চিলেকোঠার সেপাই – ৩৯
বাবা তোর পাওত পড়ি বাবা মুখ দিয়ে অক্ত উঠা মরবু বাপ। নাদু পরামাণিকের কাকুতি মিনতির সঙ্গে আরো কেউ কেউ চেংটুকে অনুরোধ করছিলো, হামাগোরে দ্যাখা ঘটনা বাবা, এই গাছোত যাই একোটা কোপ মারছে মুখত তাই আর ভাতের একটা নলাও তুলব্যার পারে নাই গো! অক্তবমি করতে করতে সিটক্যা মরছে!’
কিন্তু বৈরাগীর ভিটায় আজ এতো মানুষ, ঝুড়ি ও ডালের জঙ্গল সাফ না করলে লোকজনের বসবার ঠাই হয় কি করে? মানুষও এসেছে বাপু! ভিড় দেখে মনে হয় এদিককার গোটিয়া, তালপোতা, পদুমশহর, চিধুলিয়া, উত্তরের চন্দনদহ, দরগতলা, কর্ণিবাড়ি, পশ্চিমের কড়িতলা, দরগতলা, কামালপুর, গোলাবাড়ি—কোনো গ্রামে পুরুষমানুষ আজ ঘরে নাই। দূরের চর এলাকার লোকও এসেছে। যমুনার গহীন ভেতর থেকে জেগে-ওঠা ডাঙার মানুষ এদিকে খুব একটা আসে না, আজ তারা এসেছে দল বেঁধে। এদের বেশির ভাগ লোক বৈরাগীর ভিটার পুরনো বাসিন্দার খবর জানে না। তাই কেউ হাতের দা, এমনকি কাস্তে বা কোদাল দিয়েও ডালপালায় কোপ মারে। একেকটা কোপে বটপ্রাসাদ প্রতিধ্বনি তোলে। প্রতিধ্বনি প্রথম প্রথম ছিলো গুরুগম্ভীর, সেই আওয়াজে মানুষের গা ছমছম করে ওঠে। ডালপালা ও ঝুড়ির সংখ্যা একটু কমতেই প্রতিধ্বনি থেকে গাম্ভীর্য ও দন্ত ঝরে পড়ে, দেখতে দেখতে খটখট ও ঠকঠক ধ্বনি ছাড়া তার তেমন কিছুই থাকে না। এই শব্দসমূহ ঝরঝর করে ও পরে শিরশির করে ছড়িয়ে পড়ে পাতায় পাতায়, ডালপালায়, ফলের বোটায় এবং শালিক-হরিয়ালের পাখনায় পাখনায়। কিছু ফল টুপটাপ করে নিচে পড়ে কিছু পাতা বেঁটা থেকে খসে শূন্যে ভাসে এবং কিছু পাতার বাঁধন শিথিল হয়ে আসে। পুরুষানুক্রমে এই গাছের কোলে-কাখে বড়ো-হওয়া শালিক-হরিয়াল অতিরিক্ত উত্তেজনায় ডাল ভাঙার ও কুড়ালের কোপের ধ্বনির পাশাপাশি উড়াল দেয় উত্তরের দিকে।
বৈরাগীর ভিটা উপচে মানুষ ছড়িয়ে পড়েছে চাষের মাঠে, একদিকে পুকুর পাড় পর্যন্ত। অনেকে একটু ভয় পায়, তারা ইচ্ছা করেই সরে বসেছে, কথা বলছে ফিসফিস করে। ইন্টু মুড়ে বসে সবাই সমাবেশের ঘনত্ব বাড়ায়। ভাঙাচোরা ও মাটির সঙ্গে প্রায় সমানহয়ে-যাওয়া পুরনো ইটের বেদীর ওপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাতের কাগজ থেকে পাঠ করতে শুরু করে আলিবক্স। তার পড়া তেমন শুদ্ধ নয়। যমুনার ভিজে বাতাসের ঝাপটায়-ভারি জিভে চ বর্গের তালব্য ধ্বনিগুলো সে দস্তমূলীয় উচ্চারণ করে। এতে আনোয়ারের অনুমোদন নাই কলেজে-পড়া ও পাটি-করা ছেলেদের আরেকটু সচেতন হওয়া উচিত। তার বাক্যও মাঝে মাঝে অশুদ্ধ, প্রধানত সাধু ভাষায় লেখা হলেও চলিত রীতির হঠাৎ-ব্যবহার কানে লাগে। তবে আলিবক্সের পড়া ও মাঝে মাঝে দর্শকদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কথা বলা শুনতে শুনতে আনোয়ারের অস্বস্তি কমে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ভালো লাগতে শুরু করে। আলিবক্সের কথা খুব স্পষ্ট। তার একই কথার পুনরাবৃত্তি বাহুল্য মনে হয় না, তার ভঙ্গি জড়তামুক্ত। খয়বার গাজীর গোরুচুরির প্রসঙ্গে এলে তার পাঠ ধীরগতি হয়, ‘ধারাবর্ষা চরের হোসেন আলী ফকিরকে প্রধান সহযোগী মোতায়েন করিয়া উহার নিযুক্ত মানুষ দ্বারা কৃষকচাষীদের ঘর হইতে গোরু-চুরির যে তৎপরতায় আপনি লিপ্ত, উহা এতদঅঞ্চলের মানুষের ত্রাস ও মৃত্যুর কারণ হইয়াছে। আপনার জ্ঞাতসারে ও আপনার হুকুমে আপনার বেতনভুক্ত শয়তান মোহাম্মদ হোসেন আলি ফকির তাহার বর্গাদার ও পত্তনি চাষীদের দ্বারা গরীব কৃষকদের গোরুচুরি করিয়া থাকে। আলিবক্স মুখ তুলে থয়বার গাজীর দিকে তাকায় আপনি কি ইহা অস্বীকার করতে পারেন?
খয়বার গাজীকে বসানো হয়েছে ১টা বেঞ্চে, তার পাশে জালালউদ্দিন। এদের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে নাদু পরামাণিক। লিখিত অভিযোগসমূহ পড়তে পড়তে আলিবক্স বারবার খয়বারকে ঐ প্রশ্ন করছিলো। প্রথমবার সে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু সমাবেশের বিশাল অংশ তার না শোনার সঙ্গে সঙ্গে শালা কথা কস না। শালা কুত্তার বাচ্চা কথা কস না বলে গর্জন করে ওঠে এবং তারপর থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠের এই আদেশটি সে মেনে চলেছে।
আলিবক্স পড়ে,আপনার চুরি-করা গোরুর বাথান হইতে আপনার নির্ধারিত জরিমানা পরিশোধ করিতে না পারায় দরিদ্র চাষী শুকরা মণ্ডল ওরফে পচার বাপ আপনার নিয়োজিত মানুষের হাতে প্রাণ দিয়েছে। নানা অজুহাতে হুকুম দিয়া আপনি মানুষ হত্যা করেন, উহাদের সংখ্যা আমাদের জ্ঞাতসারে নয়জন।
পচার বাপের ছেলে পচা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে কাঁদে তার কোলের ন্যাংটা ছেলেটা। পশ্চিমে খিয়ার অঞ্চলে ধান কাটার কাজ সেরে খাওয়া দাওয়ার পরও দেড় কুড়ি টাকা নিয়ে গতকাল সে বাড়ি ফিরেছে। হামলানো কান্নায় তার ক্রোধ বোঝা যায় না, আপাতত পিতৃশোকই তাকে সম্পূর্ণ দখল করে রেখেছে। তবে চিৎকার করে রাগ জানায় নবেজউদ্দিন, মাকুচোষ শয়তানকে বিরিঞ্চি থাকা নামাও। হামারই গোরু, পয়সা দিয়া লিয়া আসা লাগে হামাকই।’
দরগাতলার বাঁকা সাকিদার উঠে দাঁড়ায়, শালা খুনী। শয়ের উপরে মানুষ মারছে। কিসের বিচার করো তোমরা? এক কোপেত শালার কাল্লাখান আলগা করা দাও।
হাতের কাগজ থেকে মুখ তোলে আলিবক্স, আমরা এ পর্যন্ত নয়জনের খবর পাইছি। আপনে আন্দাজ শয়ের কথা তোলেন কিসক?’ খয়বার গাজীর হুকুমে বিভিন্ন সময় নিহত ৯ জন ব্যক্তির পরিচয় এবং তাদের কিভাবে হত্যা করা হয় আলিবক্স সেই বিবরণ পড়ে।
বাঁকা সাকিদার আরেকজনের কথা তোলে, ছাইহাটার আকালুর ব্যাটা শহরালির কথা বাদ দিলেন যে?
‘না’ শহরালি নিহত হয় ছাইহাটার চেয়ারম্যান খবির মণ্ডলের হুকুমে। তার বিচার করবে। ছাইহাটার মানুষ। কাল ছাইহাটাত গণ-আদালত বসবো। সবাইকে এবার চুপ করতে বলে আলিবক্স পড়ে, নয়টি নরহত্যাসহ নানাবিধ অপরাধমূলক কার্যকলাপ দ্বারা মোহাম্মদ খয়বার হোসেন গাজী, ওরফে খয়বার গাজী এতদঅঞ্চলের মানুষের সমূহ বিপদ ও সর্বনাশ ঘটাইতেছে। অত্র আদালত তাহার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়। পাঠ স্থগিত রেখে যে সমাবেশের অনুমোদন চায়, খয়বার গাজীর মৃত্যুদণ্ড কি আপনারা অনুমোদন করেন?
আকস্মিক নীরবতার সৃষ্টি হলো। আলিবক্সের মুখ থেকে চোখ ফিরিয়ে সবাই এদিক ওদিক দ্যাখে। খয়বার দিকে কিন্তু কেউ তাকায় না। সিন্দুরিয়া চরের এক লোক হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়, ‘ধরো শালাকা’
‘শালাক এখনি মারো৷’ আবার সবাইকে শান্ত হতে বলে প্রস্তাবটিকে আলিবক্স রায়ে পরিণত করে এইভাবে, সর্বসম্মতিক্রমে এই গণ-আদালত মোহাম্মদ খয়বার হোসেন গাজীকে মৃত্যুদণ্ড দানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিল।
মানুষের বিপুল কোলাহলের মধ্যে খয়বার গাজীর মুখ আরো নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। হাতের কাগজ পড়েই চলেছে আলিবক্স। এখন আফসার গাজীর অপরাধের বিবরণ দেওয়া হচ্ছে।
জমির আইনকানুন আফসার গাজী ভালো বোঝে। এসব ব্যাপারে তার কাছে কেউ এলে সে বিনা পয়সায় পরামর্শ দিয়ে থাকে। জমিজমা নিয়ে পারিবারিক সমস্যা দাখা দিলে সমাধান করার জন্যে সে সবসময় প্রস্তুত। কিছুদিনের মধ্যে সমস্যাসস্কুল পরিবারের কোনো একটি পক্ষ মামলার কাটা থেকে মুক্ত হয়ে দ্যাখে যে তাদেরই কোনো টিপসই বা ছাপের কল্যাণে জমি চলে গেছে আফসার গাজীর দখলে। আবার বন্যা কি খরা কি এমনি কোনো অভাবের সময় এলে তার তৎপরতা দারুণ বেড়ে যায়। ২৫/৩০ টাকা ধার দিয়ে আফসার তখন লেগে গেলো জমি লিখে নেওয়ার কাজে। চন্দনদহ বাজারে চায়ের দোকানের মাটির বারদায় এক বুড়ো রাত্রি কাটায়, দিনের বেলা ভিক্ষা করে বাজারের প্রান্তে বটতলায় বসে। লোকটা দাঁড়িয়ে কথা বলার জন্য খুব চেষ্টা করছে, কিন্তু উচ্ছসিত মানুষের সবাই একসঙ্গে কথা বলতে চায় বলে লোকটির সুযোগ মেলাই মুশকিল। শেষ পর্যন্ত পথচারীদের কাছ থেকে ভিক্ষা চাওয়ার পদ্ধতি প্রয়োগ করে কাঁদতে শুরু করলে সবাই তার দিকে মনোযোগ দেয়। কি ব্যাপার?—না, গতবার বড়ো বানের সময় যখন বাধের ওপর জীবনযাপন করছে আফসার গাজী তাকে ৩০টা টাকা দিয়ে সাদা কাগজে একটি টিপসই দিয়ে নেয়। সেই কাগজ পরে পরিণত হয় জমি বিক্রির দলিল। বন্যার পর তার সবেধন নীলমণি সেই ১ বিঘা জমিতে চাষবাস করতে শুরু করে আফসার গাজীর বর্গাদার। বুড়ো বাধা দিতে এলে আফসার গাজীর লোকজন তাকে এ্যাঁয়সা মার মারে যে বেচারাকে চন্দনদহ বাজারে বটতলায় না বসে আর বাঁচার পথ থাকে না। এখন তার জমি ফেরত পাবার কোনো রাস্তা কি এরা বাতলাতে পারে না? তার এই জিজ্ঞাসার জবাব দেয় ১টি ছেলে, জমি সব ফেরত নিয়া ভাগ করা দেওয়া হবে সোগলির মধ্যে সমান ভাগ হবো ছেলেটি আলিবক্সের দলের কর্মী, ভূমিবন্টন সম্বন্ধে দলের নীতি ব্যাখ্যা করে, একোজনের, মানে একো পরিবারের নামে দশ বিঘা জমি রাইখা বাদ বাকি বরাদ্দ করা হবো গরিব চাষাগোরে মধ্যে।’
এই ঘোষণায় একটা হৈ চৈ পড়ে যায়। ‘তা হবো ক্যামনে? জমির দলিল লাগবো না? পরচা লাগবো না? ‘জমি এখনি ভাগ করো। কিসের দলিল? শালাগোরে সব দলিল জাল!’ এবার আলিবক্সের দলের ঐ ছেলেটি ফের উঠে দাঁড়ায়, এতো মানুষ এক সাথে কথা কলে কাম হবো? আলিবক্স তখন গাজী মোহাম্মদ আফসার আলী ওরফে আফসার গাজীর দও ঘোষণা করে। আফসার গাজীর সমস্ত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে গরিব, চাষীদের মধ্যে বিতরণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। এর ওপর তাকে যেভাবে হোক গ্রেফতার করে ৫০ ঘা বেত মারার সিদ্ধান্তও ঘোষণা করা হলে একসঙ্গে অনেকে উঠে দাঁড়ায়। নিজ নিজ হাতে অন্তত ১০ ঘা করে বেত মারার জন্যে উদগ্রীব প্রায় ২৫/৩০ জন লোক। অনেকের গায়ে আফসার বা তার হুকুমবরদারদের মারের দাগ এখনো টনটন করে। তাকে কয়েক খামারতে পারলে এই ব্যথার উপশম ঘটে। সবাই একই বাসনা প্রকাশ করতে শুরু করলে আলিবক্স তাদের বসতে বলে, ‘আরে আফসার গাজী আর রশিদ মিয়া তো এখন গরহাজির। দুই শয়তানোক যখন পাওয়া যাবো ত বিবেচনা করা দেখলেই হবো।
রশিদ মিয়ার কি করলেন? আলিবক্স জানায় যে তারও শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু তার অপরাধ ও শাস্তির বিবরণ পড়ার সুযোগ না দিয়ে একজন দাবী করে, অশিদ মিয়ার হোল আর বিচি ক্যাটা, ছেচ্য নুন-মরিচ দিয়ে ভর্তা করা কুত্তাক খিলাও। তার লিঙ্গ ও অণ্ডকোষ সহযোগে এই খাদ্যবস্তু প্রস্তুতের প্রস্তাবে অনেকেই হাসে, তবে কেউ প্রতিবাদ করে না। কারণ নারী সহবাস হলো রশিদ মিয়ার সবচেয়ে প্রিয় অভ্যাস। নারী-ভোগের ব্যাপারে লোকটি শ্রেণীচু্যত, চাষাভূষা বা কমলাপাটের বেঝিদের প্রতি তার পক্ষপাতিত্ব বরং বেশি। চন্দনদহ বাজারের পশ্চিমে এতো চমৎকার বেশ্যাপাড়া-কতোকাল থেকেই এই এলাকার ভদ্রলোকদের উদৃত্ত কাম মেটাবার জন্য সেটা যথেষ্ট বলে বিবেচিত হয়ে আসছে.–অথচ রশিদ মিয়া তার ধারে কাছেও যাবে না। অন্যান্য ঋতুতে দুপুর বেলা এবং ধান কাটার সময় চাষীরা পশ্চিমে খিয়ার অঞ্চলে গেলে সন্ধ্যার পর সে চাষাদের বাড়ির আশে পাশে ঘুরঘুর করে। একবার ১টি মেয়ের স্বামী হাতে দা নিয়ে তেড়ে এলে রশিদ মিয়া পালিয়ে এসেছিলো। কিন্তু ১সপ্তাহের মধ্যে মিয়া বাড়িতে চুরির তদন্তে এসে পুলিস ঐ লোকটিকে ধরে নিয়ে যায়। থানা পুলিস ও কোর্ট-কাছারি করতে করতে লোকটা ফতুর হলো এবং তারই আদেশে তার বৌ শেষ পর্যন্ত কাজ খুঁজতে যায় রশিদ মিয়ার বড়ি। কিন্তু রশিদ মিয়া তদিনে তার প্রতি আসক্তি হারিয়ে ফেলেছে। সুতরাং মেয়েটি তার স্বামীকে কোনো সাহায্য করতে পারলো না। ভিটামটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে তারা চলে গেলো যমুনার গভীরে ভেতরে কোনো চরে। তার ভিটার ওপর এখন রশিদ মিয়া ডিপ-টিউব ওয়েল বসিয়ে চমৎকার ইরি ধানের চাষ করছে।
আলিবক্স রশিদ মিয়ার জমি দখল করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে প্রৌঢ় একজন চাষী উঠে দাঁড়ায়, তার আবেদন, তার ডিপকল উঠায়া হামার ভিটাত আবার বাড়িঘর তুলবার চাই।’
কিন্তু রশিদ মিয়াও অনুপস্থিত। ধরতে পারলেই তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। চেংটু জিগ্যেস করে, যাই হাজির আছে তাকে তো ফাঁসি দেওয়া হবো? ‘হু ফাসি না, মৃত্যুদণ্ড যেমন করা হোক মারা হবো। কখন? এইবার খয়বার গাজী মুখ তুলে চেষ্ট্রর দিকে সরাসরি তাকাবার চেষ্টা করে। তার ধারণা চেন্টুর সঙ্গে চোখাচোখ হলে চাষার ছেলে একটু দমে যাবে। কিন্তু খয়বারের চোখ নিম্প্রভ, সে ২টো দৃষ্টিবঞ্চিত হয়ে এদিক ওদিকে ঘুরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে নিচের দিকে। পান জরদার খয়েরি ঠোঁটজোড়া খুব কাপছে, কাপন থেকে মনে হয় না সেগুলো কোনো শব্দ বের করতে সক্ষম। তার পেছনে দাঁড়িয়ে নাদু বলে, ’ও মিয়া, কথা কন। চ্যাংড়াপ্যাংড়াক বুঝ দিয়া কথা কন। জালালউদ্দীন মাস্টার একবার উঠে দাঁড়িয়ে ফের বসে পড়ে। খয়বার গাজীর শরীরের সবটাই এখন কাপছে। চেন্টু এগিয়ে যায় আলিবক্সের দিকে, ভাইজান আসামীক ক্যামন কর্যা কোপ দেওয়া লাগবো কয়া দ্যান!
বিকালবেলার আলো তার কুড়ালে ঠিকরে পড়ছে। চেষ্ট্রর শরীর একটু একটু কাপে, কিন্তু তার চোখ স্থির। আনোয়ারের দেহেও চঞ্চলতা, তার চোখ দুটো এখন একেবারে ফাক হয়ে গেছে, পলক ফেলা কঠিন। খোলা চোখ দিয়ে সে বটবৃক্ষের আগাপাস্তালা দাখার চেষ্টা করে। গাছের ওপর মনে হয় পাতলা কালি জমেছে, কোনো কোনো পাতার গুচ্ছে আরো ওপরকার আলো পড়ায় সেইসব জায়গা ঝকঝক করে। নিচে কোনো জায়গা খালি নাই। মানুষ, কেবলি মানুষ। মানুষের নীরব মুখগুলো ক্রমে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে।
আলিবক্স বলে, চেংটু, আগায়া আসো।
হঠাৎ হু হু কান্নার ধ্বনি এই ভয়াবহ নীরবতাকে ছিঁড়ে ফেলার আয়োজন করে। আনোয়ার চট করে তাকায় বটগাছের মাথার দিকে শালার পুরনো বাসিন্দা কি নতুন কোনো উৎপাত শুরু করলো? না। কাদছে খয়বার গাজী। আর কাঁদে নাদু। কাঁদতে কাঁদতে নাদু ইটু ভেঙে বসে পড়ে, হামার ব্যাটা হয় তুই মানুষ খুন করবু?
এই মানুষটা কতোগুলো মানুষের জান কবচ করছে তার হিসাব রাখে? এই মানুষ কতোগুলা মানুষের রুজি নষ্ট করছে, কও তো? ছেলের জবাব শুনে তার কান্না আরো উথলে ওঠে।
কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ায় জালালউদ্দিন, আমার একটা আরজি আছিলো।
তাড়াতাড়ি কন। বেলা যায়। আন্দারের মধ্যে কাম সারা কঠিন। আলিবক্সের অনুমতি পেয়েও জালাল মাস্টার দাঁড়িয়ে কাপে।
আলিবক্স তাগাদা দেয়, তাড়াতাড়ি কন গো! জালাল মাস্টারের চোখ তখন আনোয়ারের দিকে। আনোয়ার একটু এগিয়ে আসে, বলেন। ভয় কি? বলেন না!
আলিবক্স হঠাৎ ডাকে, চেংটু, রেডি হ।
জালাল মাস্টারের ঠোঁট কাপে, হাজেরানে মজলিসের কাছে-।
কে যেন সংশোধন করে, কন গণ-আদালত!
মহামান্য গণ-আদালতের নিকট মৌলভি মোহাম্মদ খয়বর গাজী সাহেব করুণা ভিক্ষা করেন।’
সমাবেশ জবাব দেয়, উগল্যান ধাদার কথা থোন।’
শালাক এটি কোপ দিয়া মারার পরে গোর আজাব আরম্ভ হবো। তখন বুঝবো মানুষের উপরে জুলুমের ঠেলা আল্লার বিচার যখন আরম্ভ হবো।
‘আঃ! চুপ করেন। আলিবক্সের এই নির্দেশে লোকজন থামলে জালালউদ্দিন ফের মুখ খোলে, ‘আপনেরা তাক একটা সুযোগ দেন। তওবা করার সুযোগ দেন।’
না। সুযোগ বহুত পাইছে।
জালাল মাস্টার বলে, ‘না, সেই কথা নয়। খায়বার গাজী সাহেবের একটি প্রার্থনা, কাল তিনি জুম্মার নামাজ আদায় করবার চান। তার এই অন্তিম বাসনা—।
তার ইচ্ছা তাকই কবার দেন। আলিবক্সের এই শর্ত আনোয়ার অনুমোদন করতে পারে না। বলুক না। তিনি না বলতে পারলে আর কেউ বললে ক্ষতি কি?
জালালউদ্দিন এবার সাহস পায়, ‘বাবারা, দোষক্রটি নিয়াই মানুষ। তার পাপতাপের শাস্তিও তো তাই ভোগ করবো মৃত্যুর আগেই তাই একবার জুম্মার নামাজ পড়বার চায়। এই কথার পুনরাবৃত্তি করলে সবাই হঠাৎ চুপ করে এবং শেষ বিকালের ময়লা আলোতে গোটা বটগাছ জুড়ে শালিক হরিয়াল চ্যাচাতে থাকে। করমালি বলে, উগল্যান রসের কথা থোন!
চেন্টু ঘুরে দাঁড়ায় সমাবেশের দিকে মুখ করে এই মানুষের আবার নামাজ বন্দেগি কি? তামাম জেবন তাই মানষেক জল্যা পুড়া মারছে। চুরি করছে। তার আবার নামাজের হাউস হয় কিসক?’
নাদু ডুকরে কেঁদে ওঠে, এতো বড়ো নামী মানুষটা, তার একটা হাউস রাখবেন না বাবা? আলিবক্স প্রস্তাব করে, আদালতের নিকট আমি একটা আবেদন করি। আসামীরে মগরেবের নামাজ পড়ার অনুমতি দেওয়া হোক। বাদ মগরেব তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবো।
সমাবেশ থেকে অনুমোদন পাওয়া যায়। একজন বলে, হাজার হোক, আল্লার নাম নিবার চায়। দ্যাও বাপু, মগরেবের নামাজ পড়বার দাও।
বাবারা, বুদ্ধি হওয়ার পর জুম্মার জামাত কোনোদিন বাদ দেই নাই। একবার কঠিন রোগ হলো, দুই মাস কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে, এই আনোয়ার বাবাজীর বাপখয়বার গাজী কান্নায় ভেঙে পড়ে, আনোয়ারের বাবার সেবা শুশ্ৰুষার বিবরণ স্পষ্ট বোঝা যায় না। আনোয়ার একটু অবাক হয়, খয়বার গাজী হঠাৎ এতোগুলো কথা বলে ফেললো কি করে? জুম্মার নামাজ পড়ার বাসনা কি তার মধ্যে এতোই শক্তি সঞ্চার করলো? তার চোখ এখনো নিচের দিকে। ফ্যাসফ্যাসে গলায় সে প্যানপ্যান করে, জেলহজ্জ্ব চাদের পয়লা জুম্মাটা পড়া যদি মরবার পারি তো—!
সবাই এখন চুপ। আনোয়ার ভয় পায়, লোকটার এই শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করতে না দিলে সমাবেশের ভেতর আবার বিপরীত প্রতিক্রিয়া না হয়। শোনেন’, আলিবক্সের কানের কাছে
মুখ নিয়ে আনোয়ার ফিসফিস করে, ব্যাপারটা কনসিডার করতে হয়। মানুষের সেন্টিমেন্ট আবার হার্ট না হয়!
আলিবক্সের স্বরের মাত্রা কিন্তু স্বাভাবিক, ‘আরে রাখেন। শালা টাইম চায়, বুঝলেন না? পাবলিক ঠিকই বোঝে, মানুষের বুদ্ধিসুদ্ধি আপনার চায়া কারো কম না, বুঝলেন?
জালালউদ্দিন এবার হঠাৎ হাত ধরে ফেলে আলিবক্সের, বাবা, তুমি আমার ছাত্র না হলেও পুত্রতুল্য। তোমার আত্মীয়স্বজন ইষ্টিকুটুম্বের মধ্যে আমার ছাত্র নিশ্চয়ই আছে– ‘
‘মাস্টার সায়েব, আমার জ্ঞাতিগুষ্টির মধ্যে আপনার ছাত্র থাকা সম্ভব নয়। বংশের মধ্যে ল্যাখাপড়া করছি খালি আমি একলাই।’
একটু দমে গেলেও জালালউদ্দিন হাল ছাড়ে না। একটা দিন দিব্যার পারেন না? নিজেগোরে মসজিদ, দাদাপরদাদারা বানায়া গেছে, একটা দিন খালি জুম্মার জামাত পড়বো!
আলিবক্স জবাব না দিয়ে খয়বার গাজীর অপরাধের তালিকা লেখা লম্বা কাগজটা ভালো করে পরীক্ষা করে। দলের কর্মীরা কাগজটা খয়বারের পিঠে ঠেকিয়ে দেখে নিলো, একটু পর মৃতদেহের সঙ্গে সেঁটে দেওয়া হবে। খয়বারের প্যানপাননি পরিণত হলো হাউমাউ আর্তনাদে। জেলহজ্জ্ব চাদের প্রথম জুম্মার নামাজ পড়ার আকুল পিপাসা তার মাথায় চড়ে, আল্লার নাম বাদ দিয়ে সে তার করাচি, ঢাকা ও বগুড়া শহরে বসবাসকারী ৩ ছেলে, মৃত কন্যা এবং বাপের বাড়িতে বেড়াতে-যাওয়া স্ত্রীর নাম ধরে ডাকতে থাকে। এই আর্তনাদের মর্মোদ্ধার করা আনোয়ারের পক্ষে অসম্ভব। লোকটাকে নামাজ পড়ার সুযোগ দেওয়াটা বোধ হয় উচিত। কিন্তু আলিবক্স রাজি হতে চায় না, তার আসল মতলব কাইটা পড়া!
আলিবক্সের কানে মুখ নিয়ে আনোয়ার ফিসফিস করে, মরার আগে একটা দিন কি এসে যায়? সরকারী আদালতেও তো দেয়!
খয়বার গাজীর হাউমাউ কান্না নাদুকেও জোরে জোরে বিলাপ করতে উদ্বুদ্ধ করে, এই গাওয়ের উপরে আল্লার গজব পড়বো বাবা।
ওদিকে একটু দূরে গাবতলার দিকে কয়েকটা আলো দেখা যাচ্ছে। বাদু শেখ ও নবেজউদ্দিন তাই দেখে নিজেদের মধ্যে কানাকানি করে, বটবৃক্ষের পুরনো বাসিন্দা তার বাস্ত ভিটায় মানুষের সমাগম ও কোলাহলে ক্রুদ্ধ হয়ে কি শাস্তি দিতে আসছে? করমালিও ভয় পায়, সলক কিসের গো? হাতের দায়ের ওপর তার আঙুলগুলো চেপে বসে। একটা হাজাকের আলো কাছাকাছি চলে এলে পেছনে ২০/২৫ জনে একটা মিছিল স্পষ্ট হয়। মিছিল সামনে পৌছুবার আগেই শোনা যায়, আগরতলা ষড়যন্ত্ৰ’-মানি না মানি না’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা:-তোমার আমার ঠিকানা’, ‘জেলের তালা ভাঙবো’-শেখ মুজিবকে আনবো’।
মিছিলের সামনে প্যান্ট-শার্ট, পাজামা-পাঞ্জাবি পরা কয়েকজন কলেজের ছাত্র। সমাবেশের মানুষ ওদের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। ওদের একজন আলিবক্সকে চেনে, *আপনাদের মিটিং?
‘গণ-আদালত বসছে।’ ভালো করছেন। পশ্চিমাদের দালালগুলারে শাস্তি দেন।’ চেংটু আলিবক্সের শরীর ঘেঁষে দাঁড়ায়, বড়ো দেরি হয়ে যাচ্ছে, খয়বার গাজীকে এক্ষুনি শেষ করে ফেলা দরকার।
কিন্তু হ্যাঁজাকওয়ালা মিছিল তখন সমাবেশে ঢুকে পড়েছে। এদের একজন বক্তৃতা শুরু করে, ভাইসব, স্বৈরাচারী আইয়ুব শাহী মোনেম শাহীর শোষণে সোনার বাঙলা শ্মশানে পরিণত হয়েছে। চেংটু বক্তার দিকে এগিয়ে যায়, এখন ইগল্যান থোন। হামাগোরে কাম হবা নাগছে। কিন্তু সমবেত মানুষের কেউ কেউ বস্তৃতা শুনতে চায়, হোক না! ভাষণ হোক!’
উৎসাহিত যুবক তার বক্তৃতা অব্যাহত রাখে, বাঙালির প্রাণের দাবী, বাঁচার দাবী নিয়ে আন্দোলন করার অপরাধে বাঙলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসম্বাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান আজ পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্রের শিকার। বাঙালি আজ ঐক্যবদ্ধ, একমন, একচিত্ত—।
আলিবক্স তাদের একজনকে ডেকে বলে, আমাদের আদালতের কাম হয়া যাক। আপনে না হয় পরে লেকচার দিয়েন।’
বক্তা যুবক থামতে পারে না। তার দলের লোকটি বলে, আমরা তো লেকচার দিতে আসিনি। চন্দনদহ বাজারে কাল আমাদের সভা, তাই ঘোষণা করতে এসেছি।
এদের কেউ কেউ জালালউদিনের ছাত্র। তার সঙ্গে কথাবার্তায় বোঝা যায় একজন পড়ে রাজশাহী ইউনিভারসিটিতে। আর একজন বগুড়া আজিজুল হক কলেজের ছাত্র। আর বক্তৃতা করছে যে ছেলেটি সে হলো দরগাতলার সরকারদের ছেলে, বরাবর ঢাকাতেই মানুষ, ঢাকা ইউনিভারসিটির নিমনেতা গোছের ছাত্র। জালালউদ্দিন তার ভাষণে অভিভূত, বোঝাই যায়, ভাষার উপর ছেলের দখল খুব!’
কিন্তু অধৈর্য হয়ে ওঠে চেংটু, কথা তো মেলা কলেন। আপনাগোরে মিটিঙে কাল যাওয়া হবো। এখন আমাগোরে কাম করবার দ্যান তো!
চেংটুর হাতে কুড়াল এবং চোখের স্থির মণি দেখে বক্তা ও তার সহকর্মীরা থামে। তাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়-প্রদত্ত সদাসপ্রতিভ অভিব্যক্তি দিয়ে এই ভড়কে-যাওয়া সামলানো দায়। আগামীকাল বিকেল ৩টায় চন্দনদহ বাজারে তাদের জনসভায় যোগদানের আহ্বান জানিয়ে তারা পা দেয় হয় গ্রামের রাস্তায়। কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের শ্লোগান এসে প্রতিধ্বনিত হয় বটগাছের পাতায় এবং ডালে। ওরা যাবার পর বোঝা গেলো যে সমাবেশের লোকও একটু কমে গেছে। আরো কিছুক্ষণ পর বোঝা যায় যে কয়েকজনের ছোটো একটি দল সমাবেশ থেকে বেরিয়ে হেঁটে যাচ্ছে গাজী বাড়ির দিকে। কারা? আনোয়ার পাউঁচু করে দেখবার চেষ্টা করছে, ৫/৬ জন লোকের ছায়া ছায়া গতি ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ছে না। কারা?
করমালি বলে, না, হামাগোরে মানুষ! ‘কোথায় যাচ্ছে? কেউ জবাব দেয় না। হঠাৎ করে উত্তরদিকের আকাশ আলোকিত হয়ে ওঠে। কি হলো? আগুন? হ্যাঁ, আগুনের শিখা গোলাপি রজনীগন্ধার মতো দুলে উঠলো। কি হলো? চেংটু শাও গলায় জানায়, গাজীবাড়ির খানকা ঘর পোড়া।’ ‘এ্যাঁ? আনোয়ার চমকে ওঠে, খয়বার গাজীর বৈঠকখানার দালানে আগুন লাগালো কে? দেখতে দেখতে আগুনের শরীর থেকে কোমলতা লুপ্ত হয়, চওড়া ও লম্বা শিখায় আগুন আকাশভুক হবার উদ্যোগ নেয়।
‘আল্লা গো’ বলে প্রাণঘাতী একটি চিৎকার করে খয়বার গাজী মাটিতে পড়ে যায়। আনোয়ার চমকে ওঠে, চেন্টু এরকম হঠাৎ করে কুড়ালের বাড়ি মেরে লোকটাকে কি শেষ করে ফেলল?
না, তাকে কেউ স্পর্শ করেনি। গৃহদাহের দৃশ্য তার এই আকস্মিক শোকাধিক্যের কারণ। মুহুর্তের মধ্যে করমালি ও পচা তাকে ধরাধরি করে তোলে। করমালির পায়ে পোড়ার ঘা, তার পক্ষে অতো বড়ো দেহ ধরে রাখা মুশকিল। তাই তার জায়গায় নেয় চেংটু, চেংটুর কুড়াল নিচে পড়ে রইলো। পচা ও চেন্টু খয়বার গাজীকে নিয়ে ছুটতে শুরু করে উত্তরের অগ্নিকাণ্ডের দিকে। আনোয়ার হতচকিত হয়, কি হলো? চেংটু! কোথাও যাচ্ছে? আলিবক্স কিছু না বলে ওদের অনুসরণ করে। করমালি তাদের সঙ্গে খোড়াতে খোড়াতে দৌড়ায় আর চিৎকার করে, শালাক আজ হোসেন ফকিরের দশা করমু! আসোগো, সেগলি আসো শালা মাকুচোষা ডাকাত শয়তানকে আজ আগুনের মদ্যে পোড়ানো হবো!
আনোয়ার ছুটতে ছুটতে বলে, আলিবক্স, আলিবক্স’ আলিবক্স ছুটতে ছুটতে পেছনে তাকায়, তাড়াতাড়ি আসেন। -আলিবক্স, গণ-আদালতের স্পিরিট থাকছে না। এটা ঠিক হচ্ছে না। আলিবক্স খুধু ফেলে, স্পিরিট তো নষ্ট হয়াই গেছে। জুম্মার নামাজ নিয়া কাউল পয়দা করলেন। তা শয়তানটারে বাচাবার পারলেনকৈ?
আনোয়ার প্রাণপণে ছোটে, তার জমাট-বাধা মাথা টলোমলো: খয়বার গাজীকে সে বাঁচাবার চেষ্টা করবে কেন? তার অপরাধ তাতে কয়েকবার ফাঁসি দিলেও তার উপযুক্ত শান্তি প্রদান হয় না। থানা পুলিশ, কোর্ট-কাছারি সব যখন প্রহসন তখন গণ-আদালত গঠন না করে আর পথ কি? এসব কি সে কারো চেয়ে কম বোঝে? খয়বারকে সে বাঁচাতে যাবে কেন? গাজীদের সঙ্গে আত্মীয়তার তার কি এসে যায়? এখানকার পৈতৃক সম্পত্তির সঙ্গে সে তো সম্পর্কহীন, ২পুরুষ ধরে সম্পর্কহীন। তাহলে?-প্রকৃতপক্ষে দণ্ডিতের একটি বিশ্বাস, না বিশ্বাস নয়, একটি ইচ্ছাকে স্বীকৃতি দিয়ে সে গণ-আদালতের মর্যাদাময় চরিত্র গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলো। খয়বার গাজীকে জানোয়ারের পর্যায়ে নামিয়ে দিলে তাকে মেরে ফেলার জন্যে এতো মানুষের অনুমোদনের দরকার ছিলো না। তার সমস্ত কাপড়চোপড় খুলে তাকে একটা পাগলা কুত্তায় পরিণত করে মারলে তার সঙ্গে সাধারণ হত্যার পার্থক্য কি? খয়বারকে শাস্তি দেওয়া দরকার। কাল আনোয়ার নিজে তাকে মারবে, দা দিয়ে হোক কুড়াল দিয়ে হোক-খয়বার গাজীর ঘাড়ে প্রথম ও চূড়ান্ত কোপট দেবে আনোয়ার নিজে।
আলিবক্স চেস্ট্রকে ধরে ফেলেছে, চেন্টু, এটা কি করলি? চেন্টু উদ্ধত চোখ নিচের দিকে নামে। খয়বার গাজী মাটিতে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে থাকে। আলিবক্স চেংটুর ডান হাত ধরে ঝাকায়, আদালতের সোগলির মতামত অসম্মান করা আসামীকে নিয়া তুমি দৌড় মারছে কিসক?
তাক আগুনে দিয়া মারা দরকার। আপনেরা কি তাক মারবার দিবেন?
কোন শাল তাক রক্ষা করবার পারে? আদালত তার মৃত্যুদণ্ড সাব্যস্ত করছে। তার অপরাধ সোগলি একটা একটা করা লেখা তার পিঠোত লাগায় দেওয়া হবো। তাইলে আর সব শয়তান শয়তানি বন্দ করবো। তুমি শালাক খালি খুন করবার চাও? খয়বারেক পুড়ায়৷ মারা তুমি আরেক খয়বার হবার চাও? এদিকে গাজীদের বৈঠকখানা জ্বলে যাওয়ার দপদপ আওয়াজ ছাপিয়ে শোনা যায় জালাল মাস্টারের চিৎকার, আরে, তামাম গাঁও পুড়া যাবো গো! পানি ঢালো, পানি ঢালো।’
পুডুক। করমালি প্রতিবাদ করে, শয়তানে গুনাগরি দিবো না?
আরো কেউ কেউ হৈ হৈ করে ওঠে, শালার সব শ্যাষ হয়া যাক!’
জালাল মাস্টার সর্তক করে, আরে গাও দগ্ধ হয় যাবো!
হামাগোরে আছে কি? শালারাই তো ব্যামাক নিয়া নিজেগোরে ঘরোত তুলছে!
‘আরে পরিবার আছে না? তোমাদের স্ত্রীপুত্রকন্যা আছে না? জালাল মাস্টারের আহবানে সাড়া দিয়ে এবার অনেকে তার কাছে আসে। খয়বারের আত্মীয়স্বজন কারো টিকি দাখা যায় না, ভয়ে সবাই এদিক ওদিক গা ঢাকা দিয়েছে। জালালউদ্দিন তাই সমাবেশের লোকদের কিসব নির্দেশ দেয়। দেখতে দেখতে প্রচুর পরিমাণে মাটির কলসি বদনা বাটি চলে আসে। বাড়ির সামনে পুকুর থেকে পানি তুলে লোকজন খয়বার গাজীর বৈঠকখানা আগুন নেভাবার কাজে তৎপর হয়ে ওঠে।