কুবেরের বিষয় আশয় – ৪

॥ চার ॥

আমি যখন গড়পার হইতে চলিয়া আসি, তখনও প্রবোধিনী পড়াশুনায় হাত দেয় নাই। বেহালায় দুইশত আশি টাকায় আড়াই বিঘা জমি কিনিয়া কোনমতে দোতলা তুলিলাম একখানা। প্রথম প্রথম মা-বাবা-ভাইয়ের একান্নবর্তী পরিবার ছাড়িয়া আসিয়া খুবই কষ্ট হইত। দুঃখটা দৈহিক অপেক্ষা মানসিকই বেশি। বাবা চান নাই, আমি প্রবোধিনীকে বিবাহ করি। সে-ও বড় আনাড়ি ছিল। কতদিন ভাতের হাঁড়ি বসাইয়া ফার্স্ট বুকে এমন ডুবিয়া গিয়াছে—শেষে, ফেন উথলাইয়া আমাদের নতুন পাতা চুলার ঝিক গলিয়া গিয়া কষ্টের একশেষ। আমার বয়স তখন পঁয়ত্রিশ।’

এখানে এসে ব্রজ থামল। বাবার আত্মজীবনী লেখা বড় কঠিন কাজ। তখন কি রজনী দত্তর বয়স পঁয়ত্রিশ ছিল? রজনীর একচল্লিশে ব্রজ হয়। ততদিনে প্রবোধিনী ম্যাট্রিকুলেট। তার হাতেখড়ির সময় প্রবোধিনী বড়িশার উচ্চ প্রাইমারীতে ইতিহাসের দিদিমণি |

গুচ্ছের প্রুফ পড়ে আছে। আভা খানিক দেখে দিলে কাজ অনেক এগিয়ে থাকত। সামনের আশ্বিনে তার এতদিনের পরিমশ্র বই হয়ে বেরিয়ে যেত। হারিকেন জ্বালিয়ে রাত আটটা নাগাদ লিখতে বসেছিল। খাওয়া-দাওয়ার পরেই লিখতে সুবিধে। আভা অতটা রাত জাগতে পারে না। লাস্ট ট্রেন বেরিয়ে গেছে সেই কখন। এখন কেবর মালগাড়ি যাবে—শব্দ শুনলেও চোখে দেখা যাবে না-বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তেল পাওয়ার আশায় কিছুদিনই সারারাত ধরে যন্ত্রপাতি যায় মালগাড়ি বোঝাই হয়ে। একদিন শেষরাতে কদমপুরে একটা মালগাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল—হাতির শুঁড়ের কায়দায় দফায় দফায় খোলা ক্রেনের মাথা বগির ছাদ দিয়ে বেরিয়েছিল।

খাটে ওঠার আগে আভা ব্রজর পিঠের ওপর একখানা শাড়ি দু’ভাঁজ করে মেলে দিয়ে গেছে। খুব মশা। শাড়িখানা নামিয়ে আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াল। রজনী দত্ত লোকটা তার বাবা ছিল ঠিকই। কিন্তু তার আত্মজীবনী লিখতে গিয়ে রোজই মনে হচ্ছে, ছেলে হয়েও ব্রজ তার কথা একেবারেই জানে না। কী করে রজনী ডায়মন্ডহারবার রোডের ওপর আড়াই বিঘের বাস্তুজমি দশ বিঘেতে তুলেছিল সেসব ব্রজ জানে। কিন্তু পঁয়ত্রিশ কিংবা বিয়াল্লিশে এক শনিবার কী বেস্পতির সন্ধ্যেয় রজনী কী ভেবে থাকতে পারে, কিছুতেই তা ব্রজের মাথায় আসতে চায় না।

হারিকেনটা ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে ব্রজ খাটে উঠলো। আভা সুড়সুড়ি খেয়ে জেগে গেল, ‘হচ্ছে কি লাগে না? দেব তোমায় একটা—’

আভার চিমটি, টিপুনিতে বড় লাগে। ব্রজ কি বলতে যাচ্চিল, পারল না, একখানা নরম হাত তার মুখে চাপা দিল, ‘উঁহু, একটু জড়িয়ে শোও তো।’

জড়াজড়ি ব্রজ অনেক করেছে। বাঁ কাতে শুলে ডান হাতের ওপর মাথা রাখতে হয়-বেশিক্ষণ একধারা থাকলে রক্ত বন্ধ হয়ে যাওয়ার যোগাড়। হঠাৎ ব্রজ তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। আজই দুপুরে বৌবাজারের মোড়ে দু’পুরিয়া কিনেছে। গাঁজা টেনে তার বুকের চাঁদি লাল হয়ে গিয়েছিল। ভেতরে সব সময় আঁচ ধরে থাকত। কী পিপাসা! এদানী মোদকই তাকে খাড়া রাখে।

না। ওসব আজ খেতে পারবে না—আমিও পারিনে।’

আভার মুখ দেখা যাচ্ছিল না। শুয়ে শুয়ে কথা বলছে। ব্রজ উঠে দাঁড়াতে মাথার উপর বাড়তি অনেকখানি অন্ধকার আরও ঘোলা হয়ে গেল।

‘একশোবার খাবে—’

কুলুঙ্গিতেই ছিল। রাস্তার মোড়ে কাচের বাক্সে আলো দিয়ে জিনিসটার নাম রাত এগারোটা অব্দি জ্বালিয়ে রাখা হয় কলকাতায়। মদন আনন্দ। নিজে মুখে দিয়ে আভাকে এক রকম টেনে তুলল, ‘একেবারে সবটা মুখে দিও না-আস্তে আস্তে খেতে হয়।’

‘আমি পারিনে।’

‘কাঁদছ কেন? দ্যাখো, কী বোকা! শেষে খুব ভালো লাগবে—’

‘আমি পারিনে’, আভার গলা বুজে এল, ‘তোমার পায়ে পড়ি—’

ব্রজর ঝাঁকুনিতে সোজা হয়ে বসল, কানের লতি গরম হয়ে যায় কিছু শুনতে পাইনে সত্যি—নাকের নীচে, হাওয়া চলে শুধু—’

‘ফাইন’, দুহাতে আভার কাঁধ ধরে ব্রজ তাকে সোজা রেখেছিল। অন্ধকারে মুখ খুঁজে নিয়ে একটু চুমু দিল, ‘একি! এখনও কাঁদছ কি হল?’

‘সত্যি, আমি পারিনে-দিনের বেলায় কাউকে আর এনো না—’, ব্রজ খুঁজে খুঁজে ঠোঁটের জায়গাটা বের করল, ‘হাঁ করতো লক্ষ্মী-আবু কি হচ্ছে?’ ব্রজ আঙুল ভরে দিয়ে আভাকে হাঁ করালো, পুরিয়ার সবটুকু নীচের ঠোঁটে গুঁজে দিয়ে আভাকে ছেড়ে দিল, ‘হাজারবার আনবো।’ তারপর কী মনে হল, ‘কেন? আমাদের কুবের তো বেশ ভালো—’

‘খারাপ বলেছি?’ এতক্ষণে শুয়ে শুয়ে ফোঁস করে উঠল আভা।

‘বেশ ফিটফাট-নোংরা নয় একদম, ছেলেও ভালো—’

‘অ্যাতখানি বয়সে আমি কি আবার পাত্রী হলাম নাকি?’ একটুও নামল না আভা, কুবেরবাবুকে এদিকে টানছো কেন? তার কথা বলেছি?’

ব্রজ চুপ করে আছে দেখে নিজে নিজেই বলল, ‘মোষটা আজ তিন দিনে নানা ছুতোয় পাঁচবার এসেছে। সারাদিন তুমি বাইরে বাইরে থাকো। এইটুকু তো দেওয়ালের আড়াল-লাথি দিলেই ঘেঁস-সুরকির গাঁথনি খুলে যাবে—দুপুরে এদিকটা একেবারে ফাঁকা হয়ে যায়—’

‘বারণ করলে পারো।’

‘কখন কী অবস্থায় থাকি-জামদানিখানা তো সব সময় পরে বসে থাকা যায় না—’

‘সত্যি, তোমার শাড়ি কেনা হয় না অনেক দিন—’, ব্রজ আর বেশি কথা বাড়ালো না। এখন কথার পিঠে কথার তাল ঠুকে যাওয়া শুধু। আভার গলা জড়িয়ে আসছে-হাঁ করলেই খুশি যেন ছিটকে বেরিয়ে আসে। এখন বোধহয় ওর নাকের নীচে হাওয়া চলছে। একটু পরে বাগ মানানো কঠিন হবে। এতটুকু খাটে ক্ষ্যাপাচণ্ডী সামলানো যে কী! সারাটা ভোর একেবারে নেতিয়ে পড়ে থাকে।

‘তোমার গোলাপ চারার গোড়া খোঁচাখুঁচির পর গোবর দিচ্ছি-এমন সময় আবজানো দরজা গুঁতিয়ে মোষ একেবারে ভেতরে। নষ্ট হবে বলে, শাড়ি পরিনি। সায়া পরে নীচু হয়ে খুরপি চালাচ্ছি—আচমকা দরজা ঠেলার আওয়াজে চমকে ফিরে দাঁড়িয়েছি, কোথায় যাই। তখন বলে কী জানো?’

‘কি?’

‘ক’খানা আঙুরবালার রেকর্ড এনেছি—’

‘বললাম, আমাদের তো মেশিন নেই—’

‘খোকাকে দিয়ে পাঠিয়ে দেব ওবেলা?’

ব্রজ চুপ করে থাকল। গাঁজা, ভাঙ, মোদক তার রক্তে মিশে গেছে এতদিনে। ক’দিনই দেখছে মদন আনন্দ আভার সয় না একেবারে। ভবেন সীকে নিয়ে পারা গেল না। ভবেনের এঁচোড়ে পাকা খোকাটিও প্রায়ই ঘোরাঘুরি করে। ব্রজর নজরে পড়েছে।

‘তখন খেয়াল হয়েছে আমি তো কিছু পরে নেই। একেবারে সোজাসুজি তাকিয়ে গিলছে-আর দাঁড়াই। দৌড়ে ঘরে ঢুকে সেই যে দোর দিয়েছি-তিনটে কুড়ির ট্রেন এলে তবে খুলেছি—’

ব্ৰজ আভাকে কাছে আনলো। আভা তার হাতখানা টেনে বুকের ওপর রাখলো। এখন আর কথা বলবে না। বলতে পারবে না। এখন তাকে জড়াতেও বলবে না। বাউল গাইয়ে পিরেলি দাশের বড় মেয়ের এখন নাকের নীচে বাতাস বইছে। হাত রেখে দেখল—নরম হাওয়া শুঁকে দেখলো নতুন পাটালির গন্ধ।

এক ফ্যাকড়া এসে তার আত্মজীবনী লেখা ভণ্ডুল করে তুলেছে প্রায়। অথচ, তার অনেক দিনের সাধ-বাবার জীবনী মেলায় মেলায় বিকোয়। কতজনের জীবন-কথা বাজারে চলে। বীরভূমের গাঁয়ের হাটে অদ্বৈতের জীবনী, কোলাঘাটের মহোৎসবে নবনীর কথা রাস্তায় গীতা চণ্ডির সঙ্গে ডাঁই হয়ে বিক্কিরি হয়।

ভবেন জুটেছে—সঙ্গে তার ছেলেটাও। কী কুক্ষণেই যে শ’ দুই টাকা হাওলাত করেছিল। বাবার আত্মজীবনী শেষ করেই বেনারস ঘুরে আসবে আভাকে নিয়ে। নৌকোয় বসে দুজন আখ খাবে। ছিবড়ে গঙ্গায় ভেসে যাবে। মাংসের সের মোটে আড়াই টাকা। তিন মাসে দু’জনেই মুটিয়ে ফিরবে।

আভাকে ঝাঁকুনি দিল। একেবারে বেডিং। খানিকটা দুলে কাৎ হয়ে গেল। তারপর হঠাৎ ব্রজকে চেপে ধরল। না নড়ে, ব্রজ ট্রেনের কামরার বাঙ্কের মত পুরো বোঝা নিল। এবার তাকে নিশ্চয় কামড়াবে, আঁচড়াবে—তারপর হয়ে গেলে, থেমে গেলে ঘুমের ভেতর ফোঁপাবে।

ব্রজ শিওর, তার গায়ে এতদিনে শ্যাওলা পড়েছে। গলায় আজকাল ময়লার র‍্যাক র‍্যাক দাগ ধরেছে। পুকুরে চানের এই হ্যাবিট ছাড়তে হবে, ‘কী হলো—’

‘অ্যাঁ। তুমি কোথায়?’

‘এই তো—’ শক্ত করে ধরলো আভাকে।

‘দেখতে পাচ্ছিনে।’

‘পাবে কি করে? অন্ধকার যে!’

‘তাই বলো। আমি ভেবেছি অন্ধ হয়ে গেছি—তাই দেখতে পাচ্ছিনে—কাছে এসো।’

‘বাঃ! আর কত আসবো?’

আভার বুক, বুকের হাড়, তলপেট সব নরম লাগল ব্রজর। জ্বর হবে না তো? সরস্বতী একদম ঠান্ডা ছিল। ঠান্ডা ময়াল। প্রথমজনকে ব্রজ আজ আর মনে করতে পারল না। কী যেন নাম ছিল। লতিকা, বিলাসী, কদমা, ফুল্লরা, বাঁধাকপি? একেবারে পাঁঠার পাঁজরের মাংস। নলি নলি হাড় বেরিয়ে থাকে—পাতলা মাংসের চাদর ওপরে লেপটানো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *