কালিন্দী – ১০

১০

দীর্ঘকাল পরে হেমাঙ্গিনী রামেশ্বরকে দেখিলেন। রামেশ্বরের কথা মনে হইলেই তাঁহার স্মৃতিতে ভাসিয়া উঠিত রামেশ্বরের সেকালের ছবি। পিঙ্গল চোখ, পিঙ্গল চুল, তাম্রাভ গৌর বর্ণ, বিলাসী কৌতুকহাস্যে সমুজ্জ্বল একটি যুবকের মূর্তি। আর আজ এই রুদ্ধদ্বার অন্ধকারপ্রায় ঘরের মধ্যে বিষণ্ণ স্তব্ধ শঙ্কাতুর এক জীর্ণ প্রৌঢ়কে দেখিয়া তিনি শিহরিয়া উঠিলেন। চোখে তাঁহার জল আসিল। সুনীতির সহিত তাঁহার ঘনিষ্ঠ পরিচয় না থাকিলেও পরস্পর পরস্পরকে সামাজিক ক্ষেত্রে দেখিয়াছেন, সুতরাং তাঁহাকে চিনিতে সুনীতির বিলম্ব হইল না। তিনি অতি ধীরভাবে সাদর সম্ভাষণ জানাইয়া মৃদুকণ্ঠে বলিলেন, আসুন আসুন, দিদি আসুন। তাড়াতাড়ি তিনি একখানা আসন পাতিয়া দিলেন।

হেমাঙ্গিনী কুণ্ঠিতভাবে বলিলেন, এত খাতির করলে যে আমি লজ্জা পাব বোন, এ তো আমার খাতিরের বাড়ি নয়। তুমি তো আমার পর নও। তবে তুমি দিদি বলে সম্মান করে দিলে, আমি বসছি।-বলিয়া আসনে বসিয়া সর্বাগ্রে তিনি চোখ মুছলেন। তারপর মৃদুস্বরে সুনীতিকে প্রশ্ন করিলেন, পুরনো কথা বোধ হয় ওঁর ভুল হয়ে যায়, না?

না না। আপনি রায়-গিন্নী, রায়-গিন্নী। -মৃদুস্বরে বলিলেও হেমাঙ্গিনীর কথাটা রামেশ্বরের কানে গিয়াছিল, তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া অতি সকরুণ ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়িয়া কথা কয়টা বলিলেন।

হেমাঙ্গিনীর চোখ আবার জলে ভরিয়া উঠিল। তিনি আত্মসম্বরণ করিয়া বলিলেন, না, চিনতে পারেন নি। কই, আমাকে আদর ক’রে সম্মান করে যে নাম দিয়েছিলেন, সে নামে তো ডাকলেন না।

রামেশ্বর বলিলেন, ভুলে যান রায়-গিন্নী, ও কথা ভুলে যান! দুঃখই যেখানে প্রধান রায়-গিন্নী, সেখানে সুখের স্মৃতিতেই বা লাভ কি? ভগবান হলেন রসস্বরূপ, তিনি যাকে পরিত্যাগ করেছেন, সে ব্যক্তি পরিবেশন করবার মত রস পাবে কোথায় বলুন?

হেমাঙ্গিনী গভীর স্নেহ-অভিষিক্ত কণ্ঠস্বরে বলিলেন, না না, এ কি বলছেন আপনি? ভগবান পরিত্যাগ করলে কি সুনীতি আপনার ঘরে আসে? অহিকে দেখাইয়া বলিলেন, এমন চাঁদের মত ছেলে ঘর আলো করে?

রামেশ্বর হাসিলেন-অদ্ভুত হাসি। সে হাসি না দেখিলে কল্পনা করা যায় না। বলিলেন, সূর্যে গ্রহণ লেগেছে রায়-গিন্নী, ভরসা এখন চাঁদেরই বটে। দেখি, আপনাদের আশীর্বাদ।

প্রসাধন যতই সযত্ন এবং সুনিপুণ হোক, দিনের আলোকে প্রসাধনের অন্তরালে স্বরূপ যেমন প্রকাশ পাইয়া হাকে, তেমনই ভাবেই রামেশ্বরের রূপক-উক্তির ভিতর হইতে সদ্য সংঘটিত মর্মান্তিক আঘাতের বেদনা আত্মপ্রকাশ করিল। একই সঙ্গে সুনীতি ও রায়-গিন্নীর চোখ হইতে টপটপ করিয়া জল ঝরিয়া পড়িতে আরম্ভ করিল, অহি আর সহ্য করিতে পারিল না, সে নিঃশব্দে ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল।

রামেশ্বর সুনীতিকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, অহিকে খেতে দেবে না সুনীতি? ও তো এখনও খায় নি।

হেমাঙ্গিনী ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন, সে কি। আমি তোমাকে বসিয়ে রেখেছি বোন? আর ছেলে এখনও পর্যন্ত খায় নি? মরে যাই!

এতক্ষণে সুনীতি প্রথম কথা বলিলেন, শহর থেকে এই মাত্র ফিরল। তাই দেরি হয়ে গেল। পরীক্ষার খবর বেরিয়েছে, তাই এই দুপুরেই না খেয়ে ছুটে এসেছে।

সস্নেহ হাসি হাসিয়া হেমাঙ্গীনি বলিলেন, বাছা আমার পাস করেছে নিশ্চয়? ও তো খুব ভাল ছেলে।

মুখ উজ্জ্বল করিয়া সুনীতি বলিলেন, হ্যাঁ দিদি, আপনার আশীর্বাদে খুব ভাল করে পাশ করেছে অহি; ডিভিশনের মধ্যে ফার্স্ট হয়েছে, স্কলারশিপ পাবে।

আকস্মিক প্রসঙ্গান্তরের মধ্য দিয়া অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে, পঙ্ক হইতে পঙ্কজের উদ্ভবের মত, দুঃখের স্তরকে নীচে রাখিয়া আনন্দের আবির্ভাবে সকলেই একটা স্নিগ্ধ দীপ্তিতে উজ্জ্বল হইয়া উঠিলেন।হেমাঙ্গিনী বলিলেন, শিবের ললাটে চাঁদের ক্ষয় নেই চক্রবর্তী মশায়, এ-চাঁদ আপনার অক্ষয় চাঁদ।

রামেশ্বর বলিলেন, মঙ্গল হোক আপনার, অমোঘ হোক আপনার আশীর্বাদ।

সুনীতি হেমাঙ্গিনীর পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিলেন। হেমাঙ্গিনী বলিলেন, যাও ভাই, তুমি ছেলেকে খেতে দিয়ে এস। আমি বসছি চক্রবর্তী মশায়ের কাছে।

সুনীতি চলিয়া গেলেন, যাইবার সময় হেমাঙ্গিনীকে সাবধান করিয়া চুপি চুপি বলিয়া গেলেন, মাঝে মাঝে দু-একটা ভুল বলেন, দেখবেন।

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, কত দিন ভেবেছি, আসব, আপনাকে দেখে যাব, কিন্তু পারি নি। আবার ভেবেছি, যাক, মুছেই যখন গেছে সব, তখন মুছেই যাক। কিন্তু সেও হল না, মুছে গেল না। পাথরে দাগ ক্ষয় হয় মুছে যায় কিন্তু মনের দাগ কখনও মোছে না। আজ আর থাকতে পারলাম না। অপরাধ আমাদেরই। এর জন্য দায়ী যে উনি।

কে? ইন্দ্র? না না রায়-গিন্নী, দায়ী আমি। হেতু ইন্দ্র। সব আমি খতিয়ে দেখেছি। চিত্রগুপ্তের খাতায় মাঝে মাঝে আমি উকি মেরে দেখি কিনা।

হেমাঙ্গিনী একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া চুপ করিয়া রহিলেন, কিছুক্ষণ পরে বলিলেন, কিন্তু এমনভাবে ভেঙে লুটিয়ে পড়লে তো চলবে না আপনার চক্রবর্তী মশায়। সুনীতির দিকে, ছেলের দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন তো তাদের মুখ।

বুক ফেটে যায় রায়-গিন্নী, বুক ফেটে যায়। কিন্তু কি করব বলুন, আমার উপায় নেই।

উপায় আপনাকে করতে হবে, উঠে দাঁড়াতে হবে।

কি করে উঠে দাঁড়াব? দিনের আলোতে আমার চোখে অসহ্য যন্ত্রণা, তার ওপরে,- আপনার কাছে গোপন করব না, রায়-গিন্নী, হাতে আমার কুষ্ঠ হয়েছে।

হেমাঙ্গিনী স্তম্ভিত হইয়া গেলেন।

রামেশ্বর বলিলেন, এরা কেউ বিশ্বাস করে না; কবরেজ বলেন না, ডাক্তার বলেন, না। রক্তপরীক্ষা ক’রে তারা বলে, না; সুনীতি বলে, না। মূর্খ সব। রায়-গিন্নী, ভগবানের বিধানের দুর্জ্ঞেয় রহস্য এরা বোঝে না। আয়ুর্বেদে আছে কি জানেন? যেখানে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, রোগ যেখানে কর্মফল, সেখানে চিকিৎসকের ভুল হবে। একবার নয়, শতবার দেখলে শতবার ভুল হবে।

হেমাঙ্গিনী সতর্ক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রামেশ্বরের সর্বাঙ্গ দেখিতেছিলেন, কোথাও একবিন্দু বিকৃতি তিনি দেখিতে পাইলেন না। তিনি শুনিয়াছিলেন, আজ প্রত্যক্ষ বুঝিলেন, রোগের ধারণাই মস্তিষ্কবিকৃতির উপসর্গ। বলিলেন, না চক্রবর্তী মশায়, এ আপনার মনের ভুল। কই কোথাও তো একবিন্দু কিছু নাই।

হাতের দশটা আঙুল প্রসারিত করিয়া দিয়া রামেশ্বর বলিলেন, এই আঙুলে আঙুলে।

অহীন্দ্রের খাওয়া প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছিল। সুনীতি একটা পাখা লইয়া বাতাস করিতেছিলেন। হেমাঙ্গিনী উপর হইতে নামিয়া আসিলেন, বলিলেন, আজ তা হ’লে আসি ভাই।

সুনীতি বলিলেন, সারাক্ষণ নন্দাইয়ের সঙ্গেই বসে গল্প করলেন, আমার কাছে একটু বসবেন না দিদি?

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, তোমার সঙ্গে যে কত গল্প করতে সাধ, সে কথা আর একদিন বলব সুনীতি। চক্রবর্তী মশায় যখন তোমাকে বিয়ে করে আনলেন, তখন তোমার ওপরই রাগ হয়েছিল। অকারণ রাগ। তারপর যত দেখলাম, ততই তোমার সঙ্গে কথা বলে তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে সাধ হয়েছে। সে অনেক কথা, পরে একদিন বলব। আজ যাই, বুঝতেই তো পারছ লুকিয়ে এসেছি। তবে একটা কথা বলে যাই, যেটা বলতে আমার আসা। তুমি ভাই মজুমদারকে সরাও। ওঁর কাছে আমি শুনেছি, সম্পত্তি ও-ই নিজে বেনাম করে ডেকেছে।

সুনীতি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, জানি দিদি। আমি ওঁকে জবাবও দিয়েছি। কিন্তু আশ্চর্যের কথা কি জানেন, তবুও উনি আসছেন, না বললেও কাজকর্ম করে দিয়ে যাচ্ছেন।

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, সে ও বন্ধ করা দরকার বোন, যে এমন বিশ্বাসঘাতক হতে পারে, তাকে বিশ্বাস কি?

এখন বার বার বলছেন, চরটা বেচে ফেলুন, অনেক টাকা হবে।

না না, এমন কাজও করো না ভাই। আমি ওঁর কাছে শুনেছি, চরটায় তোমাদের অনেক লাভ হবে, আয় বাড়বে।

কিন্তু চর নিয়ে যে গ্রাম জুড়ে বিবাদ দিদি, আমি কেমন করে সে সব সামলাব? আর বিবাদ না মিটলেই বা বন্দোবস্ত করব কি করে বলুন?

সাঁওতালদের ডেকে তোমরা খাজনা আদায় করে নাও সুনীতি। আমি এইটুকু বলে গেলাম যে, তোমার দাদা আর কোন আপত্তি তুলবেন না। আর কেউ যদি তোলে, তবে তাতেও তিনি তোমাকেই সাহায্য করবেন।

সুনীতি কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে হেমাঙ্গিনীর দিকে চাহিয়া বলিলেন, তাঁকে আমার প্রণাম দেবেন দিদি, বলবেন-

বাধা দিয়ে হেমাঙ্গিনী বলিলেন, পারব না ভাই। বললাম তো লুকিয়ে এসেছি।

* * *

মানদা ঝি যায় নেই, বাড়িঘর নাই বলিয়া এখানেই এখনও রহিয়াছে। আপনার কাজগুলি সে নিয়মিতই করে। সুনীতি আপত্তি করিলেও শোনে না। বরং কাজ তাহার এখন বাড়িয়া গিয়াছে, বাড়াইয়াছে সে নিজেই। সদর কাছারি বাড়ির চাকর চলিয়া গিয়াছে, নায়েবও নাই, কিন্তু তবুও অনেক পরিস্কারের প্রয়োজন আছে। সে প্রয়োজন সে নিজেই আবিস্কার করিয়া কাজটি আপনার ঘাড়ে লইয়াছে। তাহার উপর সকালে সন্ধ্যায় দুয়ারে জল, প্রদীপের আলো, ধূপের ধোঁয়া এগুলো তো না দিলেই নয়। হিন্দুর বাড়ি, মা লক্ষ্মী রুষ্ট হইবেন যে!

সুনীতি আপত্তি করিয়াছিলেন, কিন্তু মানদা বলিয়াছিল, যতদিন আছি আমি করি তারপর আপনার যা খুশি হয় করবেন। আপনি যদি তখন নিজে হাতে গোবর মেখে ঘুঁটে দেন পয়সা বাঁচাবার জন্যে-দেবেন, আমি তো আর দেখতে আসব না।

কাছারি বাড়ি সে পরিস্কার করে দিনে দ্বিপ্রহরে; খাওয়া-দাওয়ার পর মানুষের একটা বিশ্রামের সময় আছে, এই সময়টার বাহিরে লোকজন থাকে না, সেই অবসরে নিত্য কাজটা সারিয়া লয়। লজ্জাটা তাহার নিজের জন্য নয়, চাকরের বদলে ঝি কাছারি সাফ করিলে অন্য কেহ কিছু না বলুক, ওই রায়-বাড়ির ছেলেগুলি হয়তো ছড়া বাঁধিয়া বসিবে। সেদিন সে তক্তপোশের উপর পাতা ফরাশ হইতে আরম্ভ করিয়া মেঝে পর্যন্ত সমস্ত পরিপাটী করিয়া ঝাঁট দিতেছিল, আর গুনগুন করিয়া গান গাহিতেছিল। এতবড় নির্জন ঘরগুলোর মধ্যে একা একা কাজ করিতে করিতে কেমন গান পাইয়া বসে। দুই-একবার বড় আয়নাটার সম্মুখে দাঁড়াইয়া জিভ ও ঠোঁট বাহির করিয়া দেখে, পানের রসটা কেমন ঘোরালো হইয়াছে। স্নানের পর হইতেই চুল খোলা থাকে, খোলা চুলও এই সময়ে বাঁধিয়া লয়। আজ সহসা তাহার গান থামিয়া গেল, অনেক লোক যেন কাছারির বাহিরের প্রাঙ্গনে কথা বলিতেছে। ঝাঁট দেওয়া বন্ধ রাখিয়া উঠিয়া খড়খড়ি-দেওয়া দরজাটার খড়খড়ি তুলিয়া সে দেখিল, সাঁওতালেরা দল বাঁধিয়া দাঁড়াইয়া আছে। জনহীন রুদ্ধদ্বার কাছারির দিকে চাহিয়া তাহারা চিন্তিত হইয়া কি বলাবলি করিতেছে। মানদা ঘরের ভিতরে ভিতরেই অন্দরে চলিয়া গিয়া সুনীতিকে বলিল, সাঁওতালরা সব দল বেঁধে এসে দাঁড়িয়ে আছে মা, কি সব বলাবলি করছে। আমি এই গলি গলি গিয়ে ডাকব নায়েবকে?

সুনীতি বলিলেন, না। অহিকে ডাক্‌ তুই, ওপরে নিজের ঘরেই আছে সে।

অহীন্দ্র আসিয়া সম্মুখে উপস্থিত হইতেই মাঝির দল কলরব করিয়া উঠিল, রাঙাবাবু। অহীন্দ্র সাধারণতঃ এখানে থাকে না, তাহারা প্রত্যাশা করিয়াছিল মজুমদারকে। অপ্রত্যাশিত ভাবে তাহাদের রাঙাবাবুকে পাইয়া তাহারা খুব খুশি হইয়া উঠিল। অহীন্দ্র বলিল, কি রে, তোরা সব কেমন আছিস?

ঠকাঠক তখন প্রণাম হইয়া গিয়াছে। কমল মাঝি জোড়হাত করিয়া বলিল, ভাল আছি আজ্ঞা। আপুনি কেমন করে এলি বাবু? আমরা সব কত বুলি, কত খুঁজি তুকে! বুলি, আমাদের রাঙাবাবু আসে না কেনে? মেয়েগুলা সব শুধায়।

হাসিয়া অহীন্দ্র বলিল, আমি যে পড়তে গিয়েছিলাম মাঝি।

ক খ অ আ সেই সব। রিংজী ফার্সী, নাকি বাবু?

হ্যাঁ, অনেক পড়তে হয়। তার পর তোরা কোথায় এসেছিস?

আপনার কাছে তো এলাম গো। বুলছি আমাদের জমি কটির খাজনা তুরা লে, আমাদিগকে চেক-রসিদ দে। তা নইলে কি করে থাকবো গো?

খাজনা কে পাবেন, এখনও যে তার ঠিক হয় নি মাঝি। সে ঠিক-

বাধা দিয়া কমল বলিল, না গো, সে সব ঠিক হয়ে গেল। দিলে সব ঠিক করে উই সেই রায়-হুজুর, আমাদিকে বুললে, চরটি তুদের রাঙাবাবুদেরই ঠিক হল মাঝি। খাজনা তুরা সেই কাছারিতে দিবি। তাথেই তো আজ ছুটে এলম গো।

দ্বিপ্রহরে হেমাঙ্গিনীর কথা অহীন্দ্রের মনে পড়িয়া গেল। সে এবার দ্বিধা না করিয়া বলিল, দে, তবে দিয়ে যা।

কিছুক্ষণ অবাক হইয়া চাহিয়া থাকিয়া মাঝি বিনয় করিয়া হাসিয়া বলিল, হা বাবু, ইটি আপনি কি বুলছিস? জমি কটি মাপতে হবে, তা বাদে হিসাব করতে হবে, তুদের খাতিতে নাম লিখতে হবে, সি সব কর্‌ আগে! লইলে কি করে দেব?

অহীন্দ্র বিব্রত হইয়া বলিল, সে তো আমি পারব না মাঝি, আমি তো জানি না ওসব। তবে আমি তার ব্যবস্থা করছি, বুঝলি?

মাঝি বিস্মিত হইয়া গেল, তবে আপুনি কি বিদ্যে শিখলি গা?

হাসিয়া অহীন্দ্র বলিল, সে সব অনেক বই মাঝি, নানা দেশের কথা, কত বীরের কথা, কত যুদ্ধের কথা।

হ্যাঁ, তা সি কোন গাঁয়ের কথা বটে গো?-বীর বুললি-কারা বটে সি সব?

সে সব পৃথিবী জুড়ে নানা দেশ আছে, সেই সব দেশ, আর সেই সব দেশের বড় বড় বীর-তাদের কথা মাঝি। আরও সব কত কথা-ওই আকাশে সূয্যি উঠছে, চাঁদ উঠছে, সেই সব কথা।

হ্যাঁ! মাঝির মুখ-চোখ বিস্ময়ে ভরিয়া উঠিল, সে মুখ ফিরাইয়া দলের সকলকে আপন ভাষায় বলিল, রাঙাবাবু কত জানে দেখ্‌।

সঙ্গীর দল আপন ভাষায় রাঙাবাবুর তারিফ করিয়া মৃদু কলরব আরম্ভ করিয়া দিল, কমল বলিল, হ্যাঁ বাবু, এই যে পিথিমীটি, এই যি ধরতি-মায়ী-ইকে কে গড়লে? কি লেখা আছে পুঁথিতে তাদের?

অহীন্দ্র বলিল, পৃথিবী হল গ্রহ, বুঝলি? আকাশে রাত্রে সব তারা ওঠে না? এও তেমনি একটা তারা। আগে পৃথিবী দাউ দাউ করে জ্বলত। যেমন কড়াইতে গুড় কি রস টগবগ করে ফোটে তেমনি করে ফুটত।

মাঝি বিষন্নভাবে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, উঁহু, তুকে এখনও অনেক পড়তে হবে। পিথিমীতে আগে ছিল জল। কিছুই ছিল না, শুধুই জল ছিল। তার পরে হল কি জানিস? বলি শোন্‌। বলিয়া সে মোটা গলায় আরম্ভ করিল-

অথ জনম কু ধরতি লেণ্ডং

অথ জনম্‌ কু মানোয়া হড়

মান মান কু মানোয়া হড়

ধরতি কু ডাবাও আ-কাদা,

ধরতি সানাম্‌ কু ডাবাও কিদা।

গান শেষ করিয়া মাঝি বলিল, পেথমে ছিল জল-কেবল জল। তার পর হল-অথ জনম্‌ কু ধরতি লেণ্ডং; বুলছে, লেণ্ডং গায়ে থেকে মাটি বার করে ধরতিকে বানালে-মাটি করলে। লেণ্ডং হল-ওই যে মাছ ধরিস তুরা, কেঁচো গো, কেঁচো। দেখিস কেনে-আজও উহার গায়ে থেকে মাটি বার করে। তারপর হল- ‘অথ জন্‌ম কু মানোয়া হড় ‘। বুলছে, মাটিতে হল মানুষ। ‘মান মান কু মানোয়া হড়’, কিনা মানুষ মানুষ-কেবলই মানুষ। তখন তুর ‘ধরতি কু ডাবাও আ-কাদা’ কিনা-মানুষ করলে ধরতি-মাটি খুঁড়ে চাষ;-ফসল হল। ‘ধরতি সানাম কু ডাবাও কিদা’- একেবারে তামাম ধরতিতে চাষ হয়ে অ্যানেক ফসল হল।

অহীন্দ্র হাসিল, কিন্তু বড় ভাল লাগিল এই গান ও গল্প। মাঝি আবার বলিল, ধরতি-মাটি বানালে তুর ‘লেণ্ডং’-কেঁচোতে,

পোকাতে।

অহীন্দ্র তাহাকে উৎসাহিত করিয়া বলিল, এ সব কথা তো আমি জানি মাঝি।

উৎসাহ পাইয়া মাঝি জাঁকিয়া বসিয়া বলিল, তবে শুনো আপুনি, বুলি আপনাকে। ঠাকুর বুঝো তো বাবু, ঠাকুর-ভগোমান? সি পেথমে জল করলে–সব জল হয়ে গেল। তখুন ঠাকুর দুটি “হাঁস-হাসিল” বানালে। হাঁস-হাসিল হল পাখী, বুঝলিন বাবু? তা সি পাখী দুটি ঠাকুরকে বুললে, হাঁ ঠাকুর, আমাদিগে তো বানালি তা আমরা থাকব কুথা, খাব কি? ঠাকুর বললে, হেঁ, তা তো বেটে! তখন ঠাকুর ডাকলে তুর কুমীরকে। বুললে তুমি মাটি তুলতে পারিস? কুমীর বুললে, হেঁ, আপুনি বুললে পারি। কুমীর মাটি তুললে, সি-সব মাটি জলে গলে ফুরিয়ে গেল। তখন ঠাকুর ডাকলে-ইচা হাকোকে-বোয়াল মাছকে, তা উয়ার মাটিও গলে গেল। তার বাদে এল কাটকম। কি বুলিস তুরা উয়াকে? আ-হা!… কাটকমের বাংলা ভাবিয়া না পাইয়া মাঝি চিন্তিত হইয়া পড়িল।

কাঠের পুতুলের ওস্তাদ কথাটা যোগাইয়া দিল, কাঁকড়ি। কাঁকড়া বলে বাবুরা। সেই যি লম্বা লম্বা পা-

হেঁ। কমল মাঝি বলিল, হেঁ। কাঁকুড়িকে ডাকলে তখুন। বুললে, মাটি তুলো তুমি! উ মাটি তুললে, তা সিটোও গলে গেল। তখুন ঠাকুর ডাকলে লেণ্ডংকে-কেঁচোকে। শুধালে, তুমি মাটি তুলতে পারিস? উ বললে, পারি; তা ঠাকুর, হারোকে সমেত ডাক আপুনি। হারো হল তুমার ‘কচ্ছপ’ গো। কচ্ছপ এল। কেঁচো করলে কি- উয়াকে জলের উপর দাঁড় করালে, লিয়ে উয়ার পা কটা শিকল দিয়ে বেঁধে দিলে। তা বাদে, কেঁচো আপন লেজটি রাখলে উয়ার পিঠের উপর, আর মুখটি ডুবায়ে দিলে জলের ভিতর। মুখে মাটি খেলে আর লেজ দিয়ে বার করে কচ্ছপের পিঠের উপর রাখলে। তখুন আর গলে না। এমুনি করে মাটি তুলতে তুলতে পৃথিমী ভরে গেল।

সমস্ত কাহিনীটি বলিয়া কমল বিজ্ঞভাবে হাসিয়া বলিল, বুঝলি বাবু? ই সব তুকে শিখতে হবে।

সাঁওতালদের এই পুরাণকথা শুনিয়া অহীন্দ্র আশ্চর্য হইয়া গেল। ইহাদের এমন পুরাণকথা আছে, সে তাহা জানিত না। সে মুগ্ধ বিস্ময়ে নীরবে গল্পটি মনে মনে স্মরণ করিয়া আয়ত্ত করিয়া লইতে আরম্ভ করিল।

কমল মাঝিও নীরবে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া ছিল তাহার তারিফ শুনিবার প্রত্যাশায়। পিছন হইতে কাঠের পুতুলের ওস্তাদ বলিল, বাঃ, তুমি যে গল্পে মজিয়া গেলে গো সর্দার। জমির কথাটা বলিয়া কথাটা পাকা করিয়া লও! এই লোকটি জ্ঞানে-গরিমায় কমলের প্রতিদ্বন্দী। সর্দারের এই ‘বিদ্যা জাহির’ করাটা তার সহ্য হয় না, তা ছাড়াও লোকটি খাঁটি সংসারী মানুষ, বিষয়বুদ্ধিতে পাকা। অন্য মাঝিরাও কাঠের পুতুলের ওস্তাদের কথায় সায় দিয়া উঠিল।

কমল একটু রুষ্ট হইয়াছিল, কিন্তু সকলের সমর্থন দেখিয়া সে কোন প্রতিবাদ করিল না। অহীন্দ্রের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, বাবুমশায়!

অহীন্দ্র হাসিয়া বলিল, -তোমার একথা খুব ভাল কথা মাঝি। ভারী সুন্দর।

হুঁ গো, খুব ভাল বটে। তা- হা বাবু, আমাদের তবে কি করবি?

বললাম তো লোক পাঠিয়ে দেব।

উ-হুঁ। তুকে নিজে যেতে হবে! উয়ারা সব চোর বটে।

কমলের চোখ দুইটি হঠাৎ জ্বলিয়া উঠিল, বলিল, শুন রাঙাবাবু, ইয়ার লেগ্যে একবার আমরা খেপলম। এই বড় বড় হাঁড়িতে ঘি নিয়ে যেতম, দোকানীরা ঘি লিথো, তা এক সেরের বেশী কখুনও হত না। মহাজনেরা কাই হড় বটে, পাপী মানুষ, মাঝিদের হাড্ডি চিবায়ে খেলে। গোমস্তাতে টাকা লিলে, রসিদ দিলে না। খাজনা লিলে আবার জমি লিলেম করালে। জমা বাড়ালে। বললম, জমি বাড়ুক, তবে জমা বাড়বে, লইলে কেনে বাড়বে? বাবা দাদা বন কেটে জমি করলে, আমরা খাজনা দিলম, তবে লিলেম হবে কেনে জমি? তা শুনলে না। তখন আমরা খেপলম। সিধু, কানু সুভা ঠাকুর (সুবেদার) হল- এক রাতে হল। জানিস বাবু, রাতেই লোক বড় হয়, আবার রাতেই লোক ছোট

হয়। সুভা, সিধু, কানু হুকুম দিলে, আমরা খেপব। তুর দাদা-বাবার বাবা-রাঙাঠাকুর বললে, খেপ তুরা, খেপ। এই টাঙ্গি লিয়ে রাঙাঠাকুর খেপল, আমাদের বাবাদের সাথে। তখুন ধরলুম মহাজনদিকে, একটি করে আঙুল কাটলুম, আর বললাম, বাজা, টাকা বাজা! দাড়িওলা মহাজনকে জমিদারকে ধরলম, ভাল পাঁঠা বলে বোঙার কাছে কাটলম। একটো গোমস্তা জলে নামল, তীর দিয়ে তাকে বিঁধলম। তারপর টেনে তুলে- পেরথম কাটলাম পা। বললম, এই লে চার আনা সুদ। তারপর কাটলম কোমর থেকে, বললম, এই লে আট আনা, সুদ আর খাজনা। কাটলাম হাত দুটো, বললম, এই বারো আনা, সুদ, খাজনা, তোর তহুরী। তারপর কাটলাম মাথা, বললম, এই লে ষোল আনা, লিব্যাধি! ফারখত!

কমল চুপ করিল। সমস্ত বাড়িটা যেন স্তব্ধ হইয়া গেল; যেন সব উদাস হইয়া গিয়াছে। অহীন্দ্র নীরব বিস্ময়ে চাহিয়া ছিল স্তব্ধ আগ্নেয়গিরির মত ওই কমলের দিকে। সাঁওতালরাও নীরব। তাহাদের উপরেও যেন কেমন নীরব বিষণ্ণতা নামিয়া আসিয়াছে।

কমলই আবার বলিল-এবার তাহার মুখও বিষণ্ণ, কণ্ঠস্বরে মিনতির অনুনয়-বলিল, তাথেই বুলছি বাবু।

অহীন্দ্র এতক্ষণে বলিল, আবার তোমাদের ঠকালে তোমারা খেপবে?

খেপব? কমল বিষণ্ণভাবে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না।

কেন?

রাঙাঠাকুর ম’ল, সিধু সুভাঠাকুর ম’ল, রাঁচিতে বিসরা মহারাজ ম’ল আর কে খেপাবে বল্‌? কে হুকুম দিবে? আর বাবু-

কমল আপনাদের সঙ্গীদের দেখাইয়া বলিল, ইহারা সব আর সি সাঁওতাল নাই। ইয়ারা মিছা কথা বলে, কাজ করতে গিয়ে গেরস্তকে ঠকায়, খাটে না, ইয়ারা লোভী হইছে। পাপ হইছে উয়াদের। উয়ারা খেপতে পারবে না। উয়ারা ধরম লস্ট করলে।

শেষের দিকে কমলের কণ্ঠস্বর সকরুণ হইয়া উঠিল। সব কথা শেষ করিয়া সে উদাস দৃষ্টিতে চাহিয়া কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তাহার পিছনে মাঝির দল মাথা হেঁট করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। তাহাদের সর্দারের অভিযোগ তাহাদের লজ্জা দিয়াছে।

কথা বলিল সেই চুড়া মাঝি-পুতুল নাচের ওস্তাদ, সে লোকটা অনেকটা বাস্তবপন্থী, সে ঈষৎ হাসিয়া বলিল, টাকা লইলে কিছু হয় না বাবু, টাকা নাই, খেপে কি করব? আর বাবু খেপে মরেই যদি যাব তো খেপলম কেনে বল্‌? বুদ্ধি করলাম ইবার আমরা।

কমল তাহার মুখের দিকে ঘৃণার দৃষ্টি হানিয়া মুখ ফিরাইয়া লইল, তারপর অহীন্দ্রকে বলিল, আর উয়ারা খেপবে না বাবু। খেপলম, তারপর হাজারে হাজারে সাঁওতাল ম’ল গুলিতে। যারা বাঁচল, তারা ভাত পেলে না। সাঁয়ো ঘাস খেলে। বাবু, আমি তখন গিধরা-ছেলেমানুষ-তবু মনে লাগছে (পড়ছে), ইঁদুরের দড় (গর্ত) থেকে ধান বার করলম-গুণে চারটি ধান, জলে সিজলাম (সিদ্ধ করলাম), সেই জল খেলম, ফেন বলে। আর উয়ারা খেপবে না। তাথেই সাহস হচ্ছে না। বুলছে চেক রসিদটি না হলে উয়াদের চাষে মন লাগছে না। তা বাদে আমাদের বিয়া আছে। ওই যে আমার লাতিনটি-সেই লম্বা পারা, তারই বিয়া হবে। তাথেই সব মাতন আছে আমাদের, হাঁড়িয়া খাবে সব, নাচবে, গান করবে। তাথেই সব তাড়াতাড়ি করছে।

অহীন্দ্র বলিল, বেশ, তাড়াতাড়ি করে নেব- কাল কি পরশু। কিন্তু তোর নাতনীর বিয়েতে আমাদের নেমন্তন্ন করবি না?

মাঝি শিহরিয়া উঠিয়া বলিল, বাবা রে, আমাদের রাজা তুমি, রাঙাঠাকুরের লাতি, তেমুনি আগুনের পারা রঙ, তেমনি চোখ, তেমনি চুল। আপোনাকে তাই বলতে পারি? আমরা সব কত কি খাই-মুরগী শুয়োর-ছি!

সাঁওতালরা চলিয়া গেল। অহীন্দ্র মুগ্ধ হইয়া তখনও ওই বুড়া মাঝির কাহিনীর কথা ভাবিতেছিল। সে নিজে বিজ্ঞান ভালবাসে। বুড়োর কাহিনীর মধ্যে আদিম বর্বর জাতির বৈজ্ঞানিক মনকে সে আবিস্কার করিল। সৃষ্টিরহস্যভেদে অনুসন্দ্ধিৎসু মন কল্পনার সাহায্যে কাহিনী রচনা করিয়া রহস্যভেদ করিয়াছে।

তাহার চিন্তার সূত্র ছিন্ন করিয়া দিয়া রংলাল ও নবীন আসিয়া প্রণাম করিয়া দাঁড়াইল- দাদাবাবু!

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাহাদের দিকে অহীন্দ্র চাহিল, কোন কথা বলিল না।

একগাল হাসিয়া রংলাল বলিল, এই দেখেন, চর আপনাদেরই হল তো? আমি মশায়, বলেছিলাম কিনা? ছোট রায়-হুজুর সাঁওতালদের বলে দিয়েছেন তো, এই কাছারিতে খাজনা দিতে।

অহীন্দ্রের একটা কথা মনে হইল, সে নবীনকে বলিল, নবীন তুমি তো পুরনো লোক। সাঁওতালদের জমিটা মাপ করে দিতে

পারবে?

সবিনয়ে নবীন বলিল, আজ্ঞে হ্যাঁ। মাপ-জোক সব করে দেব আমি।

সোৎসাহে রংলাল বলিল, আপনি চলুন, গিয়ে দাঁড়াবেন শুধু, বাস্‌। আমরা সব ঠিক করে দেব।

অহীন্দ্র বলিল, কাল ভোরে তা হলে এস তোমরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *