কালিন্দী – ১৭

১৭

মামলার রায় বাহির হইল আরও আট মাস পর। দীর্ঘ দুই বৎসর ধরিয়া মকদ্দমা। দায়রা-আদালতের বিচারে দাঙ্গা ও নরহত্যার অপরাধে নবীন বাগদী ও তাহার সহচর দুইজন বাগদীর কঠিন সাজা হইয়া গেল। নবীনের প্রতি শাস্তিবিধান হইল ছয় বৎসর দ্বীপান্তর বাসের; আর তাহার সহচর দুইজনের প্রতি হইল দুই বৎসর করিয়া সশ্রম কারাবাসের আদেশ। দায়রা মকদ্দমা; সাক্ষীর সংখ্যা একশতের অধিক; তাহাদের বিবৃতি, জেরা এবং দীর্ঘ বিবৃতি ও জেরা বিশ্লেষণ করিয়া উভয় পক্ষের উকিলের সওয়াল-জবাবে শেষ হইতে দীর্ঘদিন লাগিয়া গেল। দাঙ্গা ঘটিবার দিন হইতে প্রায় দুই বৎসর।

রায় বাহির হইবার দিন গ্রামের অনেক লোকই সদরে গিয়া হাজির হইল। নবীন বাগদীর সংসারে উপযুক্ত পুরুষ কেহ ছিল না। তাহার উপযুক্ত পুত্র মারা গিয়েছে। থাকিবার মধ্যে আছে এক নাবালক পৌত্র, পুত্রবধু ও তাহার স্ত্রী মতি বাগদিনী। মতি নিজেই সেদিন পৌত্রকে কোলে করিয়া সদরে গিয়া হাজির হইল। রংলাল কিন্তু যাইতে পারিল না; অনেক দিন হইতেই সে গ্রামের বাহির হওয়া ছাড়িয়া দিয়াছে। অতি প্রয়োজনে বাহির যখন হয়, তখন সে মাথা হেঁট করিয়াই চলে; সদর-রাস্তা ছাড়িয়া জনবিরল পথ বাছিয়া চলে। আজ সে বাড়ির ভিতর দাওয়ার উপর গুম হইয়া বসিয়া রহিল। তাহার স্ত্রী বলিল, হ্যাঁ গো, বলি সকালবেলা থেকে বসলে যে? আলুগুলো তুলে না ফেললে আর তুলবে কবে? কোন দিন জল হবে, হলে আলু আর একটিও থাকবে না, সব পচে যাবে।

রংলাল বলিল, হুঁ।

হুঁ তো বলছ, কিন্তু রইলে যে সেই বসেই রাজা-রুজিরের মত! -বলিয়া রংলালের স্ত্রী ঈষৎ না হাসিয়া পারিল না।

অকস্মাৎ রংলাল অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া বলিয়া উঠিল, ভগমান! এত লোক মরছে, আমার মরণ হয় না কেনে, বল দেখি? সংসারের কচকচি আর আমি সইতে লারছি। -বলিতে বলিতে সে ঝরঝর কাঁদিয়া ফেলিল। তাহার স্ত্রী অবাক হইয়া গেল, সে কি যে বলিবে, খুঁজিয়া পর্যন্ত পাইল না; বুঝিতেও সে পারিল না, অকস্মাৎ সংসার কোন যন্ত্রণায় এমন করিয়া রংলালকে অধীর করিয়া তুলিল। দুঃখ অভিমানে তাহারও চোখ ফাটিয়া জল আসিতেছিল।

রংলাল কপালের রগ দুইটা আঙুল দিয়া চাপিয়া ধরিয়া বলিল, মাথা আমার খসে গেল। আমি আজ খাব না কিছু। -বলিয়া সে ঘরে গিয়া উপুর হইয়া মেঝের উপুড় শুইয়া পড়িল।

আরও একজন অধীর উৎকণ্ঠায় উদ্বেগে ও অসহ্য মনঃপীড়ায় পীড়িত হইতেছিলেন। অতি কোমল হৃদয়ের স্বভাবধর্ম-অতি মমতায়, সুনীতি এখন হইতেই নবীন ও তাহার সহচর কয়জনের জন্য গভীর বেদনা অনুভব করিতেছিলেন। উৎকণ্ঠায় উদ্বেগে তাঁহার দেহমন যেন সকল শক্তি হারাইয়া ফেলিয়াছে। উনানে একটা তরকারী চড়াইয়া সুনীতি ভাবিতেছিলেন ওই কথাই। সোরগোল তুলিয়া মানদা আসিয়া বলিল, পোড়া পোড়া গন্ধ উঠছে যে গো! আপনি বসে এইখানে, আর তরকারী পুড়ছে। আমি বলি, মা বুঝি ওপরে গিয়েছেন। নামান, নামান, নামান।

এতক্ষণে সচকিত হইয়া সুনীতি গন্ধের কটুত্ব অনুভব করিয়া ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। চারিপাশে চাপিয়া দেখিয়া বলিলেন, ওই যা, সাঁড়াশিটা আবার আনি নি। আন তো মানদা।

মানদা অল্প বিরক্ত হইয়াই বলিল, ওই যে সাঁড়াশি-ওই যে গো বাঁ হাতের নীচেই যে গো।

সুনীতি এবার দেখিতে পাইলেন, সাঁড়াশিটার উপরেই বাঁ হাত রাখিয়া তিনি বসিয়া আছেন। তাড়াতাড়ি তিনি কড়াটা নামাইয়া ফেলিলেন, কিন্তু হাতেও যেন কেমন সহজ শক্তি নাই, হাতখানা থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। মানদার সতর্ক দৃষ্টিতে সেটুকু এড়াইয়া গেল না, সে এবার উৎকণ্ঠিত হইয়া বলিয়া উঠিল, কর্তাবাবু আজ কেমন আছেন মা?

ম্লান হাসিয়া সুনীতি বলিলেন, তেমনিই আছেন।

বাড়ে নাই তো কিছু, তাই জিজ্ঞাসা করছি।

না। কদিন থেকে বরং একটু শান্ত হয়েই আছেন।

তবে?-মানদা আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিল।

সুনীতিও এবার বিস্ময়ের সহিত বলিলেন, কি রে? কি বলছিস তুই?

মানদা বলিল, এমন মাটির পিতিমের মত বসে রয়েছেন যে?

গভীর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া সুনীতি বলিলেন, নবীনদের মামলায় আজ রায় বেরুবে মানদা। কি হবে বল তো ওদের? যদি সাজা হয়ে যায়-! আর তিনি বলিতে পারিলেন না, তাঁহার রক্তাভ পাতলা ঠোঁট দুইটি বিবর্ণ হইয়া থরথর করিয়া কাঁপিতে আরম্ভ করিল, কোমল দৃষ্টিতে চোখ দুইটি জলে ভাসিয়া বেদনায় যুগ্ম-সায়রের মত টলমল করিয়া উঠিল।

মানদাও একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস না ফেলিয়া পারিল না। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া সে বলিল, সে আর আপনি-আমি কি করব বলুন? মানুষের আপন আপন অদেষ্ট; অদেষ্টর লেখন কি কেউ মুছতে পারে মা?

অসহায় মানুষের মামুলী সান্তনা ছাড়া আর মানদা খুঁজিয়া কিছু পাইল না; কিন্তু সুনীতির হৃদয়ের পরম অকৃত্রিম মমতা চিরদিনের মতই আজও তাহাতে প্রবোধ মানিল না। জলভরা চোখে উদাস দৃষ্টিতে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে তিনি বলিলেন, মানুষ মরে যায়, বুঝতে পারি মানদা-তাতে মানুষের হাত নেই। কিন্তু এ কি দুঃখ বল তো? এক টুকরো জমির জন্যে মানুষে মানুষে খুন করে ফেললে, আর তারই জন্যে, যে খুন করলে তাকে রেখে দেবে খাঁচায় পুরে জানোয়ারের মত, কিম্বা হয়তো গলায় ফাঁসি লটকে-! কথা আর শেষ হইল না, চোখের জলের সমুদ্র সর্বহৃদয়ব্যাপী প্রগাঢ় বেদনায় অমাবস্যা-স্পর্শে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল-হু হু করিয়া চোখের জল ঝরিয়া মুখ-বুক ভাসাইয়া দিল।

মানদার চোখও শুষ্ক রহিল না, তাহারও চোখের কোণ ভিজিয়া উঠিল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া, সে আক্রোশভরা কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, তুমি ভেবো না মা, ভগবান এর বিচার করবেনই করবেন। গায়ে আগুন লাগবে, নিব্বংশ হবে-

বাধা দিয়া সুনীতি বলিলেন, না না মানদা, শাপ-শাপান্ত করিস নে মা। কত বার তোকে বারণ করেছি, বল তো?

মানদা এবার সুনীতির উপরেই রুষ্ট হইয়া উঠিল; সুনীতির এই কোমলতা সে কোনমতেই সহ্য করিতে পারে না। ক্রোধ নাই, আক্রোশ নাই, এ কি ধারার মানুষ। সে রুষ্ট হইয়াই সে স্থান হইতে অন্যত্র সরিয়া গেল।

সুনীতি বেদনাহত অন্তরেই আবার রান্নার কাজে ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। রামেশ্বরের স্নান-আহারের সময় হইয়া আসিয়াছে। সেই ঘটনার পর হইতে রামেশ্বর আরও স্তব্ধ হইয়া গিয়াছেন; পূর্বে আপন মনেই অন্ধকার ঘরে কাব্য আবৃত্তি করিতেন, ঘরের মধ্যে পায়চারিও করিতেন, কিন্তু অধিকাংশ সময়ই স্তব্ধ হইয়া ওই খাটখানির উপর বসিয়া থাকেন, আর প্রদীপের আলোয় হাতের আঙুলগুলি ঘুরাইয়া দেখেন। কখনও কখনও সুনীতির সহিত কথার আনন্দের মধ্যে খাট হইতে নামিতে চাহেন, সুনীতি হাত ধরিয়া নামিতে সাহায্য করেন। অন্ধকার রাত্রে জানালার ধারে দাঁড়াইয়া অতি সন্তর্পণে মুক্ত পৃথিবীর সহিত অতি গোপন এবং ক্ষীণ একটি যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করেন। আপনার দুর্ভাগ্যের কথা মনে করিয়া সুনীতি ম্লান হাসি হাসেন, তখন চোখে তাঁহার জল আসে না।

পিতলের ছোট একটা হাঁড়িতে মুঠাখানেক সুগন্ধি চাল চড়াইয়া দিয়া স্বামীর স্নানের উদ্যোগ করিতে সুনীতি উঠিয়া পড়িলেন। এই বিশেষ চালটি ছাড়া অন্য চাল রামেশ্বর খাইতে পারেন না।

অপরাহ্নের দিকে সুনীতির মনের উদ্বেগ ক্রমশ যেন বাড়িয়াই চলিয়াছিল; সংবাদ পাইবার জন্য তাঁহার মন অস্থির হইয়া উঠিল। অন্য দিন খাওয়া-দাওয়ার পর তিনি স্বামীর নিকট বসিয়া গল্পগুজবে তাঁহার অস্বাভাবিক জীবনের মধ্যে সাময়িকভাবে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরাইয়া আনিবার চেষ্টা করেন; কোন কোন দিন রামায়ণ বা মহাভারত পড়িয়া শুনাইয়া থাকেন। আজ কিন্তু আর সেখানেও স্থির হইয়া বসিয়া থাকিতে পারিলেন না। আজ তিনি বই লইয়াই বসিয়া ছিলেন, কিন্তু পাঠের মধ্যে পাঠকের অন্তরে যে তন্ময়যোগ থাকিলে শ্রোতার অন্তরকেও তন্ময়তায় বিভোর করিয়া আকর্ষণ করা যায়, আপন অন্তরের সেই তন্ময়যোগটিকে তিনি আজ আর কোনমতেই স্থাপন করিতে পারিলেন না।

একটা ছেদের মুখে আসিয়া সুনীতি থামিতেই রামেশ্বর বলিলেন, তুমি যদি সংস্কৃতটা শিখতে সুনীতি, তোমার মুখে মূল মহাকাব্য শুনতে পেতাম। অনুবাদ কিনা, এতে কাব্যের আনন্দটা পাওয়া যায় না।

সুনীতি অপরাধিনীর মত স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, আজ তা হলে এই পর্যন্তই থাক।

রামেশ্বর অভ্যাসমত মৃদুস্বরে বলিলেন, থাক। তারপর মাটির পুতুলের মত নিস্পলক দৃষ্টিতে চাহিয়া বসিয়া রহিলেন। সুনীতি একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন। রামেশ্বর সহসা বলিলেন, অহীন-অহীন কোথায় পড়ে, বল তো?

বহরমপুর মুরশিদাবাদে। এই যে কাল তুমি মুরশিদাবাদের গল্প করলে, বললে অহীন খুব ভাল জায়গায় আছে; আমাদের দেশের ইতিহাস মুরশিদাবাদ না দেখলে জানাই হয় না!

হ্যাঁ হ্যাঁ। রামেশ্বরের এবার মনে পড়িয়া গেল। সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়িতে নাড়িতে বলিলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ। জান সুনীতি, এই-

বল।

এই, মানুষের সকলের চেয়ে বড় অপরাধ হল মানুষকে হত্যা করার অপরাধ। এ অপরাধ কখনও ভগবান ক্ষমা করবেন না। মুরশিদাবাদের চারিদিকে সেই অপরাধের চিহ্ন। আর সেই হল তার পতনের কারণ। উঃ, ফৈজীকে নবাব দেওয়াল গেঁথে মেরেছিল। একটা ছোট অন্ধকূপের মত ঘরে পুরে দরজাটা তার গেঁথে দিয়েছিল। কী করেই ফৈজীকে মেরেছিল-উঃ! রামেশ্বর চঞ্চল হইয়া উঠিলেন- হে ভগবান! হে ভগবান!

সুনীতির চোখ সজল হইয়া উঠিল, নীরবে নতমুখে বসিয়া থাকার সুযোগে সে-জল চোখ হইতে মেঝের উপর ঝরিয়া পড়িতে আরম্ভ করিল। তাঁহার মনে পড়িতেছিল-ননী পালকে, হতভাগ্য হীন-তাঁহার মহীনকে-চরের দাঙ্গায় নিহত সেই অজানা অচেনা হতভাগ্যকে, হতভাগ্য মহীন ও তাহার সহচর কয়েকজনকে। তিনি গোপনে চোখ মুছিয়া ঘরের বাহিরে যাইবার জন্য উঠিলেন; একবার মানদাকে পাঠাইবেন সংবাদের জন্য।

রামেশ্বর ডাকিলেন, সুনীতি! কণ্ঠস্বর শুনিয়া সুনীতি চমকাইয়া উঠিলেন; রামেশ্বরের কণ্ঠস্বর বড় ম্লান, কাতরতার প্রকাশ তাহাতে সুস্পষ্ট।

সুনীতি উদ্বিগ্ন হইয়া ফিরিলেন, কি বলছ?

রামেশ্বর কাতর দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে চাহিয়া বলিলেন, দেখ। আমার-আমার শরীরটা-দেখ, আমাকে একটু শুইয়ে দেবে?

সযত্নে স্বামীকে শোয়াইয়া দিয়া সুনীতি উৎকণ্ঠিত চিত্তে বলিলেন, শরীর কি খারাপ বোধ হচ্ছে?

সে কথার জবাব না দিয়া রামেশ্বর বলিলেন, আমার গায়ে একখানা পাতলা চাদর টেনে দাও তো, আর ওই আলোটা, ওটাকে সরিয়ে দাও। -বলিতে বলিতেই তিনি উত্তেজিত হইয়া উঠিতেছিলেন, ঈষৎ উত্তেজিত স্বরেই এবার তিরস্কার করিয়া বলিলেন, তুমি জান আমার চোখে আলোর মধ্যে যন্ত্রণা হয়, তবু ওটা জ্বালিয়ে রাখবে দপদপ করে।

প্রতিবাদে ফল নাই, সুনীতি তাহা ভাল করিয়াই জানেন; তিনি নীরবে আলোটা কোণের দিকে সরাইয়া দিলেন, পাতলা একখানি চাদরে স্বামীর সর্বাঙ্গ ঢাকিয়া দিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। তাঁহার মন বার বার বাহিরের দিকে ছুটিয়া যাইতে চাহিতেছিল। ঘর হইতে বাহির হইয়া বারান্দায় দাঁড়াইয়া ডাকিলেন, মানদা!

মানদা দিবানিদ্রা শেষ করিয়া উঠোন ঝাঁট দিতেছিল, সে বলিল, কি মা?

একবার একটা কাজ করবি মা?

বলুন।

একবার পাড়ায় একটু বেরিয়ে জেনে আয় না মা, সদর থেকে খবর-টবর কিছু এসেছে কি না।

মানদা ঘাড় নাড়িয়া বলিল, এর মধ্যে কোথায় কে ফিরবে গো, আর ফিরবেই বা কেমন করে? ফিরতে সেই রাত আটটা-নটা।

সে-কথা সুনীতি নিজেও জানেন, তবুও বলিলেন, ওরে বার্তা আসে বাতাসের আগে। লোক কেউ না আসুক, খবর হয়তো এসেছে, দেখ না একবার। মায়ের কথা শুনলে তো পুণ্যিই হয়।

ঝাঁটাটা সেখানেই ফেলিয়া দিয়া মানদা বিরক্তিভরেই বাহির হইয়া গেল। সুনীতি স্তব্ধ হইয়া বারান্দায় দাঁড়াইয়া রহিলেন। সহসা তাঁহার মনে হইল, বাগদীপাড়ায় যদি কেহ কাঁদে, তবে সে কান্না তো ছাদের উপর হইতে শোনা যাইবে! কম্পিতপদে তিনি ছাদে উঠিয়া শূণ্য দৃষ্টিতে উৎকর্ণ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি স্বস্তির একটা গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিলেন, নাঃ, কেহ কাঁদে না। এতক্ষণে তাঁহার দৃষ্টি সজাগ হইয়া উঠিল। আপনাদের কাছারির সম্মুখে খামার বাড়ির দিকেই তিনি তাকাইয়াছিলেন; একটা লোক ধানের গোলার কাছে দাঁড়াইয়া কি করিতেছে! লোকটা তাঁহাদেরই গরুর মাহিন্দার; ভাল করিয়া দেখিয়া বুঝিলেন, খড়ের পাকানো মোটা ‘বড়’ দিয়া তৈয়ারি মরাইটার ভিতর একটা লাঠি গুঁজিয়া ছিদ্র করিয়া ধান চুরি করিতেছে। তিনি লজ্জিত হইয়া পড়িলেন, উপরে চোখ তুলিলেই সে তাঁহাকে দেখিতে পাইবে। অতি সন্তর্পণে সেদিক হইতে সরিয়া ছাদের ও-পাশে গিয়া দাঁড়াইলেন। গ্রামের ভাঙা তটভূমির কোলে কালীর বালুময় বুক চৈত্রের অপরাহ্নে উদাস হইয়া উঠিয়াছে। কালীর ও-পারে চর, সর্বনাশা চর! কিন্তু চরখানি আজ তাঁহার চোখ জুড়াইয়া দিল। চৈত্রের প্রারম্ভে কচি কচি বেনাঘাসের পাতা বাহির হইয়া চরটাকে যেন সবুজ মখমলের মত মুড়িয়া দিয়াছে। হালকা সবুজের মধ্যে সাঁওতালদের পল্লীটির গোবরে-মাটিতে নিকানো, খড়িমাটির আলপনা দেওয়া ঘরগুলি যেন ছবির মত সুন্দর। উঃ, পল্লীটি ইহার মধ্যে কত বড় হইয়া উঠিয়াছে! সম্পূর্ণ একখানি গ্রাম। পল্লীর মধ্য দিয়া বেশ একটি সুন্দর পথ; সবুজের মধ্যে শুভ্র একটি আঁকা-বাঁকা রেখা, নদীর কূল হইতে সাঁওতাল পল্লী পার হইয়া প্রান্তরের মধ্য দিয়া ও-পারের গ্রামের ঘর বনরেখার মধ্যে মিশিয়া গিয়াছে। সাঁওতালদের পল্লীর আশেপাশে কতকগুলি কিশোর গাছে নূতন পাতা দেখা দিয়াছে। চোখ যেন তাহার জুড়াইয়া গেল। তবুও তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস না ফেলিয়া পারিলেন না। এমন সুন্দর চর, এমন কোমল-এখান হইতেই সে কোমলতা তিনি যেন অনুভব করিতেছেন-তাহাকে লইয়া এমন হানাহানি কেন করে মানুষ? আর, কোথায়-চরটায় কোন্‌ অন্তস্তলে লুকাইয়া আছে এমন সর্বনাশা চক্রান্ত?

নীচ হইতে মানদা ডাকিতেছিল, সুনীতি ত্রস্ত হইয়া দোতালার বারান্দায় নামিয়া আসিলেন। নীচের উঠান হইতে মানদা বলিল, এক-এক সময় আপনি ছেলেমানুষের মত অবুঝ হয়ে পড়েন মা। বললাম, রাত আটটা-নটার আগে কেউ ফিরবে না আর না ফিরলে খবর আসবে না। টেলিগিরাপ তো নাই মা আপনার শ্বশুরের গাঁয়ে যে, তারে তারে খবর আসবে!

সুনীতি!-ঘরের ভিতর হইতে রামেশ্বর ডাকিতেছিলেন। শান্ত মনেই সুনীতি ঘরের ভিতরে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, রামেশ্বর বালিসে ঠেস দিয়া অর্ধশায়িতের মত বসিয়া আছেন, সুনীতিকে দেখিয়া স্বাভাবিক শান্ত কণ্ঠেই বলিলেন, অহীনকে লিখে দাও তো, রবীন্দ্রনাথ বলে যে বাংলা ভাষার কবি তাঁর কাব্যগ্রন্থ যেন সে নিয়ে আসে। তা হলে তুমি পড়বে, তাতে কাব্যের রস পুরোটাই পাওয়া যাবে। হ্যাঁ, আর যদি কাদম্বরীর অনুবাদ থাকে, বুঝলে?

সংবাদ যথাসময়ে আসিল এবং শ্রীবাস ও মজুমদারের কল্যানে উচ্চরবেই তাহা তৎক্ষণাৎ রীতিমত ঘোষিত হইয়া প্রচারিত হইয়া গেল। সেই রাত্রেই সর্বরক্ষা-দেবীর স্থানে পূজা দিবার অছিলায় গ্রামের পথে পথে তাহারা ঢাক ঢোল লইয়া বাহির হইল। ইন্দ্র রায়ের কাছারিতে রায় গম্ভীর মুখে দাঁড়াইয়া ছিলেন। তাঁহার কাছারির সম্মুখে শোভাযাত্রাটি আসিবামাত্র তিনি হাসিমুখে অগ্রসর হইয়া আসিয়া পথের উপরেই দাঁড়াইলেন।

শোভাযাত্রাটির গতি স্তব্ধ হইয়া গেল।

রায় বলিলেন, এ আমি জানতাম মজুমদার! তারপর, নবেনটাকে দিলে লটকে?

মজুমদার বিনীত হাসি হাসিয়া বলিল, আজ্ঞে না, নবীনের ছ বছর দ্বীপান্তর হল, আর দুজনের দু বছর করে জেল।

রায় হাসিয়া বলিলেন, তবে আর করলে কি হে? এস এস একবার ভেতরেই এস, শুনি বিবরণ; কই শ্রীবাস কই? এস পাল, এস।

কৃত্রিম শ্রদ্ধার সমাদরের আহ্বানে শ্রীবাস ও মজুমদার উভয়েই শুকাইয়া গেল। সভয়ে মজুমদার বলিল, আজ্ঞে, আজ মাপ করুন, পূজো দিতে যাচ্ছি।

ঢাক বাজিয়ে পুজা দিতে যাচ্ছ, কিন্তু বলি কই হে? চরে বলি হয়ে গেল, আর মা সর্বরক্ষার ওখানে বলি দেবে না? মায়ের জিভ যে লকলক করছে, আমি দিব্যচক্ষে দেখছি।

মজুমদার ও শ্রীবাসের মুখ মুহূর্তে বিবর্ণ হইয়া গেল। সমস্ত বাজনাদার ও অনুচরের দল সভয়ে শ্বাসরোধ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। রায় আর দাঁড়াইলেন না, তিনি আবার একবার মৃদু হাসিয়া ছোট একটি ‘আচ্ছা’ বলিয়া কাছারির ফটকের মধ্যে প্রবেশ করিলেন।

কিছুক্ষণ পর স্তব্ধ শ্রীবাস ও যোগেশ মজুমদার অনুভব করিল, আলো যেন কমিয়া আসিতেছে। পিছনে ফিরিয়া মজুমদার দেখিল, শ্রীবাসের হাতের আলোটি ছাড়া আর একটিও আলো নাই, বাজনদার অনুচর সকলেই কখন নিঃশব্দে চলিয়া গিয়াছে।

ওদিকে চক্রবর্তী-বাড়িতে সুনীতি স্তব্ধ হইয়া দাওয়ার উপর বসিয়াছিলেন, চোখ দিয়া জল ঝরিতেছিল অন্ধকারের আবরণের মধ্যে। তাঁহার সম্মুখে নাতিকে কোলে করিয়া দাঁড়াইয়া নবীনের স্ত্রী। সেও নিঃশব্দে কাঁদিতেছিল। বহুক্ষণ পরে সে বলিল, সদরে সব বললে হাইকোর্টে দরখাস্ত দিতে।

সুনীতি কোনমতে আত্মসম্বরণ করিয়া বলিলেন, দরখাস্ত নয়, আপীল।

খালাস যদি না হয় রাণীমা, তবে আপনকারা ছাড়া আমরা তো কাউকে জানি না।

কিন্তু খরচ যে অনেক মা; সে কি তোরা যোগাড় করতে পারবি?

নবীনের স্ত্রী চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। সুনীতি খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, তাও পরামর্শ করে দেখব বাগদী-বউ; অহীন আসুক, আর পাঁচ-সাত দিনেই তার পরীক্ষা শেষ হবে, হলেই সে আসবে।

মতি বাগদিনী ভূমিষ্ট হইয়া প্রণাম করিয়া বলিল, আপনকারা তাকে কাজে জবাব দিয়েছিলেন; কিন্তু আমাকে যে আপুনি না রাখলে কেউ রাখবার নাই রাণীমা।

* * *

অহীন্দ্র বাড়ি আসিতেই সুনীতি তাহাকে ইন্দ্র রায়ের নিকট পাঠাইলেন। মনে গোপন সঙ্কল্প ছিল, চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকায় হইলে আপনার অবশিষ্ট অলঙ্কার হইতেও কিছু বিক্রয় করিয়া খরচ সংস্থান করিয়া দিবেন। কিন্তু রায় নিষেধ করিলেন, বলিলেন, খরচ অনেক, শতকের মধ্যেও কুলোবে না বাবা। তা ছাড়া-, অকস্মাৎ তিনি হাসিয়া বলিলেন, তোমরা আজকালকার, কি বলে, ইয়ংমেন, তোমরা ভাববে, আমরা প্রাচীন কালের দানব সব; কিন্তু আমরা বলি কি, জান? ছ বছর জেল খাটতে নবীনের মত লাঠিয়ালের কোন কষ্টই হবে না। বংশানুক্রমে ওদের এ-সব অভ্যাস আছে।

অহীন্দ্র চুপ করিয়া রহিল। রায় হাসিয়া বলিলেন, তুমি তো চুপ করে রইলে। কিন্তু অমল হলে একচোট বক্তৃতাই দিয়ে দিত আমাকে। এখন একজামিন কেমন দিলে, বল?

এবার স্মিতমুখে অহীন্দ্র বলিল, ভালই দিয়েছি আপনার আশীর্বাদে। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া রায় বলিলেন, আশীর্বাদ তোমাকে বার বার করি অহীন্দ্র। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়-

অহীন্দ্র কথাটা সমাপ্তির জন্য প্রতীক্ষা করিয়া রহিল। রায় বলিলেন, তোমার বাবাকে এবার কেমন দেখলে বলো তো?

ম্লান কণ্ঠে অহীন্দ্র বলিল, আমি তো দেখছি, মাথার গোলমাল বেড়েছে।

রায় কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, যাও, বাড়ির ভেতর যাও, তোমার- মানে, অমলের মা এরই মধ্যে চার-পাঁচ দিন তোমার নাম করেছেন।

অহীন্দ্রকে বাড়ির মধ্যে দেখিয়া হেমাঙ্গিনী আনন্দে যেন অধীর হইয়া উঠিলেন। অহীন্দ্র প্রণাম করিতেই উজ্জ্বল মুখে প্রশ্ন করিলেন, পরীক্ষা কেমন দিলে বাবা?

ভালই দিয়েছি মামীমা, আপনার আশীর্বাদে।

অমল কি লিখেছে জান? সে লিখেছে অহীনের এবার ফার্স্ট হওয়া উচিত।

অহীন্দ্র হাসিয়া বলিল, সে আমাকেও লিখেছে। সে তো এবার ছুটিতে আসছে না লিখেছে।

না। সে এক ধন্যি ছেলে হয়েছে বাবা। তাদের কলেজের ছেলেরা দল বেঁধে কোথায় বেড়াতে যাবে, তিনি সেই হুজুগে মেতেছেন। তার জন্য উমার এবার আসা হল না।

কিন্তু অকস্মাৎ একদিন অমল আসিয়া হাজির হইল। আষাঢ়ের প্রথমেই ঘনঘটাচ্ছন্ন মেঘ করিয়া বর্ষা নামিয়াছিল, সেই বর্ষা মাথায় করিয়া গভীর রাত্রে স্টেশন হইতে গরুর গাড়ি করিয়া একেবারে অহীন্দ্রদের দরজায় আসিয়া সে ডাক দিল, অহীন! অহীন!

ঝড় ও বর্ষণের সেদিন সে এক অদ্ভুত গোঙানি! সন্ধ্যার পর হইতেই এই গোঙানিটা শোনা যাইতেছে। অহীন্দ্র ঘুম ভাঙিয়া কান পাতিয়া শুনিল, সত্যই কে তাহাকে ডাকিতেছে!

সে জানলা খুলিয়া প্রশ্ন করিল, কে?

আমি অমল। ভিজে মরে গেলাম, আর তুমি বেশ আরামে ঘুমোচ্ছ? বাঃ, বেশ!

তাড়াতাড়ি দরজা খুলিয়া সে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, তুমি এমনভাবে?

অমল অহীন্দ্রের হাতে ঝাঁকুনি দিয়া বলিল, কনগ্রাচুলেশন্‌স! তুমি ফোর্থ হয়েছ।

অহীন্দ্র সর্বাঙ্গসিক্ত অমলকে আনন্দে কৃতজ্ঞতায় বুকে জড়াইয়া ধরিল। শব্দ শুনিয়া সুনীতি উঠিয়া বাহিরে আসিলেন, সমস্ত শুনিয়া নির্বাক হইয়া তিনি দাঁড়াইয়া রহিলেন। চোখ তাঁহার জলে ভরিয়া উঠিয়াছে। চোখ যেন তাঁহার সমুদ্র, আনন্দের পুর্ণিমায়, বেদনার আমবস্যায় সমানই উথলিয়া উঠে।

অহীন্দ্র বলিল, অমলকে খেতে দাও মা।

সুনীতি ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। কিন্তু অমল বলিল, না পিসীমা, স্টেশনে এক পেট খেয়েছি। এখন যদি আবার খাওয়ান তবে সেটা সাজা দেওয়া হবে। বরং চা এক পেয়ালা করে দিন। আয় অহীন, আলোটা আন তো, ব্যাগ থেকে কাপড়-জামা বের করে পাল্‌টে ফেলি। বাড়ি আর যাব না রাত্রে, কাল সকালে যাব।

চা করিয়া খাওয়াইয়া অহীন্দ্র ও অমলকে শোয়াইয়া আনন্দ-অধীর চিত্তে সুনীতি স্বামীর ঘরে প্রবেশ করিলেন। রামেশ্বর খোলা জানলায় দাঁড়াইয়া বাহিরের দুর্যোগের দিকে চাহিলেন, ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকিয়া উঠিতেছে, কিন্তু সে তীব্র আলোকের মধ্যেও নিস্পলক দৃষ্টিতে চাহিয়া আছেন। বিদ্যুৎ-চমকের আলোকে সুনীতি দেখিলেন, গ্রামের প্রান্তে প্রান্তে কালীর বুক জুড়িয়া বিপুলবিস্তার একখানা সাদা চাদর কে যেন বিছাইয়া দিয়াছে। ঝড় ও বর্ষণের মধ্যে যে অদ্ভুত গোঙানি শোনা যাইতেছে, সেটা ঝড়ের নয়, বর্ষণের নয়, কালীর ক্রুদ্ধ গর্জন। কালীর বুকে বন্যা আসিয়াছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *