দ্য পিকউইক পেপার্স – ১০

দশ

মি. পিকউইক ইটানসউইল ভ্রমণের জন্যে মোক্ষম সময় বেছে নিয়েছেন। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ইটানসউইলের বাসিন্দারা, এই উপলক্ষে অন্যান্য মফস্বল শহরবাসীর মতই, নিজেদের খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ মনে করছে। প্রতিটি মানুষ নিজের জীবন জড়িয়ে নিয়েছে শহরের দুটি মহান রাজনৈতিক দলের সঙ্গে- দ্য ব্লুজ এবং দ্য বাফস। দুটি দল পরস্পরের চরম শত্রু। দু’দলের সমর্থকদের যেখানেই দেখা হয় বেধে যায় তুমুল তর্ক, চড়তে থাকে মেজাজ। একপক্ষ যদি বলে, ‘জয় ব্লুজ,’ তো অপরপক্ষ, ‘বাফস জিন্দাবাদ।’ মেম্বার অভ পার্লামেন্টের জন্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে কাল। মহামান্য স্যামুয়েল পামকি অভ পামকি হল হলেন ব্লু দলের প্রার্থী। হোরেশিও ফিটজকিন, এসকয়্যার, অভ ফিটজকিন লজ দাঁড়িয়েছেন বাফের পক্ষ থেকে।

মি. পিকউইক ও তাঁর সঙ্গীদের ইটানসউইলে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধে গড়িয়ে গেল। টাউন আর্মস ইন থেকে পতপত করে উড়ছে সিল্কের নীলরঙা প্রকাণ্ড সব পতাকা, প্রতিটি জানালায় পোস্টার সাঁটানো হয়েছে- এর অর্থ মহামান্য স্যামুয়েল পামকির কমিটি ওখানে বসে আছে। এক দল আলসে, ব্যালকনিতে দাঁড়ানো লালমুখে। এক লোকের জবানীতে, মি. পামকির অতিমানবীয় গুণাবলীর বিবরণ শুনছে। কিন্তু তার অবিরাম সুবাক্যবর্ষণ ব্যাহত হচ্ছে ফিটজকিনের কমিটি রাস্তার ওই কোণে চার চারটে মস্ত বিরাট ড্রাম ইস্তামাল করায়।

পিকউইকবাহিনী কোচ থেকে নেমে এলে জনতা তাঁদের ঘিরে ধরল। ‘জয় পামকি!’ গর্জে উঠল জনতা।

‘জয় পামকি!’ হ্যাট খুলে প্রতিধ্বনি করলেন মি. পিকউইক।

‘স্লামকি কে?’ ফিসফিস করে শুধালেন মি. টাপম্যান।

‘জানি না,’ বললেন মি. পিকউইক। ‘চুপ! বেশি প্রশ্ন কোরো না। খেপা জনতার সঙ্গে শুধু তাল মিলিয়ে যাও।’

‘কিন্তু খেপা জনতা যদি দুই দল হয়?’ লাগসই প্রশ্ন মি. স্নগ্রাসের। ‘যদি বলে ফিটজকিন জিন্দাবাদ?’

‘তখন যারা দলে ভারী তাদের সঙ্গে গলা মেলাবে,’ বাতলে দিলেন মহান নেতা।

সরাইখানায় প্রবেশ করতে, তাঁদের বন্ধু মি. পার্কারকে বিশাল একটা টেবিল আগলে বসে থাকতে দেখা গেল। ‘আহ, এসেছেন, স্যার?’ বললেন বেঁটে মানুষটি, ‘খুব খুশি হলাম। বসুন, প্লীজ। তো শেষ পর্যন্ত ইলেকশন দেখতে চলে এলেন?’

মহা উৎসাহে সায় দিলেন মি. পিকউইক। ‘আমি দু’তরফেরই খাঁটি দেশভক্তি দেখতে পাব আশা করছি। তা. রেজাল্ট কি হতে পারে মনে করেন?’

‘বলা যায় না, স্যার, কিছুই বলা যায় না,’ বললেন মি. পার্কার, তিনি হচ্ছেন মহামান্য স্যামুয়েল পামকির এজেন্ট। ‘আমরা অবশ্য খুবই আশাবাদী। কাল রাতে একটা ছোটখাট টি-পার্টি দিয়েছিলাম- পঁয়তাল্লিশ জন মহিলা, স্যার- এবং প্রত্যেককে একটা করে ছাতা উপহার দেয়া হয়েছে। সাত শিলিং ছয় পেন্স করে একেকটা। জানেনই তো, স্যার, মহিলারা চটকদার জিনিস ভালবাসে। ছাতাগুলো অসাধারণ ফল বয়ে এনেছে, স্যার। প্রত্যেকের স্বামী এবং প্রায় অর্ধেকের ভাই আমাদের বাক্সে ভোট দেবে। রাস্তা দিয়ে ছয় গজও যেতে পারবেন না, স্যার, ছয়টা সবুজ ছাতা চোখে পড়বে…’

পরদিন সকালে ভোটগ্রহণ। টাউন আর্মস ইনের উঠনে ইটানসউইল ব্লুজের শক্তিমত্তা ও ঐতিহ্যের স্ফুরণ দেখা গেল। নীল পতাকা নিয়ে কুচকাওয়াজ হচ্ছে, ড্রামাররা তাদের বাদ্যযন্ত্রগুলোকে কি বেধড়ক মারপিটটাই না করছে। পুলিসবাহিনীর সদস্যদের হাতে নীল লাঠি, কমিটির সভ্যরা পরেছেন নীল স্কার্ফ, এবং সমবেত ভোটারদের হ্যাটে শোভা পাচ্ছে নীল পালক। মহামান্য স্যামুয়েল পামকির জন্যে একটা উন্মুক্ত ক্যারিজ এবং তাঁর অনুসারী ও বন্ধুদের জন্যে চারটি ছোট আকারের ক্যারিজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। উড়ছে পতাকা, বাজছে ব্যান্ড, গালিগালাজ করছে পুলিস, তর্কাতর্কি করছেন কমিটির বিশজন সদস্য, চেঁচামেচি করছে জনতা, লাথি মারছে ঘোড়ার দল।

‘সব রেডি তো?’ মহামান্য পামকি প্রশ্ন করলেন মি. পার্কারকে।

‘স-অ-ব, স্যার,’ বললেন মি. পার্কার। দরজার কাছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বিশজন লোক দাঁড়িয়ে থাকবে, স্যার। তাদের সঙ্গে হাত মেলাতে হবে আপনাকে, স্যার। ছটা বাচ্চাও থাকবে, স্যার। ওদের মাথা চাপড়ে নাম জানতে চাইবেন, স্যার, বাচ্চাদের ব্যাপারটায় ভুল করবেন না, স্যার, মানুষ এতে খুব প্রভাবিত হয়।’

‘মনে থাকবে,’ বললেন মি. স্লামকি।

‘আর যদি, স্যার, কোন একটাকে একটু চুমু খেতে পারেন তবে তো কথাই নেই।’

‘কাজটা আপনি করলে হয় না?’ মহামান্য মি. স্লামকি জিজ্ঞেস করলেন।

‘জ্বী না, স্যার,’ বললেন উকিল সাহেব। একটু কষ্ট করে চুমুটা খেতে পারলে দেখরেন, স্যার, দারুণ সুফল পাবেন।’

‘ঠিক আছে,’ বললেন মহামান্য মি. পামকি। তাই হবে।’

জনতার হর্ষধ্বনির মধ্যে ব্লুজের শোভাযাত্রা শুরু হলো। গাদাগাদি করে লোক দাঁড়িয়েছে প্রতিটি ক্যারিজে। মি. পার্কারের ক্যারিজে পিকউইকবাহিনী ও কমিটির জনা ছয়েক সভ্য উঠেছেন।

ব্লুজের সঙ্গে বাফের শোভাযাত্রা কিভাবে একাকার হয়ে গেল এবং কিভাবে মুক্তি পেল ব্লুজ বিভ্রান্তি থেকে জানা নেই কারও- বাফের একটা পতাকার আঘাতে মি. পিকউইকের হ্যাট যেহেতু নেমে এসেছিল চোখের ওপর। তাঁর লিখিত রেকর্ডে ঘটনাটিকে বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে: ‘চারপাশে ঘিরে ধরল অগণিত ক্রুদ্ধ মুখ, ঝড় উঠল ধুলোর, জনতা যে যার মত হাত-পা ছুঁড়ছে।’ শেষ পর্যন্ত তাঁকে ক্যারিজ থেকে নেমে, কটা ধাপ বেয়ে একটা প্ল্যাটফর্মে উঠতে হলো। প্ল্যাটফর্মের একপ্রান্তে ব্লুজ দল অপর প্রান্তে বাফ দল এবং মধ্যখানে ইটানসউইলের মেয়র ও তাঁর অফিসাররা। মি. হোরেশিও ফিটজকিন ও মহামান্য মি. স্যামুয়েল মাটিতে প্রায় নুয়ে পড়ে অভিবাদন জানাচ্ছেন জনসমুদ্রের প্রতি। চারদিকে হৈ-হল্লা, গোঙানি, গর্জন।

প্রার্থীদের পক্ষ থেকে ভাষণ দেয়া হলো। কিন্তু শোরগোল এত বেশি যে বক্তারা চাই কি প্যারোডিও গাইতে পারতেন, কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পেত না।

ইটানসউইলের ইলেক্টরদের গুণকীর্তন করলেন এরপর প্রার্থীরা। দু’জনেই প্রতিশ্রুতি দিলেন, ইটানসউইলের ব্যবসা, শিল্প, বাণিজ্যের উন্নতিই হবে তাঁদের জীবনের পরম আরাধ্য। দু’জনেই পরম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘোষণা করলেন, তিনিই হবেন মেম্বার অভ পার্লামেন্ট।

এবার ভোটগ্রহণের পালা। শোভাযাত্রা পুনর্গঠিত হলো এবং গণসমুদ্রের মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলল মন্থর গতিতে। ভোটগ্রহণের পুরোটা সময় গোটা শহর আবেগ- উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপল। মদের দাম নেমে এল সর্বনিম্ন পর্যায়ে।

ইলেক্টরদের একটা ছোট্ট দল, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁদের ভোট দেননি। কোন পক্ষই তখন অবধি প্রভাবিত করতে পারেনি সুবিবেচক, সতর্ক ভদ্রলোকদের। নির্বাচন শেষ হওয়ার ঘণ্টা খানেক আগে, মি. পার্কার এসব সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সামান্য সময়ের জন্যে একান্ত আলাপের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তাঁরাও আপত্তি করলেন না। আলোচনাটা হলো খুবই সংক্ষিপ্ত ও ফলপ্রসূ। তাঁরা একত্রে গেলেন ভোটকেন্দ্রে, এবং যখন ফিরে এলেন মহামান্য মি. স্যামুয়েল পামকিকে তখন নির্বাচিত মেম্বার অভ পার্লামেন্ট হিসেবে তাঁদের সঙ্গে আসতে দেখা গেল। এভাবেই অনুষ্ঠিত হলো একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও কারচুপিবিহীন (!) মহান নির্বাচন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *