দ্য পিকউইক পেপার্স – ১৭

সতেরো

চোদ্দই ফেব্রুয়ারির সকাল।

‘নটা দশ,’ বললেন মি. পার্কার। ‘এখন যাওয়া দরকার।

মি. পিকউইক কোচের জন্যে ঘণ্টি বাজালেন। একটু পরে চার বন্ধু ও মি. পার্কার রওনা হলেন গিল্ডহলের* উদ্দেশে। স্যাম ও মি. পার্কারের কেরানী ক্যাবে চড়ে অনুসরণ করল। আদালতে পৌঁছে, মি. পার্কার মি. পিকউইককে সিনিয়র ব্যারিস্টারের ডেস্কের নিচে, একটা নিচু ডেস্কের দিকে নিয়ে গেলেন।

মি. পিকউইক তিরিক্ষে মেজাজে ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে আদালতের ওপর কঠোর দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন। দর্শকদের সারিতে লোকের অভাব নেই, পরচুলা পরে ব্যারিস্টারদের আসনও দখল করে রেখেছে বড়সড় একটা দল। মি. পিকউইক তাজ্জব হয়ে দেখলেন তাঁরা দায়সারা ভঙ্গিতে আজকের সকালের খবরগুলো নিয়ে আলোচনা করছেন— একটা বিচার যে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সেদিকে যেন কোন খেয়ালই নেই।

.মি. সার্জেন্ট স্নাবিন, মি. পিকউইকের সিনিয়র ব্যারিস্টার উপস্থিত হলেন। আরও জনা তিনেক সার্জেন্ট প্রবেশ করলেন, এঁদের মধ্যে একজন বেজায় মোটা লালমুখোও আছেন। ভদ্রলোক মি. স্নাবিনের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে কুশল জানতে চাইলেন।

‘ইনি কে?’ জিজ্ঞেস করলেন মি. পিকউইক

‘মি. সার্জেন্ট বাজফাজ,’ বললেন পার্কার। ‘আমাদের বিরোধী পক্ষের। উনিই ও তরফে নেতৃত্ব দেবেন।’

মি. পিকউইক লোকটির ঠাণ্ডা মাথার শয়তানি লক্ষ করে খেপে উঠলেন; কত্তবড় সাহস ব্যাটার, বিপক্ষের মি. স্নাবিনকে আবার জিজ্ঞেস করে কেমন আছেন! কিন্তু তিনি মুখ খুলতে পারার আগেই সব ক’জন ব্যারিস্টার উঠে দাঁড়ালেন, এবং উচ্চকিত কণ্ঠে ‘সাইলেন্স!’ শব্দটি উচ্চারিত হলো। মুখ ফেরাতে দেখতে পেলেন মি. পিকউইক বিচারক প্রবেশ করেছেন।

[গিল্ডহল: লন্ডনের টাউন হল- সে সময় আদালত হিসেবে ব্যবহৃত হত।]

মি. জাস্টিস স্টেয়ারলেই অসম্ভব বেঁটে ও মোটা একজন ভদ্রলোক; তাঁকে দেখে মনে হয় মুখ আর ওয়েস্টকোট সর্বস্ব। গুটগুট করে টেবিলে গিয়ে বসলেন তিনি। পা দুটো টেবিলের নিচে চালান করে ছোট্ট হ্যাটটা রাখলেন টেবিলের ওপরে। পরচুলা পরা, কুতকুতে চোখবিশিষ্ট বিচারপতিকে কিম্ভূত ভাঁড়ের মত দেখাল মি. পিকউইকের চোখে।

ভদ্রলোক আসন গ্রহণ করলে চারদিক থেকে বাজখাঁই কণ্ঠে ‘সাইলেন্স!’ রব উঠল।

চেঁচামেচির মধ্যে সামান্য চাঞ্চল্য সৃষ্টি করল একটি দৃশ্য। মিসেস ক্লাপিনস মিসেস বারডেলকে ধরে ধরে মি. পিকউইকের উল্টোদিকের একটি আসনে বসালেন। এরপর উদয় হলেন মিসেস স্যান্ডার্স, মাস্টার বারডেলকে নিয়ে। ছেলেকে দেখে উন্মাদিনীর মত চুমো খেতে লাগল মিসেস বারডেল। তারপর মহিলা সহসা হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মত হয়ে উঠল, কোথায় আছে বুঝতে পারছে না। তার দশা দেখে বান্ধবীরা মুখ ফিরিয়ে ফোঁপাতে লাগলেন। ডডসন ও ফগ অতিকষ্টে বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করল ভদ্রমহিলাকে। সার্জেন্ট বাজফাজ রুমালে চোখ রগড়ে আর্তমানবের দৃষ্টিতে জুরিদের দিকে চাইলেন, ওদিকে খুদে বিচারপতি এই করুণ দৃশ্য দেখে প্রায় কাঁদো কাঁদো।

‘ভাল চালাকি খাটিয়েছে,’ ফিসফিসিয়ে আসামীকে বললেন মি. পার্কার। ‘হাড় বজ্জাত ওই ডডসন আর ফগ। সর্বক্ষণ শুধু শয়তানি বুদ্ধি খেলছে।’

মিসেস বারডেলকে খানিকটা সামলে উঠতে দেখা গেল এসময়। ইতোমধ্যে মিসেস ক্লাপিনস মাস্টার বারডেলকে মায়ের সামনে, মেঝেতে বসিয়ে দিয়েছেন, বিচারপতি ও জুরি উভয়ের সহানুভূতি কাড়া সহজ হবে এখান থেকে।

‘বারডেল ও পিকউইক,’ আদালতের একজন অফিসার চিৎকার ছাড়ল। মি. সার্জেন্ট বাজফাজ ও মি. সার্জেন্ট স্নাবিন যাঁর যাঁর মক্কেলের তরফ থেকে দাঁড়ালেন। বাদী পক্ষের কেস উপস্থাপন করলেন সার্জেন্ট বাজফাজ। ভদ্রলোক শুরু করলেন এই বলে, তাঁর এত বছরের পেশাদারী জীবনে নাকি এরচাইতে আবেগময় ও দায়িত্বপূর্ণ কেস তিনি হাতে নেননি। যদি মনে করতেন তাঁর হতভাগী মক্কেল জুরি-বক্সে বসা বারো জন সুবিবেচক ও প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সহানুভূতি আদায় করতে পারবেন না, তবে নাকি এই কেস তিনি নিতেন না।

এরপর তিনি কেসের খুঁটিনাটি তুলে ধরলেন। ‘বাদিনী, ভদ্রমহোদয়গণ,’ বিষণ্ন সুর ফুটিয়ে তুললেন কণ্ঠে সার্জেন্ট বাজফাজ, ‘একজন বিধবা মহিলা; হ্যাঁ, ভদ্রমহোদয়গণ, একজন অসহায় বিধবা, মরহুম মি. বারডেল, রাজকীয় কর আদায়কারী হিসেবে তাঁর দীর্ঘদিনের দায়িত্ব সম্মানের সঙ্গে পালন করে, নীরবে পা রেখেছেন এমন এক শান্তির ভুবনে কাস্টমস-হাউজ যে শান্তি তাঁকে কোনদিন দিতে পারত না।’

মি. বারডেলের মৃত্যু কাহিনী বয়ান করতে গিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠল সার্জেন্টের গলা। পাবলিক হাউজে এক মাতাল, মাথায় বিয়ারের মগ দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে ভদ্রলোককে।

‘মৃত্যুর কিছু আগে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়ে যান তিনি। এই ছেলেটিকে বুকে আঁকড়ে ধরে গসওয়েল স্ট্রীটের বাড়িটিতে শান্তি খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করেন তাঁর বিধবা স্ত্রী। সামনের জানালায় বেচারী একটা কার্ডে লিখে দেন: ‘অবিবাহিত ভদ্রলোকদের জন্যে সুসজ্জিত কামরা ভাড়া দেওয়া হইবে। অনুগ্রহপূর্বক ভিতরে যোগাযোগ করুন।

‘এটা তিন বছর আগের কথা। বেশিদিন কি ছিল কার্ডটা? না। মাত্র তিনদিনের মধ্যেই একজন তথাকথিত ভদ্রলোক, যাকে দেখে ভেতরের দানবটিকে চেনার কোন উপায় নেই, ঘর ভাড়া নিতে এল। এবং পরদিন সে প্রবেশ করল ভাড়া বাড়িতে। এই তথাকথিত ভদ্রলোক আর কেউ না- এই সেই বেরহম পিকউইক- আসামী পিকউইক!’

সার্জেন্ট বাজফাজ দম নিতে থামলেন। তাঁর নীরবতায় সজাগ হলেন বিচারপতি স্টেয়ারলেই, তৎক্ষণাৎ কালিবিহীন একটা কলম দিয়ে কি সব যেন টুকে নিলেন।

‘আমি পিকউইক সম্পর্কে কিছু বলতে চাই,’ ফের শুরু করলেন সার্জেন্ট বাজফাজ। ‘পিকউইক যতদিন মিসেস বারডেলের বাসায় ছিল ভদ্রমহিলা ততদিন মনপ্রাণ দিয়ে তার দেখাশোনা করেছেন; রান্না করে খাইয়েছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে পিকউইক তাঁর ছেলেটিকে এক পেনি এমনকি ছয় পেন্স পর্যন্ত উপহার দিয়েছে। আমি প্রমাণ করতে পারব একবার ছেলেটির মাথা চাপড়ে সে বলেওছে, ‘একটা নতুন বাপ পেলে কেমন লাগবে তোমার, খোকা?’ গ্রামাঞ্চল থেকে একবার বেড়িয়ে এসে আবছাভাবে সে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছে মিসেস বারডেলকে। তার তিন ঘনিষ্ঠ বন্ধুও নিজের চোখে দেখেছে, সে বাদিনীকে জড়িয়ে ধরে আদর করছে, সান্ত্বনা দিচ্ছে।’

কেসের এ পর্যায়ে এসে জুরিরা স্পষ্টতই আন্দোলিত হলেন। বলে যাচ্ছেন মি. বাজফাজ, এবার দু’টুকরো কাগজ বের করলেন তিনি।

‘এই দেখুন, ভদ্রমহোদয়গণ,’ বললেন মি. বাজফাজ, ‘এই চিঠি দুটো চালাচালি হয়েছে বাদিনী আর বিবাদীর মধ্যে। হাতের লেখা বিবাদীর, এবং এতে পরিষ্কার ফুটে উঠেছে তার স্বভাব-চরিত্র। খুবই ছলনাপূর্ণ, গোপন, ধূর্ত চিঠি; কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তাতে চিঠির ভাষা উপলব্ধি করতে বেগ পেতে হয় না। শুনুন আপনারা:-

গ্যারাওয়েজ
বারোটা

প্রিয় মিসেস বি,

চপ আর টমেটো সস।

আপনার,
পিকউইক।

‘ভদ্রমহোদয়গণ, এর কি মানে? চপ আর টমেটো সস! তার ওপর আবার লিখেছে আপনার, পিকউইক! চপ! হায় খোদা! আর টমেটো সস! আপনারাই বলুন, একজন সরলমনা অসহায় ভদ্রমহিলার জীবন নিয়ে এরকম ছিনিমিনি খেলা উচিত? পরের চিঠিটায় দিন-তারিখ-সময় কিছুই নেই, এটা আরও সন্দেহজনক।

প্রিয় মিসেস বি,

আগামীকাল পর্যন্ত বাসায় থাকছি না আমি। স্নো* কোচ। ওয়ার্মিং প্যান* নিয়ে ব্যস্ত হবেন না।

[*স্লো কোচ: বিভিন্ন শহরে যাতায়াতের জন্যে এক্সপ্রেস ও স্লো কোচের ব্যবস্থা ছিল সে যুগে। ধীর গতির কাউকে বোঝাতে ইংরেজি ভাষায় এখনও স্লো কোচ বাগধারাটি ব্যবহৃত হয়।

*ওয়ার্মিং প্যান;-ধাতব পাত্রে জ্বলন্ত কয়লা ভর্তি করে, শোবার আগে উষ্ণ করার জন্যে এটি বিছানায় রাখা হয়।]

‘ওয়ার্মিং প্যান! ভদ্রমহোদয়গণ, ওয়ার্মিং প্যান নিয়ে কোন্ ধরনের লোক মাথা ঘামায় আপনারাই বলুন? মিসেস বারডেলকে আকুলভাবে কেন অনুরোধ করা হয়েছে তিনি যাতে ওয়ার্মিং প্যান নিয়ে চিন্তিত না হন, যদি না এটা গোপন আগুনের, অর্থাৎ কোন প্রেমময় প্রতিশ্রুতি বা প্রেমের ভাষা না হয়ে থাকে? আর লক্ষ করুন, বলছে পো কোচ। কেন? হয়তো এর দ্বারা নিজেকে বোঝাতে চেয়েছে সে, গোটা ব্যাপারটায় সে নিশ্চয়ই ধীরে চলো নীতি নিয়েছিল, কিন্তু এখন অস্বাভাবিক ক্ষিপ্র হয়ে উঠতে বাধ্য হবে শুধু যদি আপনারা একটু সাহায্য করেন, ভদ্রমহোদয়গণ!

‘আমি আর বেশি কিছু বলতে চাই না। আমার মক্কেলের সব আশা-ভরসা শেষ হয়ে গেছে। কার্ডটা আর তাঁর জানালায় শোভা পায় না- এবং কোন ভাড়াটেও আর নেই। অবিবাহিত ভদ্রলোকেরা আশপাশ দিয়ে আসে-যায় কিন্তু ভেতরে খোঁজ নেয়ার জন্যে আর কোন আমন্ত্রণ নেই। পুরো বাড়িটা গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। এমনকি ছোট বাচ্চাটার গলাও আর শোনা যায় না। মাকে কাঁদতে দেখলে কোন্ বাচ্চার মনে শান্তি থাকে আপনারাই বলুন? কিন্তু পিকউইক, ভদ্রমহোদয়গণ, পিকউইক, সেই নির্দয় বিশ্বাসঘাতক কিন্তু বহাল তবিয়তে আছে- মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, এতটুকু লজ্জা নেই, নিজের তৈরি ভগ্ন স্তূপের দিকে তাকাচ্ছে, একবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলার বালাই নেই। ক্ষতিপূরণ, ভদ্রমহোদয়গণ- বিপুল ক্ষতিপূরণ চাপানো দরকার তার ওপর- আমার মক্কেলের জন্যে সেটাই হতে পারে একমাত্র সান্ত্বনা। এই ক্ষতিপূরণের জন্যে তিনি আকুল ফরিয়াদ জানাচ্ছেন বিচক্ষণ, উদারহৃদয়, বিবেকবান, সহানুভূতিশীল, সহমর্মী জুরিদের কাছে।

অসাধারণ সমাপ্তিটি টেনে বসে পড়লেন মি. বাজফাজ এবং ঘুম ভাঙল মি. স্টেয়ারলেইয়ের।

‘নাথানিয়েল উইঙ্কল!’ ডাকলেন মি. স্কিমপিন, মি. বাজফাজের সহকারী।

‘হাজির!’ বলল একটি দুর্বল কণ্ঠ। সাক্ষ্য দিতে এলেন মি. উইঙ্কল। তাঁকে জেরা করলেন মি. স্কিমপিন।

‘আপনার নাম বলুন, স্যার।’ উৎকর্ণ হয়ে জবাবটা শুনলেন, যেন জুরিদের সতর্ক করতে চাইলেন, মি. উইঙ্কল শপথভঙ্গ করে ভুয়া নাম বলতে পারেন।

‘উইঙ্কল,’ জবাব দিলেন সাক্ষী।

‘খ্রীষ্টান নাম কি?’

‘নাথানিয়েল।’

‘ড্যানিয়েল- অন্য কোন নাম?’

‘নাথানিয়েল, স্যার- থুড়ি, মাই লর্ড।’

‘নাথানিয়েল ড্যানিয়েল নাকি ড্যানিয়েল নাথানিয়েল?’

‘শুধু নাথানিয়েল, ড্যানিয়েল নয়।

‘তাহলে তখন ড্যানিয়েল বললেন কেন আমাকে?’

‘ড্যানিয়েল বলিনি, মাই লর্ড।’

‘আলবত বলেছেন, স্যার,’ কটমট করে তাকিয়ে বললেন বিচারপতি। ‘তা নাহলে আমি ড্যানিয়েল লিখলাম কেন?’

তর্ক করা বৃথা।

‘মি. উইঙ্কলের স্মৃতিশক্তি তেমন ধারাল নয়, মাই লর্ড,’ বাধা দিলেন মি. স্কিমপিন, জুরির দিকে এক ঝলক চাইলেন। ‘তবে জেরা শেষ হওয়ার আগেই এক্ষেত্রে তাঁর প্রভূত উন্নতি ঘটবে বলে আশা করা যায়।’

‘আপনি সাবধান হয়ে যান, স্যার, কঠোর চোখে উইঙ্কলকে মেপে বললেন খুদে বিচারপতি।

বেচারা মি. উইঙ্কল মাথা নুইয়ে সহজ হবার চেষ্টা করলেন, এতে করে তাঁকে হাতেনাতে ধরা পড়া চোরের মতন দেখাল।

‘এখন মন দিয়ে আমার কথা শুনুন, মি. উইঙ্কল,’ বললেন মি. স্কিমপিন। ‘আপনি কি আসামী, মি. পিকউইকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু?’

‘মি. পিকউইককে আমি চিনি প্রায়…

‘এড়িয়ে যাবেন না, প্লীজ। আপনি কি মি. পিকউইকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, নাকি না?’

‘আমি বলতে চাইছিলাম…’

‘জবাব দেবেন কি না?’

‘হ্যাঁ, ঘনিষ্ঠ বন্ধু।’

‘এ কথাটা বলতে এতক্ষণ লাগল কেন? বাদিনীকেও চেনেন নিশ্চয়ই?’

‘চিনি না, তবে দেখেছি।’

‘ও, চেনেন না কিন্তু দেখেছেন। দয়া করে জুরিদের বলবেন কি এর দ্বারা কি বোঝাতে চাইছেন?’

‘মানে আমি ওঁকে ভাল করে চিনি না, কিন্তু গসওয়েল স্ট্রীটে মি. পিকউইকের বাসায় যখনই গেছি ওঁকে দেখেছি।’

‘ক’বার দেখেছেন?’

মি. উইঙ্কল জানালেন এটা বলা অসম্ভব।

‘বিশবারের বেশি?’ যুগিয়ে দিলেন স্কিমপিন

‘আরও অনেক বেশি হবে,’ এবার জবাব দিলেন মি. উইঙ্কল।

‘গত জুলাইয়ের কোন এক সকালে আসামীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন আপনি, মনে করতে পারেন?’

‘পারি।’

‘সঙ্গে কি টাপম্যান ও স্নডগ্রাস নামে আরও দু’জন বন্ধু ছিল?’

‘ছিল।’

‘তারা কি উপস্থিত আছে এখানে?’

‘আছে,’ বললেন মি. উইঙ্কল, কঠোর চোখে বন্ধুরা যেখানে বসে আছে সেদিকে চাইলেন।

‘দয়া করে বন্ধুদের চিন্তা বাদ দিয়ে আমার কথা মন দিয়ে শুনুন,’ বললেন মি. স্কিমপিন। ‘জুরিদের এবার বলুন দেখি, সেদিন সকালে ঘরে ঢুকে আসামীকে কি অবস্থায় দেখেছিলেন। বলে ফেলুন ঝটপট। আগে হোক কিংবা পরে বলতে যখন হবেই।’

‘বিবাদী বাদিনীকে জড়িয়ে ধরে ছিলেন, মহিলার কোমরে তাঁর হাত ছিল,’ স্বাভাবিক দ্বিধার সঙ্গে বললেন মি. উইঙ্কল, ‘এবং বাদিনী জ্ঞান হারিয়েছেন মনে হচ্ছিল।’

‘বিবাদী কিছু বলেছিল কিনা মনে পড়ে?’

‘মহিলাকে উনি শান্ত হতে বলছিলেন। বলছিলেন কেউ এসে পড়লে কেলেঙ্কারি হবে- এমনি ধরনের কিছু।

‘আমার আর মাত্র একটা প্রশ্ন জানার আছে, মি. উইঙ্কল। আপনি কি বলবেন, আসামী, মি. পিকউইক এ কথাগুলো বলেছিল কিনা, ‘মিসেস বারডেল, আপনি একজন চমৎকার মহিলা; যেটা একদিন ঘটতই সেটা নাহয় আজই ঘটল, বা এমনি ধরনের কিছু?’

‘আ-আমার তেমন কিছু মনে পড়ছে না,’ বললেন মি. উইঙ্কল, হতভম্ব হয়ে গেছেন উকিলের চাতুরি লক্ষ করে। ‘আমি সিঁড়িতে ছিলাম ঠিকমত শুনতে পাইনি। আমার ধারণা…

‘জুরিরা আপনার ধারণার কথা শুনতে চান না,’ হস্তক্ষেপ করলেন মি. স্কিমপিন। ‘সিঁড়িতে ছিলেন পরিষ্কার শুনতে পাননি। কিন্তু আপনি হলফ করে বলতে পারবেন আমি যে কথাগুলো বললাম সেগুলো আপনার বন্ধু বলেননি?’

‘তা পারব না,’ বললেন মি. উইঙ্কল। বিজয়ীর অভিব্যক্তি নিয়ে বসে পড়লেন স্কিমপিন।

প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করা হলো মি. টাপম্যান ও মি. স্নডগ্রাসকেও।

মিসেস স্যান্ডার্সের ডাক পড়ল এরপর। জানা গেল, তিনি নাকি বলে বেড়িয়েছেন এবং মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, মি. পিকউইক তাঁর বান্ধবী মিসেস বারডেলকে বিয়ে করবেন। জুলাই মাসে মিসেস বারডেল মূর্ছা যাবার পর বাদান শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার ভেবেছিলেন তিনি ও পড়শীরা। তাঁর ধারণা মি. পিকউইক বিয়ের তারিখ ঠিক করতে বলায় মিসেস বারডেল জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কারণ মি. স্যান্ডার্স তাঁকে ও কথা বলায় তিনি নিজেও মূর্ছা গেছিলেন কিনা, এবং তাঁর ধারণা প্রতিটি খাঁটি ভদ্রমহিলা একই কর্ম করবেন। তাঁর পর এলেন মিসেস ক্লাপিনস।

তিনি বিদায় নিলে সার্জেন্ট বাজফাজ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘স্যাম ওয়েলারকে ডাকা হোক।’

ডাকার প্রশ্ন অবান্তর, কারণ নামোচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাক্ষীর কাঠগড়ায় হাজির স্যাম ওয়েলার।

‘কি নাম আপনার?’ বিচারপতির প্রশ্ন।

‘স্যাম ওয়েলার, মাই লর্ড।’

‘বানানটা কি ‘ডব্লিউ’ দিয়ে নাকি ‘ভি’ দিয়ে লেখেন আপনি?’

‘যিনি লিখছেন ব্যাপারটা তাঁর উপর নির্ভর করে, মাই লর্ড,’ জানাল স্যাম। ‘জীবনে এক-দু’বারের বেশি অবশ্য লিখতে হয়নি; তবে লিখেছি যখন ‘ভি’ দিয়ে লিখেছি।’

‘এখন বলুন দেখি, মি. ওয়েলার,’ বললেন সার্জেন্ট বাজফাজ। ‘আপনি মি. পিকউইকের সহকারী কিনা।

‘হ্যাঁ, আমি ভদ্রলোকের কাজ করছি এবং করে খুব আনন্দ পাচ্ছি।’

‘যেদিন আপনাকে বহাল করা হলো সেদিনের কোন অস্বাভাবিক ঘটনার কথা কি মনে পড়ে আপনার?’

‘পড়ে, স্যার।’

‘জুরিদের দয়া করে বলুন তবে।’

‘সেদিন সকালেই নতুন ড্রেস পেয়েছিলাম,’ বলল স্যাম। ‘ব্যাপারটা ভীষণ অদ্ভুত লেগেছিল আমার।’

হো হো করে হেসে উঠল দর্শকরা। খুদে বিচারপতি রেগে কাঁই হয়ে ধমক লাগালেন, ‘ব্যবহার ঠিক মতন করবেন, স্যার।’

‘মি. পিকউইকও তখন ঠিক এ কথাগুলোই বলেছিলেন, মাই লর্ড, প্রত্যুত্তর দিল স্যাম। ‘সুটটা দামী কিনা, তাঁর কথা মত খুব যত্ন করে পরেছি- খুবই প্রিয় জিনিস আমার, মাই লর্ড।’

‘আপনি কি বলতে চান, মি. ওয়েলার,’ বললেন সার্জেন্ট বাজফাজ, বাদিনীর ভিরমি খাওয়ার বিষয়ে আপনি কিছুই জানেন না?’

‘কিছুই জানি না, স্যার,’ জানাল স্যাম। ‘আমি বারান্দায় ছিলাম। ডাক যখন পড়ল তখন সব মজা খতম।’

‘আচ্ছা, শুনুন, মি. ওয়েলার,’ বললেন মি. বাজফাজ, ‘বলছেন বারান্দায় ছিলেন অথচ কি ঘটে গেল তার কিছুই জানেন না, কিছুই দেখেননি। আপনার চোখ আছে, না কি?’

‘আছে, স্যার। আর সেটাই তো যত নষ্টের গোড়া। চোখ না হয়ে শক্তিশালী ম্যাগনিফাইং মাইক্রোস্কোপ হলে হয়তো কাঠের দরজা ভেদ করে দেখতে

পেতাম। কিন্তু চামড়ার চোখ বলে দৃষ্টিশক্তি কত দূর্বল আমার।’

আদালতসুদ্ধ লোক হেসে ফেলল এ কথায়, স্মিত হাসি বিচারপতির ঠোঁটের কোণেও; বোকা বনে গেছেন সার্জেন্ট বাজফাজ। ডডসন ও ফগের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলোচনা সেরে স্যামের দিকে ফিরলেন তিনি, অতিকষ্টে ক্রোধ সংবরণ করছেন।

‘আরেকটা প্রশ্ন, মি. ওয়েলার। গত নভেম্বরের কোন এক রাতে মিসেস বারডেলের বাসায় গিয়েছিলেন আপনি?’

‘গেছিলাম, স্যার।’

‘বাহ, চমৎকার,’ খুশি হয়ে উঠলেন সার্জেন্ট বাজফাজ। ‘এই কেসটা সম্পর্কে কিছু কথা নিশ্চয়ই ছিল আপনার?’

‘গেছিলাম আসলে ভাড়া দিতে; তবে হ্যাঁ, এ ব্যাপারে কিছু কথাও হয়েছিল বটে।’

‘কি কথা হয়েছিল একটু বলবেন কি?’

‘কেন বলব না, স্যার,’ জানাল স্যাম। ‘যে মহিলা দু’জনকে জেরা করা হলো তাঁরা মি. ডডসন ও মি. ফগের খুব প্রশংসা করছিলেন।’

‘তাঁদের সম্পর্কে নিশ্চয়ই উচ্চ ধারণা পোষণ করেছিলেন তাঁরা?’ শুধালেন ব্যগ্র মি. বাজফাজ।

‘হ্যাঁ,’ বলল স্যাম। ‘ওঁরা বলেছিলেন, মহান উকিলরা নাকি কথা দিয়েছেন, মি. পিকউইকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে না পারলে নাকি কোন সম্মানী নেবেন না।’

অভাবিত জবাবটা শুনে ফের হাসির হুল্লোড় উঠল। ডডসন ও ফগ চুপসে গেল লজ্জায়, · মি. বাজফাজের উদ্দেশে ঝুঁকে পড়ে কানে কানে কি যেন বলল তারা।

‘ঠিকই বলেছেন,’ চড়া গলায় বললেন সার্জেন্ট বাজফাজ। ‘এই লোকের কাছ থেকে, মাই লর্ড, নতুন কিছুই জানার নেই। আমি একে প্রশ্ন করে আদালতকে আর বিরক্ত করতে চাই না।’

ডডসন ও ফগের কেস যতখানি সম্ভব কাঁচিয়ে দিয়ে বক্স ত্যাগ করল স্যাম।

আর কোন সাক্ষী নেই। এবার আসামী পক্ষের মি. স্নাবিন জুরিদের কাছে মি. পিকউইকের দীর্ঘ গুণগান করলেন। বোঝাতে চাইলেন বিবাদীর চরিত্র ফুলের মতন পবিত্র। প্রমাণ করতে চাইলেন, মি. পিকউইকের লেখা চিঠি দুটো শুধুমাত্র ডিনার ও গ্রাম থেকে ট্যুর শেষে ফিরে আসা সংক্রান্ত।

বিচারপতি স্টেয়ারলেই জুরিদের সঙ্গে কথা বললেন; জুরিরা নিজেদের প্রাইভেট রূমে গেলেন বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে এবং বিচারপতি তাঁর প্রাইভেট রূমে চলে গেলেন মাটনচপ ও শেরি গলাধঃকরণ করতে।

উদ্বেগপূর্ণ সিকি ঘণ্টা কেটে গেল। ফিরে এলেন জুরিরা। ধরে আনা হলো বিচারপতিকে।

‘ভদ্রমহোদয়গণ, রায়ের ব্যাপারে আপনারা একমত?’

‘একমত, স্যার,’ জুরিদের ফোরম্যান জবাব দিলেন।

‘বিবাদী কি দোষী নাকি নির্দোষ?’

‘দোষী।’

‘ক্ষতিপূরণ?’

‘সাড়ে সাতশো পাউন্ড।’

মি. পিকউইক মি. পার্কারকে অনুসরণ করে বেরিয়ে এলেন আদালত কক্ষ থেকে। একটা পার্শ্বরূমে মিলিত হলেন বন্ধুদের সঙ্গে। এখানে দেখা হলো ডডসন ও ফগের সঙ্গে, খুশিতে হাত কচলাচ্ছে তারা।

‘আপনারা খরচটা তুলতে পারবেন ভাবছেন, তাই না?’ মি. পিকউইকের প্রশ্ন।

ফগ বলল হয়তো পারবে। ডডসন মৃদু হেসে বলল চেষ্টা করবে।

‘আপনারা যত খুশি চেষ্টা করতে পারেন মেসার্স ডডসন অ্যান্ড ফগ, কঠোর কণ্ঠে বললেন মি. পিকউইক। ‘কিন্তু জেনে রাখুন, আমার পকেট থেকে একটা পেনিও খসাতে পারবেন না, প্রয়োজনে যদি জেলে যেতে হয় তাও সই।’

হা! হা!’ হেসে উঠল ডডসন। ‘শিগিরিই মত পাল্টাবেন আপনি, মি. পিকউইক।’

রাগে বাক্যহারা মি. পিকউইককে তাঁর উকিল ও বন্ধুরা দরজার দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন, স্যাম ওয়েলার ইতোমধ্যে ওখানে কোচ হাজির রেখেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *