দ্য জাজ’স হাউস

দ্য জাজ’স হাউস

এক

পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে এলে ম্যালকম ম্যালকমসন ঠিক করল কোথাও নিরিবিলিতে গিয়ে পড়াশোনা করবে। তবে সাগর সৈকতের ধারে কিংবা গ্রামের কোনো সম্পূর্ণ নির্জন বাড়িতে বসে পড়ার কোনো খায়েশ তার নেই। জানে এসব জায়গা বেশ আকর্ষণীয়। তাই লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে। তার চেয়ে বরং কোনো অচেনা-অজানা মফস্বল শহরে যাওয়া যেতে পারে, যেখানে তার মনঃসংযোগ বিঘ্নিত হওয়ার সুযোগ নেই। বন্ধুদের কাছ থেকে কোনোরকম পরামর্শ চাওয়া থেকে বিরত রইল সে। কারণ এরা হয়তো এমন কোনো জায়গার নাম বলবে যা ম্যালকমের চেনা বা জানা এবং সে হয়তো ওসব স্থানে আগেই ঢুঁ মেরেছে। তাই নিজেই নিজের জায়গা খুঁজে নিতে মনস্থির করল সে। সুটকেসে কিছু জামাকাপড় এবং প্রয়োজনীয় বইপত্তর ভরে নিয়ে লোকাল টাইম টেবিলে প্রথম যে জায়গাটির নাম দেখল সেখানকার একটি টিকিট কিনে ফেলল। ওই জায়গার নাম সে কস্মিনকালেও শোনেনি।

ঘণ্টা তিনেকের ট্রেন ভ্রমণ শেষে বেনচার্চে নামল ম্যালকমসন। সন্তুষ্ট বোধ করল এখন পর্যন্ত সে তার পথের নিশানা মুছে ফেলতে সমর্থ হয়েছে, কারণ কেউ জানে না পড়াশোনার জন্য তার গন্তব্য কোথায়। একটি নির্জন জায়গার সরাইখানায় রাত্রিযাপন করার জন্য গেল সে। বেনচার্চ একটি মার্কেট টাউন, তিন হপ্তায় একবার এখানে হাটবাজার বসে, বাকি একুশ দিন শহর যেন মরুভূমি।

শহরে আসার পরদিন ম্যালকমসন ঘুরতে বেরুল ‘দ্য গুড ট্র্যাভেলার’ সরাইখানার চেয়ে নিরিবিলি কোনো বাসস্থান মেলে কিনা। একটি মাত্র জায়গা তার নজর কেড়ে নিল। দেখামাত্র পছন্দ হয়ে গেল বাড়িটি-একা থাকার জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা হতে পারে না। জ্যাকোবিয়ান স্টাইলে তৈরি, যেন অপরিকল্পিতভাবে গজিয়ে উঠেছে দারুণ মজবুত চেহারার প্রাচীন বাড়িটি। ঢালু পুরু ছাদ এবং অস্বাভাবিক ছোট ছোট জানালা, মাটি থেকে অনেক উঁচুতে যাদের অবস্থান, বাড়িটি ঘিরে রেখেছে ইটের মস্ত প্রাচীর সাধারণ মানুষের বাসস্থানের চেয়ে দুর্গের সঙ্গেই এটার মিল বেশি। তবে এসব বিষয়ই ম্যালকমসনকে আকৃষ্ট করল বেশি। ‘এরকম একটি জায়গাই আমি খুঁজছিলাম,’ মনে মনে বলল সে। ‘এখানে থাকার সুযোগ পেলে খুশিই হব।’ তার আনন্দ বর্ধিত হলো দ্বিগুণ যখন বুঝতে পারল বর্তমানে এখানে কেউ থাকছে না।

ডাকঘর থেকে এজেন্টের নাম ঠিকানা পেল ম্যালকমসন। ইনি মি. কার্নফোর্ড, স্থানীয় আইনজীবী এবং এজেন্ট। খুবই সদাশয় ভদ্রলোক। খোলা মনেই স্বীকার করলেন কেউ ওই বাড়িটি ভাড়া নিতে চায় জেনে তিনি যারপরনাই আনন্দিত। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল অনেকদিন ধরেই বাড়িটি খালি পড়ে আছে। ফলে ও বাড়ি নিয়ে আজগুবি সব কুসংস্কার সৃষ্টি হয়েছে।

তবে ‘আজগুবি কুসংস্কার’ নিয়ে কোনো আগ্রহ প্রকাশ করল না ম্যালকমসন কারণ জানে সে চাইলে অন্য লোকজনের কাছ থেকে এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। সে এজেন্ট ভদ্রলোককে তিন মাসের আগাম ভাড়া দিয়ে রসিদ নিল। মি. কার্নফোর্ড তাকে এক বৃদ্ধার নাম বললেন যে ম্যালকমসনের ঘরকন্নার কাজ করে দেবে। বাড়ির চাবি পকেটে ঢুকিয়ে এজেন্টের ঘর থেকে বেরিয়ে এল সে। সোজা চলল সরাইখানায়, ল্যান্ডলেডির সঙ্গে দেখা করতে। ইনি ভারী হাসিখুশি এক ভদ্রমহিলা এবং অতিশয় সজ্জন। তার কাছে জানতে চাইল প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র কিনতে হলে কোন্ দোকানে যাবে। সে কোথায় উঠছে জানালে ভদ্রমহিলা বিষম চমকে গেলেন।

‘বিচারকের বাড়ি নিশ্চয় নয়।’ কথা বলার সময় ফ্যাকাশে হয়ে গেল তাঁর চেহারা। ম্যালকমসন বাড়ির ঠিকানাটা বলল, তবে নামটি জানাতে পারল না। তার কথা শেষ হলে মহিলা বললেন :

‘অয়ি, অয়ি, বুঝতে পেরেছি-সেই বাড়িটাই! ওটা বিচারকের বাড়ি।’

ম্যালকমসন সরাইউলির কাছে বাড়িটি সম্পর্কে জানতে চাইল। কেনই বা ওই বাড়ির নাম বিচারকের বাড়ি এবং কেন লোকে বাড়িটির বিপক্ষে কথা বলে। ভদ্রমহিলা জানালেন, স্থানীয়ভাবে ওটি বিচারকের বাড়ি নামেই পরিচিত, কারণ অনেক বছর আগে-কত বছর আগে তিনি নিজেও জানেন না, কারণ তিনি এসেছেন দেশের আরেক প্রান্ত থেকে, তবে তাঁর ধারণা বাড়িটির বয়স একশ বা তার বেশি তো হবেই—ওখানে এক বিচারপতি বাস করতেন, যিনি আসিজের কয়েদিদের জন্য ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক, কারণ কঠিন সাজা দিতেন তিনি সবাইকে। তবে বাড়িটির বদনাম কেন রটে গেছে তা ল্যান্ডলেডি জানেন না। অনেককেই এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছেন। কেউ সদুত্তর দেয়নি। তবে সকলেরই ধারণা ওখানে অশুভ এবং ভয়ানক কিছু একটা আছে। ল্যান্ডলেডিকে যদি ড্রিংকওয়াটার ব্যাঙ্কের সমস্ত টাকাও দেয়া হয় তবু তিনি ওই বাড়িতে এক ঘণ্টার জন্যও যাবেন না। তবে পরক্ষণে তিনি ম্যালকমসনের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেন এসব কথা বলার জন্য।

‘আপনাকে এরকম কথা বলা আমার মোটেই উচিত হচ্ছে না, স্যার- আপনি একজন তরুণ ভদ্রলোক—তবু বলি ওখানে একা গিয়ে থাকবেন বিষয়টি ঠিক ভালো ঠেকছে না আমার কাছে। আপনি যদি আমার ছেলে হতেন-এ কথা বলার জন্য মাফ চাইছি-আপনাকে আমি ওখানে একটি রাতও কাটাতে দিতাম না আর আমি নিজে তো যেতামই না।’ ভদ্রমহিলার আকুতি এবং আন্তরিকতা ছুঁয়ে গেল ম্যালকমসনকে। তার প্রতি মহিলার এহেন সদিচ্ছার প্রতি সাধুবাদ জানিয়ে সে বলল :

‘ডিয়ার মিসেস উইদ্যাম, আমাকে নিয়ে একদমই দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি আমার পড়াশোনা নিয়ে এত ব্যস্ত থাকব যে রহস্যময় ‘কোনো কিছু, আমার কাজে একেবারেই ব্যাঘাত ঘটাতে পারবে না।’

ওর কাজগুলো এমন কঠিন এবং বিরস যে তার মনের কোনাতেও কোনো রহস্যময় বিষয় স্থান পাবার অবকাশ নেই। সে বলল, ‘হার মোনিকাল প্রোগ্রেশন, পারমুটেশন অ্যান্ড কম্বিনেশন এবং ইলিপটিক ফাংশন আমাকে যথেষ্ট রহস্যের রসদ জোগায়!

ম্যালকমসন এরপর গেল সেই বৃদ্ধার কাছে যে তার বাসার গৃহস্থালি কাজকর্মগুলো করে দেবে। মহিলাকে নিয়ে বিচারকের বাড়িতে ফিরল সে বেশ কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করার পর। এসে দেখে মিসেস উইদ্যাম কয়েকজন লোক এবং ছেলে ছোকড়া নিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছেন। তাদের সঙ্গে নানারকম বাক্সপেটরা, একজন গাড়িতে করে বিছানাপত্তরও নিয়ে এসেছে। মিসেস উইদ্যাম ব্যাখ্যা দিলেন বিচারকের বাড়িতে চেয়ার টেবিলের অবস্থা ভালো থাকলেও গত পঞ্চাশ বছর ধরে ওখানে বিছানার কোনো ব্যবস্থা নেই, যাতে একজন তরুণ আরাম করে একটু শুতে পারে। তিনি বাড়ির ভেতরে উঁকি দিতে খুবই আগ্রহী; তবে ‘কিছু’ একটার ভয়ে তিনি এতটাই ভীত যে সামান্য শব্দেও আঁতকে উঠে ম্যালকমসনের হাত খামচে ধরলেন এবং গোটা বাড়ি ঘুরে দেখার সময় একবারের জন্যও হাতখানা ছাড়লেন না।

বাড়ি পরিদর্শন শেষ করে ম্যালকমসন সিদ্ধান্ত নিল প্ৰকাণ্ড ডাইনিংরুমে বসেই সে পড়ালেখা করবে। সুপরিসর এ কক্ষটি তার সকল প্রয়োজন মেটাবে। এবং মিসেস উইদ্যাম ঠিকা কাজের বুয়া মিসেস ডেম্পস্টারকে নিয়ে ঘর গোছাতে লেগে গেলেন। প্যাকিং বাক্সপেটরা, ঝুড়ি ইত্যাদি এনে খোলা হলো। ম্যালকমসন দেখে আগামী কয়েকদিন ভালোভাবে চলে যাওয়ার মতো খাবার দাবার পাঠিয়েছেন মিসেস উইদ্যাম। বিদায়বেলায় তিনি সকল রকম শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে দরজায় এসে ঘুরে দাঁড়ালেন এবং বললেন:

‘ঘরটি যেহেতু বিশাল এবং ঠান্ডা, কাজেই স্যার, আপনার জন্য ভালো হবে যদি রাতে ঘুমাবার সময় আপনার বিছানার ধারের বড় পর্দাগুলো টেনে দেন—যদিও সত্যি বলতে কী এরকম একটা জায়গায় ওইসব ‘কিছু’ যেগুলো মাথার ওপর দিয়ে, পাশ দিয়ে উঁকি দেয়, তার মধ্যে আমাকে বন্দী থাকতে হলে দম বন্ধ হয়ে মারাই যেতাম!’ এসব ছবির কথা কল্পনা করেই তাঁর কাঁপুনি উঠে গেল। তিনি একরকম পালিয়েই বাঁচলেন।

ল্যান্ডলেডি চলে গেলে কর্তৃত্বের ভঙ্গিতে নাক টানল মিসেস ডেম্পস্টার এবং বলল সে এসব জুজুর ভয়ে ভীত নয়।

‘বিষয়টি কি আপনাকে আমি বলছি, স্যার,’ বলল সে। ‘জুজু নানারকমেরই আছে। ইঁদুর, গুবড়ে পোকা, ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করা দরজা, আলগা স্লেট পাথর, ভাঙা কাচের জানালা, আটকে যাওয়া দেরাজের হাতল যা দিনের বেলা টেনেও খোলা যায় না অথচ গভীর রাতে আপনা- আপনি খুলে গিয়ে দড়াম শব্দে পড়ে যায়—এসবই জুজুর ভয়। এ ঘরের কাঠের আচ্ছাদন দেখুন! অনেক পুরানো শত বছরের পুরানো তো হবেই! আপনার কি ধারণা ওখানে কোনো ইঁদুর এবং গুবড়ে পোকা নেই? এবং আপনি কি কল্পনা করতে পারেন, স্যার, যে ওদের দেখতে পাবেন না? ইঁদুর হলো জুজু, স্যার, আর জুজুই হলো ইঁদুর। এছাড়া এদের আর কী বলা যায়!’

২৮

‘মিসেস ডেম্পস্টার,’ গম্ভীর গলায় বলল ম্যালকমসন। ‘আপনি অনেক খোঁজখবর রাখেন বুঝতে পারছি। আমি যখন চলে যাব আপনি এ বাড়িতে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারবেন। আমার এখানকার কাজ সপ্তাহ চারেকের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। তারপর বাকি দুই মাস আপনি মাগনা থাকতে পারবেন।’

‘ধন্যবাদ, স্যার,’ প্রত্যুত্তরে বলল মহিলা। ‘তবে বাড়ির বাইরে একটি রাত্তিরও থাকার জো নেই আমার। আমি থাকি গ্রিন হাউসের চ্যারিটিতে। এক রাত বাইরে কাটিয়েছি কি আমার সবকিছু হারাতে হবে। ওখানকার আইনকানুন বড্ড কড়া। আর আমার জায়গাটি দখল করার জন্য অনেকেই মুখিয়ে আছে। শুধু এ কারণেই, স্যার, দিনের বেলাটা আমি দিব্যি সময় দিতে পারব।’

‘কিন্তু আমি এখানে এসেছি পুরোপুরি নিরিবিলি থাকার জন্য’, দ্রুত বলে উঠল ম্যালকমসন।

কর্কশ গলায় হেসে উঠল মহিলা। ‘আপনাকে সে জন্য ভাবতে হবে না। আপনি এখানে পুরোপুরি নিরিবিলিই থাকতে পারবেন।’

মহিলা ঘরদোর পরিষ্কারের কাজে নেমে পড়ল। সন্ধ্যার পরে বৈকালিক ভ্রমণ শেষে, (ম্যালকমসন হাঁটতে হাঁটতে বই পড়ে) বিচারকের বাড়িতে ফিরে এসে ম্যালকমসন দেখে ঘর চমৎকার ঝাঁট দেয়া হয়েছে, সবকিছু সুন্দর গোছগাছ করা, পুরানো ফায়ারপ্লেসে জ্বলছে আগুন, বাড়ি জ্বালানো এবং মিসেস উইদ্যামের দেয়া খাবার দিয়ে টেবিলে সাপার সাজানো। সে খুব খুশি হয়ে গেল।

নৈশভোজ সেরে, মস্ত ডাইনিং টেবিলের আরেক মাথায় ট্রেটি ঠেলে সরিয়ে রেখে আবার বই নিয়ে বসল ম্যালকমসন। ফায়ারপ্লেসে শুকনো লাকড়ি ঢোকাল, বাতির শিখা বাড়িয়ে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল পড়াশোনার জগতে। রাত এগারোটা পর্যন্ত টানা পড়ালেখা করল সে। তারপর উঠল অগ্নিকুণ্ডের আগুনটা উসকে দিতে। এক কাপ চা বানাল নিজের জন্য। সে চা খেতে খুব ভালোবাসে। কলেজ জীবনেও অনেক রাত অবধি পড়ত ম্যালকমসন এবং চা বানিয়ে খেত। গভীর রাতে চা পানের বিষয়টি তার কাছে চমৎকার এক বিলাসিতা। ব্যাপারটি সে খুব উপভোগ করে। তাজা লাকড়ি পেয়ে আগুন দাউ দাউ জ্বলছে, প্রকাণ্ড প্রাচীন কক্ষটির দেয়ালে ফেলছে অদ্ভুতদর্শন সব ছায়া। গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে এই নির্জনতাটুকু বেশ উপভোগ্য মনে হচ্ছিল ম্যালকমসনের। হঠাৎ প্রথমবারের মতো সে সচেতন হয়ে উঠল ইঁদুরের শব্দে।

‘আমার বই পড়ার সময় ইঁদুরগুলো এখানে ছিল না,’ ভাবছে সে। ‘তাহলে নিশ্চয় ওদের সাড়া পেতাম।’ তবে এখন শব্দের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে নিজেকে এই বলে বোঝাল ম্যালকমসন যে এসব শব্দ নতুন। অচেনা একজন লোকের আগমনে মূষিককুল নিশ্চয় ভয় পেয়েছে, আগুন এবং বাতির আলোও তাদের সন্ত্রস্ত করে তুলেছে; কিন্তু সময় যত বয়ে যেতে লাগল শব্দ ততই বাড়তে থাকল, এরা যেন তাদের অভ্যস্ত খেলায় আনন্দ পেতে শুরু করেছে।

কী যে ব্যস্ত ওরা! আর বিচিত্র সব শব্দ করছে! পুরানো কাঠের আচ্ছাদনের পেছনে, ছাতের ওপর এবং মেঝের নিচে ওরা ছোটাছুটি করছে, দাঁত বসাচ্ছে, খামচি কাটছে! মিসেস ডেম্পস্টারের কথা মনে পড়তে আপন মনে হাসল ম্যালকমসন, ‘জুজু ইঁদুর, ইঁদুরই জুজু!’

চায়ের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেহ-মনে। প্রায় শেষ রাত পর্যন্ত কাজ করার মতো উৎসাহ পাচ্ছে সে। তার আগে কামরাটিতে একবার ভালোভাবে চোখ বুলালে কেমন হয়, ভাবল ও। হাতে ল্যাম্প তুলে নিয়ে ও গোটা ঘরে চক্কর দিতে লাগল। ভাবছে এমন চিত্তাকর্ষক এবং সুন্দর বাড়িটি কী করে এত দিন ধরে অবহেলায় পড়ে ছিল। ওক কাঠের দেয়ালের গায়ের ভাস্কর্যগুলো চমৎকার। দরজা এবং জানালার কারুকাজগুলোও দেখার মতো। দেয়ালে পুরানো কিছু ছবি ঝুলছে, তবে এমন ধুলো ময়লা জমে গেছে যে মাথার ওপর বাতিটি তুলে ধরেও বোঝা গেল না ওগুলো কিসের চিত্র। ফাটল বা গর্তে আলোতে মাঝেমধ্যেই ধরা পড়ল ইঁদুরের জ্বলজ্বলে চক্ষু। তবে ওগুলো আলো দেখে ভয় খেয়ে কিচকিচ শব্দ তুলে মুহূর্তে উধাও।

তবে ম্যালকমসনকে সবচেয়ে আকর্ষণ করল ঘরের কিনারে, ফায়ারপ্লেসের ডানদিকের একটি মস্ত ঘণ্টা। ওটা অ্যালার্ম বেল। ছাত থেকে রশিতে ঝুলে আছে ঘন্টাটি ফায়ারপ্লেসের ওপর। ওক কাঠের অলংকৃত, খাড়া পিঠের একটি বিশাল চেয়ার অগ্নিকুণ্ডের কাছে টেনে নিয়ে ওতে বসল ম্যালকমসন। বসে বসে শেষ কাপ চা পান করল। চা শেষ করে আগুনটা উষ্কে দিয়ে ফিরে গেল কাজে। অগ্নিকুণ্ড বাম পাশে রেখে টেবিলের একটা কিনারা দখল করল সে। ইঁদুরগুলোর কিচকিচ তাকে খানিকক্ষণ বিরক্ত করল, তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে এ শব্দে অভ্যস্ত হয়ে গেল ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ কিংবা স্রোতের শোঁ শোঁ শব্দের মতো। নিজের কাজে এমনই মশগুল হয়ে গেল ম্যালকমসন যে অঙ্কের জটিল সমস্যার সমাধান ছাড়া দুনিয়াদারির অন্য সবকিছু বিস্মৃত হলো।

সে হঠাৎ চোখ তুলে তাকাল, অঙ্কের সমস্যাটির সমাধান এখনো হয়নি, বাতাস কেমন থম মেরে গেছে। ভোরের পূর্বাভাস সূচিত হওয়ার আগে এরকম স্তব্ধ থাকে বাতাস। ইঁদুরের কিচকিচানি থেমে গেছে। আকস্মিক এক নীরবতা ওকে কেমন অস্বস্তিতে ফেলে দিল। আগুন নিভু, নিভু তবে এখনো লাল টকটকে কয়লা জ্বলছে। ওদিকে তাকাতে সে দারুণ চমকে উঠল।

ফায়ারপ্লেসের ডান দিকে, খাড়া পিঠের ওক কাঠের প্রকাণ্ড চেয়ারটির ওপর বসে আছে মস্ত এক ইঁদুর, কটমট করে তাকিয়ে আছে ম্যালকমসনের দিকে। দৃষ্টিতে প্রবল ঘৃণা। ওটাকে মারার ভঙ্গিতে হাত তুলল ম্যালকমসন কিন্তু একচুল নড়ল না ইঁদুর। উল্টো সাদা, তীক্ষ্ণ দাঁত খিঁচাল ক্রুদ্ধ হয়ে, তার নির্দয় চোখে ঝলসাল প্রতিহিংসা।

বিস্ময়বোধ করল ম্যালকমসন। চুল্লি থেকে পোকারটা তুলে নিয়ে ছুটল ওটাকে হত্যা করতে। কিন্তু আঘাত হানার আগেই কিচকিচ করে উঠল ইঁদুর, গলার স্বরে তীব্র ঘৃণা, লাফিয়ে পড়ল মেঝেয়, ঘণ্টার রশি বেয়ে আঁধারে উধাও হয়ে গেল। ওখানে সবুজ শেডের বাতির আলো পৌঁছায়নি। অদ্ভুতই বলতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালের কাঠের আচ্ছাদনের আড়াল থেকে ইঁদুরগুলোর ছোটাছুটির শব্দ শুরু হয়ে গেল।

তবে এবারে ওদিকে মনোযোগ দিল না ম্যালকমসন, কারণ তীক্ষ্ণ গলায় একটা মোরগ ডেকে উঠে জানান দিয়েছে ভোর সমাগত। সে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল এবং ঘুমিয়ে গেল।

এমন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ম্যালকমসন যে টেরই পেল না মিসেস ডেম্পস্টার এসেছে তার ঘর ঝাঁট দিতে। মহিলা ঘরদোর পরিষ্কার করে, ওর নাশতা বানিয়ে তারপর খাটের স্ক্রিনে টোকা দিয়ে ওকে ঘুম থেকে জাগাল। রাতে অনেকক্ষণ কাজ করেছে বলে ক্লান্তিটা পুরোপুরি দূর হয়নি। তবে কড়া লিকারের এক কাপ চা নিমিষে ওকে সতেজ করে তুলল। একখানা বই হাতে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে পড়ল ম্যালকমসন। সঙ্গে খানকয়েক স্যান্ডউইচও নিয়েছে যদি দুপুরে বাড়ি ফেরা না হয় তো রাস্তায় বা অন্য কোথাও বসে খেয়ে নেবে।

উঁচু উঁচু দেবদারু বৃক্ষের সারির মাঝ দিয়ে পথ চলে গেছে শহরের বাইরের দিকে। এখানকার নির্জনতাটুকু বেশ উপভোগ করল ম্যালকমসন। দিনের বেশ অনেকটা অংশ এদিকটাতেই ব্যয় হলো ওর পড়াশোনার খাতিরে।

পড়াশোনা শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে সে মিসেস উইদ্যামের সঙ্গে দেখা করতে গেল তাঁর বদান্যতার জন্য ধন্যবাদ দিতে। খাস কামরার হিরক আকৃতির কাচের জানালা দিয়ে ওকে আসতে দেখে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। স্বাগত জানালেন ম্যালকমসনকে। ওর আপাদমস্তকে নজর বুলিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন :

‘এত পরিশ্রম করা উচিত নয়, স্যার। আপনার মুখচোখ কেমন শুকনো লাগছে। রাত্রি জাগরণ এবং অতিরিক্ত পরিশ্রম কোনো মানুষের জন্যই ভালো নয়। সে যাকগে, স্যার, বলুন রাতটি কেমন কাটল? আশা করি ভালো? আপনাকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছিল। কিন্তু মিসেস ডেম্পস্টার যখন বলল আপনি সুস্থ আছেন এবং আপনাকে সে মরার মতো ঘুমাতে দেখেছে তখন একটু স্বস্তি পেয়েছি।’

‘আমি ঠিকই আছি,’ হাসতে হাসতে বলল ম্যালকমসন। ‘কিছুটা আমাকে বিরক্ত করেনি। শুধু কতগুলো ইঁদুর ছাড়া। সারা কামরাজুড়ে ওগুলো দাপিয়ে বেড়িয়েছে। একটা ধাড়ি শয়তান ফায়ারপ্লেসের ধারে আমার চেয়ারে বসে ছিল। পোকার হাতে ধাওয়া করলে ওটা অ্যালার্ম বেলের রশি বেয়ে দেয়াল কিংবা ছাতের কোথাও ছুটে পালিয়েছে-আমি ঠিক দেখতে পাইনি। বেশ অন্ধকার ছিল।’

‘ঈশ্বর রক্ষা করুন,’ বললেন মিসেস উইদ্যাম, ‘একটা ধাড়ি শয়তান ইঁদুর ফায়ারপ্লেসের ধারের চেয়ারে বসে ছিল! সাবধান, স্যার! সাবধান! যা রটে তার কিছু হলেও বটে।’

‘মানে? আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না।

‘ধাড়ি শয়তান! ওখানে হয়তো বুড়ো শয়তানটা আছে! না, না, হাসবেন না।’ ম্যালকমসনকে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে দেখে দ্রুত বললেন মহিলা। ‘বুড়োরা যাতে ভয় পায় সেসব কথা আপনারা তরুণরা হেসেই উড়িয়ে দিতে চান।’

‘আমার কথায় কিছু মনে করবেন না,’ বলল ম্যালকমসন। ‘আমাকে রূঢ় প্রকৃতির বলেও দয়া করে ভাববেন না। তবে আপনার কথা মেনে নেয়া আমার জন্য সত্যি কষ্টকর-বুড়ো শয়তানটা নিজে গত রাতে চেয়ারে বসেছিল। হা! হা! হা!’ হাসতে হাসতেই ওখান থেকে চলে এল ম্যালকমসন। বাড়ি চলল লাঞ্চ করতে।

দুই

রাতে ইঁদুরদের ছোটাছুটি একটু আগেই শুরু হয়ে গেল। বলা উচিত ও ঘরে প্রবেশের আগে থেকেই তারা দৌরাত্ম্য আরম্ভ করেছে। ম্যালকমসন ঘরে ঢুকতে তাদের দৌড়ঝাঁপে সাময়িক ছেদ পড়ল। ডিনার সেরে আগুনের পাশে খানিক বসে ধূমপান করল ম্যালকমসন। তারপর টেবিল পরিষ্কার করে গত রাতের মতো পড়তে বসল।

ইঁদুরের দল গত রাতের চেয়ে আজ বেশি বিরক্ত করছে। ওপরে-নিচে, ডানে-বামে তাদের অবিরাম ছোটাছুটি চলছেই। সেই সঙ্গে কিচকিচানির তো বিরামই নেই। তারা নখের আঁচড় কাটছে কাঠে, দাঁত বসাচ্ছে। ক্রমে তাদের সাহস বেড়ে গেল। কাঠের আচ্ছাদনের ফাঁকফোকর, ফাটল এবং গর্ত দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল। আগুনের আলোয় তাদের ছোট ছোট চোখ যেন বাতির মতো জ্বলজ্বল করছে। তবে চাউনিতে বদমায়েশি নেই। এরা শুধু খেলছে। সবচেয়ে সাহসী দুএকটা ইঁদুর মেঝেতেও চলে আসছে অথবা কাঠের আচ্ছাদনের আনাচকানাচে উঠে পড়ছে। ম্যালকমসন খুব বেশি বিরক্ত বোধ করলে ‘হুশ হাশ’ শব্দ করে অথবা টেবিল চাপড়ে ওগুলোকে ভয় খাইয়ে দিল। ওরা পড়িমরি করে সেঁধুলো গর্তে।

রাত যত গভীর হলো, ইঁদুরদের শোরগোল সত্ত্বেও ম্যালকমসন তার কাজের মধ্যে গভীর মনোযোগে ডুবে যেতে থাকল।

গত রাতের মতো হঠাৎ করে সে কাজে বিরতি দিল আকস্মিক নীরবতা টের পেয়ে। কিচকিচ, নখ আচড়ানো কিংবা দাঁতে কামড়ানোর কোনোরকম শব্দ নেই। গোরস্থানসম নিস্তব্ধতা। আগের রাতের কথা মনে পড়তে সহজাত প্রকৃতিতে তার চোখ চলে গেল ফায়ারপ্লেসের পাশে দণ্ডায়মান চেয়ারখানার দিকে। একটা অদ্ভুত শিহরণ প্রবাহিত হলো তার গোটা শরীর বেয়ে।

ফায়ারপ্লেসের পাশে, পিঠখাড়া ওক কাঠের বিরাট চেয়ারটিতে বসে আছে সেই বিশালদেহী ইঁদুর। হিংস্র, কুটিল চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ম্যালকমসনের দিকে।

সহজাত প্রবৃত্তি ওকে হাতের কাছে যা পেল তা-ই তুলে নিতে দিল- লগারিদমের একখানা বই। সে ওটা ছুড়ে মারল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো টার্গেট। ইঁদুর নড়ল না একচুল। আবার পোকার হাতে গত রাতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। এবং ইঁদুরটা ম্যালকমসনকে অস্ত্র হাতে ছুটে আসতে দেখে অ্যালার্ম বেলের রশি বেয়ে পগারপার হলো। আর ওটা চলে যাওয়ামাত্র ইঁদুরকুলের হই হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। বিশালদেহী ইঁদুরটা কামরার কোন্ অংশে কেটে পড়েছে দেখতে পায়নি ম্যালকমসন কারণ তার সবুজ শেডের বাতির আলো শুধু ঘরের ওপরের অংশ আলোকিত করে রেখেছে এবং ফায়ারপ্লেসের আগুনও তেজ হারিয়ে ধুঁকছে।

ঘড়ি দেখল ম্যালকমসন। প্রায় মাঝরাত্তির। সে অগ্নিকুণ্ডের আগুন বাড়িয়ে দিয়ে রাতের বেলার জন্য চা বানাল। অনেক কাজ পড়ে আছে। একটু ধূমপান করলে মন্দ হয় না। সে ওক কাঠের চেয়ারে বসে সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে ভাবল ইঁদুরটা কোথায় সেঁধিয়েছে সেই জায়গাটা খুঁজে বের করতে হবে। কাল ইঁদুর ধরার ফাঁদ কিনে আনার চিন্তাটাও বাতিল করে দিল না।

ম্যালকমসন আরেকটি ল্যাম্প জ্বালাল। রাখল এমন জায়গায় যাতে ফায়ারপ্লেসের ডানদিকের দেয়ালে আলো পড়ে। তারপর হাতের কাছে সমস্ত বইপত্র জড়ো করে রাখল যাতে অনিষ্টকর প্রাণীটাকে দেখা মাত্র ওগুলো ওটার গায়ে ছুড়ে মারতে পারে। সবশেষে অ্যালার্ম বেলের রশি টেনে এনে গোড়াটা রাখল টেবিলের ওপর, ল্যাম্পের নিচে। রশিটা বেশ প্যাচানো এবং মজবুত। ‘এ দিয়ে তো মানুষের ফাঁসি দেয়া যায়,’ মনে মনে বলল ও। কাজ শেষ করে চারপাশে তাকিয়ে তৃপ্তি সহকারে বলল :

‘এবারে বন্ধু তোমাকে একটা শিক্ষা দেয়া যাবে!’ ও আবার পড়তে বসল যদিও শুরুতে ইঁদুরগুলোর ছোটাছুটিতে খানিকটা বিরক্ত বোধ করলেও কাজে এমন ডুবে গেল যে ওগুলোর কথা মনেই রইল না।

আবারও সে পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে সচেতন হয়ে উঠল। এবারে আকস্মিক নৈঃশব্দ নয়, তার মনোযোগ আকর্ষণ করল রশিতে সামান্য আন্দোলন। টান খেয়েছে ওটা, সরে গেছে ল্যাম্প। নড়ল না ম্যালকমসন শুধু তাকিয়ে দেখল তার বইয়ের গাদা ঠিকঠাক আছে কিনা, তারপর তার দৃষ্টি অনুসরণ করল রশি।

চোখ তুলে তাকাতেই দেখে অতিকায় ইঁদুরটা রশি দিয়ে লাফ মেরে ওক কাঠের আরামকেদারায় বসেছে এবং তার দিকে রোষকষায়িত নয়নে তাকিয়ে আছে। ডান হাতে একখানা বই তুলে নিল ম্যালকমসন, লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে ছুড়ে মারল ইঁদুরটাকে। ঝট করে লাফিয়ে সরে গিয়ে মিশাইলের নিশানা ব্যর্থ করে দিল ইঁদুর।

আরেকটা বই নিল ম্যালকমসন, তারপর আরেকখানা এবং একের পর এক বই ছুড়তেই লাগল কিন্তু একবারও টার্গেটের গায়ে লাগাতে পারল না। অবশেষে সে বই নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল নিশানা ভেদ করতে। কিচকিচ আওয়াজ করল ইঁদুর। মনে হয় ভয় পেয়েছে। এতে আরও উৎসাহ পেয়ে গেল ম্যালকমসন। ছুড়ল বই। ওটা ইঁদুরটার গায়ে লাগল থ্যাচ শব্দ করে। বিকট আর্তনাদ করল ইঁদুর, একবার তীব্র বিবমিষায় তার হামলাকারীকে দেখে নিয়ে চেয়ারের পিঠ বেয়ে উঠে মস্ত লাফ দিল অ্যালার্ম বেলের রশি লক্ষ্য করে এবং বিদ্যুৎগতিতে দৌড়ে গেল। আকস্মিক টান খেয়ে দুলল বাতি, তবে ওজনে বেশ ভারী বলে উল্টে পড়ল না। ইঁদুরটার ওপর চোখ রেখেছে ম্যালকমসন। দ্বিতীয় বাতির আলোয় দেখল ওটা কাঠের আচ্ছাদনের কিনারে লাফিয়ে উঠে দেয়ালে ঝোলানো বিরাট আকারের ছবিগুলোর একটির নিচের গর্ত দিয়ে সুড়ৎ করে উধাও হলো। ধুলো আর কালি ঝুলি মাখা ছবির কারণে ওটাকে আর দেখা সম্ভব হলো না।

‘সকাল বেলায় আমি ইঁদুরটার নিবাসে খোঁজ লাগাব,’ মেঝে থেকে বই তুলতে তুলতে আপন মনে বলছে ম্যালকমসন। ‘ফায়ারপ্লেসের ওপরে তিন নম্বর ছবিটি। মনে থাকবে।’

সেই রাতে গভীর ঘুম হলেও বেশ কয়েকবারই কয়েক সেকেন্ডের জন্য অস্বস্তি নিয়ে ঘুম ভেঙে গেল ম্যালকমসনের নানান দুঃস্বপ্ন দেখে। মিসেস ডেম্পস্টার ওকে ডেকে তুলল সকালে। শরীরটা কেমন অসুস্থ লাগল ওর, প্রথম কয়েকটা মুহূর্ত বুঝতেই পারল না কোথায় আছে। মিসেস ডেম্পস্টারকে সে যে অনুরোধটা করল তা শুনে বিস্ময়বোধ করল মহিলা।

‘মিসেস ডেম্পস্টার, আজ যখন বাইরে যাব আপনি তখন ওই ছবিগুলোর ময়লা ধুলা পরিষ্কার করে ফেলবেন-বিশেষ করে ফায়ারপ্লেসের ওপরের তিন নম্বর ছবিটা থেকে। ওগুলো কিসের ছবি আমি দেখতে চাই।’

সেদিন বিকেলে বই নিয়ে হাঁটতে বেরিয়ে বেশ ফুর্তিই লাগছিল ম্যালকমসনের। দিন যত গড়াচ্ছিল আগের দিনের উৎফুল্লভাব ফিরে আসছিল তার মাঝে। বইয়ের যে সব সমস্যা নিয়ে সে বিচলিত ছিল তার অনেকগুলোরই সমাধান করা গেছে। সে খুশি মনে মিসেস উইদ্যামের ‘দ্য গুড ট্রাভেলার’ সরাইখানায় গেল। আরামদায়ক বসার ঘরে ডা. থর্নহিল নামে এক আগন্তুকের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলেন ল্যান্ডলেডি। তবে ডাক্তার যখন ম্যালকমসনকে একগাদা প্রশ্নে জেরবার করতে লাগলেন, ভদ্রমহিলা একটু বিব্রতই হলেন। তবে প্রশ্নের ধরন শুনে ম্যালকমসন বুঝতে পারল ভদ্রলোকের উপস্থিতি নিতান্তই কাকতালীয় নয়। তাই সে বলল :

‘ড. থর্নহিল, আমি আপনার সমস্ত প্রশ্নেরই জবাব দেব যদি আপনি আমার একটি প্রশ্নের অন্তত জবাব দেন।’

ম্যালকমসনের প্রশ্নে বিস্মিত দেখাল ডাক্তারকে, তবে তিনি হেসে তাৎক্ষণিক বললেন, ‘নিশ্চয়! কী প্রশ্ন?’

‘মিসেস উইদ্যাম কি আপনাকে এখানে আসতে বলেছেন এবং আমার সঙ্গে কথা বলতে বলেছেন?’

একটু চমকেই গেলেন ডা. থর্নহিল। মিসেস উইদ্যামের মুখ লাল হয়ে গেল, তিনি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। তবে ডাক্তার সাহেব বেশ আমুদে মানুষ এবং সকল রকম পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রস্তুত। তিনি খোলাখুলিই ওর প্রশ্নের জবাব দিলেন।

‘হ্যাঁ বলেছিলেন : তবে আপনি জেনে যাবেন তা চাননি। আমার তাড়াহুড়োর কারণেই আপনি আসলে আমাকে সন্দেহ করে বসেছেন। বলেছেন আপনি যে ওই বাড়িতে একা একা থাকেন সেটি তাঁর একদমই পছন্দ নয়। আর তাঁর ধারণা আপনি বড্ড বেশি কড়া লিকারের চা পান করছেন। আসলে তিনি চাইছেন আমি যেন আপনাকে বেশি বেশি চা খেতে বারণ করি এবং বেশি রাত জাগতেও মানা করি। কলেজ জীবনে আমিও বইপোকা ছিলাম কাজেই একজন সাবেক কলেজ ছাত্র হিসেবে এটুকু স্বাধীনতা নিতেই পারি এবং আশা করি আমাকে স্রেফ একজন আগন্তুক ভাববেন না।’

উজ্জ্বল হাসিতে উদ্ভাসিত হলো ম্যালকমসনের মুখ। হাত বাড়িয়ে দিল সে। ‘আসুন, হাত মেলাই! আমেরিকায় এভাবেই বলে ওরা। আপনার এবং মিসেস উইদ্যামের বদান্যতার জন্য ধন্যবাদ। কথা দিচ্ছি আমি আর কড়া লিকারের চা পান করব না-আপনি অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত আর চা-ই খাব না-এবং খুব যদি দেরিও করি তাও রাত একটার মধ্যে ঘুমাতে যাব। চলবে?’

‘খাসা,’ বললেন ডাক্তার। ‘এখন আমাদের বলুন তো পুরানো বাড়িটিতে কী কী দেখলেন।’

ম্যালকমসন সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিল গত দুরাতে কী ঘটেছে। তার কথা বলায় মাঝেমধ্যেই ব্যাঘাত ঘটল মিসেস উইদ্যামের ভয়ার্ত চিৎকারে। নিজেকে সামলে নিতে তিনি এক গ্লাস ব্রান্ডি এবং পানি পান করলেন। তারপর তাঁর ফ্যাকাশে মুখে রক্ত ফিরে এল। ম্যালকমসনের কথা শুনতে শুনতে ডা. থর্নহিলের মুখ গম্ভীরতর হলো এবং বর্ণনা শেষ হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইঁদুরটা কি সব সময়ই অ্যালার্ম বেলের রশি বেয়ে উপরে উঠে যায়?’

‘সব সময়।’

‘আশা করি আপনি জানেন,’ একটু বিরতি দিয়ে বললেন ডাক্তার। ‘রশিটা কিসের?’

‘না!’

‘এটা সেই রশি যা দিয়ে জল্লাদ বিচারপতির রায়ে সাব্যস্ত অপরাধীদের ফাঁসি দিত,’ ধীরে ধীরে বললেন থর্নহিল। এখানে তিনি আবার বাধা পেলেন মিসেস উইদ্যামের চিৎকারে। সামলে উঠতে তাঁকে আবার ব্রান্ডি এবং পানি পান করতে হলো। ঘড়ি দেখল ম্যালকমসন। ডিনারের সময় প্রায় হয়ে এসেছে। সে আর দেরি করল না। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথ ধরল।

ম্যালকমসন চলে যাওয়ার পরে ডাক্তারের ওপর প্রায় হামলে পড়লেন মিসেস উইদ্যাম। ক্ষিপ্ত গলায় জানতে চাইলেন বেচারা তরুণটিকে অমন ভয়ংকর একটা কথা শোনাবার মানে কী! ‘এমনিতেই ওখানের নানান ঘটনায় বেচারা বিপর্যস্ত,’ যোগ করলেন তিনি।

ডা. থর্নহিল জবাব দিলেন, ‘ম্যাডাম, ওই কথাটি বলার পেছনে আমার বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। আমি ঘণ্টার রশির দিকে ওর মনোযোগ আকর্ষণ করতে চেয়েছি যাতে ওই ঝামেলাটা সে নিজেই মিটিয়ে নিতে পারে। হয়তো ও একটু বেশিমাত্রায় উত্তেজিত এবং ক্লান্ত, খুব বেশি পড়াশোনা করছে, যদিও ওকে আমার সুস্থ এবং স্বাস্থ্যবান বলেই মনে হলো, মানসিক এবং শারীরিক উভয় দিক থেকেই- কিন্তু ওই ইঁদুরগুলো- আর ধেড়েটাকে শয়তান বলে মনে করা!’ ডানে বামে মাথা নাড়লেন তিনি। বলে চললেন, ‘আমি ওর সঙ্গে যাওয়ার প্রস্তাব দিতে পারতাম রাতটা একসঙ্গে কাটানোর জন্য কিন্তু তাতে সে অপমান বোধ করত। রাতের বেলা হয়তো ওর মধ্যে অদ্ভুত কোনো ভীতি কাজ করে কিংবা দৃষ্টিবিভ্রমের শিকার হয়। যদি তাই হয় সে ক্ষেত্রে আমি চাই ও রশিটা ধরে টানুক। ঘণ্টার শব্দ পেলেই আমরা ওখানে চলে যাব। আমি আজ অনেক রাত অবধি জেগে থাকব এবং কান সজাগ থাকবে।’

‘ডাক্তার, আপনি এসব কী বলছেন? আপনি আসলে কী বলতে চাইছেন?’

‘আমি বলতে চাইছি যে সম্ভবত আজ রাতে আমরা বিচারকের বাড়ি থেকে অ্যালার্ম বেলের শব্দ শুনতে পাব।’ বললেন ডাক্তার।

তিন

সাধারণত যে সময়ে বাড়ি ফেরে ম্যালকমসন আজ তার চেয়ে একটু দেরি হয়ে গেল। মিসেস ডেম্পস্টার কাজ টাজ সেরে চলে গেছে-গ্রিনহাউস চ্যারিটির নিয়মকানুন খুব কড়া। ম্যালকমসন খুশি হয়ে গেল দেখে ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে এবং বাতিও জ্বলছে। এখন এপ্ৰিল মাস। অথচ ঠান্ডাটা আজ একটু বেশিই পড়েছে মনে হয়। জোর হাওয়া বইছে বাইরে, ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে শক্তি ঝড়ের আশঙ্কা নিয়ে।

ম্যালকমসন ঘরে ঢোকার পরে কিছুক্ষণ ইঁদুরের দৌরাত্ম্য থেমে ছিল। ওর উপস্থিতির সঙ্গে নিজেদের সমঝে নিয়ে আবার শুরু হয়ে গেল তাদের হুটোপুটি। ইঁদুরদের সাড়া পেয়ে আজ অবশ্য খারাপ লাগছে না ম্যালকমসনের, বরং ওদের সঙ্গ উপভোগই করছে।

রিডিংল্যাম্পটি শুধু জ্বলছে। ওটার সবুজ শেড সিলিং এবং রুমের ওপরের অংশ আলোকিত করে রেখেছে। চুল্লির আগুনের আলো ছড়ানো মেঝেয় এবং টেবিলে পেতে রাখা সাদা কাপড়টি তাতে ঝকমক করছে।

পেটে বেশ খিদে নিয়ে খেতে বসল ম্যালকমসন। খাওয়া শেষ করে একটি সিগারেট ধরাল। তারপর বসে পড়ল কাজে। কোনো কিছুই সে আজ তার মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হতে দেবে না, কারণ ডাক্তারকে তেমনই কথা দিয়েছে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে অনেকটা পড়া শেষ করবে ও।

ঘণ্টাখানেক একটানা পড়াশোনা করল ম্যালকমসন। তারপর বই থেকে তার চিন্তাভাবনাগুলো অন্যত্র সরে যেতে লাগল। আশপাশের পরিবেশ, আড়ষ্ট শরীর, নার্ভাসনেস কোনো কিছুই অগ্রাহ্য করার মতো নয়। বাতাস এতক্ষণে দমকা হাওয়ায় রূপ নিয়েছে, সেখানে ঝড়ে রূপান্তর ঘটল। প্রাচীন বাড়িটি যতই নিরেট এবং মজবুত হোক না কেন, ওটার ভিত ধরে যেন নাড়া দিল ঝোড়ো হাওয়া। কেঁপে কেঁপে উঠল। বাড়িটির অসংখ্য চিমনির ভেতরে হুংকার ছাড়ছে বাতাস, খালি কামরা এবং করিডরগুলোতে বিচিত্র শব্দ তুলছে। ছাতের প্রকাণ্ড অ্যালার্ম বেলটিও নিশ্চয় বাতাসের শক্তি টের পেয়েছে, রশিটি ঈষৎ ওপরে উঠল এবং নামল, যেন ঘণ্টাটি এদিক-ওদিক দুলল। ওক কাঠের মেঝেতে রশির বাঁকানো অংশ পড়ল থপ শব্দ করে।

রশি পড়ার শব্দে ম্যালকমসনের মনে পড়ে গেল ডাক্তারের কথা ‘ওই রশিতেই জল্লাদ বিচারক ফাঁসির আসামিদের ফাঁসিতে ঝোলাত।’ সে ফায়ারপ্লেসের কাছে গিয়ে রশিটি তুলে নিল হাতে। আশ্চর্য আগ্রহ বোধ করছে রশিটির প্রতি। ওটার দিকে তাকিয়ে ভাবল ফাঁসির এ রজ্জু না জানি কত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। বিচারক নিজ চোখে দেখেছেন তাঁর আসামিদের ফাঁসিতে ঝুলতে। ও ওখানে দাঁড়িয়ে আছে, ছাতের ঘণ্টাটা দুলে উঠে রশিটিকে এদিক-ওদিক দোলাল। রশিটি কেমন কেঁপে উঠল।

অজান্তেই ওপরের দিকে চোখ চলে গেল ম্যালকমসনের। দেখল বিশালদেহী ইঁদুরটা রশি বেয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসছে তার দিকে, স্থির চোখে জ্বলন্ত চাউনি। সঙ্গে সঙ্গে রশিটি হাত থেকে ফেলে দিল ম্যালকমসন। পিছিয়ে এল সভয়ে অস্ফুট চিৎকারে। ইঁদুর এবার রশি বেয়ে তরতর করে ওপরে উঠে গেল এবং পরক্ষণে অদৃশ্য এবং ঠিক সেই মুহূর্তে ম্যালকমসন শুনতে পেল ইঁদুরের দল থেমে থাকা কোলাহল শুরু করে দিয়েছে আবার।

ম্যালকমসন ভাবছিল ধেড়ে ইঁদুরটার বাসস্থান খুঁজে দেখার কথা ছিল ওর, সেই সঙ্গে ছবিগুলোও দেখবে ঠিক করেছিল। শেডবিহীন একটি বাতি জ্বালাল ও। বাতিটি হাতে উঁচিয়ে ধরে ফায়ারপ্লেসের ডানদিকের তৃতীয় ছবিটির নিচে এসে দাঁড়াল। এ ছবিটির নিচেই গত রাতে ইঁদুরটাকে উধাও হতে দেখেছে সে।

প্রথম দর্শনেই এমন চমকে গেল ম্যালকমসন যে আরেকটু হলে বাতিটি ফেলেই দিচ্ছিল হাত থেকে। ওর মুখ শুকিয়ে গেল। হাঁটু কাঁপছে, কপালে ফুটল ভারী ঘামের ফোঁটা, বেতসলতার মতো থরথরিয়ে কাঁপছে। তবে তরুণ এবং তেজি ম্যালকমসন কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সামলে নিল নিজেকে। উঁচু করে ধরল ল্যাম্প এবং ছবিটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। আগে ওতে ধুলো পড়া ছিল। এখন পরিষ্কার করা হয়েছে।

লাল টকটকে রোব পরা বিচারপতির ছবি। কঠোর, মজবুত, নির্দয় একটা মুখ। চেহারায় ফুটে আছে চতুরতা, শয়তানি এবং প্রতিহিংসা। ইন্দ্রিয়াসক্ত মুখ, শিকারি পাখির বাঁকানো ঠোঁটের মতো লালচে নাক। মুখের বাকি অংশ পান্ডুর, বিবর্ণ। চোখ জোড়া ঝকঝকে তাতে অত্যন্ত অশুভ ছাপ। চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ম্যালকমসনের গা-হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল কারণ ওই চোখজোড়ার সঙ্গে অতিকায় ইঁদুরটার চোখের আশ্চর্য মিল। হাত থেকে বাতিটি প্রায় পড়েই যাচ্ছিল যখন দেখল ছবির পাশের একটি গর্ত দিয়ে তীব্র ঘৃণামিশ্রিত এক জোড়া চোখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক ওই মুহূর্তে অন্য ইঁদুরগুলোর কিচকিচানি থেমে গেল। যাহোক, নিজেকে সামলে নিল ম্যালকমসন এবং ছবিটি খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।

বিচারক খাড়া পিঠের ওক কাঠের অলংকৃত বিরাট একটি চেয়ারে বসে আছেন। ডান পাশে পাথরের তৈরি বড়সড় একটি ফায়ারপ্লেস। ওটার কিনারায়, ছাত থেকে একটি রশি ঝুলছে। রশির শেষ মাথা কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে মেঝেয়। আত্মা শুকিয়ে গেল ম্যালকমসনের কামরাটির দৃশ্য চিনতে পেরে। সে ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকাল যেন আশঙ্কা করছে কেউ তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়ারপ্লেসের কিনারায় তাকাতেই আঁতকে উঠল সে এবং হাত থেকে পড়ে গেল বাতি।

ওখানে, বিচারকের আসনে, পেছনে ঝুলছে রশি, বিচারপতির বিষ দৃষ্টি নিয়ে বসে আছে ইঁদুরটা, তার চেহারায় এখন উদগ্রতা এবং নিষ্ঠুর এক কদর্যতা। বাইরে বাতাসের মাতামাতি ছাড়া আর সব নীরব নিস্তব্ধ।

বাতিটি ধাতব নির্মিত বলে ভাঙেনি, তেলও ছলকে পড়েনি মেঝেয়। ওটার গড়াগড়ির শব্দে যেন সংবিৎ ফিরে পেল ম্যালকমসন। বাতিটি নিভিয়ে দিল ও। কপালের ঘাম মুছল। তারপর একটু চিন্তা করে আপন মনে বলল, ‘এভাবে চলতে পারে না। এভাবে চললে আমি নির্ঘাত পাগল হয়ে যাব। আমি ডাক্তারকে কথা দিয়েছি চা খাব না। আমার স্নায়ুর ওপর নিশ্চয় অনেক চাপ পড়েছে যা খেয়াল করিনি। তবে আমি এখন ঠিক আছি। নির্বোধের মতো আর এমন ভয় পাব না।’

সে ব্রান্ডির সঙ্গে পানি মিশিয়ে পান করল এবং মাথা ঠান্ডা করে পড়তে বসল।

প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদে, আকস্মিক নীরবতায় অস্বস্তি বোধ করে ব‍ই থেকে মুখ তুলে চাইল ম্যালকমসন। বাইরে হাউমাউ শব্দে গজরাচ্ছে বাতাস, আগের চেয়েও জোরে ছাড়ছে হুংকার, সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে বৃষ্টি, শিলাখণ্ডের মতো আছড়ে পড়ছে জানালার কাচে। তবে চিমনি থেকে ভেসে আসা হাওয়ার প্রতিধ্বনি এবং মাঝেমধ্যে দুএক ফোঁটা বৃষ্টি গরম চিমনির গায়ে আছড়ে পড়ে হিশ্ শব্দ তোলা ছাড়া ঘরের ভেতরে আর কিছুর শব্দ নেই। আগুনের তেজ কমে এসেছে, যদিও লাল দপদপে আভা ছড়াচ্ছে কয়লা। উৎকর্ণ ম্যালকমসন একটা পাতলা, খুবই আবছা খচখচ শব্দ শুনতে পেল। রশিটা যেখানে ঝুলছে, ঘরের সেই কিনারে আওয়াজটা হয়েছে। ও ভাবল রশি মেঝেয় ঘষা খেয়ে অমন শব্দ তুলেছে।

মাথা তুলে তাকাল ম্যালকমসন। স্বল্প আলোয় দেখতে পেল বিরাট ইঁদুরটা রশিতে ঝুলে ওটাকে চিবুচ্ছে। দড়িটা অবশ্য অনেকখানি কেটে গিয়ে ভেতরের সুতোও বেরিয়ে পড়েছে। ও যখন ওদিকে তাকিয়েছে ততক্ষণে রশির দফা সারা। দড়ির কাটা অংশটি ঝপাৎ করে পড়ল ওক কাঠের মেঝেতে। এক মুহূর্তের জন্য বিশালদেহী ইঁদুর রশির সুতোযুক্ত ছেঁড়া মাথায় ঝুলে রইল। ছেঁড়া রশিটা এদিক-ওদিক দুলছে। ম্যালকমসন আতঙ্কবোধ করল ভেবে যে বাইরের জগতের সঙ্গে তার যোগাযোগ মাধ্যমটি শেষ হয়ে গেল। রশি ধরে টান মেরে ঘণ্টা বাজানোর সুযোগটি আর রইল না, আর এ আতঙ্ক ওর মধ্যে সৃষ্টি করল ক্রোধ এবং সে যে বইটা পড়ছিল ওটা তুলে নিয়ে ইঁদুরের গায়ে ছুড়ে মারল।

লক্ষ্য নির্ভুলই ছিল। কিন্তু মিসাইল তার টার্গেটে পৌঁছানোর আগেই ইঁদুর রশি ছেড়ে দিয়ে ঝুপ করে নেমে পড়ল মেঝেতে। ম্যালকমসন ছুটে গেল ওটার দিকে। কিন্তু ইঁদুর তিড়িং করে এক লাফে কামরার অন্ধকার ছায়ায় উধাও হয়ে গেল।

পড়ার মুড নষ্ট হয়ে গেছে ম্যালকমসনের। ইঁদুরটাকে সে আজ ছাড়বে না। ল্যাম্পের সবুজ শেডটা খুলে নিল যাতে আলোটা ভালোভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ল্যাম্পের আলোয় রুমের ওপরের অংশ উদ্ভাসিত হলো, নতুন আলোর বন্যায় আগেকার অন্ধকারের তুলনায় দেয়ালের ছবিখানা আরও পরিষ্কার পরিস্ফুটিত হলো। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে ম্যালকমসন, তার বিপরীতে ডানদিকে, ফায়ারপ্লেসের ডানে দেয়ালে ঝুলছে তৃতীয় ছবিখানা। অবাক বিস্ময়ে চোখ ঘষল ম্যালকমসন। একটা বিকট ভয় চেপে বসল ওকে।

ছবির মাঝখানে বাদামি ক্যানভাসম তাতে ব্যাকগ্রাউন্ড আগের মতোই আঁকা আছে, ছবিতে খাড়া পিঠের চেয়ার, চিমনি এবং রশি সবই দেখা যাচ্ছে, কেবল বিচারকের ছবিটি নেই!

ভয়ের শীতল একটা স্রোত ম্যালকমসনকে প্রায় জমিয়ে দিল। সে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। ওর শরীর পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো কাঁপতে লাগল। দেহের সমস্ত শক্তি কে যেন শুষে নিয়েছে, নড়াচড়াও করতে পারছে না। চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতাও হারিয়েছে ম্যালকমসন। সে শুধু দেখছে এবং শুনছে।

কারুকাজ করা ওক কাঠের খাড়া পিঠের প্রকাণ্ড চেয়ারটাতে লাল আলখাল্লা পরা বিচারক বসে আছেন। কুটিল চোখজোড়া প্রতিহিংসায় জ্বলছে, নির্দয় মুখে বিজয়ের দৃঢ় সংকল্পের হাসি ফুটিয়ে তিনি হাতে একটি কালো টুপি তুলে নিলেন।

ম্যালকমসনের মনে হলো ওর বুকের মধ্যে প্রবল বেগে বইছে রক্তস্রোত, প্রলম্বিত সাসপেন্সের সময় মানুষের ভেতরে যেরকম অনুভূতির সঞ্চার ঘটে। তার কানে ঝিনঝিন শব্দ। প্রচণ্ড ঝড়ের হুংকার শুনতে পাচ্ছে ও, বাতাসের গর্জন ছাপিয়ে বাজার এলাকা থেকে ঘড়ির ঘণ্টাধ্বনি ভেসে এল। ঢং ঢং শব্দে ঘোষণা করছে মাঝরাত।

মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকল ম্যালকমসন। যেন অনন্তকাল ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। হাঁ করা মুখ। বিস্ফারিত চোখ। বন্ধ করে আছে নিঃশ্বাস। ঘড়ির ঢং ঢং আওয়াজে বিচারকের মুখের বিজয়ীর হাসিটি তীক্ষ্ণ হলো, শেষ ঘণ্টাটি বাজার পরে তিনি কালো টুপিটি মাথায় পরলেন।

ধীরে সুস্থে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভঙ্গিতে চেয়ার ছাড়লেন তিনি মেঝেয় পড়ে থাকা অ্যালার্ম বেলের খন্ডিত রশিটি তুলে নিলেন। হাত বোলালেন যেন ওটার স্পর্শ উপভোগ করছেন। তারপর রশিটির এক প্রান্তে গিট্টু মেরে তৈরি করতে লাগলেন ফাঁস। টেনেটুনে দেখলেন ফাঁসটি যথেষ্ট মজবুত হয়েছে কিনা। তারপর ওটা নিয়ে এগোলেন ম্যালকমসনের বিপরীত দিকের টেবিল ঘেঁষে। হাঁটার সময় তরুণ হাতটির ওপর অপলক দৃষ্টি থাকল তাঁর। তিনি গিয়ে দাঁড়ালেন দরজার সামনে

ম্যালকমসনের মনে হচ্ছিল সে ফাঁদে পড়েছে। কী করবে চিন্তা করার চেষ্টা করল। বিচারকের চোখে কীরকম যেন আকর্ষণ আছে, চলনশক্তি রহিত করে দেয়। সে একবারের জন্যও বিচারকের চোখ থেকে নিজের চোখ সরাতে পারেনি। যেন বাধ্য হয়েই তাকিয়ে থেকেছে।

বিচারককে এগিয়ে আসতে দেখল ম্যালকমসন। হাতে দড়ির ফাঁস। তিনি রজ্জুটি ছুড়ে দিলেন ওকে লক্ষ্য করে যেন গলায় ফাঁস পরাবেন। বহু কষ্টে এক দিকে ঝট করে সরে গেল ম্যালকমসন। রশিটি গিয়ে পড়ল ওর পাশে। আবার রশি তুলে নিয়ে ওকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করলেন বিচারক। তাঁর হিংস্র, কুটিল চোখ স্থির হয়ে আছে ম্যালকমসনের চোখে। প্রতিবারই বিপুল চেষ্টায় দড়ির ফাঁদ এড়িয়ে গেল তরুণ ছাত্রটি।

এরকম চলল বহুক্ষণ। বারবার ব্যর্থ হলেও বিচারককে হতোদ্যম লাগল না। তিনি যেন ইঁদুর-বেড়াল খেলায় শামিল হয়েছেন। অবশেষে দারুণ হতাশায়, ঘটনা যখন ক্লাইমেক্সে পৌঁছেছে, ম্যালকমসন চট করে একবার চারপাশে নজর বুলিয়ে নিল।

বাতিটি জ্বলছে। ঘরও বেশ আলোকিত। দেয়ালের কাঠের আচ্ছাদনের অসংখ্য ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি মারছে ইঁদুরগুলো। ইঁদুরগুলোকে দেখে যেন একটু স্বস্তি পেল ম্যালকমসন। অ্যালার্ম বেলের খণ্ডিত রশিতে চোখ পড়তে দেখল ওটা ভর্তি হয়ে আছে রাশি রাশি ইঁদুরে। রশির এক ইঞ্চি জায়গা খালি নেই। ঢেকে ফেলেছে ইঁদুরের দল। সিলিং থেকে পিলপিল করে আরও ইঁদুর বেরিয়ে আসছে। ওগুলোর ভারে ঘণ্টাটি দুলতে শুরু করল।

ঘণ্টার সঙ্গে যুক্ত দোলকটি দুলতে দুলতে ঘণ্টা স্পর্শ করল। ছোট্ট একটি শব্দ তুলল। তবে ঘণ্টা মাত্র দুলতে শুরু করেছে। ওটার শব্দ আরও বাড়বে।

ঘণ্টার শব্দে বিচারক, যিনি এতক্ষণ ম্যালকমসনের দিকে নজর রাখছিলেন, মুখ তুলে চাইলেন। তাঁর মুখে ক্রোধ ফুটল। ঘোঁত জাতীয় একটা আওয়াজ করলেন। তাঁর চোখজোড়া জ্বলন্ত কয়লার মতো ধকধক করে জ্বলছে। তিনি এত জোরে পদাঘাত করলেন মেঝেতে, গোটা বাড়ি যেন কেঁপে উঠল

বিকট শব্দে বাজ পড়ল। বিচারক রশিটি আবারও হাতে নিলেন। ইঁদুরগুলো রশি বেয়ে ওপর-নিচ করছে। এবারে রজ্জু না ছুড়ে শিকারের দিকে এগিয়ে গেলেন বিচারক। হাত বাড়িয়ে রেখেছেন ফাঁস। তিনি এগিয়ে আসছেন, তাঁর উপস্থিতির মধ্যে যেন মানুষকে অবশ করে ফেলার একটা শক্তি রয়েছে। ম্যালকমসন স্রেফ একটা লাশের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বিচারকের বরফশীতল আঙুলের স্পর্শ পেল সে গলায় যখন তিনি ওর ফাঁস পরিয়ে দিলেন। ফাঁসটি ক্রমে শক্ত হয়ে ম্যালকমসনের গলায় চেপে বসতে লাগল।

বিচারক আড়ষ্ট হয়ে থাকা তরুণ ছাত্রটিকে কাঁধে তুলে নিলেন। এগোলেন ওক কাঠের চেয়ারটির দিকে। সেখানে ওকে কাঁধ থেকে নামিয়ে দাঁড়া করিয়ে দিলেন। তারপর নিজে ওর পাশে দাঁড়ালেন। হাত বাড়িয়ে অ্যালার্ম বেলের ঝুলতে থাকা রশির মাথাটি ধরলেন। তাঁকে হাত তুলতে দেখে ইঁদুরের দল কিচমিচ করে পালিয়ে গেল। সিলিংয়ের গর্তে সেঁধুল। বিচারক ম্যালকমসনের গলায় পরানো ফাঁসের রজ্জুর শেষ মাথা বেঁধে দিলেন ঘণ্টার সঙ্গে বাঁধা দড়ির সঙ্গে। তারপর চেয়ার থেকে নেমে গেলেন তিনি।

বিচারকের বাড়িতে ঘণ্টা বাজার শব্দে শিগগির লোকজন এসে ভিড় করল। তারা মশাল এবং আলো নিয়ে এসেছে। দরজায় জোরে জোরে ধাক্কাতে থাকল। কিন্তু কোনো সাড়া মিলল না। দরজা ভেঙে ঢুকল তারা, সবেগে প্রবেশ করল প্রকাণ্ড ডাইনিং রুমে, সবার আগে আছেন ডাক্তার থর্নহিল।

ওখানে, বিশাল অ্যালার্ম বেলের রশির শেষ মাথায় গলায় ফাঁস নিয়ে ঝুলছে তরুণ ছাত্রটি। এবং দেয়ালে ঝোলানো বিচারকের ছবির মুখে ফুটে আছে অশুভ হাসি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *