কুবেরের বিষয় আশয় – ১৭

॥ সতের ॥

একা একা কদমপুরে হবিষ্যি করা যায় না। দুটো ছেলেমেয়ে, একটা বউ, বাড়ির পুকুরে জল টলটল করছে, বাঁধানো পুকুরের চাতালে একটুও ময়লা নেই—সবকিছ এত ফাঁকা, এত কম—দম ফেলা যায় না। কুবের কিছুতেই এখানে হবিষ্যি করতে পারবে না। সাধুখাঁদের পৈতৃক বাড়িতে বড়দা, নগেন, বীরেনের সঙ্গে এক ঘরে বসে হবিষ্যির অন্ন মুখে দিয়ে মনে হচ্ছিল মা বেঁচে আছে। এখুনি রান্নাঘর থেকে সেদ্ধ ডাল হাতায় নিয়ে এসে থালায় ঢেলে দেবে। অথচ সে নেই বলে কত কাণ্ড! মা নেই বলে সব ভাই মিলে হবিষ্যির নামে ক’দিন যেন পিকনিক করছিল।

ঠিক ছিল শ্রাদ্ধশান্তি হয়ে গেলেই নগেন বীরেন কদমপুরে উঠে আসবে। অথচ শ্রাদ্ধশান্তির ক’দিন আগেই কুবেরের এতদিনকার সাজানো স্বপ্নটা দুম করে ফেটে গেল। নগেন আসবে না। বীরেন আসবে না।

মা যে তার কতখানি ছিল—এই এতদিনকার জীবনে কুবের একবারের জন্যেও টের পায়নি। তাকে ঘিরে অল্পদিন হল কিছু ডালপালা বেরিয়েছে। তাদের নাম বুলু, সৃষ্টিধর, কুসুম। অথচ সে নিজে অন্য গাছের ফল। সে গাছের নাম দেবেন্দ্রলাল। সেই গাছের কোন পাতা, কোন ফল আর নেই এ বাড়িতে। ফলে কুবের তার নিজের কষ্ট কাউকে বলতে পারল না। বলব কাকে? বললে কে বুঝবে? ফাঁকা বাড়ি দেখে একবার চিৎকার করে কাঁদতে চেষ্টা করল কুবের। মা দেখে যাও তুমি—আমি সব সাজিয়ে তুলেছিলাম। কিন্তু কেউ এল না! কেউ গন্ধ নিল না। আমি নতুন বাড়িতে নতুন লোকজন নিয়ে বাড়ির কর্তা হয়ে ওঠার মহলা দিচ্ছি। সেই ছোটবেলার পর অনেককাল কান্নাকাটির অভ্যেস নেই। চোখে জল আসতেই দেরি হয়ে গেল। ঠোঁট কাঁপছে দেখে কুবেরের নিজের ছেলেই তাকে পাকড়াও করল, ‘কি হয়েছে বাবা? অমন করছ কেন?’

কুবের অবুঝ জীবটির দিকে তাকিয়ে থাকল শুধু। এই ছেলেটা লোক হয়ে উঠলে কুবের বুড়ো হয়ে যাবে। কুবেরের বিষয়-আশয়ের ওয়ারিশান। এককালে সেটেলমেন্ট পরচায় নাম উঠবে। পাশে লেখা থাকবে পিতা কুবের সাধুখাঁ। ব্যাটা বাঁচলে হয়। চাদ্দিকে যা সব কাণ্ড হচ্ছে! ক’দিন আগে সরু পিয়াসলে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের গায়ে রেল পুকুরে ঘুনি তুলে মাছ দেখতে গিয়ে ইয়া তাগড়াই এক জোয়ান সাপের চুমু খেয়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। যত কষ্ট তত দাপাদাপি। লোক ভিড় করে দেখল—তবু হাসপাতালে নিয়ে গেল না ট্রেনে করে। মরল তবে পাড়ে টেনে নিয়ে এল।

ঘাটলায় বসেই পুব-দক্ষিণ কোণের ঢোল-কলমির জঙ্গলে তাকাল কুবের। প্রথমে জায়গা মাপতে এসে একটা সাপের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। যতক্ষণ মাপামাপি ততক্ষণ মাথা তুলে তুলে ঘুরে ঘুরে জায়গা বদলে কুবেরকেই দেখছিল। আরও কয়েকবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে কুবেরের। ভদ্রেশ্বরের সঙ্গে প্রথম আলাপের দিন চেনা পড়শীর পোজে তাকে পাশ কাটিয়ে সাপটা ওই ঢোলকলমির জঙ্গলে তার বাসায় চলে গিয়েছিল। ইদানীং দেখা হলে কুবেরের মনে হয়, সাপটা তাকে ফনা তুলে নমস্কার করে জানতে চায়, কেমন আছেন বাবু? জায়গাটা কেমন? মন টিকছে তো? সাহস করে তাকে কিছু বলা হয়নি কুবেরের। এগিয়ে যেতে পারেনি। হাজার হোক সাপ তো। মানুষের সংস্কার কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

বড় বড় ফোঁটা দিয়ে বৃষ্টি আসতেই কুবের বারান্দায় উঠে এল। চাদর জড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে গুরুদশার ধড়া হাতে ঠেকালো—তখনই বুঝতে পারল আমরা কি নিঃস্ব হয়ে গেলাম। সেই সময় আকাশ দিয়ে ফাঁপানো কিছু মেঘ দিক পালটাচ্ছিল।

ক’দিন পরেই সোনা-কার্তিকের ঘাটে বড়দা, নগেন, বীরেনের সঙ্গে পাশাপাশি বসে নেড়া হল। পরামানিকের নাম—গয়া। ঘাট-কামানো পেশায় নেমে লোকটার আসল নাম আদিগঙ্গার জলে অনেকদিন ধুয়ে সাফ হয়ে গেছে। তাই নিয়ে খানিক রসিকতা হল। কুবের সবার সঙ্গে মিশে হাসল। হেসে বুঝল, তারই মত বড়দা, নগেন, বীরেন—কিছু হয়নি ভাবটা ফোটাতে শুধু শুধু হাসছে। ব্যাপারটা বুঝে নগেন, বীরেনের জন্যে কুবেরের কষ্ট হল। এ-ক’দিন ওদের ওপর রাগ করে কদমপুরে একা একা হবিষ্যি করার সময় যেসব কঠিন প্রতিজ্ঞা করেছিল—তার সবই সেই মুহূর্তে কুবেরের মন থেকে ধুয়ে গেল। ইস্কুলে থাকতে কুবেররা ঠিক এইভাবে গোল হয়ে বসে রবিবার দুপুরে চুল কাটত।

হরিরাম সাধুখাঁর ভদ্রাসনের খোপে খোপে শরিকানি সংসার। দেবেন্দ্রলালের স্ত্রী বিয়োগে অনেকেরই অশৌচ হল ঠিকই। কিন্তু শ্রাদ্ধ করার মত জায়গা হল না। জিনিসপত্তর নিয়ে কে কোথায় যাবে? পাশ ফেরার বারান্দাগুলোও এক পুরুষে খুদে খুদে সংসারের আস্তানা হয়ে গেছে। কদমপুর বড় দূর। অতএব এই সোনা-কার্তিকের ঘাট। দশমীর দিন নাকি এখানে কোন্ রাজার বাড়ি থেকে শোভাযাত্রা করে সোনার কার্তিক আনা হয়। জায়গাটাই বিশ্বাস করবার জায়গা। পুথি, সিঁদুর মাখানো কড়ি, পঞ্জিকা, বটের ঝুরির নীচে মাটির পুতুলে রোহিতাশ্ব-শৈব্যা, স্বামী কোলে বেহুলা–নানান জিনিসে গঙ্গার ঘাটটুকু ঠাসা, তার মধ্যে বিশ্বাস করে ফেলার হাওয়া বইছে সবসময়।

দানের জিনিসে জায়গাটা থইথই করছে। হোমের জন্যে অনেক কিছুর পাশে বাটিতে বাটিতে মায়ের পছন্দসই জিনিসগুলো সাজানো। ইলিশ মাছের কোল, রুই মাছের পেটি, আমসত্ত্ব—কুবের সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল।

পুরুত মশাইদের লিডার বীরেনকে মন্ত্র পড়াচ্ছে। সংস্কৃত বলে দু’এক জায়গা খট করে গিয়ে মনে লাগে। বীরেন সংস্কৃত বলছে, মা আমার গায়ে যত লোম আছে তুমি তত বছর স্বর্গে গিয়ে বাস কর। বৃর্ষোৎসর্গের ষাঁড়টি একেবারেই কচি। স্যাঁতসেঁতে শ্যাওলা-ধরা অন্ধকর পুজো-আর্চার জায়গায় দাঁড়িয়ে লাফাতে শুরু করেছে। তখনও তিলোৎসর্গের সময়কার একটা মন্ত্রের গোড়ার দিকে পুরুতমশাইর গলাঝাড়া দেওয়া সংস্কৃত মনে আসছিল কুবেরের-কৃষ্ণা তিথৌ। মা কি অমাবস্যায় মারা গিয়েছিল? মনে করতে পারল না কুবের। তিথি কি করে তিথৌ হয়।

শশ্মশানে নিয়ে যাবার আগে মাকে শুয়ে থাকতে দেখে ধক করে উঠেছিল কুবেরের বুকের মধ্যে। তাহলে মানুষটা নেই। আর কোনদিন কথা বলা যাবে না। কিন্তু হরিধ্বনি, নামগান, চিতাসাজানো, গঙ্গামাটি মাখিয়ে নাইকুগুলি জলে ফেলে দেওয়া—তারপর গলায় ধড়া পরে বাড়ি ফিরে এসে মনে হচ্ছিল—মা শেষ হয়ে যায়নি। হোম যজ্ঞ, মন্ত্রপাঠ—নানান হইচইয়ের মধ্যে মা ফুরিয়েও ফুরোচ্ছিল না।

কুবের আর নগেনের ওপর গঙ্গার ঘাটে বৃষকাঠ বসিয়ে দেওয়ার ভার পড়ল। সেইটাই এত ক্রিয়াকাণ্ডের শেষ কাণ্ড। শোনামাত্র মন খারাপ হয়ে গেল কুবেরের। বড় গঙ্গায় ভাঁটা। তাই আদিগঙ্গায় শুধু কাদার ময়দা। পা দেবে যায়। ঘাটে দাঁড়িয়ে পুরুতমশাই বারে বারে সাবধান করে দিচ্ছে—’নরম মাটিতে জোর করে ধরে চেপে বসিয়ে দিন। তারপর ওদিকে না তাকিয়ে তিনবার জল দিয়ে ওপরে উঠে আসুন। খবরদার পেছনে তাকাবেন না। জোয়ার এলেই ভেসে যাবে।’

ওপরে উঠে আসার সময় কুবের না তাকিয়ে পারল না। বৃষকাঠে খোদাই অস্পষ্ট মুখের ভেতরকার চোখ তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পলক পড়ছে না। চোখ ফেরাতে নগেনের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। কেউ কথা বলল না। এবারের মত এই শেষ। আবার বছর ঘুরলে কিছু লোক খাওয়াতে হবে। তখন কুবের দেখল নগেনের ওপর তার একটুও রাগ বা অভিমান নেই। যা আছে, তা ওর জন্য কষ্ট। নগেনের চোখ লাল হয়ে উঠেছে। যে কোন মুহূর্তে এখন বৃষকাঠ দেখার জন্যে ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়তে পারে। কুবের বললো, ‘চল ট্যাক্সিতে যাই—এখনও অনেককে নেমন্তন্ন করা বাকি।‘

সারারাত যাত্রা দেখে ভোরে বাড়ি ফেরার পথে আলোর মধ্যে গতরাতের সম্রাট, সেনাপতি, মঞ্চ, নর্তকী—কোন কিছুই মন থেকে একেবারে মুছে যেতে চায় না। সময় নেয়। কিন্তু কুবেরের জন্য কাজের চাপ, কেনাবেচার খুঁটিনাটি, ঢালাও চাষবাসের শতেক কুটকচালি একেবারে ওৎ পেতে বসেছিল।

হোমড়াপলতা আর চড়াবিদ্যার আবাদে ধান ফেলতে হবে। চারা তৈরি করে আষাঢ়ের পয়লা হপ্তায় জ্যাঠো রুয়ে দিতে পারলে বিঘে প্রতি এক পণের বেশি বীজ লাগবে না। মনে মনে কতকগুলো অঙ্ক কষে কুবেরের মাথার মধ্যে ধাঁ ধাঁ করে আগুন ধরে গেল। পাঁচসের ধান ফেললে বিঘেটাক জায়গা রোয়া যায়। কারকিত করে চাষ করলে এক বিঘে জায়গা নতুন ধরনের বীজে পনের মণ ধান হামেশা দিচ্ছে। ধানের মণ ষাট টাকা। অতএব—

শ্রাদ্ধশান্তির পর সালকে থেকে কদমপুর ফেরার পথে রেললাইনের দু’ধারে যত জায়গা দেখেছে—সবটাই যদি চষে রুয়ে দেওয়া যায়। বাব্বা!

ইদানীং ভোরে উঠে তার নিত্যকার কাজ হল একবার কুকুরের ঘরে গিয়ে বকনা দুটোর গায়ে হাত বোলানো—তারপর গোয়ালে ঢুকে দোহালের সঙ্গে বসে গরুগুলোর স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করা।

রবিবার ছিল। জেলে এসে বড় দিঘিতে জাল ফেলে মাছগুলোকে নাড়াচাড়া দিয়ে স্যাদলা কাটিয়ে দিল-তারপর আবার জলের মাছ জলে। নিজের হাতে কুবের মহুয়ার খোল ছিটিয়ে দিল। ঝাঁক বেঁধে মাছের সারি ঘুরে বেড়াচ্ছে। বড় মুলতানিটা গাভিন হয়েছে। রোদ পেয়ে ঘাড় ভেঙে নিয়ে চোখ বুজলো গরুটা। বুলু তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। সকালে উঠোনের সামনে গোলার কাছাকাছি গোটা পাঁচেক ঘুঘু পাখি নেমে এসেছে। ধান ছিটিয়ে পড়লেই ওরা ঠিক খবর পায়। বাচ্চারা তখনও বিছানায়। রাখাল খড় কাটার ইলেকট্রিক মেশিনে খড়ের তড়পা এগিয়ে ধরেছে আর কুচি কুচি হয়ে বেরিয়ে আসছে। মুগচুনি আর গুড়ের গন্ধ পেয়ে ডাঁই পিঁপড়ে সারি দিয়ে গোয়ালের দিকে চলেছে। কুবের সাধুখাঁ বুঝতে পারল, সে খুব একা পড়ে গেছে। এই পৃথিবীতে নিজেই সে এমন একটা পথ বেছে নিয়েছে, যেখানে কোন বন্ধু নেই, বন্ধু হয় না। চারদিকে শুধু প্রয়োজনের পাহাড়। তার মাঝখানে একটাই ডিউটি কুবের সাধুখাঁর। টাকা যোগাড় কর। টাকা যুগিয়ে যাও। যতগুলো গর্ত আছে—সব টাকা দিয়ে ভরাট করে যাও। আর কোন কাজ নেই তোমার। তোমার গালের মাংস ঝুলে পড়ুক, মাথা ঝিমঝিম করুক—তাতে কিছু আসে যায় না। ডিউটি ফার্স্ট-ডিউটি লাস্ট

কদমপুরের খাল পাড়ে এই নতুন পাড়ায় এখন পাঁচখানা নতুন বাড়ি উঠেছে। কুবের রোডের উপর ইট সাজানো সারা। রোডরোলার খোয়ার উপর দিয়ে শক্ত করে এগোচ্ছে। সন্ধ্যেবেলা কুবের রোডের এক ধারে এখন ইলেকট্রিক আলো জ্বলে—অন্য ধারে সেই আলো কুবেরের বসানো নানান ফলের কিশোর সব চারার পাতায় পড়ে জায়গাটা অন্যরকম করে দেয়। অথচ এখানে তার নিজের লোকজন নেই। কুকুররা কুবেরকে ভালবাসে। গরুরা কুবেরকে ভালবাসে। সৃষ্টিধর কুবেরের গলা জড়িয়ে শোয়। কুসুম ইদানীং কুবেরকে দেখলে লাল মাড়ি বের করে হাসে। বুলু হাজারো জিনিস মারকেটিং করে ফেরার পথে কুবেরের পছন্দ লবঙ্গ নিয়ে আসে পাঁচ ছ’আনার। কুবের পানের সঙ্গে লবঙ্গ খেতে ভালবাসে।

ভদ্রেশ্বর এসে হাজির। মেদনমল্লর দুর্গ বরাবর চরভরাটি পায়োস্তি জমির দখল কুবের নেবে কি না জানতে এসেছে। একেবারে দলদলে মাটি। নানান সুখ্যাতি করল ভদ্রেশ্বর। বাঁধ বেঁধে নদীর জল ঢুকিয়ে দিয়ে ভেড়ি হতে পারে। কোটি কোটি মাছের ডিম নাকি জলে লুকিয়ে থাকে। কিংবা চাষও করা যায়। অমর খন্দ হবে।

সব শুনে কুবের বললো, ‘কার জন্যে করব?’

ভদ্রেশ্বরের বাড়িতে এবেলা ওবেলা নিয়ে কুড়িজনের পাত পড়ে। কুবেরবাবুর মত লোকজন তার সংসার চালায়। জায়গা জমির খতিয়ান, দলিল, সার্চ—সব ভদ্রেশ্বর মাথায় তুলে নেয়। জায়গা কেনার সময় বহরিডাঙ্গা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের বটতলায় বসে কুবের একশো টাকার নোটের গোছা ভদ্রেশ্বরের হাতে গুনে তুলে দেয়। দিয়ে বাসে করে চলে আসে। তখন শরিকদের ভাগের টাকা বুঝিয়ে দিয়ে দু’একখানা নোট নিজের জন্যেও রাখে।

এই ভোরবেলা এমন জবাব পাবে আশা করেনি ভদ্রেশ্বর। বিষয় বিষ—সেকথা ঠিক। ভদ্রেশ্বর তা নিজেই বলে। কিন্তু এই বয়সে কারও কাছে বিষয় বিষ ঠেকলে তাতো ভাববার কথা। খেয়াদার হাটের চক্কোত্তিদের বড় ছেলে গদিতে বসেই ক্যাশবাক্স খুলে, সিন্দুক হাতড়ে টাকা পয়সা তেজারতির কাগজপত্র সব বিলিয়ে দিয়েছিল, ফিরিয়ে দিয়েছিল। সে তো অনেককালের কথা। জোয়ান বয়সে অমন ভুল কালেভদ্রে এক আধজন করে থাকে। সেই লোক এখনও নাকি কলকাতা করপোরেশনের টিকে দিয়ে বেড়ায়। পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। কোন কবে দানছত্র খুলে দিয়েছিল। আজও অন্নের জন্য চক্কোত্তি বংশের সেই মানুষটা পথে পথে ঘুরে বেড়ায়।

‘ওসব ভেবে কি কেউ বিষয় করে সাধুখা মশাই?’ একটু দম নিয়ে ভদ্রেশ্বর বললো, ‘গতবার কারও চাষ হয়নি। দোবারা বুড়ো গিয়ে জমি-জায়গা বিলকুল ভেসে গিয়েছে। খড়ের কাহন এখন পঞ্চাশ বাহান্ন। দম ঠুকে নেমে পড় ন। লক্ষ্মী চাইলে রাজা হয়ে যাবেন।

‘আমি প্রজা থাকতে চাই। কার জন্যে রাজা হব?’

‘আপনার জন্যে রাজা হবেন। সবাই নিজের জন্য হয়।’

‘আমার যা আছে খাবে কে?’

‘আপনারা খাবেন। বংশধররা খাবে—’

‘ছাই। চোখ বুজলে চেল্লাচিল্লি শুরু হয়ে যাবে। ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে হুলস্থুল পড়ে যাবে।’

বুলুর স্বপ্ন কিন্তু অনেক। খালপাড়ের উল্টোদিকের খানাখন্দ ডোবাডাঙ্গা কিনে ফেল। স্টেডিয়াম হোক। এখানে ভালো খেলার মাঠ নেই। ক’দিন আগে মাথার পাকা চুল খুঁজতে খুঁজতে বলেছিল, ‘কতকাল আর জায়গা জমির হাত বদলে টাকা আসবে। আমাদেরও বয়স হবে। তুমি একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি কর। সেখান থেকে নিশ্চিন্ত মাসে-মাইনের মত টাকা আসবে। ছেলেমেয়েরা বড় হলে টাকা লাগবে। চিরকাল তোমার টাকার ভাবনা ভাবতে হবে না।’

কুবের বলেছিল, ‘কি রকম?’

‘এই যেমন ধরো গিয়ে এটা সিনেমা হল—কিংবা অন্য কিছু। আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছি না। নিয়মিত টাকা আসবে।’

টাকা আসবে—কথাটা শুনলেই কুবের সব সময় ঝক করে স্টার্ট নেয়। বিছানায় উঠে বসেছিল। দেবেন্দ্রলাল একদিন ট্রেনে এমন বলেছিল—একদিন টাকা আসা যদি বন্ধ হয়ে যায়। বলেছিল, তোমার কত টাকা কুবের? ও জিনিসের মুখ আমি বিশেষ দেখিনি কুবের। সেজন্যে তোমাদের গর্ভধারিণীর দুঃখের অন্ত ছিল না।

মা এসব দেখে যায়নি। পালাম বুনবে বলে এক কাঠা জায়গা চেয়েছিল। আপনি থেকেই হেসে ফেলল কুবের। ভদ্রেশ্বর ঘাবড়ে গেল। ড্রিম মারচেন্ট কুবের সাধুখার গর্ভধারিণী এক কাঠা জায়গা চেয়েছিল। মা তুমি কি মানা ক্যাম্পের উদ্বাস্তু? চাষের জায়গা চেয়েছিলে যে বড়! থাকলে না কেন আর কিছুদিন।

ভদ্রেশ্বর আজ সকালে মাথা বোঝাই করে আরও অনেক কিছুই খবর এনেছিল। সোঁদালিয়ায় তেল খোঁড়ার জায়গা ফেলে মাইল দুয়েক কদমপুরের দিকে এগিয়ে এসে অনেকেই টাকা ফেলে জায়গা ধরে রাখছে। গত বছর চাষ হয়নি। এবার হালগরু ঘটিবাটি, জায়গা-জমি মবলক বন্ধক রাখবে অনেকেই। কলকাতার বাবুরা গাড়ি থেকে নেমে জায়গা দেখে বলে, কি সুন্দর—হাউ নাইস—গাছপালার রূপ দেখে দেখে মরে যায়। ভদ্রেশ্বরও মনে মনে ক্ষেপে ওঠে তাদের ভাবভাঙ্গী দেখে। বাবু তালগাছ আর নারকেল গাছের কি এমন রূপ পেলেন? কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না। মক্কেল। তারা যা ইচ্ছে দামে জায়গা কেনে। কিন্তু কুবেরের জন্যে সস্তায় জমি বন্ধক রাখার খবর এনেছিল আজ। সময়ের কড়ায় করে দরকার মত টাকা দিতে পারলে এক বন্ধে আট বিঘের একটা দাগ সতেরো শ’ টাকায় এসে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রেশ্বরেরও কিছু আসবে।

‘মেদনমল্লর জায়গা আপনি দখল নিন। যা টাকা ঢালবেন লোকজনে, চাষবাসে—তার চৌগুণ উঠে আসবে ফসলে। বুক ঠুকে নেমে পড়ুন।’

‘জোর পাই না ভদ্রেশ্বর—’

‘বুড়ো হয়ে গেলেন!’

‘হইনি। হয়ে যাব বোধহয়।’ এখানকার সমবয়সীরা কুবেরের সঙ্গে মেশে না। কুবেরও মিশতে পারে না। কান্তবাবুর মেজভাই গাঁয়ের ভেতরে থাকেন। তার বড় ছেলে শশীর কুড়িয়ে বাড়িয়ে সাতটি ছেলেমেয়ে। পঞ্চাশ বছর বয়স হয়েছে। সেও আজকাল কুবেরকে দাদা ডাকে। কুবের তাকে সাংসারিক পরামর্শ দেয়।

‘হলধরের নাম শুনেছেন?’

‘কোন হলধর?’

‘মহাভারতের—’

কুবের ঠিক চিনতে পারল না। রামায়ণেও থাকতে পারে-মহাভারতেও পারে। মুখে বলল, ‘খুব চিনি। সে আর বলতে-’

‘দেখুন সাধুখাঁ মশাই—যুধিষ্ঠির ফৌত, অর্জুন ফৌত—সংসার করতে এসে সবাই কত দুঃখ পেলেন। যুদ্ধ কান্নাকাটিতে মহাভারতখানা গরম। দেখুন টিকে থাকলেন শুধু হলঘর। তিনি চাষবাস করতেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধও তাঁকে ছুঁতে পারেনি।’

‘কি বলতে চাও ভদ্রেশ্বর—‘

‘আপনি দুর্গের দিঘি থেকে নদীর গা অবধি দখল নিন। চাষ করুন। ফসল ঘরে তুলে বলবেন—নাঃ! ভদ্রেশ্বর একটা বুদ্ধি দিয়েছিল বটে।’

‘তাহলে চাষে নামব?’

‘নামুন। দ্বিধা করে কম্বল জড়িয়ে বসে থাকবেন না।’ বুলু রাখালের হাতে কফির পট ট্রে সাজিয়ে দিয়ে নিজে আসছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *