কবি – ২০

কবি – ২০

গঙ্গার তীরবর্তী শহর, গঙ্গার তীরবর্তী শ্মশানেই, নিতাই-ই বসন্তর সৎকার করিল। সাহায্য করিল দলের মেয়েরা। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, পুরুষেরা শব স্পর্শ পর্যন্ত করিল না। এক্ষেত্রে আপন আপন জাতি সম্বন্ধে তাহারা। সচেতন হইয়া উঠিল। দোহার—ললিতার ভালবাসার মানুষ—সে মুখ ফুটিয়া বলিল—ওস্তাদ, যা করছে ওরাই করুক। করলে তো অনেক। আবার কেনে?
নিতাই হাসিল, প্রতিবাদ করিল না। কিন্তু তাহার পরামর্শ গ্রাহ্য করিবার লক্ষণও দেখাইল না। তার্কিক দোহার লোকটি ছাড়িল না, বলিল—হাসির কথা নয় ওস্তাদ। পরকালে কি জবাব দেবে বল!
নিতাই হাসিয়া বলিল—কোন জবাব দেব না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকব ভাই।
বেহালাদারটি হাসিয়া বাধা দিয়া বলিল—যাক ভাই, ও কথা যাক। বলিয়াই সে বেহালায় ছড়ির টান দিল।
চিতার উপর শবদেহ চাপাইবার পূর্বে প্রৌঢ়া একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল—আঃ! বসন আমার সোনার বসন। দুই ফোঁটা চোখের জলও তাহার চোখ হইতে ঝরিয়া পড়িল। পাশেই বালুচরের উপর বসিয়া ছিল নির্মলা এবং ললিতা। নিঃশব্দ কান্নায় তাহদের চোখ হইতে শুধু জল ঝরিয়া পড়িতেছিল অনর্গল ধারায়।
নিতাই দেহটা চিতার উপর চাপাইবার উদ্যোগ করিল, প্রৌঢ়া বলিল–দাঁড়াও বাবা দাঁড়াও। সে আসিয়া বসন্তর আভরণ খুলিতে বসিল। নিম্নশ্রেণীর দেহোপ্লজীবিনীর কি-ই বা আভরণ! কানে দুইটা ফুল, নুকে একটা নাকছবি, হাতে দুইগাছা শাঁখা বাঁধা, তাহার উপর বসন্তর গলায় ছিল একছড়া হালক বিছাহার।
নিতাই হাসিল। বলিল—খুলে নিচ্ছ মাসী?
মাসী কেবল তাহার মুখের দিকে একবার চাহিল, তারপর আপনার কাজে মন দিল। গহনাগুলি আঁচলে বাঁধিয়া সে বলিল—বুকের নিধি চলে যায় বাবা, মনে হয় দুনিয়া অন্ধকার, খাদ্য বিষ, আর কিছু ছোঁব না–কখনও কিছু খাব না। আবার এক বেলা যেতে না যেতে চোখ মেলে চাইতে হয়, উঠতে হয়, পোড়া পেটে দুটো দিতেও হয়, লোকের সঙ্গে চোখ জুড়তে হয়। বাঁচতেও হবে, খেতে পরতেও হবে—এগুলো চিতেয় দিয়ে কি ফল হবে বল? বক্তব্য শেষ করিয়া হাসিয়া সে হাতের গহনাগুলির দিকে চাহিয়া বলিল—এগুলি আবার আমার পাওনা বাবা।
নিতাই আবার একটু হাসিল, হাসিয়া সে বসন্তর নিরাভরণ দেহখানি চিতায় চাপাইয়া দিল। প্রৌঢ়া বলিল, কপালে হাত দিয়া আক্ষেপ করিয়াই বলিল—আমার আদেষ্ট দেখ বাবা। আমিই হলাম ওয়ারিশান। প্রৌঢ়ার চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িল।
ললিত, নির্মলা অদূরে সজল চোখে উদাস দৃষ্টিতে বসন্তর চিতার দিকে চাহিয়া ছিল। বসন্তর বিয়োগে বেদন তাহদের অকৃত্রিম, কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তটিতে তাহারা ভাবিতেছিল নিজেদের কথা। তাহদেরও হয়তো এমনি করিয়া যাইতে হইবে, মাসী এমনি করিয়াই তাহাদের দেহ হইতে সোনার টুকরা কয়টা খুলিয়া লইবে। বহুভাগে যদি বুড়া হইয়া বাঁচে, তবে ওই মাসীর মতই তাহারাও হয়তো দলের কত্ৰী হইবে। তখন–কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিল। কল্পনা তাহদের ততদূর গেল না, আশার চেয়ে নিরাশাই তাহদের জীবনে বড়। শুধু তাহাই নয়, নিরাশ পরিণাম কল্পনা করিতেই এই মুহূর্তটিতে বড় ভাল লাগিতেছে। তাহারাও এমনি করিয়া মরিবে, মাসী বাঁচিয়া থাকিবে।

* * *

সৎকার শেষ করিয়া ফিরিয়া নিতাই দেখিল, মহিষের মত লোকটা বসন্তর ঘরে আড্ডা গাড়িয়া বসিয়া আছে। বসন্তর জিনিসপত্রগুলি ইহারই মধ্যে এক জায়গায় স্তূপীকৃত করিয়া রাখা হইয়া গিয়াছে।
আবারও নিতাই একটু হাসিয়া ঘরের একপাশে একটা মাদুর বিছাইয়া চিতাগ্নির উত্তাপজর্জর, পরিশ্রমক্লান্ত দেহখানা ছড়াইয়া দিল।
সে ভাবিতেছিল মরণের কথা।
মরণ কি? পুরাণে পড়া মরণের কথা তাহার মনে পড়িল। মানুষের আয়ু ফুরাইলে ধর্মরাজ যম তাহার অনুচরগণকে আদেশ দেন ওই মানুষের আত্মাটিকে লইয়া আসিবার জন্য। ধর্মরাজের অদৃপ্ত অনুচরেরা আসিয়া মানুষের অঙ্গুলিপ্রমাণ আত্মাকে লষ্টয়া যায়। ধর্মরাজের বিচারালয়ে ধর্মরাজ তাহার কর্ম বিচার করেনা, তাহার পর স্বর্গ অথবা নরকে তাহার বাসস্থান নির্দিষ্ট হইয়া যায়। বিভিন্ন কর্মের জন্য বিভিন্ন পুরস্কার, বিভিন্ন শাস্তির ব্যবস্থাও সে পড়িয়ছে। নিতাইকেও একদিন সেখানে যাইতে হইবে। বসন্তর সঙ্গে তাহার কর্মের পার্থক্যই বা কোথায়? তাহা সে খুঁজিয়া পাইল না। এবং তাহাতে সে একটা আশ্চর্ষ সান্ত্বনা পাইল। কারণ বসন্ত যেখানে গিয়াছে, সেখানেই সে যাইবে। সে হয়তো অনন্ত নরক।
ত হোক। সেদিন তো আবার তাহার সহিত দেখা হইবে। কিছুক্ষণ পর মনটা আবার হায় হায় করিয়া উঠিল, আজ কিছুতেই তাহার মন ভরিতেছে না। তাহার কোলের উপরেই যে বসন্ত লুটাইয়া পড়িয়া মরিল, সে যে নিজহাতে তাহার দেহখানাপুরাইয়া ছাই করিয়া দিয়াছে কিছুক্ষণ আগে। আর যে সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে আর বসন্তকে কোখাও খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।
এই একটা কথাই বার বার মনে ঘুরিতেছে।
বসন্ত চলিয়া গেল। সমস্ত পৃথিবী খুঁজিয়া আর তাহাকে পাওয়া যাইবে না। সেই বসন্ত। ঝক্‌মকে ক্ষুরের মত মুখের হাসি, আগুনের শিখার মত তাপ, তেমনি রঙ তেমনি রূপ, বসন্তকালের কাঞ্চনগাছের মতই বসনের বেশভূষার বাহার। সেই বসন চলিয়া গেল! গায়ের গহনাগুলা প্রৌঢ়া টানিয়া খুলিয়া লইল, সে নিজে তাহার দেহখানা আগুনে তুলিয়া দিল, বসন একটা প্রতিবাদও করিল না।
মরণ সত্যসত্যই অদ্ভূত। গহনার উপর বসন্তর কত মমতা। সেই গহনা প্রৌঢ়া খুলিয়া লইল। বসন্ত একটা কখাও বলিল না। দেহের জন্য বসন্তর কত যত্ন, এতটুকু ময়লা লাগিলে সে দশবার মূছিত, এতটুকু যন্ত্রণ তাহার সহ্য হইত না—সেই দেহখান আগুনে পুড়িয়া ছাই হইয়া গেল, কিন্তু তাহার মুখের এতটুকু বিকৃতি হইল না। দুঃখ, কষ্ট, লোভ, মোহ এক মুহূর্তে মরণ সব ঘুচাইয়া দিল। মরণ অদ্ভুত! থাকিতে থাকিতে তাহার মনে সেই গানের কলিগুলা গুন গুন করিয়া জাগিয়া উঠিল।—

এই খেদ মোর মনে মনে
ভালবেসে মিটল না আশ-কুলাল না এ জীবনে।
হ্যায়! জীবন এত ছোট কেনে!
এ ভুবনে?

বসন বলিয়াছিল—কবিয়াল—তোমার গান আমার জীবনে ফলে যায়। এ গান তুমি কেনে বাঁধলে কবিয়াল! গানটা বসনের জীবনে সত্য হইয়া গেল। হায়! হায়। বসন কি মরিয়া শান্তি পাইয়াছে? এ জগতের যত তাপ—যত অতৃপ্তি সব কি ও জগতে গিয়া জুড়াইল? জীবনে যা পাওয়া যায় না—মরণে কি তাই মেলে? সুর গুন গুন করিয়া উঠিল।
জীবনে যা মিটল না কে মিটবে কি হায় তাই মরণে?
মেটে? তাই মেটে? বসন কি মরণের পরেও বসন হইয়া আছে? এ আকাশে যে চাঁদ ডোবে—সে চাঁদ কি সেখানকার আকাশে ওঠে? এ ভুবনে যে ফুলটি ঝরিয়া পড়ে, সে ফুল কি সে ভুবনে—পারিজাত হইয়া ফুটিয়া ওঠে? এ জীবনের ও জগতের যত কান্না সে কি অনাবিল আনন্দে খিল খিল করিয়া হাসি হইয়া বাজিয় ওঠে ওপারে—সে জগতে? ওঠে? ওঠে?

এ ভূবনে ডুবল যে চাঁদ সে ভুবনে উঠল কি তা?
হেথায় সাঝে ঝরল যে ফুল হোথায় প্রাতে ফুটল কি তা?
এ জীবনের কান্না যত—হয় কি হাসি সে ভুবনে?
হয়? জীবন এত ছোট কেনে?
এ ভুবনে?

হঠাৎ একটা কলহ-কোলাহলে তাহার গানের তন্ময়তা ভাঙিয়া গেল। মনটা ছি-ছি করিয়া উঠিল। বাহিরে দলের লোকেদের মধ্যে চেঁচামেচি শুরু হইয়া গিয়াছে। নির্মল তীক্ষ্ণস্বরে চীৎকার করিতেছে। সে বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। ব্যাপারটা শুনিয়া সে আরও মৰ্মাহত হইল। ঝগড়া বাঁধিয়াছে বসনের স্থান পূরণ লইইয়া ছি! ছিঃ! ছি!
বসন্ত আজই মরিয়াছে, দুপুরবেলা পর্যন্ত দেহটাও তাহার ছিল। এখন প্রায় সন্ধ্যা হইয়াছে, ইহারই মধ্যে দল হইতে বসন্ত মুছিয়া গেল। তাহার স্থান কে লইবে সেই সমস্ত এখনই পূরণ নু করিলেই নয়! প্রৌঢ়া বসন্তর জিনিসপত্র লইয়া আপনার ঘরে পুরিয়া খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থায় ব্যস্ত। ললিত, নির্মলা আজ নিজেরা খরচ দিয়া মদ কিনিয়া খাইতে বসিয়াছে। ইহারই মধ্যে বেহালাদার, দোহার ও ঢুলীট আলোচনা করিতেছিল, কোন ঝুমুর দলে সে গানে-নাচে-রূপে-যৌবনে সেরা মেয়ে কে আছে! সর্ববাদিসন্মতভাবে ‘প্রভাতী’ নামী কে একজন তরুণীর নাম স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে; মেয়েটা নাকি বসন্ত অপেক্ষা আরও ভাল এই কারণে যে তাহার বয়স বসন্তের চেয়ে অনেক কম। দোহার বলিতেছে তাহাকেই আনা উচিত। তাহাতে বিশ ত্রিশ বা পঞ্চাশ টাকা পর্যন্ত লাগে তাহা দিয়াও তাহাকে দলে আনা উচিত। না হইলে এমন যে দলটা এ দলটাও অচল হইয়া যাইবে।
ঢুলীটা এই কথায় বলিয়াছে—চিঁড়ে রসস্থ না হলে গলা দিয়ে নামে না। শুধু কবিয়ালের গান কেউ শুনবে না। ললিতা নির্মলা মুখপাত হ’লে চোখ বুজে গান শুনতে হবে।
ললিতা নির্মলা ফোঁস করিয়া উঠিয়া ঝগড়া শুরু করিয়া দিয়াছে। একে রূপোপজীবিনী নারী তার উপর মদের নেশা। রূপের নিন্দা শুনিয়া গালিগালাজে স্থানটা অসহনীয় করিয়া তুলিয়াছে।
নিতাইয়ের ভাল লাগিল না। সে ধীরে ধীরে অলক্ষিতে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। লক্ষ্যহীনভাবে চলিতে চলিতে কখন একসময় আসিয়া দাঁড়াইল গঙ্গার ধারে, শ্মশানে। সেইখানে সে বসিল।

* * *

সামনে জনশূন্য শ্মশান। একটা চিতা হইতে অল্প অল্প ধোঁয়া উঠিতেছে। এখানে ওখানে ছাইয়ের গাদা। গঙ্গার ওপারে পূর্বদিকে সন্ধ্যা নামিয়াছে। দগ্ধ দেহের গন্ধে এখানকার বাতাস ভারী। ইহারই মধ্যে চুপ করিয়া সে বসিয়া রহিল।
এত কাছে হইতে এমন করিয়া একা বসিয়া দুচোখ ভরিয়া নিতাই জীবনের ওপারকে কখনও দেখে নাই। জীবনের ওপারে মৃত্যুপুরী, মরণ ওখানে বসিয়া আছে।
পাড়ায়—গ্রামে মানুষ মরিয়াছে, সে শুনিয়াছে। মরণ সম্বন্ধে সকল মানুষের মতই একটা ভয়—একটা সকরুণ অসহায় দুঃখই এতকাল তাহার ছিল। এই প্রথম বসন্ত তাহার কোলের উপর মরিয়া মরণের সঙ্গে একটা প্রত্যক্ষ পরিচয় করাইয়া দিয়া গেল। মনে হইতেছে বসন্তর হাতে কপালে হাত রাখিয়া সে যেন মরণের ছোঁয়াচ অনুভব করিতে পারিত। কপালে হত রাখিয়া কতদিন সে চমকিয়া উঠিয়াছে। এমন ছ্যাঁক করিয়া একটা স্পর্শ লাগিত যে না চমকিয়া পারিত না। আর কাল রাত্রে তো মরণ যেন বসন্তকে লইয়া তাহার সঙ্গে কাড়াকড়ি করিয়া গেল।
বসন্ত কিন্তু মরিতে ভয় পায় নাই, তবে বাঁচিতে তাহার সাধ ছিল। অনেক গোপন সাধ তাহার ছিল। হঠাৎ মনে হইল—বসন্তের আত্মা যদি—। দেহ ঘর সংসার স্বজন পৃথিবী হারাইয়া অসহায় মানুষের আত্মা তো দেহের মমতায় অনেক সময় কাঁদিয়া কাঁদিয়া ফেরে। গভীর নিশীথ রাত্রে বসন্ত যদি আসে চিতার পাশে তাহার অনেক সাধের অনেক রূপের দেহখানির সন্ধানে? বুকখান তাহার স্পদিত হইয়া উঠিল।
সে একেবারে আসিয়া বসিল—শ্মশানের ভিতর বসন্তের চিতার পাশটিতৃে। রাত্রির তখন সবে প্রথম প্রহর। সব স্তব্ধ। সব অন্ধকার। শুধু বি ঝি পোকা ডাকিতেছে। শহরের আলো, কোলাহল অনেকটা দূরে। নিতাই চিতার পাশে বসিয়া মনে মনে বলিল—বসন এস! …বসন এস!…বসন এস!
বসন্ত কিন্তু আসিল না।
সমস্ত রাত্রি শ্মশানে শিয়াল, শকুনা, কুকুর প্রভৃতি শ্মশানচারীদের মধ্যে কাটাইয়া দিল, তাহার একে একে আসিল, কলহ করিল, খেলা করিল, চলিয়া গেল। গঙ্গার জলে কত জলচর সশব্দে ঘাই মারিল, কিন্তু বসন্তর দেখা মিলিল না। সারারাত্রি বালুচরের ধার ঘেষিয়া গঙ্গা কলকল করিয়া বহিয়া গেল। কলকল কুলকুল শব্দ কখনও উঁচু কখনও মৃদু; আকাশে দুই-তিনটা তারা খসিয়া গেল; গঙ্গার ওপারে সড়কটায় কত গরুর গাড়ী গেল; গাড়ীর নীচে ঝুলানো আলো জুলিয়া দুলিয়া একটা আলো তিন-চারিটার মত মনে হইল; সারারাত্রি জোনাকীগুলো জ্বলিল, নিবিল; গঙ্গার কিনারার জঙ্গল হইতে বাহির হইয়া শিয়ালগুলা বালুর চরের উপর ছুটাছুটি করিয়া বেড়াইল; গাছে শকুন কাঁদিল, চিতার কাছে কতকগুলা বসিয়া রহিল উদাসীর মত। নিতাই বসিয়া বসিয়া সব দেখিল, মুহূর্তের জন্য কোন কিছুর মধ্যে বসন্তর আভাস মিলিল না, বসন্ত বলিয়া কিছুকে ভ্রম পর্যন্ত হইল না, আকাশের তারাগুলা পূব হইতে পশ্চিমে ঢলিয়া পড়িল, বড় কাস্তেটা পাক খাইয়া ঘুরিয়া গেল, বিছের লেজটা গঙ্গার পশ্চিম পাড়ের জঙ্গলের মধ্যে ডুবিয়া গেল; পূব আকাশের শুকতারা উঠিল নিতাই চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।
গঙ্গার পূর্ব পাড়ের ঢালু চরটা প্রায় ক্রোশখানেক চওড়া, তার ওপরে সারি-সারি গ্রাম, গ্রামের গাছপালাগুলার মাথায় আকাশে ক্রমে ফিকে রঙ ধরিল, কল-কল কল-কল করিয়া পাখীগুলা একবার রোল তুলিয়৷ ডাকিয়া উঠিল। রাত্রি শেষ হইয়া আসিয়াছে। না, বসন্ত দুনিয়া হইতে মুছিয়াই গিয়াছে। হঠাৎ তাহার চোখ ফাটিয়া জল আসিল। সে চোখ বন্ধ করিয়া আত্মসম্বরণ করিতে চেষ্টা করিল। সঙ্গে সঙ্গে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটিল। খোলা চোখের সামনে যে বসন্ত কোখাও ছিল না, নিতাই চোখ বুজিতেই সেই বসন্ত আশ্চর্য স্পষ্ট হইয়া মনের মধ্যে ভাসিয়া উঠিল। মনে হইল, বসন্ত যেন তাহার সামনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে —বসন্ত! বসন্ত!
চোখ খুলিতেই নিতাইয়ের ভ্রম ভাঙিয়া গেল। ইহারই মধ্যে আকাশে অন্ধকারের ঘোর আরও কিছুটা কাটিয়াছে। নিতাইয়ের সম্মুখে গঙ্গা, শ্মশান, গাছপালা, চিতার আঙরা। কুকুরের পালগুলাও দেখা যাইতেছে। উদাস মনে আবার সে চোখ বুজিল। অদ্ভুত! এ কি! আবার বসন্তকে সে দেখিতে পাইতেছে। বসন্ত আসিয়ছে। চোখ বন্ধ করিলেই সে দেখিতেছে স্পষ্ট বসন্তর ছবি; ছবি নয় যেন সত্যকারের বসন্ত, সে হাসিতেছে, সে কথা বলিতেছে। পুরানো কথার পুনরাবৃত্তি নয়, বসন্ত নুতন ভঙ্গিতে কত নূতন কথা বলিতেছে, নূতন বেশভূষায় সাজিয়া নূতন রূপে দেখা দিতেছে।
নিতাই খুশী হইয়া উঠিল। থাকিতে থাকিতে নূতন কলি তাহার মনে জাগিয়া উঠিল –

“মরণ তোমার হার হল যে মনের কাছে
ভাবলে যারে কেড়ে নিলে সে যে দেখি মনেই আছে
মনের মাঝেই বসে আছে।
আমার মনের ভালবাসার কদমতলা—
চার যুগেতেই বাজায় সেথা বংশী আমার বংশীওলা।
বিরহের কোথায় পালা—
কিসের জালা?
চিকন-কাল দিবস নিশি রাধায় যাচে।”

মনখানি তাহার পরিপূর্ণ মন হইরা উঠিল। এ যে কেমন করিয়া হইল তাহ সে জানে না, তবে হইল। বসন্ত তাহার হারায় নাই। পরিপূর্ণ মনেই সে গঙ্গার ঘাটে নামিয়া মুখ-হাত ধুইল, তারপর ফিরিল বাসার দিকে।

বাসায় তখন বাঁধাছাঁদার তোড়জোড় পড়িয়া গিয়াছে। তাহাকে দেখিয়া সকলে হৈ-চৈ করিয়া উঠিল—এই যে! এই যে!
দোহারটি রসিকতা করিয়া বলিল—আমি বলি, ওস্তাদ বুঝি বিবাগী হয়ে গেল।
নিতাই মৃদু হাসিয়া ছড়ার স্বরে তাহারই পুরানো একটা গানের দুইটি কলি আবৃত্তি করিয়া দিল—

“সে বিনে প্রাণে বাঁচিনে—ভুবনে ভুবনে রহি কেমনে?
আমি যাব সেই পথে, যে পথ লাগে ভাল নয়নে ৷”

ললিতা ঠোঁটে পিচ কাটিয়া বলিল—বল কি বোনাই, অঙ্গে তবে তোমার ছাই কই?
নির্মলা কিন্তু আসিয়া সস্নেহে তাহাকে সম্ভাষণ করিয়া বলিল—ব’স দাদা, আমি চা ক’রে দি।
বাজনদারটি আসিয়া মুদুস্বরে বলিল—কাল ছিলে কোথা বল তো? কার বাড়ীতে? সে কেমন হে? অর্থাৎ তাহার ধারণা নিতাই কাল রাত্রে বসন্তকে ভুলিবার জন্য শহরের কোন দেহব্যবসায়িনীর ঘরে গিয়া আশ্রয় লইয়াছিল।
বেহালদার ধমক দিল—থাম হে, থাম তুমি। যেমন তুমি নিজে, তেমনি দেখ সবাইকে। ব’স ওস্তাদ, ব’স। নিতাই হাসিয়া বসিল।
প্রৌঢ়া এতক্ষণ কাজে ব্যস্ত ছিল। একজন পুরনো কাপড়ের ব্যবসায়ীর সঙ্গে বসন্তর কাপড়গুলি বেচিবার বন্দোবস্ত করিতেছিল। দাম-দস্তুর শেষ করিয়া সে বাহিরে আসিল। নিতাইকে বলিল—ওগো বাবা, এই বেলাতেই উঠছি। গুছিয়ে তোমার জিনিসপত্তর বেঁধেছেঁদে নাও।
নির্মলা একটি বাটিতে তেলমাখা মুড়ি নামাইয়া দিয়া বলিল—চায়ের জল ফুটছে, ততক্ষণে মুড়ি কটি থেয়ে নাও। কাল তো সারারাত খাও নাই।
তাহার মুখের দিকে চাহিয়া নিতাই বলিল—বোন নইলে ভায়ের দুঃখ কেউ বোঝে না।
—আর মাসী বেটীর কথা বুঝি ভুলেই গেলে বাবা? প্রৌঢ়া আসিয়া একটি মদের বোতল, গোটা দুয়েক গত রাত্রের সিদ্ধ ডিম, খানিকটা মাংস আনিয়া নামাইয়া দিল —কাল রাত থেকে আনিয়ে রেখেছি। খাও, শরীলের জুৎ হবে।
নিতাই তাহার মুখের দিকে চাহিয়া মৃদু হাসিয়া বলিল—মা-মাসীকে কি কেউ ভোলে, না ভোলা যায়? চিরদিন তোমার কথা মনে থাকবে মাসী।
প্রৌঢ়া হাসিয়া বলিল—তুমি খাও, আমি আসছি। প্রৌঢ়া চলিয়া যাইতেই ঢুলীটা আরও কাছে আসিয়া বসিল। নিতাই হাসিয়া বলিল— নাও, নাও, ঢেলে লাও, আরম্ভ কর।
কৃতাৰ্থ হইয়া মদ ঢালিতে ঢালিতে চুপি চুপি বলিল—বসনের কাপড়চোপড় বিক্রী হয়ে গেল।
নিতাই কোন উত্তর দিল না।
অভিযোগ করিয়া ঢুলীটা আবার বলিল—গয়না দু-এক পদ রেতে খুলে লাও নি কেনে, বল দেখি? এমুনি মুখ্যুমি করে, ছি!
নিতাই বোতল দেখাইয়া বেহালাদার ও দোহারকে বলিল—এস, লাও, তাহারাও এবার অপরিমেয় সহানুভূতির সঙ্গে কাছে আসিয়া ঘেষিয়া বলিল। কিছুক্ষণ পরেই বেহালাদার সচকিত হইয়া বলিল—ওই! বোতল শেষ হয়ে গেল! তুমি? তুমি তো কই—
নিতাই হাসিয়া বলিল—ত হোক, দরকার নাই।
—তুমি খাবে না?
—নাঃ।
সকলে অবাক হইয়া গেল।
নিতাই বলিল বেহালাদারকে—তোমার কাছে একটি জিনিস শিখবার সাধ ছিল। রাত্রে বেহালায় তুমি যে স্বরটি বাজাও ওই স্বরটি বেহালায় তুলতে শিখবো। গলায় পারি, বেহালায় শিখব।
বেহালাদার বলিল—নিশ্চয়। তোমাকে শেখাব না ওস্তাদ? দেখ দেখি! তিন দিনে শিখিয়ে দোব।
–নিতাই হাসিয়া বলিল—তিন দিন আর পাব কোথায় তোমাকে?
—কেনে? সবিস্ময়ে প্রশ্নটা করিল দোহার। বেহালাদার স্থির দৃষ্টিতে নিতাইয়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। সে আঁচ করিয়াছে।
নিতাই হাসিয়া বলিল—আজই আমি চলব।
—সে তো আমরাও। তুমি—
দোহারের মুখের উপর হাত দিয়া বেহালাদার বলিল—থাম তুমি থাম।
নিতাই কিন্তু দোহারের কথা ধরিয়াই জবাব দিল—হ্যাঁ যাব সবাই, তোমরা এক পথে, আমি আর এক পথে।
বেহালদার তাহার হাতখানি চাপিয়া ধরিল, শুধু বলিল–ওস্তাদ!
নিতাই একটু চুপ করিয়া রহিল, কথার উত্তর দিল না। একটু চুপ করিয়া থাকিয় বেশ গল ছাড়িয়া গান ধরিয়া দিল;—মনে নুতন পদ আসিয়াছে।

“বসন্ত চলিয়া গেল হায়,
কালো কোকিল আজি কেমনে গান গায়
বল—কেমনে থাকে হেথায়!”

হঠাৎ বেহালাদার বেহালাটা টানিয়া লইয়া বলিল—শোন ওস্তাদ, শোনা, সেই সুর তোমাকে শোনাই, শোন। এসেছে।
সে ছড়ি টানিল—লম্বা টানা সুর। সেই সুর!

ইহারই মধ্যে আসিয়া হাজির হইল মাসী।
—বাবা। নিতাই হাত তুলিয়া ইসারায় জানাইল—এখন নয় একটু পরে। কিন্তু বেহালাদার খামিয়া গেল। সে মাসীর মুখ দেখিয়া থামিয়া গিয়াছে।
মাসী বলিল–কি শুনছি বাবা?
—কি মাসী?
—তুমি—? তুমি চলে যাবে? আমাদের সঙ্গে যাবে না?
—না মাসী। খেলার একপালা শেষ হল। এবার নতুন পালা।
—অন্য দলে—?
—না মাসী। এবার পথের পালা। এবার পথে পথে। প্রৌঢ়া অনেক বুঝাইল। অনেক প্রলোভন দেখাইল। বসন্তর গহনা কাপড়-চোপড়ের দামের অংশ পর্যন্ত দিতে চাহিল। আরও বলিল—বসনের চেয়ে ভাল নোক আমি দলে আনছি বাবা। আমি কথা দিচ্ছি, তোমার কাছেই সে থাকবে।
নিতাই বলিল—না মাসী, আর নয়।
নির্মলা কাঁদিল।
নিতাইও একবার চোখ মুছিয়া বলিল—না ভাই, তুমি কেঁদে না, তুমি কাঁদলে আমি বেথা পাব।
বেহালাদার বলিল—তুমি বিবাগী হবে ওস্তাদ?
নিতাই ও প্রশ্নের জবাবে তাহার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। তাই তো। বসন্তের সঙ্গে যে গাটছড়া ও গিঁট সে বাঁধিয়াছিল, সে গিঁট খুলিয়া গিয়াছে। বসন্ত আজ তাহাকে মুক্তি দিয়াছে। এবার একটা নতুন ডাক যেন সে শুনিয়াছে। পথে পথে চলো মুসাকের। বেহালাদারের প্রশ্নে তাহার মনে অকস্মাৎ সুরটি বাজিয়া উঠিল।—বিবাগী?
বৈরাগ্যই তাহার ভাল লাগিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *