দ্য পিকউইক পেপার্স – ১৯

উনিশ

হতভাগ্য ভদ্রলোকটি ব্রিস্টল গেছেন, কারণ অত সকালে আর কোন কোচ ছিল না। ফলে, যেটা পেয়েছেন সেটাতেই চেপে বসেছেন। দ্য বুশে রূম ভাড়া নিয়ে সকালটা শহর বেড়িয়ে কাটালেন। ডক, শিপিং, ক্যাথেড্রাল সব দেখে-টেখে শেষ পর্যন্ত অনুসন্ধানের জন্যে একটা দোকানে গেলেন।

নয়া রং চড়ানো দোকানটা কোন ডাক্তারের হবে বলে ধারণা হলো তাঁর। তাকে থরে থরে ওষুধের শিশি সাজানো।

সবুজ চশমা পরা হাঁড়িমুখো এক যুবক, ইয়াবড় এক বই হাতে এগিয়ে এল।

‘বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত, স্যার,’ বললেন মি. উইঙ্কল, ‘আমি একটা ঠিকানা জানতে…’

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল গোমড়ামুখো যুবক। বইটা শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে কায়দা করে ফের ধরে ফেলল। কথা শোনো!’

মি. ‘উইঙ্কল এই অদ্ভুত আচরণে ঘাবড়ে গিয়ে দরজার দিকে সভয়ে পা বাড়ালেন। পাগল নাকি রে বাবা!

‘আরে, চিনতে পারেননি আমাকে?’ বলে উঠল ডাক্তার। চশমা নামাতে বেরিয়ে পড়ল রবার্ট সয়্যার। ‘আসুন, আসুন,’ আমন্ত্রণ জানাল গাইজ হাসপাতালের রবার্ট সয়্যার ওরফে বব সয়্যার। পেছনের ঘরে মি. উইঙ্কলকে নিয়ে এল সে। অ্যারাবেলার ভাই বেঞ্জামিন অ্যালেন বসা এখানে, ম্যান্টলপিসে ফুটো করছে একটা গনগনে পোকার দিয়ে।

‘বাহ,’ বললেন মি. উইঙ্কল, ‘খাসা জায়গা বেছেছেন তো।’

‘এই আছে একরকম,’ বলল বব সয়্যার। ‘পাস করার পর বন্ধুরা টাকা-পয়সা দিল, পসার জমানোর জন্যে। তো কালো সুট আর চশমা পরে মূড নিয়ে বসে আছি আরকি।’

‘ব্যবসা তো বেশ ভালই ফেঁদেছেন,’ সপ্রশংস সুরে বললেন মি.

‘কোথায় আর-‘

‘কেন, অত যে শিশি-বোতল দেখলাম!’

‘সব ভুয়া,’ বলল বব সয়্যার। ‘ভিতরে খালি পানি।’

ব্র্যান্ডি পরিবেশন করল বেঞ্জামিন, গল্প-গুজব চলছে এসময় ধূসর ইউনিফর্ম

পরা এক ছোকরা এসে হাজির।

‘টম,’ বলল বব, ‘এসো। ওষুধ দিয়ে এসেছ তো ঠিক ঠাক মত?’

‘জ্বী, স্যার।’

‘বড় বাড়ির বাচ্চাটার জন্যে পাউডার? আর বুড়ো ভদ্রলোকের জন্যে বড়ি?’

‘জ্বী, স্যার।’

‘তবে যে বললেন সব ভুয়া,’ বললেন মি. উইঙ্কল, ‘কিছু ওষুধ তো ঠিকই বিক্রি হচ্ছে।

‘আরে ভাই, টম আসলে সব উল্টোপাল্টা বাড়িতে ওষুধ দিয়ে আসে,’ সামনে ঝুঁকে ষড়যন্ত্রের সুরে বলল বব। ‘বেল টিপে চাকরের হাতে পুরিয়া ধরিয়ে দেয়। সে গিয়ে ওটা দেয় মালিকের হাতে, ভদ্রলোক লেবেলে পড়েন: ‘বড়ি ও পাউডার রাতে নিতে হবে। ডাক্তার সয়্যা: প্রেসক্রিপশন সযত্নে তৈরিকৃত।’ ব্যস, আর পায় কে, বাড়ির সবাই জেনে যায় আমার নাম। পরদিন আবার টম যায় ও বাসায়; ‘মস্ত ভুল হয়ে গেছে- আসলে এত জায়গায় ওষুধ পাঠাতে হয় যে মনে রাখা দায়- মি. সয়্যার ক্ষমা চেয়েছেন।’ এরপর আর বিখ্যাত হওয়া ঠেকায় কে? ডাক্তারির এই হচ্ছে মোক্ষম চাল, বুঝলেন কিনা। এই করেই তো পসার জমায় লোকে…’

‘বেড়ে আইডিয়া ফেঁদেছেন তো,’ বললেন মি. উইঙ্কল।

‘ওহ, বেন আর আমি এমনি আরও এক ডজন বুদ্ধি বের করে ফেলেছি,’ খুশিয়াল কণ্ঠে বলল বব। ‘এক লোককে হপ্তায় আঠারো পেন্স করে দিই, প্রতি রাতে দশ মিনিট করে আমার বেল বাজায়। আমার ছেলেটা গির্জায় গিয়ে সব সময় ডেকে আনে আমাকে, যখন আরকি সবাই এমনি এমনি বসে থাকে তখন। লোকে মনে করে কেউ নিশ্চয়ই গুরুতর অসুস্থ তাই ডাক পড়েছে আমার। কি, কেমন বুঝছেন?’

ওষুধের আরও কিছু রহস্য ব্যাখ্যা করে হাসাহাসি করতে লাগল দুই তরুণ ডাক্তার। বব সয়্যার এরপর কিছুক্ষণের জন্যে দোকানে গেল।

কথা প্রসঙ্গে মি. উইঙ্কলকে জানাল বেন, তার বোন অ্যারাবেলাকে সে ববের সঙ্গে বিয়ে দিতে চায়, দু’জনের বয়সের ব্যবধান পাঁচ বছর এবং দু’জনেরই জন্ম আগস্টে। কিন্তু কেন জানি অ্যারাবেলা খালি গাঁইগুঁই করে,’ বলল বেন, ‘বোধহয় আর কাউকে পছন্দ ওর।’

‘কে সে কোন ধারণা আছে আপনার?’ ভালমানুষের মত মুখ করে প্রশ্ন করলেন মি. উইঙ্কল।

বেন অ্যালেন পোকারটা শূন্যে দুলিয়ে, একটি কাল্পনিক মাথা লক্ষ্য করে হিংস্র আক্রোশে আঘাত হানল। ‘কে জানে কে,’ বলল ও। ‘বাগে পেলে ব্যাটাকে মজা টের পাইয়ে দিতাম।’

ঢোক গিললেন মি. উইঙ্কল, আলাপচারিতার মাধ্যমে জেনে নিলেন অ্যারাবেলা ব্রিস্টলের কাছেপিঠেই বাস করছে। কিন্তু জায়গাটা ঠিক কোথায় জানা হলো না তাঁর।

‘বাবা-মা নেই যখন দায়িত্ব তো আমারই।’ বলল বেন, ‘এখানে এক ফুফুর কাছে রেখেছি ওকে, মাথার ভূতটা যদি নামে। তাও যদি দেখি কাজ হচ্ছে না তখন বিদেশে নিয়ে যাব, দেখব ববকে বিয়ে না করে কই যায় ও।’

বব সয়্যার একটা মাংসের পাই নিয়ে এল এসময় এবং সন্ধে পেরিয়ে গেল আড্ডাবাজিতে।

দ্য বুশে ফিরে মি. উইঙ্কল এক দীর্ঘদেহী ভা লোককে আগুনের সামনে, তাঁর দিকে পেছন ফিরে বসে থাকতে দেখলেন। ভদ্রলোক চেয়ারটা একটু সরিয়ে বসতে তাঁর মুখ দেখা গেল। কালান্তক মি. ডাউলার!

তৎক্ষণাৎ বেল বাজানোর আন্তরিক তাগিদ অনুভব করলেন মি. উইঙ্কল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ওটা মি. ডাউলারের মাথার কাছে। ওটার উদ্দেশে এক কদম এগিয়ে থমকে গেলেন তিনি। ওদিকে মি. ডাউলারও সেই ফাঁকে চেয়ার ছেড়ে উঠে ত্বরিত পিছু হটে গেছেন।

‘মি. উইঙ্কল, স্যার! শান্ত হোন, প্লীজ! মাথা ঠাণ্ডা করুন! আমি রক্তারক্তি বড্ড ভয় পাই, স্যার!’ বলে উঠলেন সাবেক সৈনিক মি. ডাউলার। ‘বসুন, প্লীজ! আগে আমার কথা শুনুন!

‘স্যার,’ বললেন মি. উইঙ্কল, আপাদমস্তক শিউরে উঠলেন। বসার আগে আপনার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাই। কাল রাতে আপনি আমাকে খুন করার হুমকি দিচ্ছিলেন, স্যার, ভয়ঙ্কর হুমকি।’

‘দিচ্ছিলাম,’ মুখ মি. উইঙ্কলের মতই ফ্যাকাসে ভদ্রলোকের। ‘পরিস্থিতি তখন সন্দেহজনক ছিল। কিন্তু পরে সবই জেনেছি আমি। আপনার সাহসিকতাকে শ্রদ্ধা করি আমি। আপনার মনে কোন পাপ নেই। আসুন, হাত মেলান, স্যার।’

ইতস্তত করতে লাগলেন মি. উইঙ্কল। ‘সত্যি, স্যার, আমি…’

‘বুঝতে পেরেছি,’ বাধা দিলেন মি. ডাউলার। ‘আপনি এখনও রেগে আছেন। স্বাভাবিক। আমি হলেও তাই থাকতাম। আমি ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দিন, স্যার। আসুন, আজ থেকে আমরা আবার বন্ধু হয়ে যাই।’ প্রায় জোর করে উইঙ্কলের হাত টেনে নিয়ে রাম ঝাঁকুনি দিতে লাগলেন ডাউলার, বলতে লাগলেন তাঁর মতন অসীমসাহসী পুরুষ তিনি নাকি আর দেখেননি ইত্যাদি ইত্যাদি।

‘এখন বলুন দেখি,’ বললেন ডাউলার। ‘আরে বসুন না। সব খুলে বলুন। আমাকে খুঁজে পেলেন কিভাবে?’

‘ভাগ্যক্রমে বলতে পারেন,’ জানালেন মি. উইঙ্কল।

‘সকালে ঘুম থেকে উঠে,’ বললেন ডাউলার, ‘গতকালের হুমকির কথা একদম ভুলে গেছি। এমন হাসি পেল মনে পড়তে। নিচে নেমে দেখি আপনি নেই, পিকউইক বেজার মুখে বসে আছেন। তিনি চান না খুনোখুনি হোক। সবই বুঝতে পারলাম। আপনি অপমানিত বোধ করেছেন, হয়তো কোন বন্ধু-বান্ধবের কাছে গেছেন। কে জানে হয়তো পিস্তল-টিস্তল নিয়ে আসবেন।’

খোসা হচ্ছে বিষয়টা ধীরে ধীরে। মি. উইঙ্কল চেহারায় গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলেন।

‘আপনার জন্যে একটা চিরকুট রেখে এসেছি,’ বলে যাচ্ছেন ডাউলার। ‘বলেছি আমি খুবই দুঃখিত। ব্যবসার জরুরী কাজে ব্রিস্টল আসতে হলো। এখন দেখছি আপনি পিছু ধাওয়া করে এসেছেন। কিন্তু, ভাই, আমি তো মাফ চেয়েইছি আর অযথা এসব নিয়ে মন কষাকষির কি দরকার? আমার এখানকার কাজ হয়ে গেছে। কাল চলে যাব।

ডাউলারের বক্তব্য শেষ হতে গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হয়ে উঠল মি. উইঙ্কলের অভিব্যক্তি। কথোপকথন শুরুর সময়কার রহস্যটা ভেঙে গেছে। মি. ডাউলার মুখে যতই ফটফট করুন না কেন, ভদ্রলোক তাঁর মতই ভীরু ও কাপুরুষ।

মি. উইঙ্কল এমন কাতর অনুরোধ ফেলতে না পেরে শেষ অবধি ক্ষমা করলেন। তাঁর ঔদার্যে ও মহত্ত্বে মুগ্ধ হয়ে গেলেন মি. ডাউলার। দু’জনে যখন ঘুমোতে গেলেন, ততক্ষণে চিরন্তন বন্ধুত্বের অসংখ্য প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়ে গেছে দু’তরফ থেকেই।

সাড়ে বারোটা নাগাদ দরজায় সশব্দ করাঘাতে ঘুম ভেঙে গেল মি. উইঙ্কলের। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে জানতে চাইলেন, ‘কে?’

‘এক ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান, স্যার, বলল মেইড, ‘খুব নাকি জরুরী।’

মি. উইঙ্কল দরজা খুলতে স্যাম ওয়েলার প্রবেশ করল ঘরে, ভেতর থেকে দরজায় ফের তালা মেরে চাবিটা আলগোছে ছেড়ে দিল পকেটে।

‘এর মানে কি?’ ক্রুদ্ধ মি. উইঙ্কলের প্রশ্ন।

‘এর মানে কি? হাসালেন দেখছি।’ বলল স্যাম।

‘তালা খুলে, এখুনি বেরিয়ে যাও বলছি আমার ঘর থেকে।’

‘আপনি যখন বেরোবেন ঠিক তখনই আমিও বেরিয়ে যাব, স্যার।’ বসে পড়ে বলল স্যাম। ‘আপনাকে পিঠে করে নিয়ে যেতে হলে অবশ্য আপনার একটুখানি আগে ঘর ছাড়ব আমি। কিন্তু আশা করি তার দরকার পড়বে না। আপনি কেমন তরো বন্ধু, স্যার, আমার মনিবকে এভাবে মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে এসেছেন? জানেনই তো, নীতির প্রশ্নে অটল আমার মহান মনিব এমনিতেই নানা ঝামেলায় জড়িয়ে আছেন, নীতির জন্যে জেলে পর্যন্ত তিনি যেতে রাজি?’

‘শোনো, শোনো,’ বললেন মি. উইঙ্কল, হাত বাড়িয়ে দিলেন। ‘আমার বন্ধুর প্রতি তোমার আনুগত্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাঁর মনোকষ্ট বাড়ানোয় আমি খুবই দুঃখিত।

‘ঠিক আছে,’ বলল স্যাম। ‘আপনাকে এখানে পেয়ে খুব ভাল হলো! আসলে সাধ্য থাকলে কাউকে আমার মনিবের মনে কষ্ট দিতে দিতাম না, এই আরকি।’

‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই,’ বলে উঠলেন মি. উইঙ্কল। ‘এখন শুতে যাও, স্যাম, সকালে এ ব্যাপারে কথা বলব, কেমন?’

‘দুঃখিত, স্যার,’ জানাল স্যাম, ‘শুতে যাওয়া যাবে না।’

‘কেন?’ মি. উইঙ্কল তাজ্জব।

মাথা নাড়ল স্যাম। ‘এ ঘর ছেড়ে কোথাও আমার যাওয়া চলবে না।’

‘কি বোকার মত কথা বলছ, স্যাম,’ খেপে উঠলেন মি. উইঙ্কল। ‘আমার এখানে দু’তিনদিন থাকতে হবে; বেশিও হতে পারে, তোমাকেও থাকতে হবে, একটা মেয়েকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবে তুমি- মিস অ্যালেনকে, স্যাম, মনে আছে নিশ্চয়ই- ব্রিস্টল ছাড়ার আগে ওর সঙ্গে যে করে হোক দেখা করতেই হবে আমাকে।’

প্রথমটায় প্রতিটি প্রস্তাবের বিপক্ষে মাথা নাড়ল স্যাম, মুখে বলে গেল, ‘সম্ভব নয়।’ কিন্তু বিস্তর যুক্তিতর্কের পর সে দুর্বল হয়ে এল। শেষমেশ দু’জনের মধ্যে একটা চুক্তি হলো, এর প্রধান শর্তগুলো হচ্ছে:-

– স্যাম মি. উইঙ্কলকে তাঁর ঘরে পূর্ণ স্বাধীনতা দান করে, শুতে যাবে নিজের কামরায়, তবে এই শর্তে, স্যাম বাইরে থেকে দরজায় তালা মেরে চাবি নিয়ে যেতে পারবে।

– পরদিন সকালে মি. পিকউইককে একটি চিঠি লেখা হবে; ব্রিস্টলে স্যাম ও মি. উইঙ্কলের অবস্থানের সপক্ষে সম্মতি প্রার্থনা করে।

– মি. উইঙ্কলের প্রস্তাব মান্য করা হবে একমাত্র মি. পিকউইক যদি ব্রিস্টলে তাদের অবস্থানের পক্ষে রায় দেন; নচেৎ তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাথে যত শীঘ্রি সম্ভব ফিরে যেতে হবে।

চুক্তি হলে পর, দরজায় তালা মেরে চলে গেল স্যাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *