কবি – ১৭

কবি – ১৭

ভ্ৰাম্যমাণ নাচ-গানের দল। নাচ ও গানের ব্যবসায়ের সঙ্গে দেহের বেসাতি করিয়া বেড়ায়— গ্রাম হইতে গ্রামান্যরে, দেশ হইতে দেশান্তরে। কবে কোন পর্বে কোথায় কোন মেলা হয়, কোন পথে কোথা হইতে কোথায় যাইতে হয়—সে সব ইহাদের নখদর্পণে। বীরভূম হইতে মুর্শিদাবাদ, পদব্রজে, গরুর গাড়িতে, ট্রেনে তারপর নৌকায় গঙ্গা পার হইয়া—রাজসাহী, মালদহ, দিনাজপুর পর্যন্ত ঘুরিয়া আষাঢ়ের প্রারম্ভ পর্যন্ত বাড়ি ফেরে।
প্রৌঢ়া বলে–আগে আমরা পদ্মাপারে নিচের দিকেও যেতাম। পদ্মাপারে বাঙাল দেশে আমাদের ভারি খাতির ছিল।
নির্মলা প্রশ্ন করে—পদ্মাপার তুমি গিয়েছ মাসী?
নির্মলার কথা শেষ হইতে না হইতে মাসী পদ্মাপারের গল্প বলিতে বসে। বলে—যাইনি? বাপরে, সে কি ধুম!
তারপর বেশ আরাম করিয়া পা ছড়াইয়া বসিয়া সুপারী কাটিতে কাটিতে বলে—বাতের তাল খানিক মুলিশ করে দে দিখি; পদ্মাপারের কথা বলি শোন। .
আপসোসের দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলে—আঃ মা, তোরা আর কি দেখলি–কি-ই বা রোজগার করলি আর কি-ই বা খেলি। সে ‘দ্যাশ’ কি! সোনার ‘দ্যাশ’! মাটি কি! বারোমাস মা-নক্ষ্মী যেন আঁচল পেতে বসে আছেন। সুপুরী কিনতে হয় না মা। সুপুরীর বন। যাও—কুড়িয়ে নিয়ে এস। ডাব নারিকেল—আমাদের ‘দ্যাশের’ তালের মতন। দু-ধারি পাটের ‘ক্ষ্যাত’।
সে হাত দুইখানা দীর্ঘ ভঙ্গিতে বাড়াইয়া দিয়া সুবিস্তীর্ণ পাট চাষের কথা বুঝাইয়া দিতে চেষ্টা করে। তারপর আবার বলে—এক এক পাটের ব্যাপারী কি! পয়সা কত! এই বড় বড় লৌকো। ব্যাপারীদের নজর কি, হাত দরাজ কত। প্যালা দেয় আধুলি, টাকা; সিকির কম তো লয়। আর তেমন কি খাবার সুখ। মাছই কত রকমের। ইলিশ-ভেটকি-কত মাছ মাছ—‘অছল্যি’ মাছ! আঃ তেমনি লঙ্কা খাবার ধুম!
ললিতা বলে—আমাদের একবার নিয়ে চল মাসী ওই দ্যশে।
মাসী বলে—মা, সি রামও নাই আর সি অযুধ্যেও নাই। সি দ্যাশে আর আমাদের সে আদরও নাই মা। সি কালে আমরা যেতাম—পালাগান গাইতাম। পদাবলীর গান— আমাদের সি কালের ওস্তাদের আবার বেশ রসান দিয়ে পালাগান ‘নিকতো’—সে-সব গান আমরা গাইতাম। যে যেমন আসর আর কি! তেলক কাটতে হ’ত, গলায় কণ্ঠি পরতে হ’ত। আবার বাজারে হাটে হালফেশানী গান হ’ত। আজকাল আর পালাগান কে শোনে বল?
নইলে পালাগান নিয়েই তো ঝুমুর!
বেহালাদার মাসীর কথা শুনিতে শুনিতে বলিল—উ দ্যাশের মাঝিদের গান শুনেছ মাসী?
—শুনি নাই? ভারি মিষ্টি সুর। প্রৌঢ়া নিজের মনেই গুন গুন করিয়া সুর ভাঁজিতে আরম্ভ করিল। বার দুয়েক ভাঁজিয়া নিজেই ঘাড় নাড়িয়া বলিল—উহু, আসছে না ঠিক।
বেহালাদার কি মনে করিয়া বার দুয়েক বেহালার উপর ছড়ি টানিল, প্রৌঢ়া বলিয়া উঠিল— হ্যাঁ হ্যাঁ! ওই বটে। কিন্তু বেহালাদার সঙ্গে সঙ্গেই থামিয়া গেল।
নির্মলা সুরটি শুনিবার জন্য উদগ্রীব হইয়াছিল, বেহালাদার থামিয়া যাইতেই সে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বলিল—ওই এক ধারার মানুষ! বাজাতে আরম্ভ করে থেমে গেল!
নির্মলার প্রিয়জন বেহালাদার একটু বিচিত্র ধরণের মানুষ; সারাদিন বেহালাটি লইয়া ব্যস্ত। ছড়িতে রজন ঘষিতেছে, বেহালার কান টানিয়া টানিয়া তার ছিঁড়িতেছে আবার তার পরাইতেছে। কখনও ঝাড়িতেছে, কখনও মুছিতেছে। মাঝে মাঝে কখনও সযত্ন-সঞ্চিত বার্নিশের শিশি হইতে বার্নিশ লইয়া মাথাইতে বসে। কিন্তু বড় একটা বাজায় না। আসরে বাজায়, বাসায় নতুন গানের মহল বসিলেও বাজায়, সে স্বতন্ত্র কথা। কিন্তু সারাদিন যে মানুষটা বেহালা লইয়াই বসিয়া থাকে সে কখনও আপন মনে কোন গান বাজায় না ইহাই সকলের আশ্চর্য লাগে। ছড়ি টানিয়া সুর বাঁধিতে বাঁধিতেই জীবন কাটির গেল। তবে এক একদিন, সেও ক্বচিৎ, গভীর রাত্রে সবাই যখন ঘুমায়, সে বেহালা বাজাইতে বসে। সেও একটি গান! এবং তেমন দিনটিরও একটি লক্ষণ আছে। সেদিনের সে লক্ষণ নিতাই আবিষ্কারও করিয়া ফেলিয়াছে। নিতাই পূর্ব হইতেই বুঝিতে পারে। নির্মলার ঘরে আগন্তুক আসিয়া যেদিন সারারাত্রির মহোৎসব জুড়িয়া দিবে সেই দিন; নিতাই বুঝিতে পারে যে আজ বেহালাদার বেহালা বাজাইবে।
সে এক অভূত গান। নিতাই বাজনায় সে গান শুনিয়াছে। অন্ধকারে কোন গাছতলায় একা বসিয়া বেহালাদার সে গান বাজায়। কিন্তু কেহ কাছে আসিয়া বসিলেই বেহালাদার বেহালাখানি নামাইয়া রাখে। এমন রাত্রে, অর্থাৎ নির্মলার ঘরে মহোৎসবের রাত্রে নিতাই এই গানটি শুনিবার জন্য ঘুমের মধ্যেও উদ্গ্ৰীব হইয়া থাকে। নিস্তব্ধ রাত্রে বেহালার মুর উঠিবামাত্র তাহার ঘুম ভাঙিয়া যায়। কিন্তু সে ওঠে না, শুইয়া শুইয়াই শোনে। একমাত্র মহিষের মত লোকটাকেই বেহালাদার গ্রাহ্য করে না। লোকটা যেন লোকই নয়, একটা জড়পদার্থ। লোকটাও চুপচাপ রাঙাচোখ দুইটা মেলিয়া নেশ-বিহ্বল দৃষ্টিতে অন্ধকারের দিকে চাহিয়া থাকে।
ললিতার প্রিয়জন দোহার লোকটি অত্যন্ত তার্কিক, তর্ক তাহার অধিকাংশ সময় ওই বাজনদার লোকটির সঙ্গে। বাজনার বোল ও তাল লইয়া তর্ক তাহদের লাগিয়াই আছে। মধ্যে মধ্যে ললিতার সঙ্গেও ঝগড়া বাঁধিয়া যায়। ললিতা তাহাকে ঘর হইতে বাহির করিয়া দেয়, লোকটা মাসীর কাছে নালিশ করে, মাসীর বিচারে পরাজয় যাহারই হউক, সে-ই ললিতার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করিয়া বলে—দোষ হইছে আমার, ঘাট মানছি আমি। আর কখুনও এমন কর্ম করব না। কান মলছি আমি। লোকটা সত্যই কান মলে।
নির্মলা ও বসন্ত লোকটার নাম দিয়াছে—‘ছুঁচো! ছি-চরণের ছুঁচো।‘ কথাটা অবশ্য আড়ালে বলিতে হয়, নহিলে ললিতা কোঁদল বাঁধাইয়া তুমুল কাও করিয়া বসে। দোহার লোকটি কিন্তু রাগে না, হাসে।
বাজনদারটির প্রিয়তমা কেহ নাই। জুটিলেও টেকে না। লোকটির কেমন স্বভাব—যে নারীটির সহিত সে প্রেম করিবে, তাহারই টাকা-পয়সা সে চুরি করিয়া বসিবে। লোকটি প্রৌঢ়। নির্মল, ললিত দুইজনেই এক এক সময় তাহার প্রিয়তম ছিল। কিন্তু ঐ কারণেই বিচ্ছেদ ঘটিয়া গেছে। লোকটা কিন্তু বাজায় খুব ভাল—যেমন তাহার তালজ্ঞান, বাজনার হাতটিও তেমনি মিঠা। কতবার চুরি করিয়া ঝগড়া করিয়া দল হইতে চলিয়া গিয়াছে, আবার কিছুদিন পর ফিরিয়া আসিয়াছে। লোকটা অতিমাত্রায় চরিত্রহীন। রাত্রে বাজনা বাজায়, দিনে সে ঘুরিয়া বেড়ায় নারীর সন্ধানে।
নির্মলা ললিতা নিতাইয়ের এক নাম দিয়াছে। বলে—‘বসন্তের কোকিল’।
বসন্ত নিতাই দুজনেই হাসে।

নূতন জীবনে এই পারিপার্শ্বিকের মধ্যে নিতাইয়ের দিন কাটিতে লাগিল। জীবন-স্রোতের টানে কোথা হইতে সে কোথায় আসিয়া পড়িল, ঠাকুরঝি কোথায় ভাসিয়া গেল, রাজা কোথায় থাকিল—এ সব ভাবিতে গেলে তাহার বুকের ভিতরটা কেমন করিয়া উঠে, ছুটিয়া পলাইয়া যাইতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু বসন্তের মুখপানে চাহিয়া সে তাহা পারে না। যে গিঁটটা সে বাঁধিয়াছিল সে গিঁটটা যেন অহরহই বাঁধা আছে, খুলিতেছে না। ঘাত-প্রতিঘাত সহ করিয়া, একহাতে চোখের জল মুছিয়া, অন্য হাতখানি কবিগানের সঙ্গে দর্শকের দিকে বাড়াইয়া দিয়া সে নিম্পূহ নিরাসক্তির এমন একটি আবরণ তৈয়ারী করিয়া লইয়াছে যে, সব কিছুই তাহার সহ্য হইল, অথচ সহনশীলতার গণ্ডী তাহাকে কোনপ্রকারে কোনদিকে সঙ্কুচিত করিল না। বসন্তকে সে ভালবাসিল। দুই হাত দিয়া বুকে জড়াইয়া ধরিল, কিন্তু ঠাকুরঝিকে সে ভূলিল না। বসন্তের ঘরে যেদিন মানুষ আসে সেদিন এক গাছতলায় শুইয়া মনে মনে ঠাকুরঝির সঙ্গে কথা কয় অথবা বিরহের গান বাঁধে। অহরহই তাহার মনের মধ্যে ঘোরে গানের কলি। বসন্তের কোকিল নাম দেওয়ায় সে একটা গান বাঁধিয়াছে, কবিগানের পাল্লার আসরে যে কোন রকমে খাপাইয়া লইয়া সেই গানটি সে গাহিবেই গাহিবে—
“তোরা—শুনেছিস কি—বসন্তের কোকিল-ঝঙ্কার!
বাঁশী কি সেতার—তার কাছে ছার—
সে গানের কাছে সকল গানের হার।”
‘কোকিল’ নামটাই তাহার চারিদিকে রটিয়া গিয়াছে। ‘কালো-কোকিল’। ওই নামেই সে এখন চারিদিকে পরিচিত।
ইহারই মধ্যে সে অনেক শিথিয়াছে, অনেক সংগ্ৰহ করিয়াছে। প্রাচীন প্রসিদ্ধ কবিয়ালগণের অনেক প্রসিদ্ধ পালাগানের লাইন তাহার মুখস্থ। হরুঠাকুর, গোপাল উড়ে, ফিরিঙ্গী কবিয়াল অ্যান্টনী সাহেব, কবিয়াল ভোলা ময়রা হইতে নিতাইয়ের মনে মনে বরণ করা গুরু কবিয়াল তারণ মণ্ডল পর্যন্ত কবিয়ালদের গল্প গান সে সংগ্ৰহ করিয়া ফেলিয়াছে। অবসর সময়ে কত খেয়ালই হয় নিতাইয়ের। বসিয়া বসিয়া ঝুমুর দলের মেয়েদের লক্ষ্মীর কথাটিকে সে একদিন পয়ার ছন্দে কবিতা করিয়া ফেলিয়াছে।
লক্ষ্মীর বারের দিন সে বসন্তকে অবাক করিয়া দিল। বসন্ত যখন ব্রতের কথা শোনা শেষ করিয়া ঘরে আসিয়া সযত্নে ঠাঁই করিয়া নিতাইকে প্রসাদ খাইতে দিল, তখন নিতাই বলিল— কথা শোনা হয়ে গেল?
–হ্যাঁ।
—তবে আমার কাছে একবার শুনে লাও।
সবিস্ময়ে বসন্ত বলিল—কি?
—লক্ষ্মীর কথা! বলিয়াই নিতাই হাতখানি বসন্তের দিকে প্রসারিত করিয়া কবিগানের ছড়া বলার সুরে আরম্ভ করিয়া দিল—
“নমো নমো লক্ষ্মী দেবী—নমো নারায়ণী—
বৈকুণ্ঠের রাণী মাগো—সোনার বরণী।
শতদল পদ্মে বৈস—তেঁই সে কমলা।
সামান্য সহে না পাপ—তাই তো চঞ্চল৷”
বসন্ত অবাক হইয়া গিয়াছিল। সে জিজ্ঞাস করিল—কোথা থেকে যোগাড় করলে? নতুন পাঁচালীর বই কিনেছ, তাতেই আছে বুঝি?
নিতাই কথার জবাব না দিয়া শুধু হাসিতে লাগিল।
—বল কেনে?
—আগে শোনই কেনে। ভনিতেতেই সব পাবে।
“অধম নিতাই কবি বসন্তের কোকিল—
লক্ষ্মীর বন্দন গায় শুনহ নিখিল!”
মুখরা দর্পিত বসন্ত উল্লাসে বিস্ময়ে অধীর হইয়া ছুটিয়া গিয়া সকলকে ডাকিয়া অনিল— ওগো মাসী, নক্ষ্মীর পাঁচালী নিকেছে!
মালী জিজ্ঞাসা করিল—কি? কে?
বসন্ত হঁপাইতে হাপাইতে বলিল—নক্ষ্মীর পাঁচালী! লিখেছে তোমার জামাই!
সেদিন সন্ধ্যায় নিজের ঘরে সে আসর করিয়া সকলকে ডাকিয় কবিয়ালের পাঁচালী শুনাইয়া তবে ছাড়িল। নিতাইকে বলিল—বেশ সুর করে বল!
নিতাইয়ের পাঁচালী-শুনিয়া দলের সকলে বিস্মিত হইয়া গেল। সত্যই পাঁচালীটি ভাল হইয়াছিল। তাহ ছাড়া, তাহাদের পরিচিত কবিয়ালের কবিগান করে, ছড়া কাটে, দুই-চারিট গানও লেখে, কিন্তু এমনভাবে ধর্মকথা লইয়া কেহ পাঁচালী রচনা করে না। সেকালের বড় বড় কবিয়ালরা করিয়া গিয়াছে, তাই আজ পর্যন্ত চলিয়াছে, ভনিতার সময়ে—সেই সব কবিয়ালদের উদ্দেশে—ইহার প্রণাম জানায়। সকলে বিস্মিত হইল যে নিতাই তেমনি পাঁচালী রচনা করিয়াছে। এবং সেই দিন হইতেই তাহার সন্ত্রম আরও বাড়িয়া গেল।
নিতাইয়ের পাঁচালীই এখন এই দলটিতে ব্ৰতকথা দাঁড়াইয়াছে। শুধু এই দলেই নয়, আর পাঁচ-সাতটা দলের ওস্তাদ এই পাঁচালী লিখিরা লইয়া গিয়াছে। পূর্ণিমায় বৃহস্পতিবারে যখন মেয়ের বসিয়া তাহার রচনা করা লক্ষ্মীর পাঁচালী বলে, তখন নিতাই বেশ একটু গভীর হইয়া উঠে। মনে মনে ভাবে, আর কী এমন রচনা করা যায়, যাহাদেশে দেশে লোকের মুখে মুখে ফেরে।

তাহার দপ্তরটিও ক্রমশ বড় হইয়া উঠিল। অনেক নূতন বই সে মেলায় কিনিয়াছে। আজকাল কলিকাতা হইতেও বই আনায়। এই সন্ধানটি শিখাইয়াছে দলনেত্রী ওই মাসী। মাসী অনেক জানে। নিতাই এক এক সময় অবাক হইয়া যায়। সে তাহাকে সত্যই শ্রদ্ধা করে। বিদ্যাসুন্দরের সন্ধান তাহাকে মাসীই দিয়াছিল। বসন্ত একদিন চুল বাঁধিতে বাঁধিতে খোপা না বাঁধিয়াই বেণী ঝুলাইয়া কি কাজে বাহিরে আসিয়াছিল। নিতাই বলিয়াছিল –বিনুনীতেই তোমাকে মানিয়েছে ভাল বসন, খোপা আর বেঁধো না।
মাসী সঙ্গে সঙ্গে ছড়া কাটিয়া দিয়াছিল—
“বিননিয়া বিনোদিয়া বেণীর শোভায়,
সাপিনী তাপিনী তাপে বিবরে লুকায়।”
নিতাই বিস্ময়বিস্ফারিত চোখে মাসীর দিকে চাহিয়াছিল। তাহার চোখের দৃষ্টি দেখিয়া হাসিয়া মাসী বলিয়াছিল—‘বিদ্যেসোন্দর’ জান বাবা? রায় গুণাকরের ‘বিদ্যেসোন্দর’?
বসন্ত, ললিতা, নির্মলা ধরিয়া বসিয়াছিল—আজ কিন্তু “বিস্তেসোন্দর’ বলতে হবে মাসী।
—সব কি মনে আছে মা! ভুলে গিয়েছি।
—তবে সেই তোমার কথাটি বল। সেটি তো মনে আছে! বসন্ত হাসিয়া ভাঙিয়া পড়িয়াছিল।
—মেলেনী মাসীর কথা? মাসী হাসিয়া আরম্ভ করিয়াছিল—
“কথায় হীরার ধার—হীরা তার নাম।
দাঁত ছোলা মাজা দোলা হাস্য অবিরাম।”
মাসী গড় গড় করিয়া বলিয়া যায়—
“বাতাসে পাতিয়া ফাঁন্দ কোন্দল ভেলায়।
পড়শী না থাকে পাছে কোন্দলের দায়।”
নিতাই মাসীর কাছে বসিয়া বিনয় করিয়া বলিয়াছিল—আমাকে বলবে মাসী, আমি খাতায় লিখে রাখব?
—আমার তো সব মনে নাই বাবা। তুমি বিদ্যেসোন্দর বই আনাও কেনে। বটতলার ছাপাখানায় নিকে দাও, ডাকে চলে আসবে। তুমি দাম দিয়ে ছাড়িয়ে লেবে। বটতলার ঠিকানা পাঁজিতে পাবে।
বিদ্যাসুন্দরের সঙ্গে সে অন্নদামঙ্গল পাইয়াছে। বইয়ের পৃষ্ঠায় বিজ্ঞাপন দেখিয়া দাশু রায়ের পাঁচালী, উদ্ভট কবিতার বইও আনাইয়াছে। দাশু রায় পড়িয়া তাহার মনের একটা সংশয় কাটিয়াছে। “ননদিনী, ব’লো নাগরে। ডুবেছে রাই রাজনন্দিনী কৃষ্ণ-কলঙ্ক-সাগরে।” এবং “গিরি, গৌরী আমার এসেছিল,—স্বপ্নে দেখা দিয়ে, চৈতন্য করায়ে চৈতন্যরূপিণী কোথায় লুকাল,” দাশু রায়ই লিখিয়াছেন; আবার খেউড়েও দাশু রায় চরম লেখা লিখিয়া গিয়াছেন। আসরে খেউড়ের পালা গাহিবার আগে সে দাশু রায়কে স্মরণ করিয়া মনে মনে প্রণাম করে।
খেউড় আর তাহাকে খুব বেশী গাহিতে হয় না, গাহিতেও আর সঙ্কোচ হয় না। কিছু দিনের মধ্যেই কবিয়াল এবং কবিগান-শ্রোতাদের মধ্যে তাহার বেশ একটা সুখ্যাতি রটিয়া গিয়াছে। তাহার ফলে লোকে এখন তাহার গান মন দিয়া শোনে; অশ্লীল খেউড়, গালিগালাজের উত্তরে সে চোথা-চোখ বাঁকা রসিকতায় গান আরম্ভ করিলে লোকে এখন তাহারই তারিফ করে। কিছুদিন আগে একটা আসরে এমনি এক কবিয়ালের সঙ্গে আসর পড়িয়াছিল। লোকটা বুড়া হইয়াছে, তবুও যত তাহার টেরির বাহার তত লোকটা অশ্লীল। খেউড়ে নাকি বুড়ার নাম-ডাক খুব। লোকে তাহাকে ‘খেউড়ের বাঘ’ বলে।
সেও একটা ঝুমুর দলের সঙ্গে থাকে। বুড়াই আগে আসর লইয়া নিতাইকে কালাচাঁদ খাড়া করিয়া নিজে বৃন্দে সাজিয়া বসিল। সেই সম্বন্ধ পাতাইয়াই চন্দ্রাবলী অর্থাৎ বসন্তকে বুড়া গালিগালাজ দিতে আর বাকী রাখিল না। তাহার সঙ্গে কৃষ্ণ হিসাবে নিতাইকে যেন জীবন্ত মাটিতে পুতিতে চাহিল। এই সম্বন্ধটি কবির পাল্লায় বড় সুবিধার সম্বন্ধ। বিশেষ যে আগে আসরে নামে, সে বৃন্দা হইয়া প্রতিপক্ষকে কালাচাঁদ করিয়া গালিগালাজের বিশেষ সুবিধা করিয়া লয়। তাহা ছাড়া প্রথম আসরে যেদিন বসন্ত তাহাকে চড় মারিয়াছিল, সেদিন প্রতিপক্ষ কবিয়াল নিতাইয়ের সঙ্গে এই সম্বন্ধ পাতাইয়াই তাহাকে যে জব্দ করিয়াছিল, সে কখাও কাহারও অজানা নাই। তাই প্রায় ক্ষেত্রেই সুবিধা পাইলেই প্রতিপক্ষ এই সম্বন্ধ পাতাইয়া বসে। লোকটা আসরে নামিয়াই খেউড় আরম্ভ করিল। নিতাইয়ের চেহারা, বসন্তের চেহারা লইয়া এবং অশ্লীল গালিগালাজ করিয়া আসর শেষ করিল।
নিতাই আসরে নামিতেই প্রৌঢ়া বলিল—বাব, সেই পুরনো পালা। খানিকটা রঙ চড়াবে নাকি?
নিতাই হাসিয়া বলিল—চড়াব বইকি! দেখি এক আসর, তারপর হবে। বলিয়াই সে আরম্ভ করিল। গানটা সেই পুরানো গান।
“এ বুড়ে বয়সে বৃন্দে–কুচকে মুখে—আর রসকলি কাটিস নে।
রসের ভিয়েন না জানিস যদি—গেঁজলা তাড়ি ঘাঁটিস নে।
শোনের নুড়ি পাকা চুলে—কাজ নেই আর আলবোট তুলে—
ও তোর-ফোক্লা দাঁতে—পড়ছে লালা—জিভ দিয়ে আর চাটিস নে।
—ও—হায়,—বুড়ি মরে না—মরণ নাই—
ও–ভয়ে যম—আসে নাকো—ও—তাই মরণ নাই।”
—ভয় কিসের? দোহারগণ, জান তোমরা যমের ভয়টা কিসের?
একজন বলিল—অরুচি, যমের অরুচি।
–উঁহু।
অন্য একজন বলিল—পাছে সেখানে পেজোমি করে, তাই।
–উঁহু। বলি চন্দ্রাবলী জান?
বসন্ত বিব্রত হইল, কি বলিলে কবিয়ালের মনোমত হইবে বা সুবিধা হইবে সে জানে না, তবু সে ঠকিবার মেয়ে নয়, সে বলিল—বুড়ী পাছে যমের সঙ্গে পিরীত করতে চায়, তাই সে ওকে নেয় না।
নিতাই বাহা-বাহা করিয়া উঠিল। লোকেও একেবারে হাসিয়া ভাঙিয়া পড়িল। ঠিক ঠিক। বলিয়াই সে গান ধরিয়া দিল—
“ও পাছে, পিরীত করিতে চায়—যম ওরে নেয় না তাই—
ও তোর পায়ে ধরি—ওরে বুড়ি—ফোকলা দাঁতে হাসিস নে।
যমকে ভালবাসিস্‌ নে।”
নিতাইয়ের মিলের বাহারে, মিঠাগলার মাধুর্যে, ব্যঙ্গ-শ্লেষের তীক্ষতায় জমিয়া উঠি বেশ। সঙ্গে সঙ্গে বসন্ত নাচে। বসন্তও আজকাল তেমন অশ্লীল ভঙ্গি করিয়া নাচে না, তবে নাচে সে বিভোর হইয়া। লোকে পছন্দ করে। জনতার এক একটা অংশ অবশ্য অশ্লীল ইঙ্গিত করিয়া চীৎকার করে, কিন্তু বেশী অংশ তারিফই করে। দুই-দশজন ভদ্রলোককেও ক্রমে জমিতে দেখা যায় নিতাইয়ের পালার আসরে। নিতাইও অবসর বুঝিয়া গানকে আনিয়া ফেলে মিষ্ট রসের খাতে।
সে গান ধরে—
“(তোমায় ) ভালোবাসি ব’লেই তোমার সইতে নারি অসৈরণ,
নইলে তোমায় কটু বয়ার চেয়ে ভাল আমার মরণ।”
সে আরম্ভ করে, তুমি বৃন্দে—তুমিই তো আমার প্রেমের গুরু—তুমিই তো আমাকে রাধাকে চিনাইয়াছ—তুমিই তো রচনা করিয়াছ—পূর্ণিমায় পূর্ণিমায়—কুঞ্জশয্যা, আমাদের সম্মুখে রাখিয়া—তুমিই তো গাহিয়াছ—যুগল-রূপের মাধুরী— ওগো দূতী—সেই তোমার এই বৃদ্ধ বয়সে এই মতিভ্ৰম দেখিয়া মনের যাতনায় তোমাকে কটু কথা বলিয়াছি। তুমি নিজেই একবার ভাবিয়া দেখ তোমার নিজের কথা।
“রসের ভাণ্ডারী তুমি–কথা তোমার মিছরীর পানা
সেই তুমি আজ হাটে বেচ–সন্তা খেউড় ঘুগনীদানা৷ ”
আসরের মোড় ফিরাইয়া দেয় নিতাই। বসন্ত রাগ করে। কেন শেষকালে লোকটাকে এমন ধারার মিষ্ট কথা বলিলে?
সে বলে—ওকে বিঁধে বিঁধে মারতে হ’ত। খাতির কিসের?
নিতাই হাসিয়া বলে—বসন, নরম গরম পত্রমিদং, বুঝলে? নরম গরম—মিঠে কড়া — বুঝলে কিনা—ওতেই আসর মাৎ। তারপর বুঝাইয়া বলে—লোকটার বয়েস হয়েছে—প্ৰাণে দুঃখ দিলে কি ভাল হ’ত? তুমিই বল।
বসন্ত ইহার পর চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। নিতাই হাসিয়া বলে—রাগ করলে বসন?
বসন্ত হাসিয়া বলে—না।
—তবে?
—তবে ভাবছি, তুমি আমাকে সুদ্ধ নরম করে দিলে।
নিতাই হাসে।
বসন্ত বলে—সে চড় মনে পড়ে?
—সে চড় না খেলে কোকিল তোমার ডাকতে শিখত না। ও আমার গুরুর চড়।
বসন্ত আজ তাহার গলা জড়াইয়া ধরে। নিতাই তাহার মাথায় সস্নেহে হাত বুলাইয়া দেয়।

খেউড়, যাহাকে বলে কাঁচা খেউড় অর্থাৎ নগ্ন অশ্লীলতার গানা,—সেও তাহাকে গাহিতে হয়। দুই একটা স্থানে, গভীর রাত্রে এমন গান না গাহিলে চলে না। শ্রোতারা দাবী করে। আবার এমনও আসর আসে যেখানে এই বুড়ার মত প্রতিদ্বন্দ্বীরা হটিয়া হটিয়া গিয়া নিজের আস্তাকুঁড়ে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে নিতাইকেও টানিয়া আনে। আসর ও প্রতিদ্বন্দ্বী দেখিয়া গোড়াতেই তাহা বুঝা যায়! একটা পালাগানের পরেই সেদিন তাহার চেহারাটা হইয়া উঠে থমথমে। চোখ দুইটা ইয়া উঠে উগ্র। প্রথম হইতেই সে স্তব্ধ হইয়া যায়। দলের লোকেরাও বুঝিতে পারে, আজ লাগিল। বসন্ত এবং প্রৌঢ়া বুঝিতে পারে সর্বাগ্রে।
প্রৌঢ়া বলে—বসন! ইঙ্গিত করিয়া সে হাসে।
বসন্ত উত্তর দেয়—হ্যাঁ মাসী।
সে আসর হইতে বাহির হইয়া যায়, সেখান হইতে নিতাইকে ডাকে—শোন।
প্রৌঢ়া তাহাকে সচেতন করিয়া দেয়–বাবা! ডাকছে তোমাকে। বাবা গো!
নিতাই চমকির উঠে। তারপর গভীর মুখেই বাহিরে যায়, বসন্তের কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়া হাত বাড়ায়। সে জানে কিসের জন্য বসন্ত তাহাকে ডাকিয়াছে। গ্লাস পরিপূর্ণ করিয়া বসন্ত মদ ঢালিয়া তাহার হাতে তুলিয়া দেয়। নিঃশেষ করিয়া গ্লাস ফিরাইয়া দিয়া নিতাই আসিয়া আসরে বসে আর এক চেহারা লইয়া।
তারপর রাত্রির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আসর মাতিতে থাকে—থেউড়ে অশ্লীলতায়। প্রতি আসরের পূর্বেই বসন্ত পরিপূর্ণ মাস মদ তুলিয়া দেয় তাহার হাতে। সে খায়। মধ্যে মধ্যে নিজে ঢালিয়া বসন্তকে খাওয়ায়। বসন্তর মুখেও হাসি ফুটিয়া উঠে। সেদিন আসরে আর কিছু বাকী থাকে না। নিতাইয়ের রক্তের মধ্যে, মস্তিষ্কের মধ্যে সেদিন মদের বিশেষ স্পর্শ পাইয়া জাগিয়া উঠে-তাহার জন্মলন্ধ বংশধারার বিষ; সমাজের আবর্জনা-স্তূপের মধ্য হইতে যে বিষ শৈশবে তাহার মধ্যে সঞ্চারিত হইয়াছিল, সে বিষ তাহর মধ্যে জাগিয়া উঠে রক্তবীজের মত। ভাষায়—ভাবে—ভঙ্গীতে অশ্লীল কদর্য কোন কিছুঁই তাহার মুখে বাধে না। শুধু তাই নয়—সেদিন সে এমন উগ্র হইয় উঠে যে, সামান্য কারণেই যে কোন লোকের সহিত ঝগড়া বাধাইয়া তাহাকে মারিতে উদ্যত হয়।
প্রৌঢ়া সেদিন দলের লোককে সাবধান করে। বলে–হাতী আজ মেতেছে বাবা। তোরা একটুকুন সমীহ ক’রে সয়ে থাক। তোরা সব কত সময়ে কত বলিস। ও তো সব সয়।
নির্মলা হাসিয়া বলে—মাউতকে ( মাহুত ) বল মাসী।
প্রৌঢ়া হাসে—সে বসন্তের দিকে চায়। বসন্তও হাসে। এমন দিনে বসন্তের সে হাসি অদ্ভুত হাসি।
বসন্তের মুখে এই হাসি দেখিয়া নির্মল খিলখিল করিয়া হাসে; বলে—কি লো হাসতে গিয়ে যে গলে পড়েছিস বসন।
বসন্তের মস্তিক্ষেও মদের নেশা–চোখ তাহার ঢুলঢুল করে। সে তবুও হাসে কারণ এমন দিনটি তাহার বহু প্রত্যাশার দিন। এমন দিনেই নিতাই—বসন্তকে পরিপূর্ণভাবে ধরা দেয়। বসন্তকে লইয়া সে অধীর হইয় উঠে।
সবল বাহুর দোলায় বসন্তকে তুলিয়া লইয়া দোলায়; কখনও কখনও শিশুর মত উপরের দিকে ছুড়িয়া দিয়া আবার ধরিয়া লয়। মাথার উপর বসন্তকে তুলিয়া লইয়া নিজে নাচে। বসন্ত নির্জীবের মত ক্লান্ত হইয়া এলাইয়া পড়িলে তবে তাহার নিষ্কৃতি। তবুও এমন দিনটি বসন্তের বহু প্রত্যাশার দিন।
সহজ শান্ত নিতাই আর এক মানুষ—সে আদরে যত্নে বসন্তকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত করিয়া রাখে, কিন্তু দাঁড়াইয়া থাকে বসন্তের নাগালের বাহিরে।
তখন বসন্ত আপনা হইতে তাহার গলা জড়াইয়া ধরিলে সে তাহাকে টানিয়াও লয় না, আবার ঠেলিয়া সরাইয়াও দেয় না। তাহার মাথায় কিংবা পিঠে হাত বুলাইয়া দেয়—বসন্ত যেন কত ছেলেমানুষ। কিন্তু তাহাকে উপেক্ষাও করা যায় না—এমন পরম সমৃদর আছে তাহার মধ্যে।
বসন্ত ছুতানাতা করিয়া অভিমান করে, কাঁদে।
নিতাই হাসিয়া তাহার চোখ মুছাইয়া দেয়। বলে—তুমি কাঁদলে আমি বেথা পাই বসন। তার পর গুন গুন করিয়া গান ধরে—
“তোমার চোখে জল দেখিলে সারা ভুবন আঁধার দেখি!
তুমি আমার প্রাণের অধিক জেনেও তাহা জান নাকি?”
সঙ্গে সঙ্গে বলে–বল সত্যি কি না!
বসন্ত মনে মনে খুশী হয়। মুখে তাহার হাসি ফোটে। নিজেই চোখ মুছিয়া সে বলে— বলব না। হ্যাঁ, কোকিল বটে আমার! বাহারের গান হয়েছে। শেষ কর। নিকে রাখ।
কিন্তু শেষও হয় না, লিখিয়া রাখাও হয় না। অসমাপ্ত গানগুলা হারাইয়া যায়।
এই সেদিন একদিন—নিতাই যে গানটি গাহিল, সে গানটি শুনিয়া বসন্তের কান্না দ্বিগুণ হইয়া উঠিল।
নিতাইয়ের মনে পড়িয়া গেল বসন্তর সেই প্রথম রূপ। বসন্তর চোখে সে কি প্রখর চাছনি সে দেখিয়াছিল। আজ সেই বসন্তই কাঁদিতেছে।
নিতাই হাসিয়া গান ধরিয়া দিল—
“সে আগুন তোমার গে-লো কোথা শুধাই তোমারে?
ও তোমার নয়নকোণে আগুন ছিল জ্বলত ধিকি ধিকি হে,
আয়নাতে মুখ দেখতে গিয়ে—দেখে নি কি সখি হে?
ও হায়—সে আগুন আজ জল হ’ল কি পুড়াইয়ে আমারে?
শুধাই তোমারে! ”
গান শুনিয়া বসন্তের কান্না দ্বিগুণ হইয়া উঠিল। অনেক সাধ্য-সাধনা করিয়া তবে বসন্ত ক্ষান্ত হইল।
পরদিন সকালে উঠিয়াই কিন্তু বলিল—গানটি শেষ কর, আমি শিখে তবে উঠব। তারপর বলিল—তোমাকে চড় মেরেছিলাম, সে কথা তুমি ভোল নাই তা হ’লে?
নিতাই বলিল—ভগবানের দিব্যি বসন—
বাধা দিয়া বসন্ত বলিল—না না। আমি ঠাট্টা করছিলাম। আবার হাসিয়া বলিল—এই তো, তুমিও তো ঠাট্টা বুঝতে পার না।
বসন্তও তাহাকে অনেক শিখাইয়াছে। সে তাহাকে টপ্পাগান শিখাইয়াছে। টপ্পাগান নিতাইয়ের বড় ভাল লাগে। এই তো গান। পদাবলীর ‘পিরীতি’ এক, আর টপ্পার ভালবাসা অন্য জিনিস–একেবারে খাঁটি ঘরোয়া পিরীতি। টপ্পার সঙ্গে নিধুবাবুর নামও সে জানিয়াছে। বসন্তই বলিয়া দিয়াছে। মনে মনে সে নিধুবাবুকে হাজার বলিহারি দেয়। এই না হইলে গান!
“তারে ভুলিব কেমনে।
প্রাণ সঁপিয়াছি যারে আপন জেনে ৷”
কিংবা—
“ভালবাসিবে ব’লে ভালবাসি নে।
আমার স্বভাব এই, তোমা বই আর জানি নে।”
আহা হা! এ যেন মিছরীর পান। নিতাই মিছরীর পানার সহিত তুলনা দেয়। নিতাইয়ের সাধ, সে এমনই গান বাঁধিবে—সে মরিয়া যাইবে, নূতন কবিয়াল নুতন ছোকরার তাহার গান গাহিবে আর বলিবে—বাহবা! বাহবা! বাহবা!
অহরহই তাহার মনে গানের কলি গুন গুন করে।

আবার মধ্যে মধ্যে নিতাই কেমন উদাসীন হইয়া উঠে। মনে পড়িয়া যায় সেই রেলস্টেশন। সেই তাহাকে।
গ্রামপথে চলিবার সময় দ্বিপ্রহরে—দূরে পথের বাঁকে—হঠাৎ রোদের ছটায় ঝকমক করিয়া উঠে স্বর্ণবিন্দুর মত একটি বিন্দু। বাংলাদেশে পল্লীগ্রামে–এই সময়টাই জলখাবারের সময়, গরু খুলিবার বেলা, এই সময়েই কৃষকবধূরা মাঠে যায় পুরুষের জলখাবার লইয়া, গৃহস্থঘরে দুধের যোগান দিবার সময়ও এই। মাঠের পথে—গ্রামের পথে-ঘটি মাথায় চলন্ত কৃষকবধূদের রৌদ্রচ্ছটা প্রতিবিম্বিত ঝকমকে বিন্দুটি দেখিলেই নিতাইয়ের মন উদাস হইয় উঠে।
তাহার মনে পড়ে সেই কাশফুলের মাথায় সোনার টোপর। ঠাকুরঝি! সঙ্গে সঙ্গে, সব বিস্বাদ হইয়া যায়। এসব তাহার আর কিছুঁই ভাল লাগে না। ইচ্ছা হয় এইখান হইতেই সে ছুটিতে আরম্ভ করে, ফিরিয়া যায় তাহার সেই গ্রামে। কৃষ্ণচূড়ার তলাটিতে বসিয়া রেললাইনের বাঁকের দিকে তাকাইয়া থাকে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে তাহার সেই পুরানো বাঁধা গান—“ও আমার মনের মানুষ গো, তোমার লাগি পথের ধারে বাঁধিলাম ঘর।”
—নাঃ! পরক্ষণেই দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলে—না। চাঁদ, তুমি আকাশে থাক। ঠাকুরঝি তুমি মুখে থাক। সংসার তোমার মুখের হোক।
আর ফিরিয়া যাইবারই বা তাহার সময় কই? পাঁচদিন আবার আসর বসিবে, এবার আর ঝুমুরদলের কবিয়ালের সঙ্গে পাল্লা নয়। আসল কবিয়ালের সঙ্গে পাল্লা। তারণ কবিয়াল, মহাদেব কবিয়াল, নোটন কবিয়ালের মত দস্তুরমত কবিয়ালের সঙ্গে পাল্লা হইবে। একটা মেলার আসরে কবিয়াল হিসাবে পাল্লা দিবার জন্য তাহাকে শুধু বায়না করিতে আসিয়াছিল। ঝুমুরদলের সঙ্গে কোন সংস্রবই নাই। তবু সে বলিয়াছে—উহারা ভিন্ন তাহার দোহারের কাজ কেহ করিতে পরিবে না। সুতরাং উহারাও যাইবে।
এ বায়নার পর দল চলিবে ধুলিয়ান অঞ্চলের দিকে। সে চলিয়া গেলে কি করিয়া চলিবে? দলট কানা হইয়া যাইবে যে। সে যে তাহারই বিশ্বাসঘাতকতা করা হইবে। তা ছাড়া— বসন্ত আছে। বসন্তকে সে কথা দিয়াছে। সে যতদিন বাঁচিয়া আছে ততদিন সে তো তাহাকে ছাড়িয়া যাইতে পারিবে না। মনে পড়ে গাঁটছড়া বাঁধার কথা। কথা আছে—যে কেহ একজন মরিলে তবে এ গাঁটছড়া খুলিয়া লইবে অপর জন। ভাবিতে ভাবিতেও সে শিহরিয়া উঠে। বসন্তের মৃত্যুকামনা করিতেছে সে? না না। ঠাকুরঝি, তুমি দূরেই থাক—সুখেই থাক—তোমার সঙ্গে দেখা হয়তো হইবে না। সে বসন্তের কালো-কোকিল—যেখানে বসন্ত সেবখানে ছাড়া অন্য কোখাও যাইতে পারে না সে। বসন্ত বাঁচিয়া থাক—সে সুস্থ হইয়া উঠুক—বসন্তকে লইয়াই এ জীবনটা সে কাটাইয়া দিবে। এই তে কয়দিনের জীবন। কয়টা দিন। ইহার মধ্যে—বসন্তকে ভালবাসিয়াই কি ভালবাসার শেষ করিতে পরিবে সে? ইহার পর আবার ঠাকুরঝিকে ভালবাসিবে? এমনি করিয়াই তো একদিন ঠাকুরঝিকে ছাড়িয়া—তাহাকে ভালবাসার লীলাটা অসমাপ্ত রাখিয়া-চলিয়া আসিয়া বসন্তকে পাইয়াছে, তাহাকে ভালবাসিতে শুরু করিয়াছে। আবার বসন্তকে ছাড়িয়া ঠাকুরঝির কাছে? না। এই ভাল।
তবুও তাহার ভাল লাগে না। সে দল হইতে বাহির হইয়া গিয়া মাঠে বসিয়া থাকে।
কখনও আপনিই একসময় চকিত হইয়া উঠিয়া ফিরিয়া আসে, কখনও বা দল হইতে কেহ যায়, ডাকিয়া আনে।
বসন্ত বলে—এই দেখ, এইবার তুমি ক্ষেপে যাবে।
নিতাই নিবিষ্টচিত্ততার মধ্যেই হাসে—কেনে? কি হ’ল?
—সকাল থেকে মাঠে মাঠে ঘুরে এলে। খেতে-দেতে হবে না?
—ভারি ভাল কলি মনে এসেছে বসন। শোন—
—না, এখন নাও দিকিনি!
—না। আগে শোন। বলিয়াই সঙ্গে সঙ্গে সুর ভাঁজিয়া আরম্ভ করে—
“এই খেদ আমার মনে মনে।
ভালবেসে মিটল না আশ–কুলাল না এ জীবনে।
হয়, জীবন এত ছোট কেনে?
এ ভূবনে?”
মুহূর্তে একটা কাণ্ড ঘটিয়া গেল। বসন্ত স্থির দৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া গান শুনিতেছিল। গানটা শুনিয়া সে যেন পাথর হইয়া গেল।
নিতাই সচকিত হইয়া প্রশ্ন করিল—বসন! কি হ’ল বসন? বসন!
ধীরে ধীরে দুই চোখের কোণ হইতে দুটি জলের ধারা গড়াইয়া আসিল বসনের। সে বলিল —এ গান তুমি কেনে লিখলে কবিয়াল?
—কেনে বসন?
ক্লান্ত বিষন্ন কণ্ঠে সে বলিল—আমি তে এখন ভাল আছি কবিয়াল—তবে তুমি কেনে লিখলে, কেনে তোমার মনে হ’ল জীবন এত ছোট কেনে?
অকারণে নিতাইয়ের বুকটা ধড়াস করিয়৷ উঠিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *