দ্য পিকউইক পেপার্স – ১৩

তেরো

পরদিন সকাল হলে পর, বড়দিনের আনন্দের কথা ভেবে পুলক অনুভব করতে পারলেন মি. পিকউইক- মি. ওয়ার্ডল, মি. টাপম্যান, মি. উইঙ্কল ও মি. স্নডগ্রাসকে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানাতেও কুণ্ঠিত হলেন না। নাস্তার টেবিলে অভিযানের বয়ান দিলেন ভদ্রলোক, বললেন বদমাশ জিঙ্গলটা তাঁকে ও স্যামকে বোকা বানিয়ে কী মজাটাই না পেয়েছে।

একটা চিঠি হাতে স্যাম এল এসময়ে। ‘এ কার চিঠি,’ খাম খুলে বললে পিকউইক। ‘হায় খোদা! একি? এ কেমন তরো তামাশা! এ- এ হতেই পারে না!

‘কি ব্যাপার?’ সমস্বরে বন্ধুদের প্রশ্ন।

জবাব না দিয়ে চিঠিটা মি. টাপম্যানের দিকে ঠেলে দিলেন ভদ্রলোক, তারপর হতভম্ব মুখ নিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন। কাঁপা কাঁপা স্বরে চিঠিটা পাঠ করলেন মি. টাপম্যান :-

ফ্রিম্যানস কোর্ট, কর্নহিল, ২৮ আগস্ট, ১৮২৭।
বারডেল বনাম পিকউইক

স্যার,

আপনাকে এই মর্মে জানানো যাচ্ছে যে, মিসেস মার্থা বারডেল আপনার বিরুদ্ধে বিয়ের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দায়ে অভিযোগ এনেছেন। বাদিনী ক্ষতিপূরণ বাবদ পনেরোশো পাউন্ড দাবি করেছেন। কোর্ট অভ কমন প্লীজ আপনার নামে রিট ইস্যু করা হয়েছে। ডাক মারফত লন্ডনে আপনার আইন উপদেষ্টার নাম জানাতে সনির্বন্ধ অনুরোধ করা যাচ্ছে।

আপনার বিশ্বস্ত,
ডডসন ও ফগ।

মি. স্যামুয়েল পিকউইক।

পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে অবশেষে মি. পিকউইকের ওপর দৃষ্টিনিবদ্ধ করলেন বন্ধুরা। কথা বলতে যেন ভয় পাচ্ছেন সবাই। শেষ পর্যন্ত নিস্তব্ধতা ভাঙতে হলো আসামীকেই।

‘ষড়যন্ত্র,’ বললেন তিনি, ‘লোভী উকিল দুটোর কারসাজি! মিসেস বারডেল কখনও এমন করতে পারেন না- তিনি এমন মানুষই নন! এটা পয়সা বের করার একটা জঘন্য ফন্দি।’

‘তাই যেন হয়,’ গলা খাঁকরে বললেন মি. ওয়ার্ডল 1

‘কেউ কোনদিন ওই মহিলার প্রতি আমাকে দুর্বলতা প্রকাশ করতে দেখেছে?’ বলে চলেছেন মি. পিকউইক নিদারুণ উদ্দীপনার সঙ্গে। ‘তার সঙ্গে প্রয়োজন ছাড়া কখনও কোন কথা বলতে শুনেছে? বলুক না আমার বন্ধুরা… তারা কেউ আমাকে ওই মহিলার সঙ্গে কখনও দেখেছে?’

‘শুধু একবার,’ বললেন মি. টাপম্যান।

মুখের রং বদলে গেছে মি. পিকউইকের।

‘সন্দেহজনক তেমন কোন ব্যাপার নয়, আশা করি?’ বললেন মি. ওয়ার্ডল।

নেতার দিকে নিরীহ চোখে তাকালেন মি. টাপম্যান। ‘না, তেমন কিছু না। কিন্তু কিভাবে ঘটল জানি না, মহিলাকে ওর বাহুডোরে দেখেছি।’

‘রক্ষে করো!’ চেঁচিয়ে উঠলেন মি. পিকউইক, স্মৃতিটা মনে পড়ে যেতে। ‘ওহ, কী বিশ্রী ব্যাপার! কিন্তু তোমার দোষ নেই। যে কারও অবশ্য তাইই মনে হবে!’

‘আমাদের বন্ধু মহিলাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন,’ বললেন মি. উইঙ্কল।

‘হ্যাঁ,’ স্বীকার করলেন মি. পিকউইক। ‘তাই করছিলাম।’

‘ঘটনাটা সন্দেহজনক না হলেও,’ বললেন মি. ওয়ার্ডল, ‘দৃশ্যটা কেমন যেন অদ্ভুত, তাই না, পিকউইক?’

‘আমি ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলব,’ বললেন মি. পিকউইক। ‘ওই ডডসন আর ফগের সঙ্গে দেখা করব। কাল লন্ডনে যাচ্ছি আমি।

.

ফ্রিম্যানস কোর্ট, কর্নহিলের একটা ছোট্ট বাড়ির একতলায় মেসার্স ডডসন অ্যান্ড ফগের চার কেরানী বসে আছে। গুমোট ধরনের নোংরা ঘরটায় আসবাব বলতে কটা কাঠের চেয়ার, অল্প কিছু বই-পত্র, কানের পোকা বের করা একটা দেয়াল ঘড়ি, একটা ছাতা রাখার স্ট্যান্ড ও কটা তাকে কিছু ময়লা কাগজের বান্ডিল।

কামরার কাঁচের দরজায় মি. পিকউইক ও স্যাম ওয়েলার টোকা দিলেন।

‘কি, ভেতরে আসা যায় না?’ খেঁকিয়ে উঠল কোঁকড়া চুলো, ভোঁতামুখো এক কেরানী। কুতকুতে একজোড়া চোখ লোকটার, শার্টের কলারটা জীবনে কোনদিন মনে হয় সাবানের নাম শোনেনি।

‘মি. ডডসন আর মি. ফগ কি আছেন নাকি, স্যার?’ মি. পিকউইকের প্রশ্ন।

‘মি. ডডসন নেই আর মি. ফগ কাজে ব্যস্ত,’ বলল কেরানী।

‘মি. ডডসন কখন ফিরবেন?’

‘জানি না।’

‘মি. ফগের কাজ সারতে কি অনেক দেরি হবে?’

‘বলতে পারি না।’

লোকটা গভীর মনোযোগে কি একটা লিখতে শুরু করতে আরেকজন কেরানী হেসে উঠল।

‘আমি বরং অপেক্ষা করি,’ বলে বসে পড়লেন মি. পিকউইক

এসময় হঠাৎ বেল বেজে উঠতে একজন কেরানীর যেতে হলো মি. ফগের অফিসে। সে ফিরে এসে জানাল মি. ফগ সময় দিতে রাজি হয়েছেন।

ওপরে গেলেন মি. পিকউইক। ‘বসুন, স্যার,’ বললেন মি. ফগ। ‘আমার পার্টনার এখুনি এসে পড়বেন, তারপর আলাপটা সেরে নেয়া যাবে।’

ক’মিনিট নীরবতার পর মি. ডডসন এসে পৌঁছলেন এবং আলোচনা হলো শুরু।

‘আহ, আপনি তারমানে বিবাদী, স্যার, বারডেল বনাম পিকউইকের কেসে?’ বললেন ডডসন।

‘ঠিক ধরেছেন, স্যার, এবং আমি এসেছি আপনাদের চিঠি পেয়ে কিরকম অবাক হয়েছি জানাতে আর আমার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ আপনাদের জানতে,’ গড়গড় করে বলে গেলেন ভদ্রলোক।

‘অভিযোগের কথা জানতে নিজের বিবেককে প্রশ্ন করুন, স্যার। আমরা, স্যার, আমাদের মক্কেলের কথায় পুরোপুরি পরিচালিত হয়েছি। ওঁর স্টেটমেন্ট সত্যিও হতে পারে, মিথ্যেও হতে পারে। কিন্তু একথা বলতে পারি, স্যার, আপনার বিরুদ্ধে চিঠি পাঠানোর জোরাল যুক্তি আছে আমাদের। আপনি, স্যার, দুর্ভাগ্যের স্বীকার হতে পারেন কিংবা হয়তো অতি চালাক; কিন্তু জুরিম্যান হিসেবে ডাকা হলে আমি যে কোন একটা রায় দিতাম।

‘তা হলে বলি, স্যার,’ বললেন মি. পিকউইক, ‘আপনি নিঃসন্দেহ থাকতে পারেন এক্ষেত্রে আমি একজন হতভাগ্য, নির্দোষ মানুষ।’

‘খুব ভাল কথা,’ বললেন ডডসন। ‘কিন্তু এই যে, এটা হচ্ছে রিট। এই যে এন্ট্রি, ‘মার্থা বারডেল, বিধবা মহিলা, বনাম স্যামুয়েল পিকউইক। ক্ষতিপূরণ ১৫০০ পাউন্ড। বাদীর পক্ষে ডডসন অ্যান্ড ফগ, আগস্ট ২৮, ১৮২৭। ‘

‘আপনারা কি কেস চালিয়ে যাবেন ঠিক করেছেন?’ প্রশ্ন করলেন মি. পিকউইক।

‘অবশ্যই,’ জানালেন ডডসন।

‘আর ক্ষতিপূরণও পনেরোশো পাউন্ড?’

‘আমাদের মক্কেলকে রাজি করাতে পারলে এর তিনগুণ হত অঙ্কটা,’ বললেন ডডসন। ‘আপনি যেহেতু কোন সমঝোতায় আসতে চাইছেন না রিটের একটা কপি নিয়ে যান।’

‘বেশ, তাই সই,’ চ্যালেঞ্জের সুর মি. পিকউইকের কণ্ঠে। উঠে পড়েছেন তিনি। ‘শিগগিরই আমার উকিলের জবাব পাবেন। এবং যাওয়ার আগে বলে যেতে চাই,’ ক্ষুব্ধ শোনাল তাঁর গলা, ‘একটা জঘন্য ব্যাপার নিয়ে ঘোঁট পাকিয়েছেন আপনারা…’

‘দাঁড়ান, স্যার, দাঁড়ান!’ পরম বিনয়ে বললেন ডডসন। ‘মি. জ্যাকসন, মি. উইকস!’

‘স্যার,’ দুই কেরানী দরজায় উপস্থিত।

‘এই ভদ্রলোক কি বলেন শুধু শুনে গেলেই হবে। বলে যান, স্যার। আপনি বলছিলেন একটা জঘন্য ব্যাপার নিয়ে নাকি ঘোঁট পাকিয়েছি আমরা, তাই না?’

‘আমি বলছিলাম,’ চরম ক্রোধে বললেন মি. পিকউইক, ‘এহেন কুৎসিত অভিযোগের কথা আমি আমার এত বছরের জীবনে শুনিনি। আবার বলছি কথাটা।’

‘আমাদের জোচ্চোর বলতে চান?’ কথা যুগিয়ে দিলেন ডডসন।

‘নিশ্চয়ই,’ বললেন মি. পিকউইক, ‘আপনারা তো জোচ্চোরই!’

‘ভেরি গুড,’ বললেন ডডসন। ‘আপনারা শুনলেন তো? চালিয়ে যান, স্যার, চালিয়ে যান। মন চাইলে আমাদের চোর বলুন; চাই কি মারধরও করতে পারেন।

মি. পিকউইকের মুঠোর সামনে লোভ দেখানোর ভঙ্গিতে মুখটা এগিয়ে আনলেন ডডসন। বলাবাহুল্য, স্যাম উচ্চকণ্ঠের বাদানুবাদ শুনে উঠে না এলে একটা লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলতেন মি. পিকউইক। মনিবের বাহু চেপে ধরল ও।

‘চলে আসুন, স্যার,’ বলল স্যাম। আমরা ঝগড়া-মারামারি করার অবস্থায় নেই, স্যার। হাতি কাদায় পড়লে মশাও লাথি মারে জানেনই তো, স্যার।’

টানতে টানতে মনিবকে নিয়ে রাস্তায় নেমে এল স্যাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *