কালিন্দী – ১৯

১৯

একা অহীন্দ্র নয়, অমল এবং অহীন্দ্র দুইজনেই প্রাতঃকালে কালিন্দীর ঘাটে আসিয়া বসিয়াছিল। বর্ষার জলে ভিজিবার জন্যে দুইজনে বাড়ি হইতে বাহির হইয়াছিল। নদীর ঘাটে আসিয়া কালীর বন্যা দেখিয়া সেইখানে তাহারা বসিয়া পড়িল। খেয়াঘাটের উপরে পথের পাশেই এক বৃদ্ধ বট; বটগাছটির শাখাপল্লব এত ঘন এবং পরিধিতে এমন বিস্তৃত যে, বৃষ্টির জলধারা তাহার তলদেশের মাটিকে স্পর্শ করিতে পারে না, গাছের পাতা-ঝরা জল স্থানে স্থানে ঝরিয়া পড়ে মাত্র। গাছের গোড়ায় মোটা মোটা শিকড়গুলি আঁকিয়া বাঁকিয়া চারিপাশের মাটির মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে; কিন্তু তাহাদের উপর খানিকটা অংশ অজগরের পিঠের মত মাটির উপরে জাগিয়া আছে, সেই শিকড়ের উপর বসিয়া তাহারা দুইজনে কালীর খরস্রোতের মধ্যে ঢিল ছুঁড়িতে ছুঁড়িতে কথা বলিতেছিল। গাছটারই তলায় তাহাদের হইতে কিছু দূরে, খান-দুই গরুর গাড়ি খেয়ানৌকার অপেক্ষা করিয়া রহিয়াছে। বর্ষার বাতাসে গরুগুলির সর্বাঙ্গের লোম খাড়া হইয়া উঠিয়াছে, গাড়োয়ান দুইজন এবং আর জন-কয়েক খেয়ার যাত্রী ভিজা কাঠের আগুনের ধোঁয়ার সম্মুখে উবু হইয়া বসিয়া তামাক টানিয়া কাশিতেছে, গল্প করিতেছে।

বহুদিনের প্রাচীন বট, গাছের তলায় বহু বৎসর হইতেই পথের রাহীরা এমনই করিয়া আশ্রয় গ্রহণ করে। গাছটার নামই ‘আঁটের বটতলা’। পথের মধ্যে অপরিচিত পথিকেরা জোট বাঁধিয়া এই স্থানে আশ্রয় লইয়া থাকে-এই আশ্রয় লওয়াকে এ-দেশে বলে আঁট দেওয়া। গাছের তলাতেই একটা গরুর গাড়ির টাপর বা ছই পাতিয়া তাহারই আশ্রয়ের তলে উবু হইয়া বসিয়া খেয়াঘাটের ঠিকাদারও তামাক টানিতেছিল।

আপনার বক্তব্যের উপর জোর দিয়াই অমল কথা বলিতেছিল। সে এবার ধরিয়াছে, অহীন্দ্রকে কলকাতায় পড়িতে হইবে। অহীন্দ্রের কোন অজুহাতই সে শুনিতে চায় না; সে বার বার বলিতেছে, তোমার মত স্টুডেন্টের পক্ষে মফঃস্বল কখনও উপযুক্ত ক্ষেত্র হতে পারে না।

কৌতুকভরে অহীন্দ্র বলিল, বল কি?

নিশ্চয়। অন্তত তিন ধাপ যে খাটো, সেটা তো প্রামাণিত হয়েই গেছে তোমার রেজাল্টে?

মানে?

ভেরি ইজি। কলকাতায় থাকলে তোমার নাম থাকত সর্বাগ্রে-এ আমি নিঃসংশয়ে বলতে পারি। ক্ষেত্রের উর্বরতা-অনুর্বরতা তোমার সায়েন্সের স্বীকৃত সত্য, বীজের অদৃষ্টের ঘাড়ে দোষ চাপানোর মত অবৈজ্ঞানিক মতবাদ নিশ্চয় তুমি পোষণ করতে পার না।

এবার অহীন্দ্র কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, তুমি সবটা বুঝতে পারছ না অমল। তবে তোমাকে বলতে আমার বাধা নেই। আমাকে মাসে মাসে এবার থেকে মাকে কিছু করে না পাঠালে চলবে না। নিয়মিত আদায়পত্র তো হয় না, টাকার অভাবে মা অনেক সময় বিব্রত হয়ে পড়েন। আর মাকে আমার রান্না করতে হয়, মানদা ঝি বিনা মাইনেতে কাজ করে, অন্ততঃ এ দুটো খরচ আমাকে পাঠাতেই হবে।

অমল চুপ করিয়া গেল। কথাগুলির মধ্যে যে একটা বেদনাদায়ক সঙ্কোচ লুকাইয়া আছে, সেই সঙ্কোচে সে সঙ্কুচিত হইয়া পড়িল। প্রাণঢালা অন্তরঙ্গতায় সে অহীন্দ্রের অন্তরঙ্গ, তবুও তাহার মনে হইল, এ কথাটা জোর করিয়া অহীন্দ্রের কাছে শুনিয়া সে অনধিকার চর্চা করিয়াছে। এ-দিকে ও-পার হইতে নৌকাখানা আসিয়া পড়ায় খেয়াঘাট কলরবে মুখরিত হইয়া উঠিল। গাছতলায় গাড়ি লইয়া গাড়োয়ানেরা ব্যস্ত হইয়া পড়িল।-শীতার্ত গরু কয়টাকে গাড়িতে জুড়িবার পূর্ব হইতেই ঠ্যাঙাইতে আরম্ভ করিয়া দিয়াছে, চীৎকার শুরু করিয়া দিয়াছে। যাত্রী যাহারা নামিতেছে তাহারা চীৎকার করিতেছে কম নয়।

ঘাটের ঠিকাদার গরুর গাড়ির টাপরের ভিতর বসিয়াই পারের পয়সা আদায় করিতে করিতে একজনের সঙ্গে বিতণ্ডা জুড়িয়া দিয়াছে, একটি ছেলের পারানির পয়সা লইয়া। লোকটি বলিতেছে, কোম্পানির র‍্যালে ছেলের জন্যে হাফ-টিকিট, আর তোমার লৌকাতে নাই বললে চলবে কেনে হে বাপু? মগের মুলুক পেয়েছ লেকিনি তুমি?

গরুর গাড়ির গাড়োয়ান অত্যন্ত সাবধানতার সহিত গরুগুলিকে চালনা করিতে করিতে চেঁচাইতেছিল, অ-ই -হ-হ! ইদিগেই-

নিতান্ত প্রয়োজনীয় সময়ে এমনি কলরবমূখর একটি বিষয়ান্তরে সুযোগ পাইয়া অমল অহীন্দ্র দুইজনেই যেন বাঁচিয়া গেল। হাফটিকিট-যুক্তিবাদী লোকটির কথায় অকস্মাৎ প্রচুর কৌতুক অনুভব করিয়া অমল বেশ খানিকটা হাসিয়া লইয়া বলিল, ফাইন আর্‌গুমেন্ট কিন্তু।

যাত্রী গাড়ি বোঝাই করিয়া খেয়ানৌকা আবার ও-পারের দিকে রওনা হইল। খেয়ার মাঝি লগির একটা খোঁচা দিয়া নৌকাখানাকে তটভূমির সংস্পর্শ হইতে ঠেলিয়া জলে ভাসাইয়া উচ্চকণ্ঠে বলিল, হরিহরি বল সব। মিঞাসাহেবরা আল্ল-আল্লা বল।

হিন্দুর সংখ্যাই বেশি ছিল অথবা সবাই বোধ হয় হিন্দু ছিল, সমবেত কণ্ঠের একটা উচ্চ কলরোল উঠিল, হরি-বো-ল।

আবার ঘাট নিস্তব্ধ হইয়া গেল। শুধু নদীর আবর্তের কুটিল নিম্ন কলকল শব্দ একই ভঙ্গিতে একটানা ধ্বনিত হইয়া চলিল। সে মৃদু ধ্বনি উঠিলেও জনবিরল খেয়াঘাটের উপর যে দুই তিনটি মানুষ বসিয়া ছিল, তাহাদের অন্তরের স্তব্ধতা সে-ধ্বনিতে ক্ষুন্ন হইল না; জনবিরল খেয়াঘাটের শান্ত উদাসীনতার মধ্যে নদীর নিম্নস্বর সুশোভনরূপে অঙ্গীভূত হইয়া গিয়াছিল। কানে বাজিলেও মনে ধরা পড়িবার মত ধ্বনি সে নয়।

অমল ও অহীন্দ্রের মনের বর্হিদ্বারে অকস্মাৎ-আসিয়া পড়া কৌতুক ফুরাইয়া গিয়াছে ; আবার তাহারা দুজনেই গম্ভীর হইয়া উঠিয়াছে। একটি কাঠি দিয়া অমল বালির উপর আঁকিতেছে একটা অর্থহীন চিত্র। অহীন্দ্র স্থিরদৃষ্টি নদীর বুকের উপর। অমল সহসা বলিল, আচ্ছা, আমি যদি একটা টুইশানি যোগাড় করে দিই? এক ঘন্টা দেড় ঘন্টা পড়াবে, পনেরো টাকা কি কুড়ি টাকা তাঁরা দেবেন। তা হলে তো তোমার আপত্তি থাকতে পারে না?

অমলের মুখের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া অহীন্দ্র বলিল, আরও পরিষ্কার করে বল। তুমি কি উমাকে পড়াবার কথা বলছ?

অমলও অহীন্দ্রের মুখের দিকে চাহিয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিল, তাই যদি বলি?

পারব না।-দৃঢ়স্বরেই অহীন্দ্র জবাব দিয়া বসিল।

এবারও অমল হাসিল, বলিল, জানি। তবু কথাটা ভাল করেই জেনে নিলাম। যাক, সে কথা নয়; আমি বলছি আমার মামাতো ভাইকে পড়াবার কথা। ছেলেটা থার্ড ক্লাসে পড়ছে, তাকে পড়াবার জন্যে তাঁরা মাস্টার খুঁজছেন।

কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া লইয়া বলিল, ভাল রাজী হলাম। তারপর অল্প হাসিয়া বলিল, চল, দেখি তোমার কলকাতা কেমন। মফঃস্বলের চেয়ে কতখানি ওপরে অবস্থান করছেন, পরখ করে দেখা যাক।

অমল হাসিয়া বলিল, অনেক-অনেক। অনেক ওপরে অহি, তিন ধাপ নয়, আরও বেশী ওপরে। দেখছো না, প্রাইভেট টুইশানির কথা বলতেই তুমি ধরে নিলে উমাকে পড়াবার কথা। অর্থাৎ মনে করে নিলে উমাকে পড়াবার ভানে আমরা তোমাকে সাহায্য করতে চাই। যে দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলে, তাতে পুরাকাল হলে আমার ভস্ম হয়ে যাবার কথা। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, কেন? ধর, যদি তাই হত তাতেই বা ক্ষতি কি ছিল? শ্রমবিনিময়ে মূল্য নেবে, তাতে মর্যাদার হানিটা কোথায়? এই হল তোমার মফঃস্বল-মেন্টালিটি।

অহীন্দ্র রাগ করিল না, হাসিয়াই বলিল, এ কথায় কিন্তু কলকাতার লোকেরই হার হল অমল। মূল্য অপেক্ষা অমূল্য বস্তুর দাম বেশি এবং মূল্য না নিলে তবেই সংসারে অমূল্য বস্তু মেলে- এ সত্য কলকাতার লোক জানে না, মফঃস্বলের লোকেরাই জানে প্রমাণ হচ্ছে।

অমল হাসিয়া বলিল, বিজ্ঞানের ছাত্রের অযোগ্য কথা বললে অহীন। বৈজ্ঞানিকের কাছে অমূল্য শব্দের অ অক্ষরটা অঙ্কের পূর্ববর্তী শূণ্য ছাড়া আর কিছুই নয়। যতই উচ্চ মুল্যের বস্তু হোক, একটা মূল্য সে নির্ধারিত করবেই করবে। সেইটাই তার জ্ঞানের বৈশিষ্ট্যের পরিচয়।

অহীন্দ্র হাসিয়া বলিল, আমার মূল্য তোমার কাছে তা হলে কত তুমি বলতে পার?

অমল বলিল, তোমার কাছে আমার যত মূল্য, সেইটে ইনটু টেন।

আমার কাছে তুমি তো অমূল্য। অমূল্য ইনটু টেনের ভ্যালু কত, বল তো?

তুমি একটা বোগাস, যত কুটবুদ্ধি তোমার। -অমূল্য হাসিয়া এবার পরাজয় মানিয়া লইল।

এতক্ষণ তাহারা সহজ স্বছন্দ হইয়া উঠিল, বাহির এতক্ষণে অন্তরে প্রবেশ করিল।

নদীর বন্যা, আকাশে ঘনঘোর মেঘ, স্রোতের নিম্ন কলস্বর, বাতাসের শব্দস্পর্শ, ভিজামাটির গন্ধ এতক্ষণে তাহারা স্পষ্ট করিয়া অনুভব করিল। আবর্তকুটিল, গৈরিকবর্ণের বিশাল জলস্রোতের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চাহিয়া অমল বলিল, কালিন্দী আমাদের অদ্ভুত, বহরূপা রহস্যময়ী! অনেক দিন আগে, ছেলেমানুষ ছিলাম, তখন দেখেছি কালিন্দীর বান। আর এই দেখছি।

অহীন্দ্র বলিল, এখানকার প্রবাদ কি জান? এখানকার লোক বলে, উনি নাকি যমের সহোদরা ; অর্থাৎ যমুনার কাহিনীটা এঁর ওপর আরোপ করতে চায়। কালিন্দী নাকি যে বস্তুটিকে গ্রাস করতে বদন ব্যাদান করেন, তার রক্ষা কিছুতেই নেই। যম এসে সেখানে দোসর হয়ে ভগ্নীর পাশে দাঁড়ান। এক চাষী, তার নাম রংলাল, সেই আমাকে বলেছিল। অদ্ভুত বিশ্বাস, বললে, উনি যে-কালে হাত বাড়িয়েছেন, সে-কালে রায়হাটের আর রক্ষা নেই।

কালীর তটভূমির ভাঙনের দিকে চাহিয়া অমল বলিল, ওদের সংস্কারের কথা বাদ দিয়েও কথাটা সত্যি, ভাঙনের দিকে চেয়ে দেখ দেখি।

মৃদু হাসিয়া অহীন্দ্র বলিল, এদিকে ভাঙছে ও-দিকে গড়ছে। ও-পারের চরটা বছর বছর পরিধিতে অল্প অল্প করে বেড়ে চলেছে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সঙ্গে মানুষের কলহ বাড়ছে। গোড়া থেকেই ব্যাপারটা আমি জানি। আমি হলপ করে বলতে পারি অমল, যে, এ গ্রামে- শুধু এ গ্রামে কেন, আশেপাশে এমন লোক নেই, যার লোভ নেই ওই চরটার মাটির ওপর।

চরটার দিকে চাহিয়া অমল বলিল, চরটি কিন্তু সত্যি লোভনীয় হয়ে উঠেছে, তা ছাড়া মাটিও বোধ হয় খুব উর্বর।

খুব উর্বর। রংলাল বলছিল, ও মাটিতে সোনা ফলে-

চল একদিন দেখে আসি। কাল চল। …আরে আরে, অত সব চেঁচামেচি করছে কেন? আরে বাপ রে, দল বেঁধে চাপে যে! নৌকাখানা ডুবে যাবে!

ও-পারের চরের পার-ঘাটে দল বাঁধিয়া সাঁওতালদের মেয়েরা নৌকায় চড়িতে চড়িতে কলরব করিতেছে। নৌকায় উঠিয়া মেয়েরা দল বাঁধিয়া বাসিয়াছে, সেই ভারে এবং চাঞ্চল্যে নৌকাটা টলমল করিতেছে, তাহাতেই তাহারা সভয় কৌতুকে কলরব করিতেছে। এ-পার হইতে ঘাটের ঠিকাদারও শঙ্কিত হইয়া চীৎকার আরম্ভ করিয়া দিল, অই, অই, এরা করছে কিরে বাপু? হে-ই! হেই!

কিন্তু তাহার কণ্ঠধ্বনি নদীর কল্লোল ভেদ করিয়া ও-পারের দলবদ্ধ সাঁওতালদের কলরবের মধ্যে আত্মঘোষণা করা দূরের কথা, বোধহয় পৌছিতেই পারিল না। শেষ পর্যন্ত বেচারা কাশিয়া সারা হইল। কাশিতে কাশিতেই সে বলিল, মর, তবে মর তোরা ডুবে, নিক, নিক, কালী নিক তোদিগে। অসীম বৈরাগ্যের সহিত সে নদীর দিকে পিছন ফিরিয়া বসিয়া নূতন করিয়া তামাক সাজিতে শুরু করিল।

অহীন্দ্রের মুখে একটি পুলকিত হাসির রেশ ফুটিয়া উঠিল, সে নৌকাভরা সাঁওতাল মেয়েদের দিকে চাহিয়া বলিল, একটা মজা দেখবে দাঁড়াও।

হঠাৎ মজাটা কোত্থেকে আসবে?

ওই নৌকায় চড়ে আসছে।

বল কি? ব্যাপারটা কি?

আমার পূজারিণীর দল আসছে। আমি ওদের রাঙাবাবু।

অমল মুগ্ধ হইয়া গেল, বলিল, বিউটিফুল। চমৎকার নাম দিয়েছ তো। কিন্তু এ যে একটা রোমান্স হে!

অহীন্দ্র হাসিয়া বলিল, রোমান্সই বটে। আবার চরটার নাম দিয়েছে রাঙাঠাকুরের চর। আমার ঠাকুরদার সাঁওতাল হাঙ্গামায় যোগ দেওয়ার কথা জান তো? তাঁর প্রতি ওদের প্রগাঢ় ভক্তি। তাঁকে বলত ওরা-রাঙাঠাকুর। আমি নাকি সেই রকম দেখতে। চোখগুলো খুব বড় বড় করে বলে, তেমনি আগুনে-র পারা রং।

ঘাটের ঠিকাদারটি তামাক সাজিতে সাজিতে অহীন্দ্র ও অমলের কথাবার্তা সবই কান পাতিয়া শুনিতেছিল, সে আর থাকিতে পারিল না, বলিয়া উঠিল, তা আজ্ঞে, ওরা ঠিক কথাই বলে, বাবুমশায়। আমাদের চক্কবর্তী-বাবুদের বাড়ির মত রং এ চাকলায় নাই, তার ওপর আপনার রং ঠিক আগুনের পারাই বটে।

অমল ফিসফিস করিয়া বলিল, মাই গড! লোকটা আমাদের কথা সব শুনেছে নাকি?

হাসিয়া অহীন্দ্র বলিল, অসম্ভব নয়। চুরি করে পরের কথা শোনায় মানুষ চুরির আনন্দ পায়।

ঠিকাদারটা এবার বাহির হইয়া আসিয়া অহীন্দ্র ও অমলের সম্মুখে সবিনয় ভঙ্গিতে উবু হইয়া বসিয়া বলিল, বাবুমশায়!

অহীন্দ্র বলিল, বল।

আজ্ঞে। বলিয়াই সে একবার সঙ্কোচভরে মাথা চুলকাইয়া লইল, তারপর আবার বলিল, আজ্ঞে, বাদলের দিন, আমার কাছে সিগারেট তো নাই। তামুকও খুব কড়া, তা বিড়ি ইচ্ছে করুন কেনে।

অমল খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল, অহীন্দ্র ঈষৎ হাসিল, হাসিয়া সে বলিল, না, আমরা বিড়ি সিগরেট তামাক-এইসব খাই নে, ওসব কিছু দরকার নেই আমাদের।

লোকটি অপ্রস্তুত হইয়া অপ্রতিভভাবে হাসিয়া বলিল, আমি বলি-। কিছুক্ষণ অপ্রতিভর হাসি হাসিয়া সে আবার বলিল, আমি আজ্ঞে একটা কথা নিবেদন করছিলাম।

অমল হাসিয়া ইংরেজীতে বলিল, হোয়াট নেক্সট? এ গ্লাস অব ওয়াইন?

লোকটি কিছু বুঝিতে না পারিয়া সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, আজ্ঞে?

গম্ভীরভাবে অহীন্দ্র বলিল, কিছু না, ও উনি আমাকে বলছেন। তুমি কি বলছ, বল?

হাত দুইটি জোড় করিয়া এবার লোকটি বলিল, আজ্ঞে, ওই চরের ওপর খানিক জমির জন্যে বলছিলাম।

একটি মৃদু হাসি অহীন্দ্রের মুখে ফুটিয়া উঠিল, বলিল, জমি?

আজ্ঞে হ্যাঁ। বেশী আমার দরকার নেই, এই বিঘে দশ-পনেরো।

এ-কথার জবাব তো আমি দিতে পারব না বাপু। আমার মুরুব্বীরা রয়েছেন, তাঁরা যা করেন তাই হবে।

আজ্ঞে আমার বিঘে পাঁচেক হলেও হবে।- লোকটি কাকুতি করিয়া এবার বলিয়া উঠিল, আমি একটি দোকান ও-পারে করব মনে করছি।

দোকান? দোকান তো একটা আছে ও-পারে। শ্রীবাস মোড়ল করেছে।

আজ্ঞে হ্যাঁ, আমারও ইচ্ছে, একখানা দোকান করি। লোকও তো কের্‌মে কের্‌মে বাড়ছে। আর চিবাস আপনার গলা কেটে লাভ করে। দরে তো চড়া পাবান না, মারে ওজনে। সেরকরা আধপো ওজন কম। দু-রকম বাটখারা রাখে আজ্ঞে। ধান-চাল নেয় যে বাটখাড়ায় সেটা আবার সের-করা আধপো বেশী।

অমল এবার বলিল, সেই মতলবে তুমিও দোকান করতে চাও, কেমন?

আজ্ঞে না। এই আপনাদের চরণে হাত দিয়ে আমি বলতে পারি আজ্ঞে। ও-রকম পয়সা আমার গোরক্ত ব্রহ্মরক্তের সমান। আমি আপনার ষোল-আনার ওজন দেব, ষোল-আনা পয়সা নেব-বলিয়া সে বুড়ো আঙুলটি একত্র করিয়া ওজন করিবার ভঙ্গিতে ডান হাতখানি তুলিয়া ধরিল যেন সে এখনই ওজন করিতেছে। অমল অহীন্দ্র উভয়েই সে ভঙ্গি দেখাইয়া হাসিয়া ফেলিল।

ও-দিকে সাঁওতাল মেয়েগুলির কলরবের ভষা স্পষ্ট শোনা যাইতেছে, কিন্তু এখনও বুঝা যাইতেছে না। একে একে কথা কহিতে উহারা জানে না। একসঙ্গে পাখীর ঝাঁকের মত কলরব করে। অহীন্দ্র ঠিকাদারকে বলিল, যাও যাও, তোমার নৌকা এসে পড়ল।

পিছন ফিরিয়া নৌকাখানার দিকে চাহিয়া ঠিকাদার বলিল, সব মাঝিন, একজনাও যাত্রী নাই। খেয়াটাই লোকসান। বলিতে বলিতে সে অকস্মাৎ ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, জ্বালালে রে বাবা, ঘাট দুটো কেটে, ঝুড়ি কতক মাটি ফেলে দিয়ে মনে করছে মাথা কিনেছে সব। এই মেঝেন এই। তোরা কি ভেবেছিস বল তো? এমন করে দল বেঁধে আসবার তোদের কথা ছিল নাকি?

ঘাটে নামিয়াই সারি ঠিকাদারের সঙ্গে প্রায় ঝগড়া বাঁধাইয়া তুলিল। সে বলিল, আসবো না কেনে। আমরা যি পাড়াসুদ্ধ তিন দিন খেটে দিলম; ই-দিগের ঘাট, উ-পারের ঘাট ভাল করে দিলম। সারীর পিছনে দলসুদ্ধ মেয়েরা তাহাদের আপনাদের ভাষায় কলরব করিয়া সারীকে সমর্থন করিতে লাগিল।

ঠিকাদার বলিল, তাই বলে একসঙ্গে দল বেঁধে আসবি নাকি? এ-খেয়াতে একটা পয়সা নাই। কি, কাজ কি তোদের? এত ঝাঁটা-ঝুড়ি নিয়ে যাবি কোথা সব?

বেঁচতে যাব। ডাওর করল, ঘরকে ধান নাই, চাল নাই, খাব কি আমরা?

প্রত্যেকের হাতেই ঝাঁটা ও ঝুড়ির বোঝা। নানান ধরনের ঝাঁটা, ছোট বড় নানা ধরণের। ঝাঁটাগুলি বাঁধনের ছাঁদও বিচিত্র। ঝুড়িগুলিও সুন্দর এবং নানা আকারের।

ঠিকাদার এবার ঝগড়ার সুর ছাড়িয়া মোলায়েম সুরে বলিল, বেশ, কই, আমাকে খান কয়েক ঝাঁটা দিয়ে যা দেখি।

পোয়সা, পোয়সা দে। সারী হাত পাতিয়া দাঁড়াইল।

ঠিকাদার কিছুক্ষণ বিচিত্র ভঙ্গিতে নীরবে বর্বর মেয়েগুলির মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, তার পর বলিল, আচ্ছা, যা। তারপর আবার পার কেমন করে হোস, তা দেখব আমি। বলে সেই, লায়ে পেরিয়ে লায়েকে বলে শালা, সেই বিত্তান্ত।

সারী তাহার এই ভীতিপ্রদর্শনকে গ্রাহ্যও করিল না। ঘাট হইতে উঠিয়া একেবারে অহীন্দ্র ও অমলের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার পিছনে পিছনে মেয়ের দল। আর তাহাদের মুখে কলরব নাই, চোখে মুগ্ধ বিস্ময়ভরা দৃষ্টি, মুখে স্মিত সলজ্জ হাসি। পরস্পরের গলায় হাত রাখিয়া ঈষৎ বঙ্কিম ভঙ্গিতে সারি বাঁধিয়া দাঁড়াইয়াছে, এমনি ভঙ্গিতেই দাঁড়ানো উহাদের অভ্যাস। পথ চলে, তাও এমনি ভাবে এ উহার গলা ধরিয়া বঙ্কিম ছন্দে হেলিয়া দুলিয়া চলে।

অমল মুগ্ধ হইয়া গেল, বলিল, বিউটিফুল! মনে হচ্ছে অজন্তা অথবা কোন প্রাচীনযুগের গুহার প্রাচীরচিত্র যেন মূর্তি ধরিয়া বেরিয়ে এল।

মৃদু হাসিয়া বলিল, কি রে, কোথায় যাবি সব দল বেঁধে?

সারী বলিল-আপোনার কাছে এলাম গো। আমরা আজ সব শিকার করলম, তাই আনলম দুটো সুসুরে-উই যি, তোরা কি বুলিস গো?

পিছন হইতে তিন চার জন কলরব করিয়া উঠিল, খোরগোশ, খোরগোশ।

রক্তাক্ত খরগোশ দুইটা অহীন্দ্র ও অমলের সম্মুখে ফেলিয়া দিয়া সারী বলিল, হুঁ, খোরগোশ আনলাম আপনার লেগে গো।

একটা খরগোশের মাথা স্থুল-ফলা তীরের আঘাতে একেবারে ভাঙিয়া দুইখানা হইয়া গিয়াছে, অন্যটার বুকে একটা গভীর ক্ষত, সে ক্ষত হইতে এখনও অল্প অল্প রক্ত ঝরিয়া পড়িতেছে।

অহীন্দ্র একটা অদ্ভুত স্থিরদৃষ্টিতে রক্তাক্ত পশু দুইটির দিকে চাহিয়া রহিল। এমন রক্তাক্ত দৃশ্যের আবির্ভাবের আকস্মিকতায় সে যেন স্তব্ধ হইয়া গেল। অমল একটা খরগোশের লেজ ধরিয়া তুলিয়া বলিল, এত বড় খরগোশ এখানে পাওয়া যায়?

হেঁ গো, অনেক রইয়েছে আমাদের চরে। ভারী খারাপ করছে সব। ভুট্টা বরবটি গাছপালার ডালগুলি কেটে কেটে খেয়ে নিচ্ছে। -একা সারী নয়, পাঁচ-ছয়জনে একসঙ্গে বলিয়া উঠিল। নিজ হইতে বলিবার মত কথা উহারা ভাবিয়া পায় না, প্রশ্নের উত্তরে কথা বলিবার সুযোগ পাইলেই সকলেই কথা বলিবার জন্য কলরব করিয়া উঠে।

অমল উৎসাহিত হইয়া উঠিল, সে অহীন্দ্রকে ঠেলা দিয়া বলিল, চল, কাল চরে শিকার করে আসি। বলিতে বলিতে অহীন্দ্রের মুখের দিকে চাহিয়া বিস্মিত হইয়া গেল; অহীন্দ্রের উজ্জ্বল গৌরবর্ণের মুখ কাগজের মত সাদা হইয়া গিয়াছে, চোখ জলে ভরিয়া উঠিয়াছে, স্বচ্ছ অশ্রুজলতলে পিঙ্গল তারা দুইটি আসন্নমৃত্যু প্রাবাল-কীটের মত থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। অমল শঙ্কিত হইয়া বলিল, এ কি, কি হল তোমার?

অহীন্দ্রের ঠোঁট দুইটি কাঁপিয়া উঠিল, সে বলিল, ও দুটো সরাও ভাই সামনে থেকে। ও বীভৎস দৃশ্য আমি সইতে পারি না।

অমল খরগোশ দুইটা তুলিয়া লইতে ইঙ্গিত করিয়া বলিল, বাবুর বাড়িতে দিগে যা।

অহীন্দ্র শিহরিয়া উঠিল, না না না। মা দেখলে সমস্ত দিন ধরে কাঁদবেন।

অমল নির্বাক হইয়া গেল, এমন ধারার কথা সে যেন কখনও শোনে নাই। সম্মুখে সমবেত কালো মেয়েগুলির মুখের স্মিত হাসিও মিলাইয়া গেল, অপরাধীর মত সঙ্কুচিত শুষ্কমুখে নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। কিছুক্ষণ পর সারী কুণ্ঠিতভাবে বলিল, হ্যাঁ বাবু, খাবি না তবে খোরগোশ? আমরা আনলাম আপনার লেগে।

অহীন্দ্র খানিকটা আত্মসম্বরণ করিয়া লইয়াছিল, এতক্ষণে সে ম্লান হাসি হাসিয়া বলিল, বাবুর বাড়িতে দিগে যা। জানিস তো ছোট রায় মহাশয়ের বাড়ি? ইনি ছোট রায় মহাশয়ের ছেলে।

মেয়েগুলি আপনাদের ভাষায় মৃদুস্বরে কলরব করিয়া অমলকে লইয়া আলোচনা জুড়িয়া দিল। অমল অহীন্দ্রের কথায় প্রতিবাদ করিয়া বলিল, না, না, ওরা ওদুটো নিয়ে যাক।

অহীন্দ্র বলিল, না, তাতে ওরা দুঃখ পাবে। তোমাদের বাড়িতেই দিয়ে যাক।

বেশ, তা হলে তোমাকেও আমাদের ওখানে খেতে হবে।

খাব।

হাসিয়া অমল বলিল, তা হলে তুমি জাপানী বৌদ্ধ।

অহীন্দ্র এবার অল্প একটু হাসিল, হাসিয়া বলিল, দিনে না রাত্রে খাব কিন্তু; দিনে রান্না করতেও দেরিও হবে। আর মায়ের রান্নাবান্না বোধহয় হয়েই গেছে।

মেয়েগুলি কথা না বুঝিয়াও এতক্ষণে অকারণে হাসিয়া উৎফুল্ল এবং সহজ হইয়া উঠিল। সারী বলিল, তাই দিব তবে রায় মহাশয়ের বাড়িতে রাঙাবাবু?

হ্যাঁ।

মেয়ের দল কলরব করিতে করিতে চলিয়া গেল। অমল বলিল, চল তা হলে আমরাও যাই।

ঘাটের ঠিকাদার ঠিক সময়ে কখন আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল, সে জোড়হাত করিয়া বলিল, বাবু তা হলে আমার আরজির কথাটা মনে রাখবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *