কালিন্দী – ১৬

১৬

সেই বন্দোবস্তই হল।

অহীন্দ্র কলেজ কামাই করিয়াই আসিল। সুনীতি অহীন্দ্রকে লইয়া একটু শঙ্কিত ছিলেন। রামেশ্বরের সন্তান, মহীর ভাই সে। অহীন্দ্র কিন্তু হাসিয়া বলিল, এর জন্যে তুমি এমন লজ্জা পাচ্ছ কেন মা? এ-সংসারের সত্যকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করা প্রত্যেক মানুষের ধর্ম, এতে রাজা-প্রজা নেই, ধনী-দরিদ্র নেই। বিচারক মানুষ হলেও তিনি বিধাতার আসনে বসে থাকেন।

সুনীতি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিলেন, শুধু তাই নয়, বুকে যেন তিনি বল পাইলেন; সঙ্গে সঙ্গে বুকখানি পুত্রগৌরবেও ভরিয়া উঠিল। তিনি ছেলের মাথায় চুলগুলির ভিতর আঙুল চালাইতে চালাইতে বলিলেন, মুখ হাত ধুয়ে ফেল্‌ বাবা, আমি দুখানা গরম নিমকি ভেজে দিই। ময়দা আমার মাখাই আছে।

মানদা নীরবে দাঁড়াইয়া ছিল, সে একবার বলিয়া উঠিল, আপনি ভালই বললেন দাদাবাবু; কিন্তু আমার মন ঠাণ্ডা হল না। বড় দাদাবাবু হলে-। অকস্মাৎ ক্রোধে সে দাঁতে দাঁত ঘষিয়া বলিয়া উঠিল, বড়দাদাবাবু হলে ওই মজুমদার আর শ্রীবাসের মুণ্ডু দুটো নখে করে ছিঁড়ে নিয়ে আসতেন।

সুনীতি শঙ্কায় স্তব্ধ হইয়া গেলেন; অহীন্দ্র কিন্তু মৃদু হাসিল, বলিল, আমিও নিয়ে আসতাম রে মানদা, যদি মুণ্ডু দুটো আবার জোড়া দিতে পারতাম। না হলে ওরা বুঝবে কি করে যে, আমাদের মুণ্ডু ছিঁড়ে নিয়েছিল, আর এমন কাজ করব না!

সুনীতির চোখে এবার জল আসিল, অহীন্দ্র তাঁহার মর্মকে বুঝিয়াছে, সংসারে দুঃখ কি কাহাকেও দিতে আছে? আহা, মানুষের মুখ দেখিয়া মায়া হয় না?

মানদা কি উত্তর দিতে গেল, কিন্তু বাহিরে কাহার জুতোর দ্রুত শব্দে সে নিরস্ত হইয়া দুয়ারের দিকে চাহিয়া রহিল। একলা মানদাই নয়, সুনীতি অহীন্দ্র সকলেই। পরমুহূর্তেই ষোল-সতেরো বৎসরের কিশোর একটি ছেলে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল। স্নিগ্ধ গৌর দেহবর্ণ, পেশীসবল দেহ-সর্বাঙ্গে সর্বপরিচ্ছদে পরিচ্ছন্ন তারুণ্যের একটি উজ্জ্বল লাবণ্য যেন ঝলমল করিতেছে।

সুনীতি সাগ্রহে আহ্বান করিয়া বলিলেন, অমল! এস, এস।

সুনীতির কথা শেষ হইবার পূর্বেই অমল অহীন্দ্রের হাত দুইটা ধরিয়া বলিল, অহীন?

অহীন্দ্র স্নিগ্ধ হাসি হাসিয়া বলিল, হ্যাঁ অহীন। তুমি অমল?

অমল বলিল, উঃ, কতদিন পরে দেখা হল বল তো? সেই ছেলেবেলায় পাঠশালায়। কতদিন যে আমি তোমাকে চিঠি লিখব ভেবেছি! কিন্তু ইংলণ্ডের রাজা আর ফ্রান্সের রাজার যুদ্ধ হল, ফলে দুটো দেশের দেশবাসীরা অকারণে পরস্পরের শত্রু হতে বাধ্য হল। -বলিয়া সে হাসিয়া উঠিল।

অহীন্দ্রও হাসিয়া বলিল, ইউ টক ভেরী নাইস!

অমল বলিল, ইউ লুক ভেরী নাইস। ব্রাইট ব্লেড অব এ শার্প সোর্ড-কাব্যের ভাষায় খাপখোলা সোজা তলোয়ার।

সুনীতি বিমুগ্ধদৃষ্টিতে দুইটি কিশোরের মিতালির লীলা দেখিতে ছিলেন। তিনি এইবার মানদাকে বলিলেন, মানদা, দে তো মা, একখানা ছোট সতরঞ্চি পেতে। বস বাবা তোমরা, আমি নিমকি ভাজব, খাবে দুজনে তোমরা। উমাকে আনলে না কেন বাবা অমল।

অমল বলিল, তার কথা আর বলবেন না পিসীমা। অকস্মাৎ সে কাব্য নিয়ে, যাকে বলে ভয়ানক মেতে ওঠা, সেই ভয়ানক মেতে উঠেছে। অনবরত রবীন্দ্রনাথের কবিতা মুখস্থ করেছে, আবৃত্তি করছে। আমায় তো জ্বালাতন করে খেলে।

সুনীতির সেই দিনের ছবি মনে পড়িয়া গেল। তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন, আহা,তাঁহার যদি এমনি একটি কন্যা থাকিত, তবে এমনি কবিতা আবৃত্তি করিয়া তাঁহাকে ভুলাইয়া রাখিতে পারিত।

অমল বলিল, এই দেখুন পিসীমা, কাল তো আপনাকে নিয়ে আমি যাচ্ছি সদরে, কিন্তু ফিরে এলেই যে অহীন পালাবে, সে হবে না।

অহীন হাসিয়া বলিল, আমার প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস কামাই হবে বলে ভাবনা কিনা-

অমল বলিল, তুমি বুঝি সায়েন্স স্টুডেন্ট? আই সী!

সুনীতি কাঠগড়ায় দাঁড়াইয়া কাঁপিয়া উঠিলেন। আদালতটা লোকে গিসগিস করিতেছিল। অমল তাঁহার কাছেই দাঁড়াইয়া ছিল, সে বলিল, ভয় কি পিসীমা, কোন ভয় করবেন না। পরমুহূর্তে সে আত্মগতভাবে বলিয়া উঠিল, এ কি, বাবা এসে গেছেন দেখছি!

সুনীতি দৃষ্টি ফিরাইয়া দেখিলেন, ঘর্মাক্ত-পরিচ্ছদ, রুক্ষচুল, শুষ্কমুখ, অস্নাত, অভুক্ত ইন্দ্র রায় আদালতে প্রবেশ করিতেছেন, সঙ্গে একজন উকিল। উকিলটি আসিয়াই জজের কাছে প্রার্থনা করিল, মহামান্য বিচারাকের দৃষ্টি আমি একটি বিশেষ বিষয়ে আকৃষ্ট করতে চাই। আদালতের সাক্ষীর কাঠগড়ায় এই যে সাক্ষী-ইনি এই জেলায় একটি সম্ভ্রান্ত প্রাচীন বংশের বধূ। উভয় পক্ষের উকিলবৃন্দ যেন তাঁর মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রেখে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা ও জেরা করেন। মহামান্য বিচারক সে ইঙ্গিত তাঁদের দিলে সাক্ষী এবং আমরা-শুধু আমরা কেন, সর্বসাধারণই চিরকৃতজ্ঞ থাকব।

ইন্দ্র রায় সুনীতির কাঠগড়ার নিকট আসিয়া বলিলেন, তোমার কোন ভয় নাই বোন, আমি দাঁড়িয়ে রইলাম তোমার পেছনে।

সাক্ষ্য অল্পেই শেষ হইয়া গেল; বিচারক সুনীতির মুখের দিকে চাহিয়াই উকিলের আবেদনের সত্যতা বুঝিয়াছিলেন, তিনি অতি প্রয়োজনীয় দুই চারিটা প্রশ্ন ব্যতীত সকল প্রশ্নই আগ্রাহ্য করিয়া দিলেন। কাঠগড়া হইতে নামিয়া সুনীতি সেই প্রকাশ্য বিচারালয়ে সহস্র চক্ষুর সম্মুখে পায়ে হাত দিয়া ধূলা লইয়া ইন্দ্র রায়কে প্রণাম করিলেন। রায় রুদ্ধস্বরে বলিলেন, ওঠ বোন, ওঠ। তারপর অমলকে বলিলেন, অমল, নিয়ে এস পিসীমাকে। একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছি, দেখি আমি সেটা।

দেখিবার কিন্তু প্রয়োজন ছিল। রায়ের কর্মচারী মিত্তির গাড়ি লইয়া বাহিরে অপেক্ষা করিয়াই দাঁড়াইয়া ছিল। সুনীতি ও অমলকে গাড়িতে উঠাইয়া দিয়া রায় অমলকে বলিলেন, তুমি পিসীমাকে নিয়ে বাড়ি চলে যাও। আমার কাজ রয়েছে সদরে, সেটা সেরে কাল আমি ফিরব।

সুনীতি লজ্জা করিলেন না, তিনি অসঙ্কোচে রায়ের সম্মুখে অর্ধ-অবগুণ্ঠিত মুখে বলিলেন, আমার অপরাধ কি ক্ষমা করা যায় না দাদা?

রায় স্তব্ধ হইয়া রহিলেন, তারপর ঈষৎ কম্পিত কণ্ঠে বলিলেন, পৃথিবীতে সকল অপরাধই ক্ষমা করা যায় বোন, কিন্তু লজ্জা কোনরকমেই ভোলা যায় না।

পরামর্শ অনুযায়ী অতি যত্নে সংবাদটি রামেশ্বরের নিকটে গোপন রাখা হইয়াছিল। রচিত মিথ্যা কথাটি তাঁহাকে বলিয়াছিলেন হেমাঙ্গিনী। তিনি বলিয়াছিলেন, সুনীতি একটা ব্রত করছে, একবার গঙ্গাস্নানে যেতে হয়, কিন্তু আপনাকে রেখে কিছুতেই যেতে চাচ্ছে না। আমি বলছি যে, আমি আপনার সেবাযত্নের ভার নেব; ব্রত কি কখনও নষ্ট করে! আপনি ওকে বলুন চক্রবর্তী মশায়।

রামেশ্বর উত্তর দিয়াছিলেন, না না না। রায় গিন্নী ঠিক বলেছেন সুনীতি, ব্রত কি কখনও পণ্ড করে! আমি বেশ থাকব।

সন্ধ্যায় সুনীতি অমলের সঙ্গে রওনা হইয়া গেলেন। রাত্রির খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা সুনীতি নিজেই করিয়া গিয়াছিলেন। অহীন্দ্র রামেশ্বরের কাছে রহিল। পরদিন হেমাঙ্গিনী সমস্ত ব্যবস্থা করিলেন, দ্বিপ্রহরে খাবারের থালাখানি আনিয়া আসনের সম্মুখে নামাইয়া দিতেই রামেশ্বর স্মিতমুখে বলিলেন, সুনীতির ব্রত সার্থক হোক রায়-গিন্নী, তার গঙ্গাস্নানের পুণ্যেই বোধ করি আপনার হাতের অমৃত আজ আমার ভাগ্যে জুটল।

হেমাঙ্গিনী সকরুণ হাসি হাসিলেন। সত্যই সেকালে রামেশ্বর হেমাঙ্গিনীর হাতের রান্নার বড় তারিফ করিতেন। আজ রাধারাণী গিয়াছে বাইশ-তেইশ বৎসর-এই বাইশ-তেইশ বৎসর পরে আজ আবার তিনি রামেশ্বরকে রাঁধিয়া খাওয়াইলেন! খাওয়া হইয়া গেলে হেমাঙ্গিনী বাসন কয়খানি উঠাইয়া লইবার উপক্রম করিতেই রামেশ্বর হাত জোড় করিয়া বলিলেন, না না রায়গিন্নী না।

অহীন্দ্র বলিল, আমি মানদাকে ডেকে দিচ্ছি।

মানদা উচ্ছিষ্ট পাত্রগুলি লইয়া গেলে হেমাঙ্গিনী বলিলেন, তা হলে এইবার আমি যাই চক্রবর্তী মশায়।

রামেশ্বর সকরুণ হাসি হাসিয়া বলিলেন, চলেই তো গিয়েছিলেন রায়গিন্নী, এ বাড়িতে আর যে কখনও পায়ের ধুলো দেবেন, এ স্বপ্নেও ভাবি নি। আবার যখন দয়া করে এসেছেনই, তবে ‘যাই’ বলে যাচ্ছেন কেন, বলুন ‘আসি’। যদি আর নাও আসেন, তবু আশা করতে পারব, আসবেন-রায়গিন্নী একদিন না একদিন আসবেন।

কথাটা নিছক কৌতুক বলিয়া লঘু করিয়া লইবার অভিপ্রায়েই রায়গিন্নী বলিলেন, আপনার সঙ্গে মেয়েলি কথাতে কেউ পারবে না চক্রবর্তী মশায়। আচ্ছা তা-ই বলছি, আসি। কেমন, হল তো? তারপরে তিনি অহীন্দ্রকে বলিলেন, তুমি এইবার আমার সঙ্গে এস বাবা অহীন, খেয়ে আসবে।

উভয়ে নীচে আসিয়া দেখিলেন, উমা মানদার সঙ্গে গল্প জুড়িয়া দিয়াছে। হেমাঙ্গিনী বলিলেন, চিনিস অহীনদাকে?

উমা বলিল, হ্যাঁ। অহীনদা যে ম্যাট্রিকে স্কলারশিপ পেয়েছেন।

অহীন্দ্র হাসিয়া বলিল, সেইজন্য চেন আমাকে? কিন্তু সে তো কপালে লেখা থাকে না?

মৃদু হাসিয়া উমা বলিল, থাকে।

বল কি?

হ্যাঁ, সায়েবদের মত গায়ের রং আপনার। দেখলেই ঠিক চেনা যাবে যে, এই স্কলারশিপ পেয়েছে। সে খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।

অহীন্দ্র এই প্রগলভা বালিকাটির কথায় লজ্জিত না হইয়া পারিল না। হেমাঙ্গিনী খাবারের থালা নামাইয়া দিয়া বলিলেন, ওর সঙ্গে কথায় তুমি পারবে না বাবা, তুমি খেতে বস। ও ওদের বংশের-। কথাটা বলিতে গিয়াও তিনি নীরব হইয়া গেলেন।

উমা বসিয়া থাকিতে থাকিতে সুট করিয়া উঠিয়া একেবারে রামেশ্বরের দরজাটি খুলিয়া ঘরে প্রবেশ করিল। তাহার এই আকস্মিক আবির্ভাবে রামেশ্বর পুলকিত হইয়া উঠিলেন, আপনার বিকৃতমস্তিষ্ক-প্রসূত রোগকল্পনার কথাও সে আকস্মিকতায় ভুলিয়া গেলেন তিনি, বলিলেন, উমা? এস এস মা, এস।

উমা আসিয়া পরমাত্মীয়ের মত কাছে বসিয়া বলিল, সংস্কৃত কবিতা বলুন।

রামেশ্বর অল্প হাসিয়া বলিলেন, তুমি বল মা বাংলা কবিতা, আমি শুনি। সেই রবীন্দ্রনাথের কবিতা একটি বল তো। তোমার মুখে, আহা, বড় সুন্দর লাগে। জান মা, মধুরভাষিণী গিরিরাজতনয়া যখন অমৃতস্রাবী কণ্ঠে কথা বলতেন, তখন কোকিলদের কণ্ঠস্বরও বিষমবিদ্ধা বীণার কর্কশধ্বনি বলেই মনে হত।

স্মরণে তস্যামমৃতস্রুতেব প্রজল্পিতায়ামভিজাতবাচি।

অপানুপুষ্টা প্রতিকূলশব্দা শ্রোতুর্বিতন্ত্রীরিব তাড্যমানা।।

তার চেয়ে তুমি বল, আমি শুনি।

উমাকে আর অনুরোধ করিতে হইল না, সে আজ কয়েক দিন ধরিয়া এই কারণেই শেখা কবিতাগুলি নূতন করিয়া অভ্যাস করিয়া রাখিয়াছে।

রুদ্র তোমার দারুণ দীপ্তি

এসেছে দুয়ার ভেদিয়া;

বক্ষে বেজেছে বিদ্যুৎ-বাণ

স্বপ্নের জাল ছেদিয়া।

* * *

ভৈরব তুমি কি বেশে এসেছ,

ললাটে ফুঁসিছে নাগিনী;

রুদ্রবীণায় এই কি বাজিল

সু-প্রভাতের রাগিণী?

মুগ্ধ কোকিল কই ডাকে ডালে,

কই ফোটে ফুল বনের আড়ালে?

বহুকাল পরে হঠাৎ যেন রে

অমানিশা গেল ফাটিয়া

তোমার খড়্গ আঁধার-মহিষে

দুখানা করিল কাটিয়া।

রামেশ্বর বিস্ফারিত নেত্রে উমার মুখের দিকে চাহিয়া শুনিতেছিলেন। আবৃত্তি শেষ করিয়া উমা বলিল, কেমন লাগল, বলুন?

রামেশ্বর আবেশে তখন যেন আচ্ছন্ন হইয়া ছিলেন, তবু অস্ফুট কণ্ঠে বলিলেন, অপূর্ব অপূর্ব! ‘তোমার খড়্গ আঁধার-মহিষে দুখানা করিল কাটিয়া’!–তিনি একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন।

উমা বলিল, আমি তবু বেশী জানি না, দু-চারটে শিখেছি কেবল। আমার দাদা খুব জানেন। রবীন্দ্রনাথ একেবারে কণ্ঠস্থ। আর ভারী সুন্দর আবৃত্তি করেন। আপনি তাঁকে দেখেন নি, না?

না, সে তো আসে নি, কেমন করে দেখব, বল?

দাঁড়ান, আসুন ফিরে পিসীমাকে নিয়ে। আমার পিসীমা কে জানেন তো?

তোমার পিসীমা! তুমি তো ইন্দ্রের মেয়ে। তোমার পিসীমা?

হ্যাঁ। অহিদার মা-ই যে আমাদের পিসীমা। হন তো পিসীমা, আমরা বলি।

ও ঠিক ঠিক, আমার মনে ছিল না।

আমার দাদাই তো তাঁকে নিয়ে সদরে গেছেন। আচ্ছা, পিসীমাকে কেন সাক্ষী মানলে, বলুন তো? কে কোথায় চরের ওপর দাঙ্গা করলে, উনি আর কি করবেন? ওই যে কে মজুমদার আছে, সে-ই খুব শয়তান লোক-ও-ই এ সব করছে। এ কি, আপনি এমন করছেন কেন? পিসেমশায়! পিসেমশায়!

রামেশ্বরের দৃষ্টি তখন বিস্ফারিত, সমস্ত শরীর থরথর করিয়া কম্পমান, দুই হাতের মুঠি দিয়া খাটের মাথাটা চাপিয়া ধরিয়া তিনি বলিলেন, একটু জল দিতে পার মা-একটু জল?

পরক্ষণেই তিনি দারুণ ক্রোধে জ্ঞান হারাইয়া মেঝের উপর পড়িয়া গেলেন। উমা ব্যস্ত বিব্রত হইয়া বারান্দায় ছুটিয়া গিয়া ডাকিল, মা! ও মা! পিসেমশায় যে পড়ে গেলেন মেঝেয় ওপর। অহিদা!

জ্ঞান হইলে রামেশ্বর হেমাঙ্গিনীর মুখের দিকে তিরস্কার-ভরা দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন, আপনি আমায় মিথ্যে কথা বললেন রায়-গিন্নী?

হেমাঙ্গিনী কথাটা বুঝিতে পারিলেন না, রামেশ্বর নিজেই বলিলেন, মজুমদার সুনীতিকে দায়রা আদালতের কাঠগড়াতে দাঁড় করালে শেষ পর্যন্ত!

হেমাঙ্গিনী চমকিয়া উঠিলেন। তবু তিনি আত্মসম্বরণ করিয়া বলিলেন, না, কে বললে আপনাকে?

রামেশ্বর উমার দিকে চাহিলেন, উমার মুখ বিবর্ণ, পাংশু। তিনি চোখ দুইটি বন্ধ করিয়া যেন ভাবিয়া লইয়াই বলিলেন, এই দিকে নীচে কাছারির বারান্দায় কে বলেছিল, আমি শুনলাম

হেমাঙ্গিনী স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। অহীন্দ্র পাখা দিয়া বাপের মাথায় বাতাস দিতেছিল, রামেশ্বর অকস্মাৎ তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, দেখ তো অহি, আমার বন্দুকটা ঠিক আছে কিনা, দেখ তো।

অহীন্দ্র নীরবে বাতাস করিয়াই চলিল। রামেশ্বর আবার বলিলেন, দেখ অহি,দেখ।

অহীন্দ্র মৃদুস্বরে বলিল, বন্দুক তো নেই।

কি হল? অকস্মাৎ যেন তাঁহার মনে পড়িয়া গেল। তিনি বলিলেন, মহী, মহী-হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক। জান তুমি অহি, মহী দ্বীপান্তর থেকে কবে ফিরবে, জান?

হেমাঙ্গিনী তাঁহাকে জোর করিয়া শোয়াইয়া দিয়া বলিলেন, একটু ঘুমোন দেখি আপনি। যা তো উমা, বাক্স থেকে ওডিকোলনের শিশিটা নিয়ে আয় তো।

শুশ্রূষায় রামেশ্বর শান্ত হইয়া ঘুমাইলেন। যখন উঠিলেন, তখন সুনীতি ফিরিয়াছেন।

সন্ধ্যা তখন উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। রামেশ্বর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুনীতির দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, তুমি রাধারাণী, না সুনীতি?

ঝরঝর-ধারার চোখের জলে সুনীতির মুখ ভাসিয়া গেল। রামেশ্বর ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, তুমি সুনীতি, তুমি সুনীতি। সে এমন কাঁদত না, কাঁদতে জানত না।

অকস্মাৎ আবার বলিলেন, শোন শোন-খুব চুপি চুপি। জজ সাহেব কি আমার খোঁজ করছিলেন? আমাকে কি ধরে নিয়ে যাবেন?

সুনীতি কোন সান্তনা দিলেন না, কথায় কোন প্রতিবাদ পর্যন্ত করিলেন না, নীরবে জানলাটা খুলিয়া দিলেন।

আব্‌ছা অন্ধকারের মধ্যেও চরটা দেখা যায়। যাইবেই তো, চক্রান্তের চক্রবেগে সেটা এই বাড়িকেই বেষ্টন করিয়া ঘুরিতেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *