পঞ্চস্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ –
একজন বড় জমিদার অনেক টাকার জহরত লইয়া হুগলী আসিবেন, এ কথা আমরা নানা লোক দিয়া, চারিদিকে প্রচার করিয়া দিয়াছিলাম।
আমি অমূল্যের বাড়ীতে আসিয়া তাহাকে সকল কথা বলিয়া কাল রাত্রিতে হুগলীর মাঠে জমিদার সাজিবার বন্দোবস্ত করিতে লাগিলাম। সমস্ত আয়োজন স্থির করিয়া দুইজনে হুগলী রওনা হইলাম।
চারিজন খুব বিশস্ত লোক অমূল্য সংগ্রহ করিল। চারিজনেই খুব বলিষ্ঠ, আমরা ইহাদের চারিজনকে হুগলীর পশ্চিম-প্রান্তের এক গ্রামে পাঠাইয়া দিলাম। ঐ গ্রামে অমূল্যের এক আত্মীয় বাস করিতেন। তাঁহার একখানা ভাল বড় পাল্কী ছিল। তখনকার অনেকেরই নিজের পাল্কী থাকিত। অমূল্য তাঁহার নিকট হইতে পাল্কীখানা একদিনের জন্য চাহিয়া লইল।
আমরা পাল্কীবাহকদের বলিয়া দিলাম যে, আমরা হুগলীর মাঠের ভিতরে একস্থানে থাকিব; তৎপরে দুইজনে পাল্কীতে উঠিয়া হুগলীর দিকে আসিব। আমাদের—অন্ততঃ আমার দৃঢ়বিশ্বাস ছিল যে, যখন ডাকাত ঘোড়া লইয়া গিয়াছে, তখন এ ডাকাতি নিশ্চয় করিবে। নিশ্চয়ই সে এ জমিদারের আগমনবার্তা শুনিয়াছে। নিকটে কোনখানে ডাকাতি করিবার ইচ্ছা না থাকিলে, লোচন কখনই চন্দননগরের নিকটে থাকিত না—অন্যত্র পলাইয়া যাইত; সে বেশ জানে, চন্দননগর তাহারপক্ষে এখন নিরাপদ নহে, ধরা পড়িবার ভয় আছে। রাসমণি যদিও সে কথায় বিশ্বাস করে নাই, তবুও তাহার ভাবভঙ্গিতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হইয়াছে যে, লোচন দূরে যায় নাই।
আমরা দুইটি ভাল রিভলবার কিনিয়া, গুলি পুরিয়া সঙ্গে লইলাম, তৎপরে অতি গোপনে একজন অতি বিশ্বাসী মাঝির নৌকায় আমরা দুই বন্ধুতে গভীর রাত্রিতে কলিকাতা হইতে হুগলী রওনা হইলাম।
রাত্রিশেষে নৌকা হুগলী পৌঁছিল। আমরা এ আঘাটায় নৌকা লাগাইয়া দুইজনে পদব্রজে হুগলীর মাঠের দিকে চলিলাম। যাহাতে কেহ আমাদের দেখিতে না পায়, সেইজন্য প্রকাশ্য পথ ছাড়িয়া মাঠের মধ্য দিয়া চলিলাম।
এখন যেখানে হুগলীর ষ্টেশন হইয়াছে, ঐ স্থান হইতে পশ্চিমে প্রায় পাঁচ-ছয় ক্রোশ ব্যাপিয়া এক বিস্তৃত মাঠ ছিল। এই পাঁচ-ছয় ক্রোশের মধ্যে কোন লোকের বাস ছিল না। মাঠের মধ্য দিয়া পথ হুগলী সহরের দিকে গিয়াছে, এই পথে দিনেই লোকের বড় চলাচল ছিল না, রাত্রিতে কেহই চলিত না; কারণ পূর্ব্বেও এই মাঠে দুই-একবার ডাকাতি হইয়াছে।
আমরা কিছু খাদ্যাদি সঙ্গে লইয়াছিলাম। এক পুষ্করিণীর তীরে আসিয়া আহারাদি করিয়া লইলাম। তৎপরে এক গাছতলায় বসিয়া রাত্রির প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম! অমূল্য বলিল, “রাত্রে লড়ালড়ির ব্যাপার আছে হে, এখন একটু ঘুমাইয়া লওয়া যাক্।”
বৃক্ষতলে পড়িয়া অমূল্যচন্দ্র সুখে নিদ্রা যাইতে লাগিল। নানা কারণে আমার মন এতই বিচলিত ও উদ্বেলিত হইয়াছিল যে, আমার চোখে বহুদিন হইতেই তেমন নিদ্রা ছিল না।
কি হইবে, আজ কি ডাকাত আসিবে? না আসিলে অমূল্যের উপহাস-হাসি-টিকারীর সম্মুখে তিষ্ঠতে পারিব না; তবে আমাদের এ ব্যাপার অন্য কেহ জানে না। যে চারিজন বলিষ্ঠ লোককে পাল্কী বহিতে আনিয়াছি, তাহারাও আমাদের উদ্দেশ্য কিছুই জানে না—ভিতরের কথা তাহাদের কিছুই বলি নাই। ফতে আলিও কিছুই জানেন না; সুতরাং আজ যদি ডাকাত না আসে, আমরা যদি ডাকাত ধরিতে না পারি, তবে আমাদের অকৃতকার্য্যতার কথা আমি ও অমূল্য ব্যতীত আর কেহই জানিতে পারিবে না।
মনটা ডাকাতের দুশ্চিন্তায় এতই আলোড়িত হইয়া উঠিয়াছিল যে, কুঞ্জের কথাও ভাবিবার অবসর ছিল না; তথাপি সহস্রবার তাহার কথা, তাহার মুখ আমার মনে উদিত হইতেছিল।
ক্রমে সন্ধ্যা হইল। আমরা যে স্থানে পাল্কী রাখিতে বলিয়াছিলাম, ঠিক সন্ধ্যার পরে তথায় উপস্থিত হইলাম। ক্রমে রাত্রি নয়টা বাজিল।
তখন আমরা দুইজনে সেই নির্জ্জন প্রান্তরমধ্যে পাল্কীতে উঠিলাম। চারিজন বাহক মহাশব্দ করিতে করিতে পাল্কী লইয়া ছুটিল। আমি অমূল্যকে বলিলাম, “অমূল্য, তুমি ঐদিকে খুব নজর রাখ, আমি এই দিকে রাখিতেছি।”
অমূল্য বলিল, “নজর সে-ই আমাদের উপরে রাখিবে—এখন আসিলে হয়।”
“নিশ্চয় আসিবে—আমার মন বলিতেছে, আসিবে; যেমন আসিবে, অমনি আগে ঘোড়াটাকে গুলি করিবে—আমিও করিব; ঘোড়াটা পড়িয়া গেলে ডাকাত আর পলাইতে পারিবে না।”
“কালনেমির লঙ্কাভাগ হইতেছে, আসিবে কি না কে জানে?”
“নিশ্চয়ই আসিবে।”
কিন্তু প্রকৃত কথা বলিতে কি, আমারও মনে শতবার এ প্রশ্ন উদিত হইতেছিল; আমি একরূপ জোর করিয়া আমার মন হইতে এ কথা দূর করিতেছিলাম। আমার হৃদয় সবলে স্পন্দিত হইতেছিল। সহসা একটা ঝাঁকি দিয়া পাল্কীখানা দাঁড়াইল। কে তীক্ষ্ণস্বরে বলিল, “টাকা, কড়ি যা আছে, এখনই দাও—শীঘ্র দাও—না হ’লে এই গুলি করিলাম।”
আমরা উভয়েই পাল্কী হইতে মুখ বাড়াইয়া দেখিলাম যে, একটা বড় কৃষ্ণকায় অশ্বে একজন লোক—তাহার মুখ মুখসে ঢাকা, তাহার দুই হস্তে দুইটা পিস্তল—ঠিক পথের মধ্যে দণ্ডায়মান, তাহাকে দেখিয়া বাহকগণ স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইয়াছে।
“এইবার।” চীৎকার করিয়া এবং অমূল্যকে সবলে একটা ধাক্কা দিয়া আমি পাল্কী হইতে লাফাইয়া নামিলাম। সঙ্গে-সঙ্গেই ঘোড়ার উদর লক্ষ্য করিয়া আমি পিস্তল ছুড়িলাম। অমূল্যও নিশ্চিন্ত ছিল না—পাল্কীর অন্য দ্বার দিয়া সে-ও লাফাইয়া পড়িয়া পিস্তল ছুড়িয়াছিল।
আমরা পাল্কী হইতে বাহির হইবামাত্র অশ্বারোহী নিমেষমধ্যে অশ্বের মুখ ফিরাইয়াছিল; তৎপরে মাঠের দিকে ছুটিল, আমরাও দুইজনে তাহার পশ্চাতে ছুটিলাম। আমাদের গুলি অশ্বের গায়ে লাগিয়াছিল কি না বলিতে পারি না।
আমার সে সময়ে কোন জ্ঞান ছিল না, আমি পাগলের ন্যায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হইয়া অশ্বের পশ্চাতে ছুটিয়াছিলাম; ঘোড়াকে লক্ষ্য করিয়া পুনঃ পুনঃ পিস্তল ছুড়িতে লাগিলাম। অমুল্যের পিস্তলেও ঘন ঘন শব্দ হইতেছিল। ঘোড়াও ছুটিতেছিল আমরাও ছুটিতেছিলাম; সেইজন্য লক্ষ্য ঠিক হইতেছিল না। এইবার আমি হঠাৎ দাঁড়াইয়া স্থিরলক্ষ্যে গুলি চালাইলাম; এইবার গুলিটা ঘোড়ার গায়ে লাগিয়াছিল; আমি একবার দেখিলাম, ঘোড়াটা বিকট শব্দ করিয়া লাফাইয়া উঠিল। পরক্ষণে আরোহীকে লইয়া ভূতলে পড়িয়া গেল। দুই-একবার তাহাকে লইয়া গড়াইয়া আবার উঠিতে প্রয়াস পাইল; কিন্তু পারিল না—শুইয়া পড়িল।
আমি উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া ঘোড়ার নিকটে আসিলাম; দেখিলাম, ঘোড়াটার মৃত্যু হইয়াছে, আরোহী সংজ্ঞাহীন হইয়া ঘোড়ার নিম্নে পড়িয়া আছে। তাহার মুখ হইতে মুখস্ পড়িয়া গিয়াছে, আমি সেই অন্ধকারেও সে মুখ দেখিয়াই চিনিলাম, এ যে চেনা মুখ!
যাহাকে দেখিলাম, তাহাকে এ অবস্থায় কখনও দেখিতে হইবে, স্বপ্নেও আমি কোনদিন এমন আশা করি নাই—কেহই করে নাই—আমি বিস্মিত স্তম্ভিত, স্বপ্নাবিষ্টের মত দেখিলাম, সে মনিয়া বাইজী—একি আশ্চর্য্য ব্যাপার।
ষটত্রিংশ পরিচ্ছেদ
এই সময়ে হাঁপাইতে হাঁপাইতে অমূল্য তথায় আসিয়া উপস্থিত হইল; বলিল, “ধরিয়াছ ত?” আমি কথা কহিলাম না, সে ব্যগ্র হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ডাকাতটা ম’রে গেছে নাকি?”
আমি বলিলাম, “অমূল্য, এ পুরুষ নয়—স্ত্রীলোক!”
“স্ত্রীলোক!” বলিয়া অমূল্য লম্ফ দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।
আমি বলিলাম, “দেখ ইহাকে—কি ভয়ানক আশ্চর্য্য ব্যাপার—এ যে স্বপ্নের অগোচর! ডাকাত মনিয়া বাইজী।”
“কে—কে—মনিয়া বাইজী! সে কি?”
অমূল্য সত্বর ব্যগ্রভাবে অশ্বারোহীর মুখ দেখিয়া অতিশয় বিস্মিতভাবে বলিল, “তাই ত—সত্যই ত হে—এ যে মনিয়া বাইজী!”
আমাদের এ ব্যাপারে উভয়েরই বাগরোধ হইয়া গেল। কি বলিব, আমরা উভয়ের কেহই তাহা স্থির করিতে পারিলাম না।
যে ডাকাতির জন্য বাঙ্গালাদেশ আলোড়িত হইয়া উঠিয়াছিল, যে ডাকাতির জন্য পুলিস ব্যতিব্যস্ত হইয়াছিল; লোকে সন্ধ্যা হইলে গৃহের বাহির হইতে ভয় করিত, বড়লোকেরা সশঙ্ক হইয়া উঠিয়াছিলেন, সে ডাকাত একজন স্ত্রীলোক। সে ডাকাত—বিখ্যাত বাইজী মনিয়া
বঙ্গের ধনিসম্প্রদায় যাহার গানে নৃত্যে, রূপে, হাব-ভাবে মুগ্ধ না হইয়া থাকিতে পারিতেন না, যাহার নাম বাঙ্গালাদেশের আবালবৃদ্ধবনিতার মুখাগ্রে, সেই সুপ্রসিদ্ধা বাইজী—মনিয়া, আবার সে- ই ডাকাত! ইহাপেক্ষা বিস্ময়ের বিষয় জগতে আর কি হইতে পারে? এরূপে মনিয়া ধরা না পড়িলে কাহার সাধ্য ছিল যে, তাহাকে সন্দেহ করে? সে যে ঘোড়ায় চড়িয়া রাত্রিতে ডাকাতি করে, কবে কাহার মাথায় ইহা প্রবেশ করিয়াছিল?
আমি ও অমূল্য মৃত ঘোড়াটাকে সরাইয়া, মনিয়াকে ধরিয়া, ঘোড়ার নীচে হইতে টানিয়া বাহির করিলাম। তাহার গায়ে একটা জামা ছিল, আমি সেই জামার বোতাম খুলিয়া দিলাম; তাহার মস্তক আমার ক্রোড়ে স্থাপিত করিয়া অমূল্যকে নিকটস্থ ডোবা হইতে জল আনিতে পাঠাইলাম।
সে সত্বর নিজের কাপড় ভিজাইয়া জল আনিল। আমি সেই জল লইয়া তাহার মুখে ঝাপটা দিতে লাগিলাম—এইরূপ ঝাপটা দিতে দিতে কিয়ৎক্ষণ পরে মনিয়ার সংজ্ঞা হইল—সে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল; তৎপরে চক্ষুরুন্মীলন করিল। পরক্ষণেই সে উঠিতে চেষ্টা পাইল; কিন্তু যন্ত্রণায় আৰ্ত্তনাদ করিয়া আবার লুটাইয়া পড়িল; আমি বুঝিলাম, ঘোড়া হইতে পড়িয়া সে অত্যন্ত আঘাত পাইয়াছে। আমি অমূল্যকে পাল্কীখানা লইয়া আসিতে পাঠাইলাম। আমি আবার মনিয়ার মুখে জলের ঝাপটা দিতে লাগিলাম।
কিয়ৎক্ষণ পরে মনিয়া আবার চক্ষুরুন্মীলন করিল; আমার মুখের দিকে চাহিয়া মৃদুহাস্য করিল। আমি বলিলাম, “আমাকে চিনিতে পারেন?”
মনিয়া আবার সেইরূপ হাসি হাসিয়া বলিল, “হাঁ, অমরবাবু! আপনি বাজি জিতিয়াছেন— আপনারই জয়।”
আমি বলিলাম, “আপনার কি বড় লাগিয়াছে—কোথায় লাগিয়াছে?”
“কোথায় লাগিয়াছে জানি না, তবে লাগিয়াছে—বাঁচিব না—জেলের চেয়ে ভাল।”
“আপনাকে আমরা এখনই হুগলীর হাসপাতালে লইয়া যাইতেছি।”
“কিছু হবে না, অনর্থক কষ্টের আবশ্যক কি?”
তাহার পর মনিয়া ম্লানহাসি হাসিয়া বলিল, “ডাকাতকে আপনি কেন? এখন আমি সেই ঘোড়সোয়ার ডাকাত’—এখন ‘আপনি’ নয়, যখন মনিয়া বাইজী—তখন ‘আপনি ছিলাম।”
এই সময়ে অমূল্য পাল্কী লইয়া উপস্থিত হইল। আমরা অতি যত্নে তাহাকে ধরাধরি করিয়া পাল্কীর ভিতরে শোয়াইয়া দিলাম। বুঝিলাম, এই নাড়াচাড়াতে তাহার দারুণ যন্ত্রণা হইল; কিন্তু সে ওষ্ঠ পোষিত করিয়া রহিল, মুখ হইতে যন্ত্রণাসূচক কোন শব্দ বাহির হইতে দিল না।
পাল্কীতে তুলিয়া দিলে সে কেবলমাত্র বলিল, “আমার ঘোড়া?”
আমি বলিলাম, “সে মরিয়াছে।”
মনিয়া আর কোন কথা কহিল না। পাল্কী চলিল; আমরাও পাল্কীর সঙ্গে সঙ্গে ছুটিলাম।
প্রায় রাত্রি একটার সময়ে আমরা হুগলী হাসপাতালে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। সংক্ষেপে ডাক্তারকে সকল কথা বলিলাম। তৎপরে মনিয়াকে হাসপাতালে খট্টায় শায়িত করা হইল। ডাক্তারগণ তাহার চিকিৎসায় নিযুক্ত হইলেন।
আমি তৎক্ষণাৎ পুলিসে সংবাদ পাঠাইলাম। ফতে আলিকে সংবাদ পাঠাইবার জন্য চন্দননগরে লোক ছুটিল। আমি পুলিস-ইনস্পেক্টরকে বলিয়া চার-পাঁচজন চৌকীদারকে ঘোড়াটার পাহারায় পাঠাইয়া দিলাম।
আমরা দুইজনে বাহিরে বসিয়া ছিলাম। প্রায় আধঘন্টা পরে ডাক্তার বাহির হইয়া আসিলেন। আমি ব্যগ্র হইয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “কিরূপ দেখিলেন?”
তিনি বলিলেন, “দুই-এক ঘন্টা বাঁচিতে পারে, পিঠের মেরুদণ্ড ভাঙিয়া গিয়াছে। স্ত্রীলোকেও এরূপ পারে, এই প্রথম দেখিলাম। আপনাদের সম্মুখে—ম্যাজিষ্ট্রেটের সম্মুখে সে কি বলিতে চায়, আমি ম্যাজিষ্ট্রেটকে এখনই সংবাদ পাঠাইতেছি।”
আমরা আরও আধঘন্টা হাসপাতালের দ্বারে বসিয়া রহিলাম। তৎপরে ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব আসিলেন। তখন আমরা তিনজনে ডাক্তারের সহিত হাসপাতালে প্রবেশ করিলাম; দেখিলাম, মনিয়া চক্ষু মুদিত করিয়া শুইয়া রহিয়াছে; সহসা দেখিলে তাহাকে মৃত বলিয়াই বোধ হয়।
সপ্তত্রিংশ পরিচ্ছেদ
ডাক্তার মনিয়াকে উগ্র ব্রাণ্ডী সেবন করাইয়া দিলেন, তখন সে চক্ষু মেলিল; আমাদের দিকে চাহিয়া বলিল, “আপনারা আমাকে যথেষ্ট যত্ন করিয়াছেন, আপনাদের নিকট ঋণী রহিলাম।” তাহার পর সাহেবের দিকে ফিরিয়া বলিল, “ম্যাজিষ্ট্রেট?”
ডাক্তার বলিল, “হাঁ ইনিই ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব, কি বলিবার আছে বলিতে পার।”
মনিয়া বলিল, “হাঁ, বলিবার জন্যই ডাকিয়াছি; যাহা যাহা করিয়াছি, সব বলিব।”
সে কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিল, “এই যে সকল ডাকাতি হইয়াছে, সবই আমি করিয়াছি – যদি অমর বাবু না লাগিতেন, তাহা হইলে বোধ হয়, কেহই আমাকে ধরিতে পারিত না।”
ম্যাজিষ্ট্রেট বলিলেন, “তুমি স্ব-ইচ্ছায় ডাকাতি করিতে—তুমি স্ত্রীলোক—তোমার রূপ আছে, তুমি বড় বাইজী। আমি শুনিয়াছি, নাচিয়া অনেক টাকা উপার্জ্জন করিতে, তবে এই রকম ডাকাতি করিতে কেন?”
মনিয়া বিষণ্ন-হাসি হাসিয়া বলিল, “সাহেব, তুমি বুঝিবে না—কৰ্ম্মফল—ভাগ্য।” তাহার পর নিজ কপালে হাত দিয়া বলিল, “সবই এই।”
সাহেব বলিলেন, “তাহার পর কি বলিতে চাও, বল?”
মনিয়া বলিল, “আমি কে জানি না, আমার বাপ-মা কে, তাহাও আমি জানি না; লোচনের স্ত্রী রাসমণি—সে আমার দাই এর বোন, আমাকে ছেলেবেলায় চুরি ক’রে আনে। লোচন আমাকে ফয়জাবাদের এক হিন্দুস্থানীর কাছে বেচিয়াছিল। এই হিন্দুস্থানীই আমাকে নাচ-গান শিখাইয়া বাইজী করিয়াছিলেন। এই সময়ে আমি একজনকে ভালবাসি; কিন্তু এই হিন্দুস্থানী তাহাতে আমাদের উভয়ের উপরে রাগত হন, আমি যাহাকে ভালবাসিতাম, একদিন তিনি গোপনে আমার সঙ্গে দেখা করিতে আসেন; সেই সময়ে হিন্দুস্থানী তাঁহাকে দেখিয়া লাঠী মারেন—উভয়ে মারামারি হয়— হিন্দুস্থানী মরিয়া যান, ইহা কেবল ভিকরাজ বলিয়া হিন্দুস্থানীর একটা বন্ধু জানিতে পারে। সেই পর্য্যন্ত ভিকরাজ আমাদের দুইজনকেই খুনের জন্য ধরাইয়া দিবার ভয় দেখাইতে থাকে। আমি নাচ- গান করিয়া যাহা পাইতাম, সে সবই লইত; তবুও সন্তুষ্ট হইত না, সর্ব্বদাই ধরাইয়া দিবার ভয় দেখাইত।”
মনিয়া ক্লান্ত হইয়া নীরব হইল; তৎপরে ধীরে ধীরে বলিল, “সেই দুরাত্মার জন্য এতদিন কত যন্ত্রণা পাইয়াছি, তাহা ভগবান্ জানেন। আমি যত টাকা রোজগার করিয়াছি, সবই তাহাকে দিয়াছি, তবুও সে সন্তুষ্ট হয় নাই—আরও চাহিয়াছে। আমি যাহা তাহাকে দিতাম, জুয়া খেলিয়া সে সব নষ্ট করিয়া আসিত, টাকা ফুরাইলে আবার টাকার জন্য পীড়াপীড়ি করিত।”
সাহেব ক্রোধভরে বলিয়া উঠিলেন, “সে ভিকরাজ দ্বীপান্তর গিয়াছে—কি ভয়ানক লোক এমন বালিকাকে ডাকাত বানাইয়া ছাড়িয়াছে।”
মনিয়া বলিল, “শেষে ভিকরাজ এইরূপ ডাকাতির মতলব করিল; যিনি আমাকে কিনিয়া লইয়া মানুষ করিয়াছিলেন, তিনি আমাকে ছেলেবেলায় ঘোড়ায় চড়াইতে শিখাইয়াছিলেন—আমি ঘোড়ায় খুব ভাল চড়িতে জানিতাম, তাহাই একদিন ভিকরাজ আমাকে বলিল, ‘চল, বাঙ্গালাদেশে দিন- কতকের মধ্যে আমরা অনেক টাকা আনিতে পারিব। গান-নাচে যাহা পাওয়া যায়, আর রাত্রিতে ঘোড়ায় চড়িয়া ডাকাতি করিবে।’ আমি তাহার কথা ভাল বুঝিতে না পারায় সে আমাকে শেষে বুঝাইয়া বলিল, ‘আমি সন্ধান রাখিব যে, কখন্ কোন্ পথে কোন্ বড়লোক অনেক টাকার জহরত লইয়া যাইবে; তুমিও বাইজী হইয়া অনেক বড়লোকের সন্ধান রাখিতে পারিবে। আমি লোচনকে তাহার দল লইয়া বাংলাদেশে যাইতে বলিতেছি—তাহাকে খুব ভাল একটা সাদা ঘোড়া কিনিয়া দিব, সে সেই ঘোড়া লইয়া এক-এক জায়গায় তাদের দলের ডেরা ফেলিবে। কোন বড়লোকের সন্ধান হইলে, তুমি লোচনের ডেরার কাছে গেলে সে ঘোড়াটার রং বদলাইয়া, কাল রং করিয়া আনিয়া দিবে। তুমি মুখস্ পরিয়া দুই হাতে দুইটা পিস্তল লইয়া বড়লোকের পাল্কীর উপর পড়িবে, তাহারা ভয়েই সব জহরত ফেলিয়া দিবে। তাহার পর জহরত এক জায়গায় পুতিয়া রাখিয়া, কোন চটিতে গিয়া তাহাদের একটা ঘটীর তলায় সঙ্কেতে লিখিয়া আসিবে যে, কোথায় জহরত পোতা আছে। আমি মাড়োয়ারী ফিরিওয়ালা সেজে চটীতে গিয়ে ঘটির নীচে দেখিয়া জহরত লইয়া আসিব। তুমি যে বাইজী সে-ই বাইজী হইয়া যাইবে—কাহারও বাবার সাধ্য নাই যে, তোমাকে সন্দেহ করে।’ আমি ত শুনেই অবাক্।”
মনিয়ার কথা শুনিয়া হাবড়ার ডাকাতির কথা আমার মনে পড়িল; আমি এখন বুঝিলাম যে, মনিয়া রাত্রিতে ডাকাতি করিয়া প্রাতে বাইজী সাজিয়া, পাল্কী করিয়া কলিকাতা ফিরিতেছিল। এখন বুঝিলাম, সে পূৰ্ব্ব হইতেই জানিত যে, আমি রাসমণিকে কলিকাতায় আনিতেছি, সেইজন্যই ইচ্ছা করিয়া দাইকে গঙ্গার ঘাটে পাঠাইয়াছিল—সকলই পূৰ্ব্ব হইতে বন্দোবস্ত। আমি ইহার বিন্দুমাত্র কিছুই বুঝিতে পারি নাই।
মনিয়া বলিতে লাগিল, “আমি প্রথমে কিছুতেই তাহার এ কথায় রাজী হইলাম না; তখন সে আমাদের পুলিসে ধরাইয়া দিতে প্রতিজ্ঞা করিল—পুলিসে ধরাইয়া দিলে আমি যাহাকে ভালবাসি, তাঁহার ফাঁসী হইবে, আমারও দ্বীপান্তর হইবে। দুরাত্মা ভিকরাজ বিদ্রূপ করিয়া সর্ব্বদাই এ কথা বলিতে লাগিল। শেষে আমি বাধ্য হইয়া বাঙ্গালাদেশে আসিয়া ডাকাতি করিতে রাজী হইলাম। তাহার পর সে যেখানে আমাকে পাঠাইয়াছে, সেইখানে লোচনও দল লইয়া ডেরা ফেলিয়াছে; আমাকে ঘোড়া আনিয়া দিয়াছে—এই—এই — পৰ্য্যন্ত।”
মনিয়া চক্ষু মুদিত করিল, তাহার মুখ নিমেষের জন্য বিবর্ণ হইয়া গেল; তৎপরে তাহার মুখে অপরূপ সৌন্দর্য্য ও জ্যোতিঃ প্রকাশ পাইল। ডাক্তার সত্বর গিয়া তাহার কপালে হাত দিলেন— বুকে হাত দিলেন—নাড়ী দেখিলেন, তৎপরে ফিরিয়া বলিলেন, “হইয়া গিয়াছে।”
আমরা অতি বিষণ্ণচিত্তে হাসপাতাল হইতে বহির্গত হইলাম। এরূপ দারুণ বেদনা আমি প্ৰাণে আর কখনও পাই নাই—এমন হতভাগিনীও আর কখন আমি দেখি নাই।
বাহিরে আসিয়া অমূল্য বলিল, “দেখ অমর, লোকে যে যা ইচ্ছা বলুক, আমি এই মনিয়াকে মুৰ্দ্দফরাস দিয়া পোড়াইতে দিব না—আর কেহ কাঁধ দিক্ আর না দিক্, আমি কাঁধে করিয়া লইয়া ইহার রীতিমত সৎকার করিব।”
আমার চোখে জল আসিল; আমি বলিলাম, “আমিও এতদূর পাষাণ হই নাই।”
ম্যাজিষ্ট্রেট আমাদিগকে এই হতভাগিনীর সৎকার করিতে অনুমতি দিলেন; অধিকন্তু আমরা যাহা চাহি, তাহা দিবার জন্য পুলিসের উপরে হুকুম দিলেন।
আমরা হুগলীর ঘাটে যথাবিহিতনিয়মে এই মাতৃ-পিতৃহীনা অনাথিনী হতভাগিনীর দেহ চিতাবক্ষে সমর্পণ করিলাম।
অমূল্য স্নান করিয়া উঠিয়া বলিল, “এ আর জন্মে আমাদের কেহ ছিল হে, দেখ না কোথাকার আপদ্ কোথায় আসিয়া জুটিল।”
আমি কথা কহিলাম না, কথা কহিবার ক্ষমতা ছিল না—মন কি জানি, কেমন উদাস হইয়া গিয়াছিল।
আমরা ফিরিয়া হুগলীর দিকে আসিতেছিলাম, পথিমধ্যে দেখিলাম, ফতে আলি দারোগা লম্বা লম্বা পা ফেলিয়া সহাস্যে সেইদিকে আসিতেছেন।
অষ্টত্রিংশ পরিচ্ছেদ
ফতে আলি দারোগা আমার পৃষ্ঠে মৃদুমন্দ চপেটাঘাত করিয়া বলিলেন, “ভায়া, তা’ হ’লে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছ—ডাকাত ধরেছ; কিন্তু মালাটা একদম মাঠে মারা গেল হে, ধরা প’ড়ে শেষে ম’রে গেল। তবে এমনই বা কে ভেবেছিল যে, ডাকাতি করে মনিয়া বাইজী—তার ঠুংরিতে আমি একবারে ম’জে গেছলাম, এখনও যেন কানে লেগে আছে” এই বলিয়া হাত নাড়িয়া গুগুস্বরে একটু রাগিণী ভাঁজিলেন।
তখন আমার যেরূপ মনের অবস্থা, তাহাতে দারোগার বাচালতা আমার পক্ষে অত্যন্ত বিরক্তিকর হইতেছিল—আমি কোন কথা কহিলাম না। ফতে আলি অমূল্যের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “বাবু, মুসলমানকে শেষে গোর না দিয়ে পোড়ালে, কাজটা ভাল হলো না যে।”
অমূল্য বলিল, “মনিয়া বাইজী ছিল বটে; কিন্তু সে হিন্দুর মেয়ে হিন্দু তাহাকে মানুষ করিয়াছিল।” দারোগা ক্ষুণ্ণভাবে বলিলেন, “যা হগে—শেষে ম’রে গেল, এমন ডাকাতকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারলেম না—হাজার হাজার লোক দেখতে আস্ত, আমারও খোনামে দুনিয়া ভরপুর হ’য়ে যেত, তা না হ’য়ে সব মাটি হয়ে গেল; তবে প্রধান দুটোকে ধরেছি—এ ফতে আলি ভিন্ন আর কারও সাধ্য ছিল না।”
আমি দুজনের উল্লেখ শুনিয়া বলিলাম, “দুজন! দুজন আবার কে?
ফতে আলি উচ্চহাস্য করিয়া বলিল, “হাঁ—হাঁ, অমর বাবু, তুমি ভেবেছিলে, আমি কেবল চোখ বুজে ব’সে ফর্সী টেনেই থাকি, তা ঠিক নয়, ফতে আলি দারোগা চোখ বুজেও চেয়ে থাকে হে।”
ফতে। একজন ত হ’য়েই গেছে—ভিকরাজ; দ্বিতীয় নম্বর—লোচন—লোচন।
আমি ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম, “লোচন কি ধরা পড়িয়াছে?”
দারোগা সাহেব গম্ভীরভাবে বলিলেন, “উ হুঁ—এ ফতে আলি ভিন্ন আর কাহারও কাজ নয়— কাল রাতে সে ধরা পড়েছে।”
আমি বিস্মিত হইলাম; বলিলাম, “কিরূপে ধরিলেন?”
ফতে। তবে সব শোন—একটা মেয়েমানুষ বাইজী ধরা সহজ কাজ—আসল বদমাইস ধরাই হ’লো বাহাদুরি।”
আমি। আপনি কেমন করিয়া ধরিলেন, সেইটা আগে বলুন।
ফতে। বেদে বেটাদের আমি খুব নজরবন্দীই রাখিয়াছিলাম। কাল রাত্রে বোধ হয়, লোচন-বেটা বাইজীকে ঘোড়া পৌঁছাইয়া দিয়া কোনখানে লুকাইয়াছিল; কিন্তু সময়মত বাইজী ফিরিল না, ঘোড়ারও দেখা নাই—কেমন করিয়া থাকিবে, বাইজী তোমাদের পাল্কীতে আর ঘোড়া ম র মাঝখানে চৌপা তুলে সব শুনিয়াছি—সব শুনিয়াছি; কাজেই বেটা বদমাইস—তখন বাইজ।।ফরে এল না দেখে ভাবিল, হয় ত বাইজী কোন রকমে তাকে না দেখতে পেয়ে ডেরায় ঘোড়া ফিরাইয়া দিতে গিয়াছে; বদমাইসদের দিনটা ঘনিয়ে এলে এই রকম বুদ্ধিভ্রংশ হয়, না হ’লে শ। তাদের ধরা দায় হ’ত।
আমি। তার পর কি হইল, বলুন?
ফতে। তাই ভেবে সে ডেরার দিকে আসিল—এদিক্ ওদিক্ থেকে উঁকি মেরে দেখতে লাগ্ল অনেক রাত, ভেবেছিল কেউ জেগে নাই—শালা জান্ত না যে, একজন জেগে আছে।
আমি। কে সে—কে সে?
আমার ব্যগ্রতা দেখিয়া, ফতে আলি হাসিয়া বলিলেন, “সে হীরের টুকরো—সে হীরের টুকরো- তোমার কুঞ্জ!”
বোধ হয়, লজ্জায় তখন আমার মুখ রক্তবর্ণ হইয়াছিল; ফতে আলি তাহা লক্ষ্য করিলেন না- কোন বিষয়ে লক্ষ্য করিবার ক্ষমতা তাঁহার ছিল না। তিনি বলিলেন, “কুঞ্জ জেগে ছিল, সেই লোচনকে দেখিতে পায়, তার পর সে-ই বরকন্দাজদের খবর দেয়, আর অমনই তারা গিয়ে বেটাকে একদম্ পিছুমোড়া ক’রে বেঁধে ফেলে; তার পর আমার কাছে আলে একশো একটা লাথী বেটাকে গুণে মেরেছি—শালা—বদমাইস—ডাকু।”
অমূল্য হাসিয়া বলিল, “তাহা হইলে দারোগা সাহেব, আপনি নিজে আর ইহাকে ধরিলেন কই?” ফতে আলি ক্ষিপ্তগতিতে অমূল্যের দিকে ফিরিয়া রোষষায়িতলোচনে বলিলেন, “আমি ধরিলাম না ত, কি তুমি ধরিলে?”
অমূল্য হাসিয়া বলিল, “না, আমি কেন? এ ত দেখিতেছি, একরূপ কুঞ্জই ধরিয়াছে।”
দারোগা সাহেব নরম হইয়া বলিলেন, “এ কথা কতকটা ঠিক, তবে আমি চন্দন-নগরে না থাকিলে সে ধরা পড়িত না।”
অমূল্য। সে-ও ত আপনাকে অমর বাবু থাকিতে বলিয়াছিল বলিয়া আপনি ছিলেন; আপনি ত থাকিতেই চাহিতেছিলেন না।
ফতে। কি মুস্কিল! তোমার মত আহাম্মুখ লোক দুনিয়ায় আর দুটি নাই।
অমূল্য হাসিয়া বলিল, “দারোগা সাহেব! আপনার ন্যায় বুদ্ধি কয়জনের আছে?”
ফতে আলির বিদ্রূপ বুঝিবার ক্ষমতা একেবারেই ছিল না; অমূল্যের পিঠ চাপড়াইয়া বলিলেন, “এখন পথে এস—তোমরা বুদ্ধিমান, তাই তোমরা দুজনেই আমাকে ঠিক্ বুঝতে পেরেছ; জহুরীই জহর চেনে।”
আমরা দারোগা সাহেবকে বেশ চিনিতে পারিয়াছিলাম বলিয়াই তাঁহার কথায় রাগ করিলাম না। তবে সময়ে সময়ে ভাবিতাম, ফতে আলি এত নাম করিলেন কিরূপে? একদিন তাঁহার নিম্মতন কয়েকজন পুলিস-কর্ম্মচারীকে এ কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। প্রত্যুত্তরে তাহারা সকলেই তাহাদের কপালে হাত দিয়া কপাল দেখাইয়াছিল।
ঊনচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ
ডাকাতের ব্যাপার একরূপ মিটিল; কিন্তু আমার কাজ মিটিল না; বেদেরা দুইটি মেয়েকে চুরি করিয়া আনিয়াছিল—এক হতভাগিনী রূপ, যৌবন, গুণসত্ত্বেও সংসার-চক্রে পড়িয়া, পোষিত হইয়া চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া গেল; হয় ত পূৰ্ব্বে সংবাদ পাইলে এ হতভাগিনীকে কেহ-না-কেহ রক্ষা করিতে পারিত। দুঃখ করিবার কিছুই নাই, অদৃষ্টের ফের! যাহা হইবার, তাহা হইয়াছে; নতুবা মাতৃক্রোড় হইতে সে অপহৃতা হইত না।
অপরটিকে কি রক্ষা করিতে পারিব না? নিয়তি কি তাহার প্রতিও এমনই ভীষণা হইবে? না, কখনই না; তাহাকে বাইজী করিবার জন্য কেহ কিনিয়া লয় নাই; নতুবা সে আজ কি হইত, কে জানে?
সে ভদ্রলোকের কন্যারূপে গৃহীত হইয়াছিল—সেইরূপই লালিত-পালিত হইয়াছে—সুশিক্ষিতা হইয়াছে—সৰ্ব্বতোভাবে সৰ্ব্বগুণে গুণবতী হইয়াছে—আপনাকে আপনি রক্ষা করিতে সক্ষম হইয়াছে।
তাহাকে কি রক্ষা করিতে পারিব না? কুঞ্জকে আমি ভালবাসিয়াছি; প্রাণের সহিত ভালবাসিয়াছি কুঞ্জ আমার অস্থিমজ্জায় মিলিত হইয়া গিয়াছে; কিন্তু সেদিন গঙ্গাতটে পূর্ণযৌবনা অপরূপসুন্দরী হতভাগিনী মনিয়াকে যখন ভষ্মীভূত করিতেছিলাম; বিদেশে, বিভূমে, ন মাতা, ন পিতা, ন আত্মীয়-স্বজন—অপরে ভষ্মীভূত করিতেছে—সুন্দরীর দেহ নহে—ডাকাতের দেহ—কুলটা বাইজীর দেহ ভষ্মীভূত হইতেছে, তখন মনে সেদিন চিতাগ্নিতে যেন হৃদয়ে অঙ্কিত হইতেছিল—প্রাণের অন্তস্তম প্রদেশ হইতে যেন উত্থিত হইতেছিল, কুঞ্জকে কি রক্ষা করিতে পারিব না? না হইলে এ-ও হয় ত সংসার-আবর্ত্তে পড়িয়া কোথায় নিমজ্জিত হইয়া যাইবে।
সংসার যাক্—আত্মীয়-স্বজন যাক্—বন্ধুবান্ধব যাক্—সমাজ লোকাচার সকলই যাক্—আমি যদি ঘোরতর পাষণ্ড না হই, তবে কুঞ্জকে রক্ষা করিব—বিবাহ করিয়া রক্ষা করিব। গঙ্গাবক্ষে হতভাগিনী মনিয়ার জ্বলন্ত চিতাপার্শ্বে বসিয়া মনে মনে অনেকবার এ প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম।
আমি স্পন্দিতহৃদয়ে বেদিয়াদের ডেরার দিকে চলিলাম; অমূল্যকে সঙ্গে আসিতে বলিলাম; সে সদর রাস্তায় গাছতলায় বসিয়া-পড়িয়া বলিল, “তুমি যাও, এ মেয়েটা আমার মেজাজ একেবারে মাটি করিয়া দিয়াছে—শেষে একটা বাইজী-ডাকাতও পোড়াইতে হইল!”
অমূল্য কিছুতেই যাইবে না দেখিয়া, আমি অগত্যা একাকী বেদেদিগের ডেরার দিকে চলিলাম। বোধ হয়, দূর হইতে কুঞ্জ আমাকে দেখিতে পাইয়াছিল; সে আমাকে দেখিয়া ডেরা হইতে অগ্রবর্ত্তী হইয়া আসিল। ডাকাতের ও মনিয়ার বৃত্তান্ত ইতোমধ্যেই সর্বত্র ব্যাপ্ত হইয়াছিল, কুঞ্জ ও শুনিয়াছিল; সে আমার নিকটে আসিয়া বলিল, “মনিয়া যে ডাকাতি করে, এ কথা কে ভাবিয়াছিল?”
আমি বলিলাম, “তুমি মনিয়াকে চিনিতে?”
“আমরা যখন পশ্চিমে ছিলাম, তখন মনিয়া প্রায় আমাদের ডেরায় আসিত।”
“তুমি কি ইহার কিছুই জানিতে না?”
“কিছুই না, কখনও মনে হয় নাই। আহা, এত কম বয়সে মারা গেল! তবে ভালই হইয়াছে, না হইলে জেলে যাইত।”
“কুঞ্জ, তোমার মত তাহাকেও লোচন চুরি করিয়া আনিয়াছিল।”
এই কথায় তাহার মুখ শ্বেতবর্ণ হইয়া গেল—সে দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিল; তৎপরে ধীরে ধীরে অতি বিষণ্ণভাবে কহিল, “ভাগ্যে যাহা আছে, তাহা খণ্ডাইবে কে?”
আমি সোৎসাহে বলিলাম, “ভাগ্য তোমার প্রতি এখনও সদয় আছেন; নতুবা হয় ত কেহ তোমাকে বাইজী করিবার জন্য কিনিত।”
“তাহাই বেশী সম্ভব ছিল।”
“তাহা না হইয়া তোমাকে একজন ভদ্রলোক নিজের মেয়ের মত লালন-পালন করিয়াছিলেন।”
“তিনি বাঁচিয়া থাকিলে আমাকে আর এদের দলে আসিতে হইত না।”
“এখন আর থাকিতে হইবে না—থাকিতে দিব না।”
কুঞ্জ কিয়ৎক্ষণ কোন কথা কহিল না; তৎপরে ধীরে ধীরে বলিল, “লোচন ধরা পড়িয়াছে।” আমি বলিলাম, “তুমি না ধরাইয়া না দিলে কেহ তাহাকে ধরিতে পারিত না।”
কুঞ্জ অতি কুণ্ঠিতভাবে বলিল, “তাহাকে ধরাইয়া দিয়া ভাল করিয়াছি কি না, বুঝিতে পারিতেছি না—এখন একটু কষ্ট হইতেছে; সে এতদিন আমাকে যত্ন করিয়াছে। ধরাইয়া দিতাম না, যদি না মনে করিতাম, সে তোমাকে খুন করিবার চেষ্টায় আছে; না ধরাইয়া দিলে তোমাকে নিশ্চয়ই খুন করিত।” আমি সবেগে কুঞ্জের হাতখানা টানিয়া ধরিয়া বলিলাম, “তবে তুমি তাহাকে আমার জন্যই ধরাইয়া দিয়াছ?”
সে মৃদুস্বরে বলিল, “তা না হ’লে তাহাকে আমার ধরাইয়া দিবার দরকার কি? সে আমাকে যত্ন করিত।”
আমি বিচলিতভাবে বলিলাম, “তাহা যাহাই হউক, এখন আর আমি তোমাকে ইহাদের দলে কিছুতেই থাকিতে দিব না।”
কুঞ্জ কিয়ৎক্ষণ নীরবে রহিল, তৎপরে অতি ধীরে ধীরে বলিতে লাগিল, “আপনি—”
আমি তাহাকে প্রতিবন্ধক দিয়া বলিলাম, “এখনও ‘আপনি’ কুঞ্জ? কুঞ্জ, তুমি আমার।”
সে বোধ হয়, আমার কথায় কান দিল না; বলিল, “সেদিন থেকে আমি কেবল ভাবিয়াছি— আমার দুর্ব্বল হৃদয়ে ভগবান্ বল দিয়াছেন, তাঁহাকে অনেক ডাকিয়াছি, আমি বুঝিয়াছি, আপনি আমাকে বিবাহ করিলে লোকে আপনাকে উপহাস, বিদ্রূপ করিবে; ইহা আমার প্রাণে সহিবে না— আমি সুখী হইতে পারিব না—আপনিও আমাকে বিবাহ করিয়া সুখী হইবেন না—বরং ভগবান্ আমার অদৃষ্টে যাহা লিখিয়াছেন, আমি সেইরূপ থাকিলে একরূপ সুখে-দুঃখে জীবন কাটাইয়া দিতে পারিব। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, এত কথা বলিলাম, ছেলেমানুষ অবোধ বলিয়া ক্ষমা করিবেন।”
আমি বালিকার এই ধীর-গম্ভীরবাক্যে স্তম্ভিত হইলাম; কি বলিব, কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। দেখিলাম, কুঞ্জ অবনতমস্তকে দণ্ডায়মান রহিয়াছে—তাহার চক্ষু দুটি অশ্রুপ্লাবিত হইয়া উঠিয়াছে।
আমি অত্যন্ত বিচলিত হইলাম; দৃঢ়স্বরে অত্যন্ত বেগের সহিত বলিলাম, “যদি আমি তোমার বাপ-মাকে সন্ধান করিয়া বাহির করিতে পারি, যদি তোমাকে বিবাহ করিলে সমাজে কাহারও বলিবার আর কিছুই না থাকে; তবে বল, তুমি আমাকে বিবাহ করিতে আর আপত্তি করিবে না?”
কুঞ্জ কোন কথা কহিল না, আমি পুনরপি সেইভাবে বলিলাম, “বল—বল—তুমি কি আমাকে আজীবনের মত দুঃখী করিবে?”
আমি দেখিলাম, কুঞ্জের আপাদমস্তক কাঁপিতেছে। সে একবার ব্যাকুল-ভাবে আমার দিকে চাহিল; তৎপরে পড়িয়া যাইবার মত হইল; কিন্তু আমি তাহাকে ধরিতে উদ্যত হইলে সে অতি কষ্টে আত্মসংযম করিয়া দাঁড়াইল; তৎপরে অতি অস্ফুষ্টস্বরে বলিল, “আপনি যান্।”
আমি সবেগে বলিলাম, “যাইতেছি, কিন্তু বল, তাহা হইলে আপত্তি করিবে না।”
অতি অস্ফুষ্টস্বরে সে বলিল, “না, আপনি যান।”
আমি বুঝিলাম, তাহার নিতান্ত কষ্ট হইতেছে; আমি আর কোন কথা না কহিয়া ফিরিলাম। সদর রাস্তায় আসিয়া ফিরিয়া দেখিলাম, কুঞ্জ তখনও তথায় সেইভাবে পাষাণ-প্রতিমার মত নিস্পন্দভাবে দাঁড়াইয়া আছে।