কুবেরের বিষয় আশয় – ১৩

॥ তের ॥

‘আপনি এ কি করলেন?’

আভা বউদির বুকের ওপর দিয়ে পুরনো কালের কায়দায় শাড়ির সোনালি ফুলতোলা চওড়া পাড় হাঁটু অবধি নেমে গেছে। কুবেরের আগেকার অভ্যেসগুলো পালটে গেছে—। এখন কোথাও গেলে আড়ষ্ট ভাবটা আর তাকে চেপে রাখতে পারে না। ব্রজ দত্ত বাবার আত্মজীবনী সমেত নানান বইপত্তর নিয়ে তাড়দার হাটে বিকোতে গেছে। কুবের মাথায় বালিশটা তাকিয়ার মত পিঠের নীচে ঠেসে দিয়ে কাৎ হয়ে শুয়েছে।

আমি সেদিন সামলাতে পারিনি নিজেকে-এমনভাবে হাওয়া কাটছিল আপনার হাত-বলছিলেন, চাঁদ নীল —

‘ওদিকটা তো আর যাওয়ার উপায় রাখেননি আপনি। কেমন খোলামেলা ছিল। এখন শুধু লরি যায়। এপার থেকে খালপাড়ে সবসময় ধুলো উড়ছে দেখি। মিস্ত্রিরা সন্ধ্যেবেলা গান গায়। আপনার বাড়ি হচ্ছে, আরও অনেকের বাড়ি উঠছে। খালপাড় আর আগেকার মত নেই—’,শূন্যে তাকিয়ে থেমে গেল আভা বউদি।

‘পরশু ছাদ ঢালাই হয়ে গেল।’

‘আপনি খুব বড়লোক হয়েছেন।’

‘কে বললো?’

‘আপনার দাদা—’

‘ভালো।’ থামতে পারল না কুবের, ‘আমি যে কি হয়েছি আমিই জানি না—’

‘আমি জানি—’, আভা নীচের ঠোঁট দাঁতে চেপে হাসছে। কুবের অন্যদিকে তাকিয়ে আছে বলে দেখতে পেল না।

‘কেমন?’

‘পরের বউয়ের সঙ্গে কি সব করে ফেলছেন!’

‘তাই বলুন!’

‘অবিশ্যি তাতে আমি পচে যাচ্ছিনে—’,

ধক্ করে কুবেরের মাথার ভেতর কার হাত থেকে একখানা খাগাড়াই থালা পড়ে গেল। পড়ে আর থামতেই চায় না। ঝন্‌ঝন্ আওয়াজ হয়েই যাচ্ছে। মাথার ভেতরে নেমে অনেক কষ্টে কুবের আওয়াজটা থামাল।

‘আমার কিচ্ছু ভাল লাগে না—’

‘নিন উঠে বসুন। চা খাবেন?’

কুবের শুনেও শুনলো না। ফিরে বললো, ‘আমার সত্যি কিছু ভাল লাগে না—

‘খারাপের কি হল? আপনার দাদা বলে—আমাদের কুবেরের এলেম আছে। দু’হাতে পয়সা কামাচ্ছে। ভবেশ শী, ইটখোলার ঘনরাম চাটুয্যে সবাইকে কাৎ করে দিয়েছে। কদমপুরের নিরিমিয্যি ডাঙায় যে অত পয়সা ছিল কে জানতো!

‘তা সত্যি! লোকে কেন যে জায়গা কেনে? কেন যে যা দাম তাই দেয়! এক এক সময় আমিও কোন মানে খুঁজে পাইনে —

‘ছেলের পিঠে মেয়ে হল। আমাদের মিষ্টি বাদ পড়ল।’

‘খুব কষ্ট পেয়েছে বুলু।‘

‘তা পাবে না!’

তার চেয়েও বেশী কষ্ট পেয়েছে কুবের। সময় পার হয়ে যায়—বুলুর কোন ব্যথা নেই। হাসপাতালের কেবিনের বাইরে এসে কুবের ডাক্তারকে ধরে ফেলল, ‘স্যার, আমার একটা স্যাড় একপিরিয়েন্স’

ডাক্তার এক ঝটকায় তাকে সরিয়ে দিয়েছিল, ‘যে ওষুধগুলো আনতে দিয়েছি, এনেছেন?’

‘এনেছি। কিন্তু একটা স্যাড ঘটনায়—মানে আমি দায়ী—‘

‘পরে বলবেন। পেসেন্ট এখন অপারেশন টেবিলে—’

তারপর নাভি থেকে ন’ইঞ্চি চিরে ফেলল ডাক্তার। একটা মেয়ে বেরোলো। বুলুর চোখ বোজা। স্যালাইনের নল। হাতে ছুঁচ বিধিয়ে দেওয়া ছিল। এবার কুবের কোন বাচ্চা চায়নি। ফাও একটা মেয়ে এসে গেল।

আভা বউদি বললো, ‘আপনার তো অনেক টাকা। আপনাদের দাদাকে একটা কাজ দিন না। হাটে হাটে ঘুরে বই বেচে বেড়াচ্ছে। হাটুরে গাইয়ে বাড়ি বয়ে ধরে আনছে আর গান শুনছে। ভাব এলে নাচও জুড়ে দেয়। অথচ সংসার টানতে আমাকে কি না করতে হয়—; বলতে বলতে আভা জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। দূরে স্টেশন ঘুরে একখানা জিপ ছুটে আসছে!

‘উঠুন এবার। আপনার দাদার কাছ থেকে লোক আসছে—’

‘জিপে’

‘ওরকম প্রায়ই আসে। পেট্রোল খোঁজার সরকারী লোক। উঠুন তো।’

প্রায় ধমকে তুলে দিল কুবেরকে। বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল জিপগাড়ি থেকে সেই লোকটা নামছে। একদিন লেভেল ক্রসিংয়ে এদের ডাব কিনে দিয়েছিল কুবের। কিন্তু এ-লোকটা এখানে কেন।

‘মিসেস দত্ত আছেন?’

‘যান না ভেতরে আছেন—’

কুবের কোন মানে করতে পারল না। জানলা দিয়ে পরিষ্কার দেখতে পেল, আভা তার বাসি বেণীটা ঝপাং করে বুকের ওপর ফেলে দিচ্ছে। কুবেরের ভেতরটা হু হু করে উঠল। এ আমি কোথায় আছি। সরাইখানায় সকালবেলায় শুয়ে আছি। সবাই চলে গেছে যে যার কাজে। আমি জানি না আমার সামনে কি কাজ আছে। অল্পদিন হল আমার একটি মেয়ে হয়েছে। এই সব জন্মদানের কাণ্ডকারখানা আমাকে দিয়ে কেন? আমি কি ভালো মত পারি। থাকি সালকিয়া-হাওড়া স্টেশন দিয়ে কারখানা যেতাম (আপদ চুকে গেছে)—কদমপুর আমার দেশ হয়ে যাচ্ছে। এক জায়গায় এতদিনকার টান ভালবাসা ছিঁড়ে এ কোথায় আমি চলে আসছি। বুলু বেশ বলে, এখন খাটে শুয়ে শুয়েই বলে, নতুন বাড়িতে উঠে গিয়েই কিন্তু লাউ কুমড়োর চারা বসাব। তুমি একটা লোক ঠিক করে দিও। কুঁবিয়ে দেবে। ‘কু বিয়ে’ দেবে কি? ও কথাটা কি? কুপিয়ে বলবে বুলু। মাই আরনেস্ট রিকোয়েস্ট। আর নয় তুমি ভীষণ অর্ডিনারি হয়ে যাচ্ছ—সে খেয়াল আছে?

সিঁথির পাশ দিয়ে একটা চুল পেকেছে। কুবের সেটা অনেকবার তুলে দিয়েছে। না দেখে আন্দাজে সেই ছুঁতে পারে। ভায়রাভাই বলাই মহাপাত্র নিয়মিত দাড়ি কামায়। না হলে ভুরভুর করে পাকা দাড়ি গাল ঢেকে ফেলে দু’দিনে।

ননী বোসের ছেলে বিকাশ বোস দু’ দুটো পাম্প বসিয়ে ঝিল ছেঁটে ফেলছে চব্বিশ ঘণ্টা পাম্পের আওয়াজ। এখন তিন বছর চার বছরের মাছগুলো ধরা পড়বে।

হঠাৎ ব্রজ ফকিরের বাড়ি থেকে আভা বউদির গলার স্বর চিরে বেরিয়ে এল, ‘ছিঃ! ছিঃ!’ ক’বার এমন বলে ফেলেছে আভা এতদূর পর্যন্ত শোনা যায়নি। লোকটা তাড়া খেয়ে ছুটে বেরিয়ে এল। এসেই লাফিয়ে জিপে উঠে স্টার্ট দিল। তারপর কুবেরের গা ঘেঁষে ছিটকে বেরিয়ে গেল।

কোন্‌দিকে যাবে। শেষে ব্রজদার বাড়িতেই গিয়ে ঢুকল।

তখনও আভা চেঁচাচ্ছে, ‘ছিঃ! এই কি প্রবৃত্তি!’ তারপর পায়ের শব্দ পেয়ে ঘর থেকেই চেঁচিয়ে উঠল, ‘কে আবার?’ বাইরে বেরিয়ে এসে কুবেরকে পা থেকে মাথা অব্দি দেখল, শেষে একদম কিছু বুঝে ওঠার আগে হুহু করে কেঁদে উঠল, থামান যায় না, ভাগ্যিস অন্য ভাড়াটেরা যে যার কাজে প্রায় সবাই বাইরে।

‘আমি আর পারিনে কুবেরবাবু।’

অনেকক্ষণ কথা বলানো গেল না। কুবের চুপচাপ বসে থাকল। ঘরে কিছু ঝুল, কোণে একটা একতারা। জানলার পাশে ছোট টেবিল—টেবিলে পাউডার, চুলের ফিতে, একখানা আয়না। এসব আগে কোনদিন দেখেনি কুবের—আসলে চোখে পড়েনি। কোন জিনিস তার আজকাল চোখে পড়ে না। সূর্যের নীচে যা কিছু তা এই মাঠ-ঘাট, এ-সবই শুধু দেখতে পায় কুবের। ভদ্রেশ্বর জায়গা-জমির খোঁজ আনে। দর বলে। হাজারো লোকের জমির পরচা হতে একখানা ডাইরির মধ্যে গুঁজে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বেশ বলে লোকটা। কথার ঢিমে তালে লোকটার সুর থাকে কেমন। প্রায় ছড়া তুলে বলবেঃ সাগর ভেঙে নগর। নগর ভেঙে সাগর। কাল পরশুর মধ্যে নতুন জায়গা দেখাতে নিয়ে যাবে চড়াবিদ্যায়।

‘পেট্রোল খোঁড়ার জায়গা থেকে একজনার আসার কথা ছিল। আপনার দাদার খবর নিয়ে আসবে। এলেই তার সঙ্গে সোঁদালিয়া ক্যাম্পের ওখানে চলে যাব—

কুবের কিছু বুঝতে পারছিল না, ‘কি ব্যাপার—’

‘ওখান থেকে পুলিশ দিয়ে সব লোক তুলে দিচ্ছে। আপনার দাদা আজ মাস তিনেক ঘর তুলে সেখানেই পড়ে আছে। তাড়দার হাটে হাটে বই ফিরি করে, গান গায় ঘুঙুর বেঁধে, ভাবের গান তুলে নাচে–’ হাঁপাচ্ছিল আভা॥

‘এক গ্লাস জল খেয়ে নেবেন?’

‘না থাক। শিষ্য জুটেছিল দু’একজন। ভেবেই ছিল ওখানে থেকে যাবে। পুলিশ দিয়ে লোক ওঠানো হচ্ছে। শুধু ধর্মস্থান, মন্দির, আশ্রম এসবে রেহাই পেয়ে থাকে। কথা ছিল, গোলমাল দেখলেই খবর দেবে। আমি গিয়ে একেবারে সংসার পেতে বসব। তাহলে সংসার তুলে ওখান থেকে আপনার দাদার উঠে আসতে হবে না?’

‘উঠতে হবে কেন?’

থতমত খেয়ে গেল আভা, ‘আপনি কিছু জানেন না?’

‘নাতো।’

‘তেল বেরিয়েছে—পেট্রোল। কাউকে থাকতে দিচ্ছে না। যন্ত্র দিয়ে মড়মড় করে আধ ঘণ্টার ভেতর বাঁশ বাগান উপড়ে ফেলছে—সে কি প্রলয় কাণ্ড। আপনি কোনদিন যাননি বুঝি ওদিকে—’

কুবের আভার শেষ দিককার কথাগুলো কিছু শুনতে পেল না। শুধু বললো, ‘তেল বেরিয়েছে—পেট্রোল—‘

আভা বললো, ‘হ্যাঁ, সে জন্যেই তো তুলে দিচ্ছে সবাইকে। আপনার দাদার খবরের নাম করে অন্য একটা লোক এসে হাজির। দেখতে ভদ্রলোক। ভেতরে বসিয়েছি—’, এখানে একবারে মত থামল আভা, ‘ঠিক আর পাঁচটা পুরুষের মত—’, এবার কুবেরের মুখে তাকিয়ে ফেলল। একেবারে থেমে যেতে যেতে হঠাৎ এগিয়ে এসে কুবেরের গলাটা ডান হাতে জড়িয়ে ধরে মাথা প্রায় গলার কাছে চেপে ধরল ‘কি ঘেন্না! ঘেন্না!’ কুবের বুঝল আভা তখনও কাঁদছে।

কোনক্রমে মাথা ছাড়িয়ে নিয়ে কুবের সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করল। ‘ঘেন্না! কি ঘেন্না!’ কথাগুলা তার মাথার ভেতরে গদাম করে এইমাত্র একটা ডাণ্ডা মেরেছে। খানিক আগে লোকটা এমন ঝিলিক তুলে মিলিয়ে গেল। ব্রজদা নিশ্চয় তেল কোম্পানির আখড়ার ওখানে জমিয়ে আড্ডা দিয়ে থাকে। নইলে বলা নেই, কওয়া নেই—লোকটা এল, এসেই বলা নেই কওয়া নেই কাজকর্ম শুরু করে দিল। তক্কে তক্কে ছিল বোধ হয়।

‘একদিন বাজারে দেখেছিলাম ওকে। ফিরে ফিরে দেখছিল আমায়—’

‘তোমায় সবাই এত দেখে কেন বল দিকিনি?’

‘আমি জানব কি করে?’

‘একটু কম ঘোরাঘুরি করলে পার।’

‘চলে মশাই? মানুষটা সব সময় ঘোরের মাথায় আছে। একটা না একটা অসম্ভব জিনিস বেছে নিয়েই তার পেছনে ছুটবে। আমাকে বাকি দিকগুলো দেখতে কি যে না করতে হয়—’

সুরমা টানা চোখ জোড়া স্ফটিক হয়ে ঝিকিয়ে উঠল। নাকের পাটা নিঃশ্বাসে উঠছে পড়ছে। কুবের বুঝল এমন ঘনিষ্ঠ দশায় তার লটাপটি এখন বেশ মানানসই হত। কিন্তু ভেবে অবাক হল, আভার কথা তার একটুও মনে ধরছে না। সোঁদালিয়া পেট্রোল ক্যাম্পের ওদিকে এখন লোক ছুটবে। জায়গা জমির দর হু হু করে চড়বে। অথচ টাকা পয়সা বাড়ি তৈরিতে, পুকুর কাটানোয়, নতুন জায়গার বায়নাপত্রে ছড়িয়ে আছে। আরও চিন্তার কথা ভদ্রেশ্বরের সঙ্গে চড়াবিদ্যা গিয়ে এক লপ্তে অনেকটা চর ভরাটি জায়গা বায়না করার কথা রয়েছে। কোন দিকে যাবে।

‘সন্ধ্যে না পড়তেই ভবেন শী আসবে। অথচ মানুষটার ঘরে ফিরতে রাত হয়ে যায় ভীষণ। আমার খুব ভয় করে কুবের। দারুণ ভয় করে কুবের। হাসি-ঠাট্টা মসকরা করে, চা এগিয়ে দিয়ে লোকটা কোন রকমে ঠেকিয়ে রাখি। কোন কোন দিন বাপের আগেভাগে পুচকে ছেলেটাও আসে বুড়োর। একগাদা পাউডার মেখে সে এক বেভ্যুল অবস্থা। না দেখলে তোমার বিশ্বাস হবে না কুবের!’

‘ঢুকতে দাও কেন?’

‘সাধে দিইছি। আগের চোতে গুচ্ছের টাকা হাওলাত করে বসে আছে। সুদ তস্য সুদ। আমি এখন তোমার দাদার চক্রবৃদ্ধির ফাউ।’

ঢলঢল করে হাসল খানিক। আভার ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেল অনেকটা। বাচ্চা—টাচ্চা হবে না তো শেষে।

‘আমাকে দেখার কেউ নেই এখন কুবের—’

আভার কোমরের ওপর অনেকখানি তলপেট বেরিয়ে। এখন দুপুর। এই অজানা জায়গায় আমি কুবের সাধুখাঁ জোর করে আমার একটা শিকড় বসাবার চেষ্টা করছি। ভাল লাগাবার জন্যে কত রকমের শিকড় ছেড়েছি কতদিকে। নয়ানদের আশুতোষ নস্কর বিদ্যালয়ে টালির চাল ছেয়ে দেওয়ার জন্যে পাঁচশো টাকা চাঁদা দিয়েছি। এখানকার কাপড়ের দোকানের ফরাসে বসে দেশের কথা আলোচনা করি। এই মাটিতে বীরভূমের দুলার ধান কতখানি ফলতে পারে তাই নিয়ে শ্রীগোপাল সার কোম্পানির গোপালবাবুর সঙ্গে বসে চা খেতে খেতে চিন্তা করি। অথচ বছর দুতিন আগে কস্মিনকালেও আমি কদমপুর আসিনি। কান্তবাবু এপ্রিলে রিটায়ার করেছেন। নয়ান রেল ছেড়ে কয়লার দোকান করবে করবে করছে। বাজারে গিনি সোনার দোকানের ছাদে বিড়ি তামাকের আড়ৎ হয়েছে। ফালি মত ঘরটায় সব সময় রেডিও বাজে। ডজন দুই লোক গানের তালে তালে দুলে দুলে বিড়ি বাঁধে।

‘আমাকে নিয়ে পালাবে কুবের? এখনও সুন্দর করে ভুলিয়ে রাখব তোমাকে—’একটু হাসছে মনে হল আভাকে।

‘সিনেমা হয়ে যাবে না?’

‘হয় হোক্। আমি আর পারিনে কুবের—’

‘ব্রজদা ফেরে কখন?’

‘কোন ঠিক নেই। চল এই বেলা। আমি সব ফেলে দিয়ে যাব—

‘ভালবেসে বিয়ে করেছিলে না? সরস্বতী বৌঠানকে কানা করে দিয়ে মানুষটাকে টেনে আনোনি একদিন?

‘বয়স কম ছিল। সব বুঝতাম না। এ মানুষটা কাউকে ভালবাসে না। শুধু নিজের খেয়ালকে ভালবাসে কুবের। আমি বলে এতদিন এক সঙ্গে আছি। আমায় নিয়ে চল—এখুনি যাব আমি।’

‘আমি যেতে পারব না আভা। আমার যাবার উপায় নেই—’

আঁচলের খুঁট ডান হাতের বুড়ো আঙুলে জড়িয়ে ফেলল আভা, ‘তা ঠিক! যাবেই বা কেন! অমনতর তাজা বৌ। দাগ পড়েনি কোথাও। সোনার চাঁদ ছেলে—’

‘আমার যাবার উপায় নেই বৌদি। আমি ভীষণ জড়িয়ে পড়েছি।’

‘অমন জড়াতে পারতাম! তোমার মেয়ের গায়ের রঙ কার মত হয়েছে?’

‘আমারই মত। সেকথা বলছি নে। সংসারে আমার টান ভালবাসা কমে গেছে আভা। চারদিকে জমি জায়গার দলির দস্তাবেজে আমি ষোল আনা বাঁধা পড়ে গেছি। পাশ ফিরবার উপায় নেই। নীলামের সম্পত্তি ডাকি আজকাল। লোক ভাড়া দিয়ে হোমড়াপলতায় আবাদে জায়গা দখল নিতে হচ্ছে। দুনিয়ার কত জায়গাজমি। তাতে ঘাস হয়, উলু হয়, কাশ হয়। পালম বুনলে পালম ফলে। বীজ ধান গুঁজে দিলে তিন কালির জায়গার চল্লিশটা অব্দি বিয়েন ছাড়ে—তাতে শিষ ধরে, দুধ আসে, লোকে বলে অমরলতা। অথচ এতকাল আধমরা ইট-কাঠের বাড়ির মধ্যে বাঁধা পড়ে ছিলাম সালকেয়—’

‘তবে যে বড় বাড়ি বানাচ্ছ! ক’দিন পরেই নতুন ঘরে চাপবে। সালকের বাস তুলে দিয়ে পাকাপাকি চলে আসছ—’

‘বুলুর ইচ্ছে। বাড়ি ঘরদোরে আমার তেমন লোভ নেই। মা বাবা এখানে থাকলে খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস ফেলে দু’দিন বেশি বাঁচবে।’

‘আমি মরে যাব কুবের। তুমি আমায় রাখো। যেভাবে ইচ্ছে রাখো। কোন গোলমাল করব না। যা বলবে তাই করব। আমি আর দম ফেলতে পারছিনে কুবের—’

‘সংসারে অমন হয়ই। মানিয়ে চল। মনের মত ঘরবর সবাই চায়। ক’জন পায়?’

আভা ফুঁসে উঠল, ‘খুব হয়েছে। আর বচন ঝেড়ো না। তোমাদের মত পুরুষমানুষ আমার খুব চেনা আছে—’

কুবের কোন কথা বলল না। সালকিয়ার হরিরাম সাধুখাঁর বাড়িতে এখন বাবা, মা, বড়দা, বড় বউদি, ভাইরা, বৌমারা সবাই একটা কথা ভেবে মশগুল হয়ে আছে। হরিরাম সাধুখাঁর বংশধর কুবের সাধুখাঁর একখানা বাড়ি হচ্ছে। বাড়িতে পুকুর আছে, তিনশো লোক বসে খাওয়ার চাতাল আছে, দক্ষিণে তেতাল্লিশ বিঘের বিল আছে। তার ওপর দিয়ে হাওয়া এসে গরম একদম বুঝতে দেয় না।

‘দশটা টাকা দিয়ে যাও। মানুষটা তবিল একেবারে ফাঁক করে রেখে গেছে।‘

‘খুচরো তো নেই।’

‘যা আছে দিয়ে যাও।’

কুবের ইনসাইড পকেটে হাত দিয়ে নোটের গোছা থেকে একখানা একশো টাকার নোট বের করে দিল।

‘খুব বড়লোক হয়ে গেছ তো!’

আভার সঙ্গে কুবের হাসতে পারল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *