জ্বালা – ১৬

ষোলো

মেলোডি চিনতে পারল না সাওলোকে। ওর শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, প্রচণ্ড মারে কালশিটে পড়ে গেছে সারা গায়ে। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে ও, কাতরাচ্ছে। সাওলো ওর গায়ে হাত দেয়া মাত্র আতঙ্ক আর যন্ত্রণায় তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে এল ওর গলা দিয়ে।

পাঁজরের অন্তত তিনটে হাড় ভেঙেছে ওর। পুলটিশ দিয়ে ব্যথা কিংবা জ্বর কমাবার খুব একটা সম্ভাবনা দেখল না সাওলো। তবু কিছু গুল্মের সন্ধানে গুহা থেকে ক্যানিয়নে বেরিয়ে এল।

ক্যানিয়ন থেকে অনেক দূরে, যেখানে আম্বারগো তাদের ছেড়ে এসেছিল মেলোডিকে নিয়ে, ওখানেই ইন্ডিয়ানদের ঘোড়াগুলোকে দেখতে পেল সে। ওর মাথায় প্রথম যে চিন্তাটা এল, সেটা হলো ঘোড়া মানেই পালানোর একটা উপায়। কিন্তু ওটা ওর একার জন্যেই। ঘোড়া চালানোর মত অবস্থা মেলোডির নেই। ওকে নিতে হলে ঘোড়ায়-টানা গাড়ির মত কিছু একটা বানাতে হবে। কিন্তু তাতে অন্য সমস্যা আছে। মেলোডির পাঁজরের হাড় ভাঙা ছাড়া অভ্যন্তরীণ অন্য কোনও ক্ষতি হয়েছে কি না ও জানে না। সেরকম কিছু হলে সামান্য নড়াচড়াও ওর জন্যে মারাত্মক হতে পারে; ব্যাপারটা ওকে খুন করার শামিলই হবে। তাছাড়া ওতে সময়ও লাগবে প্রচুর, কিছুদূর যেতে না-যেতেই কুরিয়াপোর হাতে ধরা পড়ে যাবে ওরা।

অবশ্য ও একা ট্যুবাক থেকে সাহায্য নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু তাতে কমপেক্ষ দু’দিন সময় লাগবে। এখন কুরিয়াপো খুব বেশি হলে ঘণ্টাখানেকের পথ দূরে আছে। ও ফিরে আসার অনেক আগেই কুরিয়াপো ক্যানিয়নে পৌঁছে এখানে কী ঘটেছিল বুঝে নেবে। এক পর্যায়ে সে গুহাটাও পেয়ে যাবে। তার অর্থ…

তবে এটাও ঠিক, কুরিয়াপোর ভয় যদি না-ও থাকত তবু মেলোডির এ- অবস্থায় ওকে একা রেখে যাবার কথা ভাবতে পারত না সে। অতএব ওকে মেলোডির সঙ্গেই থাকতে হবে—এবং এর মানে হলো কুরিয়োপো যখন এখানে পৌঁছে যাবে সদলবলে, দু’জনকেই মরতে হবে ওদের হাতে।

গুহায় ফিরল সাওলো। গুল্মগুলো পাথরে ছেঁচে পুলটিশ বানাতে বানাতে পরিস্থিতি খতিয়ে বিচার করতে লাগল। কুরিয়াপোকে ধোঁকা দেবার জন্যে কিছু কাজ সে করতে পারে। যেমন, অ্যাম্বারগোকে কবর দেয়া, গুহামুখ এবং কাছে-পিঠের ট্র্যাকগুলো মুছে ফেলা ইত্যাদি। তবে এগুলো খুব একটা কাজে দেবে বলে মনে হয় না। কুরিয়াপো বোকা নয়-অত সহজে ওকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ও আর ওর মরুচর সহযোদ্ধাদের পক্ষে প্রকৃত ব্যাপারটা বুঝতে মিনিটখানেকের বেশি লাগবে না।

কাজে দেবার মত আরেকটা উপায়ের কথা ভাবছে সে। তবে এতে প্রচুর ঝুঁকি আছে, বলতে গেলে সূক্ষ্ম একটা তারের ওপর দিয়ে হাঁটার মত। কিন্তু ঝুঁকিটা নেবে সে।

.

মধ্যাহ্নের কড়া রোদে চারদিকের উলঙ্গ পাথরের গা থেকে তাপ যখন ঠিকরে বেরোচ্ছে, ঠিক সে সময়টায় এল ওরা। সাতজন অ্যাপাচি যোদ্ধা; পথশ্রমে ক্লান্ত, কৃশ আর তীব্র প্রতিশোধ সংকল্পে নির্মম চেহারা ওদের। নিষ্ঠুরভাবে খাটিয়ে নিজেদের ঘোড়াগুলোকে ওরা মেরেই ফেলেছে প্রায়।

গুহার বাইরে ক্যানিয়নে অপেক্ষা করছে সাওলো। নিরস্ত্র সে, ওর রাইফেল, পিস্তল আর ছোরা পড়ে আছে পায়ের কাছে মাটিতে। সাওলো জানে, দেখামাত্রই ওকে গুলি করবে না অ্যাপাচিরা। শত্রুকে অত আরামে মরতে দিতে রাজি নয় ওরা। ওর খালি দু’হাত ঝুলছে দু’পাশে, অস্ত্র পড়ে আছে মাটিতে—সুতরাং অ্যাপাচিরা ওর কাছে চলে আসতে দ্বিধা করবে না। ফলে ওদের সাথে কথা বলার মত একটা সুযোগ পাওয়া যেতে পারে।

অ্যাপাচিরা ওর চারপাশে সামান্য দূরত্বের মধ্যে এসে দাঁড়াল। নিরস্ত্র শত্রুকে এ-অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভাবছে, এটা কোনও চালাকি কি না। ঘোড়া থেকে নামল কুরিয়াপো, লাগামটা একজন সঙ্গীর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে সামনে এগোল।

কয়েক বছর পর নিজের সৎভাইকে দেখল সাগুলো। এখন তারা দাঁড়িয়েছে মুখোমুখি। সাওলোর মনে অসংখ্য স্মৃতি এসে জড়ো হলো, যেগুলোর প্রত্যেকটি ভয়াবহ ধরনের শত্রুতা আর তিক্ততার। ওর ভেতর জেগে উঠল কয়োটের উল্লাস, যে-ভাবেই হোক, আজ মীমাংসা হতে যাচ্ছে তীব্র দ্বন্দ্ব আর ঘৃণার।

কুরিয়াপো লম্বা নয়, গাট্টাগোট্টা চেহারার। ওর ঘাড়, পিঠ আর বুক পেশীবহুল, মাংসল, ঊর্ধ্বাংশের তুলনায় পা দুটো সরু, লম্বা। গায়ের আঁটসাঁট কালিকো শার্ট স্বাস্থ্যের প্রাচুর্যকে না ঢেকে বরং আরও বেশি দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তুলেছে। ওর হাতদুটো হাঁটুসমান লম্বা, মাথা বিশাল। মুখ চৌকো ও নিষ্ঠুর ধরনের।

‘মরতে চাও, না?’ কথা বলল কুরিয়াপো। ‘ব্যাপারটা খুব সহজ কিন্তু!’ ওর কণ্ঠে ব্যঙ্গ।

‘না,’ সাওলো বলল। আমার কিছু বক্তব্য আছে।’

‘তোমার কোনও বক্তব্য থাকা উচিত নয়, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল কুরিয়াপো। একজন অ্যাপাচিরই শুধু কথা বলার অধিকার থাকে।

‘আমার গায়েও অ্যাপাচি-রক্ত আছে। তাই আমারও কথা বলার অধিকার আছে।’

বাকিরা সামনে বাড়ল। দু’জনকে ঘিরে অবস্থান নিল সবাই। শুনছে ওরা কঠিন, সতর্ক মুখে। ওদের মধ্যে নেপুতেকে দেখে খুশি হলো সাগুলো।

‘মিথ্যা কথা, দাঁতে দাঁত ঘষল কুরিয়াপো, ‘আমি বলছি, তুমি মিথ্যে বলছ! তোমার মা ছিল একটা শাদাচোখো বেশ্যা আর তুমি নিজে শাদাদের মত চলাফেরা করো। তোমাদের শাদাদের মুখে আমি থুতু দিই।’

‘আমি একজন যোদ্ধা, দৃঢ়স্বরে বলল সাওলো। আমি চুড়োয় উঠে বাতাসে অর্ঘ্য দিয়েছি, উ-সেন এবং চার বায়ুদেবতার উপাসনা করেছি। একজন মানুষ যখন এসব করে, তার গা থেকে তখন শাদাদের অপবিত্র রক্ত ধুয়ে মুছে যায়।’

মিথ্যে বলছে না সাওলো, উপস্থিত সবাই তা জানে।

নেপুতে চিন্তিত স্বরে বলল, তুমি অ্যাপাচিদের রক্ত ঝরিয়েছ, বাছা, তাদের শত্রুদের নয়।’

‘এটা ঠিক না। সেটা তুমিও জানো, নেপুতে। একবার সনোরায় শত্রুরা আমাদের ক্যাম্পে হামলা চালালে আমি ওদের একজনকে রাইফেলের গুলিতে মেরেছিলাম। আমার বয়স তখন বারো।’

স্বীকৃতিসূচক ভঙ্গি করল নেপুতে, ‘হ্যাঁ, এটা সত্যি।

আরেকবার এক শাদাচামড়ার লোককেও আমি মেরেছিলাম,’ সাওলো আবার বলল। ‘ও আমাকে অ্যাম্বুশ করতে চেয়েছিল লুটপাটের উদ্দেশ্যে।’

‘হ্যাঁ, তুমি আমাদের শত্রুদের খুন করেছ, গম্ভীরকণ্ঠে বলল নেপুতে। ‘কিন্তু তুমি আমাদের রক্তও ঝরিয়েছ।

‘তা ঠিক,’ অস্বীকার করল না সাওলো। অ্যাপাচিরা নিজেদের মধ্যেও খুনোখুনি করে। বে-দোন-কি-হি নেদ-নি’দের রক্ত ঝরায়, নেদ-নি’রা ছো- কোন-এন’দের খুন করে। ছো-কোন-এন’রাও বে-দোন-কি-হি বা নেদ- নি’দের ছেড়ে কথা কয় না। আমি একজন বে-দোন-কি-হি, নিজেদের মধ্যে লড়াইয়েই আমি নিজেদের লোক খুন করেছি।’

মাথা নিচু করে ভাবল একটু নেপুতে। তারপর বলল, ‘এটা সাওলো আর কুরিয়াপোর ব্যাপার। সর্দার জারিপোর দুই ছেলের নিজেদের মধ্যেকার লড়াই।’ প্রত্যেকের দিকে চাইল ও একবার করে। ‘আমরা এর মধ্যে থাকব না।’ ঘোষণা করল সে, ‘এটাই হলো আইন।’

ঘোড়া থেকে নামল ও। সাওলোর অস্ত্রগুলো যেখানে পড়েছিল ওখানে গিয়ে কুড়িয়ে নিল ওগুলো। তারপর সাওলোর ছোরাটা মাটিতে গাঁথল। কুরিয়াপোর ছোরাটার জন্যে পা বাড়াল ওর দিকে, সরে গেল কুরিয়াপো।

‘এটাই আইন,’ গুরুগম্ভীর স্বরে বলল একজন বিশালদেহী অ্যাপাচি।

আবার এগোল নেপুতে। এবার আর আপত্তি করল না কুরিয়াপো। খাপ থেকে ছোরাটা টেনে নিল নেপুতে, তারপর ছুঁড়ে মারল ওটা সাওলোরটার পাশে। দুটো ছুরিই পাশাপাশি গেঁথে রইল একফুটের ব্যবধানে, উভয়ের কাছ থেকে সমান দূরত্বে।

নাক দিয়ে প্রচণ্ড বেগে শ্বাস টেনে নিয়ে ফের দ্বিগুণ বেগে ছেড়ে দিল সাওলো। দারুণ স্বস্তিবোধ করছে ও এখন। নেপুতেকে ধন্যবাদ জানাল মনে মনে। ওর যথাসময়ে যথাযথ কর্তৃত্বপূর্ণ হস্তক্ষেপ কুরিয়াপোর বিরুদ্ধে সমান সুযোগ পাইয়ে দিয়েছে ওকে।

নিজ নিজ ঘোড়াগুলো পিছিয়ে নিয়ে বৃত্ত বড় করে তুলল অ্যাপাচি যোদ্ধারা। মাঝখানে সাওলো আর কুরিয়াপো।

মরচে-পড়া লোহার মত বাদামী কুরিয়াপোর মুখের রঙ। ওর উচ্চতা সাওলোর সমান, তবে ওজন কমপক্ষে দেড়গুণ বেশি। হাতদুটো সাঁড়াশীর মত; প্রবল পেষণে যে কারও পাঁজর গুঁড়িয়ে দেয়ার মত অমিত শক্তিশালী।

ছোরার জন্যে দু’জনের যে কোনও একজনকে আগে চেষ্টা চালাতে হবে। তা করতে হলে সামান্য সময়ের জন্যে মাথা বা পিঠ নিচু করতে হবে। নিয়তির মত সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সমান সে-সময়টুকুই জয় পরাজয়ের নির্ধারক হতে পারে।

কুরিয়াপোই ঝাঁপ দিল প্রথমে ওর চুরির উদ্দেশে। পেশীবহুল হাতদুটো টান-টান করে আঙুল দিয়ে ছোরার বাঁট ছুঁতে গেল, সাথে সাথে এক পা চালাল সাওলোর ছুরি লক্ষ্য করে, পরক্ষণেই অন্য বাহুটা চালাল ওপর দিকে ভয়ঙ্কর বেগে। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গুঙিয়ে উঠল কপালে সাওলোর ঝেড়ে দেয়া মোক্ষম লাথি খেয়ে, উল্টে পড়ল একদিকে; যতটা না ব্যথা, তার চেয়ে বেশি আঘাত পাওয়ার ভান করে অনড় হয়ে রইল।

নিজের ছুরিটা তুলতে গেল সাওলো তড়িৎবেগে। কুরিয়াপোর পা ছুরি থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে পড়ে আছে। সাওলো ছুরিটা তুলে নিয়ে পুরোপুরি সোজা হবার আগেই শরীর বাঁকিয়ে ছেড়ে দেয়া স্প্রিঙের মত ওপর দিকে লাফাল কুরিয়াপো। ওর শরীরের ধাক্কা সাওলোর ছুরিধরা হাতটায় লাগল। যথাসময়ে হাত সরিয়ে নিতে পারল না সাওলো, নিজের পাঁজরে নিজের ছুরির খোঁচা খেল। মোকাসিন-পরা পায়ের লাথি হাঁকাল ও কুরিয়াপোর পাঁজরে, আবার তুলল মাথা সই করে, কিন্তু নিজের গতির দমকে ভূমিতে পড়ে যাওয়ায় ওর পা কুরিয়াপোর মাথার নাগাল পেল না।

ডিগবাজি খেল কুরিয়াপো, উঠে দাঁড়াল, সবেগে ছুটে এল সাওলোর দিকে। ঝিলিক দিয়ে উঠল ওর হাতে অর্ধবৃত্তাকারে ঘোরানো ছুরির ফলা। পিছিয়ে গেল সাওলো, ঘুরল বৃত্তাকারে।

সাওলোর মত ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের যোদ্ধা নয় কুরিয়াপো। নিজের নির্মম আর হিংস্র মনোভাব ওকে অস্থির করে তুলেছে। সাওলো বুঝতে পারছে তা। অপেক্ষা করছে, কুরিয়াপোর পরবর্তী পদক্ষেপের জন্যে। পদক্ষেপ নিতে দেরি করল না অ্যাপাচি প্রধান; দ্রুতবেগে ধেয়ে এল ছুরিহাতে। চোখের পলকে হাতের তালুতে উল্টে নিল ওটা। ফলাটা বিধিয়ে দিয়ে হ্যাঁচকা টান দেবার ভঙ্গিতে ধরা ওর হাতে এখন ছুরির বাঁট।

বিদ্যুদ্বেগে এগিয়ে এসে এক হাতে থাবা বসাল সাওলো কুরিয়াপোর হাতে, পরক্ষণেই সরে যেতে যেতে নিজের ছুরিটা চালাল ওর বাহুতে, টান দিল নিচের দিকে

ছুরি পড়ে গেল কুরিয়াপোর অসাড় হাত থেকে। তবে ধেয়ে এল সে। ব্যাপারটা চুকিয়ে দেবার জন্যে সাওলো নিজেও এগোল। কুরিয়াপো ওর চুরি-ধরা হাতের কবজি চেপে ধরল। ওর শক্ত হাতের চাপ সাওলোর কবজিতে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা ছড়িয়ে দিতে লাগল। দানবীয় শক্তিতে ওর হাতে ঝাঁকুনি দিল কুরিয়াপো। সাওলোর মনে হলো, বাহুমূল উপড়ে যেন চলে আসবে ওটা আর দুটো ঝাঁকুনি দিলে।

তবু হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল না সাওলো। আস্তে করে ভিড়ে গিয়ে ওর পায়ের গোড়ালির সঙ্গে পা আটকে নিল। কুরিয়াপোর হাত আরও চেপে

• বসছে। নখ গেঁথে যাচ্ছে মাংসের ভেতর। আচমকা সামনের দিকে ঠেলা দিল সাওলো। টাল সামলাতে না পেরে চিৎ হয়ে পড়ল কুরিয়াপো। সাওলো নিজেও ওর ওপর গিয়ে পড়ল। প্রবল শক্তিতে গড়ান দিল কুরিয়াপো, সাওলোকে নিচে ফেলে ওর বুকের ওপর চেপে বসতে গেল, পরমুহূর্তে কেঁপে উঠল আপাদমস্তক।

সাওলো ছুরিটা পুরো ঢুকিয়ে দিয়েছে ওর পাঁজরে।

অনেক কষ্টে ওকে নিজের ওপর থেকে সরাল সাওলো। উঠে দাঁড়াল ‘কুরিয়াপোর বন্ধুরা যদি কেউ লড়তে চাও,’ চারদিকে গোল হে দাঁড়ানো অ্যাপাচি যোদ্ধাদের দিকে চাইল সাওলো, ‘এসে যাও।’

অনেকটা জেদের বশেই কথাগুলো বলল সাওলো। কুরিয়াপো ওর বৈমাত্রেয় ভাই। জারিপো কখনও ওকে সন্তান বলে স্বীকার করেনি। কুরিয়াপো সেই ছোটবেলা থেকেই বিদ্রূপ করে এসেছে ওকে শাদা চোখো বেশ্যার বাচ্চা’ বলে। বয়স হবার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রূপ আর ঘৃণা দুটোই বেড়েছে ওর। ওকে হত্যা করে নিজের জ্বালা কিছুটা হলেও মেটাবার প্রতিজ্ঞা করেছিল ও; আজ সেটা মিটিয়েছে। জ্বালা কমছে ধীরে ধীরে।

‘শেষ,’ বলল নেপুতে।

পারিবারিক কোন্দলের চেয়ে বড় ছিল এই বিবাদ। জারিপোর প্রত্যাশিত শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলো এবার। তবে এর মূলে রইল এক ছেলের ছোরা আর এক ছেলের রক্ত।

ঘোড়া থেকে নামল অ্যাপাচিরা। কুরিয়াপোর মৃতদেহটা তুলে ঘোড়ার সাথে বেঁধে নিল, তারপর ঘোড়াটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল নিচের ক্যানিয়নের দিকে। ওখানে কোথাও ইন্ডিয়ানদের গোপন সমাধিস্থল আছে নিশ্চয় 1 সমাধিস্থলটা কেবল নামী ইন্ডিয়ান যোদ্ধাদের জন্যেই। জায়গাটার সন্ধান ইন্ডিয়ান ছাড়া আর কেউ জানে না।

.

সারাদিন মেলোডির সঙ্গে কাটাল সাওলো। ওকে পুলটিশ বেঁধে দিল, হুঁশ ফিরে আসার পর পানি খাওয়াল। সন্ধের সময় ওর প্রলাপ বকা বন্ধ হয়ে গেল, জ্বরও কমে গেল কিছুটা। কোনওমতে কথা বলার শক্তি পেল সে। সদ্যোজাত মুরগির বাচ্চার মত চিঁ-চিঁ করে বলল, ‘তোমাকে ধন্যবাদ জানানো উচিত। কিন্তু…ঠিক কী বলে…’

‘বাদ দাও,’ সাওলো যেন পরামর্শ দিচ্ছে ওকে।

‘কখনও তা পারব না।…তুমি আমার পাশে রয়ে গেছ, এ-পর্যন্ত আর কেউ থাকেনি।

সাওলো মেলোডিকে বলতে চাইছিল ব্যাপারটাকে অত বড় করে না দেখার জন্যে, কিন্তু কিভাবে বলতে হয়, বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল।

পরে ভেবে বলল, ‘আসলে কিছু ভুল লোকের সঙ্গেই তোমার জীবন কেটেছে অ্যাদ্দিন, ম্যাম। এটাই হলো ব্যাপার।’

‘হয়তো,’ বলল মেলোডি, ‘সাওলো, আমি তোমাকে আরও জানতে চাই।’

কিন্তু শব্দ করে বলল না ও কথাগুলো। কিংবা বলতে পারল না।

ও একটা কম্বলের নিচে শুয়ে আছে। কাছেই আগুন জ্বলছে। ওদিকে চাইল মেলোডি। ধোঁয়া উঠছে, ওপরে উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে আকাশে। এক সময় সাওলোকে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যাবে তুমি?’

‘যাবার মত তেমন জায়গা নেই কোথাও,’ জানাল সাওলো। তবে তুমি পুরোপুরি সুস্থ না-হওয়া পর্যন্ত নড়ছি না এখান থেকে। তুমি সুস্থ হয়ে ওঠার পর একটা ঘোড়া আর…’

‘আমি তা জানতে চাচ্ছি না, সাওলো। তুমি নিজেও তা জানো।’

অস্থির ভঙ্গিতে নড়ে উঠে পায়ের গোড়ালির ওপর বসল সাওলো। ছুরির আঘাত ওর গায়েও ক্ষতের সৃষ্টি করেছে কম-বেশি। রক্ত শুকিয়ে গেছে জামায়। ‘আমি চলার ওপর থাকব। বেশিদিন থাকব না কোথাও। হাঁটতে শুরু করব ফের।’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে,’ ওকে থামিয়ে দিল মেলোডি। ‘বুঝতে পেরেছি। আসলে আমারই ভুল। হয়তো একটু বেশি কল্পনা করে ফেলেছিলাম….

‘আমি ঠিক তা বলছি না।’

‘আমি জানি। তুমি তোমার মত চলবে এবং অন্যদেরও তাদের মত করে চলতে বলবে, এই তো?’

‘তুমি বুঝছ না, ম্যাম। আমি একজন দোআঁশলা। শাদাদের কাছেও, ইন্ডিয়ানদের কাছেও। আর তুমি একজন চমৎকার অপূর্ব সুন্দরী মহিলা।’

কম্বলের ভেতর থেকে একটা হাত বের করল মেলোডি, রাখল সাওলোর হাঁটুতে। হাসল একটু। আর তুমি একজন চমৎকার, সুন্দর বাদামী পুরুষ। কী বলো?’

ওর দিকে তাকিয়ে রইল সাওলো। শারীরিকভাবে অত্যাচারিত আর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মেয়েটির মুখ রক্তহীন, কৃশ। কিন্তু চোখদুটো অস সজীব। ওর হাত ধরল সাওলো। ‘আমি একজন দোআঁশলা, মেলোডি, হাফ ব্রীড।’

মেলোডির নরম আঙুলগুলো আঁকড়ে ধরল ওর শক্ত বলিষ্ঠ আঙুলগুলোকে। ‘এবং তুমি একজন মানুষ, স্টেইভ!’

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *