০২. ওপরের ঘরটায় পলা আর মনু শোয়

ওপরের ঘরটায় পলা (উৎপলা) আর মনু শোয়। একতলার ঘরে মাল্যবানের বিছানা বৈঠক—সমস্ত। এইখানেই সে থাকে, কথা বলে, কাজ করে, বই পড়ে, লেখে, ঘুমোয়। নিজে ইচ্ছা করে স্ত্রীর কাছ থেকে এ-রকম ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়নি সে। দোতলায় ঐ একটা ঘরেই পলার ভালো করে কুলিয়ে ওঠে তেমন : কাজেই সে স্বামীকে নীচের ঘরে গিয়ে শোবার ব্যবস্থা করতে বলেছে। অথচ দোতলার ঘরটা একতলার ঘরের চেয়ে ঢের বড়ো-আলো বাতাস রৌদ্র নীল আকাশের আনাচ-কানাচ-কিনারা, মূল আকাশেররা বড়ো নীলিমার বেশ মুখোমুখি প্রকৃতির সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে; একতলার পাশেই প্রকাণ্ড ছাদের একটা আশ্চর্য প্রসূতি রয়েছে, সিঁড়িটার দু-পাশ মাত্র নেমে গেলেই একতলার সমস্ত ছাদটা আকাশ বোদ কলকাতার শহরটাই তোমার; যদি ভেবে নিতে পার তাহলে পৃথিবীর নগরনাগরের ইতিহাস বারানবত বেবিলনও তোমার চোখে ফুটে উঠছে।

দুটি প্রাণী—ওপরে নিচে এই দুটি ঘরে আলাদা রয়েছে। মালাবানের বিয়ে হয়েছে প্রায় বারো বছর হল। বিয়ের পর দুতিন বছর পলা ঘুরে ফিরে বাপের বাড়িতেই প্রায়ই থাকত; তারপর শ্বশুরবাড়িতে বছরখানেক থাকে, মনু হয়, মনুর ছ-মাস বয়েসের সময়েই বাপের বাড়ি চলে যায় আবার, সেখানে বাবার মৃত্যু পর্যন্ত বছর-দুই আরো কাটিয়ে এই বছর-সাতেক ধরে কলকাতায় স্বামীর কাছেই রয়েছে।

রাত একটা। ডান কাৎ ফিরে মালাবান একটু ঘুমুতে চেষ্টা করল; নানারকম কথা মনে হয়—ঘুম দুরে সরে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে বাঁ কাৎ ফিরে মনে হল এইবারে ঘুম এলে বেশ ভালো লাগবে। কিন্তু ঘড়িতে দেড়টা বাজল, তারপরে দুটো, ঘুম এলো না; এক-একটা রাত এ-রকম হয়।

কম্বলটা ঠোঁট অব্দি টেনে নিয়ে চোখ বুজে আবার পাশ ফেরা গেল। কলকাতার রাস্তায় নানারকম শব্দ কানে আসে; রাত তো দুটো, শীতও খুব হুজুতে, কিন্তু কাদের ফিটন যেন রাস্তার ওপর দিয়ে খটখট করে চলেছে: গাড়ির ভেতর মেয়েদের হাসি, বুড়ো মানুষের মোটা গলা, ছোটোদের চেঁচামেচি। মাল্যবান কম্বলের নীচে ফলিকাৎ হয়ে থাকতে থাকতে ভাবছিল: তাই-তো, কোথায় যাচ্ছ তোমরা মুনশীরা, ফিরছ, কোত্থেকে? ঘোড়ার খুরের আওয়াজ অনেক দূর অব্দি স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল, এমন সময় এঞ্জিনের বিকট তড়পানিতে চারদিকের সমস্ত শব্দ গিলে খেল, এল, চলে গেল একটা লরি। মাল্যবানের মনে হল লরির এই লবেজান আওয়াজেরও এক সার্থকতা আছে: যেমন বালির থেকে তেল বার করতে পারা যায়, সে রকম; একে যদি চাকা-টায়ারের শব্দ না মনে করে বাদলরাতের ঝমঝম আওয়াজ ভেবে নেওয়া যায় তবে বেশ লাগে লরির-খানিকটা চুণবালি খসে পড়ল চাতালের থেকে মাল্যবানের নাকে মুখে; বাড়িটার ভিৎকাপিয়ে দিয়ে বাপরে, একেবারে নিপ্পনের টাইডাল ওয়েভের মতো ছুটে গেছে লরিটা: নাকমুখ থেকে চুণকাম ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে মাল্যবান ভাবছিল। রাস্তা দিয়ে কাহার-মাহাতোরা একটা মড়া নিয়ে যাচ্ছে। কার যেন প্রাইভেট মোটর মাল্যবানদের বাড়ির কাছেই এসে থামল—গাড়িটা কী রকম বিগড়ে গেছে যেন; দুচারজন মিস্ত্রি সেটা মেরামতের চেষ্টায় আছে; মবিল-অয়েলের গন্ধ মাল্যবানের নাকে ঢুকল, মন্দ লাগল না তার; একটা ষাঁড় ফুটপাথ দিয়ে যেতে-যেতে ঘঁগ-ঘড়ম করে উঠল একবার; সামনেই কাদের যেন দোতলার থেকে একটা বড়ো, অস্পষ্ট কান্না ও ঝগড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে; মাল্যবানের ঘরের পাশেই ড্রেনের কাছে একটা নেড়ি কুকুর সুর-ধুর করে রাবিশের ভেতর থাবা নখ চালিয়ে বালি ঘড়ির বাজনা বাজিয়ে চলেছে যেন অনেকক্ষণ থেকে; কী চায় সে? কী পাবে? খানিকটা দূরে একটা বাড়ির ভেতর মহলে হয়তো কলতলায়, ভাড়ার ঘরে, গুদোমে দুটো বেড়াল মরিয়া হয়ে ঝগড়া ছে অনেকক্ষণ ধরে; তাদের একটি নর ও একটি মাদী নিশ্চয়ই; এই শীত রাতে এই আশ্চর্য শীতে নিদারুণ কপট ঝগড়ার আড়ালে হুলো আর মেনির এই অত্যদ্ভুত রক্তোচ্ছ্বাস কাম নিয়ে জীবনের যৌনঋতুর; যৌন আগুনের এই প্রাণান্তকর দৌরাত্ম্যে-মাল্যবান দাঁত ফাঁক করে ভাবছিল, বেড়ালের লুটোপুটি ঝুটোপুটি কান্নাকাটি করে; বেশি বয়সে বিয়ে করেছিল, একজন সাদা দাড়িঅলা বুড়ো প্রফেসরকে ঠিক এই রকমই করতে দেখেছিল মাল্যবান প্রায় বছর-সাতেক আগে—সন্ধ্যারাতেই;—গলাখাকারি না দিয়ে প্রফেসরমশাইর ঘরে রবারসোল জুতো পায়ে ঢুকে পড়েছিল মাল্যবান: কিন্তু এ-রকম মইমারণ হইমারণ ব্যাপার যে হতে তা তো ধারণা করতে পারেনি সে; কিন্তু সেই থেকে উপলব্ধি করেছে মাল্যবান যে সমস্ত ইতর প্রাণীকে বিশ্লেষণ করে যে মহৎ সংশ্লেষে উপস্থিত হওয়া যায় তারি আশ্চর্য সন্তাপ উচ্ছ্বাস ও পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতরতাকে ভাঙিয়ে চারিয়ে জ্বালিয়ে নাচিয়েই মানুষ তো হয়েছে মানুষ। ভাবতে ভাবতে অবসন্ন হয়ে মাল্যবান কাৎ হয়ে শুয়ে পড়ল আবার। ঘড়িতে বাজল আড়াইটে, কিন্তু ঘুম তো এল না।

আজ ছিল তার জন্মদিনের তারিখ। বেয়াল্লিশ বছর আগে—এম্নি অঘ্রাণ মাসের বিশ তারিখে কলকাতার থেকে প্রায় দেড়শো মাইল দুরে বাংলাদেশের একটা পাড়াগাঁয়ে সে জন্মেছিল। সেখানে খেজুরের জঙ্গল বেশি, তালের বন কম, শুপুরীর গন্ধ হয়তো সবচেয়ে বেশি। এম্নি শীতে খেজুরগাছের মাথা চেঁছে একটা নল বসিয়ে গলায় হাঁড়ি বেঁধে দেওয়া হয়, সমস্ত শীতের রাতে ফোঁটা ফোঁটা রস ঝরতে থাকে, মাছি-মৌমাছি ছোটো ছোটো রেতো প্রজাপতি, বড়োগুলোও সেই হাঁড়ির রসে সাঁতার কাটছে, পাখনা নাড়ছে, মরে আছে; কুয়াশা নির্জন ঠাণ্ডা নিবিড় শেষ রাতে দেখা যায় এই সব। এম্নি শীতের রাতে ধানের ক্ষেত শূন্য হয়ে পড়ে আছে—হলদে নাড়ার গ্যাজে সমস্ত মাঠ রয়েছে ছেয়ে, শীত পেয়ে দু-একটা বাঘ নেমে আসে; এম্নি উদাস রাতে ফেউগুলো অন্তত খুব হাঁকড়ায়; শ্মশানে হরিবোল যেন কোন দূর কুয়াশপুরুদের রলরোল বলে মনে হয়; লক্ষ্মীপেঁচা ডাকতে থাকে, ঘুম ভেঙে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যায় শীতের কুয়াশার সে কোন অন্তিম পোচড়ের ফাঁকে-ফাঁকে বৃহস্পতি কালপুরুষ অভিজিৎ সিরিয়াস যেন লণ্ঠন হাতে করে এখান থেকে সেখানে, সেখান থেকে এখানে কোন সুদুরযানের পথে চলেছে, কেমন একটা আশ্চর্য দুর পরলোকের নিক্কণ শোনা যায় কেন?। কোনোদিন কুয়াশা কম—সাদা মেঘ আছে—একফালি গড়ানে মেঘের পাশে—নিজের কেমন যেন একটা বৃহৎ আলোর শরীর নিয়ে থেমে আছে চাদ। পঁচিশ সাতাশ বছর বয়স পর্যন্ত পাড়াগাঁয় সে ফিরে ফিরে যেত, এই সব তার দেখবার শোনবার জিনিস ছিল, কিন্তু তার পর পনোরোটা বছর কেটে গেল এই শহরই হল তার আস্তানা, একটা কঁচপোকা মৌমাছি শামকল মৌচুষকি জোনাকির কথা মনেও পড়ে না তার, আকাশের নক্ষত্রগুড়িগুলোর দিকে ফিরেও তাকায় না সে।

ভাবতে ভাবতে আকাশের রুপালি সবুজালি আগুনগুড়িগুলোর কথা ভুলে গেল সে। পনেরো বছর চাকরির পর গত মাসে আড়াইশো টাকা মাইনে হয়েছে, এর আগে মাইনে ছিল একশো পাঁচানব্বই; প্রায় পাঁচ বছর ধরে একশো পঁচানব্বই টাকাই মাইনে ছিল; তার আগে মাইনের ব্যাপারে বড়ো গরমিল ছিল। সাহেবদের অফিস বটে, কিন্তু এক সময় অফিসের অবস্থা এত খারাপ ছিল যে, যে নামমাত্র মাইনেয় মাল্যবান ঢুকেছিল অনেক বছর পর্যন্ত তার দুর্ভোগ তাকে সহ্য করতে হয়েছে। এই সময় কোনো কোনো কেরানী অফিস ছেড়ে চলে গিয়েছিল, কিন্তু মাল্যবান যায়নি, বরং যত্ন করে এই অফিসেই খেটেছে সে; আজ রাতে তার মনে হয় তার অনেক দিনের খিদমদগারির পুরষ্কার সে পেয়েছে।

খিদমদগারি? কী আর বলবে সে। পূর্বপুরুষেরা তাকে যেমন শক্তি সুযোগ দিয়েছেন তাতে দেশের, মানুষের, আইনের, চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য, এমন কি পড়াশোনায়ও নিজেকে উৎসর্গ করবার কোনো পথ আর নেই। সে সব পথে যদি যেত কেউই তাকে মানত না; মানত কি? লক্ষ্য উচু রাখলেও যে নিচে পড়ে ল্যাংচায় কে মানে তাকে? কাজেই এই পনেরোটি বছর বসে ধীরে ধীরে বটমলি বিগল্যাণ্ড ব্রাদার্সের অফিসের জন্য খেটেছে; কী করবে সে আর কী করতে পারে?

বি.এ. পাশ করে আইন পড়েছিল, কিন্ত তখনই এই অফিসের চাকরিটা পায়; চাকরিটা নিল সে।

মাঝে-মাঝে মনটা ঝুমুর দিয়ে ওঠে বটে : উকিল হলে মন্দ হত না হয়তো, বেশ স্বাধীন ভাবে থাকতে পারত, কারু তাই রাখতে হত না, ব্যবসায়ে উন্নতি করতে পারলে মানুষের কাছ থেকে ঢের মর্যাদাও পাওয়া যেত। মনে হয় এক-এক সময়ে এই সব। কিন্তু মফস্বলের বার-লাইব্রেরীগুলোর দিকে তাকিয়ে….কলকাতার বড়ো-বড়ো এম.এ, ডি. এল. কী করে টাকা রোজগারের বাপারে জেলা শহরের কমিটি পাশ পি. এল-এর কাছে হেরে যাচ্ছে কোথাও কোথাও-দেখে-শুনে মনে-মনে মাঝে-মাঝে হাসে—অহঙ্কারে নয়, আত্মসৌকর্যে নয়, কিন্তু নিজের ক্ষমতার খবৰ্তা হাড়ে-হাড়ে অনুভব করে। মাল্যবান বুঝতে পেরেছে যে-কাজ সে করছে এর চেয়ে খুব বেশি ভালো-কিছু কোনোদিনই সে করতে পারত না; হয়তো নিমকির দারোগা হত কিংবা সুপারিনটেন্ডেন্ট, গভর্ণমেন্টের চাকরির ছকে পড়ে গেলে একেবারে সবচেয়ে বড়ো কেরানীসাহেবও যে সে হতে পারত তা নয়; টাকার দিক দিয়ে খানিকটা লাভ হত বটে, টাকা সে চায়ও, খুবই চায়, কিন্তু আরো অনেক জিনিস চেয়েছিল সে: বিদ্যা সবচেয়ে আগে: অনেক দূর পর্যন্ত লেখাপড়া করবার সাধ ছিল, অনেক জিনিস শিখতে ইচ্ছা, বুঝতে ইচ্ছা; নিজের মনটা যে নেহাৎ কোরানীর ডেস্কে-আঁটা নিখেট, নিরেস কিছু নয়, মানুষকে সেটা বোঝাবার ইচ্ছা। নানা রকম ইচ্ছা—মনে অনেক রকম ভালো সুশৃঙ্খল কাটকাঠামের কথা জেগে ওঠে যে তার, মানুষকে সে তা জানাতে চায়; এক-এক সময় মনে হয় অফিসের কাজ ছেড়ে নিজের জীবনটাকে সে কোনো মহৎ কাজের ফেনশীর্ষে-ধরো কোনো উত্তেজনাময় কর্মিসংঘের মধ্যে নিয়ে ফেলুক; জীবনটাকে এ-রকম অফিসে চেপে সাপটে মেরে লাভ কী? টাকা পারিবারিক সচ্ছলতা—এগুলোকে এমন ঘাসের বিচি, ধুন্দুলের বিচি, রামকাপাসের আঁটি বলে মনে হয় এক-এক সময়! স্টিক হাতে নিয়ে গোল দীঘিতে ঘুরতে ঘুরতে মনে হয় একটা বড়ো বাজপেয়ে সভায় বেশ মার্জিত ভঙ্গিতে আবেগের বিরাট অকুলপাথারে নিজেকে আশ্চর্যভাবে নিয়ন্ত্রিত করে বক্তৃতা দেবার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তার: পোলিটিকসে বাঙালীরা আজকাল গুজরাট মারাঠি ইউ-পিওলাদের কাছে পদেপদে ভুডু খেয়ে ফিরছে—ভাবতে ভাবতে রক্ত কেমন যেন হয়ে ওঠে তার, বাঙালীর মান। সম্মান ফিরিয়ে আনবার জন্য বড়ো নয়াল আগুনের মতো দাউদাউ করে উঠতে ইচ্ছা করে তার বিপ্লবের থেকে বিপ্লবে—ফ্রান্স রুশ স্পেন চীন সমস্ত বিপ্লবেরইয়ে—স্তনাগ্রচুড়ায় নতুন দুগ্ধের উল্লাসে নবীন পৃথিবীর জন্যে। ভাবতে ভাবতে বাঙালীর কথা ভুলে যায় সে। অনেকক্ষণ পরে মাল্যবানের মাথা ঠাণ্ডা হয়; গোলদীঘির একটা বেঞ্চিতে ধীরে-ধীরে চুপ করে গিয়ে বসে সে তখন; একটা বিড়ি জ্বালায়। ক্ষিধে পেয়ে ওঠে, বাড়ির দিকে রওনা হয়।

একটা কথা ঠিক : মাটি নিচে গেঁড় আর কন্দ খাওয়া শুয়োরের মতো (আপার গ্রেডের) অফিসগিরিই তার সব নয়; এক জোড়া রেশমী স্টকিঙ, বার্ণিশকরা নিউকাট, তসরের কোট, পরিপাটি টেরি, সিগারেটকেস ও ফুটবলগ্রাউণ্ডের বেঞ্চি দিয়ে নিজেকে চোখঠার দিতে সে ভালোবাসে না। এই সবের চেয়ে সে আলাদা।

খবরের কাগজ সে রোজই পড়ে; কিন্তু স্পোর্টস রেস রাহাজানির দিকে একটু বেশি ঝুঁকে পক্ষে নয়; কোথাকার অন্তঃপুরে, আদালত কী রকম হাঁড়ি ভাঙল, বায়োস্কোপে কি থিয়েটারে কী আছে–এসব সম্বন্ধে কোনো আগ্রহ বা আস্বাদ এ বেয়াল্লিশ বছরে মধ্যে এখনও সে তৈরি করে নিতে পারেনি। খবরের কাগজে তবুও সে আশাতীত প্রয়োজনীয় নানা জিনিস খুঁজে পায়। অফিসের থেকে ফিরে চুরুট জ্বালিয়ে অনেকক্ষণ সে খবরের কাগজ নিয়ে বসে থাকে; একে একে মনের ভেতর নানা রকম সাধ-সংকল্প খেলা করে যায়; ভেঙে চুরমার হয়। তারপর অবসন্ন হয়ে পেপারটা সে রেখে দেয়; মনে থাকে না বিশেষ কিছু : কোনো কিছু সত্যিই শিখেছে বলে উপলব্ধি করতে পারে না। বিছানায় শুয়েশুয়ে ভাবে নিজে সে অবিশ্যি পার্নেল বা চিত্তরঞ্জন হতে পারবে না—কোনোদিনও না—কোনো প্রক্রিয়ায়ও না—কিন্তু পার্নেল বা চিত্তরঞ্জন বাঙালীর মধ্যে আজকালই যদি না জন্মায় তাহলে এ-জাতের ভরসা খুব কম। উনিশ-শো-ঊনত্রিশ সালের একটা রাত্তির শুয়েশুয়ে এই সব কথা ভাবছিল যখন মাল্যবান; সেই জন্যই সে এই রকম ভাবছিল।

ঘড়িতে প্রায় সাড়ে তিনটে বাজল মাল্যবান দেখল বিছানায় চিৎ কাৎ হয়ে ভেবেই চলেছে ক্রমাগত; এত ভাবায় হৃদয় শুকিয়ে যায় শুধু, কোনো তীরতট পাওয়া যায় না, আসে না চোখে এক পলক ঘুম। আস্তে আস্তে সে উঠে বসল; বিছানায় ছারপোকা আছে—কিন্তু ঘুমের ব্যাঘাত ছারপোকার জন্য নয়; এর চেয়ে ঢের বেশি আরশোলা ইদুর মশা পিসুর ঘাঁটিতে লম্বা নির্বিবাদ চৌকশ ঘুমে কত রাত কাটিয়ে দিয়েছে। রাস্তার একটা গ্যাস ল্যাম্পের আলো ঘরে ছিটকে পড়েছিল খানিকটা; স্লিপার খুঁজে নেওয়া গেল, পায়ে দিয়ে লাল-নীল-চেককাটা কম্বলে সমস্ত শরীরটা মুড়ে সে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় গিয়ে উঠল—নিঃশব্দে খানিকটা এগিয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখল নেটের মশারীর ভেতর মনু ও পলা কেমন নিশ্চিন্ত ভাবে ঘুমুচ্ছে—কেমন শান্ত প্রীত নিঃশ্বাস তাদের। একটা ভারি নিঃশ্বাস প্রাণের ভেতর প্রচুর চুম্বনে টেনে নিল সে; সমস্ত শরীরকে আস্বাদস্নিগ্ধ করে আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগল সে; ভালো লাগল তার। ভালোই লাগল তার ঘুমন্তদের দিকে তাকিয়ে : স্ত্রী সন্তানকে সচ্ছলতায় রাখা, তাদের জীবনে খানিকটা সুখ সুবিধে শান্তির ব্যবস্থা করা-মাঝারি জীবনের এ উদ্দেশ্য এ শীত রাত মাল্যবান সিদ্ধ দেখছে বলে। নিজের ঘুম হচ্ছিল না তার—এরাই বা এই শীতের মধ্যে কী করছে ঘুমিয়ে? জেগে? দেখবার জন্যই সে ওপরে এসেছিল। দেখা হল। মাল্যবান সুস্বাদ পেল, কেমন স্নিগ্ধ শারীরিক মনে হল তার রাত্রিটাকে, রাত্রির এই নিঝের সময়টাকে। এখন নীচের ঘরে যেতে হয়। কিন্তু তবুও মাল্যবান গেল না সহসা। মশারীর খুঁট তুলে এদের খাটের পাশে দাড়াগাঁর পউষরাতের নিশ্ৰুপ ডানার পাখির মতো এসে স্নিগ্ধ নৈঃশব্দে—এদের জাগিয়ে?—বসে থাকতে চায়। কিংবা বসবেও না মনুর কপালে আলতো হাত বুলিয়ে দেবে-কম্বলটা স্ত্রীর বুক থেকে সরে গেছে, তুলে গুছিয়ে দেবে আলতো। তারপর নিজের ঘরে চলে যাবে সে।

কিন্তু নেটের মশারী তুলতেই ব্যাপারটা হল অন্যরকম। উৎপলা জেগে উঠে প্রথম খুব খানিকটা ভয় খেলে; তারপর বিছানার ওপর উঠে বসে তার সমস্ত সুন্দর মুখের বিপর্যয়ে—মুহূর্তেই সে ভাবটা কাটিয়ে উঠে মরা নদীর বালির চেয়েও বেশি বিরসতায় বললে, তুমি!

এসেছিলাম।

এ সময় তোমাকে কে আসতে বললে।

দেখতে এলাম, তোমরা কী করছ।

যাও, তোমার মেয়ে নিয়ে যাও, কাল থেকে এ আমার সঙ্গে আর শোবে না। মেয়েটার দাবনা ঘেঁষে, বাপ রে, একটা ডান যেন।

কে আমি? মাল্যবান দাঁড়িয়ে থেকে বললে। খাটে বসল না, একটা কৌচে বসে বললে, না, মেয়েটিকে শুধু দেখতে আসিনি, আমি—

আ, গেল যা! বসলে! রাত দুপুরে ন্যাকড়া করতে এল গায়েন। হাত পা পেটে সেঁধিয়ে কম্বল জড়িয়ে এ কোন ঢঙের বলির কুমড়ো সেজে বসেছে দেখ। ও মা! ও মা! বেরোও! বেরোও বলছি!

তুমি ঘুমুচ্ছিলে—তোমার ঘুম ভাঙাতে আসিনি তো আমি—

বলি, বলির কুমড়ো, দুফাঁক হবে, না এখানে থাকবে?

ঘুমোচ্ছিলে, ঘুমোও।

ঘুমোচ্ছিলে, ঘুমোও! আর, গোঁসাইয়ের কুমড়ো–

কেন, কুমড়ো-কুমড়ো করছ, উৎপলা—

এখানে বসে থাকা চলবে না এখন।

আমি একটু বসে আছি,–তোমার ঘুমের ব্যাঘাত হবে না। আমি এই কৌচে বসে আছি; মনু ঘুমুচ্ছে; ঘুমিয়ে পড়।

উৎপলা গলাটা পরিষ্কার করে নিল; একটানা ছঘণ্টা ঘুমিয়ে বেশ সজীব সুস্বাদ হয়েছে শরীর; সরস কঠিন গলায় বললে, দরমুজ নিয়ে ইদুর মেরে ফেলেছি সব আমার ঘরের। তবুও যদি এক-আধটা থাকে জার্মান কল পেতে রেখেছি। ও-সব চালাকি চলবে না। ঘুম বড়ো বালাই আমার। ভালো চাও তো নিচে চলে যাও।

মাল্যবান চুপ করে বসেছিল। সে চলে গেছে না কৌচে বসে আছে সে-দিকে না তাকিয়ে অন্ধকারে কিছু না বুঝতে পেরে উৎপলা বললে, ইশ, একেবারে ঘুম ভাঙতেই চেয়ে দেখি মস্ত বড়ো একটা ড্যাকরা মিনসে কম্বল জড়িয়ে খাটের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সমস্ত বুকের রক্ত ঝিম ঝিম ঝাকর-ঝিম করে উঠল আমার।

কিন্তু দেখলে তো, আমি দাঁড়িয়ে আছি।

এ-রকম ভাবে ফের যদি আমাকে ভয় দেখাতে আস—

ভয় দেখাতে তো আমি আসিনি, উৎ–

না, এসেছেন রূপ দেখাতে। ফের আমার ঘরের ভেতর ঢুকেছ কি রাত বিরেতে—দাঁতের ওপর দাঁত চেপে কেমন একটা অদ্ভুত নিরেট নিগ্রহময়তায় বললে উৎপলা।

মাল্যবান শীতের রাতে নিঃশব্দতা ও অতিদীর্ঘতা, যে-দীর্ঘতা নিঃশব্দতা, যে নিঃশব্দতা স্নিগ্ধতা (হতে পারত; কতবার পাড়াগাঁর রাতে হয়েছিল) সে-সব সুর কেটে যাচ্ছে উপলব্ধি করে, উৎপলা যে গুমোটের সৃষ্টি করেছে সেটাকে হাল্কা করে দেবার জন্য সরু গোঁফে তা দিয়ে একটু হেসে বললে, রাত বিরেতে ওপরে চলে এলে উচ্চিংড়ের কাবাব বানিয়ে দেবে নাকি আমাকে, পলা! বলে নিজেই হাসল মাল্যবান; হাসিটা এক বগগা টের পেয়ে থেমে গেল; খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে শেষে বললে, আমি আজ এসেছিলাম—আমার আজ কেমন ঘুম চটে গেল—আমার আজ ঘুম হচ্ছিল না কিনা—

ঘুম হচ্ছে না বলে পরের ঘুমের নিকুচি করতে হবে?

তা নয়।

তবে আবার কী।

আমি এসেছিলাম— মাল্যবান মাথা হেঁট করে খতিয়ে কী বলবে,অনায়াসে সেটা স্থির করতে না পেরে কিছু বলতে গেল না আর।

উৎপলা বললে, এই যে আমার ঘুমটুকু নষ্ট করে গেলে এর ঝক্কি পোয়াতে আমি বেলা আটটা-নটার আগে উঠতে পারব না।

তা উঠো। যখন ঘুম পোষাবে তখন উঠবে, এর আর কি কথা।

কাল সমস্তটা দিন মাথা ধরে থাকবে।

সকালে উঠে গরম-গরম চা খেয়ো।

চা খেলেই ধরা সেরে যায়? এমন বেকুব!

তোমার তো স্মেলিং সল্ট আর মনেথল রয়েছে—

তাইতেই মাথা ধরা সারে! হুঁ! ঘানিগাছে ঘুরতে ঘুরতে মুখ ফাঁক করে বলেছে বুঝি জয়নাথের বলদটা?

উৎপলার গায়ের ঝালে মশারীর ভেতরটা বেশ গরম হয়ে আছে, খড়ের উমের ভেতর যেন শুয়ে আছে মনু আর পলা; মানুষ না হয়ে সে যদি সারস হত তাহলে কৌচে না বসে কোন যুগে ওদের ঐ নীড়ে জাপটে বসে থাকত সে; ভাবছিল মাল্যবান।

এক-আধটা এ্যাসপিরিন খেয়ো; কিন্তু ওগুলো বিষ ভালো জিনিস নয়, না খেলেই ভালো।

এই যে ঠাণ্ডা লাগল আমার তরাসে যাতে জেগে উঠে, কতগুলো ন্যাকড়া ছিড়ে ছোটো ছোটো সলভের মতো পাকিয়ে নাকের ভেতর সেঁধিয়ে হাঁচতে হবে; কাল সমস্তটা দিন এই আমার কাজ; ভাবতে গেলেও মনটা খিচড়ে যায়; ছোঃ!

মাল্যবান কৌচের থেকে উঠে এসে খাটের পাশে ভাঙা হাতলের হাল্কা চেয়ারটা টেনে চুপ করে বসল গিয়ে।

অ্যাসপিরিনের কৌচের থেকে উঠে এসে খাটের পাশে ভাঙা হাতলের হাল্কা চেয়ারটা টেনে চুপ করে বসল গিয়ে।

অ্যাসপিরিনের শিশিটাও তো ফুরিয়ে গেছে, একটা পিলও যদি থাকে—

কাল এক ফাইল কিনে আনতে হবে।

কাল সকালে চা আমাকে করে দিতে হবে।

করে দেব।

তিন চার কাপ চা লাগবে আমার।

গরম গরম চা সর্দি মাথাধরার বেশ কাজ করে।

হ্যাঁ, সর্দি জমেই তো এই মাথাধরা।

এখনই ধরল?

না, তত ধরেনি; তবে ভোরের বেলা হবে, খোয়া পাথরের ওপর হাতুড়ি পেটাচ্ছে যেন ঝগড়ুর বৌ—সেই কালো হয়ে লম্বা হয়ে সোমথ মাগীটা। বাবা রে! আড়ামোড়া ভাঙতে ভাঙতে আশ্চর্য আরাম বোধ করে আক্ষেপে চেঁচিয়ে-মেচিয়ে উঠে উৎপলা বললে, হাতুড়ি পেষাবে মাথার ভেতর, এই হয়ে এল আর কী। আমি বিছানার থেকে উঠতে পারব না। তুমি চা এনে আমার খাটের পাশে রেখে দিয়ে তো বাপু।

মনু কি ঘুমিয়ে আছে?

ঘুমিয়ে আছে ওর ঠাকুরের থানে।

তার মানে?

ঠাকুরের থানে দশায় পড়ে আছে।

জেগে আছে? মাল্যবান বললে, ভাকব মনুকে? কিন্তু মনুকে ডেকে দেখবার কোনো চেষ্টা না করে মাল্যবান বললে, আজ সারারাত ঘুমের টিপই এল না আমার চোখে; কেমন যেন হয়ে গেল; এক ফোঁটা ঘুম হল না।

কাল তোমার কটার সময় অফিস?

সাড়ে দশটায়।

আমি তো উঠব খুব দেরি করে : হয়তো আটটা-নটা; তখন আমাকে চা করে দিতে পারবে?

ঠাকুর দেবে। আমি দেব না হয়।

উৎপলা সমস্ত শরীরে লেপ মুড়ি দিয়ে বালিশে মাথা পেতে বললে, নাও, মশারীটা গুঁজে দাও তো মনুর পায়ের দিকে।

মশা তো নেই, মশারী টাঙাবার এক বাতিক তোমার।

মশা নেই, ইঁদুর আছে, মশারী না গুঁজলে পা কেটে খেয়ে যাবে।

মশারী ঠিক করে দিয়ে মাল্যবান চেয়ার থেকে উঠে দূরে একটা ময়লা তেলচিটে সোফায় গিয়ে বসল। উৎপলা বালিশে মাথা গুঁজে হাত পা খিচিয়ে আলসেমি ঝেড়ে হাই তুলল, তুড়ি দিল, লেপটা ভালো করে জড়িয়ে নিল সর্বাঙ্গে। তারপর মাল্যবানের দিকে আন্দাজি নজরে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললে, বসলে? বসলে যে বড়ো?

কী করব?

যাও—নীচে যাও।

সেখানে গিয়ে কী হবে?

এরকম কতক্ষণ বসে থাকবে শুনি—

তোমার সঙ্গে কথাবার্তা বলব—

দাঁতে ঠেকে যাবে জিভ বেশি কথা বলতে গেলে। দাঁতকপাটি হয়ে যাবে। দাঁতে চামচ ঢুকিয়ে চাড় দিয়ে-পেঁকির পাড় দিয়েও খুলতে পারা যাবে না আর—নাও,সুড় সুড় করে সরে পড় দিকিনি–উৎপলা পাশ ফিরে শুল।

মাল্যবান বসে রইল কনকনে ভিজে শীতে কেমন ন্যাতাজোবরার মতো। কাজ নেই, কথা নেই, চোখ বোজা নেই, নড়াচড়া নেই; কোনো কথা সে ভাবছিল বলে মনেও হচ্ছিল না।

কী রকম মানুষ তুমি!

বসে তো রয়েছি শুধু।

এতে আমার ঢের অস্বস্তি।

কী করতে হবে তাহলে?

চলে যাও।

ঘুমোবে এখন?

মুখে নুড়ো ঠেলে দেব আমি বেহায়া মড়াদের! ঘুমোবে? ঘুমোবে? রাত তিনটের সময়—কেঁদে ফেলল হয়তো উৎপলা। কিন্তু তবুও সে তো বালিকা বধু নয়—প্রায় তিরিশ পেরিয়ে গেছে। মাল্যবান একটা দমে যাওয়া নিঃশ্বাস ফেলে বললে, যা–ই।

একটু পরে ফিরে তাকিয়ে চড় খেয়ে সেঁটে চড়িয়ে দেবার মতো গলায় উৎপলা বললে, তবুও বসে রইলে!

কৈ, তোমার চোখেও তো ঘুম নেই আর।

তোমার জিভে আছে; নিচে নেমে যাও শীগগির; যাও—নামো—

যাচ্ছি, কিন্তু রাত তো ফুরিয়ে গিয়েছিল প্রায়।

উৎপলা বিছানার ওপর উঠে বসল। এবার সে কথা বলবে না আর, একটা বিষম-কিছু করে বসবে মনে হল। কিন্তু মাল্যবান নিজের ভেতরে ঢুকে পড়েছিল; উত্তরপক্ষ কী করছে না করছে দেখল না সে, চোখেই পড়ল না তার কিছু। বললে মাল্যবান, কাল বিশে অঘ্রাণ গেল; ঠিক এই অঘ্রাণ মাসের বিশ তারিখে আমার জন্ম হয়েছিল। তোমাকে হয়তো এক-আধবার বলেছি—মনে আছে তোমার? নিজেরি বলি কিছু মনে থাকে না। এই দিনটায় ঢের ভাববার কথা ছিল; বেয়াল্লিশটা বছর চলে গেল জীবনে। সুবাতাস আর কুবাতাসের কত কাটাকাটি হল। কাটাকাটি এখনও চলছে চলবে যে পর্যন্ত না মাটিতে মাথা রাখি। কিন্তু লালকমল নীলকমল কালোবাতাস সাদাবাতাস মনপবন আর চাঁদের বুড়ি মিলে কেমন যেন অপার্থিব করে তুলেছে জীবনটাকে। আমি মাটির মানুষ তো—মাটি ছাড়া টাল সামলতে পারব না–হাওয়ার চেয়ে সোনার শরীর ভালো, তার চেয়ে মাটির শরীর; চালে গুড়ে, নারকোলের ঝঝে, কপ্পূরে ফোঁপড়ায় নবান্নের গন্ধে নবান্নের মতো। তুমি আর আমি; তোমার কাছে এসেছি তাই। বসেছি তাই। দাও, দেবে না?

একেবারেই দিতে যে না পারে উৎপলা তাও নয়, দিয়েছে মাঝে মাঝে, গোড়ার দিকে খুব মন মজিয়েও দিয়েছে বটে, কিন্তু তারপরে টান কমে গেছে, খুব বেশি কমে গেছে—দুদিক থেকে সমান অনুপাতে যদিও নয়;-উৎপলা জানে সব; মাল্যবানও জানে দাম্পত্যজীবনের অনেকগুলো দিক না হলেও চলে আজ উৎপলার, শাড়ি গয়না খাওয়া-দাওয়া আরাম-বিরাম ফেলা-ছড়া বিলাস-স্বাধীনতা হলেই হল তার, মাল্যবানের কিন্তু কোনো কোনো বিশেষ দিক এখনও চাই-ই যেন, অনেক দিনের ভেতরে এক-আধ দিন অন্তত চাই, মাটির দিকটাই চাই, সোনার দিকটাও নয়, মাটিই চাই, কিন্তু নিজের সোনার ঝিলিক মাঝে-মাঝে মাল্যবানকে দেখালেও গত পাঁচ ছয় বছর ধরে মাটির সঙ্গে কোনো যোগ নেই উৎপলার—সে তো আকাশের মেঘ জলভরানত নীল মেঘ নয়—সাদা কড়কড়ে মেঘ-দূরতম আকাশের।

উৎপলা চুলের সিথি অব্দি লেপ টেনে শুয়ে পড়ল। মাথায় রক্ত উঠেছিল তার, কিন্তু মাথাটা ঠাণ্ডা রাখতে হবে—ঘুমোতে হবে। নায়েব গোমস্তা চাকর বাকর রাক্ষস খোক্ষস লালকমল নীলকমল ভ্যাক-ভ্যাক করেছে—তার ভেতর সে ঘুমিয়ে পড়েছে—এরকম ব্যাপার কতবার তো ঘটেছে তার জীবনে। আজো ঘুমোতে হবে।

আজ বিশে অঘ্রাণ, মাল্যবান বললে, পিতৃলোক মাতৃগণ মিলে জন্ম তো দিলেন; ঢের ভালো ব্যবহার হতে তো পারে জীবনের; তা হয়েছে? হয়নি? হবে? বোঝা কঠিন; মাঝে-মাঝে তুচ্ছ বেনে-বৌ পাখির চেয়েও বেশি বনেতি বলে মনে হয় সব; খাচ্ছি দাচ্ছি সংসারের বেনেগিরি করছি। আছে অনেক ফাঁক, আলো, নানা রকম বড়ো আকাশ ঘাস ও-সব পাখিদেরও; কিন্তু সালতামামি আর সালপাহলির গোলকধাঁধা ছাড়া কিছু কি আছে মানুষের?….এই সব, আরো অনেক সব বলতে চাইল মাল্যবান; কিন্তু বলাটা তার না হল সাহিত্যের ভাষা না হল নিজেদের মুখের ভাষা; মানুষের জল রক্ত অশ্রু ঘামের মধুসুধার ভাষা তো এরকম নয়। মাল্যবান টের পেল। এবারে সে না সাজিয়ে গুছিয়ে একেবারে রক্ত ঘাম সুধা স্বাভাবিক প্রাণের ভাষায় কথা বলবে। কিছুক্ষণ দেঁতো কথা ছেঁদো কথার পর সত্যিই যখন বারোয়ারী,বাজার বাসরঘরের কথা মুখে এল তার, নাক ডাকার শব্দ শুনে মাল্যবান টের পেল উৎপলাকে নিয়ে তার চলবে না কিছুতেই, তবুও চালাতে হবে মৃত্যু পর্যন্তই। বাংলাদেশের শতকরা নব্বই জন স্বামী-স্ত্রীর জীবনেই এই নিস্ফলতা, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই স্বামী-স্ত্রীরাই সেটা ঠিক মাল্যবানের মতো উপলব্ধি করতে পারে না; যেসব স্ত্রী-স্বামীরা সেটা করে, একটা ভাঙা গেলাসের কাচগুলোকে জড়ো করে জোড়াতাড়া দিয়ে প্রত্যেকবারই জল খেতে হয় তাদের : নারী-পুরুষের সম্বন্ধ স্বামী-স্ত্রী ব্যাপার বিয়ে জিনিসটা শ্রেষ্ঠ কারিগরের কাচের গেলাসের মতো সহজ ও কঠিন; ভাঙবেই; জল খেতে হবেই; একটার বেশি গেলাস কাউকে দেওয়া হবে না; সে যদি তা জোর করে বা চুরি করে নেয় সেটা অসামাজিকতা হল। দর্শনী বিজ্ঞানীরা মাথা ঘামিয়ে বিয়ে রদ, বিয়ে খণ্ডন করে আবার বিয়ে, যদৃচ্ছা বিয়ে করবার কথা পেড়ে যাচ্ছেন বটে, কিন্তু টাকাওয়ালা জাতিগুলোর টাকাওয়ালা মানুষদের সম্পর্কে এ-সব সমাধানের কিছু কিছু মানে থাকলেও বেশি কোনো মানে নেই, মাল্যবানদের মতো গরীবজাতির গরীবদের পক্ষে কোনো মানেই নেই কেবলি বিয়ে-খণ্ডন ও যদৃচ্ছা বিয়ের। গরীব জাতিদের সমাজগুলো মজন্তালি সরকারের মতো হেসে পেট ফাটিয়েই মরে যাবে কেবলি বিয়ে খসিয়ে নতুন বিয়ে-সম্পর্কের ভেতর মানুষকে ঢুকে পড়তে দেখলে, কিংবা বিবাহসম্পর্ক তুলে দিয়ে মেয়েপুরুষের স্বাধীন সেয়ানা মেলামেশায় রাষ্ট্রকে হিতার্থী বিজ্ঞানধর্মী পরিচালক হিসেবে ঘুরে বেড়াতে দেখলে। সেয়ানা স্বাধীন মেলমেশার অন্ত খুঁজে পাবে কি বিজ্ঞান—আকাশের তারা পাতালের বালি যদিও গুণে ঠিক করেছে বিজ্ঞান। সেয়ানা স্বাধীন মেলামেশার কল্যাণের অন্ত খুঁজে পাবে হিতার্থ বিজ্ঞানী রাষ্ট্র? কোনোদিনও না। কিন্তু সেরকম হিতার্থ বিজ্ঞানী রাষ্ট্রই বা আসছে কোথায়? কোনো দিকেই না। খুব। একটা গরীব জাতের গরীব মানুষ মাল্যবান। তার চেয়ে ঢের দুঃস্থ নিষ্পেষিত মানুষ আছে; তাদের অবস্থা আরো ঢের খারাপ—কিন্তু তাদের পেটের সমস্যা এ-স সমস্যাকে অনেকটা চেপে রেখেছে; এ-সব সমস্যার সমাধানেও তাদের সেই বেপরোয়া বা মরিয়া বা সাহসিক স্বচ্ছলতা আছে—যেমন অন্য এক হিসেবে উঁচু শ্রেণীর ভেতরে আছে। কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে মাল্যবানের মতো মধ্যশ্রেণীর মানুষদের নিয়ে। মাল্যবান কি নিম্নমধ্যশ্রেণীর—না, মধ্যমধ্যশ্রেণীর? খুব সম্ভব নিম্নমধ্য বিভাগের লোক সে। কিন্তু সমস্যাটা সমস্ত মধ্য শ্রোণীতে কেমন দুর্বিসহভাবে পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে, অথচ বাঙালী মধ্যশ্রেণীরা অন্তত ভাতকাপড় পেলে কেমন সুখে শান্তিতে ঘরকন্না করতে পারে দেখবার জিনিস। স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধ তো দূরের কথা—স্ত্রী-পুরুষের সম্বন্ধ সম্পর্কেও সৃষ্টির কারণকরণশালিকার ভেতর কোনো সুখশান্তির নির্দেশ নেই তো। কিন্তু বাঙালী স্বামী-স্ত্রীদের প্রেম ও যৌন জীবনে সুখ আছে, শান্তি আছে শতকরা একশো জনেরই তো : ভাবছিল মাল্যবান একটু বিষণ্ণ শ্লেষে হেসে উঠে। উৎপলা শীত রাতের কী এক পরমত্বের ভেতর ডুবে গিয়ে নাক ডাকাচ্ছে—মাল্যবানকে কেমন সহজ দিব্যােয় বিদায় দিয়ে, অথচ মাল্যবানকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, রুচির বিরুদ্ধে অপ্রেমে, কামনার টানে, বেশি লালসায় রিরংসায় উৎপলার মতন একজন ভালো বংশের সুন্দর শরীরের নিচু কাণ্ডজ্ঞানের নিরেস মেয়েমানুষের কাছে ঘুরে-ফিরে আসতে হবে নিজের মৃত্যু পর্যন্ত কী নিদারুণ ভাবে, কেমন অধমের মতো, কেমন হাতে পায়ে ধরে মেয়েটির কখনো-বা ঘরের শান্তি কখনো-বা বাইরের সুনাম রক্ষা করবার জন্যে, কখনো-বা লালসা অতিকিচিৎ প্রণয় এসে উৎপলার দিকে মাল্যবানকে হিঁচড়ে টানছে বলে।

আকাশে অনেক তারা, বাইরে অনেক শীত, ঘরের ভেতর প্রচুর নিঃশব্দতা, সময়ের কালো শেরওয়ানীর গন্ধের মতো অন্ধকার; বাইরে শিশির পড়ার শব্দ, না কি সময় বয়ে যাচ্ছে; কোথাও বালুঘড়ি নেই, সেই বালুঘড়ির ঝিরিঝিরি শিরি-শিরি ঝিরিঝিরি শব্দ : উৎপলার ঠাণ্ডা সমুদ্রশঙ্খের মতো কান থেকে ঠিকরে–মাল্যবানের অন্তরাত্মায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *