ক্রিমি
ক্রিমিরা জোঁক ও কেঁচোর জাত-ভাই। কিন্তু ইহারা নিতান্ত অধম শ্রেণীর প্রাণী এইং সম্পূর্ণ পরাশ্রিত। মানুষ বা জন্তুদের দেহের ভিতরেই ইহাদের বাস। যাহাদের দেহে আশ্রয় লয় ইহারা তাহাদেরি শরীরের রস চুষিয়া খাইয়া বড় হয়। তোমরা হয় ত ক্রিমি দেখিয়াছ; দেখিলেই ঘৃণা হয়। এমন কদর্য্য প্রাণী বোধ হয় আর নাই। ইহাদের জীবনের কথা শুনিলে তোমাদের আরো ঘৃণা হইবে।
ক্রিমি নানা রকমের আছে। সচরাচর আমরা যে, সকল ক্রিমি দেখিতে পাই,—তাহা কেঁচোর মত, কিন্তু সাদা। আবার ছোট সাদা ক্রিমি আছে, সেগুলি কেঁচোর বাচ্চার চেয়ে বড় হয় না। দেখিলে মনে হয়, সেগুলি যেন, এক একটি আলপিন্। ক্রিমিদের মধ্যে যেগুলি অতি ভয়ানক তাহাদিগকে পাটা-ক্রিমি বলে। আমরা প্রথমে পাটা-ক্রিমিদের কথা বলিব।
মানুষের অন্ত্রে অর্থাৎ পাকযন্ত্রে ইহাদের বাস। যখন বড় হয়, তখন ইহাদিগকে সাদা ফিতের মত দেখায়। এক একটা পাটা-ক্রিমি দুই হাত হইতে ছয় সাত হাত পর্য্যন্ত লম্বা হয়। কেঁচোর শরীরে যেমন আংটির মত অংশ জোড়া থাকে, ইহাদের দেহেও ঠিক্ সে রকম ছোট ছোট অংশ জোড়া আছে। কতকগুলি টুক্রা ফিতা জুড়িয়া একটা ছয় হাত লম্বা ফিতা তৈয়ার করিলে যে রকম হয়, ইহাদের শরীরটা সেই রকমের। কিন্তু টুক্রাগুলি পরস্পর খুব শক্ত করিয়া জোড়া থাকে না।
এখানে একটা বড় পাটা-ক্রিমির ছবি দিলাম। দেখ, ইহার দেহে কত টুক্রা টুকরা অংশ আছে। ইহার সম্মুখের দিক্টা কত সরু হইয়া আসিয়াছে, তাহাও ছবিতে দেখিতে পাইবে। এই দিক্টায় একটি মাথা আছে। মাথা অত্যন্ত ছোট, কিন্তু গায়ের রস চুষিয়া খাইবার জন্য ছোট মাথায় যে ব্যবস্থা আছে, তাহা অতি ভয়ানক!
পাটা-ক্রিমির মাথা অতি বিশ্রী। এই মাথা এবং সর্ব্বাঙ্গ দিয়া ক্রিমিরা মানুষ ও পশুর পেটের ভিতরকার সার অংশ চুষিয়া খায়। তা ছাড়া মাথায় বড়শির মত অস্ত্র আছে এবং মাথাকে এক স্থানে আটকাইয়া রাখিবার যন্ত্র আছে। সেগুলি পেটের নাড়ীভুঁড়ির গায়ে এমন করিয়া লাগিয়া যায় যে, ক্রিমিদিগকে কোনক্রমে পেট হইতে বাহির করা যায় না।
পাটা-ক্রিমির দেহ এত লম্বা হইলেও, ইহাদের পেট নাই বা পাকযন্ত্র নাই। মাথায় মুখের মত কয়েকটা অংশ থাকিলেও প্রকৃত মুখ তাহাদের শরীরের কোনো জায়গায় খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। মানুষ বা পশুর পেটের মধ্যে যে-সকল খাবার যায়, ক্রিমিরা সকল দেহ দিয়া তাহা চুষিয়া লইয়া নিজেদের দেহ পুষ্ট করে। এই রকম সাত হাত লম্বা প্রাণী যদি দিবারাত্রিই পেটের ভিতরকার খাবার চুষিয়া খায়, তখন মানুষের বাঁচিয়া থাকা দায় হয়। এই জন্যই মানুষ বা পশুর পেটে পাটা-ক্রিমি জন্মিলে ভয়ানক বিপদ হয়।
পাটা-ক্রিমিরা যে-রকমে দেহের বৃদ্ধি করে তাহা বড় আশ্চর্য্যজনক। গোড়ায় ইহারা ছোট থাকে। মানুষের পেটের ভিতরকার ভালো খাবার খাইয়া মোটা হইতে আরম্ভ করিলে ইহাদের শরীরে এক-একটা নূতন টুক্রা জন্মিতে আরম্ভ করে। যদি কোনো গতিতে দুই চারিটি টুক্রা শরীর হইতে খসিয়া যায় তাহাতেও উহাদের ক্ষতি হয় না। এই রকমে দেহ ছোট হইবামাত্র, লেজের দিকে আবার নূতন টুক্রা গজাইতে আরম্ভ করে।
পাটা-ক্রিমিদের দেহের দুই পাশে দুইটা স্নায়ু রজ্জু আছে কাজেই বলিতে হয় ইহাদের দেহ সম্পূর্ণ অসাড় নয়।
এই অদ্ভুত প্রাণীদের কি রকমে বাচ্চা হয়, তাহা এখনো বলা হয় নাই। তাহাও বড় আশ্চর্য্যজনক।
পাটা-ক্রিমিদের স্ত্রী-পুরুষ ভেদ নাই। বেশ পরিপুষ্ট হইলে ইহাদের লেজের দিকের গাঁটে গাঁটে ডিম হয়। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, সেগুলি মানুষের দেহের মধ্যে ফোটে না। বোধ হয়, ক্রিমির হাত হইতে মানুষকে রক্ষা করিবার জন্যই ভগবান্ এই ব্যবস্থা করিয়াছেন। যাহা হউক দেহের গাঁটে ক্রিমিদের ডিম পুষ্ট হইলেই গাঁট ছিঁড়িয়া যায় এবং ডিম সঙ্গে করিয়া টুক্রাগুলি বিষ্ঠার সহিত দেহ হইতে বাহির হইয়া পড়ে। কাজেই পেটের ভিতরে আর নূতন ক্রিমি জন্মিতে পারে না।
এখন তোমরা বোধ হয় ভাবিতেছ, ক্রিমির ডিম যখন দেহের বাহিরেই চলিয়া গেল, তখন তাহাদের বাচ্চা কি রকমে মানুষের পেটে আশ্রয় করিবে?
ক্রিমিদের ডিম-ফোটা এবং মানুষের পেটে আশ্রয় লওয়া প্রভৃতি সকলি অদ্ভুত। মানুষের বিষ্ঠার সহিত বাহির হইয়া ডিমগুলি অনেক দিন মাটির উপরে থাকে। রৌদ্রে জলে ঝড়ে সেগুলির বিশেষ ক্ষতি হয় না। শূয়ার বড়ই লক্ষ্মীছাড়া পেটুক জানোয়ার। যেখানে সেখানে মাটি খুঁড়িয়া ইহারা ঘাসের শিকড় খায়; আলু মূলা কচুর গাছ ইহাদের অত্যাচারে রাখা দায়। গোরুও কম পেটুক নয়; দিবারাত্রিই ইহাদের খাবারের দিকে নজর। বেশ তাজা ছোট গাছ বা নরম ঘাস দেখিলে ইহারা মুখ বন্ধ করিয়া রাখিতে পারে না। খাবার সময়ে ইহারা স্থান-অস্থান বা কাল-অকাল ভাবিয়া দেখে না। যে-সকল অপরিষ্কার জায়গায় ক্রিমির ডিম ছড়াইয়া থাকে, গরু-শূয়ারেরা সেখানে চরিবার সময়ে ঘাস-পাতা বা ফলমূলের সঙ্গে কখনো কখনো তাহা খাইয়া ফেলে। এই রকমে একবার ডিম পেটের মধ্যে গেলে আর রক্ষা থাকে না। ডিমগুলি তাহাদের পেটের ভিতরে গিয়া ফুটিতে আরম্ভ করে।
তোমরা হয় ত মনে করিতেছ, ডিম ফুটিলেই বুঝি সেই ফিতার মত চেপটা ছোট ক্রিমি জন্মিবে। কিন্তু গোরু বা শূয়ারের পেটে ডিম ফুটিলে ক্রিমির চেহারা সে-রকম হয় না। এই সময়ে তাহারা অসম্পূর্ণ ক্রিমির আকারে জন্মে এবং মাংস কাটিয়া শরীরে প্রবেশ করিবার জন্য তাহাদের প্রত্যেকের মাথায় ছয়টা করিয়া বাঁকানো করাত উৎপন্ন হয়। ক্রিমির বাচ্চারা এই অস্ত্র দিয়া ধীরে ধীরে গোরু শূয়ারের মাংস কাটিয়া কিছুকাল মাংসের মধ্যে বেশ আরামে বাস করিতে থাকে।
এই অবস্থায় ক্রিমি-শাবকদের শরীরের আর কোনো বিশেষ পরিবর্ত্তন হয় না। কেবল প্রত্যেকের পিছনে এক একটা থলির মত অংশ গজাইয়া উঠে মাত্র। এই রকম প্রাণীরা যে পরে সাত আট হাত লম্বা পাটা-ক্রিমির আকার পাইবে, তাহা উহাদের এখানকার চেহারা দেখিলে কিছুতেই আন্দাজ করিতে পারা যায় না।
গোরু ছাগল ভেড়া শূয়ার যেমন গাছ-পালার শত্রু, তেমনি এই পৃথিবীতে গোরু শূয়ার প্রভৃতিরও অনেক শত্রু আছে। মানুষই এই সকল শত্রুর মধ্যে প্রধান। পৃথিবীতে অনেক দেশের অনেক লোকে কেবল মাংস খাইবার জন্য গোরু ও শূয়ার পোষে। যে-সকল গোরু ও শূয়ারের মাংসে ক্রিমির বাচ্চারা বাসা করে, সেগুলিকেও মানুষ হত্যা করে এবং তাহাদের মাংস খায়। মানুষ কাঁচা মাংস খায় না, প্রথমে উহা আগুনে ঝল্সাইয়া ভাজিয়া লয় বা সিদ্ধ করে এবং তার পরে উহা খায়। গোরু বা শূয়ারের মাংসে যে ক্রিমির বাচ্চা থাকে, তাহা আগুনের একটু বেশি তাপ পাইলে মরিয়া যায় কিন্তু তাপ অল্প হইলে বা সিদ্ধ কম হইলে সেগুলি আধ-সিদ্ধ বা আধ-ভাজা মাংসে বেশ জীবন্তই থাকিয়া যায়। এই রকমে মাংসের সঙ্গে ক্রিমির বাচ্চা খাইলেই মানুষের সর্ব্বনাশ হয়। শরীরের ভিতরে গিয়াই তাহারা সেই বড়শির মত শুঁয়ো পেটের গায়ে বিঁধাইয়া দেয় এবং আমরা যে-সকল ভালো খাদ্য খাই, তাহাই সর্ব্বাঙ্গ দিয়া চুষিয়া তাহারা ক্রমে প্রায় পাঁচ সাত হাত লম্বা পাটা-ক্রিমি হইয়া দাঁড়ায়।
গোরুর মাংসের ইহাই একমাত্র ক্রিমি নয়, ইহার চেয়ে আর এক রকম ভয়ানক ক্রিমির বাচ্চাও তাহাতে থাকে। আধ-সিদ্ধ মাংসের সহিত সেগুলি মানুষের পেটে পড়িলে, সেগুলি পেটের ভিতরেই কখনো কখনো কুড়ি হাত পর্য্যন্ত লম্বা হয়।
আমাদের দেশের অতি-অল্প লোকেই গোরু বা শূয়ারের মাংস খায়। তাই পাটা-ক্রিমির উৎপাত আমাদের মধ্যে অনেক কম। শীতের দেশের লোকে ঐ সব মাংস বেশি খায়। গরিব লোকেরা আবার অনেক সময়ে আধ-সিদ্ধ মাংসই খাইয়া ফেলে। এই জন্য ঐ-সকল লোক ক্রিমির উৎপাতে খুব কষ্ট পায় এবং অনেক লোক মারাও যায়। পাটা-ক্রিমি যে কেবল মানুষের শরীরেই হয়, তাহা নয়। কুকুর, বিড়াল, ছাগল, ভেড়া প্রভৃতি জন্তুদের দেহেও ইহা জন্মে।
গোল ক্রিমি
মানুষের শরীর হইতে যে কেঁচোর মত গোল সাদা ক্রিমি বাহির হয়, তাহারা পাটা-ক্রিমিদের চেয়ে অনেক রকমে উন্নত, কিন্তু তাহাদের দেহে কেঁচোর মত দাগ কাটা দেখা যায় না। ইহা দেখিলেই বুঝা যায়, ইহাদের দেহ কেঁচোর ন্যায় অনেকগুলি আংটি দিয়া প্রস্তুত নয়। কেঁচোদের স্ত্রী-পুরুষ ভেদ নাই, কিন্তু এই ক্রিমির দল কতক পুরুষ এবং কতক স্ত্রী হইয়া জন্মে। কেঁচোর মত ইহাদের মুখ, পেট ইত্যাদি সকলি আছে। মানুষের পাকাশয়ে ইহাদের বাস এবং আমাদের উদরের খাদ্য দ্রব্য খাইয়াই ইহারা বাঁচিয়া থাকে। তাই শরীর হইতে বাহিরে আসিলে এই ক্রিমিরা বাঁচে না।
প্রত্যেক স্ত্রী-ক্রিমি প্রতিদিন গড়ে প্রায় এক লক্ষ ষাট হাজার ডিম প্রসব করে। বলা বাহুল্য, সকল ডিম হইতে বাচ্চা হয় না। এগুলির অনেকই মানুষের শরীর হইতে বিষ্ঠার সহিত বাহির হইয়া পড়ে। শেষে যে দুই-চারিটা পেটের ভিতরে ফুটিয়া ক্রিমি হয়, তাহাদের জ্বালাতেই মানুষ অস্থির হইয়া পড়ে।