কালিন্দী – ২

সুনীতি রায় বংশের ছোট বাড়ির মালিক ইন্দ্র রায়কে বলেন –দাদা। কিন্তু ইন্দ্র রায়ের সঙ্গে তাঁহার কোন সম্পর্ক নাই। ইন্দ্র রায় রামেশ্বর চক্রবর্তীর প্রথমা পত্নী রাধারাণীর সহোদর। চক্রবর্তী-বংশের সহিত রায়-বংশের বিরোধ আজ তিন পুরুষ ধরিয়া চলিয়া আসিতেছে; রায় বংশের সকলেই চক্রবর্তীদের প্রতি বিরূপ, কিন্তু এই ছোট বাড়ির সহিতই বিরোধ যেন বেশী। তবুও আশ্চর্যের কথা, রামেশ্বর চক্রবর্তীর সহিত ছোট বাড়ির রায়-বংশের কন্যার বিবাহ হইয়াছিল।

তিন পুরুষ পূর্বে বিরোধের সূত্রপাত হইয়াছিল। রায়েরা শ্রোত্রিয় এবং চক্রবর্তী-বংশ কুলীন। সেকালে শ্রোত্রিয়গণ কন্যা সম্প্রদান করিতেন কুলীনের হাতে। রামেশ্বরের পিতামহ পরমেশ্বর রায়-বংশের মাঝের বাড়ির সম্পত্তির উত্তরাধীকারিণী কন্যাকে বিবাহ করিয়াছিলেন। বিবাহ করিয়াও তিনি শ্বশুর বর্তমানে কখনও স্থায়ীভাবে শ্বশুরালয়ে বাস করন নাই। শ্বশুরের মৃত্যুর পর তিনি যেদিন এখানে আসিয়া মালিক হইয়া বসিলেন, রায়েদের সহিত তাঁহার বিবাদও বাধিল সেই দিনই। সেদিনও রায়েদের মুখপাত্র ছিলেন ওই ছোট বাড়িরই কর্তা-এই ইন্দ্র রায়ের পিতামহ রাজচন্দ্র রায়। সেদিন পরমেশ্বর চক্রবর্তীর শ্বশুরের অর্থাৎ রায়-বংশের মাঝের বাড়ির কর্তার শ্রাদ্ধবাসর। রাজচন্দ্র রায়ের উপরেই শ্রাদ্ধের সকল বন্দোবস্তের ভার ন্যস্ত ছিল। মজলিসে বসিয়া রাজচন্দ্র গড়গড়ার নল টানিয়া পরমেশ্বর চক্রবর্তীর হাতে তুলিয়া দিলেন। পরমেশ্বর নলটি না টানিয়াই রায়-বংশের হাতে সমর্পণ করিলেন। তার পর নিজের ঝুলি হইতে ছোট একটি হুঁকা ও কল্কে বাহির করিয়া একজন চাকরকে বলিলেন, কোন ব্রাহ্মণকে দে, জল সেজে এই কল্কেতে আগুন দিয়ে দিক। তিনি ছিলেন পরম তেজস্বী তান্ত্রিক ব্রাহ্মণ।

রাজচন্দ্র সম্বন্ধে পরমেশ্বরের শ্যালক, তিনি বলিলেন, ভণ্ডামিটুকু খুব আছে কুলীনদের।

হাসিয়া পরমেশ্বর বলিলেন, গুণ্ডামির চেয়ে ভণ্ডামি অনেক ভাল রায় মশায়।

রাজচন্দ্র উত্তর দিলেন, গুণ্ডামির অর্জিত ভূ-সম্পত্তি কিন্তু বড়ই উপাদেয়।

কথাটি শুনিয়া রায়-বংশের সকলেই হা-হা করিয়া হাসিয়া উঠিলেন।

পরমেশ্বর কিন্তু ক্রুদ্ধ হইলেন না, তিনি সঙ্গে সঙ্গেই মৃদু-হাস্যের সহিত উত্তর দিলেন, শুধু ভূমি-সম্পত্তিই নয় রায় মশায়, গুণ্ডাদের কন্যাগুলিও রত্নস্বরূপা; যদিও দুষ্কুলাৎ।

এবার মজলিসে যে যেখানে ছিল, সকলেই হাসিয়া উঠিল; হাসিলেন না কেবল রায়েরা। ফলে গোলও বাধিল। শ্রাদ্ধ অন্তে ব্রাহ্মণ-ভোজনের সময় রায়েরা একজোট হইয়া বলিলেন, পরমেশ্বর চক্রবর্তী আমাদের সঙ্গে এক গড়গড়ায় তামাক না খেলে আমরাও অন্ন গ্রহণ করব না।

পরমেশ্বর আপনার ছোট হুঁকাটিতে তামাক টানিতে টানিতেই বলিলেন, তাতে চক্রবর্তী-বংশের কোন পুরুষের অধোগতি হবে না। ব্রাহ্মণ-ভোজনের অভাবে অধোগতি হলে রায়-বংশেরই হবে।

অতঃপর রায়দের মাথা হেঁট করিয়া খাইতে বসিতে হইল। কিন্তু উভয় বংশের মনোজগতের মধ্যবর্তী স্থলে একটি ক্ষুদ্র পরিখা খনিত হইল সেই দিন।

পরমেশ্বর ও রাজচন্দ্রের সময় বিরোধের যে পরিখা খনিত হইয়াছিল তাহা শুধু দুই বংশের মিলনের পক্ষে বাধা হইয়াই প্রবাহিত হইত, গ্রাস কিছুই করে নাই। কিন্তু পরমেশ্বরের পুত্র সোমেশ্বরের আমলে পরিখা হইল তটগ্রাসিনী তটিনী; সে তট ভাঙিয়া কালী নদীর মত সম্পত্তি গ্রাস করিতে শুরু করিল। মামলা-মকদ্দমার সৃষ্টি হইল। রাজচন্দ্রের পুত্র তেজচন্দ্রই প্রথমটা ঘায়েল হইয়া পড়িলেন। সোমেশ্বরের একটা সুবিধা ছিল, সমগ্র সম্পত্তিরই মালিক ছিলেন সোমেশ্বরের জননী। সোমেশ্বরের মাতামহ দলিল করিয়া সম্পত্তি দিয়া গিয়াছিলেন কন্যাকে, কাজেই সোমেশ্বরের দায়ে তাঁহার সম্পত্তি স্পর্শ করিবার অধিকার কাহারও ছিল না। এই সময়ে বীরভূমের ইতিহাস-বিখ্যাত সাঁওতাল-বিদ্রোহ হয়। সোমেশ্বর অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করিয়া সাঁওতালদের সহিত যোগ দিয়া বসিলেন। কপালে সিন্দূরের ফোঁটা আঁকিয়া তিনি নাকি সাঁওতাল-বাহিনী পরিচালনাও করিয়াছিলেন। এই লইয়া মাতা-পুত্রে বচসা হয়, পুত্র তখন বিদ্রোহের উন্মাদনায় উন্মত্ত। সে মাকে বলিয়া বসিল, তুমি বুঝবে না এর মূল্য, শ্রোত্রিয়েরা চিরকাল রাজসরকারের প্রসাদভোজী, সেই দাসের রক্তই তো তোমার শরীরে।

মা সর্পিণীর মত ফণা তুলিয়া উঠিলেন, বলিলেন, কি বললি? এত বড় কথা তোর? তা, তোর দোষ কি, পরের অন্নে যারা মানুষ হয় তাদের কথাটা চিরকাল বড় বড় হয়, সুর পঞ্চমে উঠেই থাকে।

সোমেশ্বর বলিলেন, তোমার কথার উত্তর তুমি নিজেই দিলে, কাকের বাসায় কোকিল মানুষ হয়, সুর তার পঞ্চমে ওঠে, সেটা তার জাতের গুণ, কাক তাতে চিরকাল ক্রুদ্ধ হয়ে থাকে।

ওদিকে তখন তেজচন্দ্র সদরে সাহেবদের নিকট হরদম লোক পাঠাইতেছেন। সে সংবাদ সোমেশ্বরও শুনিলেন, তাঁহার মাও শুনিলেন। সোমেশ্বর গর্জন করিয়া উঠিলেন, রায়হাট ভূমিসাৎ করে দেব, রায়-বংশ নির্বংশ করে দেব আমি।

সত্য বলিতে গেলে, সে গর্জন তাঁহার শূণ্যগর্ভ কাংস্যপাত্রের নিনাদ নয়, তাঁহার অধীনে তখন হাজারে হাজারে সাঁওতাল উন্মত্ত শক্তি লইয়া ঈঙ্গিতের অপেক্ষা করিতেছে। সোমেশ্বরের গৌরবর্ণ রূপ, পিঙ্গল চোখ, পিঙ্গল চুল দেখিয়া তাহারা তাঁহাকে দেবতার মত ভক্তি করিত, বলিত, রাঙা-ঠাকুর। সোমেশ্বরের মা পিতৃবংশের মমতায় বিহ্বল হইয়া পুত্রের পা চাপিয়া ধরিলেন। সোমেশ্বর সর্পদষ্টের মত চমকিত হইয়া সরিয়া আসিয়া নিতান্ত অবসন্নের মত বসিয়া পড়িলেন, বলিলেন, তুমি করলে কি মা, এ তুমি করলে কি? বাপের বংশের মমতায় আমার মাথায় বজ্রঘাতের ব্যবস্থা করলে?

মা ছেলের মাথায় হাত বুলাইয়া লক্ষ আশীর্বাদ করিলেন, ছেলে তাহাতে বুঝিল না। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া সোমেশ্বর বলিলেন, এ পাপের স্খালন নেই মা, তুমি নিশ্চিন্ত থাক, রায়-বংশের কেশাগ্র কেউ স্পর্শ করবে না।

সেই রাত্রেই তিনি নীরবে গোপনে গৃহত্যাগ করিলেন, একবস্ত্রে নিঃসম্বল অবস্থায়, হাতে শুধু এক উলঙ্গ তলোয়ার। ঘর ছাড়িয়া সাঁওতালদের আস্তানা শাল-জঙ্গলের দিকে তিনি অগ্রসর হইতেছিলেন, পিছন হইতে কে বলিল, এত জোরে হাঁটতে যে আমি পারছি না গো? একটু আস্তে চল।

চমকিত হইয়া পিছন ফিরিয়া সোমেশ্বর দেখিলেন, তাঁহার স্ত্রী শৈবলিনী তাঁহার পিছন পিছন আসিতেছেন। তিনি স্তম্ভিত হইয়া প্রশ্ন করিলেন, তুমি কোথায় যাবে?

শৈবলিনী প্রশ্ন করিলেন, আমি কোথায় থাকব?

কেন, ঘরে মায়ের কাছে!

তার পর যখন সাহেবরা আসবে, তোমায় জব্দ করতে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে?

হুঁ। কথাটা সোমেশ্বরের মনে হয় নাই। সম্মুখেই গ্রামের সিদ্ধপীঠ সর্বরক্ষার আশ্রম। সেই আশ্রমে প্রবেশ করিয়া সোমেশ্বর বলিলেন, দাঁড়াও, ভেবে দেখি। খোকাকে রেখে এলে! যেন সেটাও তাঁহার মনঃপূত হয় নাই।

শৈবলিনী বলিলেন, সে তো মায়ের কাছে। মাকে তো জাগাতে পারলাম না!

বহুক্ষণ পদচারণা করিয়া সোমেশ্বর বলিলেন, হয়েছে। মায়ের কাছ ছাড়া আর রক্ষা পাবার স্থান নাই। এইখানেই তুমি থাকবে।

বিস্মিত হইয়া শৈবলিনী স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন, এখানে লুকিয়ে থাকবার মত জায়গা আছে নাকি?

আছে। ভক্তিভরে মাকে প্রণাম কর, আশ্রয় ভিক্ষা কর। মাকে অবিশ্বাস ক’রো না।

হিন্দু মেয়ে–প্রায় একশত বৎসরের পূর্বের হিন্দুর মেয়ে এ-কথা মনেপ্রাণেই বিশ্বাস করিত। শৈবলিনী পরম ভক্তিভরে ভূমিলুণ্ঠিত হইয়া প্রণতা হইলেন।

পরমুহূর্তে রক্তাক্ত অসি উদ্যত করিয়া হা-হা করিয়া হাসিয়া অথবা কাঁদিয়া নীরব স্তব্ধ নৈশ আকাশ প্রতিধ্বনিত করিয়া সোমেশ্বর শালজঙ্গলে প্রবেশ করিলেন। শালজঙ্গল তখন মশালের আলোর অদ্ভুত ভয়াল শ্রী ধারণ করিয়াছে, উপরে নৈশ অন্ধকারের মত গাঢ় জমাট অখণ্ড নিবিড় বনশ্রী–মধ্যস্থলে আলোকিত শালকাণ্ডের ঘন সন্নিবেশ ও মাটির উপর তাহাদের দীর্ঘ ছায়া, তাহারই মধ্যে প্রকাণ্ড অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়া সিন্দূরে চিত্রিত মুখ রক্তমুখ দানবের মত হাজার সাঁওতাল। একসঙ্গে প্রায় শতাধিক মাদল বাজিতেছে-ধিতাং ধিতাং, ধিতাং ধিতাং। থাকিয়া থাকিয়া হাজার সাঁওতাল একসঙ্গে উল্লাস করিয়া কুক দিয়া উঠিতেছে–উ -র্‌ -র্‌! উ-র্‌-র্‌!

সোমেশ্বর হাজার সাঁওতাল লইয়া অগ্রসর হইলেন; একটা থানা লুঠ করিয়া, গ্রাম পোড়াইয়া, মিশনারিদের একটা আশ্রম ধ্বংস করিয়া, কয়েকজন ইংরেজ নরনারীকে নির্মমভাবে হত্যা করিয়া অগ্রসর হইলেন। পথে ময়ূরাক্ষী নদী। নদীর ও-পারে বন্দুকধারী ইংরেজের ফৌজ। সোমেশ্বর আদেশ করিলেন, আর এগোস না যেন, গাছের আড়ালে দাঁড়া।

ও-দিক হইতে ইতিমধ্যে ইংরেজের ফৌজ ভয় দেখাইবার জন্য ফাঁকা আওয়াজ আরম্ভ করিল। সাঁওতালরা সবিস্ময়ে দেখিল, তাহারা অক্ষতই আছে-কাহারও গায়ে একটি আঁচড় পর্যন্ত লাগে নাই। সেই হইল কাল। গুলি আমরা খেয়ে লিলম!–বলিয়া উন্মত্ত সাঁওতালদের দল ভরা ময়ূরাক্ষীর বুকে ঝাঁপ দিয়া পড়িল।

মুহূর্তে ও-পারে আবার বন্দুক গর্জন করিয়া উঠিল, এবার ময়ূরাক্ষীর গৈরিক জলস্রোত রাঙা হইয়া গেল-মৃতদেহ ভাসিয়া গেল কুটার মত। সোমেশ্বর চিত্রার্পিতের মতই তটভূমির উপর দাঁড়াইয়া ছিলেন। তিনিও এক সময় তটচ্যুত বৃক্ষের মত ময়ূরাক্ষীর জলে নিপাতিত হইলেন- বুকে বিঁধিয়া রাইফেলের গুলি পিঠ ফুঁড়িয়া বাহির হইয়া গিয়াছিল।

অতঃপর সোমেশ্বরের মা পৌত্র রামেশ্বরকে লইয়া লড়াই করিতে বসিলেন- সরকার বাহাদুরের সঙ্গে। সরকার সোমেশ্বরের অপরাধে তাঁহার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিয়া লইতে চাহিলেন। সোমেশ্বরের মা মকদ্দমা করিলেন-সম্পত্তি তাঁহার, সোমেশ্বরের নয়। আর সরকারবিরোধী সোমেশ্বরকে তিনি ঘরেও রাখেন নাই, সুতরাং সোমেশ্বরের অপরাধে তাঁহার দণ্ড হইতে পারে না

সরকার হইতে তলব হইল রায়বাবুদের, তাহার মধ্যে তেজচন্দ্র প্রধান। তাঁহাদের কাছে জানিতে চাহিলেন, সোমেশ্বরের মায়ের কথা সত্য কি না। বিদ্রোহী সোমেশ্বরের সহিত সত্যই তিনি কোন সম্বন্ধ রাখেন নাই কি না।

বাড়ি হইতে বাহির হইবার মুখে তেজচন্দ্রের মা বলিলেন, ও-বাড়ির ঠাকুরঝি রায়-বংশকে বাঁচাবার জন্য সোমেশ্বরের পায়ে ধরেছিলেন! আমাকেও কি-

তাড়াতাড়ি মায়ের পদধূলি লইয়া তেজচন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, তোমার সঙ্গে তো তোমার ঠাকুরঝির পাতানো সম্বন্ধ মা, আমার সঙ্গে যে ওঁর রক্তের সম্বন্ধ।

মা বলিলেন, আশীর্বাদ করি, সেই সুমতিই হোক তোমাদের। কিন্তু কি জান, রায়বাবুদের বোনকে ভালবাসা-কংসের ভালবাসা।

তেজচন্দ্র বলিলেন, চক্রবর্তী জয়দ্রথের গুষ্ঠী মা, শ্যালক-বংশ নাশ করতে ব্যুহমুখে সর্বাগ্রে থাকেন ওঁরা। যাক গে- ফিরে আসি, তার পর বিচার করে যা করতে হয় ক’রো, যা বলতে হয় ব’লো।

সেখানে রায়-বংশীয়েরা একবাক্যে রায়-বংশের কন্যাকে সমর্থন করিয়া আসিলেন। তেজচন্দ্রের জননীকে কিছু বলিতে বা করিতে হইল না-স্বয়ং সোমেশ্বরের জননীই পৌত্র রামেশ্বরের হাত ধরিয়া রায়-বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে সন্ধ্যারতির সময় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তেজচন্দ্র রামেশ্বরকে কোলে তুলিয়া লইলেন, তাঁহার মা ননদের হাত ধরিয়া বলিলেন, বাড়িতে পায়ের ধুলো দিতে হবে।

বাড়িতে ঢুকিয়া তেজচন্দ্রের মা বলিলেন, রাধি, আসন নিয়ে আয়।

রাধি-রাধারাণী-তেজচন্দ্রের সাত বৎসরের কন্যা। সে একটা কি করিতেছিল, সে জবাব দিল, আমি কি তোমার ঝি না কি? বল না ঝিকে।

কঠোর-স্বরে ঠাকুমা বলিলেন, উঠে আয় বলছি হারামজাদী।

হাসিয়া সোমেশ্বরের মা বলিলেন, কেন ঘাঁটাচ্ছ ভাই বউ; আমাদের বংশের মেয়ের ধারাই ওই। আমরাও তাই–রায়-বাড়ির মেয়ে চিরকেলে জাহাঁবাজ।

তেজচন্দ্রের মা বলিলেন, শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের যে কি হাল হবে, তাই আমি ভেবে মরি। ও মেয়ে স্বামীর নাকে দড়ি দিয়ে ওঠাবে বসাবে, আর নয় তো শ্বশুরবাড়ির অন্ন ওর কপালে নেই।

সোমেশ্বরের মা একবার রাধারাণীকে ডাকিলেন, ও নাতনী, এখানে একবার এস না, একবার তোমায় দেখি, আমিও তোমার ঠাকুমা হই।

সোমেশ্বরের মা রাধারাণীর অপরিচিতা নহেন। কিন্তু এ সংসারে ইষ্টের পরে শত্রুই নাকি মানুষের আরাধ্য বস্তু। সময় সময় ইষ্টকেও ছাপাইয়া শত্রু মানুষের মন অধিকার করিয়া থাকে। সেই হেতু সোমেশ্বরের মা, গ্রামের লোক এবং এই বংশের মেয়ে হইয়াও রায়-পরিবারের সকলেরই সম্ভ্রমের পাত্রী। তাঁহাকে দেখিয়া রাধারাণী নিতান্ত ভালমানুষের মত ঝির হাত হইতে আসনখানা টানিয়া লইয়া আগাইয়া আসিল এবং সম্ভ্রমভরেই আসনখানি পাতিয়া দিয়া ঢিপ করিয়া প্রণাম করিয়া নীরবে যেন আদেশের প্রতীক্ষা করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

সোমেশ্বরের মা পরম স্নেহে আদর করিয়া তাহাকে কোলের কাছে টানিয়া লইয়া বলিলেন, তোমরা মিথ্যে নিন্দে কর বউ; এমন সুন্দর আর এমন ভাল মেয়ে তো আমি দেখি নি। অ্যাঁ, এ যে বড় ভাল মেয়ে গো।

তেজচন্দ্রের মা সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার হাত চাপিয়া ধরিলেন, বলিলেন, রাধুকে তা হলে তোমারই পায়ে ঠাঁই দিতে হবে ভাই। আমরা আর কোথায় যাব? রামেশ্বরের সঙ্গে রাধির বিয়ে দেবে, তুমি বল!

সোমেশ্বরের মা এমনটা ঘটিবে প্রত্যাশা করেন নাই, তিনি বিব্রত হইয়া চুপ করিয়া রহিলেন। এই সময়েই রামেশ্বরের হাত ধরিয়া বাড়িতে প্রবেশ করিলেন তেজচন্দ্র। তাঁহার মা বলিলেন, তেজু ধর, পিসীমার পায়ে ধর। ধর বলছি, ধর। খবরদার, ‘হ্যা’ যতক্ষণ না বলবেন, ছাড়বি না। আমি ধরেছি, রামেশ্বরের সঙ্গে রাধুর বিয়ের জন্য।

তেজচন্দ্র পিসীমার পাদস্পর্শ করিয়াই বসিয়া ছিলেন। এ কথাটা শুনিয়া তাঁহারও মন পুলকিত হইয়া উঠিল। রামেশ্বরের সহিত আলাপ করিয়া তাঁহার বড় ভাল লাগিয়াছে। তাহার উপর আজিকার এই প্রণাম-আশীর্বাদের বিনিময়ের ফলে মন হইয়াছিল মিলনাকাঙ্খী; কথাটা শুনিবামাত্র তেজচন্দ্র সত্যিই সোমেশ্বরের মায়ের পা জড়াইয়া ধরিলেন।

তেজচন্দ্রের মা বলিলেন, আমি তোমায় মিনতি করছি ঠাকুরঝি,’না’ তুমি ব’লো না। এ সর্বনেশে ঝগড়ার শেষ হোক, সেতু একটা বাঁধ।

সোমেশ্বরের মায়ের চোখে জল আসিল। তিনি নিজে রায়-বংশের কন্যা, আপনার পিতৃকুলের সহিত এই আক্রোশভরা দ্বন্দ্ব তাঁহারও ভাল লাগে না। চক্রবর্তীদের দ্বন্দ্বে রায়েদের পরাজয় ঘটিলে, অন্তরালে লোকে তাঁহাকে বংশনাশিনী কন্যা বলিয়া অভিহিত করে, সে-সংবাদও তাঁহার অজানা নয়। আর, রামেশ্বর সবেমাত্র দশ বৎসরের বালক, এদিকে তাঁহার জীবন-প্রদীপেও তেল নিঃশেষ হইয়া আসিতেছে; তাঁহার অন্তে রামেশ্বরকে এই রায়-জনাকীর্ণ রায়হাটে দেখিবে কে, এ-ভাবনাও তাঁহার কম নয়। তিনি আর দ্বিধা করিলেন না, সজল চক্ষে বলিলেন, তাই হোক বউ, রামেশ্বরকে তেজচন্দ্রের হাতেই দিলাম। -বলিয়া তিনি রাধারাণীকে কোলে তুলিয়া লইলেন, তাহার কানে কানে বলিলেন, কি ভাই, বর পছন্দ তো?

রাধারাণী রামেশ্বরের দিকে চাহিয়া দেখিয়া আবার সোমেশ্বরের মায়ের কাঁধে মুখ লুকাইয়া বলিল, বাবা, কি কটা চোখ!

সোমেশ্বরের মা হা-হা করিয়া হাসিয়া উঠিলেন, রায়-বংশের মেয়ে জব্দ করতে চক্রবর্তী-বংশ সিদ্ধহস্ত। তখন তেজচন্দ্রের বাড়িখানা শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত হইয়া উঠিয়াছে।

সেতুবন্ধ রচিত হইল।

তেজচন্দ্র যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন সেতুর উপর লোকচলাচলের বিরাম ছিল না। রাধারাণী এ-বাড়ি হইতে ও-বাড়ি যাইত আসিত, রামেশ্বর আসিতেন যাইতেন, তেজচন্দ্র স্বয়ং একবেলা রামেশ্বরের কাছারিতে বসিয়া হিসাব-নিকাশ কাগজ-পত্র দেখিতেন, অন্দরে রাধারাণীর মা করিতেন গৃহস্থালির তদারক।

সেকালে উচ্চশিক্ষার সুযোগ তেমন ছিল না, কিন্তু তেজচন্দ্র পুত্রজামাতার শিক্ষার জন্য যথাসাধ্য করিয়াছিলেন। পুঁথি বই সংগ্রহ করিয়া পণ্ডিত মৌলবী দুইজন শিক্ষক নিযুক্ত করিয়া দিলেন। ইন্দ্রচন্দ্র ফারসীতে পণ্ডিত হইয়া উঠিলেন, আইনের বইয়ে তিনি ডুবিয়া থাকিতেন। রামেশ্বর পড়িতেন কাব্য।

ইন্দ্রচন্দ্র হাসিয়া বলিতেন, কাব্যে আর প’ড়ো না; জান তো, রসাধিক্য হলে বিকার হয়।

রামেশ্বর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিতেন, আহা বন্ধু, তোমার বাক্য সফল হোক, হোক আমার রসবিকার। রায়-বংশের ‘তন্বীশ্যামা শিখরদশনা পক্কবিম্বাধরোষ্ঠি’রা ঘিরে বসুক আমাকে, পদ্মপত্র দিয়ে বীজন করুক, চন্দনরসে অভিষিক্ত করে দিক আমার অঙ্গ-

বাধা দিয়া ইন্দ্রচন্দ্র বলিতেন, থাম, ফক্কড় কোথাকার! রামেশ্বর আপন মনেই আওড়াইতেন, ‘শ্রোণীভারাদলসগমনা স্তোকনম্রাস্তনাভ্যাং।’ ইহার ফলে সত্যসত্যই রামেশ্বর বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠিলেন। বাড়ির মধ্যে রাধারাণীর, রায়-বাড়ির স্বভাব-মুখরা মেয়ে, কঠোর কলহ-পরায়ণা হইয়া উঠিল। তেজচন্দ্রের পরলোকগমনের পর রায়-বংশের মেয়ে ও চক্রবর্তীবংশের ছেলের কলহ আবার ঘটনাচক্রে উভয় বংশে সংক্রামিত হইয়া পড়িল।

সেদিন রাধারাণী স্বামীর সহিত কলহ করিয়া পিত্রালয়ে চলিয়া আসিয়াছিল। সন্ধ্যায় রামেশ্বর একগাছি বেলফুলের মালা গলায় দিয়া চারিদিকে আতরের সৌরভ ছড়াইতে ছড়াইতে শ্বশুরালয়ে আসিয়া উঠিলেন। ইন্দ্রচন্দ্র তাঁহার সম্ভাষণও করিলেন না, রামেশ্বর নিজেই আসন পরিগ্রহণ করিয়া হাত জোড় করিয়া বলিলেন, নমস্তুভ্যং শ্যালকপ্রবরং কঠোরং কুম্ভবদনং-

বাধা দিয়া ইন্দ্রচন্দ্র বলিলেন, তুমি অতি ইতর!

রামেশ্বর বলিলেন, শ্রেষ্ঠ রস যেহেতু মিষ্ট এবং মিষ্টান্নে যেহেতু ইতরেরই একচেটিয়া অধিকার, সেই হেতু ইতর আখ্যায় ধন্যোহহং। তা হলে মিষ্টান্নের ব্যবস্থা করে ফেল।

আদরের ভগ্নী রাধারাণীর মনোবেদনার হেতু রামেশ্বরকে ইন্দ্র রায় ইহাতেও মার্জনা করিতে পারিলেন না, তিনি আর কথা না বাড়াইয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন। রামেশ্বর আর অপেক্ষা করিলেন না, তিনি উঠিয়া হাসিতে হাসিতে বলেলেন, নাঃ, অরসিকেষু রস নিবেদনটা নিতান্ত মূর্খতা। চললাম অন্দরে।

বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়া তিনি ডাকিলেন, কই, সখী মদলেখা কই?

শ্যালক ইন্দ্রচন্দ্রের পত্নী হেমাঙ্গিনীকে তিনি বলিতেন -সখী মদলেখা। তাঁহাদের কথোপকথন হইত মহাকবি বাণভট্টের কাদম্বরীর ভাষায়। স্বয়ং রামেশ্বর তাঁহাদিগকে কাদম্বরী পড়িয়া শুনাইয়াছিলেন।

হেমাঙ্গিনী আদর করিয়া রাধারাণীকে নামকরণ করিয়াছিলেন, কাদম্বরী। রামেশ্বর উত্তর দিয়াছিলেন, তা হ’লে রায়-গিন্নীকে যে নর্মসহচরী ‘মদলেখা’ হতে হয়।

হেমাঙ্গিনী বলিয়াছিলেন, তা হ’লে আপনি আমাদের ‘চন্দ্রপীড়’ হলেন তো?

কাদম্বরীর সম্বন্ধনির্ণয়-সূত্রানুসারে অবশ্যই হতে হয়; না হয়ে উপায় কি? আর আমার জন্মকুণ্ডলীতেও নাকি লগ্নে আছেন চন্দ্রদেবতা, সুতরাং মিলেও নাকি যাচ্ছে খানিকটা!

খানিকটা বিস্ময় প্রকাশ করিয়া হেমাঙ্গিণী বলিয়াছিলেন, খানিকটা! বিনয় প্রকাশ করছেন যে! রূপে গুণে ষোল-আনা মিল যে। রূপের কথা দর্পণেই দেখতে পাবেন। আর গুণেও কম যান না। দিবসে সমস্ত দিনটাই নিদ্রা, উদয় হয় সন্ধ্যার সময়; আর চন্দ্রদেবতার তো সাতাশটি প্রেয়সী, আপনার কথা আপনি জানেন; তবে হার মানবেন না, এটা হলফ করেই বলতে পারি।

সেদিন অর্থাৎ এই নামকরণের দিন, রাধারাণীর অভিমান রামেশ্বর সন্ধ্যাতেই ভাঙাইয়া ছিলেন, কাজেই রাধারাণী এ কথায় উগ্র না হইয়া শ্লেষভরে বলিয়াছিলেন, আমাদের দেশে কুলীনদের ছেলেরা সবাই চন্দ্রলগ্নপুরুষ, কারু এক শ বিয়ে, কারু এক শ ষাট। কপালে আগুন কুলীনের!

জোড়হাত করিয়া রামেশ্বর বলিয়াছিলেন, দেবী, সে অপরাধে তো অপরাধী নয় এ দাস। আর আজ থেকে, এই নবচন্দ্রাপীড়জন্মে চন্দ্রাপীড় দাসখত লিখে দিয়ে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে, রাধারাণী-কাদম্বরী ছাড়া সে আর কাউকে জানবে না।

রাধারাণী তর্জনী তুলিয়া শাসন করিয়া বলিয়াছিল, দেখো, মনে থাকবে তো!

আজ রামেশ্বরের আহ্বান শুনিয়া হেমাঙ্গিনী তাঁহাকে সম্ভাষণ করিয়া বলিলেন, আসুন দেবতা, আসুন।

চাপা-গলায় সশঙ্ক ভঙ্গীতে রামেশ্বর বলিলেন, আপনার দেবী কাদম্বরী কই?

আসন পাতিয়া দিয়া হেমাঙ্গিনী বলিলেন, বসুন। তার পর গভীরভাবে বলিলেন, না চক্রবর্তীমশায়, এবার আপনার নিজেকে শোধরানো উচিত হয়েছে।

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া রামেশ্বর বলিলেন, চেষ্টা আমি করি রায়গিন্নী, কিন্তু পারি না।

‘পারি না’ বললে চলবে কেন? আপনার ব্যবহারে বিতৃষ্ণায় রাধুর চিত্তেই যদি বিকার উপস্থিত হয়, তখন কি করবেন বলুন তো?

রামেশ্বর একদৃষ্টে শ্যালক-পত্নীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, হুঁ, কেমন মনে হচ্ছে? তার চেয়ে সাবধান হোন এখন থেকে। রাধুর মন আজ যা দেখলাম, তাতে আত্মহত্যা করা কিছুই আশ্চর্য নয়। সময় থাকতে সাবধান হোন।

রামেশ্বর নিজে উচ্ছঙ্খৃলচরিত্র; তিনি হেমাঙ্গিনীর ‘বিকার’ শব্দের নূতন বিশ্লেষণ গ্রহণ করিতে পারিলেন না। বিকার শব্দের যে অর্থ তিনি গ্রহণ করিলেন, শাস্ত্র সেই অর্থই অনুমোদন করে, এবং বর্তমান ক্ষেত্রে সেই বিকার হওয়াই সম্পূর্ণ স্বাভাবিক-শাস্ত্রসসম্মত। কিন্তু তিনি রাগ করিতে পারিলেন না, শাস্ত্রে তিনি সুপণ্ডিত, মনে মনে তিনি অপরাধ স্বীকার করিয়া বলিলেন, রায়-গিন্নী, হয় নিজেকে সংশোধন করব, নয় ব্রাহ্মণের উপবীত পরিত্যাগ করব।

হেমাঙ্গিনী আশ্বস্ত হইয়া এইবার হাসিমুখে বলিলেন, তবে চলুন চন্দ্রাপীড়, দেবী কাদম্বরী মান-ও বিরহতাপিতা হয়ে হিমগৃহে অবস্থান করছেন। আসুন, অধীনী মদলেখা এখনই আপনাকে সেখানে নিয়ে যাবে।

দোতালার লম্বা দরদালানে প্রবেশদ্বারের সম্মুখেই মায়ের ঘরে রাধারাণী শুইয়া ছিল। মায়ের মৃত্যুর পর ঘরখানি বন্ধই থাকে, রাধারাণী আসিলে সে-ই ব্যবহার করে। দরদালানে প্রবেশ করিয়াই রামেশ্বর থমকিয়া দাঁড়াইলেন। রাধারাণীর শয্যাপার্শ্বে বসিয়া একটি তরুণকান্তি যুবক কি একখানা বই পড়িয়া রাধারাণীকে শুনাইতেছে।

ওটি কে, রায়-গিন্নী?

রামেশ্বরের সচকিত ভাব দেখিয়া হেমাঙ্গিনী কৌতুকপ্রবণা হইয়া উঠিলেন, বলিলেন, দেব, উপেক্ষিতা কাদম্বরী দেবীর মনোরঞ্জনের জন্য সম্প্রতি এই তরুণকান্তি কেয়ূরকে আমরা নিযুক্ত করেছি

ছেলেটি রাধারাণীর পিসতুতো ভাই! পিতৃমাতৃহীন হইয়া সে মামার বাড়িতে আশ্রয় লইতে আসিয়াছে আজই।

ইহার পর সমস্ত ঘটনা রহস্যের আবরণে আবৃত, সেইজন্যই সংক্ষিপ্ত। জানেন একমাত্র রামেশ্বর আর রাধারাণী। তবে ইহার পরদিন হইতে সেতুতে ফাটল ধরিল। রাধারাণীর পিত্রালয়ে আসা বন্ধ হইয়া গেল। রামেশ্বর নিজে হইয়া উঠিলেন কঠোর নিষ্ঠাপরায়ণ ব্রাহ্মণ, অন্য দিক দিয়া একাগ্রচিত্তে বিষয় অনুরাগী। বাল্যকালে রামেশ্বরের যে পিঙ্গল চোখ দেখিয়া রাধারাণী ভয় পাইয়াছিল, সে চোখ কৌতুক-সরসতা হারাইয়া এমন তীব্র হইয়া উঠিল যে রাধারাণী ভয় না করিয়া পারিল না। ওদিকে রায়-বংশের সহিত আবার খুঁটিনাটি আরম্ভ হইয়া গেল। পরস্পরের যাওয়া-আসা সংক্ষিপ্ত হইয়া অবশিষ্ট রহিল কেবল লৌকিকতাটুকু। ইহার বৎসরখানেক পরে রাধারাণী একটি পুত্রসন্তান প্রসব করিল। কিন্তু মাসখানেক পর অকস্মাৎ সন্তানটি মারা গেল; কয়েকদিন পরই একদিন রাত্রে রাধারাণীও হইল নিরুদ্দিষ্ট! প্রথমে সকলে ভাবিয়াছিল রাধারাণী বোধ হয় আত্মহত্যা করিয়াছে। ইন্দ্র রায় সন্দেহ করিয়াছিলেন, রাধুকে হত্যা করিয়াছে রামেশ্বর। কিন্তু রাধারাণীর সন্ধান পাওয়া গেল দশ মাইল দূরবর্তী রেল-স্টেশনের পথে। একজন চাষী বলিল, রায়বাড়ির মেয়ে রাধু দিদিঠাকরুণকে রেলস্টেশনের পথে দেখিয়াছে। তিনি তাহাকে স্টেশন কতদূর জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন। সে কথাটা কাহাকেও সাহস করিয়া বলে নাই। ইহার পর রাধারাণীর গৃহত্যাগে আর কাহারও সন্দেহ রহিল না।

লজ্জায় রায়-বংশের মাথা কাটা গেল। রামেশ্বর আবার বিবাহ করিলেন পশ্চিম-প্রবাসী এক শিক্ষক-কন্যা সুনীতিকে। মহীন্দ্র এবং অহীন্দ্র দুইটি সন্তান সুনীতির। তারপর রামেশ্বর এই কয়েক বৎসর পূর্বে অসুস্থ হইয়া পড়িলেন। আজ দুই বৎসর একরূপ শয্যাশায়ী হইয়া একেবারে ঘরে ঢুকিয়া বসিয়াছেন। আপনার মনে মৃদুস্বরে কথা বলেন আর চুপ করিয়া বিছানায় বসিয়া থাকেন।

এই হল রায়-বংশ এবং চক্রবর্তী-বংশের ইতিহাস। এই সম্বন্ধেই সুনীতি ইন্দ্র রায়কে বলেন, ও-বাড়ির দাদা।

* * *

সুনীতি সেদিন অপরাহ্নে অহীন্দ্রকে বলিলেন, তুই যাবি একবার ও-বাড়ির দাদার কাছে? অহি বলিল, কি বলব?

বলবি-, সুনীতি খানিকটা চিন্তা করিয়া লইলেন। তারপর বলিলেন, নাঃ, থাক অহি, মজুমদার-ঠাকুরপো আর মহী ফিরেই আসুক। আবার কি বলবেন রায়-বাবুরা, তার চেয়ে থাক।

অহি বলিল, ঐ তোমাদের এক ভয়। মানুষকে বিনা কারণে অপমান করা কি এতই সোজা মা? মহাত্মা গান্ধী সাউথ আফ্রিকায় কি করেছিলেন জান? সেখানে ইংরেজরা রাস্তার যে-ধারে যেত, রাস্তার সে ধারে কালা আদমীকে যেতে দিত না। গেলে অপমান করত, জেল পর্যন্ত হত। মহাত্মাজী সমস্ত অপমান নির্যাতন সহ্য করে সেই রাস্তাতেই যেতে আরাম্ভ করলেন। অপমানের ভয়ে বসে থাকলে কি কখনও সেই অধিকার পেত কালা আদমী? বল, কি বলতে হবে?

সুনিতী দেবী শিক্ষকের কন্যা, তাঁহার বড় ভাল লাগে এই ধারার আদর্শনিষ্ঠার কথা। তিনি ছেলের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, বেশ, তবে যা, গিয়ে বলবি, এই যে এত বড় গ্রাম জুড়ে বিবাদ-এটা কি ভাল? আপনি এখন গ্রামের প্রধান ব্যক্তি, আপনিই এটা মিটিয়ে দেন। তবে গরীব প্রজা যেন কোনমতেই মারা না পড়ে, সেইটে দেখবেন, এই কথাটা মা বিশেষ করে বলে দিয়েছেন।

ইন্দ্র রায় কাছারী-ঘরে বসিয়া কথা বলিতেছিলেন একজন মহাজনের সঙ্গে। ঐ চর লইয়াই কথা। মহাজনের বক্তব্য, পাঁচশত টাকা নজরস্বরূপ গ্রহণ করিয়া রায় মহাশয় তাহার দাবি স্বীকার করুন।

ইন্দ্র রায় হাসিয়া বলিলেন, চরটা অন্ততঃ পাঁচ শ বিঘে, দশ টাকা বিঘে সেলামী নিয়ে বন্দোবস্ত করলেও যে পাঁচ হাজার টাকা হবে দত্ত, আর এক টাকা বিঘে খাজনা হলেও বছরে পাঁচ শ টাকা খাজনা।

কিন্তু সে তো মামলা-মকদ্দমার কথা হুজুর।

ডিক্রি তো আমি পাবই, আর ডিক্রি হলে খরচাও পাব। সুতরাং লোকসান করতে যাবার কোন কারণ নেই আমার।

মহাজন চিন্তা করিয়া বলিল, আমি আপনাকে হাজার টাকা দেব, আর খাজনা ওই পাঁচ শ টাকা। অগ্রিম বরং আমি পাঁচশ টাকা দিচ্ছি। চারদিন পর আসব আমি।

নিস্পৃহতার সহিত রায় বাঁ হাতে গোঁফে তা দিতে দিতে বলিলেন, ভাল, এস।

লোকটি চলিয়া যাইতেই রায় বাহিরে আসিলেন। অহীন্দ্র তাঁহার অপেক্ষাতেই বাহিরেই বসিয়া ছিল। অহীন্দ্রকে দেখিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন। অহি তাঁহাকে প্রণাম করিয়া বলিল, আমার মা আপনার কাছে পাঠালেন।

তুমি রামেশ্বর চক্রবর্তীর ছেলে না? রায়েরা চক্রবর্তীদের কখনও বাবু বলে না।

হ্যাঁ।

হুঁ, চোখ আর চুল দেখেই চেনা যায়। রামেশ্বরের কোন ছেলে তুমি? রায়ের সকল কথার মধ্যে তাচ্ছিল্যের একটা সুর তীক্ষ্ণ সূচিকার মত মানুষকে যেন বিদ্ধ করে। কিন্তু সমস্ত উপেক্ষা করিয়া হাসিয়া স্বচ্ছন্দে সরল ভঙ্গীতে অহি উত্তর দিল, আমি তাঁর ছোট ছেলে

কি কর তুমি? পড়, না পড়া ছেড়ে দিয়েছ?

না, আমি ফার্স্ট ক্লাসে পড়ি-শহরের স্কুলে।

রায় বিস্মিত হইয়া বলিলেন, ফার্স্ট ক্লাসে পড় তুমি? কিন্তু বয়স যে তোমার অত্যন্ত কম! বাঃ, বড় ভাল ছেলে তুমি! তা তোমার বাপও যে খুব বুদ্ধিমান লোক ছিল। কিন্তু তোমার বড় ভাই, কি নাম তার? সে তো শুনেছি পড়াশুনা কিছু করে নি। স্কুলে তো তার খারাপ ছেলে বলে অখ্যাতিই ছিল, মাস্টার বলেছিলেন আমাকে।

অহি স্থিরদৃষ্টিতে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, আমার কথাগুলি একবার শুনে নিন।

হাসিয়া রায় বলিলেন, তুমি তো বলবে ঐ চরটার কথা?

হ্যাঁ।

দেখ, ও-চরটা আমার। অবশ্য আমার জ্ঞানবুদ্ধিমত। এই কথাই বলবে তোমার মাকে।

বেশ, তাই বলব। তবে মায়ের অনুরোধ ছিল, যেন প্রজাদের ওপর কোন অবিচার না হয়, সেইটে আপনি দেখবেন।

রায় এ কথার কোন জবাব দিলেন না। অহীন্দ্র আর অপেক্ষা না করিয়া গমনোদ্যত হইয়া বলিল, তা হলে আমি আসি।

সে কি? একটু জল খেয়ে যাও।

না, জল খেয়েই বেরিয়েছি, চরের দিকটায় একটু বেড়াতে যাব।

রায় বলিলেন, শোন। তখন অহীন্দ্র কতকটা অগ্রসর হইয়াছে। অহীন্দ্র দাঁড়াইল, রায় বলিলেন, চরের ওপারটায় শুনেছি বড় সাপের উপদ্রব। তোমার না যাওয়াই ভাল।

অহীন্দ্র সবিনয়ে বলিল, আচ্ছা, আমি ভেতরে যাব না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *