এপিঠ-ওপিঠ

এপিঠ-ওপিঠ 

সত্যিই ভারি আশ্চর্য সভ্যতা এই ধনতন্ত্র। এর যা কীর্তি তার পাশে পুরোনো পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্যও বুঝি ম্লান হয়ে যায়। আজকালকার বিরাট বিরাট কলকারখানাগুলোর কথা ভেবে দেখো। কোথায় লাগে মিশরের পিরামিড আর ব্যাবিলনের প্রাসাদ? চোখের নিমেষে কী রকম রাশি রাশি জিনিস তৈরি হবার ধুম— কাপড়চোপড়, খাবারদাবার থেকে শুরু করে হাওয়া-গাড়ি হাউই জাহাজ পর্যন্ত কতোই না! রূপকথায় শোনা কোনো অতিবড়ো ডাকসাইটে দৈত্যও কি এমন চোখের নিমেষে এতো রাশি রাশি জিনিস তৈরি করতে পারতো? তার মানে, আগেকারকালের মানুষ পৃথিবীকে যতোখানি জয় করবার কথা কল্পনাও করতে পারে নি। এ-কালের মানুষ সত্যিসত্যিই তার চাইতে অনেক বেশি জয় করতে শিখেছে। 

তবু, এতো গৌরবের উলটো পিঠেই একটা করুণ পরাজয়ের কাহিনী। পৃথিবীকে মানুষ অতোখানি জয় করলো, তবুও মানুষের কপাল থেকে দুঃখ আর অভাবের চিহ্ন মুছলো না। সাধারণ মানুষের কথাটা একবার ভেবে দেখো। যারা খেতে-খামারে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে, কলকারখানায় গায়ের রক্ত জল করছে— তাদের কথা। সাধারণ মানুষ বলতে, বেশির ভাগ মানুষ বলতে, তো তারাই। অথচ তাদের কপালে যে-দুর্ভোগ সেই দুর্ভোগই থেকে গেলো। এতো ঐশ্বর্যের অংশীদার হওয়া তো দূরের কথা, দুবেলা হয়তো পেট ভরে খাবারই জোটে না, পরনে জোটে না আস্ত কাপড়, জোটে না মাথা গোঁজবার ঘর। তার মানে, নেহাত যেটুকু না হলে কোনোমতে জান বাঁচে না শুধু ততোটুকু জিনিসই তাদের কপালে। 

ধনতন্ত্রের তাই দুটো দিক: একদিকে যেমন আশ্চর্য সম্পদ আর একদিকে তেমনই নির্মম হাহাকার। এ যেন এক তাজব ব্যাপার! আসলে কিন্তু তাজব ব্যাপার নয়। ধনতন্তরের যুগে এমনটা না হয়ে উপায়ই নেই। কেন, তাই দেখা যাক। 

মানুষ অনেক অনেক জিনিস তৈরি করতে শিখেছে। কিন্তু হাওয়ায় ফুঁ দিয়ে তো আর জিনিস তৈরি হয় না। কাপড় তৈরি করতে গেলে তাত কিংবা কাপড়ের মিল লাগে, হাওয়া-গাড়ি তৈরি করতে গেলে লাগে বিরাট কারখানা। তাত কিংবা কাপড়ের মিল, কিংবা হাওয়া-গাড়ি তৈরি করবার কারখানা, কিংবা ওই ধরনের যেসব ব্যাপার তাকে বলে উৎপাদনের উপায়। কেননা এগুলো ছাড়া উৎপাদন হয় না। উৎপাদন মানে হলো নতুন জিনিস তৈরি করা। 

এখন ধনতন্তরের সময় থেকে হলো কি, ওই উৎপাদনের উপায়গুলো সম্বন্ধে একটা নতুন ব্যাপার দেখা দিলো। যারা মেহনত করে উৎপাদন করছে তারা আর ওই উৎপাদনের উপায়গুলোর মালিক নয়। মালিক হলো অন্য লোক। আগে কিন্তু যখন কারিগররা কিছু তৈরি করতো তখন এ-রকম নয়। তখন পর্যন্ত যে তাতি তারই তাত, যে কামার তারই কামারশাল। কিন্তু ধনতন্তরের যুগে একটা কারখানার কথা ভেবে দেখো। কারখানায় যারা গতির খাটাচ্ছে কারখানাটা কি তাদের? নিশ্চয়ই নয়; তারা তো নেহাত দিন-মজুরের দল। গতির খাটাবার জন্যে দিন গেলে তারা মজুরি পায়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। 

মালিক আসলে অন্য লোক। সে নিজে গতির খাটায় না, নগদ চুকিয়ে অন্য লোককে খাটিয়ে নেয়। তাছাড়া মোট মানুষের তুলনায় এই মালিকের সংখ্যা নেহাতই নগণ্য : হয়তো তিনজনে মিলে একটা কারখানা ফেঁদেছে, অথচ সেখানে মেহনত করছে তিন হাজার দিনমজুর। মালিকদের সম্বন্ধে আরো একটা কথা মনে রাখা দরকার। সেটাই সবচেয়ে জরুরী কথা। তাদের কাছে একমাত্ৰ উদ্দেশ্য হলো এই সব কলকারখানা থেকে নগদ টাকা লাভ করা। লাভের আশা ছাড়া আর কিসের আশায় তারা অমন কলকারখানা ফাঁদতে যাবে বলো? আর উৎপাদনের উপায়গুলোর যারা মালিক তাদের উদ্দেশ্য অনুসারেই তো সমস্ত কিছু উৎপাদন হবে। তাই ধনতন্তরের যুগে যেখানেই যা কিছু তৈরি হোক না কেন সর্বত্রই ওই এক উদ্দেশ্য : লাভ, মুনাফা ! তার মানে মানুষের অভাব দূর করা নয়। 

ধরো, বিরাট একটা কারখানায় কাপড় তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কেন? উদ্দেশ্যটা কী? দেশের সাধারণ মানুষ ওই কাপড় পরে বাঁচবে বলে? মোটেই তা নয়। তাহলে? কারখানাটার যে মালিক তার লাভ হবে। সেইজন্যেই তো কাপড় তৈরি। মালিক তাই হিসেব করে দেখবে, কেমনভাবে কাপড় তৈরি হলে তার লাভ সবচেয়ে বেশি। আর কারখানাটার মালিক তো সে-ই, তাই এখানে তার হিসেবমতোই কাপড় তৈরি হতে বাধ্য। যেমন ধরো, দেশের লোক মোটা কাপড়ের অভাবে খুবই কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু মালিক হয়তো হিসেব করে দেখলো কারখানায় মোটা কাপড় তৈরি করে দেশের লোকের কাছে বেচবার চেয়ে যদি খুব শৌখিন কাপড় তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি করা যায় তাহলে লাভ অনেক বেশি। কারখানাতে তাহলে রপ্তানির জন্যে শৌখিন কাপড়ই তৈরি হবে না কি? কিংবা ধরো, বাজারে কাপড় নেই, হু-হু করে আগুনের মতো কাপড়ের দর বাড়ছে। তাতে মালিকের ভীষণ লাভ। আর ভীষণ লাভ বলেই মালিক ঠিক করলো, কারখানায় কাপড় তৈরির হার টার উপর রাশ টানা। আগে হয়তো দিনে হাজার গজ কাপড় তৈরি হচ্ছিলো, মালিক ঠিক করলো এখন থেকে দিনে মাত্র সাতশো গজ কাপড় তৈরি হবে। তাহলে, বাজারে কাপড়ের আমদানি আরো কমে যাবে, কাপড়ের দর আরো চড়বে, মালিকের লাভ আরো বাড়বে। কিন্তু তাতে যে দেশের লোকের দুঃখের আর অবধি থাকবে না! মালিক বলবো; তা আমি কী জানি? দেশের লোক যদি কারখানার মালিক হতো তাহলে কিসে তাদের ভালো হয় এই হিসেব অনুসারেই কারখানা চলতো ! কিন্তু কারখানার আসল মালিক হলুম আমি। লাভ করতে চাই বলেই তো আমি কারখানা খুলেছি। তাই আমার কারখানা এমনভাবে চলবে যাতে আমার লাভ সবচেয়ে বেশি। 

মুনাফার খাতিরে উৎপাদন। দেশে যা-কিছু তৈরি হবে তা শুধু মালিকদের লাভের অঙ্কটা বাড়াবার জন্যেই। আর যদি তাই হয় তাহলে দেশের সাধারণ লোকের পক্ষে খুব গরিব হয়ে থাকতেই হবে। এ তো খুব সোজা হিসেব। হিসেবটা দেখো। 

কারখানার মালিক যদি লাভ করতে চায় তাহলে তো কারখানায় মালপত্তরগুলো তৈরি করতে হবে খুব সস্তায় আর সেগুলো বাজারে ছাড়তে হবে চড়া দরে। সস্তায় মালপত্তর তৈরী করবার কায়দাটা কী? কাঁচা মাল সস্তায় কেনা আর মজুরদের কম মজুরি দেওয়া। তার মানেই কিন্তু দেশের বেশির ভাগ লোককে খুব গরিব করে রাখা। কেননা, সাধারণ মানুষ বলতে, দেশের বেশির ভাগ মানুষ বলতে তো কৃষক আর মজুরই। কাঁচা মাল তো বেশির ভাগই কৃষকদের কাছ থেকে কেনা। তাই সস্তায় কাঁচা মাল কেনা মানেই কৃষকদের গরিব করে রাখা। আর মজুরি কম পেলে মজুররা তো গরিব হয়ে থাকবেই। 

ধরো, একটা কাপড়ের কারখানা। সস্তায় কাপড় তৈরি করতে হলে সস্তায় তুলো কেনা চাই। কিন্তু সস্তায় তুলো কেনা মানেই যারা তুলোর চাষ দিচ্ছে সেই কৃষকদের কম পয়সা দেওয়া। তার মানে, গরিব করে রাখা। কিংবা শুধু কারখানায় যারা গতির খাটাচ্ছে তাদের দিনমজুরি বাবদ দেদার টাকা দেওয়া গেলো, তাহলেই কি সস্তায় কাপড় তৈরি হবে? নিশ্চয়ই নয়। তাই যতোটুকু না দিলে মজুররা জানে বাঁচে না। তাদের দিনমজুরি বাবদ শুধু ততোটুকুই। তাই লাভের আশায় কাপড় তৈরি করতে গেলে দেশের বেশির ভাগ লোককে গরিব করে রাখতেই হবে। তারপর তৈরি মালগুলো বাজারে ছাড়বার সময় হিসেব করে দেখতে হবে কতো চড়া দরে ছাড়া যায়। যতো চড়া দর ততোই তো লাভ বেশি। আর ওই চড়া দরে বাধ্য হয়ে বাজার থেকে জিনিস কিনতে হয় বলেই দেশের লোকের অবস্থা আরো সঙ্গীন হয়ে ওঠে। 

ধনতন্তরের যুগে সিপাই-শান্তরী আইন-আদালত সবই মালিকদলের হাতের মুঠোয়। তাই তারা নানান রকম কায়দা-কানুন করতে পারে। আর অতো রকম কায়দা-কানুন করতে পারে বলেই দেশের বেশির ভাগ মানুষকে অমন দীন-দরিদ্র করে রেখে নিজেরা দারুণ বড়োলোক হতে পারে। 

এই হলো ধনতন্তরের চেহারা। একদিকে মাত্র মুষ্টিমেয় মালিকের দল, তাদের অগাধ টাকা, অসীম প্রতিপত্তি। আর একদিকে দেশের সাধারণ মানুষ। তাদের কপালে শুধু ততোটুকুই যতোটুকু না হলে নেহাত জান বাঁচানো দায়। 

ধনতত্তরের তাই দুটো দিক। একদিকে দেখা যায়, মানুষের উৎপাদন-শক্তি কী অসম্ভব বেড়ে গিয়েছে, পৃথিবীর কাছ থেকে আদায় করতে শিখেছে কী অতুল ঐশ্বর্য। আর একদিকে দেখা যায় দেশের অসংখ্য সাধারণ মানুষ যেন অভাবের মহাসমুদূরে ভাসছে। 

ঐশ্বর্যের উলটো পিঠেই দারুণ অভাব। শুধু মুনাফার খাতিরেই যদি উৎপাদন হয় তাহলে এমনটা না হয়ে উপায় নেই। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এপিঠ-ওপিঠ

এপিঠ ওপিঠ

এপিঠ ওপিঠ

তরুণ আই-সি-এস্ সুখেন্দু গুপ্ত প্রেমে পড়িয়াছে; তাহার ইস্পাতের ফ্রেমে-আঁটা মজবুত হৃদয় নড়বড়ে হইয়া গিয়াছে।

শুধু প্রেমে পড়িলে দুঃখ ছিল না; কিন্তু এই চিত্তবিকারের সঙ্গে সঙ্গে আর এক উপসর্গ জুটিয়াছে। বিলাতে থাকাকালীন সে ড়ুবিয়া ড়ুবিয়া কয়েক ঢোক জল খাইয়াছিল, সেই অনুতাপের জ্বালা আজ তাহার হৃদয় দগ্ধ করিতেছে।

সুখেন্দু ছেলে খারাপ নয়। তবে, মুনীনাঞ্চ মতিভ্রমঃ, অতিবড় সাধু ব্যক্তিরও মাঝে মাঝে পা পিছলাইয়া যায়। বিশেষত বিলাতে পথঘাট একটু বেশী পিছল; তাই সুখেন্দুর পদস্থলনকে আমাদের উদার-চক্ষে দেখিতে হইবে। আমাদের একটা বদ-অভ্যাস আছে, ঐ জাতীয় ত্রুটিকে আমরা একটু বড় করিয়া দেখি এবং ক্রমাগত সেইদিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করিতে থাকি। যাঁহারা বিলাত ঘুরিয়া আসিয়াছেন তাঁহারা কিন্তু এ বিষয়ে ঢের বেশী সংস্কারমুক্ত।

যাহোক, সুখেন্দুর মনস্তাপ যে আন্তরিক তাহাতে সন্দেহ নাই। বিলাত হইতে সে গোটা হৃদয় লইয়াই দেশে ফিরিয়াছিল। তারপর তিন বছর কাটিয়াছে; হৃদয় কোনও গোলমাল করে নাই। বাংলাদেশের এক মহকুমায় সগৌরবে রাজত্ব করিতে করিতে অন্য এক মহকুমায় বদলি হওয়া উপলক্ষে কিছুদিনের ছুটি পাইয়া সে কলিকাতায় আসিয়াছিল। এখানে আসিয়াই তাহার হৃদয় হঠাৎ জাঁতিকলে পড়িয়া গিয়াছে!

যুবতীটির নাম এণা; বাংলা সরকারের একজন মহামান্য অফিসারের কন্যা। বয়স কুড়ি হইতে বাইশের মধ্যে—তন্বী, রূপসী, কুহকময়ী—এণা সত্যই অনন্যা। সে গভর্নরের পার্টিতে বাচ নাচিতে পারে, কিন্তু তাহার ব্যবহারে কোথাও প্রগলভতার ইসারা পর্যন্ত নাই; কথায় বার্তায় সে পরম নিপুণা, কিন্তু তাহার প্রকৃতিটি বড় মোলায়েম; সে ইংরেজীতে রসিকতা করিতে পারে, আবার বিদ্যাপতি-চণ্ডীদাসের পদাবলী গাহিয়া চিত্তহরণ করিতেও জানে। দর্পণে সে যে-দেহটি দেখিতে পায় তাহা যৌবনের অকলঙ্ক লাবণ্যে ঝলমল, কিন্তু দর্পণে যাহা দেখিতে পাওয়া যায় না সেই অন্তরটি কত নিবিড় রহস্যের জালে ছায়াময় হইয়া আছে তাহা কে অনুমান করিবে?

প্রথম দৃষ্টি বিনিময়ের সঙ্গে সঙ্গেই সুখেন্দু ঘাড় মুচড়াইয়া পড়িয়াছিল, তাহার আর কোনও আশা ছিল না। ওদিকে অপর পক্ষও একেবারে অনাহত অবস্থায় আত্মরক্ষা করিতে পারে নাই। সুখেন্দু অতি সুপুরুষ এবং অত্যন্ত স্মার্ট; কোনও দিক দিয়াই তাহার যোগ্যতায় এতটুকু খুঁত ছিল না। তাই অন্তরের গহন বনে এণাও বিলক্ষণ ঘা খাইয়াছিল।

তারপর আলাপ যত ঘনিষ্ঠ হইয়া উঠিতে লাগিল, দুজনের মধ্যে আকর্ষণও তেমনি দুর্নিবার হইয়া উঠিল। মুখের কথা যখন সাধারণ আলোচনায় ব্যাপৃত থাকে, চোখের ভাষা তখন আকাঙক্ষায় তৃষিত হইয়া উঠে। চোখের ভাষা নীরব হইলে কি হইবে, উহা বুঝিতে কাহারও বিলম্ব হয় না। সুখেন্দু দেখিতে পায়, এণার নরম চোখ দুটি মিনতিভরা উৎকণ্ঠায় তাহার স্বীকারোক্তির প্রতীক্ষা করিয়া আছে; এণা দেখে, সুখেন্দুর ঠোঁটের কাছে কথাগুলি কাঁপিতেছে, কিন্তু তাহারা আবেগের বাঁধনহারা প্লাবনে বাহির হইয়া আসে না। লগ্নভ্রষ্ট হইয়া যায়। সুখেন্দু বিরসমুখে অন্য কথা পাড়ে।

এইভাবে কয়েকটা অন্তর্গূঢ় অগ্নিগর্ভ দিন কাটিয়া গেল, সুখেন্দুর ছুটি ফুরাইয়া আসিল।

আর সময় নাই; দুদিন পরেই তাহাকে কর্মস্থলে ফিরিয়া যাইতে হইবে। অথচ যে কথাটি বলিবার জন্য তাহার অন্তরাত্মা আকুলি-বিকুলি করিতেছে, তাহা সে কিছুতেই বলিতে পারিতেছে না। তাহার হৃদয় মন্থন করিয়া অনুতাপের হলাহল বাহির হইয়াছে। যতবার সে বলিবার জন্য মুখ খুলিয়াছে ততবার বিবেক আসিয়া তাহার গলা টিপিয়া ধরিয়াছে।

গ্র্যাণ্ড হোটেলে নিজের কক্ষে উদ্ৰান্তভাবে পায়চারি করিতে করিতে সুখেন্দু ভাবিতেছিল, কী করি! আমি জানি ও আমাকে চায়—কিন্তু ওকে ঠকাবো? না না, অনাঘ্রাত ফুলের মতো ওর মন, অনাবিদ্ধ রত্নের মতো ওর দেহ। আর আমি! না কিছুতেই না।

মন স্থির করিয়া সুখেন্দু চিঠি লিখিতে বসিল। মুখে যাহা ফুটি-ফুটি করিয়াও ফোটে না, কাগজে কলমে তাহা ভালই ফোটে।

—আমি তোমাকে ভালবাসি। একথা জানতে তোমার বাকি নেই। আমিও তোমার চোখের নীরব বার্তা পেয়েছি, বুঝতে পেরেছি তোমার মন। কিন্তু তবু মুখ ফুটে তোমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করতে পারিনি। আমার অপরাধী মন কুণ্ঠায় নীরব থেকেছে।

তোমাকে আমি ঠকাতে পারব না। যা কোনও দিন কারুর কাছে স্বীকার করিনি, আজ তোমাকে জানাচ্ছি। বিলেতে যখন ছিলুম, তখন একেবারে নিষ্কলঙ্ক জীবন যাপন করতে পারিনি। কিন্তু তখন তো তোমাকে চিনতুম না। ভাবিও নি যে তোমার দেখা পাব।

ক্ষমা করতে পারবে না কি? শুনেছি ভালবাসা সব অপরাধ ক্ষমা করতে পারে। যদি ক্ষমা করতে পারো, চিঠির জবাব দিও। যদি না পারো বিদায়। আমার হৃদয় চিরদিন তোমারই থাকবে।

চিঠি ডাকে পাঠাইয়া দিয়া সুখেন্দু হোটেলেই বসিয়া রহিল; সেদিন আর কোথাও বাহির হইতে পারিল না।

পরদিন বিকালে চিঠির উত্তর আসিল।

—তুমি এসো— শিগগির এসো। দুদিন তোমাকে দেখিনি।

তুমি তোমার মনের গোপন কথা বলতে পেরেছ—তাতে আমারও মনের রুদ্ধ কবাট আজ খুলে গেছে। আজ আর আমার লজ্জা নেই; নিজের মন দিয়ে বুঝেছি, ভালবাসা সব অপরাধ ক্ষমা করতে পারে।

আমিও জীবনে একবার ভুল করেছি। কিন্তু আজ তা মনে হচ্ছে কোন্ জন্মান্তরের দুঃস্বপ্ন।

তুমি লিখেছ তুমি আমাকে ঠকাতে পারবে না। আমিও পারলুম কই? আর ক্ষমা! তুমি এসো—তখন ক্ষমার কথা হবে।

.

উষ্ণ নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে মেল ট্রেন রাত্রির অন্ধকারে চলিয়াছে।

একটি প্রথম শ্রেণীর কামরায় সুখেন্দু নিজের বাঙ্কে শুইয়া একদৃষ্টে আলোর পানে তাকাইয়া আছে; নির্বাপিত পাইপটা ঠোঁটের কোণ হইতে ঝুলিতেছে।

গভীর রাত্রি : কামরায় আর কেহ নাই। সুখেন্দু পাইপটা বালিশের তলায় রাখিয়া সুইচ টিপিয়া আলো নিবাইয়া দিল। তারপর যেন অন্ধকারকে উদ্দেশ করিয়াই বলিল, বাপ! খুব বেঁচে গেছি!

৬ শ্রাবণ ১৩৫১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *