কবি – ০৩

কবি – ০৩

নিতাই মিথ্য শপথ করে নাই। সত্যই নিতাই জীবনে কখনও চুরি করে নাই। তাহার আত্মীয়স্বজন গভীর রাত্রে নি:শবপদসঞ্চারে নির্ভয় বিচরণের মধ্যে যে উদ্বেগময় উল্লাস অনুভব করে, সে উল্লাসের আস্বাদ সত্যই নিতাইয়ের, রক্তকণিকাগুলির কাছে অজ্ঞাত। খ্ৰীক বীর আলেকজাগুরের সম্মুখীন থেসিয়ান দমুর মত ন্তায়ের তর্ক এখানকার বীরবংশীরা জানে না বটে, তবে নীতি ও ধর্মের কথা শুনিয়া তাহারা ব্যঙ্গ করিয়া হাসে। এবং নিতাইয়ের এই চৌর্যবৃত্তি-বিমুখতার জন্য তাহার। তাহার মধ্যে আবিষ্কার করে একটি ভীরুতাকে, এবং তাহার জন্ম তাহারা তাহাকে ঘৃণা করে।
কেমন করিয়া সে এমনটা হইল তাহার ইতিহাস অজ্ঞাত। তাচ্ছিল্যভরে কেই লক্ষ্য করে নাই বলিয়াই সম্ভবত অলক্ষ্যে হরাইয়া গিয়াছে। তবে একটি ঘটনা লোকের চোথে বার বার পড়িয়াছিল। এবং ঘটনাটি লোকের চোখে এখনও ভাসে। রোজ সন্ধ্যায় নিতাইচরণ বইয়ের দপ্তর বগলে করিয়া কালি-পড়া লণ্ঠন হাতে নাইট ইস্কুলে চলিয়াছে। স্থানীয় জমিদারের মায়ের স্মৃতিরক্ষার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত নৈশবিদ্যালয়ে নিতাই পড়াশুনা করিয়াছিল। সেকালে ডোমপাড়ার অনেকগুলি ছেলেই পড়িত। ছাত্রসংগ্রহের উদ্দেশ্যে জমিদার একখানা করিয়া কাপড় দিবার ঘোষণার ফলেই বীরবংশীর দল ছেলেদের পাঠশালায় আনিয়া ভর্তি করিয়া দিয়াছিল। সঙ্গে সঙ্গে নিতাইও আসিয়াছিল। বৎসরের শেষে কাপড় লইয়া দ্বিতীয় ভাগের চোর বেণীর গল্প পড়িবার পূর্বেই ডোমেদের ছেলেগুলি পাঠশালা হইতে সরিয়া পড়িল, কেবল নিতাই-ই থাকিয়া গেল। নিতাই পরীক্ষায় ফাস্ট হইয়াছিল বলিয়া কাপড়ের সঙ্গে একটা জামা ও একখানা গামছা এবং তাহার সঙ্গে একটা লণ্ঠন পাইল। এই প্রাপ্তিযোগের জন্যই সকলে পাঠশালা ছাড়িলেও নিতাই ছাড়ে নাই। সে সময় ছেলে কাপড়, গামছা, জামা ও লণ্ঠন চার দক পুরস্কার পাওয়াতে নিতায়ের মাও বেশ খানিকট গৌরবই অনুভব করিয়াছিল। বংশধারা-বিরোধী একটি অভিনব গৌরবের আস্বাদও বোধ করি নিতাই পাইয়াছিল। ইহার পর আরও বৎসর দুয়েক নিতাই পাঠশালায় পড়িয়াছিল। এই দুই বৎসরে পুরস্কার হিসাবে কাপড়, জাম, গামছা; লণ্ঠন ছাড়াও নিতাই পাইয়াছিল খানকয়েক বই—শিশুবোধ রামায়ণ, মহাভারতের কথা, জানোয়ারের গল্প। সেগুলি নিতাইয়ের কণ্ঠস্থ। নিতাই সুযোগ পাইলে আরও পড়িত, কিন্তু একমাত্র নিতাই ছাড়া পাঠশালায় আর দ্বিতীয় ছাত্র না থাকায় পাঠশালাটিই উঠিয়া গেল। অগত্য নিতাই পাঠশালা ছাড়িতে বাধ্য হইল। ততদিনে তাহার বিদ্যাকুরাগ আর এক পথে শাখা বিস্তার করিয়াছে। এ দেশে কবি গানের পাল্লার সে মস্ত ভক্ত হইয়া উঠিয়াছে। বাংলার সমগ্র অশিক্ষিত সম্প্রদায়ই কবিগানের ভক্ত। কিন্তু সে ভক্তি তাহাদের অনীল কুসিকতার প্রতি আসক্তি। নিতাইয়ের আসক্তি অন্তরূপ। পুরাণ-কাহিনী, কবিতার ছন্মিল এবং উপস্থিত বুদ্ধির চমক-দেওয়া কৌতুকও আহার ভাল লাগে।
মামাতে মাসতুতে ভাইয়েরা নিতাইকে ব্যঙ্গ করিয়া এতদিন বলিত-পণ্ডিত মশায়! এইবার তাহারা তাহাকে দলে লইয়া দীক্ষা দিতে ব্যগ্র লইয়া উঠিল। অর্থাৎ রাত্রির অভিযানের দলে তাহারা তাহাকে লইতে চাহিল।
মামা গৌরচরণ সস্তু পাঁচ বৎসর জেল খাটিয়া ঘরে ফিরিয়াছে। সে বোনকে ডাকিয় গম্ভীর ভাবে বলিল–নিতাইকে এবার বেরুতে বল। নেকাপড় তো হ’ল।
গৌরচরণের গম্ভীর ভাবের কথার অর্থ—তাহার আদেশ। নিতাইয়ের মা আসিয়া ছেলেকে বলিল—তোর মামা বলছে, এইবার দলের সঙ্গে যেতে হবে তোকে।
নিতাই মায়ের দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বলিল—ছি! ছি! ছি! গভধারিণী জননী হয়ে এই কথা তু বলছিস আমাকে!
নিতাইয়ের মা হতভম্ব হইয়া গেল।
নিতাইয়ের মামা চোখ লাল করিয়া আসিয়া সম্মুখে দাঁড়াইয়। বলিল—কি বলছিস মাকে? হচ্ছে কি?
নিতাই তখন পুরানো খাতাটায় রামায়ণ দেখিয়া হাতের লেখা অভ্যাস করিতেছিল। সে নিৰ্ভয়ে বলিল—লিখছি।
–নিকছিল? গৌর আসিয়া খাতাটা ও বইখান টান মারিয়া ছড়িয়া ফেলিয়া দিল। নিতাইও সঙ্গে সঙ্গে উঠিয়া দাঁড়াইল। ধীরে ধীরে মামাকে অতিক্রম করিয়া সে খাতা ও বই কুড়াইয়া লইয়া নিজেদের পাড়া পরিত্যাগ করিয়া বাহির হইয়া পড়িল। গ্রাম খুঁজিয়া সেই দিনই সে ঘনশ্যাম গোঁসাইয়ের বাড়ীতে মাহিদারী চাকুরিতে বাহাল হইল।
গোঁসাইজী বৈষ্ণব মানুষ, ঘরে সন্তানহীন স্থূলকায়৷ গৃহিণী, উভয়েরই দুগ্ধপ্রতি মার্জরের মত। ঘরে দুইটি গাই আছে, গাই দুইটি এতদিন রাত্রে স্বেচ্ছামত বিচরণ করিয়া প্রভাতে ঘরে আসিয়া দুধ দিত। কিন্তু ইদানীং কলিকাল অকস্মাৎ যেন পরিপূর্ণ কলিত্ব লাভ করিয়াছে বলিয়া গ্রামের লোকের গো-ব্রাহ্মণে ভক্তি একেবারেই বিলুপ্ত হইয়াছে। সেই কারণে র্তাহার গাভী দুইটিকে গত দুই মাসে পনেরো বার লোকে খোয়াড়ে দিয়াছে। বাধ্য হইয়া গোর্সাইজী গাভী-পরিচর্যার জন্য লোক খুঁজিতেছিলেন। নিতাইকে পাইয়া বাহাল করিলেন। নিতাইয়ের সহিত শর্ত হইল, সে গাভীর পরিচর্য করিবে, বাসন মাজিবে, প্রয়োজনমত এখানে ওখানে যাইবে, রাত্রে বাড়িতে প্রহর দিবে। গোঁসাইজীর মুদী কারবারে মূল এক শত মণ ধান এখন সাত শত মণে পরিণত হইয়াছে। ঘরের উঠানেও একটি ধানের স্তুপ বারোমাস জড়ো হইয়াই থাকে। খাতকের রোজই কিছু কিছু ধান শোধ দিয়া যায়। গোঁসাইজী স্ফীতোদর মরাই ও নিজের বিশীর্ণ দেহের দিকে চাহিয়া নিয়তই চিন্তায় পীড়িত হইতেছিলেন। বলিষ্ঠ যুবক নিতাইকে পাইয়া তিনি আশ্বস্ত হইলেন। নিতাই গোঁসাইজীর বাড়ীতেই বসবাস আরম্ভ করিল।
দিন কয়েক পরেই, সেদিন ছিল ঘন অন্ধকার রাত্রি। গভীর রাত্রে গোঁসাই ডাকিলেন – নিতাই!
বাহিরে খুটখাট শব্দে নিতাইয়ের ঘুম ভাঙিয়া গিয়াছিল, সে জাগিয়াই ছিল, সে ফিসফিস করিয়া বলিল—আজ্ঞে, আমি শুনেছি।
—গোলমাল করিস না, উঠে আয়। গোঁসাইজী অগ্রসর হইলেন। নিতাই শীর্ণকায় গোঁসাইজীর অকুতোভয়ত দেখিয়া শ্রদ্ধাম্বিত হইয়া উঠিল। গোঁসাই আসিয়ু নি:শব্দে বাহিরের দুয়ার খুলিয়া বাহির হইলেন। • বাহিরে চারজন লোক, তাহদের মাথায় বোঝাইকরা চারটি বস্তা। ভারে উত্তেজনায় লোকগুলি ইপিাইতেছে এবং থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। দরজা খুলিতেই নিঃশব্দে লোক চারিজন চুকিয়া উঠানের ধানের গাদায় বস্তা চারিটা ঢালিয়া দিল। রক্রির অন্ধকারের মধ্যেও নিতাই ধানের সেনার মত রং প্রত্যক্ষ করিল। লোকগুলিকেও সে চিনিল, তাহার আত্মীয় কেহ না হইলেও প্রত্যেকেই খ্যাতনামা ধানচোর।
সকালবেলাতেই জোড়হাত করিয়া গোঁসাইজীকে নিতাই বলিল-প্রভু, আমি মাশার কাজ করতে পারব না!
—পারবি না!
—আজ্ঞে না।
—এক পয়সা মাইনে আমি দেব না কিন্তু। আর এ কথা প্রকাশ পেলে তোমার জান থাকবে না।
নিতাই.কথার উত্তর করিল না। তাহার কাপড় ও দপ্তর লইয়া সে বাহির হইয়া পডিল। আসিয়া উঠিল গ্রামের স্টেশনে।

স্টেশনের পয়েণ্টসম্যান রাজা বায়েন তাহার বন্ধু। রাজালাল একটু অদ্ভুত ধরণের লোক। বিগত মহাযুদ্ধের সময় তাহার ছিল তরুণ বয়স, সে ঘটনাচক্রে কুলি হিসাবে গিয়া পড়িয়াছিল মেসোপটেমিয়ায়। ফিরিয়া আসিয়া কাজ করিতেছে এই লাইট রেলওয়েতে। প্রাণখোলা দিলদরিয়া লোক, অনর্গল ভুল হিন্দী বলে, ঘড়ির কাটার মত ডিউটি করে, বার ছয়-সাত চা খায়, প্রচুর মদ খায়, ভীষণ চীৎকার করে, স্ত্রীপুত্রকে ধরিয়া ঠেঙায়। রাজার সঙ্গে নিতাইয়ের আলাপ অনেক দিনের, অর্থাৎ রাজার এখানে আসিবার পর হইতেই আলাপ, সে প্রায় তিন বৎসর আগের ঘটনা।

নিতাই সেদিনও, অর্থাৎ প্রথম আলাপের দিনও স্টেশনে বেড়াইতে আসিয়াছিল, রাজার ছেলেট ট্রেন আসিবার ঘণ্টা বাজিতেই হাঁকিতে শুরু করিয়াছিল—হট যাও! হট যাও! লাইনের ধারসে হট যাও!
নিতাইয়ের বড় ভাল লাগিয়াছিল, সে প্রশ্ন করিয়াছিল—বাহা রে! কাদের ছেলে হে তুমি?
—আমি রাজার ছেলে।
—রাজার ছেলে? কেয়াবাৎ! তবে তো তুমি ‘যোবরাজ’!
রাজা ছিল কাছেই, সে নিতাইয়ের কথা শুনিয়া হাসিয়াই সারা। সঙ্গে সঙ্গে সে নিতাইয়ের সঙ্গে আলাপ জমাইয়া ফেলিয়াছিল। ট্রেন চলিয়া যাইতেই রাজা নিতাইকে ধরিয়া লইয়া একেবারে তাহার কোয়ার্টারে আনিয়া হাজির করিয়াছিল। স্ত্রীকে বলিল—আমার বন্ধুনোক! উমদা’আদমী! ফটকেটাকে বলে—রাজার বেটা যোবরাজ। বলিয়া সে কি তাহার হা-হা করিয়া হাসি!
নিতাই উৎসাহভরে কবিয়ালদের নকল করিয়া গালে হাত দিয়া, মুখের সম্মুখে অপর হাতটি রাখিয়া ঈষৎ ঝুকিয় রামায়ণ স্মরণ করিয়া গান ধরিয়াছিল—

রাজার বেটা যোবরাজা,                   ভেজার বেটা মহাতেজা
খায় সে খাস্তা খাজা গজা
বিদিত ভো-মগুলে!

রাজা লাফ দিয়া ঘরের ভিতর হইত্তে তাহার পৈতৃক ঢোল ও তাহার নিজের কাঁসি বাহির
করিয়া আনিয়। নিজে লইয়াছিল ঢোলটা—ছেলেটার হাতে দিয়াছিল কাঁসিটা। ওই কাঁসিটা রাজার বাবা রাজাকে কিনিয়া দিয়াছিল মহেশপুরের মেলায়। সেদিন .দ্বিপ্রহরেই কবিগান জমির উঠিয়াছিল রাজার ঘরে। নিতাই রাজার ছেলেকে যোবরাজ বলিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, রাজার পরিবারের দিকে ফিরিয়া গাহিয়াছিল—

রাজার ঘরের ঘরণী যিনি—তিনি মহামান্যা রাণী—
তিনি থান বড় বড় ফেনী—
সর্বলোকে বলে।

ঠিক এই সময় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল আর একজন। পনের-ষোল বছরের একটি কিশোরী। মেয়েটির রং কালো, কিন্তু দীঘল দেহভঙ্গীতে ভূঁইচাপার সবুজ সরল ডাটার মত একটি অপরূপ শ্ৰী। মেয়েটির মাথায় কাপড়ের বিড়ার উপর তকতকে মাজা একটি বড় ঘটী, হাতে একটি ছোট গেলাস; পরনে দেশী তাঁতের মোটা সূতার থাটো কাপড়। মোট সূতার খাটো কাপড়খানির আঁটোসাঁটো বেষ্টনীর মধ্যে তাহার ছিপছিপে কালো দীঘল দেহখানির স্বাভাবিক খাজগুলিকে প্রকট করিয়া যেন একটি পোড়ামাটির পুতুলের মত দেখায়। মেয়েটি রাজার শ্যালিকা, পাশের গ্রামের বধূ। সে এই বর্ধিষ্ণু গ্রামখানিতে প্রত্যহ দুধের যোগান দিতে আসে। রাজার স্টেশনে গাড়ী আসে ঘড়ির কাঁটা ধরিয়া, আর এই মেয়েটি আসে—পশ্চিমসমীপবর্তী দ্বিপ্রহরের সুর্যের অগ্ৰগামিনী ছায়ার মত। মেয়েটির সরল ভীরু দৃষ্টিতে বিস্ময় যেন কালো জলের স্বচ্ছতার মত সহজাত। সেদিন সবিস্ময়ে কিছুক্ষণ এই দৃশ্য দেখিয়া অকস্মাৎ এই সরল মেয়েটি হাসিতে আরম্ভ করিয়াছিল—অসঙ্কোচ খিলখিল হাসি।
রাজার স্ত্রী কিন্তু কঠিন মেয়ে, সে বোনকে ধমক দিয়াছিল—হাসিস না ফ্যাক ফ্যাক ক’রে। বেহায়া কোথাকার!
মুহূর্তে মেয়েটির হাসি বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু সে রাগ করে নাই বা দুঃখিত হয় নাই, স্বচ্ছন্দে শাসন মানিয়া লওয়ার মত বেতসলতাসুলভ একটি নমনীয়তা তাহার স্বভাবজাত গুণ। দেহখানিই শুধু লতার মত নয়, মনও যেন তাহার দীঘল দেহের অনুরূপ।
নিতাইও থামিয়া গিয়াছিল। ধরতার সময় পার হইয়া গেল, তবু নিতাই আর গান ধরিল না দেখিয়া রাজা বাজনা বন্ধ করিল। এবং মেয়েটিকে বলিল—দেখত কেয়৷ ঠাকুরঝি? হামারা মিতা। ওস্তাদ আদমী। হামারা নাম হায় রাজা, তো ফটকেকো নাম দিয়া যোবরাজ, তোমারা দিদিকে নাম দিয়া রাণী —বলিয়াই অট্টহাসি।
এবার অট্টহাসির ছোঁয়াচে রাণীও হাসিতে আরম্ভ করিয়াছিল। তাহার সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরঝিরঞ্চ আরম্ভ হইয়া গিয়াছিল আবার সেই হাসি। হাসিতে হাসিতে মাথার অবশ্যণ্ঠন খসিয়া গেল, চোখ দিয়া টপটপ করিয়া জল ঝরিয়া পড়িল, তবু তাহার সে হাসি থামিল না।
হাসি থামাইয়া রাজা বলিয়াছিল—ওস্তাদ! ই কালকুটি হামার ঠাকুরঝি হায়। ইস্‌কো কেয়া নাম দেগা ভাই।
নিতাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে মেয়েটিকে দেখিতেছিল, তাহার সর্বাঙ্গে কচিপাতার মত যে একটি কোমল বনাম ঐ আছে, তাহা দেখিয়া তাহাকে লইয়া রহস্ত করিতে নিতাইয়ের প্রবৃত্তি হয় মাই। সে বলিয়াছিল—ঠাকুরঝি ভাই ঠাকুরঝি, ওর আর দোসর নাম হয় না। আমার ঠাকুরঝিও ঠাকুরঝি, রাজার ঠাকুরৰিও ঠাকুরকি। ঠাকুরঝি আমাদের সবারই ঠাকুবঝি। কেমন ভাই ঠাকুরঝি!
রাজা নিতাইয়ের তর্ক-যুক্তিতে অবাক হইয়া গিয়াছিল। গভীরভাবে ঘাড় নাড়িয়া সে স্বীকার করিয়াছিল—হাঁ, হাঁ, ঠিক, ঠিক। ই বাত তো ঠিক হ্যাঁয়! ঠাকুরঝি ঠাকুরঝি!
তাহার পর খাজা পাড়িয়াছিল মদের বোতল-আও ভাই ওস্তাদ!
নিতাই জোড়হাত করিয়া বলিয়াছিল—মাফ কর ভাই রাজন। ও দব্য আমি ছুঁই না।
-তব্‌? তব্‌, তুমি কি খায়েগা ভাই?
ঠাকুরকি বলিয়াছিল—দুধ খাবা, দুধ? বলিয়া আবার সেই খিল থিল হাসি।
নিতাই হাসিয়াছিল—তা খেতে পারি। এমন দব্য কি আছে ভো-মগুলে? দেবদুল্লভ।
ঠাকুরঝি সত্যই বড় ঘটি হইতে মাপের গেলাসে পরিপূর্ণ একগ্লাস দুধ ঢালিয়া নিতাইয়ের সম্মুখে নামাইয়া দিয় তাহার অভ্যস্ত দ্রুতগমনে প্রায় পলাইয়া গিয়াছিল।
এ সব পুরোনো কথা।
রাজা এখন তাহার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, গুণমুগ্ধ ভক্ত।

সেই সুত্রেই গোঁসাইজীর চাকরিতে জবাব দিয়া নিতাই আসিয়া উঠিল স্টেশনে। সমস্ত শুনিয়া রাজা বলিল—ঠিক কিয়া ওস্তাদ। বহুৎ ঠিক কিয়া ভাই।
—আমাকে কিন্তু তোমার এইখানে একটু জায়গা দিতে হবে।
—আলবৎ দেগা। জরুর দেগা।
—এইখানে থাকব, অীর ইন্টিশানে মোট বইব। তাতেই আমার একটা পেট চ’লে যাবে।
রেলওয়ে কনস্ট্রাকশনের সময় এই স্টেশনটি এ লাইনের একটি প্রধান কর্মক্ষেত্র ছিল। সে সময় প্রয়োজনে অনেক ঘরবাড়ী তৈয়ারী হইয়াছিল, সেগুলি এখন পড়িয়াই আছে। তাহারই একটাতে রাজা ওস্তাদের বাসস্থান নির্দিষ্ট করিয়া দিল। নিতাই এখন স্টেশনে কুলিগিরি করে, ভদ্রলোকজনের মোট তুলিয়া দেয়, নামাইয় লয়, গ্রামান্যরেও মোট বহিয়া লইয়া যায়, উপার্জন তাহার ভালই হয়। স্টেশনে মাল নামাইতে-চড়াইতে মজুরি দুই পয়সা, এই গ্রামের মধ্যে যাইতে হইলে চার পয়সা, গ্রামান্যরে হইলে রেট দূরত্ব অনুযায়ী। অন্ত কুলিদের অপেক্ষ নিতাইয়ের উপার্জন বেশী। কারণ তাহার সহায় স্বয়ং রাজ।
স্টেশন-স্টলটি তাহদের একটি আডডা; স্টলের ভেণ্ডার ‘বেনে মামা’ রহস্ত করিয়া নিতাইকে বলে—রাজ-বয়স্য।
মামার দোকানে সজীব-বিজ্ঞাপন বাতব্যাধিতে আড়ষ্ট, অতি-প্ৰগলভ বিপ্রপদ বলে—বয়স্ত কি রে বেট, বয়স্য কি? সভাকবি, রাজার সভাকবি।
নিতাই বিপ্ৰপদর পদধূলি লইয়া ‘সুপ’ শব্দ করিয়া মুখে দেয়, সভাকবি কথাটিতে ভারি খুশী হইয়া উঠে। বিপ্রপদকে বড় ভাল লাগে তাহার। এত যন্ত্রণাদায়ক অমুখের মধ্যেও এমন আনন্দময় লোক দেখা যায় না। বাতব্যাধিগ্রস্ত বিপ্ৰপদ সকালে উঠিয়াই কোনমতে খোড়াইতে খোড়াইতে স্টেশনে আসিয়া মামার দোকানে আডডা লয়, বেঞ্চিতে বসিয়া অনর্গল বকে, লোকজনকে চা খাইতে উৎসাহিত করিয়া মধ্যে মধ্যে হাঁকিয়া উঠে—চ গ্রো-ম! চা গ্রেী-ম! দেহ তাহার যত আড়ষ্ট, জিহা তত সক্রিয়। উৎকট রসিক ব্যক্তি, ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ মেজাজের মানুষ। মামার দোকানে সকালবেলায় আসিয়া বিপ্রপদ চ বিড়ি খাইয়া খাইয়া বেলা বারোটায় বাড়ী ফিরে খাইবার জন্য। খাইর, খানিকটা ঘুমাইয়া লইয়া বেলা তিনটার আবার খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে স্টেশনে আসিয়া বসে। যায় রাত্রি সাড়ে দশটার ট্রেন পার করিয়া তবে। বিপ্ৰপদর সঙ্গে নিতাইয়ের জমে ভাল। নিতাই পদধূলি লইলে, বিপ্রপদ স্বরচিত সংস্কৃত শ্লোকে আশীৰ্বাদ করে–

ভব কপি, মহাকপি দগ্ধানন সলাঙ্গুল—

হাত জোড় করিয়া নিতাই বলে—প্রভু, কপি মানে আমি জানি।
বিপ্রপদ হাসিয়া ভুল স্বীকার করিয়া বলে—ও। কপি নয়, কপি, নয়, কবি, কবি। আমারই ভুল। আচ্ছা, কবি তো তুই বটিস, কই বল দেখি—‘শকুনি খেললে পাশা, রাজ্য পেলে দুৰ্যোধন, বাজী রাখলে যুধিষ্ঠির কিন্তু ভীমের বেটা ঘটোৎকচ মরল কোন পাপে?’
নিতাই সঙ্গে সঙ্গে উঠিয়া দাঁড়াইয়া কবিগান আরম্ভ করিয়া দেয়। বা হাত গালে চাপিয়া মুখের সম্মুখে ডান হাত আড়াল দিয়া ঈষৎ ঝুঁকিয়া সুর ধরিয়া আরম্ভ করে—আ হা রে—ঘটোৎকচ মরল কোন্‌ পাপে?
রাজা ভাবে, ঢোলকট পাড়িয়া আনিবে নাকি? কিন্তু সে আর হইয় উঠে না। ইতিমধ্যে বারোটার ট্রেনের ঘণ্টা পড়ে।
দূরান্তরের যাত্রী অধিকাংশই পায় নিতাই। স্টেশনের জমাদার রাজার মুপারিশে যাত্রীরা নিতাইকেই লইয়া থাকে। নিতাইয়ের ব্যবহারও তাহারা পছন্দ করে।
মজুরির দরদপ্তর করিতে নিতাই সবিনয়ে বলে—প্রভু, গগনপানে দিষ্টি করেন একবার। গ্রীষ্মকাল হইলে বলে—দিনমণির কিরণটা একবার বিবেচনা করেন। বর্ষায় বলে—কিষ্ণবন্ন মেঘের একবার আড়ম্বরটা দেখেন কর্তা। শীতে বলে—শৈত্যের কথাটা একবার ভাবেন বাৰু।
মামার দোকানে বসিয়া বিপ্রপদ নিতাইকে সমর্থন করে,—বলে—আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনাদের তো সব শাল-দোশাল আছে। ওর যে কোন শালাই নাই। ওর কষ্ট্রের কথা বিবেচনা করুন একবার।
দ্বিপ্রহরে বাহিরে যাইতে হইলে নিতাই রাজাকে বলিয়া যায়—রাজন, ঠাকুরঝি এলে দুধটা নিয়ে রেখে।
এখানে থাকিলে বারোটার ট্রেনটি চলিয়া গেলেই নিতাই একটু আগাইয়া গিয়া পয়েন্টের কাছে লাইনের ধারে যে কৃষ্ণচুড়ার গাছটি আছে তাহাঁর ছায়ায় গিয়া দাঁড়ায়। দ্বিপ্রহরে তখন রোদ পড়িয়া লোহার লাইনের উপরের ঘষা অংশটা সুদীর্ঘ রেখায় ঝকমক করে। নিতাই নিবিষ্ট মনে, যেখানে লাইনটা বাক ঘুরিয়াছে সেইখানে দৃষ্টি আবদ্ধ করিয়া দাঁড়ায়। সহসা সেখানে শুভ্র একটি চলন্ত রেখার মত রেখা দেখা যায়, রেখাটির মাথায় একটি স্বর্ণবর্ণ বিন্দু। স্বর্ণবর্ণ-বিন্দুশীর্ষ শুভ্ৰ চলন্ত রেখাটি আগাইয়া আসিতে আসিতে ক্রমশ পরিণত হয় একটি মানুষে। ক্ষারে কাচ তাঁতের মোটা সূতার খাটো কাপড়খানি আঁটসাঁট করিয়া পরা সে একটি কালো দীর্ঘাঙ্গী মেয়ে; এবং তাহার মাথায় একটি তক-তকে মাজা সোনার বর্ণের পিতলের ঘটী। ঘটীটি সে ধরে না—একহাতে মাপের গেলাস, অন্য হাতটি দোলে, সে দ্রুতপদে অবলীলাক্রমে চলিয়া আসে। মেয়েটি চলে দ্রুত ভঙ্গিতে, কথাও বলে দ্রুত ভঙ্গিতে। মেয়েটি সেই ঠাকুরঝি।
নিতাই নেশা করে না; কিন্তু দুধ তার প্রিয়বস্তু। চায়েও আসক্তি তাহার ক্রমশ বাড়িতেছে। ঠাকুরঝির কাছে সে নিত্য একপোয়া করিয়া দুধ যোগান লইয়া থাকে। দুধ আসিলেই চায়ের জল চড়াইয়া দেয়। মামার দোকানে চা খাইলে দাম দিতে হয় দু পয়সা কাপ। বিপ্রপদর মত বিনা পয়সার চা খাইবার অধিকার তাহার নাই। তা ছাড়া জমে না। কেমন ছোট ছোট মনে হয়।
স্টেশনে নিত্য নানা স্থানের লোকজনের আনাগোনা। আশপাশের খবর স্টেশনে বলিয়াই পাওয়া যায়। খবরের মধ্যে কবিগানের খবর থাকিলে নিতাই উল্লসিত হইয়া উঠে। সেদিন সন্ধ্যাতেই লালপেড়ে পরিষ্কার ধুতি ও হাতকাটা জামাটি পরিয়া, মাথায় পাগড়ি বাঁধিয়া সাজে এবং গুন-গুন করিয়া কবিগান গাহিতে গাহিতে রাজাকে আসিয়া তাগাদ দেয়। মিলিটারী রাজা সাড়ে আটটার ট্রেন পার করিয়াই বলে—ফাইভ মিনিট ওস্তাদ!
পাঁচ মিনিটও তাহার লাগে না, তিন মিনিটের মধ্যেই রেলওয়ে কোম্পানির দেওয়া নীল কোর্তাটা চড়াইয়া স্টেশনের একমুখে বাতি ও লাঠি হাতে বাহির হইয়া পড়ে। ভোর হইবার পূর্বেই আরার ফিরিয়া আসে। শুধু কবিগানই নয়, যাত্রাগান, মেল—এ সবই নিতাইয়ের ভাল লাগে। আহ, আলোকোজ্জ্বল উৎসবমুখর রাত্রির মধ্যেই যদি সমস্ত জীবনটা তাহার কাটিয়া যায়, তবে বড় ভাল হয়।
মনের এই বাসনাটুকু সে দুই কলি গানে বাঁধিয়া রাখিয়াছে। নির্জন প্রান্তর পাইলেই গাহিয়া সে নিজেকেই শুনায়; আর শুনায় কোন রসময় ভাইকে। সে রসময় ভাই তাহার রাজন।

সেই মেলাতে কবে যাব
ঠিকানা কি হায়রে!
যে মেলাতে গান থামে না
রাতের আঁধার নাইরে।
ও রসময় ভাইরে!

রাজা শুনিয়া বাহ বাহা করিয়া জড়াইয়া ধরিয়া বলে-ওস্তাদ তুম ভাই গুন তৈয়ার করো। আচ্ছা গান আত তুমার!
গান তাহার অনেক আছে। কিন্তু কোনটাই সম্পূর্ণ হইয়া উঠে না। হঠাৎ চণ্ডীমায়ের মেলাতে এই নিতাই সত্য সত্যই কবিয়াল হইয়া উঠিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *