১. ভূমিকা

আমরা সেদিন ক্লাবে তাস-খেলায় এতই মগ্ন হয়ে গিয়েছিলুম যে, রাত্তির যে কত হয়েছে সে দিকে আমাদের কারও খেয়াল ছিল না। হঠাৎ ঘড়িতে দশটা বাজল শুনে আমরা চমকে উঠলুম। এরকম গলাভাঙ্গা ঘড়ি কলকাতা সহরে আর দ্বিতীয় নেই। ভাঙ্গা কাসির চাইতেও তার আওয়াজ বেশী বাজখাই, এবং সে আওয়াজের রেশ কাণে থেকেই যায়,আর যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ অসোয়াস্তি করে। এ ঘড়ির কণ্ঠ আমাদের পূর্বপরিচিত, কিন্তু সেদিন কেন জানিনে তার ধ্যান খ্যানানিটে যেন নূতন করে, বিশেষ করে, আমাদের কাণে বাজল।

হাতের তাস হাতেই রেখে, কি করব ভাবছি—এমন সময়ে সীতেশ শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে, দুয়োরের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন “Boy. গাড়ী যেনে বলে।” পাশের ঘর থেকে উত্তর এল—“যো হুকুম!”

সেন বললেন—“এত তাড়া কন? এ হাতটা খেলেই যাও না।”

সীতেশ।—বেশ! দেখছ না কত রাত হয়েছে! আমি আর এক মিনিটও থাকব না। এমনিই ত বাড়ী গিয়ে বকুনি খেতে হবে।

সোমনাথ জিজ্ঞেস করলেন—”কার কাছে?”

সীতেশ।–স্ত্রীর–

সোমনাথ উত্তর করলেন—”ঘরে স্ত্রী কি দুনিয়াতে একা তোমারই আছে, আর কারও নেই?”

সীতেশ।—তোমাদের স্ত্রীরা এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। বাড়ীতে তোমরা কখন আসো যাও, তাতে তাদের কিছু আসে যায় না।

সেন বল্লেন—“সে কথা ঠিক। তবে একদিন একটু দেরী হয়েছে, তার জন্য……”

সীতেশ।—একটু দেরী? আমার মেয়াদ আটটা পর্যন্ত—আর এখন দশটা। আর এ-ত একদিন নয়, প্রায় রোজই বাড়ী ফিরতে তোপ পড়ে যায়।

“আর রোজই বকুনি খাও?”

“খাইনে?”

“তাহলে সে বকুনি ত আর গায়ে লাগবার কথা নয়। এত দিনেও মনে ঘাটা পড়ে যায় নি?”

সীতেশ।—এখন ইয়ারকি রাখ, আমি চলুম—Good night!

এই কথা বলে তিনি ঘর থেকে বেরতে যাচ্ছেন, এমন সময় Boy এসে খবর দিলে যে, “কোচমান-লোগ আবি গাড়ী যোৎনে নেই মাঙ্গতা। ও লোগ সমজতা দো দশ মিমে জোর পানি আয়েগা, সায়েৎ হাওয়া ভি জোর করেগা। ঘোড়ালোগ খাড়া খাড়া এইসাই ডর হায়। রাস্তামে নিকালনেসে জরুর ভড়কেগা, সায়েৎ উখড় যায়েগা। কোই আধা ঘণ্টা দেকে তব্‌ সোয়ারি দেনা ঠিক হ্যায়।”

এ কথা শুনে আমরা একটু উতলা হয়ে উঠলুম, কেননা একা সীতেশের নয়, আমাদের সকলেরই বাড়ী যাবার তাড়া ছিল। ঝড়বৃষ্টি আসবার আশু সম্ভাবনা আছে কিনা, তাই দেখবার জন্য আমরা চারজনেই বারান্দায় গেলুম। গিয়ে আকাশের যে চেহারা দেখলুম, তাতে আমার বুক চেপে ধরলে, গায়ে কাঁটা দিলে। এ দেশের মেঘলা দিনের এবং মেঘলা রাত্তিরের চেহারা আমরা সবাই চিনি; কিন্তু এ যেন আর এক পৃথিবীর আর এক আকাশ;-দিনের কি রাত্তিরের বলা শক্ত। মাথার উপরে কিম্বা চোখের সুমুখে কোথাও ঘনঘটা করে নেই, আশে-পাশে কোথায়ও মেঘের চাপ নেই; মনে হল যেন কে সমস্ত আকাশটিকে একখানি একরঙা মেঘের ঘেরাটোপ পরিয়ে দিয়েছে, এবং সে রং কালোও নয়, ঘনও নয়; কেননা তার ভিতর থেকে আলো দেখা যাচ্ছে। ছাই-রঙের কাচের ঢাকনির ভিতর থেকে আলো দেখা যায়, সেইরকম আলো। আকাশ-জোড়া এমন মলিন, এমন মরা আলো আমি জীবনে কখনও দেখিনি। পৃথিবীর উপরে সে রাত্তিরে যেন শনির দৃষ্টি পড়েছিল। এ আলোর স্পর্শে পৃথিবী যেন অভিভূত, স্তম্ভিত, মূৰ্জিত হয়ে পড়েছিল। চারপাশে তাকিয়ে দেখি,গাছ-পালা, বাড়ী ঘর-দোর, সব যেন কোনও আসন্ন প্রলয়ের আশঙ্কায় মরার মত দাঁড়িয়ে আছে; অথচ এই আলোয় সব যেন একটু হাসছে। মরার মুখে হাসি দেখলে মানুষের মনে যেরকম কৌতূহলমিশ্রিত আতঙ্ক উপস্থিত হয়, সে রাত্তিরের দৃশ্য দেখে আমার মনে ঠিক সেইরকম কৌতূহল ও আতঙ্ক, দুই একসঙ্গে সমান উদয় হয়েছিল। আমার মন চাচ্ছিল যে, হয় ঝড় উঠুক, বৃষ্টি নামুক, বিদ্যুৎ চমকাক, বাজ পড়ুক, নয় আরও ঘোর করে আসুক—সব অন্ধকারে ডুবে যাক। কেননা প্রকৃতির এই আড়ষ্ট দম-আটকানো ভাব আমার কাছে মুহূর্তে পর মুহূর্তে অসহ্য হতে অসহতর হয়ে উঠছিল, অথচ আমি বাইরে থেকে চোখ তুলে নিতে পারছিলুম না;—অবাক হয়ে একদৃষ্টে আকাশের দিকে চেয়েছিলুম, কেননা এই মেঘ-চোয়ানো আলোর ভিতর একটি অপরূপ সৌন্দর্য ছিল।

আমি মুখ ফিরিয়ে দেখি আমার তিনটি বন্ধুই যিনি যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি তেমনই দাঁড়িয়ে আছেন; সকলের মুখই গম্ভীর, সকলেই নিস্তব্ধ। আমি এই দুঃস্বপ্ন ভাঙ্গিয়ে দেবার জন্য চীৎকার করে বল্লুম— “Boy, চারঠো আধা peg লাও?” এই কথা শুনে সকলেই যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। সোমনাথ বল্লেন-”আমার জন্য peg নয়, Vermout।” তারপর আমরা যে যার চেয়ার টেনে নিয়ে বসে অন্যমনস্ক ভাবে সিগারেট ধরালুম। আবার সব চুপ। যখন boy peg নিয়ে এসে হাজির হল, তখন সীতেশ বলে উঠলেন “মেরা ওয়াস্তে আধা নেই—পূরা।”

আমি হেসে বল্লম—”I beg your pardon, স্থূল পদার্থের সঙ্গে তরল পদার্থের এ ক্ষেত্রে সম্বন্ধ কত ঘনিষ্ঠ, সে কথাটা ভুলে গিয়েছিলুম।”

সীতেশ একটু বিরক্ত স্বরে উত্তর করলেন—”তোমাদের মত আমি বামন-বতারের বংশধর নই।”

–“না, অগস্ত্যমুনির; একচুমুকে তুমি সুরা-সমুদ্র পান করতে পার!”

এ কথা শুনে তিনি মহাবিরক্ত হয়ে বললেন-”দেখো রায়, ও সব বাজে রসিকতা এখন ভাল লাগছে না।” আমি কোনও উত্তর করলুম, কেননা বুঝলুম যে, কথাটা ঠিক। বাইরের ঐ আলো আমাদের মনের ভিতরও প্রবেশ করেছিল, এবং সেই সঙ্গে আমাদের মনের রঙও ফিরে গিয়েছিল। মুহূর্ত মধ্যে আমরা নতুন ভাবের মানুষ হয়ে উঠেছিলুম। যে সকল মনোভাব নিয়ে আমাদের দৈনিক জীবনের কারবার, সে সকল মন থেকে ঝরে গিয়ে, তার বদলে দিনের আলোয় যা-কিছু গুপ্ত ও সুপ্ত হয়ে থাকে, তাই জেগে ও ফুটে উঠেছিল।

সেন বল্লেন—”যেরকম আকাশের গতিক দেখছি, তাতে বোধ হয়। এখানেই রাত কাটাতে হবে।”

সোমনাথ বল্লেন—”ঘণ্টাখানেক না দেখে ত আর যাওয়া যায় না।” তারপর সকলে নীরবে ধূমপান করতে লাগলুম।

খানিক পরে সেন আকাশের দিকে চেয়ে যেন নিজের মনে নিজের সঙ্গে কথা কইতে আরম্ভ করলেন, আমরা একমনে তাই শুনতে লাগলুম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *