পর্শ করে না। চিবুক পর্যন্ত বোতাম আঁটা ওটার এবং একটা পুরানো স্টক লোকটার গলায় পেঁচানো, ভেতরে শার্টের চিহ্ন নেই। জরাজীর্ণ জুতোর ওপর কষে বাঁধা কালো ট্রাউজার, নোংরা সাদা মোজা দুটোর দুর্দশা ঢাকতে যেন। মুখের চেহারা শুকনো ও চোখা হলেও কেমন এক ঔদ্ধত্য ও আত্মবিশ্বাস ঘিরে আছে লোকটিকে।

চশমার আড়াল থেকে (ভাগ্যক্রমে ওটা উদ্ধার করতে পেরেছেন মি. পিকউইক) লোকটিকে জরিপ করে উষ্ণ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন তিনি তার প্রতি।

‘ও কিছু না,’ বলল আগন্তুক, বাধা দিল তাঁকে। ‘আপনি বেশি বেশি বলে ফেলেছেন- আর লজ্জা দেবেন না- চালু লোক- ড্রাইভারটা- ঘুসি যা ঝাড়ল- ওর মাথায় ঘুসি মারা উচিত ছিল।’

কোচোয়ান রচেস্টারের উদ্দেশে কোচ ছাড়ছে ঘোষণা করতে বাধাপ্রাপ্ত হলো লোকটির কথা। তড়াক করে লাফিয়ে উঠল সে। ‘আমার কোচ- সীট কেনা- ড্রিঙ্কের দামটা দিয়ে দেবেন- ভাংতি নেই— দিতে পারছি না।’

এখন কথা হচ্ছে, মি. পিকউইক ও তাঁর বাহিনীও রচেস্টারকে তাঁদের প্রথম স্টপেজ মেনেছেন। কাজেই সবাই মিলে কোচের পেছনে বসবেন সিদ্ধান্ত নিলেন। আগন্তুক তার মালপত্র জোগাড় করল- ব্রাউন পেপারে মোড়া একটা শার্ট ও একটা রুমাল- এবং শীঘ্রিই যাত্রা করল কোচ।

বড় রাস্তায় পড়ল কোচ, তোরণ শোভিত নিচু পথ এটা। ‘ভয়ঙ্কর জায়গা,’ নতুন লোকটি মন্তব্য করল। ‘বিপজ্জনক- সেদিন— পাঁচটা বাচ্চা- মা- লম্বা মহিলা, স্যান্ডউইচ খাচ্ছিলেন- তোরণের কথা ভুলে গেছিলেন- বাড়ি–খসে পড়ল- বাচ্চারা চেয়ে দেখে- মায়ের মাথা নেই- হাতে স্যান্ডউইচ- খাওয়ার মুখ নেই— পরিবারের মাথা বিচ্ছিন্ন- মারাত্মক, মারাত্মক!’

‘তাই তো বলি,’ বললেন মি. পিকউইক, ‘মানুষের জীবন কত বিচিত্রভাবেই না বাঁক নেয়।’

‘আপনি কবি নাকি, স্যার?’

‘আমার বন্ধু স্নডগ্রাস কবি,’ বললেন মি. পিকউইক।

‘আমিও,’ বলল আগন্তুক। ‘মহাকাব্য- দশ হাজার লাইন- যুদ্ধের সময় লেখা- ঠুস করে গুলি ফোটাও, পটাং করে বীণার তার ছেঁড়ো।’

‘আপনি ওই মহান জায়গায় উপস্থিত ছিলেন, স্যার?’

‘উপস্থিত! আমার তো তাই ধারণা! বন্দুক ফোটালাম- মাথায় ঘুরছে আইডিয়া- দৌড়ে গেলাম মদের দোকানে- লিখে ফেললাম- ফিরে এলাম আবার- গুড়ুম– আরেকটা আইডিয়া- ফের মদের দোকান- কলম আর কালি- আবার ফিরলাম- কচুকাটা–দারুণ সময়, স্যার। খেলোয়াড় নাকি, স্যার?’ মি. উইঙ্কলের ওপর চোখ।

‘তা বলতে পারেন,’ বললেন মি. উইঙ্কল।

‘চমৎকার পেশা, স্যার। কুকুর টুকুর?’

‘এ মুহূর্তে নেই।’

‘আহ! কুকুর পালা দরকার- দারুণ জানোয়ার- বুদ্ধিমান জীব- আমারও ছিল একসময়- শিকারে বেরোলাম একদিন- ঢুকলাম মাঠে- মারলাম শিস থামল কুকুর- আবার শিস- পন্টো আসে না- পন্টো! পন্টো! নড়ে না- একটা নোটিসের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে— তাকালাম- নোটিসে বলছে, ‘মাঠে কুকুর ঢুকলে গুলি করা হবে।’ কিছুতেই ঢুকবে না- খাসা কুকুর- ভীষণ।’

‘অদ্ভুত!’ বলে উঠলেন মি. পিকউইক। ‘নোট নিতে পারি?’

‘আলবত, স্যার, আলবত। শয়ে শয়ে গল্প আছে জানোয়ারটাকে নিয়ে। দারুণ মেয়ে, স্যার,’ শেষের অংশটুকু মি. টাপম্যানের প্রতি, রাস্তার ধারে একটি মেয়ের দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে ছিলেন তিনি।

‘খুবই!’ বললেন মি. টাপম্যান।

‘ইংরেজ মেয়েরা স্প্যানিশদের মত সুন্দরী হয় না। অনেককে চিনতাম- ডন বলেরো ফিজগিগ- স্প্যানিশ জমিদার- একমাত্র মেয়ে- ডোনা ক্রিস্টিনা- পাগলের মত ভালবাসত আমাকে- অসাধারণ মেয়ে- বাপ খেপে আগুন- জমিদারের মেয়ে- সুদর্শন ইংরেজ যুবক- হতাশা- ডোনা ক্রিস্টিনার পেটে বিষ- মৃত্যু, স্যার, মৃত্যু।’

‘আর তার বাবা, স্যার? কবি মি. স্নডগ্রাসের প্রশ্ন।

‘মন ভেঙে গেল,’ জবাব দিল আগন্তুক। ‘হঠাৎ উধাও- সবখানে তল্লাশী- বৃথা- পাবলিক ফাউন্টেন হঠাৎ অকেজো- ক’সপ্তাহ পার- পরিষ্কার- মেইন পাইপে মাথা দিয়ে ডন বলেরোর লাশ- ডান পায়ের বুটে দোষ স্বীকারপত্র- বের করা হলো- ঝর্না ফের চালু।’

‘রোমান্টিক ঘটনাটা লিখতে পারি?’ বললেন মি. স্নডগ্রাস। চোখ মুছলেন।

‘আলবত, স্যার, আলবত। চাইলে এমনি আরও পঞ্চাশটা শোনাতে পারি- বিচিত্র জীবন- আমার- ইন্টারেস্টিং।

আগন্তুক তার এ ধরনের নানা গল্প শোনাল সারাটা রাস্তা, রচেস্টার পৌঁছতে পৌঁছতে তার অভিযানের কাহিনীতে ভরে গেল মি. পিকউইক ও মি. স্নডগ্রাসের নোটবই।

হাই স্ট্রীটের বুল ইনে থামলেন ওঁরা।

‘আপনি এখানে উঠছেন?’ শুধালেন মি. উইঙ্কল।

‘আমি না- কিন্তু আপনারা উঠুন- ভাল বাড়ি- তোফা বিছানা।

মি. পিকউইক অনুসারীদের সঙ্গে ফিসফিসিয়ে আলোচনা সেরে তারপর বললেন, ‘আজ সকালে আপনি আমাদের মস্ত উপকার করেছেন, স্যার। ডিনারের আমন্ত্রণ রক্ষা করে আমাদেরকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ দেবেন কি?’

‘আনন্দের কথা— যে কোন কিছু হলেই চলবে- তবে সেদ্ধ মুরগি আর মাশরুম হলে তো কথাই নেই- দারুণ! কখন?’

‘এখন তো প্রায় তিনটে,’ ঘড়ি দেখে বললেন মি. পিকউইক। পাঁচটা হলে কেমন হয়?’

‘দারুণ,’ বলল আগন্তুক। ‘নাম জিঙ্গল- এখন আসি তবে- ভাল থাকুন।’ হ্যাট তুলল সে, মাথার একপাশে কায়দা করে ওটাকে বসিয়ে হাই স্ট্রীট ধরে পা চালাল।

‘মি. জিঙ্গল বহু দেশ ঘুরেছেন,’ বললেন মি. পিকউইক।

‘তাঁর কাব্য পড়তে পারলে বেশ হত,’ বললেন মি. স্নডগ্রাস।

‘আহা, কুকুরটা যদি দেখতে পেতাম,’ মি. উইঙ্কলের মন্তব্য।

মি. টাপম্যান কিছু বললেন না, কিন্তু ডোনা ক্রিস্টিনার কথা ভেবে তাঁর দু’চোখ ভরে উঠেছে জলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *