দেবী – ১১

১১

মিসির আলি হাসপাতালে এসেছেন একগাদা বই নিয়ে। তাঁর ধারণা ছিল বই পড়ে সময়টা খুব খারাপ কাটবে না। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সে-রকম হয় নি। ডাক্তাররা বই পড়তে নিষেধ করেন নি, কিন্তু দেখা গেল বই পড়া যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই মাথার ভেতর ভোঁতা এক ধরনের যন্ত্রণা হয়। যন্ত্রণা নিয়ে বই পড়ার কোনো মানে হয় না। তবু তিনি মৃত্যু-বিষয়ক একটি বই পড়ে ফেললেন, এবং মৃত্যু ব্যাপারটিতে যথেষ্ট উৎসাহ বোধ করতে লাগলেন। তাঁর স্বভাবই হচ্ছে কোনো বিষয় একবার মনে ধরে গেলে সে-বিষয় সম্পর্কে চূড়ান্ত পড়াশোনা করতে চেষ্টা করেন।

মৃত্যু সাবজেক্টটি তাঁর পছন্দ হয়েছে, কিন্তু এ-বিষয়ে পড়াশোনা করতে পারছেন না। বইপত্র নেই। ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে কিছু থাকার কথা, কিন্তু আনাবেন কাকে দিয়ে? তাঁকে কেউ দেখতে আসছে না। তিনি এমন কোনো জনপ্রিয় ব্যক্তি নন যে তাঁর অসুস্থতার খবরে মানুষের ঢল নামবে। তা ছাড়া অসুখের খবর তিনি কাউকে জানান নি। হাসপাতালে ভর্তি হবার ইচ্ছাও ছিল না। কিন্তু ঘরে দেখাশোনার লোক নেই। কাজের মেয়েটি তিনি মধুপুর থাকাকালীন বেশ কিছু জিনিসপত্র নিয়ে ভেগে গেছে। এমন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ছাড়া উপায় কী?

বিকালবেলা তাঁর কাছে কেউ আসে না। সবারই আত্মীয়স্বজন আসে দেখতে, তাঁর কাছে কেউ আসে না। এই সময়টা তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকেন এবং এখনো মানুষের সঙ্গ পাবার জন্যে তাঁর মন কাঁদে দেখে নিজের কাছেই লজ্জিত বোধ করেন।

আজ সারা দিন মিসির আলির খুব খারাপ কেটেছে। তাঁর রুমমেট ছাব্বিশ বছরের ছেলেটি সকাল ন’টায় বিনা নোটিসে মারা গেছে। মৃত্যু যে এত দ্রুত মানুষকে ছুঁয়ে দিতে পারে তা তাঁর ধারণাতেও ছিল না। ছেলেটা ভোরবেলায় নাশতা চেয়েছে, তার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথাবার্তাও বলেছে। তিনি জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আজ কেমন আছ?’

‘আজ বেশ ভালো।’

‘লিভার ব্যথা করছে না?’

‘নাহ্, তবে তলপেটের দিকে একটা চাপা ব্যথা আছে।’

‘খুব বেশি?’

‘না, খুব বেশি না। আপনি এটা কী বই পড়ছেন?

‘এটা একটা সায়েন্স ফিকশন—’ফ্রাইডে দি থার্টিন্থ’। বেশ ভালো বই। তুমি পড়বে?’

‘জ্বি-না। ইংরেজি বই আমার ভালো লাগে না। বাংলা উপন্যাস পড়ি।

‘কার লেখা ভালো লাগে? এ-দেশের—মানে বাংলায়, কার লেখা তোমার পছন্দ?’

‘নিমাই ভট্টচার্য।’

‘তাই নাকি?’

ছেলেটি আর জবাব না দিয়ে কাত্রাতে থাকে। সকাল সাড়ে আটটায় বলল, ‘এক জন ডাক্তার পাওয়া যায় কি না দেখবেন?’ তিনি অনেকক্ষণ বোতাম টিপলেন, কেউ এল না। শেষ পর্যন্ত নিজেই গেলেন ডিউটি রুমে। ফিরে এসে দেখেন ছেলেটি মরে পড়ে আছে।

মৃত্যুর সময় পাশে কেউ থাকবে না, এর চেয়ে ভয়াবহ বোধহয় আর কিছু নেই। শেষ বিদায় নেবার সময় অন্তত কোনো-একজন মানুষকে বলে যাওয়া দরকার। নিঃসঙ্গ ঘর থেকে একা-একা চলে যাওয়া যায় না। যাওয়া উচিত নয়। এটা হৃদয়হীন ব্যাপার।

এত দিন যে-ছেলেটি ছিল, এখন আর সে নেই। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই তার সমস্ত চিহ্ন এ-ঘর থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বিছানায় নতুন বালিশ ও চাদর দিয়ে গেছে—হয়তো সন্ধ্যার মধ্যে কোনো নতুন পেশেন্ট এসে পড়বে।

মিসির আলি সমস্ত দিন কিছু খেতে পারলেন না। বিকেলের দিকে তাঁর গায়ে বেশ টেম্পারেচার হল। প্রথম বারের মতো মনে হল একজন—কেউ তাঁকে দেখতে এলে খারাপ লাগবে না। ভালোই লাগবে। কেউ না-এলে এক জন রোগী হলেও আসুক, একা-একা এই কেবিনে রাত কাটানো যাবে না। ঠিক এই সময় ইতস্তত ভঙ্গিতে রানু এসে ঢুকল।

‘আপনি ভালো আছেন?’

‘না, ভালো না। তুমি কোথেকে?’

‘বাসা থেকে। ইস্! আপনার এ কী অবস্থা।’

‘অবস্থা খারাপ ঠিকই। আনিস সাহেব কোথায়?

‘ও আসে নি, আমি একাই এলাম। ওর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়েছি।’

‘বস তুমি। ঐ চেয়ারটায় বস। ফ্লাস্কে চা আছে। খেতে চাইলে খেতে পার।’

‘উঁহু, চা-টা খাব না। আপনার কাছে একটা খবর জানতে এসেছি।’

‘কোন খবরটি?’

‘মধুপুরে গিয়ে আপনি কী জানলেন?

‘তেমন কিছু জানতে পারি নি।’

‘তবু যা জেনেছেন তা-ই বলুন। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছে। অনুফা লিখেছে, আপনি নাকি হাজার-হাজার মানুষকে নানা রকম প্রশ্ন করেছেন।’

মিসির আলি হাসলেন।

‘হাসলে হবে না, আমাকে বলতে হবে।’

‘প্রথম যে জিনিসটি জানলাম—সেটি হচ্ছে, তুমি অনেকগুলো ভুল তথ্য দিয়েছ।’

‘আমি কোনো তথ্য দিই নি।’

‘তুমি নিজে হয়তো জান না সেগুলো ভুল। যেমন পায়জামা খোলার ব্যাপারটি–এ-রকম কোনো কিছু ঘটে নি।‘

রানু চোখ লাল করে বলল, ‘ঘটেছে।’

‘না রানু, ঘটে নি। এটা তোমার কল্পনা। তা ছাড়া তুমি উলঙ্গ একটি ডেড বডির কথা বলেছ—সেটাও ঠিক না।’

‘কিন্তু আমি জানি, এগুলো ঠিক।’

‘না রানু। এইসব তুমি নিজে ভেবেছ এবং আমার ধারণা এ-জাতীয় স্বপ্ন তুমি মাঝে-মাঝে দেখ। দেখ না?’

‘কী রকম স্বপ্নের কথা বলছেন?’

মিসির আলি কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করলেন। স্পষ্ট গলায় বললেন, ‘তুমি প্রায়ই স্বপ্ন দেখ না—এক জন নগ্ন মানুষ তোমার কাপড় খোলার চেষ্টা করছে?’

রানু উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে থাকল।

‘বল রানু। জবাব দাও।’

‘হ্যাঁ, দেখি।’

‘কখনো কি ভেবে দেখেছ এ-রকম স্বপ্ন কেন দেখ?’

‘না, ভাবি নি।’

‘আমি ভেবেছি। এবং কারণটাও খুঁজে বের করেছি। আজ সেটা বলতে চাই না, অন্য এক দিন বলব।’

‘না, আপনি আমাকে আজই বলেন।’

মিসির আলি ফ্লাস্ক থেকে চা ঢাললেন। শান্ত স্বরে বললেন, ‘চা খেতে-খেতে শোন। চায়ে ক্যাফিন আছে। ক্যাফিন তোমার নার্ভগুলোকে অ্যাকটিভ রাখবে।’

রানু চায়ের পেয়ালা নিল, কিন্তু চুমুক দিল না। মাথা নিচু করে বসে রইল। মিসির আলি ঠাণ্ডা গলায় বলতে লাগলেন, ‘রানু, তোমাকে নিয়ে এই গল্পটি আমি তৈরি করেছি। তুমি মন দিয়ে শোন। তুমি যখন বেশ ছোট—নয়, দশ বা এগার বছর বয়স, তখন এক জন বয়স্ক লোক তোমাকে ভুলিয়েভালিয়ে নির্জন কোনো জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। তোমাদের গ্রামে এ-রকম একটা নির্জন জায়গার খোঁজে আমি গিয়েছিলাম। সেখানে জঙ্গলের কাছে একটা ভাঙা বিষ্ণুমন্দির দেখেছি। মনে হয় ঐ জায়গাটাই হবে। কারণ সাপের ভয়ে ওখানে কেউ যেত না। রানু, তুমি কি আমার কথা শুনছ?’

‘শুনছি।’

‘তারপর সেই বয়স্ক মানুষটি মন্দিরে তোমাকে নিয়ে গেল।

‘আমাকে কেউ নিয়ে যায় নি। আমি নিজেই গিয়েছিলাম। ঐ মন্দিরে খুব সুন্দর একটি দেবীমূর্তি আছে। আমি ঐ মূর্তি দেখার জন্যে যেতাম।’

‘তারপর কী হয়েছে, বল।’

রানু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তীব্র স্বরে বলল,’আমি বলব না, আপনি বলুন।’

মিসির আলি শান্ত স্বরে বললেন, ‘ঐ লোকটি তখন টেনে তোমার পায়জামা খুলে ফেলল।’

রানুর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।

‘ঐ লোকটির নাম ছিল জালালউদ্দিন।’

রানু কিছু বলল না। মিসির আলি বললেন, ‘তোমার অসুখ শুরু হল সেদিন থেকে। তোমার মনের মধ্যে ব্যাপারটি গেঁথে গেল, পরবর্তী সময়ে গোসলের সময় যখন মরা মানুষটি তোমার পায়ে লেগে গেল, তখন তোমার মনে পড়ল মন্দিরের দৃশ্য। বুঝতে পারছ?’

রানু জবাব দিল না।

‘অসুখের মূল কারণটি আলোয় নিয়ে এলেই অসুখ সেরে যায়; এ-জন্যেই আমি এটা তোমাকে বললাম। তুমি নিজেও এখন গোড়া থেকে সমস্ত ব্যাপারটি নিয়ে চিন্তা করবে। তোমার অসুখ সেরে যাবে।’

রানু মৃদু স্বরে বলল, ‘আপনি কি ঐ লোকটির সঙ্গে কথা বলেছেন?’

‘বলেছি।’

‘ও কী বলেছে?’

‘তেমন কিছু বলে নি।’

‘না, বলেছে, আপনি আমাকে বলতে চাচ্ছেন না। এতটা যখন বলেছেন, তখন বাকিটাও বলুন।’

রানু তীব্র চোখে তাকাল। মিসির আলি বললেন, ‘দেখ রানু, আমি খুবই যুক্তিবাদী মানুষ। অলৌকিক কোনো কিছুতে বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি সব কিছুরই একটি ব্যাখ্যা আছে। জালালউদ্দিন যা বলেছে, তাও নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা করা যায়।’

‘ব্যাখ্যা পরে করবেন। আগে বলুন, সে কী বলেছে।’

‘সে বলেছে, হঠাৎ সে দেখে মূর্তিটি ছুটে এসে তোমার মধ্যে মিলিয়ে গেছে। তোমার গা থেকে আগুনের হল্কা বেরুচ্ছে। জালালউদ্দিন তখন ছুটে পালিয়ে যায়।

‘আপনি জালালউদ্দিনের কথা বিশ্বাস করেন না?’

‘না। ওর মনে পাপবোধ ছিল। মন্দিরটন্দির নিয়ে মূর্খ মানুষদের মনে অনেক রকম ভয়-ভীতি আছে। তা থেকেই সে একটা হেলুসিনেশন দেখেছে। তুমি নিজে তো কিছু দেখ নি।’

‘না।’

‘তাহলেই হল। জালালউদ্দিন কী দেখেছে না দেখেছে, সেটা তার প্রবলেম, তোমার নয়।

রানু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘কিন্তু একটা জিনিস কি জানেন? ঐ ঘটনার পর থেকে আমি অসম্ভব সুন্দর হয়ে গেলাম।’

মিসির আলি শব্দ করে হাসলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘সুন্দর তুমি সব সময়ই ছিলে। ঘটনাটি ঘটেছে তোমার বয়ঃসন্ধিতে। বয়ঃসন্ধির পর মেয়েদের রূপ খুলতে শুরু করে। এখানেও তাই হয়েছে।’

‘কিন্তু ঐ দেবীমূর্তিটিকে এর পর আর খুঁজে পাওয়া যায় নি।’

‘তুমি কিন্তু খুব ছেলেমানুষের মতো কথা বলছ রানু। মূর্তিটি চুরি গেছে, কেউ নিয়ে পালিয়ে গেছে, ব্যস।’

‘মূর্তিটি চুরি যায় নি।’

‘তুমি নিশ্চয়ই বিশ্বাস কর না—একটা পাথরের মূর্তি তোমার মধ্যে ঢুকে আছে? কি, কর?’

রানু তীব্র কণ্ঠে বলল, ‘আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলুন, আমাকে কি অনেকটা মূর্তির মতো দেখায় না?’

‘না রানু, মূর্তির মতো দেখাবে কেন? অসম্ভব রূপবতী একটি তরুণী—এর বেশি কিছু না। তোমার মতো রূপবতী মেয়ে এ-দেশেই আছে এবং তারা সবাই রক্ত— মাংসের মানুষ।’

রানু উঠে দাঁড়াল। মিসির আলি বললেন, ‘চলে যাচ্ছ রানু?’

‘হ্যাঁ।’

‘অসুখ সারলে তোমাদের ওখানে একবার যাব।’

‘না, আপনি আসবেন না। আপনার আসার কোনো দরকার নেই।

রানু ঘর ছেড়ে চলে গেল। মিসির আলি ক্ষীণস্বরে বললেন, ‘ভেরি ইন্টারেস্টিং।’ তাঁর ভ্রূ কুঞ্চিত হল। তিনি ব্যাপারটি ঠিক বুঝতে পারছেন না। যতটা সহজ মনে হয়েছিল এখন ততটা মনে হচ্ছে না। তিনি মৃত্যু-বিষয়ক বইটি আবার পড়তে শুরু করলেন। সাবজেক্টটি তাঁকে বেশ আকর্ষণ করেছে। ফ্যাসিনেটিং টপিক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *